কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

ভরুয়া

 ভরুয়া ছোটগল্প – চিন্ময় বসু                   

                   চাকরিটা ক্যাম্পাস ইন্টার্ভিউতেই পেয়েছিলাম। প্রথম দুই দফায় হয় নি। ক্লাসের ভালো ছেলেরা  একটার পর একটা চাকরি বগলদাবা করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। আমরা জন দশেক পড়ে রইলাম । কেউ পছন্দ করছিল না। প্লেসমেন্ট ডিপার্টমেন্টের  দায়িত্বে প্রফেসর শ্রীনিবাস রাওয়ের ভ্রু কুঁচকে ছিল। এমন ভাবে তাকাচ্ছিলেন আমদের দিকে, যেন আমরাই অপরাধী । সপ্তাহের শেষে অঘটন ঘটলো। এক ওষুধ কোম্পানির বড় ম্যানেজারের নাজানা কারণে আমায় পছন্দ হয়ে গেল । আনন্দর থেকে স্বস্তির দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়েছিল বেশি। যদি কেউ না নিত, বিজ্ঞাপন ঘেঁটে  এপ্রান্ত থেকে সে প্রান্ত ইন্টার্ভিউর দৌড়ে লেগে থেকে চাকরির বন্দরে নৌকা ভেড়াতে জীবন প্রাণপাত হতো। আমি তাই বেজায় খুশি, লটারি পাওয়ার থেকে অনেক বেশি। 

               নিয়োগপত্র হাতে দিয়ে ম্যানেজার মহোদয় বললেন, কলকাতায় আঞ্চলিক হেড অফিসে রিক্রুটমেন্ট ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে। চিঠি বলছে,  আমার চাকরি হলো এক বিদেশি ওষুধ কোম্পানির পূর্বাঞ্চলে।  দিন দুয়েকের মধ্যে হস্টেলের সব পাওনা গণ্ডা চুকিয়ে, সবার কাছে বিদায় নিয়ে ট্রেনে রওনা হলাম দুর্গাপুর থেকে। ঘণ্টা তিনেক লাগলো পৌঁছাতে । কলকাতা আমার নিজের জায়গা। বাবা মা থাকেন, উত্তর কলকাতার এক ভালো স্কুল থেকে পাস করেছি । কলকাতার অলি গলি সব আমার মুখস্ত।   ভাগ্য খারাপ, পরীক্ষা দিয়ে অন্য বন্ধুরা কলকাতায় বা আশে পাশে ভালো কলেজে জায়গা পেয়ে গেল, আমায় যেতে হলো দুর্গাপুর।

            অফিসটা খুঁজে বার করতে অসুবিধে হয় নি। সামনের গেটে সিকিউরিটি গার্ড বসে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, রিক্রুটমেন্ট ম্যানেজার কোথায় বসে। শুনেই লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে স্যালুট করলো । কেউ বোধহয় ওকে কিছু বলেছে।  সাথে নিয়ে একেবারে সেই ম্যানেজারের অফিসের সামনে ছেড়ে দিল। এমন  সাদর আহ্বানে আমি বিগলিত । ম্যানেজার ভদ্রলোকও আদর, অভ্যর্থনা করলেন, অফিস ঘুরে দেখালেন, কফি খাওয়ালেন, কিছু লোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন ।

             সব কিছু ভালো হয় না, মনের মত ও না। পরের কথাটা আনন্দ দিল না। বললেন,  আমার পোস্টিং হলো পাটনায়। কাজ হবে পাটনা  ডিভিশনে ওষুধ কোম্পানির যে সব প্রতিনিধি আছে অর্থাৎ মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভ, তাদের কাজ তদারকি করা, অসুধের বিক্রি বাড়ানো । ভেবে ছিলাম কলকাতায়ই কোথাও পোস্টিং পাবো। একেবারে রাজ্য ছাড়া । আমার মুখ দেখে বোধহয় একটা কিছু আঁচ করেছিলেন;  হিন্দিভাষী মাঝ বয়েসী ভদ্রলোকটি । বললেন,

ঃ যত ভালো কাজ করবে, ততো ওপরে উঠবে,  আর ততো বেশি বাড়ি থেকে দূরে যাবে। বাবা মা খুশিই হবেন। পরশু সকালে পাটনায় কাজে যোগ দাও। পাটনা অফিসে খবর দিয়ে দিচ্ছি, তোমার থাকার জন্য যা প্রয়োজন সব পাটনা  অফিস করবে। অফিসের একটা ভাড়া বাড়ি আছে ম্যানেজারের জন্য, তবে ভাড়ার অর্ধেক তোমায় দিতে হবে, সেটা আবার মাইনা থেকে কেটে নেবে। অফিসের  অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার রঘুবীর শর্মা  

