কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

তীক্ষ্ণ বুদ্ধি

তীক্ষ্ণ বুদ্ধি গোয়েন্দা গল্প – ভাস্কর সিন্হা

কলকাতা শহরের বুকে আলোকোজ্জ্বল রাতে ঘুমিয়ে পড়েছে আধুনিকতার চাদর গায়ে দেওয়া বিশাল এই মহানগরী। সল্টলেকের একটি বাড়ির ছাদে বসে আছে তিন কিশোর—ঋজু, ইরা আর অর্ক। তিনজনই শহরের অন্যতম সেরা স্কুলের ছাত্র, IQ যাদের আকাশছোঁয়া। তাদের বন্ধুত্বের মালায় গাঁথা অজস্র স্মৃতি—কম্পিউটারের কোডিং, পদার্থবিদ্যার জটিল তত্ত্ব আর নতুন নতুন গ্যাজেট বানানো। এদের মধ্যে ঋজু বিশেষভাবে পরিচিত তার অসামান্য বুদ্ধি, ইরা তার প্রযুক্তিগত দক্ষতা আর অর্ক তার অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার জন্য।

একদিন ভোরে ইরার ঘুম ভাঙল মোবাইলের মৃদু ভাইব্রেশনে। স্ক্রিনে অপরিচিত এক নাম্বার থেকে মেসেজ—”তোমাদের সাহায্য দরকার। গোপনে দেখা করো, সিটি সেন্টার লাইব্রেরিতে, সকাল ১০টায়।”

ঋজু আর অর্ককে জানাতেই তারা উত্তেজনায় ঝাঁপিয়ে পড়ল রহস্যে। নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে দেখল লাইব্রেরির এক কোণে বসে আছে সমবয়সী এক মেয়ে। তার চোখেমুখে উদ্বেগ, পাশে থাকা বইয়ের ভেতর দিয়ে গোপনে দেখছে বারবার।

“আমি অন্বেষা। আমার বাবা একজন বিজ্ঞানী। সম্প্রতি এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে দুদিন আগে থেকে নিখোঁজ হয়ে গেছেন। পুলিশ কিছুতেই সাহায্য করছে না।”

ঋজু তৎক্ষণাৎ বলে উঠল, “গবেষণাটি কিসের ওপর ছিল?”

“মস্তিষ্কের তরঙ্গকে সরাসরি যন্ত্রের মাধ্যমে পড়ার উপায় নিয়ে। বাবা একটি অত্যাধুনিক নিউরাল রিডার তৈরি করেছিলেন।”

ইরা চোখ বড় করে বলল, “অর্থাৎ, ব্রেইন থেকে সরাসরি তথ্য চুরি করা সম্ভব! ব্যাপারটা  বেশ বিপজ্জনক।”

ঋজু ও অর্ক দ্রুত নিজেদের গ্যাজেটগুলো বের করল। অর্কের হাতে থাকা স্মার্ট ওয়াচটি নিউরাল সিগনাল ট্র্যাকিং করতে পারে, আর ইরার কাছে ছোট্ট এক AI-বট, যে পারে নেটওয়ার্কে ঢুকে যেকোনো তথ্য খুঁজে আনতে।

প্রথমেই তারা অন্বেষার বাবার ল্যাব ঘুরে দেখল। ল্যাবের ভেতরে সবকিছু ঠিকঠাক, শুধু একটি ল্যাপটপ নিখোঁজ। মেঝেতে ছড়ানো কিছু বিচ্ছিন্ন তার, যা দেখে মনে হল খুব তাড়াহুড়ো করে কেউ বেরিয়ে গেছে। অর্ক মৃদু হেসে বলল, “চোর বড্ড তাড়াহুড়োয় ছিল, ভুল করে কিছু ক্লু রেখে গেছে।”

