কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

ফুলি

ফুলি ছোট গল্প – রথীন্দ্রনাথ রায়

ভাঙছে । ফুলেশ্বরী ভাঙছে । কেউ বলে ফুল্লরা । ভেঙে দিচ্ছে এপারের জনপদ । ভাঙছে সামসেরগঞ্জের বিস্তীর্ন এলাকা । যতীনপুর সেই বিস্তীর্ণ এলাকার একটি ছোট্ট গ্রাম । না, এপাশের শহর ফুলনগর ভাঙছে না । শহর তো সেজন্যই । শহরটাকে বাঁচাবার জন্য নদীতীরবর্তী অঞ্চলকে কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছে । কতো ধনীলোকের বাস সেখানে । প্রাসাদোপম বাড়ি সরকারি লোকেদের বাস । সেসব ভেঙে গেলে তারা থাকবে কোথায়  ? যতীনপুরের লোকেরা গরীব এবং দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত । গান্ধিজী বলেছেন হরিজন । ভোটের সময় ওদের দাম বাড়ে । জেলা শহর থেকে নেতারা আসেন । ঢালাও প্রতিশ্রুতি দেন । একশো দিনের কাজে কোটি কোটি টাকা খরচ করে বাঁধ তৈরি হয় । একটা বর্ষাতেই সে বাঁধ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় । অবস্থার বদল হয়না । এসব গা সওয়া ব্যাপার । 

ক’দিন ধরেই রাতপাহারার ব্যবস্থা হয়েছে । ফুল্লরার তীরে ওরা পালা করে বসে থাকে একটা প্রায় ভাঙা চাতালের নিচে । চাতালের ঠিক নিচেই ফুল্লরার জল এসে ধাক্কা খায় । আর মাঝনদী থেকে একটা গোঙানির মতো শব্দ ভেসে আসে ।

নবীন বিড়িতে একটা জোর টান দিয়ে বলে, তাই বলো, ফুলি এবার ক্ষেপেছে । যতীনপুরকে সে গিলবেই । ছেড়ে কথা কইবেনা সামসেরগঞ্জকেও । 

“গিলব বললেই হল ? ভাদ্রের অমাবস্যায় ষোল আনা মিলে পূজো দেব । পাঁঠা বলি দেব । রক্ত না পেলে ফুলি শান্ত হবেনা । ” বুধাই হয়তো আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল । কিন্তু তার কথার মাঝেই ধ্বস ছাড়ার শব্দ হল — ঝুপ । তারপর আবার ফুল্লরার গোঙানি । একটানা বৃষ্টি হয়ে চলেছে প্রায় ন’দিন । পঞ্চমীতে নেমেছে অমাবস্যা না গেলে ছাড়বে না । সেরকমই বিশ্বাস ওদের । ক’বছর আগে মতিপুর মৌজাকে ভাঙত । এখন ভাঙছে যতীনপুরকে । এই ক’বছরেই যতীনপুরের অর্ধেক জমি চলে গেছে ফুল্লরার পেটে । যেটুকু বেঁচে আছে সেটুকুকে বাঁচাতে ওরা বারবার নেতা মণ্ত্রীদের দ্বারস্থ হয় । একশো দিনের কাজে “বালির বাঁধ ” দেওয়া হয় । আবার ভাঙে । বর্ষা শেষ হতেই ফুল্লরার পেট থেকে বালি সরিয়ে জমি বের করতে ব্যস্ত হয় ওরা । ভুলে যায় আশ্বাসের কথা । কিন্তু এবার বুঝি আর রক্ষে হয়না । ইতিমধ্যেই ঘরের মায়া ছেড়ে দাসপাড়াকে উঠে যেতে হয়েছে গ্রামের একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ে । বিডিও দেখে গেছেন । ত্রিপল, চিড়ে, গুড় আর শিশুখাদ্য পাঠিয়ে দেবেন বলেছেন । সেসবও আসেনি এখনো । আকাশে ঘন কালো মেঘ । কোথাও একটা তারা দেখা যায়না । হয়তো এখনি বৃষ্টি নামবে । নবীন চাতাল থেকে বাইরে এসে আকাশটাকে ভালো করে দেখে নিয়ে বলল, “গতিক সুবিধের নয় ।” বলতে বলতেই বৃষ্টি নামল । তবে খুব একটা জোরে নয় । হালকা । দূর থেকে একটা আলো ভেসে আসে । আলোটা ক্রমশ নিকটবর্তী হয় । রঞ্জন । সে হাঁক পেড়ে বলে, চাতালে কারা গো  ? 

