কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » পুজো সংখ্যা ১৪২৯ » নীলবাস্প

নীলবাস্প

নীলবাস্প গল্প – ভাস্কর সিন্হা

রয় অস্বস্তিতে ছটপট করে উঠল। দম তো প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে।ফুসফুসে বিষবাস্প ঢুকে অন্তরকে পিষে ফেলতে চাইছে। মনে পড়ছে বিধিসম্মতসতর্কীকরন হিসাবে ওস্তাদের সাবধানবাণী-

– “এমত বিষাক্ত বাস্প বেরোনো সুরু হলেই শ্বাস টানা বন্ধ করো। ছুটে চলে এসো কাছাকাছি ঘরে। দরজা- জানালা সব বন্ধ করে রুদ্ধদ্বার থাকো। কাছে- পিঠে দেখো অক্সিজেন মাস্ক আছে কিনা? পেলে লাগিয়ে নাও তা। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অক্সিজেন মাস্কের যোগান থাকতে- থাকতেই এলাকা পরিত্য়াগ করো অ্য়াম্বুলেন্স ডেকে।”

বিপদ ঘন্টি বাজছে। সব শ্রমিকে বিভ্রান্ত। কোন দিকে গেলে বাঁচার পথ- কেউ যানেনা। দু- একজনা জরুরীকালীন পরিসেবক বা কর্মির দেখা মিললেও, তারা নিজেদের প্রাণরক্ষণেই অধিক মনোযোগী। রয় অবশ্য় এতে দোষের কিছু দেখে না। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। অক্সিজেন মাস্ক ছাড়া অন্য় শ্রমিকের প্রাণরক্ষণ চূড়ান্ত অবিবেচনা এই বিষ বাস্পের মুক্ত বিহঙ্গের ক্রীড়া- কৌতুকে।

অথচ যখন কারখানা শুরু হয়- মন্ত্রী, বড়- মেজো- সেজো- ছোটো নেতা, কাউন্সিলর সব্বারই বেদম দাপাদাপি ছিলো। হ্য়ান হোগা, ত্য়ান হোগা! এত লোকের কর্মসংস্থান হবে। স্বপ্নের সুদিন আসবে ঘরে- ঘরে। রাজনীতির কারবারির তো তাই কাজ- স্বপ্নের জাল বুনে চলা। তাতে যদি ফাঁদে পড়ে সাধারণ ভোটদাতা! এভাবেই তো চলে গেল অর্ধশতাব্দীর বেশী কিছু সময়। সামগ্রিক উন্নয়ন কিয়ৎই হয়েছে। বড়- মেজো- সেজো- ছোটোদের পেট পোরার পর তলানিটুকু ঠেকেছে সর্বজনীন ব্য়বস্থায়। তবে যত দিন যায় নির্বিশেষ জনসাধারণ এতে কৌতুকভিন্ন ঈষৎ বিচলিতও হয় না।

তবে রয় ভাবে যে কিছুক্ষেত্রে সামগ্রিক বিচারবুদ্ধি ও আক্কেলের সুপ্রয়োগের যারপরনাই উপযোগিতা আছে। বিষবাস্পের কারখানা হলে পার্টির পেটোয়াদের নাহয় চাকুরি হলো, কিন্তু ফাঁস হয়ে যাওয়া বিষবাস্প কতদূরের দুর্গতি এনে কতপ্রাণ যে বিপন্ন করে ওঠাবে, তা উপলব্ধির অন্তর্দৃষ্টি বা ধারণাশক্তি খুব কম মানুষেরই এভূমে আছে। এই বোঝাপড়াটা যা সর্ব প্রথমেই হয়ে যাওয়া উচিত, তা সমঝদারির মুন্সীয়ানা বা পরিবেশ সম্বন্ধে সামগ্রিক ধারণার প্রতীতি খুব কম জনেরই আছে। সাময়িক স্বার্থের আগ্রহে, ভয়াল পরিবেশের ভবিতব্য় আমাদের সবাইকে যে গ্রাস করবে তা আর আমরা কবে বুঝব? প্রায়োগিক বিদ্য়ার দ্বারা নদী বেঁধে বিদ্য়ুৎ না হয় পাওয়া গেল, কিন্তু এতে স্রোতস্বিনী ধারার স্রোতবহতা কমে যায় আর অববাহিকার চূড়ান্ত অবক্ষয় হয়, তা তো জানতে আর মানতে হবে। এদিকে পারমাণবিক বিদারণে প্রভূত শক্তি পাওয়া যায়, তা বিদ্য়ুৎ সমস্য়ার কিয়দংশের সুরাহা করলেও, আকস্মিক দুর্ঘটনা পরিবেশের দফারফা ঘটিয়ে দেয়। আগের সুস্থির পরিবেশ ফেরত আনা তো অনেক দূরের বিষয়, বিপদ- সংকুল স্থলে প্রাণ সংরক্ষণ বা প্রাণের আবির্ভাবও সংশয়জনক হয়ে পড়ে।

