বেল ফুলের গন্ধ রহস্য গল্প – শম্পাশম্পি চক্রবর্তী
বেশ সকাল আন্দাজ ছ’টা হবে । ঘরের মাঝ বরাবর রাখা সেন্টার টেবিলে ওপর মোবাইল ফোন টা বেজে উঠতে ঘুম টা ভেঙে গেল পদ্মিনী’র। গতকাল রাতে বাড়ি ফিরতে বেশ দেরি হয়েছিল কারণ একটি কেসের সুন্দর সমাধান হয়েছে তার হাত দিয়ে। ভাবতেও অবাক লেগেছিল তার, সে কেমন করে পাড়ল কেস টা সমাধান করতে মাত্র কয়েক দিন আগে প্রাইভেট ডিটেক্টিভ হয়ে?
হ্যাঁ সে একজন প্রাইভেট ডিটেক্টিভ। স্বামী সুজয়ের কথায় ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। তবে গতকাল সকলের মাঝে পুলিশ কমিশনার অনিমেষ আইচ যখন তার হাতে রজনীগন্ধা ফুলের তোড়া টা তুলে দিতে গিয়ে বলেছিলেন “– মিসেস পদ্মিনী চ্যাটার্জী আপনি যা করে দেখালেন তাবড় তাবড় পুলিশ অফিসার ও ফেলিওর। আপনার বুদ্ধি প্রশংসনীয়। আপনি এমনভাবেই এগিয়ে চলুন আপনার প্রয়োজনে কলকাতার পুলিশ ডিপার্টমেন্ট আপনার পাশে সব সময় থাকবে।”
এক সামান্য গৃহবধূর রহস্য উদঘাটন ক্ষমতা এ কোনো ছোট ব্যাপার ছিল না বিশেষ করে যেখানে দিন রাত তাকে শুনতে হয়েছে “– নিজেকে কী মনে করো? ব্যোমকেশ বক্সী না কী ফেলু দা? দু’ একটা ডিটেক্টিভ গল্প পড়লেই ডিটেক্টিভ হওয়া যায় না চাই বুদ্ধি যা তোমার নেই।” কথাগুলি স্বামী সুজয়ের । পদ্মিনী নীরব থেকে যায় কারণ তার আত্মবিশ্বাস আছে সে তার বুদ্ধি দিয়ে কঠিন থেকে কঠিনতম সমস্যার সমাধান করতে পারবে। ছোট বয়স থেকে অনেক ছোট ছোট সমস্যার সমাধান করে আসছে সে, তাহলে এখন পারবে না কেন?
যাইহোক যে কেস টা নিয়ে এই গল্প সেই কেসটা নিয়ে একদিন দুপুরে ছুটে এসেছিল চাণক্য যে সুজয়ের মাসতুতো ভাই মানে পদ্মিনী’র সম্পর্কে দেওর। কেন জানা নেই চাণক্য ‘র ধারণা হয়েছিল পদ্মিনী’ ই পারবে এই কেস টা সমাধান করতে। কারণ সে পদ্মিনী’র অনেক ছোট ছোট কাজ দেখেছে যেমন বেহালায় তাদের মামার বাড়ি ‘র কুলদেবতা সোনার মদনমোহন চুরি হয়ে গেলে পুলিশও যখন অকৃতকার্য হয় উদ্ধার করতে তখন উদ্ধার করেছিল পদ্মিনী এবং তা সেজ মামা’র বাক্স থেকে । অভাবের তাড়নায় সেজো মামা সেটি চুরি করেছিলেন। বলা যায় সেই থেকেই চানক্য পদ্মিনী’কে লেডি ডিটেক্টিভ বলে ডাকাও শুরু করেছিল। নিজে পুলিশের উঁচু পোস্টে থাকলেও মাঝে মধ্যেই কোনো কেস সমাধান করতে গেলে পদ্মিনী’র স্মরণাপন্ন হতেই হয় চাণক্য কে। সুজয় অবশ্য ব্যাপারটাকে মজার চোখে দেখে বলে “— তুই আর লোক পাস না! পদ্মিনী করবে তোদের কেসের সমাধান?” চাণক্য প্রত্যুত্তরে হাসে মাত্র।
সেদিন চাণক্য পদ্মিনী’র কাছে এসে বলেছিল”— বৌদি এটা কিডন্যাপ কেস। ভদ্রলোক বেশ বৃদ্ধ। বয়স সত্তরের মতো । কসবায় একটি ফ্ল্যাটে তাঁর স্ত্রী কে নিয়ে থাকেন। এক ছেলে তাঁর বৌ কে নিয়ে আমেরিকায়। ভদ্রলোক শারীরিক দিক থেকে সুস্থ হলেও স্ত্রী অসুস্থ বলা যায় দীর্ঘ কয়েক বছর রোগশয্যায়। ঘটনাটা হলো মাস খানেক আগে ভদ্রলোক সন্ধ্যে বেলায় দোকানে কিছু কিনতে গেলে ফিরে এসে দেখেন তাঁর স্ত্রী ঘরে নেই। স্ত্রী ‘র বিছানা ছেড়ে ওঠার ক্ষমতা বিন্দুমাত্র নেই। তাহলে গেল কোথায়? অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কোনো ফল মেলেনা। একজন ষাট বছরের বৃদ্ধা যে কি না দীর্ঘ পাঁচ বছর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না সে কর্পূরের মতো উধাও! এ ও কি সম্ভব? এখন কথা হচ্ছে, যে করেই হোক বৃদ্ধ ‘ র কাছে বৃদ্ধা কে ফিরিয়ে দিতে হবে। নইলে বৃদ্ধ নিশ্চিত মৃত্যুর পথ বেছে নেবেন।”
