এক পাটি জুতা গোয়েন্দা গল্প – সুতপা সোঽহং
সুসান নিজের হাতঘড়িটার দিকে তাকালো। নাহ আর কাঁহাতক এভাবে বসে থাকা যায়! পাক্কা একুশ মিনিট ধরে এখানে বসে আছে। না ম্যানেজার, না রিসেপশনিস্ট, না ওয়েটার। রিকের এখনো আসতে দশ মিনিট দেরি। সুসান দুতিনবার ‘হ্যালো কেউ আছো’ বলে ডাকাডাকি করলো। কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। মুম্বাইয়ের এতো নামি দামী রেস্টুরেন্ট থাকতে এই নির্জন রেস্টুরেন্টটাকে যে রিক কেন বেছে নিয়েছে ভগবানই জানে। ওকে নাকি কী একটা আশ্চর্য জিনিস দেখাবে। সুসান ফোনটা পকেট থেকে বের করল। রিক কতদূর, আর কতক্ষন লাগবে আসতে এসব জানার জন্য কল করতেই টু টু শব্দ করে কল কেটে গেল। এ আবার কী! একে এমন নির্জন একখানা রেস্টুরেন্টে সার্ভিস দেওয়ার কেউ নেই তার উপরে রিককেও ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। ল্যাপটপ থেকে অনেক গুলো গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট পাঠাতে হবে। কাজটা ওরা যত তাড়াতাড়ি শেষ করে ইন্ডিয়া ছাড়তে পারবে তত ওদের জন্য ভালো। বিরক্তিতে সুসান চেয়ার ছেড়ে উঠলো। কিচেনের দরজার সামনে দাঁড়ালো। কালো কাঁচের ওইপাশে কী আছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। খুলবে কি খুলবে না দোনামোনা করতে করতে দরজাটা ঠেলতেই ওর পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে গেল। নিজের অজান্তেই গলা দিয়ে আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। মেঝেতে মুখ থুবড়ে যে পড়ে আছে তার এক ঝলক দেখেই সুসানের বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হল না যে সে রিক ছাড়া আর কেউ নয়। মেঝেতে চাপ চাপ রক্ত। ও দৌড়ে রিকের কাছে যেতে নিয়েও থমকে দাঁড়ালো। জীবনের প্রথম দিকের অনেক গুলো বছর মাফিয়া দলের হয়ে কাজ করতে হয়েছে। তাই হৃদয়ের আবেগ কাজ করার অনেক আগে মস্তিষ্কের ভাবনা চিন্তার কাজ শুরু হয়ে যায়। মুম্বাইয়ের সানবার্ন থেকে বাঁচতে ওর ব্যাগে গ্লাভস থাকে সবসময়। ঝট করে ব্যাগ থেকে গ্লাভস বের করে পরে নিল। তারপর রিককে উল্টো করে দিল। বুকের পাঁজর ঘেঁষে একটা বুলেটের ক্ষতচিহ্ন। নাড়ি ধরেই বুঝল প্রাণ নেই। অনেকক্ষণ আগেই রিক মারা গেছে। সুসানের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। তবে এভাবে রিকের মৃতদেহ নিয়ে বসে থাকাটা শুধু বোকামি নয় জীবন মরণের ব্যাপার। একবার যদি পুলিশের খাতায় নাম ঢুকে যায় কোনোমতেই আর দেশে ফিরতে পারবে না। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বিপদের সম্ভাবনাগুলো সবই তার মুখস্থ। সুসান আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। রিক ঠিক যেভাবে উপুড় হয়ে পড়েছিল সেইভাবে শুইয়ে দিল। নিজের স্মার্টফোন থেকে নানা এঙ্গেলে এগিয়ে পিছিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল। ওর মনে এখন হাজারটা প্রশ্ন পাক খাচ্ছে। সেগুলোর উত্তর জানতে হলে ও নিজে বাঁচার রাস্তা খুঁজতে হলে ওকে এটুকু ঝুঁকি নিতেই হবে। