কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

উত্তরাধিকার রহস্য 

উত্তরাধিকার রহস্য রহস্য গল্প – বর্ণালী বসু

প্রতিবারে মত এবারেও বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা চলছিল দুই বোনের। আশা বলছে, “এবার পাহাড় চল দিদি। চল রামধুরা যাই । আমার বন্ধুরা ঘুরে এসেছে, ফটো দিয়েছিল।কি সুন্দর জায়গা রে দিদি কি বলব তোকে। বিপাশা বল্ল, ” নানা গতবার তোর পাল্লায় পড়ে সিকিম গিয়েছিলাম। কি ঠান্ডা বাপরে! আমি নেই ! চল কোনো ঐতিহাসিক জায়গায় যাই।” আশা কিছু বলতে গিয়েছিলো, কিন্তু বলা আর হলো না কারন বিপাশার ফোনটা ক্যানক্যানে সুরে বেজে উঠেছে।

“হ্যালো…কে?… ও হ্যা বল…… বাবা কতোদিন পর………হ্যা বল…… আচ্ছা…আচ্ছা…… হ্যা হ্যা…… অবশ্যই। তেইশে ডিসেম্বর তো?ঠিক আছে আমরা বাইশে ট্রেনে চাপছি।আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে।” বিপাশা ফোন রেখে আশার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসি হেসে বল্ল,”হলো? নো পাহাড়,এবার সমতল”

রনিতার দাদু ছিলেন বিশাল এক জমিদার ,মধ্যপ্রদেশে ওদের এস্টেট‌ সেখানেই রনিতার জন্মদিনের নিমন্ত্রন। ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফর্মের বাইরে আসতেই দেখা গেল একজন স্যুটেট ভদ্রলোক হাতে বোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে, যাতে লেখা , “বিপাশা সেন এন্ড সিস্টার”। ওরা এগিয়ে যেতেই ভদ্রলোক শশব্যস্ত হয়ে উর্দিধারি ড্রাইভার কে ইশারা করলেন লাগেজ তুলতে।

রনিতা গাড়িবারান্দার সামনেই অপেক্ষা করছিল। গাড়ি বিশাল ফটক পেড়িয়ে গিয়ে দাঁড়ালো গাড়ি বারান্দার নীচে। বিপাশা আর আশা গাড়ি থেকে নামতেই রনিতা বল্ল চল আমাদের বাগান আর হাভেলীর চারপাশটা ঘুরিয়ে দেখাই।তারপর পিছনে দঁড়িয়ে থাকা চাকর কে বল্ল,লাগেজ নিয়ে গেস্ট্রুমে রাখতে আর কিচেনে খবর দিতে গেস্টরা এসে গেছে,হেভী ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে। গাড়ি বারান্দা ছাড়িয়ে বাকী বেশ খানিকটা জায়গা সাদা নুড়ি ছড়ানো। 

রনিতা হাঁটতে হাঁটতে বল্ল, “ভিতরে কথা বলা যাবেনা তাই বাইরে নিয়ে এলাম”

বিপাশা জিজ্ঞেস করলো,” কেন কিছু হয়েছে নাকি !”

রনিতা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বল্ল, “আমার সন্দেহ হচ্ছে আমি খুন হতে পারি।”