চাণক্য ‘র থেকে সবটুকু শুনে পদ্মিনী বলে উঠেছিল ‘— সে তো বুঝলাম কিন্তু আমি কি পারবো এমন একটা জটিল সমস্যার সমাধান করতে? তোমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট যেখানে সমাধান করতে অপরাগ !! “
“— হ্যাঁ পারবে বৌদি। এখন আমার সাথে চলো ওই বৃদ্ধ “র বাড়ি। না গেলে তোমার পক্ষে তদন্ত শুরু করা কঠিন হবে। আমি গাড়িতে গিয়ে বসছি।
তুমি তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে এসো।
অগত্যা চাণক্য ‘র একান্ত অনুরোধে পদ্মিনী উপস্থিত হয়েছিল ঢাকুরিয়া এলাকায় প্রায় চার কাঠা জমির ওপর গড়ে ওঠা বাড়িটিতে। বাড়ি ‘র পুরাতন চাকর বছর পঞ্চাশের নকুল পদ্মিনী আর চাণক্যকে বাড়ির প্রধান গেটের সামনে উপস্থিত হতে দেখে ছুটে আসে এবং তখনি সাথে করে নিয়ে যায় বৈঠকখানা ঘরটির সামনে। ঘরের মাঝ বরাবর রাখা ইজিচেয়ারটাতে গা এলিয়ে দিয়ে এক প্রকার ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বৃদ্ধ নিখিলেশ সান্যাল। নামগুলো চাণক্য’র থেকেই জেনেছিল পদ্মিনী । নকুল ঘরের মধ্যে ঢুকে বৃদ্ধ কে ‘বাবু “সম্বোধন করে ডেকে উঠলে বৃদ্ধ ‘র আচমকা ঘুম টা ভেঙে যায়। ইজিচেয়ার ছেড়ে শরীর টা দ্রুত তুলে নেন সুঠাম দেহের অধিকারী বৃদ্ধ নিখিলেশ সান্যাল। ঘরের একধারে কালো রঙের সোফা টা দেখিয়ে বসতে বলেন পদ্মিনী আর চাণক্য কে।
পদ্মিনী ঘরের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে উঠেছিল “– নমস্কার আমি পদ্মিনী চ্যাটার্জী। প্রাইভেট ডিটেক্টিভ। আমি যতটুকু জেনেছি নিখিলেশ বাবু তা হলো ঘটনাটা ঘটে মাস খানেক আগে। সকালের দিকে থানাতে ফোন করে খবরটা জানায় আপনার কাজের লোক নকুল। বলে নিখিলেশ সান্যাল মানে আপনি একজন অবসর প্রাপ্ত সরকারী কর্মচারী আপনার স্ত্রী বিমলা দেবী কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না আগের রাত থেকে। রোজকার মতো সকালে নকুল ও বিমলা দেবী’র জন্য নিযুক্ত আয়া শোভা দাস এ বাড়িতে কাজ করতে এসে দেখে আপনি মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন । আপনাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে নকুল আর শোভা দু’জনেই ভয় পেয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ নকুল আপনাকে ওভাবে বসে থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করাতে দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ওঠেন আপনি । বেশ কিছুক্ষণ পরে বলে ওঠেন “– গতকাল সন্ধ্যা বেলা শোভা চলে যাওয়ার কিছু পরে আপনি দোকানে বেড়িয়ে ছিলেন। বাড়ি ফিরে দেখেন স্ত্রী বিমলা দেবী ‘র ঘরের দরজা খোলা বিছানায় তিনি নেই। নকুল আপনার থেকে বিমলা দেবী’র অন্তর্ধানের কথা শুনে তখনি থানায় ফোন করে তারপর এই একমাস ধরে তন্নতন্ন করে খুঁজেও পুলিশ ডিপার্টমেন্ট সম্পূর্ণ রূপে হতাশ কারণ বিমলা দেবী’র কোনো খোঁজ এই একমাসে পাওয়া যায় নি। এখন কথা হচ্ছে ওনাকে কিডন্যাপ করে কার কী লাভ?”
