কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

স্বপ্নপূরণ

স্বপ্নপূরণ ছোটগল্প – মিঠুন মুখার্জী

স্বপ্ন দেখে সবাই, কিন্তু সবার স্বপ্ন পূরণ হয় না। কেউ জেগে, আবার কেউ ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখে। তবে যে স্বপ্ন মানুষকে ঘুমাতে দেয় না, এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে তাড়া করে বেড়ায়, সেই স্বপ্ন পুরণ হয়। ভ্যানচালক জীবনের ছেলে শশীর বড় হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল। অনেক কষ্ট সহ্য করে বড় হয়েছে সে। কখনো ভাত খেয়েছে একবেলা, কখনোবা ফ্যান খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কখনো না খেতে পেয়ে কান্না করেছে। লোকেরা ধূরছাই করেছে। মূল্য দেয়নি কেউ। তবুও দমে যায় নি শশী। স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে অটুট ছিল।

           বাবার ও নিজের চেষ্টায় বি.এ পাস করেছে সে। প্রথমে কলকাতার এক কোম্পানিতে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করতো।  মাইনার টাকায় সংসার মোটামুটি চলে যেত। কোম্পানি থেকে চুরি যাওয়া মাল শশীর সহযোগিতায় চোর সমেত ধরা পড়ে। মালিকপক্ষ ওর সততার জন্য প্রমোশন দেয়। হিসাব-নিকাশের কাজে নিয়োগ করে ওকে। সেখান থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি শশীকে। আজ ‘বি. কে রায় এন্ড কোং’এর দশটি ব্রাঞ্চের দেখাশোনার দায়িত্ব ওর ওপর। এক লক্ষ টাকার উপরে মাসে মাইনা পায়। গাড়ি, থাকার ফ্ল্যাটও পেয়েছে শশী‌।

বাবা-মাকেও কলকাতার সেই ফ্লাটে নিয়ে এসেছে সে। তাদের আর কিছুই করতে দেয় না শশী। নিজের মতো অসংখ্য মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ‘মায়ের আশীর্বাদ’ নামে একটি এন.জি.ও খুলেছে। করেছে অনাথ আশ্রম ও বৃদ্ধাশ্রম। মালিক মিস্টার বিকাশ কুমার রায়ের সহযোগিতা পেয়েছে বারবার। এই সমাজসেবামূলক কাজ করার জন্য বাবা-মা বিয়ের কথা বললে শশী রাজি হয়না। তাদের বলে—“বিয়ে আমার জন্য নয় মা। আমি তোমাদের চোখের জল দেখতে পারবো না। তাছাড়া বিয়ে করলে মানুষের জন্য কাজ করতে পারবো না  আমি। বিয়েতে আমি বিশ্বাসী নই মা।” মা-বাবা অনেক বুঝিয়েও কোন লাভ হয় না।

              একদিন ‘বি. কে রায় অ্যান্ড কোম্পানি’র মালিক খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। একমাত্র মেয়ে অস্মিতা লন্ডনে থেকে ডাক্তারি পড়ছে ।  শশীকে মিস্টার বিকাশ কুমার রায় খুব ভালোবাসেন ও বিশ্বাসও করেন। যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাকে ডাকেন। এ দিনও শশীর ডাক পড়ল। ডাক্তার বলে গিয়েছেন— ‘উনার মনে আঘাত লাগার মতো কাজ কেউ করবেন না। উনি যা চান তাই সকলে করার চেষ্টা করবেন।’  মিস্টার বিকাশ কুমার রায় শশীকে বলেন— “দেখো বাবা, আজ তোমার উপর আমি একটা বড় দায়িত্ব অর্পণ করতে চাই।

আমার বিশ্বাস তুমি আমার কোম্পানির একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি।‌ আমার বয়স হয়েছে। আজ আছি, কাল নাও থাকতে পারি। আমার তো কোন ছেলে নেই। তাই ভাবছিলাম এই কোম্পানির দায়িত্ব আমি তোমার হাতে দিয়ে দেব। আমার একমাত্র মেয়ে অস্মিতার সঙ্গে আমি তোমার বিয়ে দিতে চাই। আমার মেয়ে বলে বলছি না, ও বিদেশে ডাক্তারি পড়লেও মানুষের প্রতি ওর শ্রদ্ধাবোধ আছে। তুমি সুখী হবে বাবা।

তুমি তোমার বাবা- মাকে নিয়ে আগামী পরশু আমার সঙ্গে দেখা করো। আগামীকাল অস্মিতা লন্ডন থেকে বাড়ি ফিরছে। ফলে তাদের দেখাশোনা হয়ে যাবে। আমিও নিশ্চিন্ত হই।” এরপর শশী জানায়— “কিন্তু স্যার, আমি আমার জীবনকে মানুষের সেবায় অর্পণ করেছি। আমি সংসারের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাই না। তাছাড়া আপনি তো আমার সম্পর্কে সব জানেন। মানুষের নিয়ে আমার কাজ। অসহায় মানুষ আমার উপর আশা করে। সংসার জীবনে ঢুকলে আমি সেইসব সমাজসেবামূলক কাজ কিভাবে চালাবো!”

শশীর কথা শুনে মিস্টার বিকাশ কুমার রায় বলেন— “তোমার ধারণা ভুল। সংসার করেও সব করা যায়। দরকার হলে আরও লোক নিয়োগ করবে। তোমার যতো রকম সহযোগিতার দরকার আমি করব। তাছাড়া অস্মিতাও একজন ডাক্তার, সেও মানুষের মাঝেই থাকতে ভালোবাসে। আমার মনে হয় তোমার কোন অসুবিধা হবে না। তাছাড়া যারা সমাজসেবার সঙ্গে যুক্ত তারা সবাই কি সংসার ধর্ম বিসর্জন দিয়ে সমাজসেবা করেন?” মিস্টার বিকাশ কুমার রায়ের কথা শুনে শশী চুপ করে যায়। তিনি আবার বলেন— “ভেবে দেখো। আমার প্রস্তাব যদি তোমার গ্রহণযোগ্য মনে হয়, তবে এক সপ্তাহের মধ্যে জানিও।” এরপর শশী সেখান থেকে চলে আসে।

           শশী বাবা-মার কাছে বিষয়টা গিয়ে বলে। মা খুব আনন্দ পায়। কিন্তু বাবা বলেন— “বড়লোকের একমাত্র মেয়ে, আমাদেরকে মানিয়ে নিতে পারবে? তাছাড়া তোর সমাজসেবামূলক কাজে সহযোগিতা করবে কী? আমার তো সন্দেহ হয়।” বাবার কথা শুনে শশী বলে— “মিস্টার বি.কে রায় মহাশয় আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন, তাঁর মেয়ে এখনকার মতো নয়। সবরকম পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে পারে।” তবে আমার বিয়ে করতে ইচ্ছা নেই। কিন্তু ভাবছি, যার জন্য আজ আমি এতদূর এসেছি, তাঁর এরকম একটা প্রস্তাবকে আমি ফিরিয়ে দেবো।

উনি খুবই কষ্ট পাবেন। তাছাড়া ডাক্তার উনার মনে আঘাত দিয়ে কোন কথা বলতে বারণ করেছেন। তোমরা কিছু একটা উপায় বলতে পারো।” এরপর শশীর মা বলেন— “দেখ শশী, উনি তোকে বিশ্বাস করেন বলেই এই দায়িত্বটা দিতে চেয়েছেন। তাছাড়া ভালোবাসেন নিশ্চয়ই। নতুবা এত বড় কোম্পানির মালিক আমাদের মতো ঘরের একটা ছেলেকে এমন সুযোগ দিতে যাবেনবা কেন! কত যোগ্য ছেলেই তো আছে এই শহরে। তুই উনার মনে আঘাত দিসনা। উনার কথায় তুই রাজি হয়ে যা।” এরপর শশী অনেকক্ষন চুপচাপ থেকে বলে— “তোমরা যা ভালো বোঝো তাই করো। আমার কিছু বলার নেই।” তবে তোমাদের ইচ্ছে থাকলে আগামী পরশু চলো  মেয়েটাকে দেখে আসবে। আমি যদিও কখনও তাকে দেখিনি।” শশীর মা এরপর বলেন— ‘তবে তাই হোক।’

