নায়ক হত্যা রহস্য গোয়েন্দা গল্প – মৌলী কুন্ডু
মিসেস মধু চ্যাটার্জি ঘুমিয়েছিল তার নিজের ফ্ল্যাটের চারতলায়। তার স্বামী ব্রিজেশ অফিসের কাজে কিছুদিনের জন্য বাইরে গেছে। ব্রিজেশ আর মধুর এই একবছর হলো বিয়ে হয়েছে। অফিস যাওয়ার সুবিধার জন্য, আর মধুকে একটু বেশী সময় দেওয়ার জন্য শহরতলীর বাড়ি ছেড়ে নিউটাউনে এই ফ্ল্যাটটা নেয় ব্রিজেশ। এই ফ্ল্যাটে এসে মধু তো ভীষণ খুশী। একতো এতো সুন্দর ফ্ল্যাট, উপরি পাওনা হিসাবে তাদের কমপ্লেক্সের একটা আ্যপার্টমেন্টে টলিউড সুপারস্টার রাজ ব্যানার্জি থাকে। মধুদের ফ্ল্যাটও চারতলায় আর সুপারস্টার রাজের ফ্ল্যাটও চারতলায়। রাজের ঘরের জানলায় অবশ্য মোটা পর্দা থাকায় ঘরের মধ্যে কিছুই দেখা যায় না। তবে ফ্ল্যাটের কমপ্লেক্সে বেরোনো আর ঢোকার সময় প্রায়ই মধু দেখতে পায় সুপারস্টার রাজকে।
আজ ব্রিজেশের সাথে ফোনে কথা বলে ঘুমাতে একটু দেরীই হয়ে গেছে মধুর। কিন্তু তা সত্বেও রাত দুটোয় হঠাৎ তার ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘরে একবারে অন্ধকার না হলে মধুর ঘুম আসে না। তাই ঘরটা অন্ধকারই ছিল। মধু ভাবল একটু বাথরুমে যাবে। তাই বিছানার পাশের নাইটল্যাম্পটা জ্বেলে উঠে বসল। বিছানার সাইডে সোজাসুজি ড্রেসিং টেবিল। বিছানা থেকে নামার সময় মধুর চোখ পড়ল ড্রেসিংটেবিলের আয়নায়। সেখানে সে দেখল অভিনেতা রাজের ঘরের জানলা খোলা আছে। আর সেই খোলা জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঘরের ভেতরটা। ঘরে আলো জ্বলছে। মধু ভাবল রাত দুটোতেও রাজের ঘরে জানলা খোলা কেন? আর ঘরে আলোটাও তো জ্বালা আছে। অন্যদিন হলে অবশ্য আলো দেখা যেত না। রাজের ফ্ল্যাটের জানলায় মোটা পর্দা সবসময় টানা থাকে। কিন্তু জানলাটা আজ সকাল থেকেই খোলা আছে। সম্ভবত রাজের ঘরের এ.সি খারাপ হয়ে গেছে। সকালে ওর কাজের লোকের ওপর এই নিয়ে চোটপাট করতেও শোনা গেছে।
কিন্তু একি, এসব কি হচ্ছে রাজের ঘরে ! তিনজন লোক রাজকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর একজন ওর পা দুটো চেপে ধরল। একজন মুখে বালিশ চাপা দিল ,আর একজন রাজের গলায় দড়ির মত কিছু পেঁচিয়ে টেনে ধরল ।
মধু শিউরে উঠল। তার মনে হল,
“এটা কী সিনেমার কোনও শুটিং! নাকি রাজকে খুন করা হচ্ছে?”
সেই সময়েই আততায়ীদের একজনের চোখ পড়ল মধুর ঘরের দিকে। সেই ঘরে আলো জ্বলতে দেখে আর মধুকে বিছানায় বসে থাকতে দেখে সেই আততায়ী বালিশটা ছেড়ে দিয়ে ঘরের জানলাটা বন্ধ করে দিল।
মধুর চোখের ঘুম ছুটে গেল। কি ভয়ঙ্কর! এখন সে কী করবে? গতবছর শব্দবাজি নিয়ে অভিযোগ জানাতে যখন থানায় গেছিল তখনই থানার ফোন নম্বরটা নিয়ে রেখেছিল। একটু ভেবে সে তড়িৎ গতিতে থানায় ফোন করল।
“হ্যালো পুলিশ স্টেশন ?”