–” লাভ বা লোকশান বুঝি না ম্যাডাম পুলিশ ডিপার্টমেন্ট যে নিতান্তই অপদার্থ কিছু পুলিশ অফিসার কে নিয়ে গড়ে উঠেছে তার উদাহরণ বেশ ভালো করেই চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি । আজ দীর্ঘ এক মাস হয়ে গেল আমার স্ত্রী নিখোঁজ অথচ আপনাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট নপুংসক হয়ে রয়ে আছে।।
পদ্মিনী তৎক্ষণাৎ প্রসঙ্গ বদলে শান্ত কন্ঠস্বরে বলে উঠেছিল”— আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো নিখিলেশ বাবু ? বাড়ি ‘র কাছে কি কোনো বেলফুলের গাছ আছে? বেশ সুন্দর গন্ধ আসছে। বর্ষাতে এই ফুলের খুব কদর। সাদা সাদা ছোট আকারের মিষ্টি গন্ধে টইটুম্বুর বেলফুল আমার ভীষন প্রিয়। “
নিখিলেশ সান্যাল আলতো করে মাথাটা হেলিয়ে বলে উঠেছিলেন”– হ্যাঁ এই ঘরটার পেছনেই আছে
বেলফুলের গাছ । বয়স বেশি নয় এক মাসের মতো। বর্ষা’র মৌসুম। গাছ ভরা বেলফুল আর তার সুবাস যাতে বাড়ির সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে সে জন্যই বাজার থেকে কিনে এনে লাগিয়েছিলাম।”
পদ্মিনী মৃদু হেসে পুনরায় প্রসঙ্গ টেনে বলে উঠেছিল “— যাইহোক প্রশ্নে আসি। আচ্ছা নিখিলেশ বাবু আপনার স্ত্রীর সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল? কারণ শুনলাম আপনার স্ত্রী দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন। একজন আয়া তার দেখাশোনা করতো। আপনার বিরক্ত লাগতো না এতো বছর ধরে একজন মানুষ রোগ শয্যায় তাঁকে চোখের সামনে দেখতে । মন কোনো সময় চাইতো না স্ত্রী ‘র এবার মৃত্যু হোক? “
নিখিলেশ সান্যাল স্মিত হাসি হেসে বলে উঠেছিলেন “– আমি এখন সত্তর বছরের বৃদ্ধ। জীবনের শেষ ক’টাদিন চেয়েছিলাম বিমলা কে নিয়েই কাটিয়ে দেবো। ছেলেটা আমেরিকাতে থাকে। ওর সাথে যোগাযোগ ফোন নয়তো কম্পিউটারে। স্ত্রী ছাড়া আমার উপায় কি ম্যাডাম।”
“– আপনাকে আরো কিছু প্রশ্ন করবো দয়া করে সঠিক উত্তর দেবেন ।”
“– অবশ্যই। আপনি প্রশ্ন করুন। আমি আপনাদের সাহাযার্থে সঠিক উত্তর দেবো।”
একটি ডায়েরি ব্যাগ থেকে বার করে পদ্মিনী তারপর নিখিলেশ সান্যাল কে প্রশ্ন করে গিয়েছিল একের পর এক।
—” আপনাদের বিয়ে কতো বছর হয়েছে?’