ঋজু একদৃষ্টে তারের বিচ্ছিন্ন প্রান্তের দিকে তাকিয়ে বলল, “তারগুলো তামার নয়, সোনা ও প্ল্যাটিনামের মিশ্রণে তৈরি। এমন তার শহরে অল্প কয়েকটি জায়গায় পাওয়া যায়।” তারা দ্রুত কলকাতার অন্যতম বড় ইলেকট্রনিক মার্কেট, চাঁদনি চক গেল। সেখানে গোপনে তারা খুঁজে পেল একটি দোকান, যার মালিক সম্প্রতি এই ধরনের বিরল তার বিক্রি করেছেন এক রহস্যময় ব্যক্তিকে। CCTV ফুটেজ সংগ্রহ করে ইরার AI-বট মুহূর্তেই খুঁজে বের করল সেই ক্রেতার পরিচয়। ব্যক্তিটির নাম বিক্রম সেন, কলকাতার এক বিখ্যাত ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, যার গোপনে রয়েছে আন্তর্জাতিক টেকনোলজি মার্কেটে গোপন লেনদেনের ইতিহাস। ঋজু, ইরা ও অর্ক ঠিক করল বিক্রম সেনের বিলাসবহুল বাংলোয় গোপনে প্রবেশ করবে। বিক্রম সেনের বাংলোয় থাকা অত্যাধুনিক সিকিউরিটি সিস্টেম অতিক্রম করা সহজ ছিল না, কিন্তু ইরার দক্ষতায় AI দিয়ে লেজার অ্যালার্ম নিস্ক্রিয় হল। ভেতরে ঢুকে তারা দেখে অবাক—অন্বেষার বাবা একটি ঘরে বন্দি, তাঁকে দিয়ে জোরপূর্বক নিউরাল রিডারের পাসওয়ার্ড জানতে চাওয়া হচ্ছে। ঋজু তৎক্ষণাৎ একটি ছোট EMP ডিভাইস দিয়ে রুমের সমস্ত ইলেক্ট্রনিক্স সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিল। অর্ক ও ইরা দ্রুত অন্বেষার বাবাকে উদ্ধার করল। বিক্রম সেন বাধা দিতে এলেও তিন কিশোরের অসাধারণ বুদ্ধি ও প্রস্তুতিতে সে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হল। ঠিক সেই মুহূর্তেই অ্যালার্ম আবার বেজে উঠল। কিন্তু এটা বিক্রম সেনের করা নয়, বরং বাংলোর সিকিউরিটি AI-টি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুলিশকে সতর্ক করেছে। “এখন কী করব?” ইরা চিৎকার করে বলল।

ঋজু মৃদু হেসে জবাব দিল, “আমরা নির্দোষ, বরং পুলিশ এলে আমাদেরই সুবিধা হবে।” কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসে হাজির। তারা গোটা ঘটনা বুঝে নিয়ে বিক্রম সেনকে গ্রেফতার করল।

পুলিশ অফিসার তাদের প্রশংসা করে বললেন, “তোমরা সত্যিই অসাধারণ কাজ করেছো। বড় হয়ে তোমাদের মত গোয়েন্দাদেরই আমাদের বাহিনীতে দরকার।”

পরের দিন কলকাতার সংবাদপত্রে বড় বড় হেডলাইন—”তরুণ গোয়েন্দাদের অসাধারণ কীর্তি!”

কিছুদিন পর এক শনিবার সন্ধ্যায় দক্ষিণ কলকাতার একটি পরিচিত ক্যাফেতে তিন বন্ধু আবার মিলিত হল। অন্বেষাও ছিল তাদের সাথে। ক্যাফেতে ঢোকার মুহূর্তেই ঋজু বলল, “অদ্ভুত ব্যাপার, এরকম উত্তেজনার পর সাধারণ জীবন বেশ একঘেয়ে মনে হচ্ছে!”

ইরা হেসে বলল, “ঋজু, তোমার তো রহস্য ছাড়া আর কিছু ভালোই লাগে না। একটা রহস্য শেষ না হতেই আরেকটা চাই তোমার।”

অর্ক মুখে হালকা হাসি ফুটিয়ে বলল, “দেখো, রহস্যের সঙ্গে তো আমাদের বন্ধু অন্বেষাও জড়িয়ে গেল। সেও এখন আমাদের দলেরই একজন।”

অন্বেষা লাজুক হেসে বলল, “তোমাদের সঙ্গ পেয়ে আমিও রোমাঞ্চের স্বাদ পেয়ে গেছি।”

ঋজু গম্ভীর মুখে বলল, “এখন আমাদের পরবর্তী মিশন কী হবে?”

