গোয়েন্দা বোসের নেকলেস রহস্য ভেদ রহস্য গল্প – মিঠুন মুখার্জী
গোয়েন্দা বোস ওরফে অমরকৃষ্ণ বোসের রহস্যভেদের কথা ভারতবর্ষের সবাই শুনেছে। এমন গোয়েন্দা সমগ্ৰ ভারতবর্ষ খুঁজলে খুবই কম পাওয়া যাবে। আজ তাঁর এক অসাধ্য সাধনের গল্প বলব। আমি ঋজু চট্টোপাধ্যায় ওরফে ঋজু, গোয়েন্দা বোসের ডান হাত। তার সমস্ত কেসের সমাধানে আমি তার সঙ্গেই ছিলাম। বাঁহাত হিসাবে ছিলেন কৃষ্ণচরণ মিত্র ওরফে কেষ্টা দা। এই কেস হাতে নেওয়ার আগে আমরা তিন জন বহু রহস্য উন্মোচন করেছি। একটা আরেকটার থেকে ছিল গভীর রহস্যময়। বোস দার ঠান্ডা মাথার চিন্তা ও ধৈর্য্য এককথায় অসাধারণ। আমাদের দুজনের চিন্তা-ভাবনা যেখানে পৌঁছাতে পারে না, সেখানে বোস দা অবলীলায় দ্রুত পৌঁছে যান। সেই কারনেই তিনি আমাদের গুরু আর আমরা দুজন তার দুই হাত।
আমাদের তিনজনের প্রকৃতি, দৈহিক গঠন, বেশভূষা, পছন্দ-অপছন্দ সবটাই ‘গোয়েন্দা বোসের রহস্যভেদ’ গল্পে আলোচনা করা হয়েছিল। বলেছিলাম বোসদার বন্দুক চালানোর দক্ষতা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার কথা। দেশনায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের আদর্শে আদর্শায়িত সে। ফেলুদার মতো একজন গোয়েন্দা হয়ে ওঠার চেষ্টা করেন তিনি। সত্যজিৎ রায়ের এই চরিত্রটি তার খুবই পছন্দের। সমস্ত পুলিশেরা যে সব রহস্য উন্মোচন করতে বার বার ব্যর্থ, সেই সকল রহস্য ভেদে গোয়েন্দা অমরকৃষ্ণ বোসের ডাক পড়ে। তাঁর ডাক পড়া মানেই আমার ও কেষ্টাদারও ডাক পড়া। কারণ আমাদের দুজনকে না নিয়ে আজ পর্যন্ত বোস দা কোনো রহস্যই উন্মোচন করেন নি। ‘বিশাখাপত্তনামে জোড়া খুনের মামলা’ কেসটির রহস্য উন্মোচন করে মাত্র একসপ্তাহ আমরা বাড়ি ছিলাম। তারপর লাগেজ বেঁধে উড়িষ্যার পুরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করি আমরা। এবারের কেসটি একটু অন্যরকম। কোনো খুন বা নারী পাচার কান্ড নয়, হীরের নেকলেস গায়েব হওয়ার রহস্য উন্মোচনই এবারের বিষয়। তবে কেসটা খুবই ক্রিটিক্যাল ছিল। হীরের নেকলেস যে চুরি করেছিল তাকে আমরা কোনো মতেই ধরতে পারছিলাম না। অনেক কষ্ট করে আমরা এই অসাধ্য সাধন করেছিলাম।
এবারের ঘটনাটি ঘটেছিল একেবারে জগন্নাথ মন্দিরে। উড়িষ্যার এক বিখ্যাত গায়কের পত্নী প্রথম পুত্র সন্তান হওয়ায় জগন্নাথ মন্দিরে পুজো দিতে এসেছিলেন। বছর দশেক তাদের বিবাহ হলেও কোনো সন্তান হয় নি । নাম-যশ ও অর্থের কোন অভাব ঈশ্বরের কৃপায় না থাকলেও সন্তানের অভাবে সেই গায়কের পত্নী পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলেন। তাই গায়ক তার পত্নীকে নিয়ে এসে প্রভুর মন্দিরে মানত করেছিলেন– ‘তাদের যদি একটি পুত্র সন্তান হয়, তাহলে তারা সেই সন্তানকে এই মন্দিরে নিয়ে এসে পুজো দেবেন এবং সেই সন্তানের ওজন অনুযায়ী সোনা দান করবেন।’ যেমন কথা তেমনি কাজ। যেদিন তাঁরা পূজো দিতে এসেছিলেন সেদিন সকাল এগারোটার থেকে বারোটা পর্যন্ত মন্দিরে সাধারণের পুজো দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন মন্দির কর্তৃপক্ষ। উত্তম মোহান্তি নামের ওই ব্যক্তি দেশের একজন নামকরা গায়ক ছাড়াও তিনি উড়িষ্যা সরকারের একজন অত্যন্ত ক্ষমতাশালী বিধায়ক ছিলেন। ফলে চারিদিকে পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ ছিল। একটা মাছি গলার মতো পরিস্থিতি ছিল না। তবুও উত্তম মোহান্তির পত্নীর গলায় থাকা তিন কোটি টাকার হীরের নেকলেস কীভাবে উধাও হয়ে গেল কেউ তা বুঝে উঠতেই পারছিলেন না। তাদের পরিবার, পুলিশ ও সেবায়েতরা ছাড়া সেই এক ঘন্টা মন্দিরে কেউই ছিলেন না। আঁটোসাঁটো পাহাড়ার