–” এই চল্লিশ বছর।”
–” আপনাদের সন্তান?”
“— একটিমাত্র ছেলে আমেরিকায় থাকে সস্ত্রীক।”
–” আপনার সাথে কারো শত্রুতা? “
“— জীবনে কারো কোনো ক্ষতি করিনি যে শত্রু হবে।”
—” আপনার স্ত্রী সম্পর্কে কিছু যদি বলেন তাহলে তদন্ত করতে সুবিধা হয়”।
“— আমার স্ত্রী বিমলা বেনারসের মেয়ে। ভীষণ ভালো নাচতে পারতো কিন্তু ছেলে কে মানুষ করতে গিয়ে ও নাচ বন্ধ করে দেয়। পরে দীর্ঘ সময় পর ও আমার একান্ত ইচ্ছেতে পুনরায় নাচ শুরু করে আর তা বয়সকাল পর্যন্ত ধরে রেখেছিল। কিন্তু নাচ যে ওর জীবনে চরম দুর্ভাগ্য নিয়ে আসবে তা আমার বা ওর কারো জানা ছিল না। সেদিন ছিল কলকাতার একটি নামী মঞ্চে ওর নাচের অনুষ্ঠান। বয়স হয়েছে। শরীরে সে জোর নেই কিন্তু নাচের প্রতি আগ্রহ একটু ও কমেনি ওর আর তার ফলস্বরূপ স্টেজে নাচতে উঠে ও নিজেও বুঝতে পারে না ওর শরীর নাচতে আর সক্ষম নয় একটা সময় শরীর আর নাচের ধকল না নিতে পেরে ও ছিটকে পড়ে যায়। কলকাতার একটি হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলে এক্সরে রিপোর্ট আসে নিম্নাঙ্গে প্যারালিসিস। ডাক্তার জানিয়ে দেন কোনো ভাবেই ওর বিছানা ছেড়ে ওঠা সম্ভব নয় ।
তারপর থেকেই,,,,,”
—” আচ্ছা শেষ প্রশ্ন ? আপনার ছেলে তাঁর
মায়ের অন্তর্ধানের খবর পেয়েছেন “?
“— না এখনো দেওয়া হয় নি তবে এবার দিতে হবে। ও ওর মা কে ভীষণ ভালোবাসে। ভাবছি খবর টা শুনলে ওর মনের অবস্থা কতোটা কি হতে পারে। সে জন্যই দিতে সাহস পাচ্ছি না।”
“— ঠিক আছে নিখিলেশ বাবু চিন্তা করবেন না। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করবো বিমলা দেবী কে খুঁজে বের করতে। ” পদ্মিনী কথাগুলি বলে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। সাথে সাথে চাণক্য ও।
২
রাতে কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না পদ্মিনী’র। বেলফুলের সুমিষ্ট গন্ধ যেন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। মনে মনে ঠিক করে নেয় পরের দিনই আবার সে যাবে সান্যাল বাড়িতে। আরো কিছু জানার দরকার।
পরের দিন বেলার দিকে নিজের স্কুটি টা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল পদ্মিনী।
গন্তব্যস্থল সান্যাল বাড়ি।
বাড়ি টা’র বিশালাকার গেট টা ঠেলে স্কুটি টা
একপাশে রেখে দু’ধারে বাগান মাঝে সরু পথ টা দিয়ে খানিকটা এগোতেই পদ্মিনী “র চোখ চলে গেল বৈঠকখানা ঘরের পিছনের দিকের অংশটুকুতে যেখানে নরম মাটির ওপর বেড়ে উঠেছে বেলফুলের গাছটা। গাছের ফাঁকে ফাঁকে থোকা থোকা শ্বেতশুভ্র বেলফুল। পদ্মিনী এগিয়ে গেল গাছটির কাছ বরাবর। চোখে বিস্ময়। নিখিলেশ সান্যাল গাছের পাতা গুলিতে সস্নেহে হাত বোলাচ্ছেন যেন গাছটি তাঁর বড় আপনজন। পদ্মিনী’র নিখিলেশ বাবু কে দেখে সেই মুহূর্তে বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, বৃদ্ধ এই বয়সে এসে একাকিত্ব বোধ করছেন। অজানা, চিন্তা,ভয় মানুষ টা কে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। হয়তো সেজন্য’ই গাছ পালার মাঝে নিজেকে ব্যস্ত রেখে ভুলে থাকতে চান তাঁর ভালোবাসার মানুষ টা’র হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট।
—” নিখিলেশ বাবু।”
শান্ত কন্ঠস্বরে পদ্মনী ডেকে উঠলে, পদ্মিনী’র কন্ঠস্বর কানে যেতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠে বলে উঠেছিলেন নিখিলেশ সান্যাল “– আপনি! আপনার আবার আসার কি প্রয়োজন পড়লো ম্যাডাম?”
