কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

চা-বেলার চৌকাঠ

চা-বেলার চৌকাঠ গোয়েন্দা গল্প – আলেখ্য রায়

“What if the dining table remembered every lie, every silence, every scream that was never heard?”

                                     ১

সেদিন সন্ধ্যেটা যেন কলকাতার অন্যসব সন্ধ্যার চেয়ে একটু আলাদা ছিল। বাতাসে একটা ঘন চাপা গন্ধ, যেন পুরোনো কোনো পত্রিকার পাতার সঙ্গে ধূপের ধোঁয়া মিশে অদ্ভুত এক ঘোর তৈরি করছে। দক্ষিণ কলকাতার এক নীরব গলির শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা চৌধুরী পরিবারের বাড়িটা বাইরে থেকে দেখতে যতটা বনেদি, ভেতরে ভেতরে ঠিক ততটাই গাঢ়। মসৃণ পাথরের পেঁচানো সিঁড়ি, দেয়ালে পুরোনো কালি মাখানো ছবির ফ্রেম, আর প্রতিটা ঘড়ির টিক-টিক শব্দ যেন আর একটু করে সময়ের ঘূর্ণিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অতীতের দিকে। চারপাশের হাওয়ারা ফিসফিস করে বলছে আজ যেন কিছু হবে।

ডাইনিং টেবিলের চারপাশে সবাই বসেছে—চা-পানের সময়। বাইরে মৃদু বৃষ্টি পড়ছে, জানালায় বৃষ্টির ফোঁটা আর ভেতরে ক্লান্ত আলোয় দীপ্ত ছায়া।

বাড়ির কর্ত্রী শুভ্রা চৌধুরী—ষাটোর্ধ্বা, অথচ চোখে সেই পুরোনো কলকাতার আগুন। তার মুখে কোনো মায়া নেই, ঠোঁটের রেখা কঠিন, চোখের তলায় দীর্ঘ অপেক্ষার ছাপ। তিনি বসলেন চায়ের কাপ হাতে। তার মুখে যেন কিছু একটা জমে ছিল বহুদিন ধরে—আজ সেই কথা বলার সন্ধ্যা।

বাড়ির আর চারজন টেবিলে বসে আছে — বড়ো ছেলে সুদীপ (৪৫)—রুক্ষ স্বভাব, গলায় ব্যবসার চাপ , চোখে মোবাইল স্ক্রিনের ক্লান্তি। তার স্ত্রী রিমা—নিঃশব্দে বসে থাকা, নিঃসঙ্গতায় জড়ানো এক নারী। মুখে প্রায় কোনো অভিব্যক্তি নেই।

ছোটো ছেলে অরিত্র (৩৮)—কিছুটা ভদ্র, কিছুটা বিদ্রোহী, চোখে বেঁচে থাকার ক্লান্ত স্পর্ধা।

আর একমাত্র নাতনী ঋদ্ধি (২১)—বাবার মতোই চুপচাপ, কিন্তু চোখে অনেক প্রশ্ন, কিছু না বলা অভিমান, আর একরাশ গোপন কিছু বোঝার চেষ্টায় ভরা দৃষ্টি।

শুভ্রা বললেন, গলায় থেমে থেমে একটা ধাতব রকমের স্পষ্টতা, “আজ একসঙ্গে বসা গিয়েছে, এটা ভালো। অনেকদিন পর বসলাম সকলে।”

সবাই মাথা নেড়ে চা খেতে থাকে নিঃশব্দে।

শুভ্রা আবার বললেন, এবার একটু নীচু গলায়, “তবে একটা কথা বলতেই হবে আজ। এই সন্ধ্যায় তোমাদের সবার কিছু জানার আছে।”

একটা অস্বস্তিকর নীরবতা ঘরের বাতাসে জমে উঠল, যেন কেউ হঠাৎ ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না।

অরিত্র মুখ তুলল, কপাল কুঁচকে, “কী মা, কেউ আবার কী করেছে ? সুদীপদা নিশ্চয় আবার ব্যবসার নামে আমাদের কিছু লুকোচ্ছে ?”

সুদীপ তৎক্ষণাৎ চোখ পাকাল, “তুই আবার এসব কী বলছিস ?”

শুভ্রা শান্ত গলায় বললেন, চোখের পলক না ফেলে, “তোমাদের কেউ কিছু করেনি। আমি করেছি ।”

একটা নিঃশব্দ বিস্ফোরণ ঘটল যেন ঘরের মধ্যে। সবাই একসঙ্গে স্থির হয়ে গেল।

ঋদ্ধি ধীরে ধীরে বলল, ” আপনি ? “

শুভ্রা এবার চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখলেন টেবিলে। কাপটার কাঁচে ঠক করে একটা ক্ষীণ আওয়াজ হল।

“হ্যাঁ,” বললেন শুভ্রা “যে জিনিসটা এতদিন তোমরা ভাবতে পারোনি, সেটা আমি করেছি। আর সেটা জানার পর… হয়তো তোমরা কেউই আর এই টেবিলে আমার দিকে তাকিয়ে চা খেতে পারবে না।”

সবার গলা শুকিয়ে এলো, কেউ কিছু বলতে পারল না। রিমা থেমে গেল মাঝপথে, কাপটা ঠোঁটে নিয়ে থেমে রইল।