 কাজের লোক । সব ব্যবস্থা করে রাখবে, কোনও চিন্তা নেই।  বাঁ হাতে একটা সাদা খাম ছিল, খুলে একটা চিঠি  দিলেন, তাতে মাইনার বিবরণ, আমার চাকরির সব পাওনা গণ্ডার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা রয়েছে  । মাইনা দেখে, সব দুঃখ চলে গেল। বন্দোবস্ত এদের মনে হলো, বেশ পাকা। বললেন,

ঃ যাও এবার তৈরি হও। তিন মাসে একবার রিজিওনাল মিটিং হয়, তখনই আসতে পারবে কলকাতা । অনলাইন মিটিং হয় প্রতি সপ্তাহে, সেগুলো যেন ‘মিস’ না হয়। বড় সাহেবেরা সবাই দিল্লি গেছেন  বার্ষিক কনফারেন্সে । ফিরলে তোমার সাথে হয়তো ভিডিও কলে কথা বলে নেবেন। বেরিয়ে আসছিলাম। হঠাৎ বললেন,

ঃ তদারকি করার জন্য একটা জীপ ও ড্রাইভার তোমার কাছে থাকবে। অফিসে অন্য গাড়ি আছে, সবার ব্যবহারের জন্য। ভালো পারফরম্যান্স দেখাতে পারলে প্রমোশন এখানে তাড়াতাড়ি হয়।

                   বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। কেউ নিচ্ছিল না বলে বড় দুঃখ হয়েছিল, একদিন কেঁদেও ছিলাম। এখন তো মনে হচ্ছে আমার চাকরি দেখে বন্ধুরা অবাক হবে। কত মাইনা, এরিয়া ম্যানেজারের চাকরি, প্রথমেই সুপারভাইসারের কাজ, গাড়ি, ড্রাইভার – আর কি চাই। তর সইছিল না কবে গিয়ে পাটনায় যোগ দেব। বাবা মা ও খুশি, মা পুজো দিয়ে এলো কালী মন্দিরে । রাতের খাবার খেতে যাওয়ার আগে মা’র নিচু স্বরে কথা কানে এলোঃ

ঃ মেয়ে দেখতে শুরু কর। আজকাল তো আবার  সব কম্পিউটারে হয়। সামনের শীতে বিয়েটা দিয়ে দিলে হবে। জানা শোনার মধ্যেও কয়েকজন বলেছে ।

                  আমি আনন্দে বিভোর।  ঘোর কাটলো যখন যোগ দিলাম কাজে । রঘুবীর মিশ্র লোকটি বড়ই অমায়িক ও কাজের মানুষ ।  অফিসে কাগজপত্র সই করার পরে, আমার বসার টেবিল, অফিস,  এসব দেখালেন। আলাপ করালেন সবার সঙ্গে। তারপর নিয়ে এলেন গাড়ি বারান্দায়। দাঁড়িয়ে ছিল, একটা বেশ পুরনো ফাইবার গ্লাসের জীপ ।  চেহারা  মোটেই  সুবিধের নয়, দেখলেই মনে হয়  অনাদরে অভ্যস্ত এক বৃদ্ধ গাড়ি, যেন অবসর চায়।  ভাবলাম এটা  বোধহয় অন্য কারো হবে।  

                  এরিয়া ম্যানেজারের  জীপ, চাকচিক্য থাকবে।  অনেকটা যেমন মিলিটারি জীপরা খুব সেজে গুঁজে থাকে, তেমন।  চাকরির প্রথমেই নিজের গাড়ি, ড্রাইভার – ভাবাই যায় না। আমি রোমাঞ্চিত । কিন্তু যে গাড়িটি  সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তেমন গাড়ি ছোটবেলা থেকে জানি, সবাই ছেঁকরা গাড়ি বলে ।

                       রঘুবীর মিশ্র এসেছেন,  ড্রাইভার ও গাড়ির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। গাড়িটাকে দেখিয়ে বললেন

