কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

রক্ত রুমাল

রক্ত রুমাল গোয়েন্দা গল্প – প্রনব কুমার কুণ্ডু

হিমালয়ের কোলে অবস্থিত “ছাম্বা ধাম” — একটা ছোট পাহাড়ি গ্রাম। চারপাশে পাইন গাছ, সরু পাহাড়ি পথ আর গভীর নীরবতা। এখানে সন্ধ্যা নামে অনেক আগেই। আলো নিভে গেলে গাছের ছায়াগুলোও যেন ফিসফিস করতে থাকে।

ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। গ্রামের মানুষজন কাঁপতে কাঁপতে কাঠের ঘরে ঢুকে যায় বিকেলের মধ্যেই। এদিনও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এই শীতল বিকেলেই গ্রামে এসে পৌঁছালেন অনিরুদ্ধ দাসগুপ্ত এবং তাঁর সঙ্গী নীল সেন — দুজনেই কলকাতা থেকে আগত, বেসরকারি তদন্ত সংস্থার হয়ে কাজ করেন।

নীল একটু হেসে বলল, “দাদা, একবার ভাবো—শীত, পাহাড়, আর একটা খুন। একেবারে থ্রিলারে ঢুকে পড়েছি যেন।”

“এটা থ্রিলার নয়, নীল। এখানে একজন মানুষের জীবন শেষ হয়েছে। গ্রামের লোকজন বলছে আত্মহত্যা। পুলিশ বলছে দুর্ঘটনা। কিন্তু মৃতের ভাই বলেছে—’আমার দাদা আত্মহত্যা করতে পারে না।’ সেই জন্যেই তো আমাদের ডাক পড়েছে।” অনিরুদ্ধ গম্ভীর গলায় বললেন।

সৌরভ পাল—পেশায় শিক্ষক, থাকতেন একা, একেবারে ঝর্ণার ধারে একটা কাঠের বাড়িতে। তিনদিন আগে, তাঁকে পাওয়া যায় সেই ঝর্ণার জলে, মাথায় গভীর আঘাত নিয়ে। গ্রামবাসীরা বলছে, স্লিপ করে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই ঘটনা যতই সরল মনে হোক, তার ভেতরে জমাট বাঁধা আছে বহু অসঙ্গতি।

নীল কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “এত ঠাণ্ডায় কে-ই বা সন্ধ্যাবেলা ঝর্ণার কাছে যায়? আর যদি গিয়েও থাকে, মাথায় এমন আঘাত এল কীভাবে?”

“ঠিক সেটাই দেখতে এসেছি আমরা,” অনিরুদ্ধ ধীরে ধীরে বললেন। “আর মনে রেখো, যত বেশি নির্জন জায়গা, রহস্য তত বেশি লুকিয়ে থাকে।”

পাহাড়ি রাস্তায় পাইন গাছের ছায়া আর নীচে বরফের স্তর এক অদ্ভুত নীরবতা সৃষ্টি করছিল। দূরে এক ঝাঁক নাম না জানা পাখি হঠাৎ ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল। বাতাসে তখন ঝড়ের পূর্বাভাস।

বাইরের প্রকৃতি যতই নিস্তব্ধ হোক, তাদের পায়ের নিচে তখনই যেন গল্পের প্রথম কুয়াশা ঘন হতে শুরু করল। 

পরদিন সকালবেলা অনিরুদ্ধ ও নীল সৌরভ পাল-এর কাঠের বাড়ির দিকে রওনা দিল। গ্রামটি খুব একটা বড় নয়—ঘরবাড়ি কম, মানুষজনও একে অপরকে ভালো করেই চেনে। সৌরভের বাড়ি ঝর্ণার কাছেই, একপাশে গভীর পাইনবন, অন্যপাশে ঢালু নেমে গেছে পাহাড়ের দিকে।

নীল বলল, “এমন নির্জন জায়গায় একা থাকা মানে তো ভয় লাগারই কথা।”