শুভ্রার ঠোঁটের কোণে একধরনের অদ্ভুত, যেন বিষাক্ত হাসি দেখা দিল।

“আজ সন্ধেটা শুধু গল্পের সন্ধ্যা নয়। আজ আমি তোমাদের সত্যি বলব। সেই সত্যি যা এই পরিবারের ভিত নড়িয়ে দিতে পারে। যে সত্যি জানলে তোমাদের নিজেদের ওপরও সন্দেহ হবে—কারণ তোমরা এত বছর ধরে একটা মিথ্যার মধ্যে বড় হয়েছ।”

ঘরের বাতাসটা হঠাৎ আরও ভারী হয়ে এল। ছাদ থেকে একটা ফোঁটা জল পড়ে টুপ করে টেবিলে।

আর তখনই সুদীপ চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করলো , ” কী সত্যি ? “

শুভ্রা তাকিয়ে রইলেন সবার দিকে।

“তোমাদের বাবা কীভাবে মারা গিয়েছিলেন, সেটা তোমরা আজ অবধি যেটা শুনেছ—তা ঠিক নয়।”

অরিত্র কাঁপা গলায় বলল , ” মানে ? “

শুভ্রা এবার সোজা হয়ে বসলেন – “তোমাদের বাবা আত্মহত্যা করেননি। তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। আর সেই হত্যাটা আমি করিয়েছি।”

টেবিলের চারপাশে নিঃশব্দ বিস্ফোরণ। কারও মুখে কথা নেই। কেবল চায়ের কাপ কাঁপছে, ঠোঁট কাঁপছে, হৃদপিণ্ড কাঁপছে।

বাইরে বৃষ্টি তখন আরো গাঢ় হয়ে উঠেছে। জানালায় বিদ্যুতের আলোয় একবার ঝলকে উঠল চারপাশ। যেন ভেতরের এই সত্য উন্মোচনের সঙ্গে প্রকৃতিও সঙ্গ দিচ্ছে।

শুভ্রা চুপ। বাকিরা নীস্তব্ধ।

রিমা ধীরে ধীরে বলল , ” মা , আপনি… কেন ? “

শুভ্রার ঠোঁটে সেই হাসিটা ফিরে এল—

“কারণ সব পরিবারেই একটা ভূত থাকে। আর কখনও কখনও, সেই ভূতের জন্ম দেয় কেউ একজন… খুব আপনজন।”

                                     ২ 

শুভ্রা শুরু করলেন—গলা ভারী, কণ্ঠে এমন এক চাপা কাঁপুনি, যা বয়স নয়, অভিশাপ টেনে এনেছে।

“তোমাদের বাবার সঙ্গে আমার বিয়েটা ছিল একরকমের বোঝাপড়া। ভালোবাসা নয়, বরং বাবার আদেশে মাথা নত করে নেওয়া এক রকমের আত্মসমর্পণ। আমি তখন এক সদ্য তরুণী , সেই সময়ে আমি ভালোবাসতাম এক ছেলেকে। নাম ছিল নবীন। সে ছিল অন্য ঘরানার—বুদ্ধিদীপ্ত, সাহসী, আর…ভীষণ জীবন্ত। “

শুভ্রার চোখে যেন সেই নবীন ফিরে আসে। তিনি যেন কিছুক্ষণ হারিয়ে যান।

“বিয়ের আগের রাতে পালিয়ে যাওয়ার কথা ছিল আমাদের। সব ঠিক করে ফেলেছিলাম। স্টেশন, টিকিট, নগদ টাকা… কিন্তু যাওয়ার আগেই ধরা পড়ে যাই তোমার কাকুর হাতে। বেদম মার খেয়েছিল নবীন। ওর একটা হাতও ভেঙে যায়। আমি আটকে গেলাম এ বাড়ির এই অন্ধকার দেয়ালের মধ্যে। নবীন হারিয়ে গেল সেদিন থেকে।”

তিনি থেমে গেলেন। দীর্ঘ নিঃশ্বাস।

রিমা গলা নীচু করে বলল , ” তারপর কী হল মা ? “

শুভ্রার চোখে তখন কুয়াশা। যেন এত বছরেও কিছু মুছে যায়নি। একদম কিছু না।

“তারপর অনেক বছর কেটে গেল। আমি মেনে নিলাম সংসার, মুখে হাসি এঁকে। কিন্তু আমার ভেতরে যেন একটা গর্ত হয়ে গেল। যেটা কেউ দেখতে পায়নি। হয়তো তোমাদের বাবা পেরেছিলেন… তাই তিনি আর আমাকে বিশ্বাস করতে পারেননি।”

বাইরে বৃষ্টির শব্দ তখন আরও গাঢ়, যেন ছাদের ওপরে আঙুলে আঙুল বোলাচ্ছে অজানা কেউ।

“তারপর এক রাতে,” শুভ্রা বললেন, “নবীন ফিরে এসেছিল। হঠাৎ, অনেক বছর পর। আমাকে একবার দেখার ইচ্ছে ছিল তার। জানতাম এটা ভুল হচ্ছে , তবু গিয়েছিলাম দেখা করতে। সেই রাতে তোমাদের বাবা ছিলেন না বাড়িতে… আমি ভেবেছিলাম এটাই শেষ দেখা। কিন্তু…. তার ফল হয়েছিল ভয়াবহ।”

সুদীপ হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। গলা কাঁপছে, কিন্তু চোয়াল শক্ত — ” আমার জন্ম সেই রাতে, তাই না ? “