ঠিক তখনই ঋজুর স্মার্টফোন বেজে উঠল। ফোনে একটি অজানা নম্বর থেকে কল এসেছে। কল ধরতেই অপরপ্রান্ত থেকে রহস্যময় কণ্ঠ শোনা গেল, “ঋজু, তোমরা যে এত বড় রহস্য সমাধান করতে পারবে ভাবিনি। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, বিক্রম সেন ছিল শুধু দাবার বোর্ডের একটি ছোট সৈনিক। আসল রাজা এখনও অধরা।”

ঋজু সতর্ক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কে? কী চান?”

ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে হাসির শব্দ ভেসে এল, “আমার পরিচয় সময়মতো জানতে পারবে। কিন্তু তোমাদের নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত থাকতে হবে। সামনের মিশন আরও কঠিন।”

কথাটা বলেই লাইন কেটে গেল। তিনজনের মধ্যে মুহূর্তেই নীরবতা নেমে এল। অন্বেষা বিস্ময়ে বলল, “তার মানে রহস্য শেষ হয়নি, বরং সবে শুরু।”

ঋজু হাসিমুখে বলল, “ঠিক তাই, রহস্যের গভীরে যাওয়ার সময় এসেছে। আমাদের নতুন অভিযান শুরু হতে চলেছে।”

ইরা উৎসাহে বলে উঠল, “তাহলে আমাদের গোয়েন্দা দলের নাম হওয়া উচিত ‘তীক্ষ্ণ বুদ্ধি’। আমাদের আইকিউ আর অ্যাডভান্সড গ্যাজেটের সামনে কোনো রহস্যই টিকতে পারবে না।”

ক্যাফের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে কলকাতার ব্যস্ত রাস্তা। সন্ধ্যার আলোর ঝলকানিতে শহর আরও প্রাণবন্ত। টেবিলে সাজানো আধুনিক গ্যাজেটের পাশে জমে উঠল বন্ধুত্ব, রোমাঞ্চ আর নতুন রহস্যের অঙ্গীকার।

কিছুদিন পর কলকাতার অন্যতম বড় ও অভিজাত স্কুলে আয়োজিত বিজ্ঞান মেলায় বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হল ঋজু, ইরা আর অর্ক। শহরের নানা স্কুলের প্রতিভাবান ছাত্রছাত্রীরা সেখানে ভিড় জমিয়েছে। পরিবেশটা উৎসবমুখর হলেও তিন কিশোর গোয়েন্দার মন কিছুতেই নিশ্চিন্ত হচ্ছিল না। বিশেষ করে, যখন তারা শুনল স্কুলের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র এবং তরুণ উদ্ভাবক রাহুল গতকাল থেকেই নিখোঁজ, তখন তাদের রোমাঞ্চিত মন আবার সক্রিয় হয়ে উঠল।

ঋজু গম্ভীর হয়ে বলল, “দেখছি, রহস্য আমাদের পিছু কিছুতেই ছাড়ছে না।”

ইরা সঙ্গে সঙ্গে তার স্মার্ট গ্লাসে সিসিটিভি ফুটেজ স্ক্যান করতে শুরু করল। অর্ক তার বিশেষ স্মার্ট ট্র্যাকার ডিভাইস দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে রাহুলের উদ্ভাবিত রোবটের হারানো ট্র্যাকিং কোডের অবস্থান সনাক্ত করল। তারা বুঝল, স্কুলের বিজ্ঞান ল্যাবের মধ্যেই এই রহস্যের সূত্রপাত।

তিনজন নিঃশব্দে ল্যাবে ঢুকে দেখল, ঘর জুড়ে ছড়ানো কিছু ভাঙা ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ। ইরা হাসতে হাসতে বলল, “এই দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে, কোনও অদক্ষ চোর ভুলে এখানে কিছু ক্লু রেখে গেছে।”

অর্ক হঠাৎ উৎসাহে বলে উঠল, “দেখো! এটা তো রাহুলের স্মার্ট ওয়াচ!”

