কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

পিকনিক

পিকনিক ছোট গল্প – দেবস্মিতা সাহা

রেশমি ও ইন্দ্রনীলের একমাত্র ছেলে কুট্টুস। বছর পাঁচেক বয়স।  ইন্দ্রনীল পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং রেশমি একজন অধ্যাপিকা।তাদের অফিসের সময় টুকুতে কুট্টুস থাকে তাদেরই ফ্ল্যাট  থেকে খানিকটা  দূরে তার দাদু দিদার কাছে। ইন্দ্রনীলের বাবা মা অনেক কাল আগে গত হয়েছেন। তাই রেশমি যখন কলেজে চাকরি পেল তখন কুট্টুস কার কাছে থাকবে এই ভেবে তার বাবা মা ই নিজেদের গ্রামের বাড়ি ছেড়ে এই শহরে এসে ফ্ল্যাট কিনলেন।শহরের যান্ত্রিক পরিবেশ তাদের ভালো না লাগলেও একপ্রকার বাধ্য হয়ে নাতির কথা ভেবে  রেশমির বাবা মা  এই জীবন মেনে নিয়েছেন। 

      আসলে রেশমির মা অলোকাদেবী একজন আদ্যন্ত আটপৌরে মানুষ।  তাঁর বাপের বাড়ির অবস্থা যথেষ্ট সচ্ছ্বল হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছেলেবেলা থেকেই নিতান্ত সাধারণ। তখনকার দিনে একজন গ্র্যাজুয়েট।গ্রামে  তাঁদের বাড়ির যথেষ্ট সম্মান ছিল।  এতদ্সত্ত্বেও তিনি এবং তাঁর পরিবার যথেষ্ট উদারমনা ছিল। তবে রেশমির বাবা অর্থাৎ নারায়ণবাবুর সঙ্গে তাঁর যখন বিয়ে হল সম্পূর্ণ আলাদা পরিবেশের মধ্যে গিয়ে পড়লেন অলোকাদেবী। নারায়ণবাবুর বাড়ির লোকেরা যেন বড্ড দাম্ভিক,আত্মকেন্দ্রিক। নিজেদের নিয়েই নিজেরা ব্যস্ত।  আর কপালদোষে রেশমিও ছোটো বেলা থেকেই তার বাপ ঠাকুরদার মতই স্বভাব পেয়েছে।সে ও তাদের মতই আত্মঅহংকারী,নিজের মতামতকেই সর্বদা প্রাধান্য দেয়।অলোকা দেবীকে এই দুঃখ যেন গোটা জীবন ধরে কুঁড়ে কুঁড়ে খেল।  নিজের একমাত্র সন্তানকে নিজের মনের মত করে গড়ে তুলতে পারেননি ।  গর্ভজাত সন্তানের সাথেও  এক অদ্ভুত শীতল সম্পর্ক  তিনি সারাজীবন ধরে বয়ে চলেছেন।শিক্ষিত,সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন হয়েও  নিজের অত্যন্ত সাদামাটা স্বভাবের জন্য শ্বশুরবাড়ির লোকের কাছে তো নয়ই, এমনকি মেয়ের কাছেও প্রাপ্য সম্মানটুকুও পাননি।   নাতি হওয়ার পর তিনি ভেবেছিলেন নাতিকে তিনি তাঁর মনের মত করে গড়বেন। কিন্তু রেশমির প্রয়োজনাতিরিক্ত হস্তক্ষেপে তারও তো জো রইল না।   স্কুল, আঁকার ক্লাস, সাঁতার, আর অবসর সময়ে  কম্পিউটারে ভিডিও গেম এই হল কুট্টুসের নিত্য দিনলিপি।  বেচারা একটু মাঠে বা পার্কে গিয়ে খেলার অবকাশ টুকুও পায় না।কি আর করা !স্কুলের যা চাপ,আবার বাড়িতেও আণ্টির পড়া। কুট্টুসের দিম্মা বা দাদুন মন থেকে কুট্টুসের এই বদ্ধ ঘরে আটক জীবন মেনে নিতে না পারলেও নিজের মেয়ের মুখের ওপর কথা বলতে পারে না। কারণ ছেলের এই দিনলিপি রেশমির নিজের হাতে তৈরি। একটামাত্র ছেলেকে নিয়ে অনেক অনেক স্বপ্ন তার। 