মধ্যে কখন হীরের নেকলেসটি উধাও হয়ে যায় তা তারা বুঝতেই পারেন নি। মন্দিরের ভিতরে বিরাট আড়ম্ভরের সঙ্গে পুজোর আয়োজন করা হয়েছিল। জগন্নাথ দেবের প্রধান সেবায়েত ও কয়েকজন অপ্রধান সেবায়েতের উপর এই পুজোর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল। পুজো খুব ভালো ভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর যখন গায়ক উত্তম মোহান্তি তাঁর ছেলেকে দাঁড়িপাল্লায় বসিয়ে সম ওজনের সোনা প্রভুর উদ্দেশ্যে মেপে দিচ্ছিলেন, তখন পত্নীর গলায় হীরের নেকলেস না দেখতে পেয়ে তিনি চিৎকার করে ওঠেন। তাঁর চিৎকারে অনেকেই ভয় পেয়ে যান। তিনি তাঁর পত্নীকে জিজ্ঞাসা করেন—“তোমার হীরের নেকলেসটা কোথায় গেল? একটু আগেও তো তোমার গলায় আমি দেখেছি। খুলে রেখেছ তুমি?” গায়ক উত্তম মোহান্তির বলার পর গলায় হাত দিয়ে তাঁর পত্নী দেখেন তার নেকলেসটি নেই। তিনি কান্না জুড়ে দেন। পুলিশ এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে মন্দিরের সমস্ত গেট বন্ধ করে দেন। তারপর মন্দিরে উপস্থিত সকল ব্যক্তির তল্লাশি নেন। পুলিশ কারো কাছ থেকে হীরের নেকলেস খুঁজে পান না। মন্দিরের সেবায়েতদের পুলিশ সন্দেহের বাইরে রাখেন না। অপ্রধান সেবায়েতদের তল্লাশি নেওয়ার পর পুলিশ যখন প্রধান সেবায়েতের তল্লাশি নিতে যান, তখন গায়ক উত্তম মোহান্তি তাদের বলেন—“ওনার তল্লাশি নিতে হবে না। ওনার উপর আমাদের বিশ্বাস আছে। এমন জঘণ্য কাজ উনি করবেন না। ওনার তল্লাশি নিলে ওনাকে অসম্মান করা হবে। তাছাড়া উনি আমাদের কাছে প্রভুসম।” উত্তম মোহান্তির কথা শুনে পুলিশ প্রধান সেবায়েতকে আর তল্লাশি করেন না। হীরের নেকলেসের এভাবে ভ্যানিশ হয়ে যাওয়াটা সকলের কাছে পীড়া দায়ক হয়ে ওঠে। গায়ক ও বিধায়ক মোহান্তি প্রশাসনকে তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার কথা বলে সন্তান ও পত্নীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। তার আগে তিনি সন্তানের সম ওজনের সোনা প্রধান সেবায়েতের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
তারা চলে যাওয়ার পর স্থানীয় পুলিশেরা মন্দির চত্বর তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিলেন, যাকেই সন্দেহ হয়েছিল তাকেই তল্লাশি চালিয়েছিলেন। কিন্তু হীরের নেকলেস তারা খুঁজে পান নি। স্থানীয় পুলিশ ব্যর্থ হওয়ার পর ডাক আসে কলকাতার বিখ্যাত গোয়েন্দা অমর কৃষ্ণ বোস ওরফে গোয়েন্দা বোসের। যেদিন এই কেসটা আমরা হাতে নিয়েছিলাম তার এক সপ্তাহ পর পুরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলাম। বোসদার বোনের বিয়ের কারণে কেস হাতে পাওয়ার পর এই প্রথম আমরা এক সপ্তাহ দেরি করেছিলাম। নতুবা দুদিনের মধ্যে সকল তদন্তের জন্য উদ্দিষ্ট জায়গায় আমরা পৌঁছে যাই। বোসদার বোনের বিয়েতে আমি ও কেষ্ট দা খুবই আনন্দ করেছিলাম। কলকাতার এক বনেদি বংশে তার বোনের বিয়ে হয়েছিল। ছেলে ইন্সপেক্টর অফ পুলিশ। যাকে বলে সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি। বোসদারই বন্ধু। ছোটবেলা থেকেই উভয়ের সঙ্গে প্রেম ছিল। সেই প্রেম উভয় বাড়ির মতে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে পরিণত হয়েছে। বিয়ে থেকে বৌভাত পর্যন্ত এই তিন দিন আমাদের তিনজনের কিভাবে যে কেটেছিল তা বুঝতেই পারিনি। সব কিছুর দায়িত্বে আমরা তিনজনেই ছিলাম। একমাত্র বোনের বিয়েতে বোসদা কোনো কার্পণ্য করতে চাননি। তাই খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে বোনকে সাজিয়ে দেওয়া, কলকাতার সবচেয়ে ভালো বিয়ে বাড়ি বুকিং, শ্রেষ্ঠ ক্যাটারার, বোনের প্রিয় খাবার সব কিছুরই আয়োজন করেছিলেন গোয়েন্দা অমর কৃষ্ণ বোস। পুলিশের বিয়েতে পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ ছিল। সে এক এলাহী কান্ড। না দেখলে যতই বর্ণনা করি না কেন কম হবে। একমাত্র বোনকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠেছিলেন বোস দা। এই মানুষটির এমন রূপ আমরা কোনদিন দেখিনি। তিনিও যে এভাবে কারো জন্য মনের কষ্টে কাঁদতে পারেন, তা আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। সব বিষয়ে বোস দার মনের জোর ছিল প্রবল। তাই আমরা দুঃখ পেয়ে কাঁদলে তিনি আমাদের বলতেন— “এভাবে কেঁদে কোনো সমস্যার সমাধান পাওয়া যায় না। মনের বিশ্বাস নিয়ে সমস্ত সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করতে হবে। তাহলেই কান্না ভুলে যাবি। প্রিয়জন বিচ্ছেদেও আমি কোনদিন চোখের জল ফেলি নি। আমরা গোয়েন্দা, চোখের জল ফেললে অন্যের চোখের জল মোছাব কীভাবে? আমাদের মনকে অনেক শক্ত করতে হবে।” সত্যিকথা বোসদার বাবা বছর পাঁচেক আগে অকালে চলে গেলে বোসদাকে একফোঁটা চোখের জল ফেলতে দেখি নি আমরা। আমাদের বলেছিলেন—” আমি চোখের জল ফেললে এখন থেকে এ সংসার কে সামলাবে? আমার চোখে জল দেখলে মা-বোনও ভেঙে পড়বে। কষ্ট আমারও হচ্ছে, কিন্তু চোখে জল আনা একেবারে বারন।”
বোসদার বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ার দুই দিন পর আমরা তিনজন বাক্সপ্যাটরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম গন্তব্য স্থলে। হাওড়া থেকে সকাল বেলা ট্রেনে চাপলাম আমরা। এসি টু-টায়ারের টিকিট ইমেইলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন হীরের নেকলেস ভ্যানিশ কেসের দায়িত্বে থাকা অফিসার। ট্রেনে চেপে লাগেজপত্র ঠিকঠাক ভাবে রেখে যে যার সিটে গিয়ে বসি। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখি বোসদা নাখ ডাকা শুরু করেছেন। আমি বুঝলাম বোনের বিয়ে নিয়ে কদিন যেভাবে বোসদার ধকল গেছে তারই পরিনতি এই ঘুম। বিশাখাপত্তনাম থেকে ফিরে মানুষটা দুটি চোখের পাতা এক করতে পারেন নি। আমি ও কেষ্টা দা প্রতিদিন রাতে বাড়ি চলে যেতাম। ফলে ঘুমের ঘাটতি আমাদের দুজনের ছিল না। তাকে আর জ্বালাতন না করে আমি ও কেষ্ট দা নিজেদের পারিবারিক বিষয় নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে যাই। একঘন্টা পর আমাদের গুরুর ঘুম ভাঙে। এসির ঠাণ্ডাটা একটু বেশি থাকায় আমরা একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে নিই। আমাদের বগিতে একজন ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনিও পুরীর জগন্নাথদেবের দর্শনে যাচ্ছিলেন। বাড়ি তার কলকাতায় হলেও কর্মসূত্রে তিনি মুম্বাইতে থাকেন। সেখানে তিনি টাটা কোম্পানিতে চাকরি করেন। প্রত্যেক বছর একবার করে বাবার দর্শনে তিনি পুরীতে যান। তাই সেখানকার সবকিছুই তার নখদর্পনে। হীরের নেকলেস চুরি যাওয়ার সমস্ত ঘটনাটাই ফোনে পুলিশ অফিসার বোসদাকে জানিয়েছিলেন। বোসদার কাছ থেকে আমরা দুজন শুনেছিলাম। ট্রেনে এমন একটি লোকের সঙ্গে আলাপ হওয়ায় বোস দা পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা জানার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। প্রথমে সেই আগন্তুক ব্যক্তি বলেন– “আমি জয়প্রকাশ ধর। মুম্বাইয়ের টাটা টিসকোতে আজ পঁচিশ বছর চাকরি করছি। বিয়েতে আমি বিশ্বাসী নই বলে বিয়ে করি নি। পনেরো বছর আগে আমি আমার মাকে নিয়ে প্রথম জগন্নাথদেবের দর্শনে আসি। মার এই শ্রীক্ষেত্রধাম এতো ভালো লেগেছিল প্রায়ই আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতেন। আমি মনে মনে সংকল্প করেছিলাম মা যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন প্রত্যেক বছর একবার করে তাকে জগন্নাথ দেবকে দর্শন করাতে নিয়ে আসব। পাঁচ বছর হয়েছে আমার মা গত হয়েছেন। তার আগের দশ বছর তাকে নিয়ে প্রতিবছর আমি এখানে এসেছি। এই পাঁচ বছর আমি একা আসছি জগন্নাথ ধামে। চাকরি নিয়ে যতই ব্যস্ত থাকি না কেন একটু সময় বের করে প্রতিবছর এখানে আসবই। পান্ডাদের অত্যাচারে মাঝে মাঝে মনে হয় আসব না, কিন্তু সব ভুলে গিয়ে সুটকেস গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ি। এই মন্দিরে ভালো মানুষের যেমন অভাব নেই, তেমনি লোক ঠকানোর মানুষেরা যত্রতত্র ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। যারা মানুষকে সাবধান হতে বলেন তারাই মানুষের পকেট কেটে সর্বস্বান্ত করেন। মন্দিরের ভিতরে কোনো মানুষকে সহজে বিশ্বাস না করাই ভালো। মন্দিরের ভিতরে কোনো সিসি টিভি নেই। ফলে চোরদের বারবাড়ন্ত। সন্দেহের বসে কাউকে ধরে জিজ্ঞাসা করলে পান্ডারা সব এক জায়গায় হয়ে প্রতিবাদ করবে। ফলে প্রতিটি পদক্ষেপ খুবই বুঝে ফেলতে হবে। আমার মার সোনার হার বারদুয়েক মন্দিরের ভিতর থেকে উধাও হয়েছে। কিন্তু জনস্রোতের মধ্যে কারোকে কিছু বলতে পারি নি। একসঙ্গে ঠেলাগুত দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে জগন্নাথের দর্শন করানোর মধ্যেও আছে বিরাট দুর্নীতি। মন্দির কর্তৃপক্ষ সবকিছু জেনেশুনে এইরকম পরিবেশ তৈরী করে। শুধু পুরীতেই নয় দক্ষিণের তিরুপতি মন্দিরেও সকাল থেকে সমস্ত মানুষকে আটকে রেখে রাত্রে একসঙ্গে তিরুপতি নারায়নকে দর্শন করানো হয়। এখানে ঐ সময় যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তা মুখে বলা যায় না। প্রতিদিন প্রচুর পুন্যার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েন, ছেলে-মেয়ের ভিড়ে মেয়েদের সম্মানহানি ঘটে। এমনটা পুরীতেও হয়।”
জয়প্রকাশ ধর মহাশয়ের কথা শুনে আমরা খুবই উপকৃত হই। বোস দা রহস্য উন্মোচনের ছকটা মাথায় সাজিয়ে নেন। আমরা যে গোয়েন্দা তা জয়প্রকাশ ধর মহাশয়কে বুঝতেই দিই না। তিনি আমাদের পেশা নিয়ে একবার প্রশ্ন করেছিলেন। বোসদা বুদ্ধি করে বলেন— “আমরা তিনজন পুরীতে তিনটে হোটেলে ম্যানেজারি করি। এক মাসের ছুটিতে পাঁচ বছর পর বাড়িতে গিয়েছিলাম। এই সময় মালিক ও মালিকের ভাইয়েরা হোটেল তিনটি দেখাশোনা করছেন। জীবনটা একেবারে একঘেয়ে হয়ে গেছে।” ওই ব্যক্তির চোখ-মুখ দেখে আমার মনে হয়েছিল উনি আমাদের কথা বিশ্বাস করেন নি। আমাদের কথা শুনে উনি একটু হেসেছিলেন।
বিকেল চারটের মধ্যে আমরা পুরী স্টেশনে পৌঁছেছিলাম। লাগেজপত্র নামানোর পাঁচ মিনিটের মধ্যে দুজন পুলিশ অফিসার এসে হাজির হন। তারা বোসদাকে চিনতে পেরে নমস্কার জানান। বোসদা তাদের দুজনের সঙ্গে কেষ্ট দা ও আমার পরিচয় করিয়ে দেন। আমরাও জানতে পারি ঐ দুজন অফিসারের মধ্যে একজন সুশান্ত কুমার সাহু আর অন্যজন রবীন পাট্টানায়েক। তাদের দুজনের উপর হীরের নেকলেস চুরি হওয়ার কেসটির দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে । এরপর তাদের একটা জিপ গাড়ি করে স্বর্গদুয়ারের পাশের একটি হোটেলে এসে উঠি আমরা তিনজন। বোসদা অফিসার দুজনকে বলেন — ” আজকের দিনটা আমরা একটু বিশ্রাম নেব। আগামীকাল সকাল দশটায় আমরা জগন্নাথদেবের মন্দিরে যাব। আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকবেন। স্পটে যাওয়ার একঘন্টা আগে আপনারা হোটেলে আসবেন। ওই দিনের সমস্ত ঘটনাটা সামনাসামনি শুনব আমরা তিনজন। তারপর কালকে মন্দিরে আমাদের