ঃ ইয়ে আপকা জীপ হ্যায় ।

                       যে ভয় পেয়েছিলাম, তাই হলো ।  ওই ধুতরা, পুরনো জীপটা আমারই। খুঁজছি,  এমন রথের সারথি কোথায় ।  রঘুবীরবাবু ও একটু আশ্চর্য হয়েই খুঁজছিলেন ড্রাইভারকে। কোথায় গেল ? আমিও অবাক।   ড্রাইভাররা অভিবাদন জানায়,  দরজা খুলে ধরে থাকে, উঠে বসলে, দরজা বন্ধ করে দেয়। অবশ্য জীপে নয়, যাকে আমরা ‘কার’  বলি তেমন গাড়িতে। সিনেমায় দেখেছি। তাহলেও প্রথম আলাপে,  নতুন ম্যানেজারের সাথে  এমন করার কথা নয়।

                       লুকিয়ে ছিল জীপেরই  আড়ালে ।  একটু একটু করে পুরো শরীরটা বার করলো গাড়ির আড়াল থেকে। মাথা নিচে নামানো, হাত জোড়  করা। মাথায় সাদা কালো চুল, মুখে লাজুক হাসি। চোখে পড়লো  হাসি মুখের দাঁত, লাল ।  সদ্য  একটা পান বোধহয় শেষ হয়েছে!                                 

                       দাঁতের পরে নজর গেল ওর পরিধানের দিকে। মনের মধ্যে রঙিন স্বপ্ন ছিল, যদিও জানতাম ঠিক অমন হয় না।  ভেবেছিলাম একটা সুন্দর সাজানো জীপে সোফারদের মত  সাদা জামা কাপড় ও  মাথায় সাদা টুপি পড়া  স্মার্ট চেহারার একজন ড্রাইভার থাকবে, লোকে  সমীহ করবে।  তার বদলে, আমার ড্রাইভারের পরনে খাকি রঙের বিরাট ঘের দেওয়া  হাফ প্যান্ট ।  সেই হাফ প্যান্টের তলা দিয়ে  বেরিয়ে আছে দু’টো  শুকনো পা,  আর তাতে পুরোনো একটা হাওয়াই চটি।  এখন যে সব বারমুডা ও আরও  কত নামের হাফপ্যান্ট,  পায়ে হাওয়া খাওয়ার আধুনিক আধা প্যান্ট বেরিয়েছে, তেমন নয় । পুরোনো দিনের পুলিশের হাফ প্যান্টের মত। আমি খুবই  মনমরা, আরও  কি নতুন  অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করে আছে ! 

 রঘুবীর মিশ্র বললেন,

— “সাব, ইয়ে হ্যায় আপকা  ড্রাইভার, ভরুয়া” ।                                                  

                         নাম ভরুয়া !!!  নামটাও অদ্ভুত, শুনিনি কখনো।  লোকটার সব কিছুই অদ্ভুত। নামের আঘাতে আমি আর পদবি কি প্রশ্ন করি নি। ওই ‘ভরুয়া’ই  যথেষ্ট । কিন্তু সেই ব্যক্তিটি মনে হলো আমায় দেখে  খুশি হয়েছে। মুখের লাজুক হাসি চোখকেও ছুঁয়েছে । ওর চোখে বোধহয় আমায়, ছোট খাটো বাচ্চা সাহেব লেগেছে। আমি শুধু উচ্চতায় কম নই, দেখতেও একটু খোকা খোকা,  জানি আমি। বন্ধুরা খেপাতো,

ঃ সাবধানে থাকিস, ফুলসজ্জার রাতে কণে গাল না টিপে দেয়। 

 কোনও কথা না বলে গম্ভীর ভাবে উঠে বসলাম জীপে I  এরিয়া ম্যানেজার হওয়ার আনন্দ সেদিন  আর বিশেষ অবশিষ্ট থাকে নি।

                        প্রথম দিনের গাড়ি চড়ার অভিজ্ঞতা বেশ রোমহর্ষক লেগেছিল। হঠাৎ গাড়িটা বিকট শব্দ করে লাফ মেরে যাত্রা শুরু করলো, বিভিন্ন কলকব্জা থেকে নানা রকমের শব্দ করতে করতে। পাটনা  পুরোনো শহর,  আর অন্য সব পুরোনো শহরের মত অনেক রাস্তাই বেশ সরু।  সেই রাস্তা দিয়ে যখন ভরুয়ার গাড়ি দৌঁড়াতে শুরু করলো, আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। চল্লিশ, পঞ্চাশ না  ষাট  কিলোমিটার  বেগে ছুটছে,  ঠিক ধারণা করতে পারছিলাম না।  ওই শুরু রাস্তা  দিয়ে। ভগবানের কাছে শুধু প্রার্থনা করে গেছি, উল্টো দিক দিয়ে যেন কিছু না এসে পড়ে । যদি পড়ে, তার ফলাফল কি কি হতে পারে সে চিন্তা মনে স্থান দিই  নি। গরমের দুপুর, রাস্তা খালি ছিল, তাই এক আধটা সাইকেল ছাড়া আর কিছু পড়ে নি। নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে গেছি। 