ঘরের মধ্যে একটা শূন্যতা নেমে এল , শব্দ ছিন্ন , দৃষ্টি অনড়। চায়ের কাপের ভাপ থেমে গেছে, ঘড়ির কাঁটাও যেন থেমে আছে।

শুভ্রা মাথা নীচু করে বললেন , “হ্যাঁ, সুদীপ। তুমি নবীনের সন্তান। “

দেয়ালের ঘড়ির টিক টিক শব্দটা হঠাৎ অস্বাভাবিক জোরে শোনা গেল।

অরিত্র ধীরে, স্তব্ধ গলায় বলল, ” মানে… দাদার জন্মবাবা আমাদের বাবা নন ? তাহলে আমার… আমার বাবা কে ? “

শুভ্রা উঠে দাঁড়ালেন। যেন কিছু একটা তাকে ভিতরে ভিতরে পোড়াচ্ছে।

“তোমাদের বাবা অর্থাৎ, যিনি এই বাড়ির ‘চৌধুরী’ নাম রেখে গেছেন, তিনি ছিলেন কেবল একজন প্রতিশোধপরায়ণ মানুষ। আমার জীবনটাকে জেল বানিয়ে তুলেছিলেন তিনি। তিনি জানতেন সত্যিটা… জানতেন সুদীপ কার সন্তান। কিন্তু কিছু বলেননি। তার বদলে বছরের পর বছর ধরে আমাকে মানসিকভাবে শেষ করে দিয়েছেন। শাস্তি দিয়েছেন এমনভাবে, যাতে বাইরে কিছু বোঝা না যায়। আর শেষে একদিন, আমি… আর সহ্য করতে পারিনি। “

রিমা এবার উঠে দাঁড়িয়ে গলা চেপে বলল, ” আপনি কী করলেন মা ? “

শুভ্রা খুব ধীরে ধীরে তাকালেন তার দিকে।

“আমি নিজে খুন করিনি , করিয়েছিলাম। এমনভাবে, যাতে মনে হয় আত্মহত্যা। কিন্তু সেটা হয়নি। সে রাতে শুধু আমি ওকে ওষুধ দিয়েছিলাম , তারপর… বাকিটা করেছে আমাদেরই কেউ।”

সুদীপ চিৎকার করে উঠল , ” মানে আমাদের কেউ ?”

শুভ্রা তাকাল তার চোখে। তীব্র, ছেদহীন দৃষ্টি।

“তুমি সুদীপ। তুমি ছিলে সাত বছর বয়সি। কিছুই বোঝোনি তখন, কিন্তু সেই রাতে তুমি যা করেছিলে, সেটা… সেটা হয়তো কোনোদিন বুঝতেই পারো না।”

ঘরে হিম নেমে এল। যেন মৃত্যু এসে দাঁড়িয়েছে টেবিলের কোণায়।

ঋদ্ধি উঠে দাঁড়িয়ে বলে , ” দাদু… দাদু কীভাবে মারা যান, সেটা আমরা যেটা জেনেছি তা কি মিথ্যে ?”

শুভ্রা বললেন, “তোমার দাদু আত্মহত্যা করেননি। সুদীপ তাকে গলায় দড়ি দিতে দেখেছিল, ছিঁড়তে যেতেও পারেনি, বরং…”

তিনি থেমে গেলেন।

“সে সময় আমি চুপ করে দেখেছিলাম—আমি চাইনি ও বাঁচুক।”

সুদীপের মুখ থেমে গেল, অরিত্র সরে গেল, রিমা ফুঁপিয়ে উঠল।

আর তখনই ঘরের আলো একটু কমে এল। বিদ্যুৎ চমকাল, বাইরের ঝড় যেন আরও কাছে এগিয়ে এল।

ঋদ্ধি ধীরে ধীরে বলল, “আপনারা সবাই একটা মিথ্যার মধ্যে বেঁচেছেন। আর এখন আমাকে এই সত্যি শুনতে হল।”

তার চোখে জল নয়, ভয় নেই—শুধু একধরনের স্তব্ধ বিস্ময়।

শুভ্রা বললেন, “তুমি এখন জানলে কেন এই সন্ধ্যায় আমি সবাইকে একসঙ্গে বসাতে চেয়েছিলাম। এই পরিবারে সত্য একসময় বলতে হয়—না হলে ছায়ারা কথা বলে ওঠে।”

ঘরজুড়ে তখন এক অদ্ভুত নীরবতা। যেন ছাদের উপর দিয়ে কারা হাঁটছে ধীরে ধীরে। ঘড়ির কাঁটা থেমে আছে ঠিক সন্ধ্যা ৭:১৭-তে।

শুভ্রার ঠোঁট থরথর করে উঠল।

ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠল আরেকবার।

                                   ৩ 

ঋদ্ধি উঠে গেল। তার মুখে তখন আর কোনো অভিমান, বিস্ময় বা ভয় নেই—শুধু একরকম নিঃসঙ্গ প্রয়োজনীয়তা। ঘরজুড়ে যখন সবাই নিজেদের ছায়ার মধ্যে ডুবে যাচ্ছে, সে যেন আরও একটা ছায়া এনে ফেরত এল—হাতে একটা পুরোনো, নীল রঙা খাম। খামের চারপাশে কালচে হয়ে যাওয়া দাগ, যেন আর্দ্রতা আর সময় একসঙ্গে ঘুরপাক খেয়েছে।