“সেকি !!” বিপাশা আর আশার মুখ থেকে একসাথেই বেড়োলো কথাটা।

“হুম পুরো ব্যাপারটা খুলেই বলছি তোদের বুঝতে সুবিধা হবে……………আমার প্রপিতামহ থেকেই শুরু করছি।আমার পিতামত,প্রপিতামহের একমাত্র ছেলে ছিলেন। প্রপিতামহ খুব ছোটবেলাতেই পিতামহের বিয়ে দিয়ে দেন এক রাজকুমারির সাথে,তার ছেলে হলো আমার বাবা,বাবার একমাত্র মেয়ে আমি।পরে পিতামহ নিজের ইচ্ছায় একজনকে বিয়ে করেন।তিনি কোনো রাজ বংশের মেয়ে ছিলেন না, তাই আমার প্রপিতামহ তাকে পছন্দ করতেন না।তার ছেলে হলেন আমার কাকা রথীন্দ্রনাথ,আর কাকার ছেলে হলো রনজয়।রনজয় আমার থেকে তিনমাসের ছোট। খুব ‘গুনী’ ছেলে,রেসের মাঠে নিত্য যাওয়া আসা আছে ,শুনেছি বাজারে প্রচুর দেনাও আছে।সব থেকে বড় কথা হলো, এক মহিলাকে বিয়ে করেছে যে এসকর্ট সারভিস দেয়, কোনো এক হোটেলের বাধাধরা।আমি যখন এখানে ছিলাম না তখন বার দুয়েক এসেছিলো আমার পিতামহ তার পরিচয় এবং পেশা জানতে পেরে তাড়িয়ে দেয়।আমার পিতামহ ওনার প্রথম স্ত্রীকে খুব রেস্পেক্ট করতেন যেহেতু উনি রাজকুমারী ছিলেন এবং এই এস্টেটের রানি ছিলেন।আর দ্বীতিয় স্ত্রীকে ভালোবাসতেন। এবার আসল কথায় আসি যার জন্য এতো অবতারনা।আমার পিতামহ প্রথমে একটা উইল করেন, যেখানে আমার দুই ঠাকুমা সমান সম্পত্তি পাবেন,কিকি পাবেন আর খুলে বললাম না।বড়রানির পর পাবে আমার বাবা তারপর আমি আর ছোটরানির পর পাবে কাকা রথীন্দ্রনাথ তারপর রনো। সেই উইলে আমার ঠাকুমা এবং রনজয়ের ঠাকুমা দুজনেরই সই ছিলো সাক্ষী হিসেবে।উইল যেদিন ফাইনালাইজ হয় সেদিন রাতে রনজয়ের ঠাকুমা ওনার ঘরের বারান্দা থেকে পড়ে মারা যান। চাকর দের মুখে শুনে ছিলাম আগের দিন রাতে নাকি কাকার সাথে ছোট ঠাকুমার খুব তর্ক বিতর্ক হয়েছিল।”

“এক মিনিট ” বিপাশার কথায় রনিতা থামলো, “কাকা কি এই উইলে খুশী ছিলেন না?”বিপাশা প্রশ্ন করলো

“না “রনিতা বল্ল, “পিতামত সম্পত্তি দুভাগে ভাগ করে ছিলেন দুই রানীর নামে।তার মধ্যে হাভেলী দিয়েছিলেন বড় রানীকে,সেটা কাকার পছন্দ ছিলো না। আমার ছোট ঠাকুমা খুব ভালো মানুষ ছিলেন বড় ঠাকুমার খুবই অনুগত,তাই সম্পত্তির যা ভাগ বাটোয়ারা হয়েছিল,উনি সহজ সরল মনেই মেনে নিয়েছিলেন।পিতামহ এমন ভাবে সম্পত্তি ভাগ করেছিলেন যে বড় রানির অংশ, বড় রানির পর বাবা পাবে তারপর আমি আর ছোটরানির অংশ ছোটরানির পর কাকা পাবেন তারপর রনজয়। পিতামহ রনজয়ের বিয়ের জন্য রাজ ঘরানার এক মেয়েকে ঠিক করলেন আর রনজয় ঐ এসকর্ট মেয়েটিকে বিয়ে করে নিয়ে চলে এলো।পিতামহ প্রচন্ড রেগে গিয়ে দ্বীতিয় উইল করলেন । সত্তর শতাংশ হলো বড় ঠাকুমার নামে আর তিরিশ শতাংশ হলো কাকার নামে।এই উইলের ঠিক তিনদিন বাদে বড় রানী সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা গেলেন।আমার বাবা আর মা বিদেশে থাকতেন। বাবা কোনদিনই সম্পত্তি নিয়ে এতো মাথা ঘামাতেন না।আমি ছিলাম ঠাকুমার তত্তাবধানে।তখন আমি কোলকাতায় পড়াশোনা করতাম, তোর সাথে।ঠাকুমা মারা যাবার পর দাদু বাবাকে ডেকে পাঠালেন আমাকে বিদেশে নিয়ে যাবার জন্য।বাবা মা যখন ভোপাল থেকে বাই রোড আসছিলেন তখন কার অ্যক্সিডেন্টে দুজনেই স্পট ডেড। এত গুলো ধাক্কা পিতামহ কি আর নিতে পারে! হলো হার্ট অ্যাটাক।” এই সময় রনিতা কে থামতে হলো। কারন খানসামা গাড়িবারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে বল্ল, “খানা পরোস দি গয়ি হ্যায়”।রনিতা ইশারায় বল্ল,আসছি।