“সবাই ভয় পায় না, নীল,” অনিরুদ্ধ বললেন, “কিছু মানুষ নির্জনতাকে আশ্রয় হিসেবে বেছে নেয়। তবে এই নির্জনতা অনেক সময় বিপদেরও নামান্তর।”

সৌরভের বাড়িতে তালা লাগানো ছিল না। ভেতরে ঢুকে তারা যে দৃশ্য দেখল, তা আরও ধন্দ বাড়াল। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল পুরোনো বই, কিছু কাঁচের টুকরো, আর টেবিলের ওপর রাখা একটি মদের বোতল—অর্ধেক খালি।

“মদের গন্ধটা যেন অন্য কিছু চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে,” নীল নাক কুঁচকে বলল।

অনিরুদ্ধ চারপাশে চোখ বোলালেন। “এই বাড়িতে কেউ খুব তাড়াহুড়ো করে কিছু খুঁজেছে বা কিছু লুকিয়েছে। তুমি দেখো, টেবিলের ড্রয়ারে কী আছে।”

ড্রয়ার খুলতেই নীল একটি ছোট চিঠির খাম পেল। কিন্তু তার ভেতরটা ছিল ফাঁকা। শুধু বাইরের খামে লেখা ছিল—”আমার যদি কিছু হয়, সত্যিটা খুঁজে নিও।” 

নীল শিউরে উঠল।
“দাদা, এটা কি সৌরভের লেখা?”

“সম্ভবত। কিন্তু এখনই নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। হ্যান্ডরাইটিং মিলিয়ে দেখতে হবে।”

তারা এরপর বাড়ির পাশের ঝর্ণার দিকে এগোল। জায়গাটি পিচ্ছিল, পাথর ঢাকা। সেখানে পৌঁছে অনিরুদ্ধ নিচু হয়ে একটি জায়গায় আঙুল রাখলেন—পাথরের ওপর শুকনো রক্তের দাগ।

“তুমি জানো, নীল,” তিনি ফিসফিস করে বললেন, “কারও পা পিছলে গেলে রক্ত এমনভাবে জমে না। এটা মাথায় আঘাতের পর ফেলা হয়েছে।”

“মানে কেউ ফেলে দিয়েছে তাকে?”

“হ্যাঁ। এবং সেটা আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনার নাটক তৈরি করার জন্য।”

ঝর্ণার শব্দ যেন আরও তীব্র হয়ে উঠল, যেন সে-ও কিছু বলতে চাইছে। নীল তাকিয়ে রইল পাইনবনের গভীর ছায়ার দিকে। কোথাও যেন একটা চোখ লুকিয়ে আছে।

অনিরুদ্ধ তখনই বলে উঠলেন, “আমাদের এবার সেই চোখকে খুঁজে বের করতে হবে।” 

গ্রামে ফিরে আসতেই তাঁদের প্রথম দেখা হয় স্থানীয় মোড়ল চরণ সিংয়ের সঙ্গে। লম্বা, পাথুরে চেহারা, ধবধবে সাদা দাড়ি, বয়স ষাট ছুঁইছুঁই। তাঁর চোখে কিছু একটার আড়াল—যেমনটা অনিরুদ্ধ বহুবার খুনের কেসে দেখেছেন।

চরণ বললেন, “ওকে তো সকলে ভালোবাসত। নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ ছিল, কারও সঙ্গে ঝামেলাও ছিল না। আত্মহত্যা ছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে?”

অনিরুদ্ধ বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, “কাউকে কি দেখতে পেয়েছিলেন বা কিছু অস্বাভাবিক শুনেছেন ঐ রাতে?”

চরণ মাথা নেড়ে বললেন, “না, কিছু না। তবে আগের দিন রাতে ওর ঘরে আলো জ্বলছিল বেশ রাত অবধি, যেটা খুব বিরল। কে ছিল, সেটা দেখিনি।”

নীল আস্তে করে বলল, “এই চরণ সিংকেই কেমন সন্দেহ লাগছে না দাদা?”