“হ্যাঁ বলুন ।
“আমি মধু চ্যাটার্জি বলছি। নিউটাউনের এ বি ব্লকের আশীর্বাদ অ্যাপার্টমেন্ট থেকে। আমাদের পাশের সূর্য অ্যাপার্টমেন্টে অভিনেতা রাজ ব্যানার্জি থাকেন। তিনজন লোক মিলে ওকে গলায় ফাঁস দিয়ে খুন করার চেষ্টা করছে ।”
“এক মিনিট ম্যাডাম। একটু গুছিয়ে বলুন ।
“এত সময় নেই, আপনারা এক্ষুনি এখানে চলে আসুন। রাজের ফ্ল্যাটে গেলেই আপনারা সব বুঝতে পারবেন।”
“ও.কে, আমরা যাচ্ছি।”
মধু ফোনটা রেখে ঘরে আর বসে থাকতে পারল না। তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। নীচে নেমে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে মধু, রাজের অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল পুলিশের জন্য।
পুলিশ কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এল। মধু তাদের গোটা ঘটনাটার বর্ণনা করতে করতে সূর্য অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকল। পুলিশ দেখে আ্যপার্টমেন্টের সিকিউরিটি গার্ডরাও বাধা দেওয়ার সাহস পেল না। লিফ্টে উঠে মধুও পুলিশের সঙ্গেই গেল রাজের ফ্ল্যাটে। সূর্য অ্যাপার্টমেন্টের চারতলার ফ্লোরটা পুরোটাই রাজের। লিফ্ট থেকে বেরিয়ে দেখা গেল সেখানে একটা কম পাওয়ারের নাইট ল্যাম্পের মতো আলো জ্বলছে। কিছুটা করিডোরের মতো জায়গা তারপরেই রাজের ফ্ল্যাটের দরজা। পুলিশ ডোরবেল বাজাতেই দরজা খুলল স্বয়ং অভিনেতা রাজ।
মধু চমকে উঠে বলল,
“একি আপনি বেঁচে আছেন?”
এমন অদ্ভুদ প্রশ্ন শুনেও রাজের মুখে কোনো অভিব্যক্তি দেখা গেল না। সহজভাবেই সে বলল,
“হ্যাঁ বেঁচে আছি, তা নয়তো কি মরে যাব?”
পুলিশ অফিসার বললেন,
“আসলে এই ভদ্রমহিলা বলছেন, উনি নাকি আপনাকে খুন হতে দেখেছেন।”
“আরে আমার ঘরে ফিল্মের রিহার্সাল চলছিল। তবে কোনো খুনের দৃশ্য তো ছিল না। যাই হোক, ফ্যানেরা আমার সাথে দেখা করার জন্য এরকম অনেক কিছুই বলেন।”
“আচ্ছা আচ্ছা সরি স্যার, এতো রাতে আপনাকে শুধু শুধু বিব্রত করলাম।”
এই বলে পুলিশ সেখান থেকে যেতে উদ্যত হল।
আর মধুকে বলল,
“ম্যাডাম শুনলেন তো? আপনি হয়তো কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন। এরপর থেকে এইভাবে মাঝরাতে পুলিশকে ফোন করার আগে ভালো করে দেখেশুনে নেবেন।”
মধুর তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। সত্যিই কী তাহলে সে স্বপ্ন দেখছিল। এরপর এই ব্যাপার নিয়ে মধু আর কোনও কথা বলল না। পুলিশ চলে গেল।
এই ঘটনার একদিন পর সকালে অভিনেতা রাজের পরিচারিকা পুলিশকে ফোন করল,
“স্যার রাজ দাদাবাবু মানে, নায়ক রাজ ব্যানার্জি তার নিজের ঘরে একটা কাপড়ে ফাঁস লাগানো অবস্থায় সিলিংফ্যান থেকে ঝুলছেন। আপনারা তাড়াতাড়ি চলে আসুন।”
এই কথা শুনে পুলিশ তাড়াতাড়ি রাজের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছায়। তারা এসে দেখল এবারে সত্যিই রাজ মারা গেছে। পরিচারিকাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে সে জানায়,
