কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » ভৌতিক গল্প » তুলির টান

তুলির টান

তুলির টান ভৌতিক গল্প – পারমিতা রাহা হালদার (বিজয়া)

 নীলের ছোট বেলার থেকেই পেইন্টিং এর নেশা। এখন প্রফেশনাল আর্টিস্ট হিসেবে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বাইরেও। অদ্ভুত ভাবে কিছুদিন ধরেই ক্যানভাসে তুলি বোলাতেই নিজের ভাবনার সাথে তুলির টান মিলাতে পারছেনা। তুলির টান দিতেই ভাবনার অবাধ্য হয়ে অন্য রূপ ফুটিয়ে তুলছে তুলি। হাজার চেষ্টাতেও ভাবনা রূপায়িত হচ্ছেনা। অবাক হয় নীল তুলির এক টানেই নিজের ভাবনা যেখানে অনায়াসে সাদা কাগজ রঙিন করে তুলতে পারে এখন সন্তান সম তুলি কেন এতটাই অবাধ্য! ল্যান্ডস্কেপের স্কেচে নিজের অজান্তেই একটা বাড়ি কিভাবে দেখা যাচ্ছে!?

      -বিরক্ত হয়ে নীল একদিন আঁকার সরঞ্জাম গাড়িতে নিয়ে অচেনা পথেই চলতে লাগল। একটা জঙ্গলের সামনে আসতে প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হতেই গাড়িটা আর এগিয়ে নেওয়া গেলনা।”ঘন অন্ধকারে কোথায় আশ্রয় পাবে এই দুর্যোগে”,দুশ্চিন্তায় আশ্রয়ের খোঁজে গাড়ি থেকে নেমে জঙ্গলের রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলো এবার। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর দূরে আগুন জ্বলছে দেখতে পেয়ে সেদিকেই এগোলো। ওই তো কে যেন তাবুর ভিতরেই আগুন পোহাচ্ছে! কাছে যেতেই লোকটা বললো, বসুন বাবু ভিজে গেছেন ঠান্ডা লেগে যাবে একটু তাপ নিলেই সুস্থ বোধ করবেন। লোকটা এমন ভাবে কথা বলছিল মনে হচ্ছিল যেন আগের থেকেই জানতো নীল আসবে। 

        -অন্ধকার জঙ্গলে এতো বৃষ্টিতে আপনি একা কি করছেন? আপনার চাদরটাও বেশ ভিজে রয়েছে। কথাটা বলে নীল চারিপাশ তাকালো। সামনে একটা কুয়ো আর ঠিক উল্টো দিকে বড়ো একটা বাড়ি, দেখে বেশ পুরোনো মনে হচ্ছে । যদিও মেঘাচ্ছন্ন পরিবেশ চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার ঠিকমতো কিছুই দেখা যাচ্ছেনা । উপায় নেই এই আশ্রয়ে রাত কাটাতে হবে! ভদ্রলোকের উল্টো দিকে বসলো নীল, হাত দুটো আগুনের তাপ নিতে বাড়িয়ে দিল। বেশ কিছু সময় আগেই বৃষ্টি বন্ধ হয়ে আগুনের তাপে নীলের ভেজা জামা শুকিয়ে গেছে কিন্তু লোকটার চাদর থেকে তখনও অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে দেখে নীল জিজ্ঞাসা করলো আপনার চাদর শুকাচ্ছে না কেন এখানো ভিজেই…! উত্তরে লোকটা হাসলেন।

        -আচ্ছা এই বাড়িতে কে থাকে আপনিও বা এই জঙ্গলে কেন?

বাবু, এই বাড়ি ডাক্তার কৃষ্ণপ্রসন্ন,খুব ভালো মানুষ। বিয়ের কয়েক বছর পরেও কোন সন্তান হলোনা। কৃষ্ণপ্রসন্ন আর ওনার স্ত্রী অনাথালয় থেকে পুত্র দত্তক নিয়ে তাকেই সন্তান রূপে স্নেহ করতেন। এইটা ওনার আউট হাউস। দেশ বিদেশ ঘুরে অনেক অর্থ উপার্জন করলেও এখানে আসতেন এখানকার আশেপাশের গ্রামের দরিদ্র মানুষের সেবা করার জন্য। এই গরীব মানুষ গুলোর কাছে ভগবান ছিলেন।

