কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

অ্যালার্মের ভাষা

অ্যালার্মের ভাষা রহস্যগল্প – অরিত চক্রবর্তী

প্রথম অধ্যায়: শুরুর শব্দ

নিরঞ্জন বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের চা-টা শেষ করছিল। ভোরের আলো তখনও পুরোপুরি ফোটেনি। কলকাতার আকাশে ধূসর মেঘের আনাগোনা, যেন শহরটাও ঘুম থেকে উঠতে চায় না। সামনের রাস্তায় কয়েকজন মর্নিং ওয়াকার, দু-একটা দুধের গাড়ি আর কাগজওয়ালার সাইকেল ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়ার মতো নেই। বাতাসে ছিল ভোরের সেই চিরচেনা ঠান্ডা, যা নিরঞ্জনকে প্রতিদিন সজাগ করতে করে তুলতে সময় নেয়।

হঠাৎ করেই তার কানের পাশে একটা অদ্ভুত আওয়াজ – “আজকে আবার লেট হবে, এই লোকটা কখনও সময়মতো উঠবে না। রোজ এই একই ব্যাপার, আমি যে ক্লান্ত হয়ে গেলাম।”

নিরঞ্জনের হাত থেকে চায়ের কাপটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। গলার ভেতর থেকে একটা অস্পষ্ট চিৎকার বেরিয়ে এল। চোখ প্রায় কপালে উঠে গেল তার। পাশে কেউ নেই, তবে এই কথাগুলো কার? আওয়াজটা আসছে তার মোবাইলের অ্যালার্ম থেকে। কিন্তু সেটা তো বাজছেও না।

বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল যখন আরও একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল। পাশের ফ্ল্যাটের সিকিউরিটি সিস্টেম বলে উঠল – “দেখো না, রোজ সকালে ওই মহিলাটা আমাকে অন করে রেখে অফিসে চলে যায়। আমি একা একা সারাদিন পাহারা দিই। কী যে করব! একটু কথা বলারও লোক নেই।”

নিরঞ্জন নিজের কানে বিশ্বাস করতে পারছিল না। মাথার ভেতরটা ঝিমঝিম করে উঠল। ছত্রিশ বছর ধরে সেলস্‌ম্যান হিসেবে কাজ করে আসছে, জীবনে অনেক অদ্ভুত ঘটনা দেখেছে, কিন্তু এমন কিছু কখনও ঘটেনি। হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছল সে। প্রথমে ভাবল, হয়তো ঘুমের ঘোরে কিছু শুনছে। নিজেকে চিমটি কেটে দেখল – না, সে পুরোপুরি জেগে আছে।

পাশের ফ্ল্যাটে থাকে রূপা দত্ত, একা থাকে। স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে দু’বছর আগে। অফিসে যাওয়ার আগে রোজ সকালে সিকিউরিটি সিস্টেম অন করে যায়। নিরঞ্জন জানত না যে এই মেশিনগুলোর মনে এত বেদনা, এত একাকিত্ব লুকিয়ে আছে। নিজের জীবনের একঘেয়েমিটাও হঠাৎ যেন নতুন করে অনুভব করল সে।

বারান্দার রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল নিরঞ্জন। তার মনে হল, এতদিন যে জগতটাকে সে চিনত, সেটা হয়তো আসল জগৎ নয় ।তার চারপাশে এক অদৃশ্য জগৎ রয়েছে, যেখানে নীরব যন্ত্রগুলো নিজেদের ভাষায় কথা বলে, অনুভব করে, একাকিত্বে ভোগে। এই উপলব্ধিতে তার শরীরটা শিউরে উঠল।

দ্বিতীয় অধ্যায়: রহস্যের জাল

সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে। নিরঞ্জন বারান্দার চেয়ারে বসে আছে, হাতে এক কাপ কড়া চা। আজ সারাদিন সে অফিসে যায়নি। কীভাবে যাবে? প্রতিটি যন্ত্রের কথা তার কানে ভেসে আসছে, যেন একটি অদৃশ্য রেডিও সারাক্ষণ চালু রয়েছে তার মস্তিষ্কে।