—” নিখিলেশ বাবু আমি একবার আপনার বাড়ির কাজের লোক নকুলের সাথে কথা বলতে চাই।”
নিখিলেশ সান্যালের চোখেমুখে অদ্ভুত বিরক্তি প্রকাশ পেল যা পদ্মিনী’র দৃষ্টি এড়ালো না।। নিজেকে যথাসাধ্য স্বাভাবিক রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে নকুলের নাম ধরে বার কয়েক ডাক দিতেই নকুল উপস্থিত হলো।
পদ্মিনী কে পুনরায় আসতে দেখে নকুল ও অবাক হয় যেমন নিখিলেশ সান্যাল হয়েছিলেন। খানিক মাথা চুলকে নিয়ে বলে উঠেছিল নকুল “– দিদিমণি চা,কফি কিছু দেবো?
“— না ওসব কিছু লাগবে না। নকুল আমি তোমার কাছে এসেছিলাম বিশেষ প্রয়োজনে। তুমি যদি শোভা নামে ভদ্রমহিলা টি কে ও একবার ডেকে নিয়ে গেটের ওদিক টা যদি আসো ভালো হয়।”
–” শোভা দি তো বোবা দিদিমণি।”
–” ও আচ্ছা। তাহলে তুমি ই একা এসো।”
নকুল পদ্মিনী’র পিছু পিছু বাড়ির মেইন গেটের দিকে এগিয়ে গেলে পদ্মিনী এদিক ওদিক তাকিয়ে বেশ নিচু কন্ঠস্বরে বলে উঠেছিল “– তুমি একটা সত্য কথা বলবে নকুল?”
“–কী বলবো দিদিমণি?”
“— এই তোমার মণিবের সাথে গিন্নী মায়ের সম্পর্কের কথা।”
“– আপনি যা প্রশ্ন করেছেন তার উত্তর হলো ওনারা একে অপরকে খুব ভালো বাসতেন।
তাই তো,,,,”
“—” তাই তো কী নকুল? আমার মনে হচ্ছে তুমি কিছু লুকিয়ে যাচ্ছো বলো নকুল বলো?”
কান্নায় ভেঙে পড়লো নকুল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নকুল নিজের ফতুয়ার পকেট থেকে একটি ছোট আকারের কীটনাশক ওষুধের শিশি আর একটি ছোট আকারের টেপ রেকর্ডার বার করে দ্রুত পদ্মিনী ‘র হাতের মধ্যে দিয়ে বলে উঠেছিল”— আপনি আসবেন আমি জানতাম। পুলিশ কে দিতে ভরসা পাই নি তাই আপনাকে দিলাম। দিদিমণি বুড়ো বাবু বা আমি কেউ চাইনি গিন্নী মা চলে যাক। বুড়ো বাবু বড্ড ভালোমানুষ তার অসহায়তা আমি দেখেছি দিদিমণি। এ ছাড়া ওঁর আর কিছু করার ছিল না। ‘ কথাগুলি বলে চলে গিয়েছিল নকুল। পদ্মিনী ও শিশি আর টেপ রেকর্ডার ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে কিছু মনে পড়াতে পুনরায় এগিয়ে গিয়েছিল বেলফুলের গাছ টা’র
দিকে । নিখিলেশ সান্যাল তখনো সেখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পদ্মিনীকে আবারো আসতে দেখে নিখিলেশ সান্যাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠেছিলেন “— আপনার সাথে নকুলের দেখা হয়েছে? শোভা’র সাথে? কথা বলেছেন নকুলের সাথে? শোভা অবশ্য বোবা ও কিছু বলতে পারবে না। একটা কথা সামনের মাসেই আমার ছেলে আমেরিকা থেকে ফিরছে ও আশাকরি ও যেন ওর মা কে ফিরে এসে দেখতে পায় দেখবেন ম্যাডাম। “
