আবির চৌধুরী হত্যারহস্য গোয়েন্দা গল্প – অমিতাভ সাহা
(১)
এক বর্ষণসিক্ত সন্ধ্যা। কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ভবানীপুর এলাকায় পুরনো জমিদারবাড়ির আদলে তৈরি ‘শান্তি কুটির’-এর তিনতলার ফ্ল্যাটে ফোনটা বেজে উঠল। রাত তখন প্রায় ৯টা। অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অয়ন সেন তার দিনলিপিতে গুরুত্বপূর্ণ মামলার নোট টুকে রাখছিলেন। ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল সাব-ইন্সপেক্টর সুমিতের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর।
-“স্যার, একটা অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর এসেছে। শান্তি কুটিরে। বিখ্যাত সাহিত্যিক আবির চৌধুরী-র ফ্ল্যাটে,” সুমিতের গলাটা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি চাপা শোনাল।
আবির চৌধুরী! অয়নের ভ্রু কুঁচকে গেল। সাহিত্যের জগতে তার একচ্ছত্র আধিপত্য, অসংখ্য পাঠক তার লেখার অনুরাগী। তার ফ্ল্যাটে অস্বাভাবিক মৃত্যু? অয়ন দ্রুত তৈরি হয়ে নিলেন।
যখন তিনি ঘটনাস্থলে পৌঁছলেন, ফ্ল্যাটের সামনে পুলিশের ভিড়। পুরনো দিনের স্থাপত্যের এই বাড়িটার প্রতিটা কোণে যেন এক পুরনো দিনের গল্প লুকিয়ে আছে। ভেতরের লিফট ধরে তিনতলায় উঠতেই দেখেন সুমিত দাঁড়িয়ে আছে। ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকতেই অয়ন এক বীভৎস দৃশ্যের মুখোমুখি হলেন।
আবির চৌধুরী তার লেখার ঘরের আরামকেদারায় বসে আছেন। তার হাতে একটি খোলা বই কিন্তু চোখ দুটো বিস্ফারিত। তার মুখটা নীলচে হয়ে গেছে, আর টেবিলে রাখা এক গ্লাস জল থেকে এক অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে। ঘরের আসবাবপত্র ছিমছাম, কোনো ধস্তাধস্তির চিহ্ন নেই।
-“কারা ছিল ফ্ল্যাটে?” অয়ন জিজ্ঞেস করলেন, তার চোখ মৃতদেহের ওপর নিবদ্ধ।
সুমিত ফাইল দেখতে দেখতে বলল, “বাড়িতে কাজের লোক ছাড়া কেউ ছিল না, স্যার। আবির চৌধুরীর স্ত্রী নন্দিনী চৌধুরী একটি সাহিত্য সভায় যোগ দিতে শহরের বাইরে ছিলেন। তিনি খবর পেয়ে ফিরছেন। আর তাদের পারিবারিক বন্ধু অদিতি সেন তিনি পাশের ফ্ল্যাটেই থাকেন।”
-“কাজের লোক কোথায়?”
-“তারা রান্নাঘরে আছে, স্যার। খুব ভয় পেয়েছে। বলছে, তারা কিছুই শোনেনি।”
অয়ন কাজের লোকদের জেরা করলেন। তাদের নাম সুশীলা এবং মহেশ। তারা জানাল, তারা রান্নাঘরে কাজ করছিল যখন হঠাৎ আবিরবাবুর লেখার ঘরে একটা মৃদু কাঁচ ভাঙার শব্দ শুনতে পায়। তারা এসে দেখে আবির চৌধুরী তার চেয়ারে নিথর বসে আছেন। মহেশ যোগ করল, তারা কাউকে ফ্ল্যাটে ঢুকতে বা বেরোতে দেখেনি। ফ্ল্যাটের মূল দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।
অয়নের মনে একটা খটকা লাগল। ভেতর থেকে বন্ধ দরজা? তাহলে কি আবির চৌধুরী নিজেই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন?