“সন্দেহ করো, কিন্তু প্রমাণ ছাড়া এগোনো যাবে না,” অনিরুদ্ধ সাবধান করে দিলেন।

গ্রামের মধ্যে ঘুরে তারা আরও দুটি মানুষের সঙ্গে কথা বলল—একজন ছিল রিমা থাপা, স্থানীয় একটি হোমস্টের কর্মী, যার চোখে আতঙ্ক ও সংশয়ের ছায়া। আরেকজন ধীরেন বকসী, সৌরভের প্রাক্তন ছাত্র, যিনি খুব নিরুত্তাপভাবে বললেন, “স্যার খুব ভালো মানুষ ছিলেন, তবে ইদানীং খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন।”

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। পাহাড়ের গায়ে সূর্য ডুবে যাচ্ছে, আর শীত যেন হাড়ের ভেতর গেঁথে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। নীল বলল, “এই নির্জনতা আমাকে ঠিক স্বস্তি দিচ্ছে না। কোনো একটা অদৃশ্য ছায়া যেন আমাদের অনুসরণ করছে।”

“ঠিক ধরেছো,” অনিরুদ্ধ বললেন, “এটা কেবল একটি খুনের কেস নয়, এটা মানুষের ভেতরের দীর্ঘদিন জমে থাকা কিছু অন্ধকারের গল্প—যেটা কেউ প্রকাশ করতে চায় না।”

সেই মুহূর্তে, একজন অজানা ছায়ামূর্তি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিল দুজন আগন্তুককে। পাইন গাছের আড়ালে কুয়াশার মধ্যে তার অবয়বও যেন স্পষ্ট হচ্ছিল না।

বাতাস থেমে গিয়েছিল। পাহাড়, বন আর সময়—সব মিলিয়ে তাদের সামনে এক অদ্ভুত অজানা খেলার দরজা খুলছিল। 

পরদিন খুব ভোরে, যখন গ্রামটা তখনো ঘুমিয়ে, অনিরুদ্ধ আর নীল চলে গেল সেই পাইনবনের দিকে—ঝর্ণার ঠিক ওপাশে, যেখানে সৌরভ পালকে শেষবারের মতো দেখা গিয়েছিল।

নীল বলল, “পুলিশের ফাইল বলছে, রাত একটা নাগাদ তার মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু কেউ চিৎকার পর্যন্ত শোনেনি। এতো গভীর ঘুম গ্রামে হয় না, দাদা।”

অনিরুদ্ধ মাটির দিকে তাকালেন। বনের ভেজা মাটি তখনো কিছু রহস্য ধরে রেখেছে। হঠাৎই তিনি থেমে গেলেন—এক জোড়া পায়ের ছাপ, ছোটখাটো, নুড়ি-কাঁকর মাড়িয়ে এগিয়ে গেছে ভেতরের দিকে।

“এই দেখো নীল, এগুলো কোন পুরুষের পা না। সম্ভবত কোনো নারী বা কিশোরীর।”

নীল ক্যামেরা বের করে ছবি তুলল। “তবে কি সৌরভের সঙ্গে দেখা করতে কেউ এসেছিল সেদিন রাতে?”

“হয়তো। অথবা কেউ খুব ভালো করেই জানে কী হয়েছিল, কিন্তু মুখ খুলছে না।”

এই কথা বলতে বলতেই পেছন থেকে একটা নরম শব্দ ভেসে এলো—পাতার খসখসানি। দুজন একসঙ্গে ঘুরে তাকাল, কিন্তু কিছুই দেখা গেল না।

“কে?” অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন।

কোনো উত্তর নেই। তবে হাওয়ার মধ্যে অদ্ভুত একটা গন্ধ ভেসে এল—চামেলি ফুলের মত, অথচ কেমন গন্ধটা ঘোলাটে, যেন কোনো পুরোনো ঘর থেকে আসছে।

