কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

অরুন্ধতির নীল চিঠি

অরুন্ধতির নীল চিঠি গোয়েন্দা গল্প – সুকন্যা রায়

পর্ব ১. অজানা ডাকে শান্তিনিকেতন:-

জানুয়ারি মাসের এক শীতল সকাল। কলকাতার ঠান্ডা অনেকটাই জমাট হয়ে আসে জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে। ঠিক এমনই এক সকালে গোয়েন্দা অনিরুদ্ধ মৈত্র তার লেক টাউনের অফিসে বসে তার একটি ফাইল ঘাঁটছিলেন, এমন সময় ডাক এল—একটি বিশেষ কাগজের খামে মোড়া চিঠি।

প্রেরক: প্রিয়রঞ্জন বসু

ঠিকানা: অরুণোদয় ভিলা, শান্তিনিকেতন, বোলপুর

চিঠিতে লেখা:

[[মহাশয়

আমি প্রিয়রঞ্জন বসু। আমার স্ত্রী অরুন্ধতি বসু তিন দিন আগে অদ্ভুতভাবে আত্মহত্যা করেছেন বলে পুলিশ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এটা আত্মহত্যা নয়—এটা পরিকল্পিত খুন।

মৃত্যুপরবর্তী সময়ে আমি তার রচনাগুলোর মাঝে একটি নীল খামে মোড়া চিঠি খুঁজে পেয়েছি, যাতে কেবল লেখা রয়েছে — ‘তিন নম্বর পাথরের নিচে খুঁজে দেখো’।

আমি মনে করি, আপনি এ রহস্য উদঘাটন করতে পারবেন। আপনি যদি রাজি হন, দয়া করে দ্রুত আমাদের বাড়িতে চলে আসুন।

শ্রদ্ধাসহ,

প্রিয়রঞ্জন বসু”]]

অনিরুদ্ধ ঠিক করলেন, কলকাতার কোলাহল পেরিয়ে আবার একবার শান্তিনিকেতনের শান্ত অথচ রহস্যময় বাতাসে পা রাখবেন।

পর্ব ২. অরুণোদয় ভিলার ছায়া:-

শান্তিনিকেতনে পৌছনোর সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল, কিছু একটা চাপা অস্বস্তি এখানে ছড়িয়ে রয়েছে। অরুণোদয় ভিলা — একশো বছরের পুরনো জমিদার বাড়ি। সাদা রঙের দেওয়ালে নানা শ্যাওলা আর ভাঙাচোরা কার্নিশের দাগ। বাড়ির করিডোরে ঢুকতেই তিনি দেখতে পেলেন  প্রিয়রঞ্জন বসু—মাঝবয়সী, ভদ্র, কিন্তু চোখে গভীর দুশ্চিন্তা।

“আমার স্ত্রী, অরুন্ধতি… শিল্পী মানুষ ছিলেন। কবিতা লিখতেন, গান গাইতেন। তবে গত কয়েক মাস ধরে খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন। ওর এই মৃত্যুটা… হঠাৎ…” কথাটি শেষ হতে না হতেই অনিরুদ্ধ বাবু, বলে উঠলেন-

“মৃত্যুর আগে আপনি কিছু অস্বাভাবিক দেখেছেন?”

“একটা ছায়ার কথা বলতেন। বারান্দার কোণায় নাকি কেউ দাঁড়িয়ে থাকত। আমি বিশ্বাস করতাম না… এখন মনে হচ্ছে হয়তো সত্যিই কিছু ছিল…”

এরপর অনিরুদ্ধ বাবু, প্রিয়রঞ্জন বাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন “আপনার মতে সন্দেহের তালিকায় কে কে রয়েছে?”

তিনি বললেন “আমি ঠিক বুঝতে পারছি না এই কাজ কে করতে পারে তবে এক্ষেত্রে আমি তিনজনের নাম করতে পারি, একজন হলেন মালতি দি অর্থাৎ আমাদের বাড়ির কাজের মাসি, অন্যজন আমার স্ত্রীর সাথে গানের তালিম দিত মধুসূদন দত্ত, এবং পিয়ালী সেন। 