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোনোর আগে যতটা সম্ভব দরজার হাতল, টেবিল, চেয়ার সব জায়গা থেকে নিজের হাতের ছাপ মুছে ফেলল। এখানে এক মুহুর্ত দেরি করার জন্য ওকে অপরিমেয় মাশুল গুনতে হবে। সুসান সানগ্লাসটা পরে যতটা সম্ভব মুখ আড়াল করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এল। জায়গাটা এত নির্জন। মুম্বাইয়ের মতো এমন জনবহুল শহরে এমন একটা নির্জন জায়গা কল্পনাই করা যায় না। রাস্তাগুলোও নির্জন। হাতে গোণা একজন দুজন। সুসানের বুকের ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। রিক যে সত্যিই আর বেঁচে নেই এটা যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। সুসান নিজেকে কোনোরকমে সামলালো। এখন আবেগে ভাসার সময় নয়। ওর পার্টনার মারা গেছে মানে প্রথম ও প্রধান তীর ওর দিকেই আসবে। বিদেশী হওয়ার ফলে ব্যাপারটা আরো জটিল হবে। সবথেকে বড় কথা সুসান যে খুনের স্পটেই ছিল এতে পুলিশের সন্দেহ আরো জোরদার হবে। সবার প্রথমে এই জায়গা থেকে ওকে দ্রুত সরতে হবে। ও জোরে পা চালালো। একটু যেতেই হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেল। নিচের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলো। রাস্তার পাশে রিকের একপাটি জুতা। সুসানের মনে পড়ল রিকের পায়ে জুতা ছিল না। তখন খেয়াল করেনি ব্যাপারটা।এখন জুতোর এক পাটি দেখে মনে পড়ল। কিন্তু আরেক পাটি কোথায়? সুসান এদিক ওদিক তাকালো। নাহ কোথাও আরেকটা পাটি দেখা পাওয়া গেল না। হঠাৎ সুসানের নজরে পড়ল একটা পাগল মত লোক হনহনিয়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে। কিন্তু তার পোষাক পাগলের মতো হলেও চোখগুলো তীক্ষ্ণ শিকারীর মতো যেখানে পাগলামীর চিহ্নমাত্র নেই। ডানহাত ছেঁড়া শার্টের নীচে এমনভাবে ঢাকা যে বোঝা যাচ্ছে না হাত আছে কি নেই। কিন্তু সুসানের এক মুহূর্ত লাগল না বুঝতে যে ওইভাবে হাত রাখার একটাই মানে। মাফিয়া দলের হয়ে কাজ করতে গিয়ে বন্দুক ধরার কায়দা, হাত রাখার কায়দা ওর নখদর্পণে। ও দৌঁড়াতে শুরু করলো। রাস্তার পাশে একটা ক্যাব দাঁড়ানো। ড্রাইভার আয়েস করে একটা সিগারেট সবে ধরিয়েছে। সে কিছু বলে ওঠার আগেই সুসান চার পাঁচটা পাঁচশো টাকার নোট হাতে গুঁজে দিয়ে নিজের ফ্ল্যাটের ঠিকানা বলল। ঠিকানা অনুযায়ী হাজার টাকাই ঠিক ছিল। বাড়তি এতগুলো টাকা পেয়ে ড্রাইভার সিগারেট ফেলে আর কিছু না বলে গাড়ি স্টার্ট করল। সুসান পিছনদিকে একবার দেখল। পাগল লোকটা খুব কাছে এসে পড়েছে।ক্যাব স্পিড নেওয়ার আগ মুহূর্তে গাড়ির আয়নায় লোকটার ছেঁড়া শার্টের ফাঁক দিয়ে বন্দুকের বাঁট চোখে পড়লো। সুসান পরিষ্কার বুঝলো রিকের পরে পরবর্তী টার্গেট এখন সে।
অথচ ঠিক কী কারণে রিককে খুন করা হয়েছে সেটাও সে জানে না। আর এখন এই মুহূর্তে তাকেই বা কেন টার্গেট করা হচ্ছে। সে রিকের লাশ দেখে ফেলেছে বলে? যদি কাউকে দেখত রিককে খুন করতে তাহলেও নাহয় বোঝা যেত যে খুনের সাক্ষ্য প্রমাণ লোপাট করতেই তাকে নেক্সট টার্গেট করা হয়েছে। নাকি যে প্রোজেক্ট নিয়ে ওরা ইন্ডিয়ায় এসেছে তার কারণে ? প্রোজেক্টটা সাফল্য পেলে শাসকদলের অনেকেরই মুখোশ খুলে পড়বে। এটাও কারণ হতে পারে। ঘটনার আকস্মিকতায় সুসানের সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। অনেকগুলো প্রশ্নের কোনো কুল কিনারা পাওয়া যাচ্ছে না। সে নিজের ফ্ল্যাটেও কি সুরক্ষিত? রিককে যারা মেরেছে তাদের কাছে সুসানের ঠিকানা জানা অসম্ভব ব্যাপার নয়। কিন্তু তা বাদে সে কোথায় যাবে কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। শত্রু চেনা বা তার কার্য কারণ জানা থাকলে তাও পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া যায়। এখানে তো কে শত্রু, কেন শত্রু, তাদের উদ্দেশ্য কী কিছুই জানে