কী করনীয় তা আমি আপনাদের জানিয়ে দেব।” এরপর সুশান্ত কুমার সাহু বোসদাকে বলেন —” স্যার, আমরা কি সিভিল পোশাকে আসব না ইউনিফর্ম পরে? তাছাড়া আমাদের এখানে সবাই চেনে, আমাদের সঙ্গে আপনাদের দেখলে অপরাধীরা সচেতন হয়ে সরে পড়বে।” এরপর বোসদা বলেন—” সেই জন্যই তো কাল আগে আসতে বলেছি। কালকের পুরো ঘটনাটাই কালকে বলব। আর আপনারা আপনাদের পুলিশের পোশাক পরেই থাকবেন।” এরপর অফিসার দুজন চলে গেলে আমরা স্নান সেরে একটু বিছানায় গড়িয়ে নিই। তারপর বোসদা আমাকে ও কেষ্ট দাকে ডেকে বলেন— ” এই ঘটনাটি একটু অন্যরকম। আমার মন বলছে এই নেকলেস চুরির ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত। তানাহলে এতো প্রশাসনিক নিরাপত্তার মধ্যেও, এতোগুলো চোখকে ফাঁকি দিয়ে মহিলার গলা থেকে মহামূল্যবান হীরের নেকলেসটা নেয় কি করে!! এই রহস্য উন্মোচন খুব একটা সহজ হবে না। প্রধান সেবায়েতের তল্লাশি নেন নি পুলিশ। উত্তম মহান্তি তাদের বারণ করেছিলেন। তিনিও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নন। কিন্তু তার তল্লাশি করা চাপের হয়ে যাবে। এছাড়া মন্দিরের ভিতরে গেলে আরও অনেক সমাধানসূত্র পাওয়া যাবে।” এরপর আমরা একটু সমুদ্র তীরে ঘুরতে গিয়েছিলাম। আমরা যখন বাড়ি ফিরি তখন রাত নটা বাজে। কিছুক্ষণপর হোটেল বয় আমাদের ডিনার নিয়ে উপস্থিত হন। তাড়াতাড়ি খেয়ে আমরা শুয়ে পড়ি।
পরদিন বোসদা ও কেষ্ট দা খুব ভোরে উঠে সমুদ্র তীরে হাঁটতে যান। তাদের দুজনেরই সকালে হাঁটার অভ্যাস। বোস দা সকল সকাল স্নান সেরে ধ্যান করেন। তারপর আমরা তিনজন ব্রেকফাস্ট সারি। সকাল নটা নাগাদ পুলিশ অফিসার দুজন আসেন। বোসদা তাদের সকলকে নিয়ে ওই দিনের পরিকল্পনার কথা বলেন। তিনি বলেন– ” আজ আপনারা দুজন মন্দিরের ভিতরেই থাকবেন, আমার যখন কোনো কিছু জানার প্রয়োজন হবে তখন আমি আপনাদের কাছে ফোন করে জেনে নেব। ঋজু ও কেষ্ট দা মন্দির চত্বরে এমনভাবে থাকবে যাতে আমাদের কেউ সন্দেহ না করে। সমস্ত তদন্তটা ফোনের সহযোগিতায় হবে। কোনো অসঙ্গতি দেখলে আপনারা চারজন আমাকে জানাবেন।” আলোচনার পাঁচ মিনিট পর পুলিশ অফিসার দুজন একটা জিপ গাড়ি নিয়ে মন্দিরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তার কুড়ি মিনিট পর বোসদা, কেষ্ট দা ও আমি আলাদা আলাদা অটো ধরে মন্দিরে যাই। বোসদা মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করে সবকিছু গোয়েন্দার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখেন। পুলিশ অফিসার সুশান্ত কুমার সাহু মন্দিরের ঢোকার দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং রবীন পট্টানায়েক ছিলেন মন্দিরের ভিতরে। আমি ও কেষ্ট দা মন্দিরের বাইরের চাতালে আলাদা আলাদা দাঁড়িয়ে মন্দিরের দায়িত্বে থাকা সকলের উপর নজর রাখছিলাম। দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশদেরও সন্দেহের বাইরে রাখি নি আমরা। এদিকে বোসদা অপ্রধান সেবায়েতদের ও প্রধান সেবায়েতকে ভালো করে পরখ করতে লাগেন। তার মন বলে প্রধান সেবায়েতকে নজরে রাখলে অবশ্যই এই রহস্যের জট খুলতে পারে। যেদিন হীরের নেকলেস চুরি গিয়েছিল সেদিন সেবায়েতরা, পুলিশেরা ও গায়ক উত্তম মোহান্তি এবং তার পত্নী কোথায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তা বোস দা মিঃ সুশান্ত কুমার সাহুকে ফোন করে জেনে নেন। যদিও কয়েকদিন আগে পুরো পজিশনের একটি নক্সা মিস্টার সাহু হোয়াটসঅ্যাপে বোসদাকে পাঠিয়েছিলেন। সেটাই প্রত্যেকদিনের পজিশন ছিল সেবায়েতদের ও পুলিশদের। তদন্তের প্রথম দিনে সেই পজিশনগুলো ভালো করে লক্ষ করছিলেন বোসদা। প্রথম দিন একটি মাত্র অসঙ্গতি তার চোখে পড়েছিল। মন্দিরে দাঁড়িয়ে তিনি কিছুই বলেননি। দুইঘন্টা পর আমরা তিনজন হোটেলে ফিরে আসি। বোসদা পুলিশ অফিসার দুজনকে ফোন করে বিকেলে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন।