রনিতা আবার শুরু করলো,”পিতামহের এরকম হবার পর থেকে আমি এখানেই ছিলাম।পিতামহ হসপিটাল থেকে ফেরার তিনদিনের মাথায় খাট থেকে পড়ে মারা যান। এমন ভাবে পড়েছিলেন যাতে মনে হচ্ছিল উনি জানলায় এমন কিছু দেখেছিলেন,যা দেখে উনি তার কাছে যেতে ছেয়েছিলেন।কিন্তু পারেন নি।এইঘটনার পর থেকে আমার মনে হচ্ছে এবার আমার টার্ন। তুই দ্যাখ একটা মৃত্যুও কিন্তু স্বাভাবিক নয়।” 

বিপাশা মন দিয়ে কথা গুলো শুনছিল।হঠাৎ এক দীর্ঘদেহী প্রৌঢ়কে এগিয়ে আসতে দেখলো।রনিতা চাপা গলায় বল্ল, কাকা। 

দূর থেকেই রথীন্দ্রনাথ গলা তুলে বললেন, “কি বন্ধু নাকি?কোলকাতা থেকে”।উনি সামনে আসতেই রনিতা আলাপ করে দিল।বিপাশা আশা প্রণাম করলো।

“বন্ধু কে ক’দিন রাখছ তো, নাকি? আমাদের এস্টেট টা ঘুরিয়ে দেখিও। রথীন্দ্রনাথ দাঁড়ালেন না।

 বিপাশা অন্যমনস্ক হয়ে গেল। আশা জানে দিদি যা শুনলো সেটা মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে।খাবার টেবিলে রথীন্দ্রনাথ ছিলো না, জানাগেল উনি বেড়িয়েছেন ফিরতে বিকেল হবে।সম্ভবতঃ ছেলেকে নিয়ে ফিরবেন। বিপাশা রনিতা কে জিজ্ঞেস করলো, ” আচ্ছা উইল টা এখন কি তোদের উকিলের কাছে?”

রনিতা বল্ল “ওরে ব্বাবা সেতো আর এক ঘটনা। পিতামত গত হবার পর উকিল কাকা নায়েব কাকা কে ফোন করে বললেন যে উইলটা পিতামহ গত হবার একদিন আগে এনেছিলেন কিসব রদবদল করতে।কিন্তু পিতামহর দেরাজে সেটা পাওয়া যায়নি। নায়েব কাকা পিতামহর গোপন কুঠুরি খুলেও সেটা পাননি।উকিল কাকা বললেন যে কাকা লোক পাঠিয়ে নিয়ে এসেছিলেন পিতামহর নাম করে। কিন্তু কাকা আগাগোরা অস্বীকার করে যাচ্ছেন যে তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।”

বিপাশা বল্ল ,”তাহলে আলটিমেটলি নতুন উইল হাওয়া”