“দাদাবাবু গতকাল সারাদিন কিছু খাননি। তাকে খুব দুঃখী আর হতাশ লাগছিল। সকালবেলা দাদাবাবুকে ফ্রুট জুস দেওয়ার জন্য আমি ডাকাডাকি করি। ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। তখন দাদাবাবু দরজা খুললেন না। এরপর ব্রেকফাস্টও করলেন না। তারপর আমার একটু কেমন লাগে। দাদাবাবু কোনোদিন তার রুটিন ভাঙেন না। তখন আমি ম্যানেজারবাবুকে ডাকলাম। ম্যানেজারবাবু এই ফ্ল্যাটেই অন্য ঘরে থাকেন। সকাল থেকে উনি নানারকম কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ম্যানেজারবাবু এসে ডাকলেও বাবু দরজা খোলে না। তখন ড্রাইভার আর কিছু লোককে ডেকে দরজা ভাঙতেই দেখা যায় ওই দৃশ্য।”
পুলিশ পরীক্ষা করে বুঝতে পারে এটা সুইসাইড নয় মার্ডার। কারণ গলায় গোল দড়ির দাগ। সুইসাইড হলে সেটা ভি আকৃতির হতো। মুখেও কোনো বিকৃতি নেই। সম্ভবত অজ্ঞান করে খুন করা হয়েছে। তারপর ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে ফ্যান থেকে। গোটা ঘরে রাজ আর তার বাড়ির লোক ছাড়া আর কারও আঙুলের ছাপ নেই। চারিদিক পরিষ্কার গোছানো।
অবস্থা দেখে অফিসার ইনচার্জ রোহিত সেনকে তার আ্যসিস্টেন্ট ভরত প্রশ্ন করল,
“কিন্তু স্যার মার্ডারার কে? রাজের শত্রুর তো অভাব নেই। সম্ভবত এই শত্রুদের মধ্যেই কেউ সুপারি দিয়ে খুনটা করিয়েছে এটা বোঝা যাচ্ছে। আমরা তদন্ত কোথা থেকে শুরু করব?”
“দেখো ভরত যতদূর মনে হচ্ছে, কিলাররা হয়তো এই পেশায় নতুন তাই প্লটটা ঠিক সাজাতে পারেনি। এবারে মনে হয় সহজেই তাদের ধরা যাবে। না হলে বহু অভিনেতা অভিনেত্রীদের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে সুইসাইড বলে চালানো মৃত্যুগুলো আসলে খুন। কিন্তু সেটা প্রমাণ করা যায়নি।”
সংবাদ মাধ্যমকে জানানো হলো রাজ আত্মহত্যা করেছেন। এটা পুলিশের নতুন কৌশল। প্রথমেই এরকম বড়ো কোনও মানুষ খুন হলে পুলিশ জানায় সুইসাইড বা স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। এতে পাবলিক শান্ত থাকে। আর খুনিরা সতর্ক হয়ে সরে পড়ে না, বা তথ্য প্রমাণ লোপাট করার চেষ্টা করে না। খুনিদের ধরতে সুবিধা হয়।
পোস্টমর্টেম আর ভিসেরা টেস্টে শরীরে কোনো মাদক বা অজ্ঞান করার কোনও ড্রাগের উপস্থিতি পাওয়া গেল না। ব্যাপারটা নিয়ে রোহিত সেন অন্যান্য অফিসারদের সাথে মিটিংয়ে বসল। রোহিত প্রথমে কেসের অবস্থাটা সকলের সামনে তুলে ধরল,
“যত দূর মনে হয় রাজ মারা যাওয়ার আগে সজ্ঞানে ছিল। রাজের ফ্লোরের সমস্ত সিসিটিভি অকেজো হয়ে যায় দুদিন আগে। তাই আমাদের হাতে কোনো সিসি টিভি ফুটেজ নেই। তার বাথরুমে অবশ্য একটা জানলার মতো ফাঁক আছে, সেখান দিয়ে খুনিরা ঢুকতে পারে। তবে তার বাড়ির পরিচারিকা আর ম্যানেজার আগের দিন রাতে কোনোরকম আওয়াজ পায়নি। অভিনেতা রাজ মারা গেছে রাত দুটো থেকে আড়াইটের মধ্যে। কেউ রাজের ঘরে প্রবেশ করলে তিনি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। ঘরে কোনো ধস্তাধস্তির চিহ্নও নেই।”