বিকেল চারটে নাগাদ পুলিশ অফিসার দুজন আমাদের হোটেলের ঘরে আসেন। বোসদা আমাদের চারজনকে নিয়ে আলোচনায় বসেন। তিনি বলেন — ” আজ আমার চোখে একটা অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। একজন পুলিশ তার জায়গায় আজ ছিলেন না। যেহেতু সাধারণ মানুষেরা কেউ তখন ছিলেন না, সেহেতু সেবায়েতদের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশেরাও সন্দেহের বাইরে নন। রক্ষক ভক্ষকের ভূমিকা নিয়েছে এর আগে অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে। তাছাড়া প্রধান সেবায়েতকে যেহেতু তল্লাশি নেওয়া হয় নি, সেহেতু তিনিও সন্দেহের বাইরে নন।” আমি বোসদাকে বলি— ” ওই পুলিশটি আজ হয়তো কোনো ব্যক্তিগত কাজের কারণে ছুটি নিয়েছেন। তার একদিন অনুপস্থিতিতে এটা ধরে নেওয়া বোকামি হবে যে সেই এই চুরি করেছে। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে আমাদের কাছে কোন প্রমাণ নেই। মন্দিরের ভিতরে কোনো সিসি ক্যামেরাও নেই যে আসল দোষীকে আমরা ধরতে পারব। সুতরাং আমাদের আরো বেশি করে চিন্তা করতে হবে।” আমার কথা শুনে বোস দা বলেন— ” তুই ঠিকই বলেছিস। তাহলে আমাদের এতো তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্তে আসলে চলবে না। আরও ভালো করে কয়েক প্রহর মন্দির চত্বর ও বিধায়ক উত্তম মোহান্তির বাড়িতে নজর রাখা প্রয়োজন। এমনও হতে পারে চুরিটা বাড়ির কেউ করেছেন। প্রমান লোপাট করার চেষ্টা করছেন। তবে তো ঘুঘুর বাসা বিধায়কের বাড়ির মধ্যেই থাকতে পারে।
পরদিন সকালে বোস দা আমাদের দুজনকে নিয়ে উত্তম মোহান্তির বাড়ি যান। সঙ্গে দুজন পুলিশ অফিসারও ছিলেন। তাড়া উত্তম মোহান্তির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। একজন পুলিশ অফিসার আমাদের দেখিয়ে বলেন—- ” স্যার , ইনারা তিনজন হীরের নেকলেস চুরির কেসটা দেখছেন। ইনি গোয়েন্দা অমর কৃষ্ণ বোস , ইনি কৃষ্ণচরণ মিত্র আর ইনি ঋজু চট্টোপাধ্যায়।” আমাদের সঙ্গে তিনি করমর্দন করলেন। তারপর এই রহস্য উন্মোচনের বিষয়টি কোথায় দাঁড়িয়ে আছে এবং চোরকে ধরতে আর কতদিন লাগবে তিনি তা আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন। তার কথার উত্তরে বোস দা বলেন —- ” আমরা আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি চোরকে ধরতে পারব। তবে কেসটা একটু জটিল আছে। সন্দেহ অনেকের উপরই হচ্ছে । তবে আসল অপরাধীকে ধরতে আপনাদেরও আমাদেরকে সহযোগিতা করতে হবে।” বোসদার কথা শুনে উত্তম মোহান্তি বলেন — ” অবশ্যই করব। আপনার কোনোকিছু জানার থাকলে আমাকে বলতে পারেন। আমি আপনাদের মনের সংশয় দূর করে দেব। ” এরপর বোসদা তাকে জিজ্ঞাসা করেন— “সেই দিন অর্থাৎ হীরের নেকলেস চুরির দিন আপনাদের বাড়ি থেকে কারা কারা মন্দিরে উপস্থিত ছিলেন? তাদের মধ্যে কজন গাড়ির ড্রাইভার ও বডিগার্ড ছিলেন? আপনাদের কাদের উপর সন্দেহ আছে তার একটি লিস্ট আমাদের এখনি দিতে হবে। প্রয়োজন হলে আমরা তাদের সবাইকে ডাকব। এই কেসটি অনেক জটিল। অপরাধীকে ধরতে আমাদের একটু বেগ পেতে হচ্ছে। তবে আপনি একদম চিন্তা করবেন না, চোর ধরা পড়বেই। গোয়েন্দা বোস আজ পর্যন্ত কোনো কেস হাতে নিয়েছেন আর রহস্য উন্মোচন হয়ে অপরাধী ধরা পড়ে নি, এমন খুবই কম হয়েছে।” এরপর উত্তম মোহান্তি সব তথ্য দিয়ে সাহায্য করেন। তাছাড়া তিনি বলেন— “সেই দিন তার সঙ্গে মন্দিরের ভিতরে সুরেশ দেশমুখ ও অবিনাশ দত্ত নামে দুজন বডিগার্ড ছিলেন। তিনজন গাড়ির ড্রাইভারও ছিলেন। তবে তারা মন্দিরের ভিতরে যান নি।”