“নাকি কাকা লুকিয়ে রেখেছে?” আশা প্রশ্ন করলো

“আমার মনে হয়,দ্বীতিয়টা ঠিক” রনিতা বল্ল। কথা আর বেশী দূর এগোলো না।

দ্বীতিয় পর্ব

দুপুরে এলাহী খাওয়া দাওয়া করে ভাত ঘুম। বিকেলে দুই বোন সেজে গুজে সন্ধ্যের পার্টির জন্যতৈরী।সন্ধ্যের একটু আগে রনিতা তৈরী হয়ে এলো পার্টিতে নিয়ে যাবার জন্য।

বিপাশা রনিতাকে বল্ল, একটু সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে নামিস। ঠাকুমা দুজনের মৃত্যুদুটো তো ঠেলে ফেলে দেওয়া মতই লাগছে।আজ রাতে কিছু একটা ঘটবে মনে হচ্ছে।”

ওরা কথা বলতে বলতে এসে দাঁড়ালো হল ঘরের সামনে। ইতি মধ্যেই লোক সমাগম শুরু হয়ে গেছে ।বিপাশা আশা কে দেখে এক সুপুরুষ এগিয়ে এলো ভীড়ের মধ্য থেকে।বুঝতে এতো টুকু অসুবিধা হলো না এই হলো রনজয়। “আপনি বিপাশা নিশ্চয়ই,বাবা বলছিলেন,আমি রনজয়” সৌজন্য বিনিময় করে রনজয় চলে গেল। সন্ধ্যে থেকে রাত গড়িয়ে চল্ল গভীর রাতের দিকে। এর মধ্যে সব অতিথি আগমন শেষে কেক কাটা হয়েছে। সবার হাতের পানীয়ও প্রায় শেষ।ধীরে খাবার ঘরের দিকে এগোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই মানষিকভাবে । এই সময় বিকট আওয়াজ করে হল ঘরের মাঝখানের বিশাল ঝাড়বাতিটার কিছু অংশ ভেঙ্গে পড়লো।ঠিক ওই জায়গাটাতেই রনিতা আর বিপাশা দাঁড়িয়ে ছিল বেশ খানিক ক্ষন আগে। রনিতা প্রচন্ড ঘাবড়ে গিয়েছে। কেউ না বুঝুক রনিতা বিপাশা আর আশা বুঝতে পারছিল এটা বাইচান্স হয়নি। বিপাশা এদিক ওদিক খুঁজছিল কাকে যেন। এবার সবাই লক্ষ্য করল রথীন্দ্রনাথ প্রচন্ড হাফাতে হাফাতে সোফায় বসে পড়লেন। রনিতা চিৎকার করে বলে উঠলো “কাকার প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে, নায়েব কাকা! নায়েব কাকা!” রনিতা ছুটে গেলো রথীন্দ্রনাথের কাছে । ততক্ষনে রনজয় বাবার কাছে এগিয়ে এসেছে। রনিতা বল্ল, “রন তোর গাড়িতে কাকাকে হসপিটাল নিয়ে যা।আমার মনে হচ্ছে একটা হার্ট অ্যাটাক হলেও হতে পারে। গো কুইক!” আশা খেয়াল করলো,দিদি সবার অলক্ষে কি একটা তুলে নিয়ে কুর্তির পকেটে ঢোকালো।এই সব ঝামেলায় খাওয়া দাওয়া আর হয়নি।অতিথিরা সবাই ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক।বিপাশা আশা দুজনেই না খেয়ে উঠে এসেছিল নিজেদের ঘরে। কিন্তু নায়েব কাকা লোক পাঠিয়ে ঘরে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। 

খাওয়া দাওয়ার পর দুই বোন ঘরের সামনে টেরেসে এসে দাঁড়িয়েছিল। বিপাশা অন্য মনস্ক হয়ে বাগানের একটা নুড়ি পাথর হাতে ঘোরাচ্ছিল।

আশা জিজ্ঞেস, “এটা কোথায় পেলি?”