সে শান্ত গলায় বলল, “এই চিঠিটা আমি পেয়েছিলাম তিন দিন আগে। বাবার সেই পুরোনো ট্রাঙ্কে, যেটা কেউ খোলে না। মা বলেছিল খুলতে না… কিন্তু আমি খুলেছিলাম। কারণ আমি জানতাম, এই বাড়িতে কেউ না কেউ মিথ্যে বলছে। “

সবার দৃষ্টি এবার ঋদ্ধির দিকে। সেই পুরোনো খাম যেন ঘরে একটা অদৃশ্য বিস্ফোরণ ঘটায়। যেন এটা কেবল কাগজ নয়, একটা মৃত মানুষের প্রত্যাবর্তন।

ঋদ্ধি খামটা খুলল। ভেতরে একটা জীর্ণ, বাদামি চিঠি। লেখাগুলো কাঁপা হাতে লেখা, কিন্তু প্রত্যেকটি অক্ষরে ছিল এক ভয়ংকর সতর্কতা।

ঋদ্ধি পড়তে শুরু করল—

“আমি জানি, আমার মৃত্যু দুর্ঘটনা নয়। শুভ্রা এখনও জানে না, কিন্তু একদিন জেনে যাবে – যে সেই রাতে আমি ফিরেছিলাম। আমি দেখেছিলাম… শুভ্রা ঘর থেকে বেরোচ্ছে, কাপড় এলোমেলো… আর বিছানায় ছিল এক অপরিচিত পুরুষ…”

ঘরের বাতাস হঠাৎ যেন হিমেল হয়ে গেল। কারও মুখে কোনো শব্দ নেই।

ঋদ্ধি একটু থেমে বলল, ” চিঠির কাগজটা প্রায় ছেঁড়া হয়ে আছে। কিন্তু নীচের লেখাটা এখনও স্পষ্ট “

 “…আমার বুকে তখন কেবল ঘৃণা নয়, ভয়ও ছিল। আমার সন্তানেরা যেন জানতে না পারে, ওদের মা কাদের নিয়ে সংসার করছে। তাই চুপ করে গিয়েছিলাম। কিন্তু আজ বুঝেছি, এই নীরবতা আমার মৃত্যুর কারণ হতে চলেছে। শুভ্রা যদি কখনও বলে , আমি আত্মহত্যা করেছি—বিশ্বাস কোরো না। আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারিনি, কিন্তু কেউ যদি এই চিঠি পড়ে, যেন জানে— ‘ আমার মৃত্যু যদি স্বাভাবিক না হয় , তার দায় একমাত্র শুভ্রার । ‘

                                       — অরবিন্দ চৌধুরী “

চিঠি পড়া শেষ হতে না হতেই কাঁচের জানালায় একটা ঝটকা—ঝড়ের দমক এসে জানালার কপাট খুলে দেয় হঠাৎ। টেবিলে রাখা কাপগুলো কেঁপে ওঠে।

সুদীপ উঠে দাঁড়াল। চিঠিটা ঋদ্ধির হাত থেকে টেনে নিল।

“এটা তো বাবার হাতের লেখা! এই অক্ষর আমি চিনে রাখতাম হাজার মানুষের মধ্যেও। কিন্তু বাবা কখনো তো বলেননি… কিছুই বলেননি…”

শুভ্রা নির্বিকার মুখে বললেন, ” বলার সুযোগ দিয়েছিলে ওকে ? “

তার চোখে এবার আর গ্লানি নেই—এক অদ্ভুত শীতল স্থিরতা। যেন অনেককালের পরিকল্পনার ছায়া হঠাৎ পরিষ্কার হয়ে উঠছে।

অরিত্র বলল, ” তুমি জেনেও… বাবার মৃত্যুর পরেও চুপ করে ছিলে ? “

ঋদ্ধি ধীরে বলল, “চুপ থাকাটা তো এই বাড়ির অভ্যাস, কাকু। প্রত্যেকেই কিছু না কিছু চেপে রাখে। কেউ চিঠি পায়, কেউ ডায়েরি, কেউ চুপচাপ শুধু রক্তের সম্পর্ক বিশ্বাস করে। “

সেই মুহূর্তে রিমা উঠে বলল, “এই চিঠিটা যে সত্যি, সেটা কি কেউ জানে ? হতে পারে এটা কেউ বানিয়েও ফেলতে পারে, মিথ্যে সাজিয়েও…”

ঋদ্ধি বলল, ” চিঠির সঙ্গে একটা পাতা ছিল বাবার ডায়েরি থেকেও। তারিখ লেখা—’১৯৯৭, জুলাই ২১’ — যেদিন দাদু মারা যান। আর তাতে লেখা ছিল একটাই লাইন—”

সে একটা ছোট্ট ছেঁড়া ডায়েরির পাতা বের করল, সেখানে লেখা—

> “আজ রাতে শুভ্রার চোখে ভয় ছিল না। ছিল দাহ। আমি ওকে আর চিনি না।”

শুভ্রার মুখে তখনও কোনো দুঃখ নেই। বরং এক অদ্ভুত শূন্যতা।

তিনি ধীরে বললেন, “আমি তো চেয়েছিলাম এই পরিবার টিকে থাকুক। সত্যি বললে ভেঙে যেত। এখন যা হচ্ছে, সেটা আর থামানো যাবে না। “

সুদীপ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “তুমি কি সত্যিই বাবাকে…? “