                    অনেকদিন পরে যখন সম্পর্কতে লজ্জাটা কেটেছে, বাঁধন ভেঙ্গেছে ম্যানেজার সাহেব আর ড্রাইভারের মধ্যে, একদিন ওকে প্রশ্ন করেছিলাম  ‘কেন হাফ প্যান্ট পরো ?’

 উত্তর শুধু লাজুক হাসি।

 বলেছি, ‘হাওয়াই চটি কেন পরো, চামড়ার চটিও তো পাওয়া যায় সস্তায় ?’

  উত্তর, আরেকটু বড় হাসি। অদ্ভুত মানুষটি। চমক দিতে ভরুয়া ছাড়েনি শেষ পর্যন্ত।  

                       বছর তিনেক ভরুয়ার  গাড়ি চড়েছি I ওপরের হ্যান্ডল বা সামনের রড ধরে সতর্ক না থাকলে, সম্মান নিয়ে বসে থাকা মুস্কিল। হঠাৎ নেওয়া যে কোনো বাঁকে গাড়ি থেকে বাইরে গিয়ে পড়ার সম্ভাবনা অগ্রাহ্য করা যায় না। ঝড়ের গতিতে ভরুয়ার গাড়িকে আসতে দেখে সামনের  রিক্সা যখন মরিয়া হয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে, শেষ মুহূর্তে ও ঠিক পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায়  আর বেচারা রিক্সা হুমড়ি খেয়ে পড়ে  উল্টোদিক থেকে  আসা টেম্পোর উপরে। দু’জনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া, কিন্তু ভরুয়া  অনেক আগেই সেখান থেকে চলে গেছে। এমন ভাবে কত পথচারি, সাইকেল, রিক্সা  পরস্পরের  মধ্যে ধাক্কা লাগিয়েছে।  আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকতাম জীপে, বুক ভরা আতংক আর  উত্তেজনা নিয়ে। গাড়িতে সামনে বসে বুঝতে পারছি, সংঘাতের  কারণ  ভরুয়ার গাড়ি।  কিন্তু কটু কথা শোনার দুর্ভাগ্য ওর নয়।  এক দিন  জিজ্ঞেস করেছিলাম,

ঃ  এরকম ভাবে  গাড়ি চালাও, লোক আতংকিত হয়ে যায়।  কোনো  দিন একসিডেন্ট হয়ে যাবে।

 হেসে  বললো ,

ঃ “পঁচিশ বছর গাড়ি চালাচ্ছি স্যার, কোনোদিন একসিডেন্ট করি নি” ।

                            সত্যিই তাই । তিন  বছরে কোনোদিন কোনো অঘটন ঘটে নি। পাটনাকে কেন্দ্র করে  সারা রাজ্য ঘুরেছি, রাত বিরেতেও ।  সব সময়ের সাথী ও সারথি ভরুয়া  কোনও অসুবিধেয় ফেলে নি ওই পুরোনো অসুন্দর গাড়ি নিয়ে ।  বিশালাকার হাফ প্যান্ট ও হাওয়াই চপ্পল পরা  ভরুয়া I                                                                                                 

                        সেদিন সোমবার I সকালে ফোন এলো অফিস থেকে সাড়ে ন’টায়, ভরুয়ার জ্বর হয়েছে, আজ আসবে না।  আরেকজন  ড্রাইভার, অন্য গাড়িটা নিয়ে আসবে। এই প্রথম ভরুয়া অসুস্থ। ওর প্রথম ছুটিও । গাড়ি যখন পাটনা কলেজের পাশ দিয়ে যাচ্ছে, জিজ্ঞেস করলাম ড্রাইভারকে ,

“ভরুয়ার বাড়ি জানো কোথায় ?  কোথায় থাকে? ” 

মোটামুটি ধারণা ছিল, কাছেই যে রিজেণ্ট সিনেমা আছে, ওর পেছনে কোথাও । ড্রাইভার চেনে।  বললাম ,