এরপর অনিরুদ্ধ একে একে তিন জনের সাথেই কথা বললেন:-

ক)মালতি দি: “দেখুন দাদাবাবু এসব সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না আমি সকালে কাজ করে দিয়ে চলে যায় আবার বিকেলে আসি এইরকমই সেদিন বিকেলে এসে হঠাৎ দিদিকে বাইরের বাগানে রক্তাক্ত অবস্থায় আঘাত পাওয়া অবস্থায় দেখতে পায়। আমি চেঁচিয়ে লোকজনকে ডাকি তারপর একে একে সবাই এসে পরীক্ষা করে দেখে দিদি মারা গেছে। দিদির সাথে কোনদিন খারাপ ব্যবহার আজ পর্যন্ত আমিও করিনি দিদিও খুব নম্র স্বভাবের ছিলেন সত্যিবাদী ছিলেন আমার সাথে কখনো কোন রকম খারাপ ব্যবহার করেনি খুব ভালবাসতেন। আমি আরো পাঁচটা বাড়িতে কাজ করি চাইলে খবর নিতে পারেন।”

খ) মধুসূদন দত্ত:-এই ছেলেটি অরুন্ধতীর থেকে অনেকটাই ছোট ছিল প্রায় ৪-৫  বছরের তফাৎ।সে বলল “স্যার সত্যি বলছি ম্যাডাম আমাদের কাছে দেবীর মতন ছিলেন ম্যাডামের গলা ছিল অত্যন্ত সুন্দর উনি গান গাইতেন সেখানে তবলচির কাজটি আমি করতাম। শুধু আমি নয় আমাদের প্রত্যেকজন ছাত্র-ছাত্রী ম্যাডামকে খুব ভালোবাসতাম এবং সম্মান করতাম ম্যাডাম আমাদের সাথে খুব ভালো ব্যবহার করতেন আর খুব ভালবাসতেন নিজের ছোট ভাই বোনের মতন ম্যাডাম আমার থেকে বয়সে বড় হয়, আমি ওনাকে সবসময়ই দিদির মতন শ্রদ্ধা করতাম সম্মান করতাম আর ম্যাডাম আমাকে নিজের ভাইয়ের মতন সবসময় গাইড করতো। কিন্তু তিনি কিভাবে যে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন কি করে দুর্ঘটনা ঘটে গেল তার কিছুই বুঝতে পারছি না আমি চাই এবং আসল কারণ খোঁজার পর যেন সত্যি কারের বিচার হয়।”

৩) পিয়ালী সেন – স্থানীয় লাইব্রেরির কিউরেটর। শান্ত, কমবক্তা, কিন্তু চোখে এক ধরনের জিজ্ঞাসু চাহনি। “আমি ওঁর গবেষণার বইপত্র সরবরাহ করতাম। উনি সত্যিই কিছু পেয়েছিলেন, আমি নিশ্চিত,” পিয়ালী বললেন।

অনিরুদ্ধ চুপ করে সব শুনছিলেন। এরপরের প্রশ্নটা তিনি প্রিয়রঞ্জন বাবুকে সরাসরি ছুঁড়ে দিলেন।

“তিন নম্বর পাথরটা কোথায়?”

পর্ব ৩. পাথরের নিচে যা ছিল:-

বাড়ির পেছনের বাগানে নিয়ে যাওয়া হল অনিরুদ্ধকে। সেখানে তিনটি বেলেপাথরের ঢিপি ছিল। মাঝখানেরটিতে বড় করে রোমান হরফে খোদাই করা ছিল: III।

পাথর সরাতেই বেরিয়ে এল একটি পুরনো, ধূলিধূসরিত, কালি-লেগে-থাকা ডায়েরি।

প্রথম পাতায় লেখা —

[• “অরুন্ধতি বসু – ব্যক্তিগত রেকর্ড, ২০১৯ থেকে…”]

ডায়েরির ভেতরে কেবল লেখা নয়, ছিল একের পর এক ধাঁধা। এমনকি কয়েকটি কবিতার মাঝে লুকানো কোড।

একটা অংশে লেখা:-

• “পূর্বের আলোয় ছায়া হয় ঘন,

ন’টি নক্ষত্রে আছে মিলন।

তৃতীয় কক্ষ, দ্বিতীয় তাক,

খুলে ফেলো অতীতের ফাঁক।”

এই কবিতাটা দেখে অনিরুদ্ধ বুঝলেন — এটি কোন ঘরের বর্ণনা। ‘তৃতীয় কক্ষ, দ্বিতীয় তাক’ মানে নিশ্চয়ই লাইব্রেরির তৃতীয় ঘরের দ্বিতীয় বুকশেলফ। এবং “ন’টি নক্ষত্রে মিলন” কি কোনো পুরোনো ফটো বা চিত্র?