পাইন গাছের একটি নিচু ডালে হঠাৎ নীলের চোখ পড়ল—একটা রক্তমাখা রুমাল ঝুলে আছে, অর্ধেক শুকনো। রুমালের কোণে লেখা একটা অদ্ভুত চিহ্ন—একটি উল্টে যাওয়া অক্ষরের মতো, যেন একটা ‘R’।

“এটা কোনো গোষ্ঠীর সংকেতও হতে পারে,” নীল বলল।

অনিরুদ্ধ রুমালটা ভালো করে দেখে বললেন, “না, এটা কারও ব্যক্তিগত প্রতীক। আমাদের এখন সেই প্রতীকের মানুষটিকে খুঁজে বের করতে হবে।”

বনের ভেতর হাওয়া বইতে লাগল। সূর্য উঠে গেছে, তবু ছায়া যেন আরও গাঢ় হয়ে এল।

কেউ যেন বনের মধ্যেই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে—চোখে চোখ রেখে দেখছে অনিরুদ্ধ দাসগুপ্ত আর তার সহযোগী নীলকে। 

গ্রামের কেন্দ্রস্থলে ফিরে আসার পর অনিরুদ্ধ আর নীল সোজা গেলেন স্থানীয় স্কুল ভবনে, যেখানে সৌরভ পাল দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছিলেন। পুরনো কাঠের গন্ধে ভরা শ্রেণিকক্ষে একটা শূন্যতা ছড়িয়ে আছে—যেন দেওয়ালও তার অনুপস্থিতি অনুভব করছে।

স্কুলের অফিসঘরে সৌরভের পুরোনো জিনিসপত্র এখনো টেবিলে পড়ে। একটা ধুলোমাখা ডায়েরি আর কিছু কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে অনিরুদ্ধ পেয়ে গেলেন এক পাতায় আঁকা সেই একই প্রতীক—উল্টানো ‘R’। ডায়েরির কোণে লেখা একটি নাম: রিনু।

“এই নামটা আমাদের রুমালের সূত্রের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে,” অনিরুদ্ধ বললেন।

নীল জিজ্ঞেস করল, “তবে কি রিনুই সেই রাতের আগন্তুক?”

ঠিক তখনই স্কুলের আয়া, বৃদ্ধা বাসুতি দেবী, আস্তে করে বললেন, “রিনু নামের মেয়ে তো ছিল, বছর ছয়েক আগে, দশম শ্রেণিতে পড়ত। খুব মেধাবী… কিন্তু হঠাৎ করেই স্কুল ছাড়ল। কেউ জানে না কোথায় গেল।”

“সৌরভ স্যার কি তার সঙ্গে বিশেষ বন্ধুত্বে ছিলেন?” নীল জিজ্ঞেস করল।

বাসুতি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “অনেকেই তখন ফিসফিস করত… কিন্তু প্রমাণ তো কিছু ছিল না। তবে রিনু একদিন কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গিয়েছিল, তারপর আর কেউ ওকে দেখেনি।”

তাদের হাতে এবার দুটো ক্লু—রুমাল আর ডায়েরি। দুটোতেই রিনুর ছায়া।

নীল বলল, “খুনের সঙ্গে এই মেয়ের সম্পর্ক কী? সে কি এখনও আছে এই গ্রামে?”

“হয়তো আছে, হয়তো কারও ছায়ায় আড়াল হয়ে আছে,” অনিরুদ্ধ বললেন।

তাঁরা বেরিয়ে এলেন স্কুল থেকে। পথের পাশে একটা ছোট্ট দোকানে থেমে চা খেলেন। দোকানদার চুপ করে তাকিয়ে ছিল ওদের দিকে, তারপর অস্ফুটে বলল, “আপনারা কি ওই বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছেন? তাহলে শোনেন… সৌরভ স্যার মারা যাওয়ার আগের দিন একজন মেয়ে এসেছিল ওর কাছে। পরনের ওড়নায় ছিল এক রকম চিহ্ন। আমি নিজ চোখে দেখেছি।”