ইরা দ্রুত সেটি হাতে নিয়ে পরীক্ষা করল। বলল, “এখানে একটা এনক্রিপ্টেড ম্যাসেজ রয়েছে। আমার AI দিয়ে চটজলদি ডিকোড করে ফেলছি।”

মুহূর্তেই ওয়াচ থেকে বার্তাটি স্পষ্ট হল: “আমি বিপদে, দ্রুত বোটানিক্যাল গার্ডেনে এসো।”

তিনজন এক মুহূর্তও দেরি না করে কলকাতার ঐতিহাসিক বোটানিক্যাল গার্ডেনের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সন্ধ্যার আবছা আলোয় বাগানের ভিতরে ঢুকে নির্জন একটি কোণে তারা দেখতে পেল রাহুলকে বন্দি অবস্থায়। পাশে দাঁড়ানো তার উদ্ভাবিত রোবটটিও যেন বিষণ্ণ মুখে তাকিয়ে আছে।

ঋজু স্মার্ট ড্রোন দিয়ে এলাকাটি স্ক্যান করে বলল, “আশ্চর্য, চারপাশে ইলেকট্রনিক সিকিউরিটি জাল বিছানো হয়েছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, কেউ অত্যন্ত দক্ষ ও সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করেছে।”

অর্ক চোখ মটকে হেসে বলল, “দাঁড়াও, আমার বিশেষ EMP পেন ড্রাইভটা কাজে লাগানোর এটাই সেরা সময়।”

EMP চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সব ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস মুহূর্তের জন্য নিস্ক্রিয় হয়ে গেল। তিন বন্ধু দ্রুত এগিয়ে গিয়ে রাহুলকে মুক্ত করল। রাহুল কৃতজ্ঞ চোখে বলল, “তোদের না পেলে কী যে হতো!”

ঋজু হেসে বলল, “আমরা ‘তীক্ষ্ণ বুদ্ধি’, আমাদের কাছে কোনও রহস্যই টেকে না।”

কিন্তু হঠাৎই দূরে এক ছায়াময় মূর্তি দেখা গেল। ঋজু বলল, “ওখানে কে?”

একটি পরিচিত কণ্ঠ শোনা গেল, “তোমাদের অভিনন্দন, তোমরা আবারও প্রমাণ করলে তোমাদের দক্ষতা। কিন্তু এ কেবল শুরু। আরও বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে।”

ঋজু সতর্ক হয়ে বলল, “আপনার পরিচয় দিন।”

অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলেন রাহুলের বিজ্ঞান শিক্ষক ড. সমীরণ বসু। তিনি বললেন, “আমি তোমাদের দক্ষতার পরীক্ষা নিচ্ছিলাম। কারণ আমি গোপনে জানতে পেরেছি, শহরে কিছু অসাধু লোক রয়েছে যারা রাহুলের এই রোবটটি বিদেশি শক্তির কাছে পাচার করতে চায়। তোমরা আমার বিশ্বাসের যোগ্য। আসো, এই নতুন রহস্য সমাধানে এবার আমরা একসাথে কাজ করি।”

ঋজু, ইরা ও অর্ক পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “রহস্য যেখানে, ‘তীক্ষ্ণ বুদ্ধি’ সেখানেই থাকবে!”

ড. সমীরণ বসু তাঁদের নিয়ে গেলেন তাঁর গোপন গবেষণাগারে। আধুনিক গ্যাজেটে পরিপূর্ণ সেই ল্যাবে ছিল হাই-টেক মনিটর, কোয়ান্টাম কম্পিউটার, আর অতি উন্নত নিউরাল নেটওয়ার্ক সিস্টেম। ইরা আশ্চর্য হয়ে বলল, “স্যার, এত কিছু গোপনে আপনি তৈরি করেছেন?”

সমীরণ হেসে বললেন, “আমার গবেষণার প্রয়োজনেই এই ব্যবস্থা। আমাদের লক্ষ্য এবার শহরের সবচেয়ে রহস্যময় অপরাধী গোষ্ঠী, যারা আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি পাচারের সাথে যুক্ত।”

পরের দিন থেকেই শুরু হল তাদের গোয়েন্দা অভিযান। কলকাতার পুরনো বইয়ের দোকান, কফি হাউস, কলেজ স্ট্রিট থেকে শুরু করে এসপ্লানেডের জনাকীর্ণ চত্বরে তাঁরা খুঁজতে থাকল ক্লু। তাদের অত্যাধুনিক গ্যাজেটের সাহায্যে সহজেই মিলতে লাগল গোপন তথ্য।