শুভ্রা তাকাল। নিঃশব্দে।

“আমি তাকে ঠেলে দিইনি। কিন্তু জানতাম সে মরবে। তাই দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ও বাঁচবে। কিন্তু…”

একটা পিয়ানোর মতো শব্দ হল হঠাৎ পাশের ঘর থেকে। অথচ কারও বাজানোর কথা নয়।

ঋদ্ধি বলল, “মা, তুমি বলেছিলে ট্রাঙ্কটা না খুলতে। তুমি জানতে এই চিঠি আছে তাই না ? “

রিমা চুপ। তারপর চোখ নামিয়ে বলল, “জানতাম। কিন্তু আমি চুপ ছিলাম… তোমার দাদুর কথা ভেবে, তোমার কথা ভেবে। যদি জানতে পারো, তোমার পরিবারটা এক মিথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে, তুমি কি মেনে নিতে পারতে ঋদ্ধি ? “

ঋদ্ধি চোখ তুলে তাকাল সবার দিকে—

“আজ বুঝলাম, পরিবার আসলে একধরনের নাটক। কেউ মুখোশ পরে বাঁচে, কেউ মুখোশ খুলে দেয়। কিন্তু একবার খুলে গেলে, আর কোনো মুখই নিরাপদ নয়। “

বাইরে তখন প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে আর সেই ঝড়ের ভেতর, ঘরের এক কোণে রাখা পুরোনো কাঁসার আয়নাটার কাঁচে ধরা পড়ল একটা ছায়া—

একজন পুরুষ, গা ছমছমে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে, গলায় ঝুলন্ত দাগ।

কে সে ? অরবিন্দ চৌধুরী ? নাকি নতুন কোনো চরিত্র ?

                                     ৪  

হঠাৎ অরিত্র বলল, কাঁপা কণ্ঠে—

” তাহলে তুমি… মানে, মা তুমি… বাবাকে মেরে ফেলেছো ? “

ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে একটা নিঃশব্দ বিস্ফোরণের মতো ঝাঁকুনি। টেবিলের কোণৈ রাখা চায়ের কাপটা যেন নিজে থেকেই খানিকটা সরে আসে, শব্দ না করে।

শুভ্রা ধীরে ধীরে মাথা তুললেন। চোখে জল, কিন্তু মুখে দুঃখ নয়—শুধু শুষ্ক এক ক্লান্তি।

“না,” বললেন তিনি, “আমি ওকে মারিনি। কিন্তু তোমাদের যাকে আমি সেই রাতে ঘরে পেয়েছিলাম… সে তোমাদের বাবা ছিল না। ছিল তোমাদের কাকা—তাপস।”

সুদীপ চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল , ” মানে ? তুমি… বাবার ভাইয়ের সঙ্গে ? “

তার গলা কাঁপছিল, কিন্তু তাতে যতটা ক্ষোভ, তারচেয়েও বেশি ছিল একরকম অস্তিত্বভ্রষ্ট হয়ে যাওয়ার আতঙ্ক।

শুভ্রা চুপ করে রইলেন এক মুহূর্ত। যেন ভেতরে একটা বিশাল দরজা খুলে যাচ্ছে।

তারপর গলায় ছায়া মেশানো কষ্ট নিয়ে বললেন,

“আমি তখন নবীনের খোঁজে প্রায় পাগল। বিয়ের আগে যার হাত ধরতে চেয়েছিলাম, সে হঠাৎ নিখোঁজ। আমি ভেবেছিলাম, আত্মহত্যা করেছে। আর তোমাদের বাবা… মানে অরবিন্দ… চুপচাপ, কঠোর, তার সংসার ছিল, কিন্তু সম্পর্ক ছিল না। ওই ঘরটা একটা শবঘরের মতো হয়ে উঠেছিল।”

তিনি একটু থামলেন, যেন পুরোনো সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছেন ভিতরের কোনো একটা দুঃস্বপ্নে।

” তাপস তখন প্রায়ই আসত। কথা বলত। আমাকে সাহস দিত। একরাতে… হয়তো দুর্বল ছিলাম আমি, হয়তো নিঃসঙ্গ, কিন্তু যা হয়েছিল, সেটা চিরকাল বুকের মধ্যে পাথরের মতো চাপা ছিল। আমি ভাবিনি, তাপস সেটা নিয়ে… পরবর্তীতে ব্ল্যাকমেল করবে। “

রিমা এবার প্রথমবারের মতো স্পষ্ট গলায় বলল,

” ব্ল্যাকমেল ? কীভাবে ? “

শুভ্রা গলায় শীতলতা এনে বললেন,

“সে আমাকে হুমকি দিতে শুরু করল। বলল, নবীনকে সে সরিয়েছে—আমার জন্য। আর যদি আমি চুপ না থাকি, সংসার না টানি, তাহলে সুদীপ আর অরিত্র—দু’জনকেই খুন করে ফেলবে।”

সুদীপ এবার যেন বসে পড়ল চেয়ারটায়।

” তাপস কাকু তো হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেছিল! আমরা তখন ছোটো… বাবা বলেছিল তাপস চাকরির জন্য বাইরে গেছে । “

অরিত্র ফিসফিস করে বলল , “সে নিখোঁজ হয়েছিল আজ থেকে ঠিক ৩৭ বছর আগে। আমার বয়স তখন মাত্র এক বছর… আর সেই রাতেই…”