       -ডাঃ কৃষ্ণপ্রসন্ন এখন আসেননা এখানে? নীলের প্রশ্ন শুনে লোকটি বলেন,বছর পঁচিশ আগেই ডাক্তারবাবুর পালিত ছেলে সম্পত্তির লোভে ধারালো অস্ত্র পিঠে মেরে ওনাকে হত্যা করে এই কুয়োতে ফেলে দেয়। 

           -অন্ধকার পরিবেশে লোকটার কথায় নীলের গা ছমছম করছিল। লোকটি তখনও কথা বলে যাচ্ছে, আপনার হাতের সরঞ্জাম দেখে মনে হচ্ছে আপনি চিত্রশিল্পী। যেকোনো ছবিই আঁকতে পারেন নিশ্চয়ই? 

    হ্যাঁ পারি,আমার নাম নীল।যেকোনো ছবি শুধু বিবরণ শুনেই আঁকতে পারি,গম্ভীর স্বরেই উওর দিল ও।

            -বেশ তাহলে একটা ঘটনা আপনাকে বলি বাবু। কৃষ্ণপ্রসন্ন একবার এই আউট হাউসে আসলে এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে দরজায় কেউ জোরে জোরে ধাক্কা দেয়। কৃষ্ণপ্রসন্ন গ্রামের কারোর বিপদের আশঙ্কা বুঝতে পেরে ছুটে এসে দরজা খোলে। একজন ভদ্রলোক দরজায় দাঁড়িয়ে, ডাক্তারবাবু কে দেখে পা জড়িয়ে ধরে বলেন আপনি আমার স্ত্রী আর সন্তান কে বাঁচান। আপনার উপর ভরসায় অনেক দূর থেকে এসেছি। 

কিন্তু আপনার স্ত্রী সন্তানের কি হয়েছে?

আমার স্ত্রী গর্ভবতী,প্রসব যন্ত্রণা অসহ্য হতেই জ্ঞান হারিয়েছে। ঝড়-বৃষ্টির রাত আশেপাশে কোন হসপিটাল নেই তাই আপনার কাছে ছুটে এসেছি। আপনি আমাকে দয়াকরে ফেরাবেন না। 

    -একটু অপেক্ষা করুন আমি তৈরি হয়েই আসছি বলে, ডাক্তার বাবু নিজের ডাক্তারি সরঞ্জাম সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। ভদ্রলোক নিজের বাইকে ডাক্তারবাবুকে চাপিয়ে এগোতে লাগলেন,অনেকটা পথ যাওয়ার পর ভদ্রলোকের বাড়িতে পৌঁছালেন। সেখানে ভদ্রলোকের স্ত্রী অবচেতন অবস্থায় একাই পড়ে ছিল। ডাক্তারবাবু পরীক্ষা করে বললেন অপারেশন করা ছাড়া উপায় নেই। 

      -আপনার উপর সম্পূর্ণ আস্থা আছে, আপনি যেটা ভালো হয় করুন ডাক্তারবাবু। নিরুপায় হয়ে ডাক্তারবাবু রাজি হলেন বাড়িতেই অপারেশন করতে। ভদ্রলোককে সাহায্য করতে বলে তিনি অপারেশন শুরু করলেন আর ডাক্তারবাবুর নির্দেশ মতোই ভদ্রলোক সাহায্য করতে থাকলেন। সুন্দর ফুটফুটে কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হলো। স্ত্রী, সন্তান উভয়ের প্রাণ রক্ষায় ভদ্রলোক ভীষণ খুশি। ডাক্তারবাবু জানালেন আশা করি দুপুরের মধ্যেই আপনার স্ত্রীর জ্ঞান ফিরবে। 

   -আপনার এই ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারবো না ডাক্তারবাবু! আপনাকে যথাযথ প্রাপ্য দেওয়ার মতো অর্থ আমার কাছে এই মুহূর্তে নেই। তবু স্মৃতি হিসেবে আমি আপনাকে কিছু দিতে চাই। এইটা আপনি আপনার কাছে রাখবেন,এই বলে ভদ্রলোক নিজের ওয়ালেট থেকে কিছু বের করে দিলেন ডাক্তারবাবুর হাতে। রাতের অন্ধকারে ডাক্তারবাবু বুঝতে পারলেন না উপহারটি আসলে কি। ভদ্রলোকই ডাক্তারবাবুকে বাড়িতে পৌঁছে দিলেন। ডাক্তারবাবু বললেন, আপনার স্ত্রীর জ্ঞান ফিরলে আমাকে একবার জানাবেন আমি দুশ্চিন্তায় থাকবো। 