বিকেল থেকে শুরু হয়েছে এক অদ্ভুত শ্রুতিনাটক। প্রথম ফ্লোরে থাকে সেন পরিবার। তাদের হোম থিয়েটার সিস্টেম থেকে একটি করুণ স্বর ভেসে এল, “ওরা জানে না, অনন্যা কাল রাতে কী করেছে। ল্যাপটপে টিকিট বুক করেছে। পালাবে বাড়ি থেকে। আমি দেখেছি, রাত দুটোয় উঠে প্যাকিং করছিল।” নিরঞ্জনের বুক টিপটিপ করে উঠল। অনন্যা, সেই মেয়েটি যে প্রতিদিন স্কুল বাসে যায়, যার হাসি শোনা যায় সিঁড়িতে।

তৃতীয় তলার মিত্র পরিবারের ল্যাপটপ আরও এক চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস করল। “প্রতি রাতে অভিক আমাকে খোলে। ভাবে মা-বাবা ঘুমিয়ে পড়েছে। অনলাইন ক্যাসিনোতে লক্ষ লক্ষ টাকা হারিয়েছে। আজ সকালে বাবার ক্রেডিট কার্ডের পাসওয়ার্ড চুরি করেছে।” নিরঞ্জন চিনত অভিকের বাবাকে, ভদ্রলোক ব্যাঙ্কে চাকরি করেন।

কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর খবরটা এল ষষ্ঠ তলার সিকিউরিটি ক্যামেরা থেকে। গলাটা কাঁপছিল ভয়ে, “সাবধান! ৬০২ নম্বর ফ্ল্যাটে বিপদ আসছে। কাল রাতে দেখলাম, দুজন লোক ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে ম্যাপ দেখছিল। একজন বলল – ‘বুড়ো একা থাকে, অ্যান্টিক কালেকশন আছে। কাল রাতেই হাত সাফাই করতে হবে।'”

নিরঞ্জনের গলা শুকিয়ে এল। ৬০২ নম্বর ফ্ল্যাটে থাকেন অধ্যাপক দেবাশিস রায়। বৃদ্ধ মানুষটি একা থাকেন, স্ত্রী মারা গেছেন দু’বছর আগে। ছেলে আমেরিকায়। সপ্তাহে একবার ফোনে কথা হয়। ভদ্রলোক পুরনো বই আর অ্যান্টিক জিনিস কালেকশন করেন। নিরঞ্জন মাঝে মাঝে সন্ধ্যায় গিয়ে বসে, চা খায়, গল্প করে।

“কী করব এখন?” নিরঞ্জনের মাথার ভেতর চিন্তাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল। পুলিশে খবর দেওয়া যায়, কিন্তু কী বলবে? একটা সিকিউরিটি ক্যামেরা আমাকে বলল? কে বিশ্বাস করবে? তাকে পাগল ভাববে না? অথচ কিছু একটা করা দরকার। অধ্যাপক রায়ের জীবন বিপন্ন হতে পারে।

হঠাৎ তার মোবাইলের ভয়েস রেকর্ডার জীবন্ত হয়ে উঠল, “আমাকে ব্যবহার করো। আমি রেকর্ড করে রাখব। তুমি শুধু আমাকে চালু রেখো। প্রমাণ লাগবে, আমি সংগ্রহ করব।”

নিরঞ্জন অন্ধকার বারান্দায় বসে থাকল। শহরের আলোগুলো জ্বলছে দূরে। আর তার কানে বাজতে থাকল শত যন্ত্রের গুঞ্জন, যা তাকে এক নতুন দায়িত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

তৃতীয় অধ্যায়: পদক্ষেপ

পরের দিন সকাল থেকেই নিরঞ্জনের মনের ভেতর একটা অস্থিরতা। রাতে ঘুম হয়নি বললেই চলে। প্রতিটি শব্দে চমকে উঠছিল। ভোর পাঁচটা থেকেই বারান্দায় বসে আছে, চোখ ৬০২ নম্বর ফ্ল্যাটের দিকে। মাঝে মাঝে নিজের ক্ষমতাটাকে অভিশাপ মনে হচ্ছিল, আবার মনে হচ্ছিল এটা হয়তো এক অদ্ভুত ক্ষমতা ।