পদ্মিনীকে যে জন্য পুনরায় ফিরে আসতে বাধ্য করেছিল তা হলো মাটি। বেলফুলের গাছের গোড়ায় যতোটা মাটি দেওয়ার কথা তার চাইতে অনেক বেশি মাটি দিয়ে উঁচু করা হয়েছে। অথচ নিখিলেশ সান্যালের বাগানের চারিপাশে যতোগুলি গাছ রয়েছে সব গাছ গুলির গোড়ায় মাটির পরিমাণ প্রয়োজন মতো।বিস্ময়ের সাথে পদ্মিনী প্রশ্ন করে উঠেছিল “— আচ্ছা নিখিলেশ বাবু গাছটার গোড়ায় অতো মাটি কেন? আপনার বাগানে তো অতো গাছ যার গোড়ায় পরিমাণ মতো মাটি ! শুধু এই বেলফুলের গাছের গোড়ায় অতো মাটি? “পদ্মিনী’র প্রশ্নে বেশ চমকে উঠেছিলেন নিখিলেশ সান্যাল। নিজেকে মুহূর্তের মধ্যে সামলে নিয়ে হেসে বলে উঠেছিলেন”– আসলে এটা নকুলের কাজ। যত পেরেছে মাটি দিয়েছে। ভাবছি গাছ গুলোর পরিচর্যার জন্য মালি রাখবো। নকুল ঠিক পাড়েনা।” পদ্মিনী স্মিত হাসি হেসে যেমন এসেছিল তেমনি দ্রুত চলে গিয়েছিল।
পরের দিন চাণক্য,সুজয় এবং পুলিশ অফিসার রণজিৎ সেন যিনি চাণক্য’র ঊর্দ্ধতন সকল কে নিখিলেশ সান্যালের বাড়িতে ডেকে পাঠানোর অনুরোধ করলো পদ্মিনী চাণক্য কে দিয়ে।
যথা সময়ে সকলে নিখিলেশ সান্যালের বাড়িতে উপস্থিত হলে পদ্মিনী কোনো ভূমিকা না করে সকলের উদ্দেশ্যে বলে উঠেছিল “– আপনারা সকলেই আমার সাথে বৈঠকখানা ঘরের পেছনে আসুন যেখানে আছে একটি বেলফুলের গাছ।” ” সকলেই অবাক হলো এর ওর মুখের দিকে তাকালো সেই মুহূর্তে।
পদ্মিনী নকুল কে একটি শাবল বা ওই জাতীয় কিছু আনতে বললে নকুল প্রথমটা আনতে চায় না পরে পদ্মিনী’র ধমকে তখনি একটি শাবল নিয়ে আসে ও পদ্মিনী’র নির্দেশে সোজা সেটি নিয়ে উপস্থিত হয় বেলফুলের গাছের কাছে। সবাই কে আশ্চর্য করে দিয়ে পদ্মিনী’র কথামতো যেই মাত্র সে বেলফুলের গাছের গোড়ায় আঘাত হানতে যাবে নিখিলেশ সান্যাল ওর হাত টা চেপে ধরে বলে উঠেছিলেন “— কী করছিস নকুল? তুই জানিস না তোর গিন্নী মা কতো আরামে ওখানে রয়েছে। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে যে যন্ত্রণা তাকে সহ্য করতে হয়েছে তার হাত থেকে মুক্তি পেতেই তো এই মাটির তলায় আশ্রয় নিয়েছে।” নকুল নিখিলেশ সান্যালের কথাগুলি ‘র প্রত্যুত্তরে ম্লান হাসি হেসে চোখের কোণ দুটো মুছে নিয়ে ক্রমাগত মাটিতে কোপ বসাতে লাগলো আর কিছু সময়ের মধ্যেই মাটি খনন শেষ হলে সকল কে অবাক করে দিয়ে দেখা দিল একটি কঙ্কাল।
পদ্মিনী সেই মুহূর্তে সকলের উদ্দেশ্যে বলে উঠেছিল—“এই হলো বিমলা দেবী ‘র অন্তর্ধান রহস্য। “
দিন দু’য়েক বাদে।
— “সকলের কাছে সবিস্তারে এইবার ঘটনাটা বলা যাক। ” নিখিলেশ সান্যালের বৈঠকখানা ঘর। শ্মশানের নীরবতা। ঘরের এক কোণে একটা শ্বেত পাথরের বাটিতে কিছু বেল ফুল যা সমগ্র ঘরটা জুড়ে একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়ে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। গত রাতের ফ্লাইটে নিখিলেশ সান্যালের ছেলে এসে পৌঁছেছেন। বিমলা দেবী ‘র সৎকার ও করেছেন নিষ্ঠাভরে। তবে তার চোখে মুখে তীব্র ঘৃণা এবং তা বাবা নিখিলেশ সান্যালের প্রতি সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বারবার একটাই প্রশ্ন সে করে চলেছে”— বাবা কেন এই বয়সে এসে কিটনাশক ওষুধ খাইয়ে মাকে হত্যা করলো? “