না। রিক হয়তো এসব প্রশ্নের উত্তর জানতো। রিক হয়তো সেগুলো জানাতেই ওই নির্জন জায়গাটা বেছে নিয়েছিল। কিন্তু জানানোর আগেই নিজেই খবর হয়ে গেল। রিক কিছু একটা দেখাতে চেয়েছিল। কী সেই জিনিস? এমনও হতে পারে সেই জিনিসটার জন্যই রিক খুন হয়েছে এবং খুনি জিনিসটা লোপাট করেছে। এই মুহূর্তে নিজের আগের হোটেলে যাওয়াটাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। হতেই পারে কেউ সেখানে ওকে শেষ করে দেবার জন্য আগে থেকেই অপেক্ষা করছে। ব্যাগে যা টাকা আছে তা দিয়ে এক সপ্তাহ চালিয়ে নেওয়া যাবে। সুসান একটা পার্লারের সামনে এসে ক্যাবটাকে বিদায় করে দিল। পার্লারে দুতিন রকমের উইগ কিনে নিজের চুলও বয়সকার্ট করে বেরিয়ে এল।
সুসান প্রয়োজনীয় জামাকাপড়, কিছু দরকারী জিনিসপত্র কিনে জুহু বিচের কাছাকাছি একটা হোটেলের রুম নিল। এখানকার হোটেলগুলোতে বিদেশীদের সংখ্যা প্রচুর। তাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সহজ। সুসান রুমেই খাবার দিতে বলে টিভি ছাড়ল। সমস্ত নিউজ চ্যানেল গুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। একটা চ্যানেলে গিয়ে আটকে গেল। যা ভেবেছে তাই কেউ গ্রীণ নামক ওই রেস্টুরেন্টের কিচেনে রিকের লাশ দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দিয়েছে। সুসান মন দিয়ে পুলিশের বিবৃতি শুনতে লাগল ” পশ্চিম মুম্বাইয়ের গ্রীণ নামক রেস্টুরেন্টে যে মৃত ব্যক্তির লাশটি পাওয়া গেছে তা একজন আমেরিকার নিবাসীর। আমেরিকা দূতাবাস মারফত তার নাম জানা যায় রিক ব্রাউন। আটদিন আগে সে তার এক বান্ধবীর সঙ্গে ভারতে আসে ঘোরার জন্য। তারা কোন হোটেলে উঠেছিল তা এখনো জানা যায়নি। তার বান্ধবীরও কোনো খবর পাওয়া যায়নি। খোঁজ চলছে। আততায়ী মৃতের বুকের পাঁজর বরাবর গুলি ছুঁড়েছে। বা পায়ের তালুতে ক্ষতচিহ্ন আছে যেন দেখে মনে হয় শক্ত ছুঁচালো পাথরে পা কেটেছে। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত কিছুই বলা যাবে না।” খবর বলার সাথে সাথে রিক ও সুসান দুজনেরই পাসপোর্ট ছবি টিভির পর্দায় ফুটে উঠেছে। সুসান জানত পুলিশ রিকের খোঁজ খবর করলেই ওর নিজের নামও তাতে জড়াবে। কিন্তু এখন টিভিতে খবর ও নিজের ছবি দেখার পর
নিজেকে হঠাৎ খুব অসহায় লাগছে। এখন সবার সামনে বাইরে বেরোলেও সমস্যা হতে পারে। যদিও ছোট্ট খবর তবুও ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে কারণ বিদেশীদের দিকে সবার নজর এমনিতেই বেশি। যা করতে হবে খুব ভাবনা চিন্তা করে। ভাগ্যিস বুদ্ধি করে অন্য নকল পাসপোর্ট দেখিয়ে এই হোটেলে উঠেছে। এরকম তিন চারটা নকল পাসপোর্ট ওদের কাছে সবসময় থাকে যেখানে চুলের স্টাইল পরিবর্তন করে বা বিভিন্ন উইগ, চশমা, নকল দাড়ি পড়ে ছবি তোলা। আর সুসানের ইনট্যুইশন বলছে তার হাতে সময় খুব কম। রিক না থাকায় এজেন্সির দেওয়া কাজও ওকে একাই শেষ করতে হবে। প্রোজেক্ট শেষ করার সাথে সাথে রিকের খুন হওয়ার পিছনের কারণ ও অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। সুসানের ইনট্যুইশন বলছে দুটোই আসলে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটার জট খুলতে পারলে অন্যটাও হয়ে যাবে। কাজগুলো প্ল্যান করে সিস্টেমেটিক করতে হবে। সুসান রুমের দরজা জানালা ভালো করে বন্ধ করে দিয়ে ডায়েরি নিয়ে বসল। যা যা মাথায় এল লিখে ফেলল
১) রিক সুসানকে কী দেখাতে চেয়ে ওমন নির্জন রেস্টুরেন্টে ডেকেছিল?