“চল তো দেখি, কেমন আছে ভরুয়া”।

                    গাড়ি গিয়ে পৌঁছালো, সরু গলিটার  মাথায়। তিন নম্বর ঘরটাই ভরুয়ার।  কিন্তু দরজায় তালা ঝুলছে, জানলাটা ভেজানো ।  একটা পাল্লা খুলে দেখলাম, একটা ছ’ ফুট চওড়া, আট ফুট লম্বা ঘর। কোণায়  রান্নার কিছু সরঞ্জাম ও ছোট্ট উনুন। ভরুয়ার বাসস্থান।  কিন্তু কোথায় গেল ? আসে পাশের বাড়িতে জানা গেল, শুক্রবার  অফিসের পরে রাত  থেকেই জ্বর।  শনি, রবি দু’ দিন  ছুটি ছিল, ঘরেই ছিল। রবিবার  বিকেল থেকে জ্বর বেশি বেড়ে যায়। কাছেই ওর  গ্রামের এক জানা শোনা লোক থাকে, সেই অসুস্থ ভরুয়াকে বাসে চাপিয়ে গ্রামের বাড়িতে ছেড়ে এসেছে । চিন্তা হচ্ছিল, কি হলো ।

                     জ্বর ছিল শুক্রবার, বলে নি আমায়, তাই নিয়েই গাড়ি চালিয়েছে। অদ্ভুত লোক । সপ্তাহটা কেটে গেল, ও এলো না। কোনও খবরও নেই। অপেক্ষা করেই রইতে হলো। পরের সপ্তাহে যাওয়ার ছিল সমস্তিপুর । মিটিং ছিল।  শুনেছিলাম সমস্তিপুর শহর থেকে একটু দূরে, গ্রামে ওর দেশের বাড়ি। রঘুবীর মিশ্রকে বলেছিলাম,

ঃ “ভরুয়ার  বাড়ির ঠিকানাটা ড্রাইভারকে দিয়ে দেবেন। ডিলারদের মিটিং শেষ হলে, সময় থাকলে যাবো” ।

                         মিটিং চারটের  মধ্যেই শেষ হলো।  বেশি দেরি হলে তো ফিরেই যেতাম পাটনা । এখান  থেকে পাটনা ফিরে যেতেও তো তিন  ঘন্টা লেগে যাবে। ভাগ্য প্রসন্ন। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম ,

ঃ “তোমাকে ভরুয়ার ঠিকানাটা দিয়েছে না ? চল যাই”।

ড্রাইভারটি একটু অবাকই হয়েছিল, ম্যানেজার সাহেব কেন ড্রাইভারের বাড়ি যাবেন। তবে অল্প বয়স হলেও বেশ চালাক চতুর ছেলেটা, খুঁজে বার করে নিয়ে গেল। যখন পৌঁছেছি, গোধূলীবেলা।  দিনের আলো অল্প আছে , সন্ধ্যে নেমে আসছে।  গাড়ি থেকে নেমে ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে ডাকলাম,

ঃ “ভরুয়া । ও ভরুয়া, কেমন আছো” ?

                        বেরিয়ে এলো, একটা চাদর গায়ে। সেই বিরাট ঘের দেওয়া খাকি হাফপ্যান্ট, আর পায়ে হাওয়াই চটি।  আশ্চর্য লাগলো, বাড়িতেও সেই একই পরিধান। আমাকে দেখে মুখের যা অভিব্যক্তি, মনে হচ্ছিল যেন ভুত দেখছে ।  তাড়াতাড়ি একটা প্লাস্টিকের চেয়ার এনে দিল বারান্দার কোন থেকে। দেখতে তখনও অসুস্থ লাগছে।  বললো, জ্বর আর নেই, দুর্বলতা আছে।  দিন তিনেকের মধ্যেই বোধহয় অফিসে কাজে যোগ দেবে।                                         

                   সন্ধ্যে হয়ে আসছে, তাড়াতাড়ি ফেরার তাড়া  না দিয়ে উঠে পড়লাম। 

                  ভরুয়া জানতো না, মাস তিনেক আগে আমি কলকাতার হেড অফিসে একটা নতুন গাড়ির জন্য অনুরোধ করেছিলাম, এই গাড়িটা অনেক পুরনো হয়েছে। আমার কাজে কোম্পানি খুশি, রাজি হয়ে গেছে। পরের দিনই সেই গাড়িটা  এলো। স্টিলের চকচকে রড দিয়ে সাজানো। মিলিটারি জীপের কায়দায়। ঝকঝকে, চকচকে চেহারা। আমি ভীষণ খুশি, এমনি একটা সুন্দর জীপ চেয়েছিলাম।