অয়নের মনে পড়ল আবির চৌধুরীর ব্যক্তিগত জীবনের কিছু গুজব। শোনা গিয়েছিল, আবির চৌধুরীর নাকি তার স্ত্রী নন্দিনী চৌধুরীর সাথে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। তার জীবনে অন্য কোনো নারীর উপস্থিতি নিয়েও গুঞ্জন ছিল। অয়নের মনে হলো, হয়তো এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর পেছনে কোনো ব্যক্তিগত টানাপোড়েন বা সম্পর্কের জটিলতা লুকিয়ে আছে।
-“আবির চৌধুরীর কি ইদানীং কারো সাথে কোনো সমস্যা চলছিল? ব্যক্তিগত বা সাহিত্যিক মহলে?” অয়ন প্রশ্ন করলেন।
সুশীলা ইতস্তত করে বলল, “সাহেব… ইদানিং খুব চিন্তায় থাকতেন। আর প্রায়ই দিদিমণির সঙ্গে কথা কাটাকাটি হত।”
অয়ন মৃতদেহের দিকে তাকালেন, তারপর সুমিতকে নির্দেশ দিলেন, “সারা ফ্ল্যাট ভালো করে সার্চ করো। কোনো ক্লু মিস করা চলবে না। আবির চৌধুরীর কল ডিটেইলস, ল্যাপটপ আর তার মোবাইল ফোনটা খুঁজে বের করো। বিশেষ করে গত কয়েকদিনের কল লিস্ট আর ইমেইলগুলো। আর হ্যাঁ, ওই জলের গ্লাসটার ফরেনসিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করো।”
সুমিত মাথা নাড়ল। অয়নের মনে হলো, এই আপাত সরল মৃত্যুটা হয়তো আসলে এক জটিল রহস্যের জাল এবং সেই জালের সুতো হয়তো আবিরের লুকানো কোনো সম্পর্কের দিকেই ইঙ্গিত করছে।
(২)
অয়ন সেন যখন ঘটনাস্থল থেকে ফিরলেন, তখনও বৃষ্টি পড়ছিল। আবির চৌধুরীর ফ্ল্যাটে ফরেনসিক টিম তাদের কাজ করছিল। বিষক্রিয়ায় মৃত্যু কিন্তু কে বিষ দিল সেটাই আসল প্রশ্ন। আবির চৌধুরীর মোবাইল ফোনটা তার পড়ার টেবিলেই পাওয়া গিয়েছিল কিন্তু ল্যাপটপটা ফ্ল্যাটে ছিল না।
অয়ন দ্রুত মোবাইল ফোনের কল ডিটেইলস পরীক্ষা করলেন। গত কয়েকদিনে আবির চৌধুরী একটি নির্দিষ্ট নম্বরে বারবার ফোন করেছেন। আর গতকাল রাতে খুন হওয়ার ঠিক ১৫ মিনিট আগে ওই নম্বর থেকে তাকে একটা ফোন করা হয়। নম্বরটি ছিল পরিচিত, তার দীর্ঘদিনের প্রকাশক সুমন দে-র।
সুমিতকে ফোন করে অয়ন নির্দেশ দিলেন, “সুমিত, সুমন দে-কে এখুনি থানায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করো। আর আবির চৌধুরীর স্ত্রী নন্দিনী চৌধুরীকে নিয়ে এসো।”
এরপর অয়ন আবির চৌধুরীর পারিবারিক বন্ধু এবং পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা অদিতি সেনকে ডাকলেন। অদিতি আবির চৌধুরীর মৃত্যুর খবরে বিধ্বস্ত।
-“মিসেস সেন, আবির চৌধুরীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। আপনি কি তার সম্পর্কে কোনো অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করেছেন ইদানীং?” অয়ন শান্ত গলায় শুরু করলেন।
অদিতি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “আবিরদা গত কয়েক মাস ধরে খুব চিন্তায় ছিলেন। তিনি নন্দিনীর সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে খুব হতাশ ছিলেন।”
-“নন্দিনী চৌধুরীর সঙ্গে আবির চৌধুরীর সম্পর্ক কেমন ছিল?”