রয় জানেনা আর সুস্থভাবে ঘরে ফিরবে কিনা? এই বিষবাস্প তো হাওয়ার সাথে পাড়ি দেবে স্রোত বরাবর। জানেনা পরিবারের সবার কি দশা হবে? সবু তো স্কুল থেকে ফেরত আসছে। জানেনা স্কুল কর্তৃপক্ষ এই বিষবাস্পের নির্গম সম্বন্ধে অবগত কিনা? জানেনা জরুরীকালীন পরিস্থিতির কোনো সুরাহার বন্দোবস্ত আছে কিনা বা হয়েছে কিনা, কোনো কর্তৃপক্ষের পক্ষ হতে? সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন যে কর্তৃপক্ষেরা কি বিষবাস্পের নির্গম রোধে সমভাবাপন্ন হয়ে কাজ করছে?

রয়ের মাথা আর কাজ করে না। নিরাপদ আভ্য়ন্তরীণে কোনোক্রমে প্রবেশ করে এককোণে নেতিয়ে পড়ে। ঢোকার আগে দেখে কারখানা জুড়ে ভয়ঙ্কর অব্য়বস্থা। অসংখ্য় শ্রমিক শোচনীয় পরিনামের দিকে অভিমুখী। জরুরীকালীন সমন্বয়কারীরা অক্সিজেনের সিলিন্ডারসহ মুখোশ লাগিয়ে কিছু শ্রমিককে অ্য়াম্বুলেন্সে ওঠাচ্ছে। রয়েদের অ্য়াম্বুলেন্স আসতে সময় লাগবে। সামনের হাসপাতালের সব অ্য়াম্বুলেন্স কাজে লেগে গেছে। দূরবর্তী হাসপাতালগুলিতে খবর পৌঁচেছে, কিন্তু তাদের আসতে তো সময় লাগবে। আর তারা যদি পথিমধ্য়ে অন্য় বিষবাস্পাক্রান্তদের সুশ্রুশা করতে ব্য়াপৃত হয়, তাহলে? 

কিন্তু এমন তো হওয়ার ছিলো না। লাভজনক আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানটি নতুন রাসায়নিক তৈরিতে হাত দিল। নামী বহুজাতিক সংস্থার সাথে সমঝোতা হল। বেশ কিছুদিন বিদেশী আধিকারিক, বিশেষজ্ঞ এবং পেষাদার উপদেষ্টারা আসা- যাওয়া করলেন। পরিকল্পনা মাফিক প্রকল্প শুরু হোলো। উৎপাদনও শুরু হোলো বছরখানেক পরেই। এক সুরক্ষা আধিকারিকও কর্মে যোগ দিলেন। ওনার সাথে কথাবার্তায় আর ওনার সুরক্ষার কর্মশালাগুলিতে যোগদান করে রয়রা যুগপৎ আশ্বশ্ত ও উদ্বিগ্নও হলো। সুরক্ষা আধিকারিক ভরসা দেওয়ার মতো কতগুলি ধাপ আর সুরক্ষা বলয়ের প্রসঙ্গ তুলে ধরেছিলেন। আর বলেছিলেন যে কোনো অবস্থাতেই সুরক্ষা বলয়কে অগ্রাহ্য় বা বাতিল করে উৎপাদনকে মূল চালিককাশক্তি না করতে।