ভরত বলে উঠল,
“কিন্তু এটা কী করে সম্ভব স্যার? রাজের ঘরে অজ্ঞাত পরিচয় কেউ ঢুকলে তিনি শব্দ করবেন না? বা আততায়ীরা কোনো আঘাত করে তাকে অজ্ঞান করলে তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন তো থাকতো। সেসব তো কিছুই নেই।”
আর একজন অফিসার বলল,
“স্যার রাজের ইন্ডাস্ট্রির ভেতরে আর বাইরে শত্রু সংখ্যাও তো কম ছিল না। আর গার্লফ্রেন্ডদের সংখ্যাও মন্দ ছিল না। তাদের কেউ কী এটা করতে পারে? আমরা তো সম্ভাব্য সকলই জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। এতো শোকের মধ্যেও পরিবারের কোনো লোককে বাদ দেওয়া হয়নি। কিন্তু নিট ফল তো জিরো।”
তখনই কেসের ইন চার্জ রোহিত সেনের মনে পড়ল মধু চ্যাটার্জির কথা। এই ভদ্রমহিলা রাজের মৃত্যুর আগের দিন থানায় ফোন করে জানিয়েছিলেন কারা যেন রাজকে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করছে। রোহিত ব্যাপারটা সকলকে বলল। ভরত বলল,
” তাহলে আগে থেকেই রাজকে মারার চেষ্টা চলছিল? তাই যদি হয় তাহলে রাজ সেই ব্যাপারে পুলিশকে কিছু জানায়নি কেন? পুলিশ তো সেদিন রাজের বাড়িতেও গেছিল। তখন রাজ জানিয়েছিল সেখানে নাকি শুটিংয়ের রিহার্সাল চলছে।”
” এই ব্যাপারটা বিশদে জানতে গেলে আমাদের মধু চ্যাটার্জির সাথে কথা বলতে হবে।”
পরের দিনই ডেকে পাঠানো হলো মধুকে। পুলিশ তাকে জেরা শুরু করল।
“আপনি জানলা দিয়ে অভিনেতা রাজকে খুন হতে দেখেছিলেন। তাই না?”
“হ্যাঁ দেখেছিলাম তো। তিনজন লোক ছিল। যে লোকটা রাজের গলায় দড়ি পেঁচিয়ে ধরেছিল, তার মুখ তো পরিষ্কার দেখেছিলাম।”
“লোকটাকে কেমন দেখতে ছিল তার বর্ণনা দিতে পারবেন?”
“হ্যাঁ পারব।”
এরপরেই পুলিশের প্রফেশনাল স্কেচ আর্টিস্টকে ডাকা হল। মধু চ্যাটার্জির বর্ণনা অনুযায়ী, তার দেখা সেই আততায়ীর স্কেচও আঁকানো হল। তারপর অবশ্য আততায়ী দলটাকে ধরতে বেশী সময় লাগল না। কিন্তু তারা কিছু স্বীকার করল না।
এদিকে রোহিত সেন রাজের পরিচারিকা রত্নার কাছে একটা বিশেষ তথ্য পেল। রাজ মারা যাবার আগের দিন কিছু খায়নি, এই কথা আগেই জানা গেছিল। যখনই রত্না খাবার দিতে গেছিল, রাজ বলেছিল,
“না আমি কিছু খাবো না।”
রাজের গলার স্বর নাকি রত্নার কিরকম একটু যেন আলাদা মনে হয়। রত্না বলল,
“দাদাবাবু যখন সিরিয়াল করতো সেই সময় থেকে আমি দাদাবাবুর কাছে কাজ করছি। দশ বছর ধরে দাদাবাবুকে দেখছি। তার গলার স্বর আমি খুব ভালো করে চিনি। সেদিন দাদাবাবুর গলাটা কীরকম যেন আলাদা লাগল। তাছাড়া খাবার না খাওয়া, এরকম তো দাদাবাবু কখনো করতেন না। দাদাবাবু তো খিদে সহ্যই করতে পারতেন না। যত শরীর খারাপই হোক না কেন খাওয়া ছাড়তেন না। আবার রাতে তাকে মনমরা হয়ে ঘরে বসে থাকতে দেখলাম। দাদাবাবু সব সময় খুব হাঁসিখুশি থাকতেন। প্রচন্ড বিপদে বা দুঃখের মধ্যেও তাকে কখনও ভেঙে পড়তে দেখিনি। এমনকী দাদাবাবু যে মাকে নিজের থেকেও বেশী ভালোবাসতেন তার মৃত্যুর খবর পেয়েও স্বাভাবিক ছিলেন। সেই দাদাবাবু কারণ ছাড়াই এমন মনমরা হয়ে কেন বসেছিলেন বুঝলুম না।”