অদিতি ইতস্তত করলেন। “তাদের মধ্যে সমস্যা চলছিল, স্যার। প্রায়ই ঝগড়া হতো।”
-“আপনি কি জানেন, আবির চৌধুরী অন্য কোনো সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন?” অয়ন সরাসরি প্রশ্ন করলেন।
অদিতির চোখ দুটো বড় হয়ে গেল। “হ্যাঁ, স্যার। আমি জানতাম। আবিরদা গত প্রায় এক বছর ধরে একজনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। সে তার এক পুরনো ছাত্রী, ঐশী মিত্র।”
অয়ন নড়েচড়ে বসলেন। এই সেই ত্রিকোণ প্রেমের একটি কোণ! “ঐশী মিত্র? তার সম্পর্কে কী জানেন?”
-“ঐশী একজন শিক্ষিকা। সে আবিরদার লেখার একজন বড় অনুরাগী। আবিরদা তাকে তার অনেক অপ্রকাশিত লেখা দেখাতেন,” অদিতি বললেন।
অয়নের মনে পড়ল আবির চৌধুরীর ল্যাপটপটি ফ্ল্যাটে পাওয়া যায়নি। হয়তো সেই ল্যাপটপে ঐশী মিত্রের সঙ্গে তার সম্পর্কের কোনো প্রমাণ ছিল।
ঠিক এই মুহূর্তে সুমিত ফিরে এল। “স্যার, আবির চৌধুরীর জলের গ্লাসের ফরেনসিক রিপোর্ট এসেছে। গ্লাসে সায়ানাইডের চিহ্ন পাওয়া গেছে।”
সায়ানাইড! এই বিষের এমন মিষ্টি গন্ধ হয়তো হতে পারে। কিন্তু এই বিষ এল কোথা থেকে? আর ফ্ল্যাটের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল।
এরপর অয়ন আবির চৌধুরীর প্রকাশক সুমন দে-কে জেরা করলেন। সুমন ছিলেন আবিরের দীর্ঘদিনের সঙ্গী, তার প্রতিটি লেখার সাক্ষী।
-“মিস্টার দে, আবির চৌধুরী গতকাল রাতে আপনার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। কী বিষয়ে?” অয়ন জিজ্ঞেস করলেন।
সুমন দে হতাশ ভঙ্গিতে বললেন, “আবির আমাকে ফোন করেছিলেন, স্যার। তিনি বলেছিলেন, তিনি একটি নতুন উপন্যাস শুরু করেছেন, যা তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে। কিন্তু তিনি খুব হতাশ ছিলেন। বলছিলেন, তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খুবই জটিলতার মধ্যে আছেন।”
-“তিনি কি ঐশী মিত্রের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা আপনাকে বলেছিলেন?”
সুমন দে চমকে উঠলেন। “না, স্যার! আবির ব্যক্তিগত বিষয় খুব গোপন রাখতেন।”
অয়নের মনে হলো, সুমন দেও কিছু লুকাচ্ছেন। আবিরের প্রকাশক হিসেবে তার ব্যক্তিগত জীবনের গভীরের তথ্য হয়তো তিনি জানেন।
-“আবির চৌধুরীর ল্যাপটপ ফ্ল্যাটে পাওয়া যায়নি। আপনি কি জানেন সেটা কোথায়?” অয়ন প্রশ্ন করলেন।
সুমন দে মাথা নাড়লেন। “না, স্যার। ল্যাপটপ সম্পর্কে আমি কিছু জানি না।”
এরপর আবির চৌধুরীর স্ত্রী নন্দিনী চৌধুরীকে থানায় আনা হলো। নন্দিনী অত্যন্ত ভেঙে পড়েছেন। তার চোখে-মুখে এক অদ্ভুত আতঙ্ক।
-“মিসেস চৌধুরী, আপনার স্বামী আবির চৌধুরী খুন হয়েছেন। আপনি কী জানেন, তিনি ঐশী মিত্র নামে কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়িত ছিলেন?” অয়ন সরাসরি প্রশ্ন করলেন।
নন্দিনী কেঁপে উঠলেন। তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। “হ্যাঁ, স্যার। আমি জানতাম। গত প্রায় এক বছর ধরে ওদের সম্পর্ক চলছিল। আমি অনেকবার প্রতিবাদ করেছি, ঝগড়া করেছি, কিন্তু উনি শুনতেন না।”
-“গতকাল রাতে আপনি কোথায় ছিলেন?”