লিফটের ডিসপ্লে স্ক্রিন থেকে আওয়াজ এল, “অধ্যাপক রায় নেমে আসছেন। রোজকার মতোই সাতটায় মর্নিং ওয়াক।” নিরঞ্জন দেখল, সাদা পাঞ্জাবি পরা বৃদ্ধ মানুষটি ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছেন। কী নিষ্পাপ, নিরীহ চেহারা। কে জানে এই মানুষটার জীবনে কী বিপদ ঘনিয়ে আসছে।

বাড়ির ইন্টারকম হঠাৎ বলে উঠল, “ওর মোবাইলটা দেখো, পুরনো মডেলের নোকিয়া। কোনো স্মার্ট ফিচার নেই। চোরদের জন্য সুবিধা হবে। কেউ ট্র্যাক করতে পারবে না।”

নিরঞ্জনের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে দ্রুত তৈরি হয়ে নিল। অধ্যাপক রায় ফিরে আসার আগেই তার সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু কী বলবে? কীভাবে বলবে?

ঠিক আটটায় অধ্যাপক রায় ফিরলেন। নিরঞ্জন দেখল, ভদ্রলোক হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। বারান্দায় চা-বিস্কুট নিয়ে বসলেন। নিরঞ্জন এগিয়ে গেল।

“নমস্কার স্যার।”

“এসো, এসো নিরঞ্জন। আজ সকাল সকাল? অফিস নেই?”

“না স্যার, আজ ছুটি নিয়েছি।” নিরঞ্জন একটু ইতস্তত করে বলল, “স্যার, একটা কথা ছিল।”

“বলো।”

“স্যার, কাল রাতে কোনো অদ্ভুত শব্দ শোনেননি তো? মানে, কেউ দরজায় নক করা, এমন কিছু?”

অধ্যাপক রায় একটু অবাক হয়ে তাকালেন। “না তো। কেন বলো তো?”

নিরঞ্জন চুপ করে রইল। কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। এমন সময় তার মোবাইল ফোন বলে উঠল, “সত্যিটা বলো। উনি বুঝবেন।”

“স্যার,” নিরঞ্জন গলা নামিয়ে বলল, “আপনার নিরাপত্তা নিয়ে একটু চিন্তিত আছি। মানে, কিছু সন্দেহজনক লোক দেখা গেছে এদিকে।”

অধ্যাপক রায়ের চোখে উদ্বেগের ছায়া পড়ল। “কী রকম লোক?”

“স্যার, আপনার অ্যান্টিক কালেকশনের কথা অনেকে জানে। আর আপনি একা থাকেন…” নিরঞ্জন থামল। “আজ রাতে আমি জেগে থাকব। আপনি দরজা-জানালা ভালো করে চেক করে রাখবেন।”

বৃদ্ধ মানুষটি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “বুঝেছি। তোমার চিন্তার কারণ আছে। কিন্তু কীভাবে জানলে?”

নিরঞ্জনের মোবাইলের ভয়েস রেকর্ডার আবার বলে উঠল, “বলো, আমরা সবাই তোমার সঙ্গে আছি।”

চতুর্থ অধ্যায়: মোকাবিলা

রাত এগারোটা। নিরঞ্জন তার ফ্ল্যাটের আলো নিভিয়ে অন্ধকারে বসে আছে। প্রতিটি মিনিট যেন ঘণ্টার মতো কেটে যাচ্ছে। বাড়ির প্রতিটি যন্ত্র সজাগ, যেন তারাও পাহারা দিচ্ছে। ফ্রিজের মৃদু গুনগুনানি থেমে গেছে, ঘড়িগুলো নিঃশব্দে কাজ করছে।

“ওরা আসছে,” হঠাৎ করে লিফটের আওয়াজ ভেসে এল। নিরঞ্জনের বুকের ভেতর ধক করে উঠল। “দুজন লোক। ষষ্ঠ তলার বোতাম টিপল। একজনের হাতে কালো ব্যাগ, আর একজনের হাতে কিছু ধাতব জিনিস।”