— আমি গো রঞ্জনদা । আমি নবীন । কি হয়েছে কি? 

— হবে আবার কি  । দাসপাড়াটা ফুলির পেটে গেল ।

রঞ্জনের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা । ইতিমধ্যে বুধাই আর অক্রুর ছাতা নিয়ে রঞ্জনের সামনে আসে । বলে, লোকজন  ?;

— লোকজন সব সাঁঝবেলাতেই ঘর ছেড়েছিল । জিনিসপত্রও সরিয়েছিল কিছু কিছু । বাকি সব ফুলি নিয়ে গেছে । 

“এরপর?” নবীনের গলায় উদ্বেগ । 

— এরপর আবার কি, গোটা গ্রামটাই যাবে ফুলির পেটে । শ্মশানের ধারে বুড়ো বটগাছটা যেদিন নদীর স্রোতে এলিয়ে পড়ল, সেদিনই বুঝেছি ফুলি সহজে শান্ত হবেনা । 

এবার বৃষ্টিটা বেশ জোরেই নামল । সঙ্গে দমকা হাওয়া । সেই হাওয়াতে রঞ্জনের হাতের লণ্ঠনটাও গেল নিভে । 

হঠাৎ ওদের পায়ের তলার মাটিটা বুঝি কেঁপে উঠল । বেশ কিছুটা পিছিয়ে যেতেই ওদের চোখের সামনেই চাতালটা নুয়ে পড়ল নদীতে । তারপর এক সময় স্রোতের টানে ভেসেও গেল । ফুলেশ্বরীর এই তাণ্ডবের সামনে ওরা বড়ো অসহায় । প্রতিবাদ করার শব্দ পর্যন্ত নেই আজ ওদের মুখে । রঞ্জন অন্ধকারেই নদীর দিকে চেয়ে বলে, আজ রাতেই কিছু একটা হয়ে যেতে পারে । গাঁয়ের লোকেদের জাগিয়ে দিতে হবে । 

  কিন্তু শিয়রে যাদের শমন তাদেরকে আলাদা করে জাগিয়ে দিতে হয়না । তারা নিজেরাই জেগে যায় । তাই ঘোর বর্ষাতেও অন্ধকারেই গ্রামের সমস্ত নারীপুরুষ ফুলেশ্বরীর তীরে এসে দাঁড়ায় । জল বাড়ছে । সেই সঙ্গে বাড়ছে ভাঙনের আশঙ্কা । এভাবেই রাত এগিয়ে চলল ভোরের দিকে । একসময় সকাল হল । বৃষ্টি থামল । কিন্তু আকাশটা মুখ ভার করেই রইল ।যত বেলা বাড়ল ততই নানা ধরনের খবর আসতে লাগল । কোথাও ক্ষুব্ধ জনতা ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে সরকারি কর্মীদের ঘেরাও করেছে । কোথাও বা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখিয়েছে । 

যতীনপুরের অর্ধেকটা ইতিমধ্যেই নদীগর্ভে । বাকি অর্ধেকটা যেটা নদী থেকে বেশ কিছুটা দূরে সেই এলাকায় ভাঙনের আশঙ্কা খুব একটা নেই । যাদের ঘরবাড়ি নদীর ভাঙনের ফলে তলিয়ে গেছে তারা আজ আশ্রয়প্রার্থী । তাদের কাছে ধর্ম নেই, বর্ণ নেই, ধনী-দরিদ্র নেই, এমনকি সঙ্কীর্ণ গ্রাম্য রাজনীতিও নেই । ভাঙন আজ সবাইকে এক পঙক্তিতে এনে দাঁড় করিয়েছে । 

রঞ্জনের বাড়ি ।

দুলাল দাসের বৌ কাতু এসে রঞ্জনের স্ত্রী রমাকে বললে, একটু ঠাঁই দাওগো দিদি । পুরুষরা সব এখানে ওখানে কাটাবে । কিন্তু বাচ্চাগুলোর জন্য  ? 