-“আমি একটি সাহিত্য সভায় যোগ দিতে শহরের বাইরে ছিলাম। রাত ১০টা নাগাদ খবর পেয়েই ফিরে এসেছি।”
অয়নের মনে হলো, এই তিনজনের মধ্যেই কেউ একজন খুনি। আবির চৌধুরীর মৃত্যু কি এই ত্রিকোণ প্রেমেরই চূড়ান্ত পরিণতি?
(৩)
ঐশী মিত্রকে থানায় আনা হলো। তার চোখেমুখে স্পষ্ট শোক, কিন্তু তার মধ্যে এক ধরণের দৃঢ়তাও লক্ষ্য করলেন অয়ন সেন। সে পেশায় একজন শিক্ষিকা, দেখতে শান্তশিষ্ট।
-“মিস মিত্র, আপনি আবির চৌধুরীকে চিনতেন?” অয়ন শান্ত গলায় শুরু করলেন।
ঐশী মাথা নাড়লেন। “হ্যাঁ, চিনতাম। আমি ওনার ছাত্রী। স্যার আমার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতেন। স্ত্রীর সঙ্গে ওনার সম্পর্ক ভালো ছিল না, তা আমি জানতাম। স্যার মানসিকভাবে ভীষণ একাকীত্ব অনুভব করতেন। উনি মেন্টালি ডিপ্রেসড থাকতেন। মানসিক কষ্টের কথা আমার সঙ্গে অনেকবার শেয়ারও করেছেন। আমি ওনার নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য মাঝেমাঝে ওনাকে সঙ্গ দিতাম।”
-“আবির চৌধুরীর সঙ্গে আপনার শেষ কবে কথা হয়েছিল?” অয়ন জিজ্ঞেস করলেন।
ঐশী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “গতকাল রাতে। আমি তার ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম। আমাদের মধ্যে কিছুক্ষণ কথাবার্তা হয়েছিল।”
অয়ন নড়েচড়ে বসলেন। “আপনি কতক্ষণ ছিলেন আবির চৌধুরীর ফ্ল্যাটে?”
-“প্রায় ঘণ্টাখানেক। রাত ৮টা নাগাদ আমি ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসি।”
-“যখন আপনি ফ্ল্যাট থেকে বেরোচ্ছিলেন, আবির চৌধুরী কি তখন জীবিত ছিলেন?”
ঐশী চোখ তুলে অয়নের দিকে তাকালেন। “হ্যাঁ, স্যার। তিনি জীবিত ছিলেন। আমি স্যারকে বিদায় জানিয়েই বেরিয়ে আসি।”
-“আর কেউ ছিল ফ্ল্যাটে?”