ঋদ্ধি এবার ধীরে ধীরে একটা ছোট্ট রুমাল পকেট থেকে বের করল – “এই রুমালটা আমি পেয়েছি বাড়ির পুরোনো বেসমেন্টে, এক কাঠের সিন্দুকে তালাবন্ধ একটা পুরোনো বাক্সে। রক্তের দাগ আজও আছে। আর এতে লেখা – ‘ তাপস চৌধুরী, ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি ‘। “

ঘরে কারও নিঃশ্বাস পড়ার শব্দ নেই । শুধু বাইরের ছাদের ওপর জল পড়ার ঠকঠক আওয়াজ।

সুদীপ চিৎকার করে উঠল, ” তুমি তাপস কাকুকে খুন করেছো ? “

শুভ্রা এবার চেয়ারে বসে পড়লেন, গলার স্বর ফেটে যাচ্ছে — ” আমি করিনি! আমি চেয়েছিলাম সেই রাতেই সব ফাঁস করে দেবো। কিন্তু সেদিন, ঠিক সেদিনই অরবিন্দ হঠাৎ চলে আসে কাজে না গিয়ে… আর তাপস তখন ঘরে ছিল। ওদের মধ্যে কথা কাটাকাটি, ধাক্কাধাক্কি… তারপর একটা বিকট শব্দ… আমি ছুটে যাই, দেখি… তাপস পড়ে আছে, মাথা ফেটে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আর অরবিন্দ, নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে…”

অরিত্র এবার বলল, ” তাহলে বাবা… খুন করেছে নিজের ভাইকে ? “

শুভ্রা নিঃশ্বাস নিলেন, ” না। আমি নিশ্চিত, সেটা দুর্ঘটনা ছিল। ওরা কেউ কাউকে মারতে চায়নি। কিন্তু যা হয়েছিল, সেটা চাপা দিতে হয়েছিল। সেই রাতে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিই—আমি তাপসের মৃতদেহ লুকিয়ে ফেলি। বেসমেন্টে। একা। কেউ জানে না বিষয়টা। “

ঋদ্ধির গলা এবার স্পষ্ট হয়ে উঠল, ” তাহলে বাবা আত্মহত্যা করেনি, বরং… অপরাধবোধে দগ্ধ হয়ে নিজেই মারা গিয়েছিল ? “

শুভ্রা বললেন , ” হ্যাঁ। আমি জানতাম ও কষ্ট পাচ্ছে, কিন্তু ওকে বলতে পারিনি—আমি পাশে আছি। ও চুপ করে গিয়েছিল। আর একদিন সকালে, শুধু একটা চিরকুট রেখে গিয়েছিল টেবিলে – ‘ আমি আর কারোর চোখের দিকে তাকাতে পারছি না।’ সেই ছিল শেষ কথা।”

সুদীপ কাঁদছে না। শুধু শ্বাস নিচ্ছে ধীরে ধীরে, যেন ভিতর থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে।

” তাহলে আমরা সবাই একটা হত্যার উপর দাঁড়িয়ে বড়ো হয়েছি ? “

ঋদ্ধি ধীরে বলল , – “না কাকু, আমরা একটা মিথ্যের গা ছমছমে রাজনীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছি—যেখানে প্রতিটি সম্পর্ক একেকটা প্রেত হয়ে গেছে।”

ঠিক তখনই বারান্দার দিক থেকে একটা শব্দ এল—ঘষা ঘষা… যেন কেউ বেসমেন্টের দরজা ঠেলে খুলছে।

সবার চোখ ঘুরে গেল সেই দিকে।

বাইরের আলো নিভে গেছে হঠাৎ। একটা বিকট গর্জনের শব্দে জানালার কাঁচ কেঁপে উঠছে।

ঋদ্ধি বলল, “আমি আজ রাতে বেসমেন্টে যাব। দেখি কে কোথায় থাকে—কোন সত্যি এখনও লুকিয়ে আছে সেই অন্ধকারে।”

আর ঘরের কোণে টাঙানো পুরনো ঘড়িটার কাঁটা –

ঠিক তখন থেমে গেল, রাত ৩:৩৭-এ।

যেটা ছিল তাপস চৌধুরীর মৃত্যুর সময়।

                                    ৫

ঘরটা নিঃশব্দ হয়ে এল। একটা থমথমে ভার যেন মেঝের ওপর বসে আছে, কারও ঘাড়ের ওপর ঠান্ডা একটা হাত।

রিমা হঠাৎ গলা নামিয়ে বলল,

“গত মাসে রান্নাঘরে একটা পুরোনো কাঠের খুন্তি পেয়েছিলাম। কড়িকাঠের পাশেই ছিল, ধুলোর নীচে ঢাকা। তাতে কিছু লালচে দাগ ছিল… প্রথমে ভেবেছিলাম পাঁঠার মাংসের রক্ত। কিন্তু সেই দাগ শুকিয়ে এমনভাবে বসেছিল… যে রক্ত বলেই মনে হয়েছিল।”

সুদীপ কুঁচকে তাকাল, “কোন মাংস?”