       কিন্তু কুট্টুসের মন যে বিকেলবেলা হলেই তার দিম্মার বাড়ির পাশের ঐ পার্কটায় ঐ ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে গুলোর সাথে খেলতে চায়, প্রজাপতি ধরতে চায়, প্রাণ খুলে একটু খোলা আকাশের নিচে নিশ্বাস নিতে চায় তা আর কে বোঝে। বিকেল হলেই সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাশের পার্কটায় বাচ্চাদের খেলা দেখে। কুট্টুসের দিম্মার চোখ তা কিন্তু এড়ায় না। শুধু তাই নয় রেশমি আর ইন্দ্রনীল নিজেদের সবটুকু কুট্টুসকে দিতে চেষ্টা করলেও অতিরিক্ত শাসন,অতিরিক্ত নিয়মানুবর্তিতা, তাকে দিন দিন একটু একটু জেদী,একগুঁয়ে করে তূলছিল। কথায় কথায় বায়না, অকারণে মন খারাপ করে বসে থাকা এসব দেখে রেশমি কি বুঝত জানি না অলোকাদেবী বুঝতে পেরেছিলেন ঠিকই যে তাঁর নাতির আসলে একটু ছাড় দরকার।  

       এরই মধ্যে হল কি কুট্টুসের দিম্মার বাড়িতে নতুন একটি বউ কাজ করতে এল। রান্না করা ,বাসন মাজা,ঘর মোছা,কাপড় কাচা, অলোকা দেবী ও নারায়ণবাবুর দেখাশোনা সবটাই করবে। তার বদলে তাদের দুজনকে ঐ বাড়িতে থাকতে দিতে হবে।  

     সে যাই হউক এই কদিনের মধ্যেই বিনা একটু একটু করে অলোকাদেবীর সংসারের সমস্ত  খুঁটিনাটি দিক সামলাতে শুরু করেছে। রান্নাবান্না সহ সব কিছুই এখন বিনা সামলায়। অলোকাদেবী এখন অনেকটাই হাল্কা। 

      সবচেয়ে বড় কথা বিনার ছেলের সাথে কুট্টুসের ইতিমধ্যেই একটু একটু করে বেশ ভাব জমে উঠেছে। কুট্টুস আর বিনার ছেলে পিন্টু এখন বন্ধু। তারা বিকেলে একসাথে ছাদে খেলে,বাগানে পাখি দেখে,প্রজাপতির পেছনে দৌঁড়োয়। ঘুড়ি ওড়াতে পারুক না পারুক লাটাই আর সুতো নিয়ে ছাদের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে দৌঁড়ে বেড়ায়। আজকাল তো আবার অলোকা দেবী রেশমিকে না জানিয়ে মাঝেমাঝে পাশের মাঠে পিন্টুর সাথে খেলতে পাঠায়। ইদানিং কালে কুট্টুসের আবার আরো কজন বন্ধু হয়েছে।তাদের সাথে ঝগড়া, খুনসুঁটি, আর সর্বোপরি রোজকার ক্রিকেট খেলা…… কুট্টুসের  রোজকার দমবন্ধ করা দিনলিপির মধ্যে এইসব যে কখন জায়গা করে নিয়েছে তা সে নিজেও জানেনা।  আস্তে আস্তে কুট্টুসের সবসময় মন খারাপ করে থাকা,মুখ ভার করে থাকা কোথায় যেন ছু মন্তরে মিলিয়ে গেল।

     ইতিমধ্যে একদিন কুট্টুস খেয়াল করল খুব সকালবেলায় পাশের বাড়ির টিনটিন, তার মা আর বাপির সাথে খুব সুন্দর জামাকাপড় পড়ে, সাজগোজ করে কোথায় যেন যাচ্ছে।  সাথে একটা ঢাউস ব্যাগে দু দুটো ব্যাডমিন্টন খেলার রেকেট ।  টিনটিনকে ডেকে জিজ্ঞাসা করাতে টিনটিন জানাল সে বাবা মায়ের সাথে পিকনিক করতে যাচ্ছে। ওদের দেখে কুট্টুসেরও খুব পিকনিক  যেতে ইচ্ছে হল। সে ছুটে এসে তার দিম্মাকে বলল ‘চলো না দিদান আমি, তুমি,মামনি,বাপি,দাদান,বিনা পিসি,পিণ্টু,ঐ পাড়ার চুমকি, টুয়া, রানা ওদের বাপি মামনিরা সব্বাই মিলে একদিন কোথাও পিকনিকে  যাই।’মনে হল নাতির কথাটা অলোকাদেবীর বেশ মনে ধরল। তিনি নাতিকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন ‘দেখছি কি করা যায় সোনা!’