-“না, স্যার। আমরা দু’জনই ছিলাম।”
এই বয়ানটা অয়নকে ভাবিয়ে তুলল। যদি ঐশী রাত ৮টা নাগাদ বেরিয়ে আসে, আর আবির চৌধুরী খুন হন রাত ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে, তাহলে ঐশী সরাসরি জড়িত নয়। কিন্তু ফ্ল্যাটের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল, এবং খুনের আগে কোনো ধস্তাধস্তি হয়নি।
-“আবির চৌধুরীর ল্যাপটপটা ফ্ল্যাটে পাওয়া যায়নি। আপনি কি জানেন সেটা কোথায়?” অয়ন জিজ্ঞেস করলেন।
ঐশী কিছুক্ষণ ভাবলেন। “আমি যখন বেরিয়ে আসছিলাম, তখন ল্যাপটপটা স্যারের হাতেই ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘এই ল্যাপটপেই আমার জীবনের হতাশার রহস্য লুকিয়ে আছে।'”
এই তথ্যটা অয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ল্যাপটপটা অবশ্যই খুনের রহস্যের মূল চাবিকাঠি।
ঠিক এই মুহূর্তে সুমিত ফিরে এল। “স্যার, আমরা আবির চৌধুরীর ফ্ল্যাটের বাইরের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করেছি। রাত ৮টা ১৫ মিনিট নাগাদ ঐশী মিত্র ফ্ল্যাট থেকে বেরোচ্ছে। এরপর রাত ৯টা ৩০ মিনিটে একজন লোক ফ্ল্যাটে প্রবেশ করছে।”
অয়ন দ্রুত ফুটেজটা দেখলেন। লোকটি অন্ধকারে ঢাকা, মুখ স্পষ্ট নয়। কিন্তু তার হাতে একটি ছোট ব্যাগ দেখা যাচ্ছে। আর তার হাঁটার ধরন খুব পরিচিত মনে হলো।
-“এই লোকটাকে চিনি আমি,” অয়ন ফিসফিস করে বললেন। “এ তো সুমন দে!”
সুমিত চমকে উঠল। “আবির চৌধুরীর প্রকাশক?”
অয়ন মাথা নাড়লেন। “হ্যাঁ। সুমন দে দাবি করেছিলেন তিনি গতকাল রাতে আবির চৌধুরীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলেন, কিন্তু তিনি ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন।”
অয়ন এবার সুমন দে-কে আবার জেরা করার নির্দেশ দিলেন। সুমন দে-কে আবার থানায় আনা হলো। এবার তার মুখে আর সেই আত্মবিশ্বাসের ভাব নেই, স্পষ্ট ভয় এবং অস্থিরতা।
-“মিস্টার দে, সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, আপনি গতকাল রাত ৯টা ৩০ মিনিটে আবির চৌধুরীর ফ্ল্যাটে প্রবেশ করছেন। আপনি কেন মিথ্যা বললেন যে আপনি ফ্ল্যাটে যাননি?” অয়নের গলার স্বর হিমশীতল।
সুমন দে’র মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। “আমি… আমি তখন… একটা দরকারি কাজে গিয়েছিলাম।”
-“কীসের দরকারি কাজ, মিস্টার দে? আবির চৌধুরী খুন হয়েছেন। আপনার মিথ্যা বলার কারণ কী?”
সুমন দে চুপ করে রইলেন। তার নীরবতা যেন অনেকটাই স্বীকারোক্তির মতো শোনাচ্ছিল।
-“আপনি কি আবির চৌধুরীর ল্যাপটপটা নিয়ে গেছেন?” অয়ন সরাসরি প্রশ্ন করলেন।
সুমন দে কেঁপে উঠলেন। “আমি… আমি ল্যাপটপ নিইনি। আমি কিছুই জানি না!”
এই মুহূর্তে অয়নের মনে হলো, সুমন দে শুধু মিথ্যাই বলছেন না, বরং ল্যাপটপটি তিনি গায়েব করে ফেলেছেন। অয়নের মনে পড়ল, আবির চৌধুরী তার ল্যাপটপেই তার জীবনের হতাশার রহস্য লুকিয়ে রেখেছেন। তাহলে কি সুমন দে সেই সত্যিটা লুকানোর জন্য আবিরকে খুন করেছেন? সুমন দে’র মিথ্যাচার এবং সিসিটিভি ফুটেজ, সব মিলিয়ে অয়ন সেনের সন্দেহ সুমন দে-র দিকেই নিবদ্ধ হলো। কিন্তু সায়ানাইডের মতো বিষ এবং ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে বন্ধ দরজা, এই দুটি বিষয় তাকে ভাবিয়ে তুলছিল।
-“মিস্টার দে, আপনি কেন আবির চৌধুরীর ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন গতকাল রাতে?” অয়ন সরাসরি প্রশ্ন করলেন।
সুমন দে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “আমি… আমি আবিরের সঙ্গে একটা নতুন বইয়ের বিষয়ে কথা বলতে গিয়েছিলাম। সে আমাকে বলেছিল, খুব জরুরি কথা আছে।”
-“আর ল্যাপটপটা? আপনি কেন সেটা নিয়ে গেছেন?”