রিমা চুপ। চোখ নামিয়ে নেয়।

অরিত্র হঠাৎ যেন একটা পুরোনো স্মৃতির প্যাঁচ খুলে বলে উঠল – “আমার মনে আছে… ছোটোবেলায় একবার আমরা বরফঘর খুঁজে খেলছিলাম। তখন একটা পুরোনো কোট পাওয়া গিয়েছিল। লাল দাগ ছিল পিছনে। বাবা দেখেই সেটা সরিয়ে ফেলেছিল। বলেছিল, পুরোনো কোট নোংরা হয়ে গেছে , ছুঁয়ে দেখতে মানা…”

3ঋদ্ধি উঠে দাঁড়িয়ে জানালার দিকে এগোল। গ্লাসে হাত রেখে মৃদু গলায় বলল – ” তাপস কাকুর মৃত্যুও কি ‘দুর্ঘটনা’ ছিল না ? “

ঘরের আলো হঠাৎই কেমন ম্লান হয়ে এলো।

একটা ছায়া যেন ঘরের কোণে নড়ে উঠল—কিন্তু কেউ খেয়াল করল না।

শুভ্রা মাথা নীচু করে বললেন,

“আমি বারবার বলেছি—তাপসের মৃত্যু এক অন্ধকার রাতের ফল। কিন্তু সত্যি কথা বললে, আমিও জানি না ও মারা গিয়েছিল কিনা। আমি… আমি শুধু ওর দেহটা দেখিনি। দেখেছিলাম শুধু রক্ত, আর একটা কোট… আর তারপর ও যেন গায়েব হয়ে গেল।”

সুদীপ অবাক হয়ে বলল, ” মানে ? তুমি লাশ দেখোনি ?”

শুভ্রা চুপ। তারপর চাপা স্বরে বলল,

“না। আমি গিয়েছিলাম, কিন্তু দেহটা ছিল না। রক্ত ছিল, একটা গন্ধ, আর একটা হাতঘড়ি—যেটা তাপস সবসময় পরত। আর ছিল সেই খুন্তিটা, যা রান্নাঘর থেকে হারিয়ে গিয়েছিল কিছুদিন আগেই।”

রিমা যেন আতঙ্কে পিছিয়ে গেল, ” মানে… খুন্তিটা ৩৭ বছর পরে আবার পাওয়া গেল ?”

ঋদ্ধি বলল, “এবং তাতে এখনও লেগে আছে রক্তের দাগ… যা হয়তো আজও শুকোয়নি।”

একটা পুরোনো ঘড়ির কাঁটা তখন হঠাৎ টিক টিক করে জোরে আওয়াজ করতে শুরু করে।

অরিত্র বলল, ” বরফঘরটা কি এখনও বন্ধ ? “

শুভ্রা মাথা নাড়লেন, “না। বাবা একসময় সেটা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তালাটা… খেয়াল করেছিলাম, মাঝে মাঝে খুলে যেত। আজও যদি দেখি—”

“আমি যাচ্ছি,” বলল ঋদ্ধি। “এখনই।”

“তুই একা যাবি না ,” বলে দাঁড়িয়ে গেল সুদীপ।

সবার পেছনে পায়ের শব্দ, যেন কেউ সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামছে… অথচ কেউ ওঠেনি।

ঋদ্ধি বলল, “চলো।”

বাড়ির নিচের দিকে বরফঘর। পুরোনো, পাথরের, দেয়ালে স্যাঁতসেঁতে ছোপ। দেয়ালে একটা ছবি এখনও ঝুলছে—তাপস চৌধুরীর ছাত্রজীবনের। চোখের চাহনি আজও জ্বলজ্বল করছে, যেন কিছু বলতে চাইছে।

তারা ঘরে ঢুকতেই হঠাৎ একটা ঠান্ডা হাওয়া তাদের কাঁধ ছুঁয়ে চলে গেল।

ঋদ্ধি তাকাল দেয়ালের কোণায়। একটা পুরোনো ট্রাঙ্ক। খুলতেই বেরিয়ে এল ঘরের বাতাসে ভাসতে থাকা একরকম বাষ্প। ট্রাঙ্কের ভেতরে একটা পুরোনো রুমাল, একজোড়া চশমা, একটা চিঠি।

রিমা তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করল— “তাপস মরেনি। তাকে মরতে হয়নি। কারণ সে আগে থেকেই মরে গিয়েছিল— যখন সে প্রথম ব্ল্যাকমেল করল, যখন সে প্রথম শুভ্রার গায়ে হাত দিল। আমি শুধু একটা জিনিস ফিরিয়ে এনেছিলাম— ন্যায়ের চাবি। খুন্তি ছিল সেই চাবি।

আমি ব্যবহার করেছিলাম, আমি পরিষ্কার করেছিলাম, আমি রেখেছিলাম— কারণ তাপস ছিল শয়তান, আর আমি ছিলাম ন্যায়ের হাত।”

সুদীপ ঠোঁট কামড়ে বলল, “এটা কার লেখা?”

ঋদ্ধি চিঠির নিচের দিকে তাকাল। লেখা –

” অরবিন্দ চৌধুরী, ১৯৮৮ “

সবাই চুপ।

শুভ্রা ঘরে ঢুকে বললেন – “তাহলে সত্যি… ও করেছিল। আমার স্বামী করেছিল… আর আমি সব দোষ নিয়েছিলাম নিজের কাঁধে, দশকের পর দশক।”

এক মুহূর্তে ঘরের বাতাস হিম। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছবি যেন নিজে থেকেই পড়ে যায় মেঝেতে।

ছবির ফ্রেম ভেঙে পড়ে। তার পেছনে লেখা কিছু—

ঋদ্ধি তুলে নেয় ফ্রেমটা, আর পেছনে দেখা যায় এক লাল কালি দিয়ে লেখা বাক্য—

> ” আমি আবার আসব। যাকে আমি খুন করেছিলাম, সে তো আসলে… মরেনি। “

ঘরের আলো নিভে যায়।

দেয়ালের এক কোণ থেকে গলায় এক ফিসফিস—

“শুভ্রা… এত বছর পরও… তুমি কি মনে করো, আমি ক্ষমা করব ?”