পর্ব ৪. ধাঁধার ছায়ায় রহস্য:-

অরুণোদয় ভিলার লাইব্রেরি বিশাল। কাঠের পুরোনো তাক, বইয়ের ঘ্রাণ, আর ভেতরের একটা চাপা গন্ধ—বহু বছরের অপ্রকাশিত ইতিহাস যেন ঢেকে আছে সেখানে।

তৃতীয় ঘরের দ্বিতীয় তাকের বই সরাতেই একটি পুরনো ক্যানভাস বেরিয়ে এল। এতে আঁকা ছিল একটি “আকাশনক্ষত্র”–র চিত্র — এবং তাতে ন’টি তারা চিহ্নিত।

একটির নিচে লেখা ছিল — “রুবি”।

“রুবি” কার নাম? কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটির পর বেরোল, বাড়ির পুরোনো কাজের মেয়ে রুবিনা – যিনি বছরখানেক আগে হঠাৎ নিখোঁজ হন।

আরেকটি ধাঁধা অনিরুদ্ধকে তাড়িত করল —

•”রুবি জানে শেষ সত্য,

কিন্তু সে আর নেই জীবিত।

তার ঘরেই পা ফেলো,

সেখানে আছে অরুন্ধতির শেষ লেলো।”

“শেষ লেলো” – মানে সম্ভবত শেষ চিহ্ন, বা শেষ রেকর্ড।

পর্ব ৫. রুবির ঘরের সন্ধান ও অরুন্ধতির দেওয়া সূত্র:-

রুবির ঘর ছিল পুরোনো চাকর-কামরায়। সেখানে ধুলো জমে জমে শেওলা উঠেছে। কিন্তু একটি বাক্সের নিচে পেয়ে গেলেন একটি ক্যাসেট। তাতে লেখা — “AB-শেষ বার্তা”

একটি পুরোনো টেপ রেকর্ডারে বাজানো হল সেই ক্যাসেট।

•অরুন্ধতির কণ্ঠস্বর—

 “যদি কেউ এটি শুনছো, বুঝবে আমি আর নেই। কিন্তু আমি মরিনি, আমাকে মেরে দেওয়া হয়েছিল। সে আমার খুব কাছের কেউ… আমি জানতাম সত্য, তাই আমাকে সরিয়ে দিল।”

“সে…” কে?

পর্ব ৬. গল্পের মোচড় ও সত্য উন্মোচন:-

অনিরুদ্ধ মৈত্র ডায়েরির শেষ পাতায় গিয়ে দেখলেন একটি নাম।

প্রিয়রঞ্জন বসু।

সঙ্গে একটি নোট:

• “আমার সমস্ত চিঠি ও গোপন কাগজ তাকে দিয়েছিলাম… যদি সে সত্যিই আমায় ভালোবাসে, সে জানবে আমি কাউকে আঘাত করিনি। কিন্তু যদি সে আমার লেখা গোপন ডায়েরির খোঁজ পায়… তাহলে আমায় সরিয়ে দেওয়াটা তার পক্ষেই সম্ভব।”

অনিরুদ্ধ তখন সমস্ত রহস্যের মূল কারণটা বুঝতে পারলেন এবং ঠিক করলেন যে, সময় হয়েছে সত্যের মুখোমুখি হওয়ার।

পর্ব ৭. অপরাধী এবং সত্যের মুখোমুখি:-

অনিরুদ্ধ বললেন, “আপনার স্ত্রী আপনাকে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু আপনি কী করলেন প্রিয়রঞ্জনবাবু ?”

প্রিয়রঞ্জন বাবু অবাক হয়ে কিছুটা ভয় পেয়ে হতবঙ্গ হলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন ” মা–মা– মানে কি বলতে চাইছেন টা কি আপনি?”

তখন অনিরুদ্ধ বাবু তাকে সমস্ত সূত্র এবং ধাঁধা একের পর এক সমাধান করে মিলিয়ে দিয়ে প্রমাণ সহকারে বুঝিয়ে দিলেন তার করা প্রশ্নের আসল মানে,

এবং বললেন “আর কোন কিছু বুঝতে অসুবিধা আছে আপনার প্রিয়রঞ্জন বাবু”?