— তা এতো কাঁচুমাচু করার কি আছে  ?

— না মানে, আমরা তো নিচু জাতের  ? 

— আর জাত  ? ফুলি জাতের রেখেছে কিছু  ? জমিজিরেত সবই নিয়েছে । এবার বসুবাড়িটাকে গিলতে আসছে । যে ক’দিন এটা আছে থাক এখানে । 

— তা দিদি তুমি বাঁচালে আমাদের ।

মনে মনে রমাকে প্রনাম করে কাতু । ছেলে মেয়ে না হওয়ায় লোকেরা ওকে আড়ালে আঁটকুড়ি বলে । আজ বুঝতে পারে ও সত্যিকারের একজন মা । তাই বাচ্চাদের কষ্ট শুনেই ও রাজী হয়ে গেল । ইতিমধ্যে বাচ্চাগুলো তাদের ছোটোখাটো খেলার অথবা ব্যবহারের জিনিস নিয়ে এসেছে । রমা এগিয়ে গিয়ে বললে, এখানে রাখ, ওখানে রাখ । 

তারপর কাতুকে বললে, খাবি কোথায়  ? 

— জানিনা । কাল রেতের বেলা যখন ঘরবাড়ি সব চোখের সামনে ভেসে গেল তখন থেকে শুধুই কেঁদেছি । যা কিছু জমানো ছিল, তাও ভেসে গেছে । এখন সব ভগবানের হাতে । 

— আমার ঘরে যতক্ষণ আছে ততক্ষণ একমুঠো জুটবে তোদের । কিন্তু আনাজপাতি নেই । 

— তা যদি আমার ছোঁয়া নাও তাহলে শাকপাতা বা একদুটো ঢ্যাঁড়স, বেগুন এনে দিতে পারি । 

— তা আনিস । শোন তোর কত্তাকেও দুপুরবেলা খেতে বলিস । 

— বলব । মানুষটা সেই ভোরবেলায় নদীর পাড় থেকে বড় রাস্তার ধারে চলে গেছে । বলেছে, সরকারি ত্রাণের জিনিস যদি কিছু পায়  ? 

কাতুর কথা শেষ না হতেই রঞ্জনের সঙ্গে দুলাল আসে । হাতে একটা নীল রঙের ত্রিপল । মুখটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে । তা দেখে রমা এবং কাতু আঁতকে ওঠে । রঞ্জন বলে, সরকারি ত্রাণ নিতে গিয়ে পুলিশের লাঠি খেয়েছে । 

“কেন ?” রমার চোখে প্রশ্ন । 

— আসলে ত্রাণ এসেছে কম । এর মধ্যে যাদের ঘরবাড়ি আস্ত আছে তারাও দু একটা হাতিয়ে নিতে ব্যস্ত । ত্রাণের জিনিস গাড়ি থেকে নামানোর আগেই লুট হয়ে গেল । 

— দুলাল, তুমি বসোতো । আমার ঘরে কিছু ওষুধ আছে লাগিয়ে দিচ্ছি । 

রমা ব্যস্ত হয়ে পড়ে । 

— না গো বৌদি ব্যস্ত হতে হবেনা । আমাদের ঘরবাড়ি ভেসে গেল । আমরা সর্বহারা হলাম । সেই আমাদের রক্ত ঝরতেই পারে ।

রঞ্জন বিষ্ময়ের সঙ্গে দুলালের কথা শোনে । কিন্তু প্রকাশ্যে এসব কথা বলা বারণ । মাঝে মাঝে ওর মনটাও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে । কিন্তু ভোট দেওয়া ছাড়া ওদের কিচ্ছু করার নেই । প্রসঙ্গ বদলে বলে, এখানেই খাওয়া দাওয়া করে তারপর কোথাও যাবি । 

ব্যাণ্ডেজ বাঁধা হয়ে গেলে বেশ একটু সুস্থ হওয়ার পর দুলাল বলে, রঞ্জনদা তোমার তুলনা হয়না গো । তুমি এ ক’দিন গাঁয়ের লোকের পাশে না দাঁড়ালে অনেকেই না খেতে পেয়ে মরে যেত । 

— এখন এসব কথা থাক । আমি একবার নদীর ধার থেকে ঘুরে আসি । 

রঞ্জন চলে যায় । দূর থেকে একদল লোকের চিৎকার ভেসে আসে । রমা উৎকর্ণ হয়ে থাকে । আবার কার ঘরদোর সব ফুলির পেটে গেল কে জানে ? 