                       ভরুয়া ফিরলো তিন দিন নয়, আরও পাঁচ দিন পরে।

রঘুবীর মিশ্র নতুন জীপ দেখালো ভরুয়াকে।  কিন্তু ও খুশি নয়। পুরনো জীপ ছাড়তে রাজি  নয়। রঘুবীর অনেক বোঝাবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছে। সন্ধ্যে বেলায় ভরুয়া এলো আমার কাছে। আমি চেম্বারে বসে কিছু কাগজপত্র দেখছিলাম, হাতজোড় করে  এসে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করলাম,

ঃ কি হলো ভরুয়া?

ঃ আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার, আমি ওই নতুন জীপ চালাতে পারবো না।

ঃ কিন্তু কেন? তোমার একটা নতুন সুন্দর জীপ চালাতে ভালো লাগবে না?

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। মুখটা অল্প একটু তুলে অনুনয়ের সুরে বললো,

ঃ স্যার, আমি গত ন’বছর ধরে জীপটা চালাচ্ছি । আমি ওতে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছি। এখনো জীপটা ভালো আছে। আমাকে দয়া করে ওটা চালাতে দিন।

                    ও জানতো, এর পরিণতি কি হবে,  ও পুলের গাড়ির ড্রাইভার হবে। এরিয়া ম্যানেজারের গাড়ি ছেড়ে,  অফিসে সব অধস্তন কর্মচারীদের নানা ধরণের কাজ করবে। ড্রাইভারদের কাছে তা চাকরিতে অবনতির সমান। আমার কোনও ধারণা ছিল না, ভরুয়া এতো  ভালোবাসে ওই জীপ। কিন্তু নতুন জীপ আনিয়ে, আমি তা ছেড়ে দিতে পারি না, ড্রাইভারের অসঙ্গত আবদারে।

                   নতুন ড্রাইভার সেই অল্পবয়সী ছেলেটি। ওর চাকরিতে প্রোমোশন হলো, এরিয়া ম্যানেজারের গাড়ি চালাবে। আনন্দে সাদা সাফারি স্যুট বানিয়ে নিয়েছে, যদিও মাথায় টুপি ছিল না।  চেয়েছিলাম মিলিটারি জীপের মত চকচকে জীপ, সাদা ড্রেস পড়া স্মার্ট ড্রাইভার। যা স্বপ্ন ছিল, পেলাম। আমার স্ট্যাটাস বেড়ে গেল।

                     কিন্তু কোথাও একটা ছন্দ পতন হয়েছিল। যে সুখের ছন্দে চলছিল জীবন, সে ছন্দ যেন ভেঙ্গে গেছে। আর ভালো লাগছিল না পাটনাতে । 

 নতুন ড্রাইভারের কাছে শুনলাম ভরুয়ার কিছু কথা।  

                    অনেক অল্প বয়সে স্ত্রীকে হারিয়েছে। ওর  মেয়ের তখন তিন বছর বয়স।  দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের সময় স্ত্রীকে হাস্পাতাল না নিয়ে যেতে চাইলেও, কুটুমদের আদেশে গ্রামের ধাইয়ের ওপরই ছাড়তে হয়। যখন হাসপাতালে পৌঁছায়, অনেক দেরি হয়ে গেছে।  স্ত্রী ও দ্বিতীয় সন্তান,  দু’জনকেই হারায়। অভিভাবকদের কথা আর মানে নি, দ্বিতীয় বিয়েও  করে নি।  মেয়েকে নিজেই মানুষ করেছে । মেয়ের বিয়ে হয়েছে কাছেই, বৈশালী জেলায়।

পান খাওয়া দাঁতের হাসির পেছনে আড়ালে এতো কথা লুকিয়ে ছিল, কে জানতো!!

মাস দুয়েকের মধ্যেই নিস্তার পেলাম। ভালো কাজের জন্য, আমার বদলি হলো লখনউ ।

যেদিন বিদায় সম্বর্ধনা দিল অফিস, পিয়ন ড্রাইভারদের মাঝেই বসে ছিল। কাছে আসে নি।

ভরুয়া ছোটগল্প – সমাপ্ত                                                 

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!