এই যখন অবস্থা, গোটা পুলিশ ডিপার্টমেন্ট তখন কেসটা নিয়ে মাথার চুল ছিঁড়ছে, কেসের তদন্তকারি দুঁদে পুলিশ অফিসার রোহিত সেনও কিছু বুঝতে না পেরে হিমশিম খাচ্ছে, তখন ভরত একটা আলোর দিশা দেখতে পেল।
সারাদিনের ডিউটি সেরে ভরত বাড়ি ফিরে দেখল তার বোন শাহরুখ খানের ‘ফ্যান’ নামের একটা সিনেমা দেখছে। শাহরুখ তারও প্রিয় অভিনেতা। গরম গরম কফির কাপ নিয়ে সেও বসে পড়ল সিনেমা দেখতে। সিনেমায় শাহরুখ একজন সুপারস্টার হিরোর রোল করছে। তার সবচেয়ে বড় ফ্যান ঠিক তারই মতো দেখতে, তার ডামি। চেহারায় ঊনিশ বিশের পার্থক্য। সেই ডামি ফ্যান একসময় নানারকম অপরাধ করে সব দোষ সেই হিরোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। এই সিনেমাটা দেখেই ভরতের মাথায় একটা অদ্ভুত সন্দেহ জাগল। রাজের ঘরে লোকটা হয়তো রাজ ছিলই না। সেদিন পুলিশের সাথেও যার দেখা হয়েছিল সে হয়তো রাজের মতো দেখতে অন্য কেউ ছিল। এই সম্ভাবনার কথা মাথায় আসতেই ভরত, রোহিত সেনকে ফোন করে ব্যাপারটা বলল। ভরত ভেবেছিল স্যার হয়তো ব্যাপারটা শুনে হাঁসবেন। কিন্তু রোহিত কথাগুলো যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই শুনল। আর যথারীতি এ ব্যাপারে পরের দিন থেকে খোঁজ নেওয়াও শুরু হল। পুরো পুলিশ টিম খুঁজতে লাগল রাজের এরকম কোনো ডামি আছে কিনা। আর সে হঠাৎ বড়লোক হয়ে গেছে কিনা।
এরকম একটি লোকের খোঁজ পাওয়াও গেল। রাজের খুনের দায়ে অভিযুক্ত আততায়ী গ্যাংয়ের লিডার বিরজু যে পাড়ায় থাকে সেই পাড়াতেই রাজের মতো দেখতে ওম নামের একটা ছেলে আছে। তার আ্যকাউন্টে হঠাৎ দশ লাখ টাকা জমা পড়েছে। পুলিশ সেই ছেলেটিকে ধরে এনে চাপ দিতেই সে দোষ স্বীকার করল,
” বিরজুদা হঠাৎ রাত্রিবেলা এসে আমাকে বলল, রাজের ভূমিকায় রিয়াল লাইফে অভিনয় করতে হবে। পুলিশ এলে তাদের বলতে হবে — আমি বেঁচে আছি। আমার ঘরে শুটিংয়ের রিহার্সাল হচ্ছিল। আর বাড়ির ঝি খাবার দিতে এলেই বলতে হবে খাবো না। সারাদিন খুব দুঃখী দুঃখী মুখ করে বসে থাকতে হবে। এমন দেখাতে হবে যেন মনে হয় আর বাঁচার কোনও ইচ্ছা নেই।”
রোহিত সেন ভরতকে বলল,
“এটা এখন পরিষ্কার যে, বিরজুর কথা মতোই ওম কাজ করেছিল। মধু চ্যাটার্জি রাজের খুনের দৃশ্য দেখতে পাওয়ার পর বিরজু গিয়ে হয়তো ওমকে নিয়ে আসে। তারা রাজের বাথরুমের জানলা দিয়ে রাজের ঘরে ঢোকে। বিরজুরা সারাদিন বাথরুমেই লুকিয়ে ছিল। পরের দিন রাতে খুন করার পর সেই জানলা দিয়েই সবাই বেরিয়ে যায়।”