উত্তম মোহান্তির বলা কথার মধ্যে অসঙ্গতি পান গোয়েন্দা বোস। পরদিন উত্তম মোহান্তির কথা মতো পাঁচজনকে ডাকা হয়। চারজন উপস্থিত থাকলেও একজন গাড়ির ড্রাইভার আসেন না। তার প্রতি আমাদের সন্দেহ জাগে। উপস্থিত চারজনকে আমরা বিভিন্ন প্রশ্নের জালে জড়ানোর চেষ্টা করি। কিন্তু তাদের প্রতিটি প্রশ্নের নির্ভীক উত্তর দেওয়া দেখে আমাদের মনে হয় এরা কেউ হীরের নেকলেস চুরি করতে পারে না। যিনি অনুপস্থিত ছিলেন ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখেছিলাম তিনি ভয়ের কারণে আসি নি তা নয়। তার এক আত্মীয় সেদিন পরলোক গমন করেছিলেন। পরদিন তার বাড়িতেও আমরা যাই। বোস দার কথা শুনে তিনি বলেন — ” দেখুন স্যার, আমরা পেটের জন্য গাড়ি চালাই। যারা আমার অন্নদাতা তাদের পেটে ছুরি মারার মতো প্রবৃত্তি আমার নেই। তাছাড়া আমার যখন যা প্রয়োজন স্যার ও ম্যাডাম সব পূরণ করেন। আমার কাছে তারা ভগবান আছেন। এমন জঘণ্য কাজ করার মতো কল্পনা আমি করতেও পারি না।” তার কথায় বোস দা বুঝতে পারেন তিনি যা বলছেন সব সত্য কথা।
বোস দা এই কেসের কোনো সমাধানসূত্র খুঁজে না পেয়ে খুবই চিন্তায় পড়ে যান। তিনি আমাকে ও কেষ্ট দাকে বলেন— ” এই হীরের নেকলেস যে বা যারা চুরি করেছে তারা খুবই গভীর জলের মাছ। তেমন কোনো প্রমাণই তারা রাখে নি। কি করে যে এই চোরদের ধরব তা বুঝে উঠতে পারছি না। তোমরা আরও চিন্তা করো, আমিও ভাবছি। অফিসার দুজনকে আজ বিকেলে একবার ডেকে নাও। ফাইনালি আমাদের একটা আলোচনায় বসতে হবে।” বোস দার কথা মতো অফিসার দুজনকে বিকেলে আলোচনার টেবিলে ডেকে নিই। গোয়েন্দা বোস ও আমরা দুজন হীরের নেকলেস চুরি যাওয়ার দিনের ঘটনা বারংবার খুব মনোযোগের সহিত শুনি। হঠাৎ বোস দা বলেন — ” চোরকে ধরার জন্য আমাদের একটা গল্প ফাঁদতে হবে। এই বিষয়টি আমরা পাঁচজন ছাড়া বিধায়ক উত্তম মোহান্তি ও তার সহধর্মিণী একমাত্র জানবেন। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আগামী পরশু এগারোটার সময় উনারা পুনরায় পুজো দিতে আসবেন। কিছু সময়ের জন্য সাধারণের পুজো দেওয়া বন্ধ থাকবে। হীরের নেকলেস চুরির দিন যারা যারা মন্দিরে ডিউটিতে ছিলেন সেদিন সকলেই থাকবেন। কেবল আমরা তিনজন সিভিলে মন্দির চত্বরে যাব। উত্তম মোহান্তির পত্নীর গলায় থাকবে একটা নকল হীরের নেকলেস। আমার বিশ্বাস এই খবর পেয়ে এবারও চোর হীরের নেকলেস চুরি করতে আসবে। আমাদের সকলকে খুবই সচেতন থাকতে হবে। যে করেই হোক এবার পাকা শোল আমাদের জালে ধরা পড়বেই। আমাদের প্রত্যেকের জামার পকেটে একটা করে ছোট ক্যামেরা লাগানো থাকবে। সেই ক্যামেরার টিভি অপারেটিং করবে ঋজু চট্টোপাধ্যায়। কোনো রকম অসঙ্গতি দেখলেই ও আমাকে ফোন করে জানাবে।”
একদিন পর বোস দার প্লান অনুযায়ী জগন্নাথের মন্দিরে পুজো দেওয়ার ঘটনাটি ঘটানো হয়। কেউ যাতে বুঝতে না পারেন এই পুজো দেওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ সাজানো, চোর ধরার জন্য, তাই খুবই সন্তপর্নে সবকিছু চলছিল। মন্দিরের সেবায়েতদেরও কিছু জানানো হয়নি। উত্তম মোহান্তি এবং তার পত্নীকে বোস দা তাদের প্লানের কথা জানিয়েছিলেন। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছুই চলছিল। সকাল এগারোটার সময় সাধারণের পুজো দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। গোয়েন্দা বোস মন্দিরের ভিতরে ও বাইরে কেষ্ট দা সকলের গতিবিধির উপর নজর রাখছিলেন। আমি একটি ঘরে বসে টিভিতে পুরো চত্বরটা দেখছিলাম। পুলিশ অফিসার দুজনও সবদিকেই নজর রাখছিলেন।