       অলোকাদেবী কথাটা ঘরে পাড়তেই নারায়ণবাবুও এক কথায় রাজি হলেন। সত্যিই তো সবাই মিলে কতদিন কোথাও যাওয়া হয় না।

    কিন্তু কথা হল কোথায় যাওয়া হবে পিকনিক?  আশেপাশের পিকনিক স্পট গুলোতে যা ভিড়। শহরের ইট কাঠ পাথরের ভিড়ের  থেকে যদি দূরে যাওয়া যায়! 

      বিনার বাড়ি প্রত্যন্ত গ্রামে,শহুরে সভ্যতার আলো গিয়ে এখনো পৌঁছয়নি।  প্রস্তাব প্রথমে বিনাই দিল। ‘মাসিমা আমাদের গ্রামে যাবেন? এখান থেকে যেতে ঘণ্টা তিনেক লাগবে। ওখানে প্রথমে বাসে করে যেতে হয়, তারপর নৌকা করে নদী পেরোতে হয়।  তবেই আমাদের গ্রামে পৌঁছনো যায়। ওখানে থাকা,খাওয়ার ব্যবস্থা আমার উনিই সব করে দেবে গো মাসীমা। ‘লজ্জা লজ্জা মুখে বিনা কথাটা বলল। কথাটা অলোকাদেবী ও নারায়ণবাবুরও বেশ মনে ধরল। দেখতে দেখতে অলোকাদেবীই উদ্যোগ নিয়ে   আশেপাশের বাড়ির বেশ কয়েকজনকে  জুটিয়েও ফেললেন বেড়াতে যাওয়ার জন্য  ।শুধু বাকি রইল রেশমিদের রাজী করানোর।  প্রথমে রাজী করানোর জন্য  বেগ পেলেও ইন্দ্রনীলই রেশমিকে বোঝানোয় রেশমিও রাজি হয়ে যায়।   

      একদিন সবাই মিলে অনেক সকাল বেলা বেরিয়ে পড়ল । একটা বাস আগে থেকেই ঠিক করে রাখা হয়েছিল। কুট্টুসের তো খুব মজা। এই প্রথমবার সে কোথাও পিকনিক যাচ্ছে।  শুধু কি বাবা, মা আর দাদু দিম্মা! ওর কজন বন্ধুও তো সঙ্গী হয়েছে তাদের বাবা মা র সাথে।  সব পুঁচকে গুলোই তাদের কিছু না কিছু খেলার সরঞ্জাম নিয়েছে তাদের সাথে। রাস্তায় একবার বাস দাঁড় করিয়ে বড়দের চা বিস্কুট , ছোটদের বিস্কুট, চিপস্, চকোলেট এই সবের পর্বও মিটেছে।

     প্রায় আড়াই ঘণ্টা বাসে করে যাওয়ার পর এক জায়গায় বাস থামল। যেদিকে দু চোখ যায় শুধুই সবুজ আর সবুজ। ফসলে ভরা। শহরে এমন দৃশ্য সত্যিই দেখা যায় না। কুট্টুস তার বন্ধুদের নিয়ে হাপুস নয়নে চারদিকে হাঁ করে তাকিয়ে দেখতে লাগল। যেন এতদিনে সে প্রথম খোলা আকাশের নীচে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিল। আর বড়রাও তো আছেই ঐ দলে।

      যাই হোক, বিনা তার গ্রামের চেনাশোনা লোকেদের দিয়ে একটা ছোটো বাগানবাড়ি ঠিক করে রেখেছিল। অলোকাদেবী  সদলবলে সেখানে উঠলেন। লুচি,তরকারি সহ জলযোগ সেরে সবাই চারপাশের গ্রাম দেখতে বেরিয়ে পড়ল। আর বাচ্চারা তাদের খেলার সরঞ্জাম নিয়ে ঐ বাগানবাড়ির বড় বাগানে খেলা,ইচ্ছেমত ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছিল বিনার তত্ত্বাবধানে। 

  আর ওদিকে চলছিল দুপুরের খাবারের জোগাড়। কাঠ দিয়ে উনুন জ্বালিয়ে রান্নার ব্যবস্থা হয়েছে। যথাসময়ে ভাত, ডাল,আলু ভাজা,পমফ্রেট মাছের ফ্রাই,রুই মাছের কালিয়া,খাসির মাংস, চাটনি, পাঁপড় রেডি। প্রথমে বসল পুঁচকেগুলো।পিকনিক বলে কথা! তারা বাড়িতে ভালো করে নিজে হাতে ভাত না মাখতে পারলেও ওখানে তারা হাতে মুখে বেশ করে এঁটো ভরিয়ে নিজে হাতে দিব্যি খেল। 