       দুদিন পর শশী মা ও বাবাকে সঙ্গে নিয়ে অস্মিতাকে দেখতে যায়। অস্মিতাকে দেখে তাদের খুবই পছন্দ হয়। অস্মিতা বাড়ি ফেরার দিনই মিস্টার বিকাশ কুমার রায় তাকে শশী সম্পর্কে সব জানিয়েছেন। অস্মিতা বাবাকে বলেছে— “তোমার যখন পছন্দ বাবা, তখন আমার কিছু বলার নেই। কারণ, আমি জানি তোমার জহুরীর চোখ। রত্ন চিনতে তুমি ভুল করো না।” ঐ দিনই অস্মিতার বাবার সঙ্গে শশীর বাবা পাকা কথা বলে ফেলেন। দুমাস পর একটি গোধূলি লগ্ন দেখে তাদের বিয়ে ঠিক হয়।

এই দুমাস শশীর সঙ্গে অস্মিতার পরিচয় আরো গভীর হয়ে ওঠে। দু-মাসের মেলামেশায় দুজন দুজনকে আরো ভালোভাবে চিনে নেয়। মিস্টার বিকাশ কুমার রায় মনে মনে ঠিক করে ফেলেন, বিয়ের দিনই তাঁর কোম্পানির সমস্ত দায়িত্ব তিনি শশীর উপর অর্পণ করবেন।

      দু-মাসে  শশী ও অস্মিতার মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক  গড়ে ওঠে। পূর্ব নির্ধারিত দিনে মহাজাকজমকের সঙ্গে তাদের বিয়ে হয়। বিয়েতে প্রায় তিন হাজার মানুষ নিমন্ত্রিত ছিলেন। শশী যে সমস্ত অনাথ শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের নিয়ে কাজ করে, তারাও উপস্থিত ছিল এই অনুষ্ঠানে। সকলের আশীর্বাদ লাভ করে নবদম্পতি। অস্মিতার বাবা মিস্টার বিকাশ কুমার রায় পূর্বপরিকল্পনা মতো সকলের সামনে তাঁর কোম্পানির সমস্ত দায়িত্ব জামাই শশীর হাতে তুলে দেন। এরপর তিনি বলেন— “আমি বিশ্বাস করি, তুমি ও মামণি মিলে আমার এই কোম্পানিকে আরো অনেক দূরে নিয়ে যেতে পারবে। তাছাড়া তোমাদের পিছনে আমি তো আছি। তোমার সমাজসেবামূলক কাজে তুমি আমাকে ও মামণিকে সবসময়ের জন্য সঙ্গে পাবে।” এরপর বিশাল খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন ছিল। পরদিন মিস্টার বিকাশ কুমার রায় চোখের জলে মেয়েকে বিদায় জানান।

         দুদিন পর বৌভাতের অনুষ্ঠান করে শশীরা। অস্মিতার বাড়ি থেকে পঞ্চাশ জন কন্যাযাত্রী আসেন। প্রায় পাঁচশ জন নিমন্ত্রিত ছিলেন। অস্মিতার কিছু বন্ধু-বান্ধবীও এসেছিল। শশীকে তাদের খুব একটা ভালো লাগেনি। তারা অস্মিতাকে বলে— “শেষ পর্যন্ত তোর বাবার দয়ায় যে চলে তাকেই বিয়ে করলি! তোর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎটা নষ্ট করলি এভাবে!!” অস্মিতা তাদেরকে বলে— “দেখ অমন বলিস না তোরা। শশী মানুষ হিসাবে খুবই ভালো। ও ওর যোগ্যতায় আমাকে বিয়ে করেছে। ওর মতো উদার ও ভালো মনের মানুষ খুবই কম হয়।” বান্ধবীদের কথা আড়াল থেকে শুনে খুবই খারাপ লেগেছিল শশীর। কিন্তু অস্মিতার কথা শুনে সে বুঝতে পারে, তার চিন্তা-ভাবনা অনেক ভালো।শশীর সাময়িক খারাপ লাগলেও পুনরায় মন ভালো হয়ে যায় অস্মিতার কথা শুনে।