কলেজ স্ট্রিটের সেই চিরপরিচিত কফি হাউস। পুরোনো দিনের হলদেটে দেয়ালে এখনও লেগে আছে বহু লেখক, কবি, শিল্পীর না-বলা গল্প। নস্টালজিক হয়ে মাঝে মাঝেই এখানে বসে তিন বন্ধু—ঋজু, ইরা আর অর্ক। তাদের দল, ‘তীক্ষ্ণ বুদ্ধি’, শহর কলকাতার নবীন গোয়েন্দা সংস্থা।

এক সন্ধ্যায় কফি হাউসের নির্জন কোণে বসে তিনজন গল্পে মগ্ন। হঠাৎই ইরা তার স্মার্ট গ্লাস দিয়ে আশপাশটা একটু স্ক্যান করতে গেল। গ্লাসে ফুটে ওঠা হলোগ্রাফিক স্ক্রিন দেখে সে উত্তেজনায় কেঁপে উঠল।

“ঋজু, দেখো!” উত্তেজিত কণ্ঠে ইরা ফিসফিস করে বলল, “আমাদের পেছনে বসে থাকা সেই লোকটি কে জানো?”

ঋজু তার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, “কী ব্যাপার, এত উত্তেজিত হচ্ছো কেন?”

ইরা তার স্মার্ট গ্লাসটা এগিয়ে দিল। সেখানে ভেসে উঠেছে লোকটির মুখের পরিচয়, CCTV ফুটেজের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি হওয়া ডেটা। এটি সেই সন্দেহভাজন ব্যক্তি, যার নাম অর্কের বিশেষ এআই সফটওয়্যার আগেই বের করেছে—শেখর মজুমদার, আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি পাচার চক্রের অন্যতম প্রধান হোতা।

তারা তিনজন সতর্ক হয়ে গেল। হঠাৎই শেখর মোবাইল ফোনে চাপা গলায় বলল, “আজ রাতেই পাচার সম্পন্ন হবে। নদীর ঘাটে গাড়ি প্রস্তুত রেখো। কোনও ভুল যেন না হয়!”

অর্ক মুচকি হেসে বলল, “ব্যাপারটা বেশ জমে উঠেছে। আজকের রাত মনে হয় লম্বা হতে চলেছে।”

তিনজন দ্রুত ক্যাফে থেকে বেরিয়ে এসে তাদের হাই-টেক বাইকে চেপে রওনা দিল হুগলি নদীর দিকে। রাতের কলকাতা তখন জেগে উঠেছে আলো ঝলমল শহুরে সৌন্দর্যে। পথে যেতে যেতে ইরা বলল, “মনে আছে, ছোটবেলায় ফেলুদার গল্প পড়ে আমরা ভাবতাম, এমন রোমাঞ্চকর ঘটনা কি সত্যি ঘটে?”

ঋজু হেসে বলল, “হ্যাঁ, আর আমরা এখন সেই রোমাঞ্চের মধ্যেই আছি!”

কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা পৌঁছে গেল নদীর ঘাটে। রাতের অন্ধকারে দেখা গেল কিছু রহস্যময় ছায়ামূর্তি, দ্রুত হাত চালিয়ে একটি ট্রাকে অত্যাধুনিক রোবটটি লোড করছে। দূরে দাঁড়িয়ে শেখর, হাতে ধরা তার মোবাইল।

ঋজু চট করে নিজের ছোট ড্রোনটি উড়িয়ে দিল। নিঃশব্দে সেটা ঘুরে ঘুরে ছবি তুলে নিচ্ছে। ইরা সঙ্গে সঙ্গেই তার স্মার্ট গ্লাস দিয়ে সরাসরি ফুটেজ পুলিশের কাছে পাঠিয়ে দিল। অর্ক বলল, “অপেক্ষা করতে হবে না, পুলিশ এসে পড়েছে প্রায়।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশের সাইরেনের শব্দ শুনে পাচারকারীরা ঘাবড়ে গেল। তারা পালানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পুলিশ তাদের আগেই ঘিরে ফেলেছে। পুলিশ-অফিসার এসে বললেন, “এই ছেলেমেয়েগুলোই কি সেই বিখ্যাত ‘তীক্ষ্ণ বুদ্ধি’?”