“পড়েছিলো ভাঙ্গা কাচের টুকরোর মধ্যে” বল্ল বিপাশা।

“কিন্তু এটা তো বাগানের নুড়ির মতো” আশা বল্ল

” ‘মতো’ নয় বাগানেরই নুড়ি।কিন্তু কথা হলো এটা ওখানে এলো কি করে? ধুলোবালি নয় যে উড়ে আসবে বা কারো পায়ে পায়ে আসবে।যদিনা কেউ এটা ছুঁড়ে ঝাড়বাতি টা ভাঙ্গে।”

“আমি চোখ রেখেছিলাম রথীন্দ্রনারায়নের দিকে উনি কিন্তু ঘর থেকে বেড়োননি।” আশা বল্ল

বিপাশা বল্ল, ” উনি বেড়োন নি কিন্তু রনজয় বেড়িয়েছিল, এবং ঝাড় ভেঙ্গে পড়ার বেশ খানিক বাদেই ঘরে ঢুকেছিল।ওছাড়া আর কেউ বাইরে যায়নি”

“তারমানে পাথরটা রনজয়ই ছুঁড়েছিল?” আশা জিজ্ঞেস করল।

“হুম তাই তো মনে হচ্ছে” বিপাশা বল্ল, “কিন্তু রনিতাকে মারতে নয়। কারন আমি আর রনিতা ঝাড়ের নীচ থেকে সড়ে যাবার অনেক পর রনজয় বাইরে যায়।

সিঁড়িতে ছায়া পড়তেই ওরা চুপ করে গেল। রনিতা উঠে এলো।

“ঘুমাসনি?” জিজ্ঞেস করলো বিপাশা।

“এইসবের মধ্যে ঘুমানো যায় !”

“আচ্ছাকাকার এই প্যানিক অ্যাটাকের ব্যাপারটা কে কে জানে?”বিপাশা জিজ্ঞেস করলো।

রনিতা বল্ল, “আমি রনো আর নায়েব কাকা”

“কাকার ঘর টা এখন দেখা যাবে?” বিপাশার  প্রশ্নের উত্তরে রনিতা বল্ল,”ঘর তো খোলা দেখলেই হয়” বিপাশা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘরটা দেখলো।ঘরে নানারকম মূল্যবান জিনিস রয়েছে সাজানো। চোখে পড়ার মতো হলো একটা বুক কেস আর তার উলটোদিকের দেওয়ালে নানা রকম মুখোশ দিয়ে সাজানো।বিপাশা বইগুলো দেখছিলো। বইগুলো দেখে বোঝা যায় ওনার কত রকম বিষয়ে উৎসাহ।হঠাৎ একটা লম্বা বড়ো বইএর পাশ থেকে খবরের কাগজে মোরা একটা ফটো বেড়োলো।ফটোটা দেখে রনিতা বল্ল, বড় ঠাকুমার ছবি। ছবিটা একটু অন্য ধরনের।বিপাশা হাতে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখতে গিয়ে পিছনে একটা বোতাম বা সুইচ ধরনের জিনিস দেখলো।সেটা টিপতেই ছবির ভিতরে আলো জ্বলে উঠলো। আলো টা জ্বালানোর সাথে সাথে ফটোটা ভীষণ ভাবে জীবন্ত হয়ে উঠলো। আশা অস্ফুটে বল্ল ‘থ্রিডি পিকচার’।

“তার মানে পিতামহ কে জানলা দিয়ে এই ছবিটাই দেখানো হয়েছিল”বিপাশা বল্ল।

বিপাশা বুককেস থেকে ঘুরে আবার মুখোশ গুলোর সামনে গেল,অস্ফুটে বল্ল, “কিন্তু এগুলো এখানে কেন?”তারপর বল্ল, “আশা দ্যাখ ওই মুখোশটার চোখটা অন্যগুলোর থেকে অন্যরকম লাগছে না?কেমন যেন মেকানিকাল মনে হচ্ছে না?”