গ্রামের প্রায় সব লোকই আজ আবার নদীর তীরে হাজির হয়েছে বৃষ্টি মাথায় করে । কারোর মাথায় ছাতা রয়েছে, কারোর বা নেই । তবু তারা ফুল্লরার পূজো দিতে সমবেত হয়েছে । যেখানটায় পূজোর আয়োজন হয়েছে তার হাত দশেক দূরেই বড় একটা ফাটল । কাল রাত থেকে এটি দেখা গেছে । আজ হোক বা কাল, এই অংশটাও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে । এপর্যন্ত প্রায় গোটা পঞ্চাশেক বাড়ি নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে । এখনো শ’খানেক বাড়ি ভাঙনের আশঙ্কার মুখে দাঁড়িয়ে । অনেকেই আজ ফুল্লরার পূজো দিতে এগিয়ে এসেছে । বিবাহিত মেয়েরা ঘট মাথায় নিয়ে সুর করে গান গায়  —

কালকেতুর ঘরণী তুমি 

ফুল্লরা রমণী 

মোদের প্রতি সদয় হও

ব্যাধের ঘরণী ।

মোদের ঘর ভেঙোনা 

সব নিয়োনা চণ্ডীর নন্দিনী 

তোমারেই পূজি মাগো 

তোমারেই নমি । 

পূজো হল, পাঁঠা বলি হল । কেউ একজন ছাগলের কাটা মুণ্ডটা নদীগর্ভে ছুঁড়ে দিয়ে বললে, নে, রক্ত নে ফুলি । 

ইতিমধ্যে মুষলধারে বৃষ্টি নামল । বৃদ্ধ বিজয় দাস ভিজতে ভিজতে নদীর তীরে এসে বললে, নদী কেমন যেন ফুলে ফুলে উঠছে । এমনটা দেখেছিলাম আজ থেকে পেরায় চল্লিশ বছর আগে । তখনও ফুলি এমনিভাবে ঘরদোর সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল । 

ভিড় ক্রমশ কমতে থাকে । তবু তখনও কিছু লোক রয়ে গেছিল ফুল্লরার তাণ্ডবলীলা দেখতে । বৃষ্টিতে চারদিক ঝাপসা হয়ে আসে । তবু রঞ্জন কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছিল । কিন্তু হঠাৎ একটা ঝুপ শব্দ । তারপর একটা আর্তনাদ । কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা ধ্বস নামার সঙ্গে সঙ্গে নদীগর্ভে তলিয়ে যেতে থাকল রঞ্জন । 

— আমাকে বাঁচাও । 

কিন্তু সমবেত জনতা নিজেদেরকে বাঁচাতে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায় । আর রঞ্জনের আর্তনাদ প্রতিধ্বনি তুলে হারিয়ে যায় নদীবক্ষের  বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে । ফিরে যাওয়া জনতার মধ্যে ছিল রমা । সে বুঝতে পারল কিছু একটা হয়েছে । ভিড় ঠেলে একপ্রকার দৌড়েই এল নদীর কিনারায় । দেখল রঞ্জন স্রোতের সঙ্গে লড়াই করছে নিজেকে বাঁচাতে । আর পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে মানুষগুলো । সে কাল বিলম্ব না করে ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীতে । স্রোত ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল । কিন্তু জলের ধাক্কায় দুজনেই দুজনের কাছ থেকে সরে যেতে লাগল । ঘূর্ণি স্রোতের মধ্যে পড়ে অতলে তলিয়ে গেল রঞ্জন । রমার আকূল চিৎকার প্রতিধ্বনি তুলল মাত্র । দূরে অনেক দূরে কালো বিন্দুর মতো দেখা গেল রমা ও রঞ্জনের মাথাদুটো । তারপর শুধুই জলরাশি আর গাঙচিলের আর্তনাদ ।

ফুলি ছোট গল্প – সমাপ্তি

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!