এদিকে বিরজু প্রথমে কিছু স্বীকার না করলেও পুলিশী জেরার মুখে পড়ে অনেক কথাই উগরে দেয়। তার থেকে রোহিত সেন জানতে পারে বিরজুর সুপারি কিলিংএর প্রফেশনে এটাই প্রথম খুন। এই খুনটার সুপারি যে দিয়েছিল তার নাম শুনে গোটা পুলিশ টিম চমকে ওঠে। নামটা ছিল সুবর্ণ ব্যানার্জি। এই সুবর্ণ ব্যানার্জি আসলে রাজের বাবা। ভদ্রলোক বিরজুদের গ্যাংকে রাজের মার্ডার করার জন্য একটা ফুল প্রুফ প্ল্যান দিয়েছিল। পুরো প্ল্যানটা ঠিকঠাক এক্সিকিউট করলে রাজের খুনিকে হয়তো কোনোদিনই ধরা যেত না। এছাড়া একটা ওষুধও দিয়েছিল রাজকে অজ্ঞান করার জন্য। কিছুটা ওষুধ তখনও বিরজুর কাছে ছিল। পুলিশ সেই ওষুধটা পরীক্ষা করে জানতে পারে এটা একটা নতুন ড্রাগ। আমেরিকায় আবিষ্কার হয়েছে। তাই পোস্টমর্টেমে অজ্ঞান করার কোনো ওষুধ পাওয়া যায়নি। রাজের এক দিদি আমেরিকায় থাকে। সুবর্ণ ব্যানার্জি মেয়ের সাথে আমেরিকায় দেখা করতে গিয়ে হয়তো এই ড্রাগটা জোগাড় করেছিল।
সব কিছু জানার পর রোহিত সেন কেসটা আবার সাজাতে শুরু করে,
“যেদিন রাতে রাজকে মারার কথা ছিল সেদিন ঘরের এসি খারাপ হয়ে যাওয়ায় জানলাটা খোলা ছিল। খুনিরা সেটা বন্ধ করতে ভুলে যায়। তাই পাশের ফ্ল্যাটের মিসেস মধু চ্যাটার্জি সব দেখে ফেলে। তখন বিরজু তার পাড়ার রাজের মতো দেখতে ওমকে নিয়ে আসে পুলিশকে ধোঁকা দেয়ার জন্য। রাজকে অজ্ঞান করে সারাদিন বাথরুমে লুকিয়ে থাকে। রাজের জায়গায় ওই ছেলেটাকে বসিয়ে রাখে। ওমকে কিছু খেতে বা কোথাও হাত ঠেকাতেও বারণ করা ছিল। যাতে ওর হাতের ছাপ কোথাও না পড়ে। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আবার তারা রাজকে মারার চেষ্টা করে। এবারে সফল হয়। তারপর রাজকে ঝুলিয়ে দিয়ে সবাই বাথরুমের জানলা দিয়ে পালিয়ে যায়।”
সব শুনে ভরত বলে ওঠে,
“কিন্তু স্যার একজন বাবা কেন নিজের ছেলেকে মারতে চাইবে।”
“এটাই তো আসল প্রশ্ন ভরত। আর উত্তর একমাত্র সুবর্ন ব্যানার্জি দিতে পারবে।”
প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য রোহিত সেন, সুবর্ণ ব্যানার্জিকে জেরা করতে শুরু করল। এতদিন সবাইকে জেরা করা হলেও শোকাহত বাবাকে সেইভাবে প্রশ্ন করা হয়নি। জেরার মুখে সুবর্ণবাবু দোষ স্বীকার করে। তিনি বলেন,
“ওই রাজ আমার নিজের ছেলে ছিল না। ওর মা পাড়ার এক লোকের সাথে নষ্টামি করে ওকে পেটে ধরেছিল। সব জেনেও আমি ওকে ছেলে বলে মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু হিরো হয়ে ও নষ্ট হয়ে যায়। হাজারটা মেয়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি করতো। ওর দিদিদেরকেও ও নষ্ট করতে থাকে। আমি আমার মেয়েদের ভালো বিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু রাজের পাল্লায় পড়ে আমার দুই মেয়েই সংসার ছেড়ে সারাদিন পার্টি, মদ, গাঁজা নিয়ে পড়ে থাকতো। আমি এইসব দেখেও কাউকে কিছু বলিনি। কিন্তু রাজের শেষ জন্মদিনের পার্টিতে ও যা করে তার ক্ষমা হয় না।