        ইতিমধ্যে বড়দের গ্রাম ঘুরে এসে পেটে ছুঁচোয় ডন মারতে শুরু করেছে। তারাও বসে পড়ল। অফিসের রোজকার একঘেয়ে  পাস্তা, স্যান্ডুইচ খেয়ে খেয়ে সবার মন ,সবার রসনা যেন অন্য কিছু চাইছিল। অলোকাদেবীর আজ যেন অবাক হওয়ার পালা।রেশমি আজ তাঁকে নিজে পাশে বসে খাইয়েছে।   এত সব সুস্বাদু খাবারের প্রতিটিই সবাই  চেটেপুটে খেল। তারপর রোদ পড়ে এলে গাছের ছায়ায় চলল স্বপরিবারে গানের লড়াই খেলা। সন্ধ্যা নামলে পাখিদেরও যেমন বাসায় ফেরার পালা ,তেমনি আজ অনেক অনেকদিন বাদে বা বলা ভালো অনেক বছর বাদে অলোকাদেবী ও নারায়ণবাবু তার পুরো পরিবারকে নিয়ে শান্তিতে বাড়ি ফিরছেন।  কারণ তাঁরা লক্ষ্য করলেন কুট্টুসের সাথে সাথে তাদের মেয়েও যেন অনেকদিন বাদে মন খুলে হাসছিল,সবার সাথে কথা বলছিল। এ যেন এক অন্য রেশমি। আর ঐ দিকে মা ,বাপিকে অনেকদিন বাদে একসাথে পেয়ে কুট্টুসের চোখে মুখে যেন খুশি উপচে পড়ছিল ।  রাতে বাড়ি ফিরে অলোকাদেবীকে আরো অবাক করে দিয়ে রেশমি সেই তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে বলল মা সামনের বছরও সবাই আমরা এইভাবে পিকনিক করব তো? রাতে শুয়ে শুয়ে অলোকাদেবী ভাবলেন শেষ পর্যন্ত একটা পিকনিক কি পারল তিন প্রজন্মের সম্পর্কের সমীকরণ বদলাতে!!

মনস্তাত্ত্বিক রোমাঞ্চকর গল্প : রক্ষাকবচ

কলমে : তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী

“মিসেস বাসু, আপনি শান্ত হন। টেনশন করবেন না। আপনাকে ডিপ ব্রিদিং করতে বলেছিলাম মনে আছে? শান্ত না হলে আমায় সমস্যাটা খুলে বলবেন কীভাবে?”

মনের ডাক্তারের দিকে মুখ তুলে চায় তৃণা। কথা বলতে গিয়ে স্বর কেঁপে যায়।

“ওরা আমাকে পাগলাগারদে দেওয়ার ফন্দি আঁটছে ডাক্তারবাবু। আশীষের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে আত্মরক্ষা করতে গিয়ে ওর ওই অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটেছিল। আচ্ছা আপনিই বলুন, দুর্ঘটনার উপর কারুর হাত থাকে! আর এই রাগ মেটানোর জন্য ওরা আমাকে পাগলাগারদে রেখে দিতে চাইছে।”

ডাক্তারবাবু চোখ থেকে চশমাটা খুলে কিছুক্ষণ চিন্তা করেন। তারপর পুনরায় সেটা পরে নিয়ে বলেন, “একটা কথা বলুন, আপনাদের দাম্পত্যজীবনে আপনি কতখানি খুশি ছিলেন?”

অসহায়তা ফুটে ওঠে তৃণার কথায়।

“এমনি তো সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু ওইযে, আশীষের সন্দেহবাতিক মন! সবসময় আমাকে সন্দেহ করতো।” ফুঁপিয়ে ওঠে তৃণা। “এমনকি আপনাকে নিয়েও। আপনার সঙ্গে কী আমার আজকের পরিচয়! আপনি আমার কাছে কতখানি ভরসার জায়গা! কখনও কোনো সমস্যায় পড়লে আপনার কাছেই তো আগে আসবো! আর এতেই ছিল আশীষের আপত্তি, আপনার সঙ্গে আমাকে কিছুতেই কথা বলতে দেবে না। খালি বাধা দিত, আমার উপর জোর খাটাতো। সহ্য করতে করতে একসময় আর পারলাম না।” তৃণা কান্নায় ভেঙে পড়ে।

চশমাটা খুলে শশব্যস্ত হয়ে ডাক্তারবাবু বলেন, “আরে মিসেস বাসু, এভাবে কাঁদবেন না প্লিজ। আশীষবাবু আপনাকে সেভাবে বুঝে উঠতে পারেনি। এতে আপনার কোনো দোষ নেই।”

চোখের জল মোছে তৃণা, “সেটাই তো কেউ বুঝতে চাইছে না। আমাকে পাগল অপবাদ দিতে চায়।”

………………..