২) সুসান নিজেই নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগে এসেছিল। অথচ রিককে ঢুকতে দেখেনি। তার মানে রিক তারও আগে এসে পৌঁছেছিল। কিন্তু কেন? ও কি অন্য কারোর সাথেও দেখা করতে গিয়েছিল? কে সে?
৩) পায়ে জুতা ছিল না। রেস্টুরেন্টের বাইরে একপাটি জুতা। তবে কি বাইরেই রিকের উপর আক্রমণ করা হয়েছিল? ধস্তাধস্তিতে খুলে যায়? আরেক পাটি জুতা মিসিং।
৪) পায়ের তলায় ঘষটানোর চিহ্ন
সুসানের মনে হল আগে কেসটা যত জটিল মনে হচ্ছিল আসলে তার থেকেও জটিলতর। হঠাৎ করে ফোনের শব্দে ওর চিন্তার রেশ কাটলো। একটা আননোন নম্বর। ধরবে কি ধরবে না ভাবতে ভাবতে ধরেই ফেলল। ওপাশ থেকে একজন গম্ভীর গলায় ভাঙা ইংলিশে যা বলল তার সারমর্ম এই যে রিকের জিনিসটা তার কাছে আছে। সুসান যদি ‘লাল নথি নম্বর ৩০৩’ এজেন্সিকে না দিয়ে লোকটাকে দেয় তবে সে সুসানকে রিকের জিনিসটা দিয়ে দিবে ও সঙ্গে সুসানকে নিরাপদে দেশেও ফেরত পাঠাবে। আর তা নাহলে সুসানের ভবিষ্যতও রিকের মতো হবে। সুসান লোকটাকে পরিষ্কার করে জানালো রিকের কোন জিনিসের কথা বলা হচ্ছে সে সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। আর নিজের দেশ আমেরিকায় ফিরে করবেই বা কী! এরকম বোকা বোকা ডিল করতে সে রাজী নয়। যদি এজেন্সির ম্যানেজারের পোস্টটা সে পায় তবে ভেবে দেখতে পারে। লোকটা একটু দ্বন্ধে পড়ে গেল। সুসান যে এমন একটা আকর্ষনীয় ডিলকে নাকচ করে একদমই অন্যরকম একটা ডিলের আবদার রাখবে এটার জন্য লোকটা একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। সুসান সেটা লোকটার গলার স্বর ও উচ্চারণেই বুঝতে পারল। ও ঠিক এটাই চাইছিল। লোকটাকে নিজের ইনটেনশন ও চাহিদা সম্পর্কে দ্বন্ধে ফেলে যতটা সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করা। সুসান গলায় অবহেলার সুর ফুটিয়ে বলল রিকের জিনিস মানে ওই ডায়েরিটা ওর কোনোই দরকার নেই। সেটা লোকটা রাখতেই রাখে। ওষুধে কাজ হল। লোকটা একটু জোরে চিৎকার করে বলে উঠলো “ডায়েরি ? কীসের ডায়েরি? আমি রিকের ডান পায়ের জুতার কথা বলছি যেটার ক্যামেরাতে ধরা পড়েছে অনেক আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের নথির ছবি। সেই ছবিগুলো যদি একবার সবার সামনে আসে তবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনেকেরই মুখোশ খুলে পড়বে। শোনো মেয়ে সে জুতা তুমি চাও কিংবা না চাও তোমার দেশ আমেরিকা কিন্তু এই মূল্যবান জিনিস ছাড়বে না। তাই ভেবে চিন্তে আমাকে উত্তর দিও এ ডিলে তুমি রাজী কিনা। আমি আবার কালকে তোমাকে কল করব।”