“এই মেয়ে এখন কোথায়?” অনিরুদ্ধ দ্রুত প্রশ্ন করলেন।

দোকানদার মাথা নেড়ে বলল, “কিছু জানি না। তবে ও চলে যাওয়ার পর স্যারের মুখটা খুব বদলে গিয়েছিল… অদ্ভুত রকম চিন্তিত লাগছিল।”

নীল চোখে চোখ রেখে বলল, “দাদা, আমরা একটা পুরনো গল্পের দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। দরজাটা খুললে হয়তো শুধু খুন নয়, বেরিয়ে আসবে লুকিয়ে থাকা আরও কিছু ভয়ংকর সত্য।” 

পাইনবনের রক্তমাখা রুমাল আর সৌরভের ডায়েরির পাতায় লেখা “রিনু” নামটা যেন ছায়ার মতো অনিরুদ্ধ আর নীলকে ঘিরে রেখেছিল। সন্ধ্যার আলো ঢলে পড়ছিল পাহাড়ের পাঁজরে। ঠিক তখনই খবর এলো—গ্রামের প্রান্তের ছোট্ট এক কুঁড়েঘরে একা থাকে একজন যুবতী, নাম রিমা। বয়স প্রায় ছাব্বিশ। সে কারও সঙ্গে খুব একটা মেশে না। গ্রামের অনেকে বলাবলি করে, “ও আসলে সেই রিনু, নাম বদলে ফিরে এসেছে।”

অনিরুদ্ধ আর নীল গিয়ে হাজির হল সেই কুঁড়েঘরে। দরজার সামনের উঠোনে গাঁদাফুল গাছ, ভিতরে অন্ধকার। রিমা যেন ওদের আসার অপেক্ষাতেই ছিল।

“আপনারা জানেন আমি কে?” সে নিজেই জিজ্ঞেস করল।

অনিরুদ্ধ শান্ত গলায় বললেন, “তুমি রিনু। আমরা তোমার কথা জানতে পেরেছি… আর সৌরভ পালের শেষ দিনেও তোমার উপস্থিতি কেউ কেউ মনে রেখেছে।”

রিনু—এখন রিমা—চোখ নামিয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি এসেছিলাম। বহু বছর পর… শুধু ওর মুখোমুখি হতে।”

নীল সাবধানে জিজ্ঞেস করল, “তোমার উদ্দেশ্য কী ছিল? প্রতিশোধ?”

রিমার চোখে তখনই হঠাৎ জ্বলজ্বলে তীব্রতা ফুটে উঠল। “ও আমাকে পঁচিয়ে দিয়েছিল। আমার বয়স তখন ষোল… আর ও ছিল আমার শিক্ষক, অভিভাবক। সবাই যখন ওকে পুজো করত, তখন আমি জানতাম সে আসলে কী। আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম, নিজের নাম ফেলে পালিয়ে ছিলাম। ফিরে এসেছিলাম শুধুই ওকে মনে করিয়ে দিতে, আমার জীবনটা ও কীভাবে শেষ করে দিয়েছিল।”

“তুমি খুন করোনি?” অনিরুদ্ধ খুব আস্তে জিজ্ঞেস করলেন।

রিনু কাঁপা গলায় বলল, “আমি খুন করতে চাইনি। কিন্তু… সেদিন আমি যখন ওর কক্ষে পৌঁছালাম, ও একটুও অনুতপ্ত ছিল না। আমাকে দেখে শুধু বলল—’তুই এখনও সেই দুর্বল মেয়েটাই রয়ে গেছিস।’ আমার মাথায় আগুন ধরে গেল।”