           জীবনের পরিপূর্ণতা আসে বাবা কিম্বা মা হলে। কিন্তু অস্মিতা ও শশীর সন্তান নেওয়ার কোন ইচ্ছা ছিল না। তাদের ব্যস্ততম জীবনকে তারা বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। মানুষের জন্য জীবনকে তারা উৎসর্গ করেছিল। মিস্টার বিকাশ কুমার রায়ের ও শশীর বাবা-মার ইচ্ছা হয় তারা একটা সন্তান নিক। তাঁরা তাদেরকে অনেক বোঝায়। অবশেষে তারা রাজি হয় । কিন্তু গর্ভে নয়, দত্তক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। তাদের অনাথ আশ্রম থেকে এক বছরের একটা ছেলেকে তারা আইনত দত্তক নেয়। তার নাম দেয় স্বস্তিক। স্বস্তিককে কখনো দাদু-ঠাকুমার কাছে, কখনো মিস্টার বি.কে রায়ের কাছে রেখে মানুষের সেবায় ও অফিসের কাজে বের হত অস্মিতা ও শশী।

          দেখতে দেখতে পঁচিশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায়। শশী ও অস্মিতার জীবনে অনেক পরিবর্তন ঘটে। মিস্টার বিকাশ কুমার রায় ও শশীর  বাবা-মা গত হয়েছেন। দুজনা মিলে একটা হাসপাতাল তৈরি করেছে অনেক দিন হয়েছে। অসংখ্য মানুষকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করে তারা। ‘বি.কে রায় এন্ড কোম্পানি’ এতগুলো বছরে আরো ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। ছেলে স্বস্তিক ডাক্তারী পাশ করে বিলেত থেকে ফিরে এসে বাবা-মা’র মতো একজন সমাজসেবক হয়েছে। দরিদ্র মানুষদের কাছে এভাবেই তারা ভগবান হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ চাইলে এভাবেই ভগবানে পরিণত হতে পারে।

        শশী ও অস্মিতার চুলে পাক ধরেছে। মানুষের সেবা করতে করতে তাদের জীবনের এতোগুলো বছর কিভাবে কেটে গেছে তা তারা বুঝতেই পারে না।  মাঝে মাঝে কোন ক্ষনিকের অবসরে তাদের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। শশীর মনে পড়ে একটা সামান্য অভাবী মানুষ হয়েও আজ তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। মানুষের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দিতে পেরেছে সে । এজন্য সে ঈশ্বরের কাছে ও মিস্টার বিকাশ কুমার রায়ের কাছে সারা জীবন ঋনী থাকবে। অস্মিতা ভাবে, বাবার জন্য আজ সে ডাক্তার হতে পেরেছে। তাঁর দেখা শশী তার জীবনে রবির মতো উজ্জ্বল একজন ব্যক্তি। এর জন্য সে ঈশ্বর ও পিতার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। স্বস্তিকের মতো ছেলে পেয়ে অস্মিতা নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করে। স্বস্তিক যে তাদের দত্তক ছেলে, তা তাকে কোনদিন তারা দু’জন বুঝতে দেয় নি। তাদের পরিবারকে দেখে আশেপাশের মানুষেরা ভগবানের কাছে এমনই সুখী পরিবার প্রার্থনা করেন। তারাও যেন মানুষের জন্য ভাবতে পারেন, তার আশীর্বাদ চান ঈশ্বরের কাছে।

স্বপ্নপূরণ ছোটগল্প – সমাপ্তি

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!