সুমন দে কিছুক্ষণ নীরব রইলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আবির আমাকে ল্যাপটপটা দিতে চেয়েছিল, স্যার। সে বলেছিল, ‘আমার জীবনের অনেক সত্যি এই ল্যাপটপে আছে। যদি আমার কিছু হয়, তুমি এটা রক্ষা করো।'”
অয়নের মনে হলো, সুমন দে কোন চালাকি করছেন। কারণ আবির চৌধুরীর মৃত্যু তার জন্য বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।
-“আপনি কি সেই ল্যাপটপটা নিয়ে এসেছেন?” অয়ন জিজ্ঞেস করলেন।
সুমন দে মাথা নাড়লেন। “না, স্যার। আমি ল্যাপটপটা নিই নি। আমি কোন জটিলতার মধ্যে জড়াতে চাই নি। ভয় পেয়ে চলে গিয়েছিলাম।”
অয়ন সুমিতকে ইশারা করলেন। সুমিত সুমন দে’র বাড়িতে তল্লাশি করার জন্য রওনা হলো।
এরপর অয়ন আবির চৌধুরীর স্ত্রী নন্দিনী চৌধুরীকে আবার ডাকলেন। তার চোখেমুখে এখন গভীর উদ্বেগ।
-“মিসেস চৌধুরী, আপনি কি জানেন, আপনার স্বামী আবির চৌধুরী তার ল্যাপটপে কী রাখতেন?” অয়ন জিজ্ঞেস করলেন।
নন্দিনী মাথা নাড়লেন। ” আমি জানি না, স্যার। উনি ওটা সবসময় নিজের কাছেই রাখতেন।”
-“আবির চৌধুরীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল? আর ঐশী মিত্রের সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়ে আপনি কী জানতেন?”
নন্দিনী চোখ নামিয়ে নিলেন। “আমাদের সম্পর্ক ভালো ছিল না, স্যার। ঐশী মিত্রের সঙ্গে ওর সম্পর্ক নিয়ে আমাদের প্রায়ই ঝগড়া হতো। আমি ওকে বারবার বারণ করেছি।”
ঠিক এই মুহূর্তে সুমিত ফিরে এল। তার হাতে একটি ল্যাপটপ। “স্যার, ল্যাপটপটা আমরা সুমন দে’র বাড়ির বাগান থেকে পেয়েছি। মাটির নিচে পুঁতে রাখা ছিল।”
অয়ন ল্যাপটপটা হাতে নিলেন। সুমন দে মিথ্যা বলেছিলেন। তিনি ল্যাপটপটি লুকিয়ে রেখেছিলেন।
অয়ন দ্রুত ল্যাপটপটি ফরেনসিকে পাঠালেন, ফাইলগুলো ডিকোড করার জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফরেনসিক টিম থেকে ফোন এলো। “স্যার, ল্যাপটপে কিছু এনক্রিপ্টেড ফাইল পাওয়া গেছে। মনে হচ্ছে, এগুলো আবির চৌধুরীর ব্যক্তিগত ডায়েরি। আর কিছু ছবি।”
অয়ন দ্রুত ডায়েরি এবং ছবিগুলো দেখলেন। সেখানে আবির চৌধুরীর জীবনের শেষ কিছু দিনের ঘটনা বর্ণনা করা ছিল। তিনি বলছিলেন, কীভাবে তার ব্যক্তিগত জীবন জটিল হয়ে উঠেছে। ঐশী মিত্রের প্রতি তার ভালোবাসা, এবং নন্দিনী চৌধুরীর সঙ্গে তার দাম্পত্য জীবনের সমস্যা।
কিন্তু একটি ছবি দেখে অয়নের চোখ কপালে উঠল। সেই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, নন্দিনী চৌধুরী এবং সুমন দে দু’জনই একে অপরকে আলিঙ্গন করছেন। তাদের সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ! এই ছবিটা দেখে অয়ন বুঝতে পারলেন, এই ত্রিকোণ প্রেমের রহস্য আরও গভীরে। নন্দিনী চৌধুরী এবং সুমন দে-র মধ্যে একটি গোপন সম্পর্ক ছিল। আর এই সম্পর্কই হয়তো আবির চৌধুরীর মৃত্যুর কারণ।
অয়ন দ্রুত নন্দিনী চৌধুরী এবং সুমন দে-কে আবার জেরা করার নির্দেশ দিলেন। তাদের দু’জনকেই মুখোমুখি বসানো হলো।