উত্তর টা পদ্মিনী ‘ই দিলো সকলের উপস্থিতিতে।
“— আসলে এই রহস্য উদঘাটন করা আমার করা সম্ভব হতো না যদি নকুল আমাকে সাহায্য করতো। আসলে দীর্ঘ কয়েক বছর বিছানায় পড়ে থাকা পঙ্গু স্ত্রী কে দেখতে দেখতে বৃদ্ধ নিখিলেশ বাবু ক্লান্ত হয়ে পড়েন। বিমলা দেবী তা অনুভব করতেন । তাই নিজের জীবন থেকে মুক্তি কামনায় তিনি অহরহ মৃত্যু কে আহ্বান জানাতেন। কিন্তু মৃত্যু যে আসতে চায় না বৃদ্ধার কাছে। অনেক ভেবে বৃদ্ধা নিজের শারীরিক মানসিক উভয় দিকের কষ্টের হাত থেকে মুক্তি পেতে স্বামী নিখিলেশ সান্যাল কে বিষ এনে দিতে বলেন একদিন। নিখিলেশ বাবু আনতে চান নি। কিন্তু অসহ্য শারীরিক কষ্টে দিনের পর দিন লড়াই চালিয়ে যাওয়া অসহায় স্ত্রী কে সব কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে হয়তো মন কে শক্ত করেছিলেন। তাই নকুল কে দিয়ে কিটনাশক ওষুধ আনান আর তা বিমলা দেবী কে জানিয়েই দুধের সাথে মিশিয়ে খাইয়ে দেন। অদ্ভুত ভালোবাসা যাতে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে স্বামী ‘র কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্য বিমলা দেবী নিজেই বলে যান তাঁকে যেন পুঁতে দেওয়া হয় বাগানের একধারে। বেল ফুলের গন্ধ বিমলা দেবী ভীষণ পছন্দ করতেন আর সে জন্যই তাঁকে বাগানের যে অংশে পুঁতে ফেলা হবে সেখানে বসিয়ে দেওয়া হয় যেন একটি বেল ফুলের গাছ। ” পুঙ্খানুপুঙ্খ ঘটনাটা বলার পর পদ্মিনী বলে ওঠৈ এখন আপনাদের মনে হতেই পারে এর সত্যতা কী?”এর সত্যতা হলো এই ছোট্ট টেপ রেকর্ডার যেটি নকুল আমার হাতে তুলে দেয়। এই রেকর্ডটাতে বিমলা দেবী ‘র ইচ্ছামৃত্যু বরণ করার ইচ্ছা প্রকাশের কথা সম্পূর্ণ ভাবে নিজ কন্ঠস্বরে ব্যক্ত আছে। ” বলে পদ্মিনী নিজের ব্যাগ থেকে একটি ছোট আকারের টেপ রেকর্ডার বার করে চাণক্যর দিকে এগিয়ে দেয়। বৈঠকেখানা ঘরে নেমে আসে অদ্ভুত নীরবতা।
বিমলা দেবী’র অন্তর্ধান রহস্য উদঘাটন হওয়ার পরের দিন নিখিলেশ বাবু ‘র মৃত্যু হয়। এবং তা কীটনাশক ওষুধেই। অবশ্য এক্ষেত্রে খুন নয় । আত্মহত্যা । আইনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করার আর ক্ষমতা হয়তো ছিল না বৃদ্ধ ‘র। ফোন টা ধরতেই এই খবরটাই দেয় চাণক্য পদ্মিনী কে।
বেল ফুলের গন্ধ রহস্য গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
অ্যালার্মের ভাষা
চা-বেলার চৌকাঠ
অরুন্ধতির নীল চিঠি