কলটা কেটে গেল। ক্যামেরা লাগানো রিকের ডান পায়ের জুতা! এই কারণেই রিকের ডান পায়ের জুতা মিসিং ছিল। আর বাঁ পায়ের জুতা রাস্তায় পড়েছিল। তার মানে এই জুতাই রিক দেখাতে চেয়েছিল। আন্তর্জাতিক রাজনীতির কালো ইতিহাস জুতার ক্যামেরাতে সে বন্দী করে রেখেছিল। কিন্তু সুসানের একটা ব্যাপারে ভীষণ আশ্চর্য লাগলো। ‘লাল নথি নম্বর ৩০৩’ এর ব্যাপারটা লোকটা জানল কীকরে। রিক আর সুসান বাদে এজেন্সির শুধুমাত্র দুজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাই এ ব্যাপারে জানে। মিঃ রেহমান আর মিঃ উড। প্রথমজন ভারতীয়। দ্বিতীয়জন আমেরিকান। এজেন্সি ভারত থেকে একটা লাল নথি সংগ্রহ করার ভার ওদের উপর দেয়। নথির একটা কোড আছে । ৩০৩।যেটা শুধু সুসান আর রিক জানে। নথিটার গুরুত্ব সম্পর্কে শুধু এটুকুই জানানো হয় যে ১৯৪৭ এ স্বাধীনতার পরে আমেরিকার সাথে ভারতীয় উপমহাদেশের সমস্ত দেশগুলোর বিশেষ করে আমেরিকার সাথে রাজনৈতিক যে চুক্তিগুলো হয় তার পিছনে তৎকালীন এক ভারতীয় নেতা তথা ষড়যন্ত্রকারীর প্রভাব প্রচন্ড। সেই ষড়যন্ত্রকারীর আসল নাম সুসানদের জানানো হয়নি। শুধু সে সম্পর্কে অনেক নথি এক ভারতীয় সাংবাদিক সংগ্রহ করে লাল ব্যাগে পুরে রাষ্ট্রপতি ভবনে লুকিয়ে রাখে। কিন্তু বর্তমানে আমেরিকার এক সাংবাদিক সে সম্পর্কে খোঁজ পেলে আমেরিকার রাজনীতিতে তোলপাড় শুরু হয়। তারপর থেকে অনেকেই চাইছে সেই নথি সংগ্রহ করে আমেরিকার সরকারকে চাপে রাখতে। সুসানদের এজেন্সিও সে কাজে পিছিয়ে নেই। রিক আর সুসানের মতো করিৎকর্মা দুই গুপ্তচরকে এ কাজে ভারতে পাঠিয়ে দেয়।
পরেরদিন সুসান উইগ পাল্টিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ল। গ্রীন রেস্টুরেন্টে আরেকবার যাওয়া দরকার। ভিতরে ঢুকবে না। শুধু সেই রেস্টুরেন্টের মালিক বা কর্মচারীগুলোকে একটু দেখা দরকার। রিকের বাঁ পায়ের জুতাটাও দরকার। গ্রীণ রেস্টুরেন্টের সামনে পৌঁছে আশে পাশে প্রায় আধ ঘন্টা খোঁজার পর মিলল সেটা। সুসান চটপট জুতাটা পলিথিনে মুড়ে ব্যাগে ঢোকালো। তারপর সোজা হোটেলে।
হোটেলের রুমে ঢুকেই জুতার পাটিটা বের করল। ম্যাগনিফাইং গ্লাসে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বুঝলো জুতার ডান ধারে ঘষা লেগে বেশ খানিকটা চামড়া উঠে গেছে। জুতার ভিতরের দিকে হাত দিয়ে দেখতে গিয়ে খটকা লাগলো বাইরে থেকে জুতার সামনের দিকটা এত সরু লাগছিল না কিন্তু ভিতরের দিকে বেশ সরু হয়ে শেষ হয়ে গেছে। আলো ফেলে দেখতে গিয়ে বুঝল ভিতরে কিছু একটা আছে। বেশ কিছুক্ষণ কসরত করার পর সুসানের মুখে হাসি ফুটলো। রিক এত বোকামি কখনোই করবে না। জুতার বাঁ পায়ের পাটিতে ডানদিকে ঘষা লাগার সম্ভবনা সাধারণত কম থাকে যদি না জুতার উপর কিছু দিয়ে ঘষা হয়। জুতার ভিতর থেকে প্লাস্টিকের খাপটা বের করল যার