ঋজু হাসিমুখে বলল, “স্যার, রহস্য যেখানে, আমরাও সেখানে!”

পুলিশ অফিসার হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, “তোমাদের মতো কিশোরদের জন্যই এই শহর নিরাপদ আছে। তোমাদের জন্য গর্ববোধ করি।”

পরের দিন কলকাতার সব পত্রিকায় হেডলাইন বড় করে লেখা—”প্রযুক্তি পাচারকারী চক্রের ফাঁস! কলকাতার ‘তীক্ষ্ণ বুদ্ধি’ আবারও সফল!”

এক সপ্তাহ পর। সেই কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউস। ঋজু, ইরা, অর্ক এবং নতুন বন্ধু অন্বেষা আবার বসে গল্পে মগ্ন। কফির ধোঁয়া, স্মৃতির পাতা, বন্ধুত্বের আবেগ—সব যেন মিশে গেছে এই মুহূর্তে।

অন্বেষা আবেগে চোখ চিকচিক করে বলল, “তোমাদের সঙ্গ পেয়ে জীবনটা যেন নতুন করে চিনলাম। আমার বাবা এখন সুস্থ আছেন, আর আমাদের নিউরাল রিডারটাও সুরক্ষিত।”

ঋজু গভীর গলায় বলল, “এখন আমাদের থামলে চলবে না। শহরে আরও রহস্য আছে, আর আমাদের বুদ্ধির ধার আরও বাড়াতে হবে।”

ইরা একটু রসিকতার সুরে বলল, “এত বুদ্ধি নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে কখনো কখনো মনে হয়, আমাদেরও মাথায় একটা নিউরাল রিডার বসানো দরকার!”

সবাই হেসে উঠল। ক্যাফেতে বসা বয়স্ক এক ভদ্রলোক হঠাৎ তাদের দিকে এগিয়ে এলেন। সাদামাটা পাজামা-পাঞ্জাবি, হাতে পুরোনো বই। হাসিমুখে বললেন, “তোমাদের গল্প শুনছিলাম। তোমাদের দেখে মনে পড়ে গেল আমাদের যৌবনের দিনগুলো। তোমাদের জন্য আশীর্বাদ রইল, বাচ্চারা!”

অর্ক একটু কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনার পরিচয়টা জানতে পারি কি?”

ভদ্রলোক একটু মৃদু হাসলেন, চোখে এক অদ্ভুত মায়া নিয়ে বললেন, “আমার নাম সমরেশ। একসময় আমিও লিখতাম গোয়েন্দা গল্প। তোমাদের মতো তরুণদের গল্প আমার লেখা চরিত্রদের চেয়েও প্রাণবন্ত।”

বলেই ভদ্রলোক পেছন ফিরে ধীরে ধীরে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেলেন।

চার কিশোর-কিশোরী পরস্পরের দিকে তাকাল। তারা জানল না, লোকটি কে ছিলেন। কিন্তু সেই রহস্যময় মানুষের হাসিমাখা মুখ, আশীর্বাদ, এবং লেখকের গভীর মমতা তাদের বুকের ভেতর এক অপূর্ব অনুভূতির জন্ম দিল।

কফি হাউসের ভেতর মৃদু গুঞ্জন, বইয়ের পাতার গন্ধ, সন্ধ্যার আলোয় মিশে থাকা কলকাতার স্মৃতি। চার বন্ধু বুঝল, তারা শুধু রহস্যের সমাধানই করছে না, বরং জীবনকে নতুনভাবে আবিষ্কার করছে।

ঋজু ধীরে বলল, “চলো, পরবর্তী রহস্যের জন্য প্রস্তুত হই!”

বন্ধুরা হাসিমুখে সম্মত হল। বাইরের রাস্তায় নেমে আসছে রাতের আলো, সামনে অপেক্ষা করছে অজানা রহস্য, রোমাঞ্চ, ও তাদের বন্ধুত্বের নতুন অধ্যায়।

তীক্ষ্ণ বুদ্ধি গোয়েন্দা গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!