আশা পড়ার টেবিলের সামনে থেকে একটা চেয়ার টেনে এনে সটান উঠে দাঁড়ালো ওটার ওপর।মুখোশটা নামিয়ে উলটে দেখে বল্ল, “ওবাবা এতো সিসি টিভি ক্যামেরা”

“অ্যাঁ?” রনিতা অবাক, অবাক বিপাশাও। “হ্যা এই তো দ্যাখোনা” বল্ল আশা।

“তাহলে ক্যামেরা এখানে হলে রেকর্ডিং হচ্ছে কোথায়?” বিপাশা অন্যমনষ্ক হয়ে আওড়াতে লাগলো, “ল্যাপটপ, ল্যাপটপ”

ল্যাপটপ একটা পাওয়া গেল ঠিকই কিন্তু তাতে কোনো রেকর্ডিং ছিলো না।

রনিতা হতাশ হয়ে পড়লো, “তাহলে?”

“তাহলে মোবাইল,………… কিন্তু মোবাইল কোথায়” বিপাশা যেন নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলো।”রথীন্দ্রনাথ যখন পরে যান সোফায়, তখন ওনার পকেট থেকে মোবাইল পড়ে যেতে পারে এবং লোকের পায়ে লেগে সেটা সোফার তলায় ঢুকে যেতে পারে” বিপাশার কথা রনিতা আর আশা সহমত পোষণ করল। 

তিনজনেই ছুটলো হল ঘরের দিকে।পুরোনো দিনের মেহগনি কাঠের সোফা তিনজনের ঠেলে সড়াতে কাল ঘাম ছুটলো,এই শীতে ঘেমে নেয়ে একসা।অবশেষে পাওয়া গেল মোবাইল। আশা মোবাইলের পাসওয়ার্ড বার করে ফোন খুলে ফেল্ল। বেশীদুর যেতে হলো না।দেখা গেল আগের দিন সকালেই রথীন্দ্রনাথ বুককেসের একটা অংশ খুলে গুপ্ত কুঠুরি থেকে একটা লম্বা কাগজের বান্ডিল বার করে দেখে আবার রেখে দিলেন। বুঝতে বাকী রইলো না। ওটাই দ্বীতিয় উইল। ওরা আবার ফিরে এল রথীন্দ্রনাথের ঘরে। বিপাশা সিসি টিভির রেকর্ডিং অনুযায়ী গোপন কুঠুরিটা বার করে খুলে ফেল্ল আর উইল বার করে রনিতার হাতে তুলে দিল।রনিতা ঘড়ি দেখে বল্ল, “চারটে বাজে ভোর হতে এখনও দেরি আছে,একটু ঘুমিয়ে নে তোরা”। রনিতার ফোন বেজে উঠলো। রনজয় ফোন করেছে, রথীন্দ্রনাথ ভালো আছে, হার্ট অ্যাটাক করে নি, সকালেই ডিসচার্জ করে দিচ্ছে।

বিপাশা বল্ল” দাঁড়া আর একটু কাজ বাকী আছে।রনজয়ের ঘরটা একটু দেখতে হবে “।রনজয়ের ঘর খোলাই ছিলো। বিপাশা ঢুকেই সোজা একটা বড় ফুলদানিরমধ্যে হাত ঢুকিয়ে তিনটে পেন ড্রাইভ বার করে আনলো। “এগুলো এখানে আছে কি করে জানলি” রনিতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।

“ম্যাডাম কাকার ঘরে যে ল্যাপটপটা ছিলো ওটা কার ছিলো?” বিপাশা জিজ্ঞেস করলো।

“ও হ্যা ,ওটা খোলার সময় তো রনোর নাম দেখেছিলাম ।তার মানে ওটা ওর” রনিতা বল্ল

“ইয়েস ওই ল্যাপটপেই সিসি টিভি রেকর্ডিং দেখেছিলাম যেটা রনজয়ের ঘরে লাগানো আছে ।রনজয় হয়তো নিজের প্রটেকশনের জন্যই লাগিয়েছে। দেখেছিলাম, রনজয় কিছু একটা লুকাচ্ছে এখানে। কিন্তু সে গুলো যে পেন ড্রাইব হবে বুঝিনি।চল ওর ল্যাপটপেই দেখি এর মধ্যে আছে টা কি যে ও লুকিয়ে রাখছিল এতো যত্ন করে।