-“মিসেস চৌধুরী, মিস্টার দে, এই ছবিগুলো আপনারা দেখুন,” অয়ন ছবিগুলো তাদের সামনে রাখলেন। তাদের দু’জনের মুখই ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তাদের মধ্যে নীরবতা।
-“আপনারা দু’জনই মিথ্যা বলেছেন। আপনাদের দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক ছিল, তাই না?” অরিত্রের গলার স্বর কঠোর হলো।
নন্দিনী এবং সুমন দু’জনেই মাথা নিচু করলেন। তাদের নীরবতা যেন অনেকটাই স্বীকারোক্তির মতো শোনাচ্ছিল।
-“আপনারাই কি আবির চৌধুরীকে খুন করেছেন?” অয়ন সরাসরি প্রশ্ন করলেন।
তাদের চোখে আতঙ্ক ফুটে উঠল। তারা একে অপরের দিকে তাকালেন। তাদের নীরবতা যেন এক নতুন রহস্যের ইঙ্গিত দিচ্ছিল।
(৪)
নন্দিনী চৌধুরী এবং সুমন দে-র গোপন সম্পর্ক উন্মোচিত হওয়ার পর অয়ন সেনের কাছে খুনের রহস্যের জট অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেল। তিনি জানতেন, এই সম্পর্কই আবির চৌধুরীর মৃত্যুর মূল কারণ। কিন্তু সায়ানাইডের মতো বিষ, এবং ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে বন্ধ দরজা, এই দুটি বিষয় এখনও অয়নকে ভাবাচ্ছিল।
অয়ন সেন নন্দিনী চৌধুরী এবং সুমন দে-কে আবার জেরা করলেন। তাদের মুখে এখন আর কোনো লুকোচুরি নেই, শুধু ভয় আর অনুশোচনা।
-“আপনারা দু’জনই কেন আবির চৌধুরীকে খুন করলেন?” অয়ন সরাসরি প্রশ্ন করলেন।
নন্দিনী কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমি খুন করিনি, স্যার। বিশ্বাস করুন। সুমন আর আমার সম্পর্ক আবির জেনে গিয়েছিল। ও আমাদের সম্পর্ক শেষ করতে চেয়েছিল। আর বলেছিল, সব ফাঁস করে দেবে।”
সুমনের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। “হ্যাঁ স্যার। আবিরদা আমাদের সম্পর্কটা জেনে গিয়েছিল। ও খুবই রেগে গিয়েছিল। হুমকি দিচ্ছিল যে সব ফাঁস করে দেবে এবং নন্দিনীকে ডিভোর্স দেবে। আমরা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
-“তাহলে খুনটা কে করল? আর সায়ানাইড কোথা থেকে এল?” অয়ন জিজ্ঞেস করলেন।
নন্দিনী এবং সুমন দু’জনেই নীরব রইলেন।
ঠিক এই মুহূর্তে সুমিত দৌড়ে এলো। “স্যার, আমরা আবির চৌধুরীর ফ্ল্যাটের বাইরের সিসিটিভি ফুটেজ আবার চেক করেছি। রাত ৯টা ৪০ মিনিটে, আবির চৌধুরীর কাজের লোক মহেশ ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকছে। আর প্রায় রাত ১০টা নাগাদ, সে আবার বেরিয়ে যাচ্ছে।”
অয়নের চোখ কপালে উঠল। মহেশ! কাজের লোক মহেশ দাবি করেছিল সে ফ্ল্যাটের ভেতরেই ছিল, এবং কাউকে ঢুকতে বা বেরোতে দেখেনি।
-“মহেশকে এখুনি নিয়ে এসো!” অয়ন নির্দেশ দিলেন।
মহেশকে থানায় আনা হলো। তার মুখটা ভয়ে নীল হয়ে গেছে।
-“মহেশ, তুমি কেন মিথ্যা বললে যে তুমি ফ্ল্যাট থেকে বেরোওনি?” অয়ন সরাসরি প্রশ্ন করলেন।
মহেশ কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমি… আমি বেরোইনি, স্যার।”
-“সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে তুমি ফ্ল্যাট থেকে বেরোচ্ছ। তুমি কেন মিথ্যা বলছ?”