আকৃতি জুতার মতই শুধু ডানদিকে একটা ছোট্ট ক্যামেরা লাগানো। সুসান শব্দ করেই রিকের তারিফ করল। জুতার আগায় ফুটা বা ক্যামেরা থাকলে সহজেই বোঝা যেত। তা না করে বাঁ পাটির ডানদিকে ক্যামেরা লাগিয়ে সেই জায়গার জুতার চামড়া ঘষে পাতলা ও ফুটা করেছে। কেউ বুঝতেই পারবে না। সুসান পুরো ঘটনাটা কল্পনা করার চেষ্টা করে। খুব সম্ভবত রিককে যখন আক্রমণ করা হয় রিক ক্যামেরা যুক্ত বাঁ পাটির জুতা রাস্তায় খুলে ফেলে। ওদের সামনে ডান পাটিটাকে রক্ষা করার ভান করে। ফলে সবাই ধারণা করে যে ডান পাটির জুতাতেই ক্যামেরা টাইপের কিছু আছে। সেটা সংগ্রহ করে খুনি রিককে খুন করে পালায়। কিন্তু পরে সেই জুতা থেকে কিছুতেই ক্যামেরা বের করার বুদ্ধি না পেয়ে সুসানের সাথে লাল নথির ডিল করার চেষ্টা করে।
সুসান ঝটপট নিজের ল্যাপটপে ক্যামেরাটা কানেক্ট করে। অনেকগুলো ভিডিও ফাইল দেখাচ্ছে। প্রথমটাতে ক্লিক করতেই পাসওয়ার্ড চাইছে। সুসান ভাবতে বসে পাসওয়ার্ড কী হতে পারে। রিক সম্পর্কে যতটুকু তথ্য জানা ছিল সুসান একের পর এক পাসওয়ার্ড বসায়। কিন্তু একটাও হয় না। সুসান ভাবতে থাকে। হঠাৎই ওর মনে হয় ক্লু হয়তো সেই রেস্টুরেন্টে থাকতে পারে। রিক মরার আগে সুসানের জন্য ক্লু রাখার একটা শেষ চেষ্টা করবেই কারণ সুসান যে সেই রেস্টুরেন্টে আসবেই সেটা তো রিকের জানা ছিল। সুসান নিজের ফোনে তোলা রিকের লাশের ছবিগুলো ভালো করে দেখতে থাকে। জুম করে দেখতে দেখতে হঠাৎ লক্ষ্য করে রিকের ডান হাতের নীচে রক্ত দিয়ে কিছু একটা লেখা। ছবিটা আরো ভালো করে জুম করলে বোঝা যাচ্ছে রিক ডান হাতের তর্জনী দিয়ে কিছু একটা লেখার চেষ্টা করেছে সুসান লেখাটা পড়ার চেষ্টা করে। প্রথম অক্ষর ইংরেজির এম। পাশে দুটো শূণ্য শূন্য কিংবা ও। MOO এটার মানে কী? ও সঙ্গে সঙ্গেই পার্সওয়ার্ডে মু টাইপ করে কিছুই হয় না। এরপর এম জিরো জিরো দেয়। তাতেও কিছু হয় না।
এর মধ্যে গতকালকের সেই অজানা নম্বর থেকে কল এল। এটার জন্য সুসান নিজেকে প্রস্তুত করেই রেখেছিল। কল আসতেই সুসান বলে উঠলো ‘হ্যালো মিঃ উড’। লোকটা ‘ইয়েস স্পিকিং’ বলতেই নিজেকে সামলে নিল। কিন্তু তাতে সুসানের যা বোঝার ছিল বোঝা হয়ে গেছে। লোকটা পরের একমিনিট ধরে নানা উপায়ে পরোক্ষভাবে বোঝানোর চেষ্টা করল যে সে মিঃ উড নয়। সুসানও এমন ভাব করল যে ওটা তার স্লিপ অফ টাং হয়েছে। আজে বাজে কিছু বকে সে ফোনটা রাখল। সুসান ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দিল না যে তার কাছে লাল নথির ফাইলটাই আর নেই। ও আবার ল্যাপটপে ক্যামেরাটা কানেক্ট করল। ছবিগুলো নিয়ে আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল করল সে তো ওটাকে ইংরেজির এম অক্ষর ধরেছে। উল্টোটাও তো হতে পারে যে ওটা ডব্লিউ। মনে হতেই ডব্লিউ ও বসালো। পরের ঘরে কী বসতে পারে? লাল নথি নম্বর ৩০৩ মানে 303 হ্যাঁ এক পলকে পাসওয়ার্ড ম্যাচ করে খুলে যায় ফাইল।