নিরঞ্জনের মোবাইল ফোন কেঁপে উঠল, “এখনই পুলিশে ফোন করো। আমি নম্বর ডায়াল করছি।” কিন্তু নিরঞ্জন জানত, পুলিশ আসতে কমপক্ষে পনেরো মিনিট লাগবে। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যাবে।

করিডোরের লাইট হঠাৎ করে জ্বলে উঠল। “ওরা সিঁড়ি দিয়ে উঠছে,” বাল্বগুলো একসঙ্গে বলে উঠল। “লিফটের শব্দ এড়াতে চায়।”

নিরঞ্জন দ্রুত বেরিয়ে এল বাইরে। বুকের ভেতর ধুকপুক করছে, কিন্তু ভয়ের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে দায়িত্ববোধ। মোবাইলের ভয়েস রেকর্ডার অন করে রাখল। পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে, ক্রমশ কাছে আসছে।

দুজন ছায়ামূর্তি দেখা গেল। তারা ৬০২-এর দরজার সামনে পৌঁছে গেছে। একজন লক খোলার চেষ্টা করছে।

“কে ওখানে?” নিরঞ্জন চিৎকার করে উঠল। তার গলায় এমন শক্তি, যা সে নিজেও জানত না যে আছে।

লোক দুজন চমকে তাকাল। একজনের হাতে মাস্টার কি, আরেকজনের হাতে ব্যাগ। মুহূর্তের জন্য সবাই স্থির। তারপরই হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল।

করিডোরের সমস্ত লাইট একসঙ্গে জ্বলে উঠল, যেন কেউ স্যুইচ টিপেছে। ফায়ার অ্যালার্ম বেজে উঠল। প্রতিটি ফ্ল্যাটের ডোরবেল একসঙ্গে বাজতে শুরু করল। “জেগে ওঠো! জেগে ওঠো!” যন্ত্রগুলো একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল।

চোর দুজন ঘাবড়ে গেল। পালাতে শুরু করল। কিন্তু লিফট কাজ করছে না। “আমি ওদের নামতে দেব না,” লিফট বলল।

ততক্ষণে অন্য ফ্ল্যাট থেকে লোকজন বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। প্রথমে রূপা দত্ত, তারপর মিত্র পরিবার। সিকিউরিটি গার্ড ছুটে এল নীচে থেকে। চোর দুজন সিঁড়িতে আটকা পড়ে গেল।

পুলিশের সাইরেন শোনা গেল দূর থেকে। নিরঞ্জনের মোবাইল বলল, “সব রেকর্ড করে রেখেছি। এবার নিশ্চিন্ত।”

অধ্যাপক রায় বেরিয়ে এসেছেন ফ্ল্যাট থেকে। তার চোখে বিস্ময়, কৃতজ্ঞতা। নিরঞ্জনের দিকে তাকিয়ে শুধু বললেন, “ধন্যবাদ্।”

সেই রাতে নিরঞ্জন বুঝল, প্রযুক্তির এই যুগে আমরা কেউ একা নই। প্রতিটি যন্ত্রের ভেতরে একটা প্রাণ আছে, যা আমাদের দেখে, শোনে, রক্ষা করে। শুধু তাদের ভাষা বোঝার মানুষ লাগে।

পঞ্চম অধ্যায়: শোনার গল্প

“তুমি কী করে জানলে?” অধ্যাপক রায় জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর চোখে বিস্ময় আর কৌতূহল। পুরনো চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, “আমি তো কিছুই টের পাইনি।”

নিরঞ্জন একটু ইতস্তত করল। তার মোবাইল ফোন পকেট থেকে মৃদু স্বরে বলল, “বলো। উনি বুঝবেন।”

“স্যার, আমি যন্ত্রপাতির কথা শুনতে পাই।” নিরঞ্জন অস্বস্তি নিয়ে স্বীকার করল। “প্রতিটি যন্ত্র আমার সঙ্গে কথা বলে।”

অধ্যাপক রায়ের চোখে হঠাৎ এক চমক জ্বলে উঠল। তিনি ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে একটা পুরনো গ্রামোফোন নামালেন। কাঠের বাক্সটি ধুলোয় ঢাকা, কিন্তু তার গায়ে যে কারুকাজ, তা এখনও উজ্জ্বল।