 প্রিয়রঞ্জন চুপ।

“আপনি ডায়েরির লেখা পেয়ে গিয়েছিলেন… সেখানে আপনার ব্যবসায়িক কেলেঙ্কারির কথা ছিল, যেটা অরুন্ধতি জানত। তিনি সেটা প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। তাই আপনি…”

কিছুক্ষণ পর সমস্ত সত্যি উদঘাটন হওয়ায় আর কোন কিছু মিথ্যে দিয়ে চাপা দিতে না পারায়, প্রিয়রঞ্জন বসু হঠাৎই মুখ খুললেন, “হ্যাঁ, আমি অরুন্ধতীকে খুন করেছিলাম! বিশ্বাস করুন ও আমার শত্রু ছিল না আমাদের মধ্যে শত্রুতা সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু হঠাৎই সে সম্পর্ক মোড় নিল আত্মসম্মান বাঁচানোর তাগিদায় এবং আতঙ্কে তাই আমি শুধু নিজের সংসারকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম,আর নিজের সম্মানকে ধূলিসাৎ হওয়া থেকে মুক্ত করার জন্যই…..”

আর কিছু বলে উঠতে পারলেন না তিনি, অনিরুদ্ধ বাবু মৃদু ঠোঁটের কোনায় হাসি দিয়ে বলে উঠলেন- 

“‘ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না।’ আপনাকে এ কথাটি মাথায় রাখতে হতো। আর যদি আপনি কোনরকম অন্যায় বা দোষ না করতেন এবং কার সাথে কী আচরণ করছেন এটা যদি মাথায় রাখতে পারতেন তাহলে এরকম অপরাধ মূলক কাজ করে ক্রিমিনাল হতে হতো না আপনাকে। আর আপনার স্ত্রী কেউ আপনার হাতে খুন হতে হতো না। নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্য নিজের স্ত্রীকে খুন করে ফেললেন এমন কাজ করার কি দরকার ছিল যার জন্য নিজের সম্মান ধূলিসাৎ হয়?” আর কি সুন্দর নিজের প্ল্যান মাফিক পরিকল্পনা করেছিলেন আপনি ধরতেই পারেন নি যে অল্প সময়ের মধ্যে আপনার স্ত্রী এত সুন্দর ভাবে সমস্ত প্রমাণের তথ্য রেখে যাবে। এমনকি আপনি অতি চালাকি করে সবার সন্দেহ এড়াতে নিজে একজন গোয়েন্দাকে ডেকে খবর দিলেন তদন্তের জন্য আর শেষে কি করলেন নিজের জালে নিজেই ফাঁসলেন।

প্রিয়রঞ্জন বাবুর মুখে একটিও শব্দ নেই শুধু লজ্জা, ভয় এবং নিজের করা অপরাধের জন্য, নিজের স্ত্রীকে নিজের হাতে খুন করার জন্য কোন এক কষ্ট থেকে চোখের কোনায় একটু জল দেখা গেল।

পর্ব ৮. অন্তিম পর্ব

অবশেষে অরুন্ধতীর মৃত্যুর আসল রহস্য উদঘাটন করে , প্রকৃত দোষীকে (তারই স্বামী প্রিয়রঞ্জনবাবুকে) চিহ্নিত করার পর প্রিয়রঞ্জনকে গ্রেফতার করা হল। আর অরুন্ধতির ডায়েরি ও ক্যাসেট ছিল তার প্রধান প্রমাণ।

অনিরুদ্ধ বাবুর কোথাও যেন খারাপ লাগছিল প্রিয়রঞ্জন বাবুর জন্য তবে সে যা করেছে তা অত্যন্ত অপরাধমূলক কাজ। তার শাস্তি হওয়া ছিল আবশ্যক। আইনের কাছে অপরাধের জন্য শাস্তি পেতেই হয়।তবে অনিরুদ্ধ জানতেন, সব সত্যের মূল্য চোকাতে হয়।

বেরিয়ে আসার সময় তিনি আবার সেই তিন নম্বর পাথরের দিকে তাকালেন। হঠাৎ তিনি লক্ষ্য করলেন

সেখানে এক নতুন গাছের চারা গজিয়ে উঠেছে।

কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলেন হয়তো এটি অরুন্ধতির খুনের খুনি শাস্তি পাওয়ার জন্য তার আত্মা এখন শান্তি পেয়েছে তারই একটি চিহ্ন।

অরুন্ধতির নীল চিঠি গোয়েন্দা গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!