সে থামল। এক দীর্ঘ নীরবতা। বাতাস থমকে গেল যেন।

“তুমি কিছু করেছিলে?” নীল প্রশ্ন করল।

“না… আমি চিৎকার করেছিলাম। আর তখনি দরজার ওপাশে কেউ দৌড়ে পালিয়ে গেল। আমি ভয় পেয়ে ছুটে বেরিয়ে যাই। তারপর সকালে শুনি—ও মরে গেছে। কারা খুন করল, জানি না। কিন্তু আমি জানি, ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী কেবল আমি নই। আমি কেবল তার মুখোশটা খুলে দিয়েছিলাম।”

অনিরুদ্ধ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। “রিনু, তুমি খুন করোনি—এই কথাটুকুতে আমি তোমার চোখ দেখে বিশ্বাস রাখতে পারি। কিন্তু যেই লোক সেই রাতে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, সে-ই হয়তো…”

“সে ওর কাছের কেউ,” রিনু ফিসফিস করে বলল। “ওর ছায়া হয়ে ছিল সারাক্ষণ, কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি। হয়তো… ও নিজেই সহ্য করতে পারেনি সৌরভের আসল রূপ।”

সেই মুহূর্তে বাইরে থেকে ভেসে এলো এক অচেনা কণ্ঠ—”আপনারা যদি সত্য জানতে চান, তাহলে কাল সকালে পাইন ঝর্ণার নিচে আসুন। একা।”

কণ্ঠটা মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।

অনিরুদ্ধ নীরবে বললেন, “এই খেলার শেষ পর্দা এখন বাকি। আর সেটাই হবে কাল।”

পাহাড়ি সকালের বাতাস কুয়াশায় মোড়া, যেন চারপাশে কেউ নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে। পাইন ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন অনিরুদ্ধ দাসগুপ্ত। পাশে নীল। দুজনের মুখেই চুপচাপ উত্তেজনা। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, ঘড়ির কাঁটা আটটা ছাড়িয়ে সাড়ে আটটা ছুঁয়েছে, কিন্তু সেই অচেনা কণ্ঠের লোকটি এখনও আসেনি।

হঠাৎ কুয়াশার ভেতর থেকে ভেসে এল পায়ের শব্দ। ধীরে ধীরে একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এল—সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, হাতে লাঠি। মুখে সাদা দাড়ি, চোখে গভীর বিষাদ।

নীল বলল, “এ তো স্কুলের প্রাক্তন লাইব্রেরিয়ান সোমনাথ দত্ত!”

অনিরুদ্ধ একটু এগিয়ে গিয়ে বললেন, “আপনিই তো কাল রাতে এসেছিলেন?”

সোমনাথ কাঁপা গলায় বললেন, “হ্যাঁ… আমিই। অনেক বছর চুপ করে থেকেছি। কিন্তু আর না।”

তিনি একটা পুরোনো খাম বের করলেন। খুলে দেখালেন—সৌরভ পালের হাতে লেখা কিছু চিঠি। তাতে মেয়েদের নাম, রেফারেন্স, তারিখ, আর কিছু লজ্জাজনক কনটেন্ট।

“এই চিঠিগুলো আমি অনেক বছর আগেই পাই। কিন্তু সাহস ছিল না কিছু বলার। সৌরভ ছিল ক্ষমতাধর, ভয়ংকর, আর প্রতিহিংসাপরায়ণ। আমার স্ত্রীর চিকিৎসা নিয়ে সে হুমকি দিয়েছিল… আমি চুপ করে গিয়েছিলাম।”

অনিরুদ্ধ বললেন, “কিন্তু আপনি খুন করেননি, তাই তো?”