“দেখছেন ডক্টর! এই সমস্যার জন্যই বিশেষ করে রাত্রিবেলায় আপনাকে একবার চেকআপ করার জন্য রিকোয়েস্ট করেছিলাম।” কাঁচের ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে আকুলস্বরে বলে নন্দিনী।

ডক্টর পূর্ণেন্দুপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় আশ্বস্ত করেন, “ঘাবড়াবেন না। এরকম ‘শয়ে ‘শয়ে পেসেন্ট আমরা রোজ দেখছি। আপনার দিদিকে আমরা ঠিক সামলে নিতে পারবো। ওইযে উনি বারবার চশমা খোলাপরা করছেন, নিজের অন্য সত্ত্বার সঙ্গে কথা বলছেন এখন। ডুয়াল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের পেসেন্টরা এমনই করেন। এই ঘরটা এজন্যই বানানো হয়েছে যাতে আমরা পেসেন্টকে এখানে কিছুক্ষণের জন্য রেখে অবজার্ভ করতে পারি।”

হতাশকণ্ঠে নন্দিনী বলে, “কীভাবে যে কী হয়ে গেলো! আমার জামাইবাবুর মতো ভালোমানুষ আর হয় না। দিদির যে এমন একটা সমস্যা ছিল আমরা কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি। বিয়ের আগে বাড়িতে দিদির নিজের জন্য আলাদা রুম ছিল। সেখানে এমন কিছু করতো কিনা জানতামও না। আর এমনিতেও সারাটা দিন তো ঠিকঠাকই থাকতো। বিয়ের পর জামাইবাবুই এটা প্রথম লক্ষ্য করে। দিদির সমস্যাটা ক্রমে বাড়তে থাকে। রাতের বেলায় ঘন্টার পর ঘন্টা দিদি আয়নার সামনে কথা বলে যেতো, আশীষদা বাধা দিত যাতে অবস্থাটা আরো বিগড়ে না যায়। তাও আশীষদা দিদিকে ছেড়ে যায়নি, ট্রিটমেন্ট করাতে চেয়েছিল। আর দিদি কিনা কাঁচি দিয়ে আশীষদাকেই..!!”

কান্নায় কণ্ঠরোধ হয়ে আসে নন্দিনীর। তারপর সামলে নিয়ে বলে, “সবাই বলেছিল রাত হলেই দিদির উপর ভূতপেত্নী ভর করে। আত্মীয়স্বজনরা একরকম জোর ফলিয়েই দিদির উপর ওঝা, ঝাড়ফুঁক সবকিছু করিয়েছে। কিছুতেই কিছু হয়নি। শেষ ভরসা আপনারা।”

“আপনি কিছু ভাববেন না। আমরা আপনার দিদিকে বেস্ট ট্রিটমেন্ট দেবো।” আশ্বাস দেন ডক্টর চট্টোপাধ্যায়।

………………

“আপনাকে কী করতে হবে মনে আছে তো? ভেঙে পড়লে চলবে না।”

মনের ডাক্তারের কথায় শাড়ির ভাঁজে লুকিয়ে রাখা কাঁচিটা শক্ত করে ধরে তৃণা। মুচকি হেসে বলে, “আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন ডাক্তারবাবু। ওরা কেউ একবার আমার কাছে আসুক!!”

অবিকল একইরকম মুচকি হেসে আয়নার ভেতর থেকে তৃণার দিকে তাকিয়ে তার অন্য সত্ত্বা তার বহুকালের পরিচিত সেই ডাক্তার বলে, “ভয় কি! আমি তো আছি, আপনার রক্ষাকবচ। আশীষবাবুর ডেথ-এ আপনার যেমন কোনো জেল হয়নি, এবারেও হবে না। সারাটা জীবন আমি আপনাকে গার্ড দিয়ে চলবো।”

পিকনিক ছোট গল্প – সমাপ্তি

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!