ওরা তিন জনে আবার ফিরে এলো রথীন্দ্রনাথের ঘরে। ল্যাপটপ চালু করে একে একে সব কটা পেন ড্রাইব দেখা হলো। এগুলো ছিলো বিশাল প্রমান রথীন্দ্রনাথের কির্তীকলাপের,যেগুলো রনোজয় বিভিন্ন সিসি ক্যামেরা থেকে যোগাড় করে রেখেছিল।সম্ভবতঃ ব্ল্যাকমেল করতো ছেলে, বাবা কে।এর মধ্যে দেখা যাচ্ছে বড়রানীমাকে কি ভাবে রথীন্দ্রনাথ ধাক্কা দিয়ে সীঁড়ি থেকে ফেলে দেয়, ছোট রানীকে কিভাবে বারান্দা থেকে ফেলে দেয়। পিতামহের ঘরের সিসিটিভির রেকর্ডিং ও আছে এখানে, যেখানে দেখা যাচ্ছে,বড় রানীমার ছবি জানলায় দেখে উনি কিরকম উত্তেজিত হয়ে খাট থেকে নামতে গিয়ে পড়ে যান। 

রনিতা বল্ল, “কিন্তু তুই এটা আগে থেকে জানলি কি করে”

“এটা তো কমন সেন্স। যে সিঁড়ি দিয়ে উনি অহরহ নামছেন, যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে উনি অহরহ প্রকৃতির শোভা দেখছেন,সেখান থেকে দুম করে পড়ে যায় কি করে, যদিনা কেউ ধাক্কা মারে।আর পিতামহর ব্যাপারটা তো তুইই বলেছিলি উনি জানলার দিকে যাবার চেষ্টা করতে গিয়ে খাট থেকে পড়ে গেছেন। তাহলে নিশ্চয়ই জানলায় এমন কিছু দেখানো হয়েছিল যা বা যেটা উনি ভালোবাসতেন! আর কি রাখা হয়েছিল তার প্রমান তো পেয়েই গিয়েছিলাম রথীন্দ্রনাথের ঘরে”

“আর ঝাড়বাতি?”রনিতা জিজ্ঞেস করলো।

“ওটা রনজয় করেছিল,বাইরের নুড়ি ছুঁড়ে। তবে তোকে মারতে নয়,ওর বাবাকে শিক্ষা দিতে কারন ওর বাবার এই কাজ গুলো ও মেনে নিতে পারে নি।” কথাটা শেষ করে বিপাশা রনিতার হাতে সেই নুড়ি পাথর টা দিলো। “এটাই ছিলো ভাঙ্গা কাচের মধ্যে। তবে আমি বলবো ওর কথা পুলিশকে বলিস না,ও মনের দিক থেকে খারাপ নয়”

বিপাশা, রনিতার হাতে উইল,রথীন্দ্রনাথের মোবাইল ফোন আর পেন ড্রাইভ গুলো তুলে দিয়ে বল্ল, “আমার মনে হয় রথীন্দ্রনাথ কে ধরিয়ে দেবার উপযুক্ত প্রমাণ তোকে দিয়েছি।এগুলি পুলিশ কে দেখাস তাহলেই হবে।তুই এবার ঘুমিয়ে পর।আমরা একটু রেস্ট নিয়ে বেড়িয়ে পরবো ফেরার ট্রেন ধরতে। বেস্ট অফ লাক ডিয়ার।

উত্তরাধিকার রহস্য রহস্য গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!