সোমনাথ চোখ নামিয়ে বললেন, “সেদিন রাতে আমি শুনতে পাই, কে যেন ওর ঘরে চিৎকার করছে। আমি কাছে যাই। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখি—রিনু দাঁড়িয়ে আছে, আর সৌরভ তাকে অপমান করছে। আমি কিছু করতে পারিনি। সে চলে যাওয়ার পর আমি ঢুকি…”

“তারপর?” নীল জিজ্ঞেস করল।

“তখন ওর সঙ্গে আরেকজন ছিল। ওর নিজের ভাইপো—তীর্থ পাল। ও চুপচাপ কোণে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ সে এগিয়ে এসে সৌরভকে ঘুষি মারে। সৌরভ তীর্থকে বলে, ‘তুইও ওর মতো দুর্বল! আমি তোদের বানিয়েছি। তুই কিছুই করতে পারবি না।’ তখন…”

তিনি থেমে গেলেন। চোখে জল।

“তীর্থ একটা কাগজ কাটার ছুরি টেনে নেয়… আর এক মুহূর্তে সব শেষ। আমি শুধু দেখেছিলাম। কিছু করতে পারিনি।”

অনিরুদ্ধ বললেন, “তীর্থ এখন কোথায়?”

“সে পালিয়ে গেছে। রাত্রির আঁধারে পাহাড় থেকে নেমে গিয়েছিল। কেউ জানে না সে কোথায়। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, একদিন ঠিক সব বলে দেবো। আজ, আপনাদের চোখে সত্যের খোঁজ দেখে… আমার ভয় কেটে গেছে।”

নীল ধীরে ধীরে বলল, “তীর্থ হয়তো খুনি, কিন্তু এক অর্থে সে নিজেই সেই ব্যবস্থার তৈরি রাক্ষসের ছায়া। সৌরভ শুধু একজন মানুষ নয়, একটা পচনশীল সংস্কৃতির নাম।”

অনিরুদ্ধ বললেন, “এই গল্পে রিনু খুনি নয়, সোমনাথ অপরাধী নয়, তীর্থ খুনি হলেও একা দায়ী নয়। সত্যটা অনেক গভীরে।”

সেই মুহূর্তে ঝর্ণার পাশ থেকে রিনু এগিয়ে এলো। তার চোখে জল, গলায় সাহসের স্পষ্ট সুর।

“আমি এই সত্যটা জানতাম না… কিন্তু আজ, আজ আমি মুক্ত। আমার বুকের চাপ নেমে গেছে। তোমরা যদি লেখো—এই গল্পটা, তাহলে যেন সবাই জানে, সৌরভ পাল ছিল এক ভয়ঙ্কর মানুষ, আর আমরা যারা বেঁচে আছি—তারা এখন সত্যের সাক্ষী।”

ঠিক তখনই পেছনের পথ ধরে এগিয়ে এল দুজন পাহাড়ি থানার পুলিশ অফিসার। অনিরুদ্ধ তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমিই আপনাদের ফোন করে ডেকেছিলাম। এখানে যে সত্য লুকানো ছিল, সেটা এখন প্রকাশ্যে এসেছে।”

পুলিশ অফিসাররা সোমনাথবাবুর কাছ থেকে সেই পুরোনো চিঠিগুলো জব্দ করলেন। নীল বলল, “এই চিঠিগুলো এবং সোমনাথবাবুর সাক্ষ্য তীর্থ পালের বিরুদ্ধে অপরিহার্য প্রমাণ। ওর সন্ধানে রেড অ্যালার্ট জারি করা উচিত।”

এক অফিসার বললেন, “আমরা তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাব। কিন্তু এই সাহসী স্বীকারোক্তিগুলোর জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। বিচার যেন না থেমে যায়, সেটা আমাদের দায়িত্ব।”

রিনু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। হয়তো তার জীবনে ন্যায়বিচার পূর্ণরূপে আসবে না, কিন্তু এই মুহূর্তে সে জানে—তার ভাঙা কণ্ঠস্বর এবার কেউ শুনেছে।

অনিরুদ্ধ ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে পাহাড়ের দিকে তাকালেন। দূরে, সূর্যের আলো কুয়াশা ভেদ করে উঠছে। রহস্যের অন্ধকার কেটে আলো ফুটছে এক নতুন ভোরে—যেখানে সত্য শুধু প্রকাশ পায় না, তার পাশে দাঁড়ায় সমাজও। 

রক্ত রুমাল গোয়েন্দা গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!