সুসান নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। টিভির সাউন্ড জোরে দিয়ে কানে হেডফোন গুঁজে ভিডিওগুলো একের পর এক চালায়। প্রথম ভিডিওটা পুরোটাই মিশমিশে অন্ধকার। কিন্তু কথাবার্তা শোনার যাচ্ছে। সুসান বুঝতে পারল রিকের সাথে মিটিং চলছে এজেন্সির। এজেন্সির একজনের গলা সে চিনতে পারল। হ্যাঁ সেই আননোন নম্বরের লোকটার গলা। অন্ধকার ঘরে বসে শুধু কানে শোনা নির্দেশ। তার পরের কয়েকটি ভিডিও জুড়ে ইন্ডিয়ার বেশ কিছু প্রভাবশালী মানুষের ভিডিও। কোনোটা গোপন মিটিং এর, কোনোটা ফোনকলে বলা কথার রেকডিং চালিয়ে ভিডিও করা। আবার কোনোটা কোনো জরুরি অফিসের কিছু অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভিডিও। আর একদম শেষের ভিডিওটা রিকের খুন হওয়ার পুরো ঘটনা। সুসান মন দিয়ে বার কয়েক শেষ ভিডিওটা দেখে। রেকডিং শুরু হয়েছে রিকের সাথে একটা লোকের আলোচনা দিয়ে। সুসান গ্রিণ রেস্টুরেন্টে আসার আগে রিক সেই লোকটার সাথে কথা আলোচনা করতে যায়। যেহেতু রিক চেয়ারে বসা আর জুতোর ক্যামেরার সামনে বাধা হল টেবিল তাই লোকটার মুখ দেখা যায় না। দুজনের কথা শুনে পরিস্কার বোঝা যায় যে লোকটা আসলে রিকের সাথে ডিল করতে চায়। লাল নথির তথ্যর বদলে বিশাল অঙ্কের টাকা। কিন্তু রিক এই সমস্ত কাজ থেকে মুক্তি চায়। লোকটা রাজী হয় না। উঠে চলে যায়। রিক বসে থাকে। হয়তো সুসানের জন্য অপেক্ষা করছিল। তারপর রিকও রেস্টুরেন্টের বাইরে যায়। দূর থেকে সেই পাগল ছদ্মবেশি লোকটাকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। এক হাত দূর থেকে গুলি করলে রিক মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। রিক ডান পায়ের জুতার পাটি বুকে জড়িয়ে ধরে। সেসময় ক্যামেরা এত নড়েছে যে বোঝা যায় ধস্তাধস্তি হয়। এক পর্যায়ে রিক বাম পায়ের জুতার পাটি খুলে ফেলে ডান পায়ের জুতোর পাটি নিয়ে কষ্ট করে রেস্টুরেন্টে ঢোকে। হয়তো সাহায্যের আশায়। ওইটুকু পর্যন্তই দেখা যায়। রিক গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রেস্টুরেন্টে ঢুকে কী করে বা তার সাথে কী হয় দেখা যায় না যেহেতু বাম পায়ের জুতার পাটির ক্যামেরা রাস্তাতেই পড়ে থাকে। সুসানের কাছে সমস্ত প্রমাণ আছে নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করার। রিককে হত্যাকারী যে ওই পাগল ছদ্মবেশি লোকটা সেটারও প্রমাণ রয়েছে। রেস্টুরেন্টে ঢোকার পরে রিকের সাথে কী হয়েছে সেটুকু কল্পনা করতে সুসানের সমস্যা হয় না।