“এটা ১৯৩২ সালের,” তিনি আলতো করে গ্রামোফোনটি স্পর্শ করলেন। “প্রতি রাতে আমি এর গান শুনি। এর কাছ থেকে পুরনো দিনের গল্প শুনি। কিন্তু…” তিনি একটু থামলেন, “শুধু পুরনো জিনিসগুলোর কথাই শুনতে পাই আমি। নতুন যন্ত্রপাতি আমার কাছে নীরব।”

গ্রামোফোনটি ধীরে ধীরে বলল, “আমরা পুরনো যন্ত্ররা শুধু ওনার সঙ্গে কথা বলি। আমাদের ভাষা পুরনো, আমাদের স্মৃতি প্রাচীন।”

নিরঞ্জন বুঝতে পারল কেন অধ্যাপক রায় সিকিউরিটি ক্যামেরার সতর্কবাণী শুনতে পাননি। প্রতিটি যন্ত্রের একটা নিজস্ব ভাষা আছে – কেউ কথা বলে পুরনো কবিতার মতো, কেউ আধুনিক গানের তালে।

অধ্যাপক রায় জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন। বাইরে সন্ধ্যা নামছে। “জানো নিরঞ্জন,” তিনি বললেন, “মানুষ শুধু কানে শোনে না, হৃদয় দিয়েও শোনে। আমি শুধু পুরনো যন্ত্রদের কথা শুনতে পাই, কারণ আমার হৃদয় সেই সময়ের সঙ্গে বাঁধা। তুমি দুই যুগের কথাই শোনো, কারণ তোমার হৃদয় উদার।”

রাত গভীর হল। নিরঞ্জন একটু হাঠতে বেড়লো । পথে হাঁটতে হাঁটতে শুনল শহরের কথা। ট্রাফিক সিগন্যাল বলছে তার ক্লান্তির কথা, রাস্তার লাইট বলছে রাতের গল্প, দোকানের শাটার বলছে দিনের হিসেব।

কিন্তু এখন সে বুঝতে পারে, শোনার জন্য শুধু কান নয়, চাই বোঝার মন। প্রতিটি যন্ত্রের আছে নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব সুর। কেউ যেমন গায় রবীন্দ্রসংগীত, কেউ র‍্যাপ। কেউ বলে কবিতা, কেউ গদ্য।

সব শোনার জন্য চাই একটি উদার হৃদয়, যে হৃদয় পুরনো-নতুন সব সুরকেই আপন করে নেয়। যে হৃদয় বুঝতে পারে, প্রতিটি যন্ত্রের ভেতরে লুকিয়ে আছে একটি গল্প, তাঁকে ব্যবহার করা মানুষের আবেগ ।

নিরঞ্জন মৃদু হাসল। এই শহরে কেউ একা নয়। প্রতিটি যন্ত্র, প্রতিটি বস্তু – সবার আছে নিজের ভাষা। শুধু প্রয়োজন একটু নীরবতা, একটু ধৈর্য, আর একটি শোনার মন।

বাড়ি ফিরে সে বারান্দায় দাঁড়াল। শহরের আলোগুলো জ্বলছে দূরে। হাজার হাজার যন্ত্র বলছে হাজার হাজার গল্প। কেউ হাসছে, কেউ কাঁদছে, কেউ গাইছে, কেউ স্বপ্ন দেখছে।

আর নিরঞ্জন শুনছে। কারণ সে জানে, শোনার জন্য শুধু কান নয়, চাই একটি সজাগ হৃদয়। যে হৃদয় বুঝতে পারে যন্ত্রের ভাষা, যে মন পড়তে পারে তাদের নীরব কবিতা।

উপসংহার: শব্দের সেতু

এক মাস কেটে গেছে। নিরঞ্জনের জীবন এখন আর আগের মতো নেই। অফিসে যাওয়ার পথে এখন সে শোনে মেট্রোর চাকার ছন্দ, “আজ লাইন ঠিক আছে, নিশ্চিন্তে যাও।” লিফটের বাটন বলে, “তাড়াতাড়ি করো, দশ মিনিট বাকি।” এমনকি অফিসের পুরনো কম্পিউটারটাও এখন তার বন্ধু, রোজ সকালে বলে, “আজকের সেলস টার্গেট ভালো যাবে।”