উত্তম মোহান্তি তার পত্নী ও ছেলেকে নিয়ে মন্দিরে ঢোকেন। তার সঙ্গে দুজন বডিগার্ড ছিলেন। ড্রাইভার তিনজন বাইরে গাড়িতে বসেছিলেন। পুজো দেওয়ার আগে উত্তম মোহান্তির পত্নী বাচ্চাটিকে একজন বডিগার্ডের কাছে দেন। তারপর হাত-পা ধোওয়ার জন্য কলে যান। সেখানে একজন সেবায়েত তাকে পুজো দেওয়ার জন্য ফুল ও মিষ্টি কেনার জন্য বলেন। হঠাৎ আরেকজন সেবায়েত বিধায়কের পত্নীকে ইচ্ছা করে ধাক্কা মেরে বলেন, দুঃখিত মা দেখতে পাই নি। এই ঘটনা সকলের চোখ এড়িয়ে গেলেও গোয়েন্দা বোসের তিক্ষ্ণ দৃষ্টিকে এড়াতে পারে নি। গোয়েন্দা বোস তৎক্ষণাৎ এগিয়ে গিয়ে দেখেন বিধায়ক পত্নীর গলায় নকল হীরের নেকলেসটি নেই। তাকিয়ে দেখেন ধাক্কা মারা ও ফুল-মিষ্টি বিক্রি করা সেবায়েত দুজন মন্দিরের বেরনোর গেটের দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাদের চোখে – মুখে ভয়। নেকলেসটি যে হাপিস হয়ে গেছে তখনও কেউ নজর দেন নি। আমি টিভিতে পুরো বিষয়টি দেখে বোসদাকে ফোন করে জানাই। মন্দিরে ঢোকার গেটের সামনে আমি বন্দুক নিয়ে ছুটে আসি। ওদিকে বোস দা ওই দুজন সেবায়েতের পিছনে ছোটে বন্দুক নিয়ে। বোসদাকে ছুটতে দেখে কেষ্ট দা ও দুজন পুলিশ অফিসার তার পিছন পিছন বন্দুক নিয়ে ছোটেন। হঠাৎ-ই বুঝতে পেরে সেবায়েত দুজন কোমর থেকে বন্দুক বের করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে লাগে। বোস দা বসে পড়ে প্রথমে দুজনের হাতে তারপর পায়ে গুলি করেন। সেবায়েত দুজনের হাত থেকে বন্দুক ছিটকে যায় ও তারা পড়ে যায়। আমি ছিটকে যাওয়া বন্দুক দুটি তুলে নিই। মন্দিরের ভিতরে থেকে সকলে বেরিয়ে আসেন গুলির শব্দ পেয়ে। ততক্ষণে বোস দা ও আমরা সবাই মিলে মালদুটোকে ধরে ফেলি। বোস দার মারের চোটে তারা স্বীকার করে দুটো হীরের নেকলেসই তারা চুরি করেছে। তারা বলে— ” আমরা পুরীর মন্দিরের বাইরে থাকা দুজন চোর, আমরা সেবায়েত নই। মালদার পার্টি দেখলেই আমরা সেবায়েত সেজে চুরি ছিনতাই করে থাকি। তবে এখানকার সেবায়েতরাও আমাদের থেকে কম নয়। আজ আমরা বুঝতে পারি নি যে আমাদের ধরার জন্য আগে থেকেই জাল পাতা হয়েছে।” নকল হীরের নেকলেসটি ওদের কাছ থেকে নিয়ে বোস দা বলেন— “আগের হীরের নেকলেসটি কোথায় রেখেছিস আমাদের নিয়ে চল।” তারা একবার বলে বেঁচে দিয়েছি, একবার বলে হারিয়ে গিয়েছে। সকলে মিলে রামধোলাই দেওয়ার পর তারা দুজন পুরীর সবচেয়ে বড় সোনার দোকানে নিয়ে যায়। ভালোকরে তল্লাশি করে সিন্দুকের গোপন ড্রয়ার থেকে বিধায়ক উত্তম মোহান্তির পত্নীর আসল হীরের নেকলেসটা উদ্ধার করা হয়। জেনেশুনে চুরির মাল কেনার অপরাধে সোনার দোকানের মালিককে গ্ৰেপ্তার করা হয় ও দোকান সিল করে দেওয়া হয়। চোর দুটোকে রুলের বাড়ি দিতে দিতে পুলিশভ্যানে তোলা হয়।
হীরের নেকলেস পেয়ে আনন্দে চোখে জল আসে বিধায়কের পত্নীর। আমাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন সকলে। সকলে হাততালি দিয়ে আমাদের কাজের প্রশংসা করেন। উত্তম মোহান্তি সেইদিন রাত্রে তার বাড়িতে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানান আমাদের। পরদিন আমরা যখন কোলকাতায় এসে পৌঁছেছিলাম তখন বোস দা আমাদের জানান— ” একসপ্তাহ পর আগ্ৰায় বি.কে রায় এন্ড কোম্পানির মালিকের হত্যার রহস্য উদ্ধারের জন্য আমাদের যেতে হবে। তোমরা মানসিক প্রস্তুতি নিও।”
গোয়েন্দা বোসের নেকলেস রহস্য ভেদ রহস্য গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
অ্যালার্মের ভাষা
চা-বেলার চৌকাঠ
অরুন্ধতির নীল চিঠি