সুসান উঠে ব্যালকনিতে যায়। এখন শুধু শেষ কাজটা বাকি। মোবাইলে সেই আননোন নম্বরে কল করে। একবার রিং হতেই কল রিসিভ হয়। সুসান সোজাসুজি বলে ওঠে ‘মিঃ উড তোমার ডিলে আমি রাজি। শর্ত অনুযায়ী আমার আমেরিকার অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দাও। আমি রিকের জুতায় লুকানো ক্যামেরার ভিডিও ফাইলটা পাঠিয়ে দিব।’
‘কে মিঃ উড? আমি কোনো মিঃ উড না। আর তোমার সাথে ডিল হয়েছিল আমেরিকায় তোমার নিরাপদে ফেরার ব্যবস্থা করার পরিবর্তে ওই ফাইল তুমি আমাকে দিবে।’
‘ডিলটা আমি একটু পরিবর্তন করেছি। শুধু আমেরিকায় নিরাপদে ফেরত যাওয়া নয় সঙ্গে লাল নথির তথ্যর জন্য যে পরিমাণ অর্থ দেওয়ার শর্ত হয়েছিল তার দ্বিগুণ তুমি আমাকে দিবে।’
লোকটা চিৎকার করে উঠল
‘তুমি ডিল পরিবর্তন করার কে? তুমি আমার হাতের পুতুল সুসান। আমি যা বলব তাই তোমাকে করতে হবে। ভেবে দেখো।’
‘ভেবে দেখা হয়ে গেছে মিঃ উড। তোমার লোক পাগল সেজে রিককে মেরেছে। তার প্রমাণ আমার কাছে আছে। শুধু তাই নয় এজেন্সির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছ তুমি।’
লোকটার হম্বিতম্বি হঠাৎ বদলে গিয়ে মিনমিন করে বলে ওঠে ‘এসব সব বানানো।’
সুসান হেসে ওঠে। ‘বানানো না সত্যি সেটা তুমি সবচেয়ে ভালো জানো। এবার বলো ডিলে রাজি কিনা।’
‘ঠিক আছে তাই হবে। তুমি দ্বিগুণ পরিমাণ টাকাই পাবে। কিন্তু ওই ভিডিওর ফাইল আমি চাই।’
‘ঠিক আছে। ডিল।’
সুসান এরপর আরেকটা ফোন আরেক জায়গায় করে। তার কাজ প্রায় শেষ। নিজের অ্যাকাউন্টটা চেক করে। হ্যাঁ শর্ত অনুযায়ী টাকা সে পেয়ে গেছে। উডকে সে ফাইলও পাঠিয়ে দিয়েছে। সুসান হাসে। উড ফাইলটা খোলার সময়ও পাবে না। মিঃ উডের বিরুদ্ধে সুসান আর মিঃ উডের কথাবার্তার রেকর্ডিং আরো একটা বড় প্রমাণ।
এমন সময় দরজায় টোকা পড়ে। সুসান না দেখেও বুঝতে পারে কে হতে পারে। দরজা খুলে দেয়। দুজন পুলিশ অফিসার ভেতরে ঢোকে। সুসান রিকের বাম পাটির জুতা, ক্যামেরা, অফিসারের হাতে তুলে দিল। ভিডিওর ফাইল ও মিঃ উডের সাথে কথাবার্তার রেকর্ডিং সুসান আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিল। বড় অফিসার হ্যান্ড শেক করে বলে ওঠে
‘ধন্যবাদ সুসান। আপনি যে দেশের কত বড় উপকার করলেন আপনি জানেন না। আপনি এখন সম্পূর্ণভাবে মুক্ত।’
এক পাটি জুতা গোয়েন্দা গল্প – সমাপ্ত
যে কেউ তাদের লেখা জমা দিতে চান। অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা জমা দিন পৃষ্ঠায় জমা দিন এবং যারা লেখা জমা দিচ্ছেন। পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
অ্যালার্মের ভাষা
চা-বেলার চৌকাঠ
অরুন্ধতির নীল চিঠি