কিন্তু সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্কে। রূপা দত্তের সিকিউরিটি সিস্টেম একদিন জানাল যে সে প্রতি রাতে কাঁদে। নিরঞ্জন পরের দিন সকালে তার দরজায় এক কাপ চা নিয়ে হাজির। আজ রূপা আর একা নয়, প্রতি সন্ধ্যায় অধ্যাপক রায়ের বাড়িতে বসে তিনজনের আড্ডা হয়।

সেন পরিবারের মেয়ে অনন্যা এখন তার কাছে পিয়ানো শিখতে আসে। একদিন সে বলল, “আংকল, আপনি কীভাবে জানলেন আমি পালাতে চাইছিলাম?” নিরঞ্জন শুধু হেসেছিল। পিয়ানোটা বলে উঠল, “ও এখন অনেক খুশি। প্রতিদিন নতুন সুর শেখে।”

মিত্র পরিবারের অভিক এখন কাউন্সেলিং-এ যায়। তার ল্যাপটপ এখন আর দুঃখ করে না। বরং গর্বের সঙ্গে জানায়, “ও এখন প্রোগ্রামিং শিখছে। গেমিং চ্যানেল খুলবে।”

সবচেয়ে মজার পরিবর্তন এসেছে বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড রমেশের ক্ষেত্রে। একদিন সকালে সিসিটিভি ক্যামেরা জানাল, “রমেশদা রোজ রাতে কবিতা লেখে। কিন্তু কাউকে পড়ায় না, লজ্জা পায়।” পরের দিন থেকে অধ্যাপক রায়ের বৈঠকে রমেশের কবিতা পাঠের আসর বসে।

নিরঞ্জন এখন বুঝতে পারে, প্রতিটি যন্ত্রের মতো প্রতিটি মানুষেরও আছে নিজস্ব ভাষা। কেউ কথায় প্রকাশ করে, কেউ চোখের ভাষায়, কেউ নীরবতায়। যন্ত্রের ভাষা শোনার ক্ষমতা তাকে শিখিয়েছে মানুষের ভাষাও শুনতে।

সেদিন রাতে অধ্যাপক রায়ের বাড়িতে বসে সবাই গল্প করছিল। পুরনো গ্রামোফোন বাজছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান। তারপর রূপার আইফোন বাজল আধুনিক ব্যান্ডের সুর। অনন্যার পিয়ানো বাজছিল তার নিজের রচিত সুরে । রমেশ আবৃত্তি করল তার নতুন কবিতা।

হঠাৎ অধ্যাপক রায় বললেন, “জানো নিরঞ্জন, তুমি শুধু যন্ত্রের ভাষা শোনোনি। তুমি মানুষের ভাষাও শুনতে শিখেছ। আর তাই তুমি সবার জীবনে একটু আলো জ্বালাতে পেরেছ।”

নিরঞ্জন চুপ করে রইল। বাইরে শহরের কোলাহল। ভেতরে সংগীতের সুর। যন্ত্র আর মানুষের মিলিত কণ্ঠস্বর। সব মিলে এক অপূর্ব সিম্ফনি।

তার মোবাইল ফোন চুপি চুপি বলল, “দেখো, কত সুন্দর এই বিশ্ব, যেখানে সবাই একসঙ্গে গান গায়।”

পুরনো গ্রামোফোন সায় দিল, “হ্যাঁ, যেখানে পুরনো-নতুন, মানুষ-যন্ত্র, সবার ভাষা এক হয়ে যায়।”

নিরঞ্জন জানে, এই পৃথিবীতে কেউ একা নয়। প্রতিটি প্রাণে লুকিয়ে আছে একটি গল্প। শুধু প্রয়োজন তা শোনার মন। যন্ত্র হোক বা মানুষ, সবার ভাষা বোঝার জন্য চাই একটি হৃদয়।

আর সেই হৃদয় যখন জেগে ওঠে, তখন সমস্ত শব্দ মিলে তৈরি হয় এক অপূর্ব সুর – যা শোনা যায় না কানে, শোনা যায় শুধু আত্মায়।

অ্যালার্মের ভাষা রহস্যগল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!