ঘরের ভেতর, হাওয়ার সঙ্গে ভেসে আসে স্যাঁতসেঁতে কোলাহল, আর কেউ যেন বেসমেন্টের সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামছে—ধীরে ধীরে, প্রতিশোধের ধ্বনি নিয়ে।

                                      ৬

ঋদ্ধি উঠে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে সে ডাইনিং টেবিলের নীচ থেকে বের করে আনে একটা পুরোনো লোহার বাক্স।

“এইটা পেয়েছি ভেতরের বন্ধ ঘরে, চাবিটা ছিল ঠাকুরদার বুকসেলফে। খোলার সাহস হয়নি… আজ খুলে ফেলি ?”

সকলের সম্মতিতে খোলা হলো বাক্স।

ভেতরে একটা পুরোনো VHS ক্যাসেট আর একটি রিপোর্ট – মেডিক্যাল ফাইল। তাতে লেখা:

“Patient Name: Supriya Roy

Age: 14

Diagnosis: Pregnancy following repeated abuse

Father: Mr. Tapan Roy (deceased)”

সুদীপ হতবাক ” সুপ্রিয়া ? কে এই সুপ্রিয়া ? “

শুভ্রা মুখ ঢেকে ফেলেন।

“ও আমার মেয়ে। তাপসের সঙ্গে আমার যা হয়েছিল, তার থেকে জন্মেছিল সুপ্রিয়া। আমি তোমাদের কাউকে বলিনি, ওকে হোস্টেলে পাঠিয়েছিলাম। ও বড় হয়ে ফিরে এসেছিল এক সন্ধ্যায়। আমি ওকে গ্রহণ করিনি। সে রাতেই সে মারা যায়।”

সকলের মাথা ঝিমঝিম করে উঠল।

অরিত্র বলল, “তাহলে সেই VHS ক্যাসেট…”

ঋদ্ধি বলল, “হ্যাঁ, ওই ক্যাসেটে আছে সুপ্রিয়ার অডিও। আত্মহত্যার আগে সে বলেছিল – এই বাড়ির সবাই জানে, কেউ মুখ খোলে না। মা-ই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।”

এক এক করে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে আসে।

রিমা বলে, “আমি জানতাম সুদীপের বাবা আলাদা, কিন্তু বলিনি… আমি চাইনি ঋদ্ধির ভবিষ্যৎ নষ্ট হোক।”

শুভ্রা ফিসফিস করে বলেন, “এই বাড়ি একটা কঙ্কালের ঘর। প্রতি সন্ধ্যায় একটা করে মুখ খুলবে।”

সুদীপ চিৎকার করে উঠে, “আমি কার ছেলে? কে আমার বাবা ? নবীন ? কিন্তু ও তো এক রেপিস্ট ছিল, তুমি বলেছিলে–”

শুভ্রা চুপ।

ঋদ্ধি তখন হাসছে – চাপা, ঠান্ডা হাসি।

ঋদ্ধি ধীরে ধীরে বলে, “আমি এই বাড়িতে এসেছি প্রতিশোধ নিতে। আমি সুপ্রিয়ার মেয়ে।

আমার মা তোমাদের ঠাকুরমা, মানে শুভ্রার মেয়েই।

তোমাদের কারোর সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক ঠিকঠাক নেই – অথবা সবাই-ই আমার কিছু না কিছু। তোমরা একজনকে গর্ভধারণ করতে বাধ্য করেছিলে, একজনকে আত্মহত্যায় ঠেলেছিলে,

একজনকে চুপ করে থাকতে শিখিয়েছিলে।

আমি সেইসব ছায়াদের কণ্ঠস্বর।”

সবাই স্তব্ধ।

ঋদ্ধি নিজের গলার নিচে থেকে এক হালকা ব্লেড বের করল।

“না না, ভয় পেয়ো না। আমি কাউকে মারতে আসিনি। আমি এসেছি তোমাদের মুখোশ ছিঁড়তে।

এবার চা-বেলার পর সন্ধ্যার আলোয় সত্যিটা ভালো করে দেখো, একবার আয়নায় গিয়ে নিজেদের দেখো –কার মুখে আসলে রক্ত লেগে আছে।”

ঘরের আলো নিভে যায়।

দরজার বাইরে কুকুর ডাকে।

ডাইনিং টেবিলের উপর পড়ে থাকে—

একটা VHS ক্যাসেট

একটা মেডিক্যাল রিপোর্ট

একটা পুরোনো ব্লেড

আর আয়নার পাশে লেখা—

“তোমরা কি আয়নাতে তাকাও, নাকি শুধু নিজের মুখটা কনফার্ম করো?

চেহারা তো সব দেখায় না। কিছু কিছু সত্য লুকিয়ে থাকে ছায়ার ভেতরে।”

আর শেষে পাঠকবন্ধুরা যারা শেষটায় কিছু প্রশ্নের উত্তর পেলেন না ? তাদের জন্যে আবারও বলি লেখাটা ভালো করে পড়তে কেননা যা আছে এর মধ্যেই আছে।

চা-বেলার চৌকাঠ গোয়েন্দা গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!