মহেশ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। “আমি… আমিই খুন করেছি, স্যার।”
এই স্বীকারোক্তি শুনে নন্দিনী এবং সুমন দুজনেই চমকে উঠলেন।
-“তুমি কেন খুন করলে আবির চৌধুরীকে?” অয়ন শান্ত কিন্তু কঠোর গলায় প্রশ্ন করলেন।
মহেশ কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আবির সাহেব… সম্প্রতি ওনার চরিত্রদোষ ঘটেছিল। উনি আমার স্ত্রীকে কাজের অছিলায় ডেকে প্রায়ই বিরক্ত করতেন। ওনার কাছে লাঞ্ছিতা হয়ে আমার স্ত্রী আমার কাছে কান্নাকাটি করত। আমি ওনাকে অনেকবার বারণ করেছি, কিন্তু উনি শোনেন নি।”
-“তুমি কীভাবে খুন করলে আবির চৌধুরীকে? আর সায়ানাইড কোথা থেকে পেলে?”
-“আমি একজন কৃষকের কাছ থেকে সায়ানাইড সংগ্রহ করেছিলাম, স্যার। ইঁদুর মারার কথা বলে। আমি জানতাম আবির সাহেব রাতে লেখার ঘরে বসে জল খেতেন। আমি তার গ্লাসে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর তাড়াতাড়ি ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে রেখে গিয়েছিলাম, যাতে মনে হয় তিনি নিজেই বিষ পান করেছেন।”
অয়নের মনে পড়ল, জলের গ্লাস থেকে যে মিষ্টি গন্ধ আসছিল, সেটা সায়ানাইডেরই হতে পারে। আর ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে বন্ধ দরজার রহস্যও এবার পরিষ্কার। মহেশ ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে এসেছিল, যাতে কেউ তাকে সন্দেহ না করে।
এই জটিল প্রেমের রহস্যের সমাধান হলো এক অপ্রত্যাশিত মোড়কে। আবির চৌধুরীর সম্পর্ক ছিল ঐশী মিত্রের সঙ্গে। তার স্ত্রী নন্দিনী চৌধুরীর সঙ্গে সুমন দে-র গোপন সম্পর্ক ছিল। কিন্তু খুনি ছিল আবিরের কাজের লোক মহেশ, যে তার স্ত্রীর উপর আবিরের অন্যায় আচরণের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল।
আইন তার নিজস্ব পথে চলে। মহেশকে গ্রেপ্তার করা হলো খুনের দায়ে। নন্দিনী চৌধুরী এবং সুমন দে-কেও শাস্তি দেওয়া হল তথ্য গোপনের জন্য।
অয়ন সেন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই মামলাটা তার মনে এক নতুন দাগ কেটে গেল। মানুষের সম্পর্কের জটিলতা, গোপন প্রেম, প্রতিশোধের আগুন – সবকিছু মিলেমিশে এক মর্মান্তিক পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে, তারই এক বিচিত্র উদাহরণ হয়ে রইল এই ‘জটিল প্রেমের রহস্য’।
আবির চৌধুরী হত্যারহস্য গোয়েন্দা গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
অ্যালার্মের ভাষা
চা-বেলার চৌকাঠ
অরুন্ধতির নীল চিঠি