আমি এমনিতে রাজের কোনও পার্টিতে যেতাম না। কিন্তু ওই দিন আমার বড়মেয়ের আট বছরের মেয়ে টুটুল আমেরিকা থেকে এসেছিল মামার জন্মদিন উপলক্ষে। সেই জন্যই গিয়েছিলাম। সেই পার্টিটেও যথারীতি মদ, গাঁজা নেশায় সবাই বুঁদ হয়েছিল। টুটুল এইসময় নিজের মামার কাছে গিয়ে হাজির হয়। আর রাজ তখন নিজের আট বছরের ভাগ্নিকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে রেপ করে। এদিকে আমার মেয়ে মানে টুটুলের মায়ের তখন হুঁশ নেই। মদের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। আমি ঘুমাচ্ছিলাম, ঘুম ভাঙতে নাতনিকে খুঁজতে গিয়ে দেখি রাজের ঘরে অস্বাভাবিক অবস্থায় পড়ে আছে। বিছানা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সব বুঝতে পেরে বাচ্ছা মেয়েটাকে আমিই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। ডাক্তার বলেন মামার ওপর বিশ্বাস থাকায়, আর কী হচ্ছে বুঝতে না পারার জন্য ফিজিকাল ইনজুরি তেমন হয়নি, কিন্তু মেন্টালি একেবারে মেয়েটা ভেঙে পড়েছে। পারিবারিক কেচ্ছা আমি লোক জানাজানি করিনি। কিন্তু এই কাণ্ডের শাস্তি রাজকে দেব ঠিক করি। আর তাই খোঁজ নিতে শুরু করি টাকা নিয়ে খুন করে এমন কাউকে পাওয়া যায় কিনা। বাজারে এই ধরনের সুপারিকিলারদের রেট অনেক হাই। আমি রিটেয়ার্ড ব্যাংক ম্যানেজার, এত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য আমার ছিল না। তাই বিরজুকে খুঁজে পেলে এই কাজের ভার দিই। ওদের নতুন বিসনেস তাই রেট বেশী ছিল না। তবে কাজে হয়তো সেরকম পটু হবে না এটা বুঝতে পেরে আমিই ওদের পুরো প্ল্যানটা বলি। আমেরিকায় আমার জামাইয়ের ওষুধ কোম্পানির মালিক। আমি জামাইকে বলেছিলাম, আমার মারাত্মক ইনসোমেনিয়া আছে এই দেশের সব ঘুমের ওষুধ ফেল করে গেছে। তাই ও যেন খুব কড়া আর ভালো কিছু একটা ওষুধ আমাকে দেয়। এরকম নতুন একটা ওষুধ আবিষ্কার হতেই জামাই আমাকে সেটা পাঠিয়েছিল। আমি রাজকে যেদিন মারা হবে সেদিন ওর বাড়িতে যাই। রাতে ডিনারের সময় ঘুমের ওষুধটা খাবারে মিশিয়ে খাইয়ে দিই। বিরজুদেরও এই ওষুধ দেওয়া ছিল। প্রয়োজন হলে যাতে ব্যবহার করতে পারে। রাজের কোনও ডামিকে জোগাড় করে রাখতেও আমি বলেছিলাম। বিরজুদের ওপর দায়িত্ব ছিল মার্ডার করে সুইসাইডটা যাতে ঠিক করে সাজায়। কিন্তু ব্যাটারা সেটাও ঠিক করে করতে পারেনি। তাই ধরা পড়তে হল। এবার আর কেচ্ছা কেলেঙ্কারির কিছু বাকি থাকবে না। যে জিনিসটাকে সারা জীবন আমি এড়িয়ে চলেছি সেটাই শেষ বয়সে..”
এই বলেই বৃদ্ধ হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগলেন।
ভরত বলল,
“স্যার একটা কথা কিন্তু মানতেই হবে মিসেস মধু চ্যাটার্জি সেই প্রথম দিন ঘটনাটা দেখে না জানালে কেসটার সমাধান করা দুষ্কর হতো।”
ইন্সপেক্টর রোহিত সেন বললেন,
” ঠিকই বলেছো ভরত, সত্যিই এই মায়ানগরী কী বিচিত্র। এখানে সবার মনের মণিকোঠার নায়ক বাস্তব জীবনে খলনায়কের থেকেও জঘন্য ও চরিত্রহীন হয়। তাদের অপরাধের জন্য কতো মানুষকেই না কষ্ট পেতে হয়।”
নায়ক হত্যা রহস্য গোয়েন্দা গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
অ্যালার্মের ভাষা
চা-বেলার চৌকাঠ
অরুন্ধতির নীল চিঠি