হঠাৎই একদিন ঐ সুরক্ষা আধিকারিক কাজে ইস্তফা দিয়ে চলে গেলেন। কর্তপক্ষের সাথে মতানৈক্য় আর বাদানুবাদ কিছুকাল ধরেই চলছিল। আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল, যখন অগ্নিসুরক্ষার কাজে নিযুক্ত কর্মিদের ছাঁটাই নোটিশ ধরানো হলো। কানাঘুষো চলছিল কিছুদিন ধরেই যে বেশীর ভাগ কর্মচারীকেই চুক্তিবন্ধ করা হবে। খুব কম সংখ্য়ক স্থায়ী পদাসীনেরা এবার থাকবেন, মূলতঃ হাতে গোণা উচ্চপদের কয়েকজন। এতে সংস্থার প্রভূত লাভ। চুক্তিবন্ধদের চিকিৎসা খাতে কোনো খরচা নেই। বীমাকরণের কোনো দায় নাই। তাদের পরিবারের দায় সংস্থা নেবে না। ছুটি- ছাটা প্রায় নেই বল্লেই হয়। ছুটি নিলেও তার যায়গায় অন্য় চুক্তিবন্ধকে চলে আসতে হবে। সর্বোপরি পেন্সন- গ্রাচুইটি দেবার কোনো বালাই নেই। রক্ষাকবচের কোনই বালাই নেই। সংস্থার তো এপথে লাভই লাভ। রয় মধ্য়মবর্গীয় আধিকারিকদের সাথে কথা বল্লে বুঝল যে এমন ধারা দেশে- বিদেশে সর্বত্র এসে গেছে।  

আর কোনো সুরক্ষা আধিকারিক যোগদান করেন নি। রয় জানেনা যে ঐ পদটিও এখন স্থায়ী আছে, না চুক্তিবন্ধ হয়ে গিয়েছে? সংস্থার নিয়োগ পদ্ধতি অতীব জটিল। বিজ্ঞাপন দেওয়া থেকে  সাক্ষাৎকার- পরীক্ষণের আর নির্বাচন পর্ষদের বেড়া ডিঙিয়ে নির্বাচনের পত্রে মুখ্য় আধিকারিকের সই হতে বছর ঘুরে যায়। দেবু মিত্তির নাকি নিজের কানে শুনেছে যে চলে যাবার আগে ঐ সুরক্ষাকর্তা বলে গেছেন যে- দোহাই আপনাদের স্থায়ীভাবে সুরক্ষার দিকে ধ্য়ান দিন, কোনো চুক্তিবন্ধের ফাঁদে পড়বেন না। কোনো ভাড়াটিয়াই বাড়িওলার জন্য় বিশেষ প্রভাবান্বিত হয় না। বাড়ির নিজস্ব লোকদিগেরই বাড়ির প্রতি যদি কিছু মায়া- মমতা থাকতে পারে।  

আর কিছুই মাথায় নেই রয়ের। সব কিছু ধোঁয়া- ধোঁয়া। এ কোথায় সে? শরীর বলতে তো কোনো কিছুরই সাড় নেই। খালি ওপরে শুধুই যন্ত্রনা। কিছু ভাবতে গেলেই সে যন্ত্রনা চড়ে ওঠে বহুগুণ। এটা কি স্থান? সে কি পরলোকে আগত? চারিদিক যেন আবছায়াময়। সারি সারি শয্য়া। অনেক নল। সেগুলি আবার লম্বাকৃতি সিলিন্ডারের সঙ্গে যুক্ত। কিছুক্ষণে কিছু পরিস্কার হয় দৃশ্য়। তার মতোই সবাই শায়িত। অনেকের মুখেই মুখোশ, সাথে নল লাগানো। ওরাও কি সব মৃত? তাহলে তার মুখে মুখোশ আর নল লাগানো তো নেই। হ্য়াঁ ঠিকই দেখছে সে।  এটা কি হাসপাতাল? তার পাশের শয্য়ায় কেউ যেন বিড়- বিড় করে কিছু বলছে। আরে ব্য়ক্তিটি তার পরিচিত ঠাহর হয়। আরো কিছুক্ষণে রয় উপলব্ধি করে যে শায়িত প্রতিবেশী আর কেউ নন, তাদের পূর্বতন সুরক্ষা কর্তা। ওনার মুখে নেই মুখোশ, নেই নল। দুগাল বেয়ে কষ আর ফেনা। উনি কি রয়কে চিনতে পারলেন? রয় কেশে দৃষ্টি আকর্ষনের প্রচেষ্টা চালায়। কিছুই উদ্গ্ত  হয় না। উনি কি কিছু বলছেন রয়ের দিকে তাকিয়ে? রয় কান খাড়া করে। উনি বিড়বিড়ান:

-“জেগে ওঠো। বেঁচে ওঠো। দ্য়াখো, আমাদের ভবিষ্য়ত মারা যাচ্ছে।”

নীলবাস্প গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!