            – কেটে গেল দু’দিন ঐ ভদ্রলোক আর এলোনা। ডাক্তারবাবু ভাবলেন,অপারেশনটা এতটাই ঝুঁকি নিয়ে করলাম খবর না পাওয়া পর্যন্ত মনের ভিতর কেমন খচখচ করছে। ডাক্তারবাবু এবার নিজেই পৌঁছালেন ভদ্রলোকের বাড়িতে। ভদ্রলোকের স্ত্রী দরজা খুললেন। ডাক্তারবাবু ভদ্রলোকের কথা জিজ্ঞাসা করে বললেন, উনি আছেন কি? ভদ্রলোকের স্ত্রী অবাক চোখে  তাকিয়ে উত্তর দিলেন, আমার স্বামী ছ’মাস আগেই যুদ্ধে মারা গেছেন। ডাক্তারবাবু চমকে উঠলেন, কি বলছেন! উনি সেদিন রাতে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন। আমি যখন আপনার অপারেশন করি তখন উনিই আমাকে সাহায্য করেছেন। হঠাৎ ডাক্তারবাবুর মনে পড়ল উপহারের কথা ব্যস্ততায় সেটা আর দেখা হয়নি পকেটেই রয়ে গেছে । উনি পকেট থেকে সেটা বার করে দেখাতে যেতেই দেখলেন ওটা একটা সোনার মেডেল এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসিকতার জন্য তাঁকে মেডেলটি দিয়ে সন্মানিত করা হয়েছিল। ভদ্রলোকের স্ত্রী ভীষণ হতবাক হয়ে বললেন, এই মেডেলটি ওনার ভীষণ প্রিয় আপনি পেলেন কিভাবে? ডাক্তারবাবু ভদ্রলোকের স্ত্রী কে সমস্ত ঘটনা বলে ফিরে এলেন আর ভাবলেন এও কিভাবে সম্ভব। একজন মৃত সৈনিক তার পরিবার কে বাঁচাবার জন্য মৃত্যুলোক থেকে ফিরে এসেছিলেন। সেদিন থেকেই ডাক্তারবাবু চেয়েছিলেন এই বীর সৈন্যের ছবিতে মেডেলটি নিজের হাতে পরিয়ে তাঁর স্মৃতি আঁকড়ে রাখতে। কিন্তু এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর ছেলে তাকে হত্যা করে। ইচ্ছাটা অপূর্ণ রইল ডাক্তারবাবুর। আপনি তো বিবরণ শুনেই আঁকতে পারেন বললেন। আপনি ছবিটা এঁকে দিলে উপকৃত হব। ডাক্তারবাবুর ইচ্ছা পূরণ হবে। 

  নীল মুহূর্তেই রাজি হয়ে গেল ছবি আঁকতে। সামনে বসা লোকটি বিবরণ দিচ্ছে আর নীল শুনে শুনেই ছবিটা আঁকছে। ছবিটা দেখে লোকটা ভীষণ খুশি হচ্ছিল। কমপ্লিট আঁকা ছবি নীল লোকটার হাতে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,আপনার সাথে ডাক্তারবাবুর কি সম্পর্ক? আর এই সৈন্যটিকে আপনি তো দেখেন নি তাহলে এতো সুন্দর বিবরণ কিভাবে দিলেন?

প্রশ্ন শুনে লোকটি বলল আমিই ডক্টর কৃষ্ণপ্রসন্ন। আমাকেই এই কুয়োতে আমার ছেলে ফেলে দেয় তখন থেকে আমি এখানেই থাকি। মেডেল টা ছবিতে পরিয়ে দিলেন সামনের লোকটি। 

  এতক্ষণে ভোরের আলো ফুটে গেছে। আবছা আলোয় নীল হতভম্ব হয়ে দেখছে তার উল্টো দিকে একটা কঙ্কাল গায়ে চুপচুপে ভেজা চাদর লেপ্টে বসে আছে যার মুখটা অন্ধকারে দেখতে পায়নি এতক্ষণ। সামনের বাড়িটা ল্যান্ডস্কেপে ফুটে ওঠা সেই স্কেচ যেটা তার অবাধ্য তুলি এঁকে চলেছিল….. !!

তুলির টান ভৌতিক গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!