কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

ছায়ার আড়ালে

ছায়ার আড়ালে ছোট গল্প – রাশিদুল বিশ্বাস

জাঁকিয়ে বৃষ্টি নামে । আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে নামছে হুড়হুড় করে বাতাসের চাপ। সারাদুপুর মেঘ আর বাতাসের সে কি খেলা!  ধেয়ে আসে আর বসে যায় মাটিতে। আত্মমগ্ন  মারজান। লম্বা ঢাড্ডায় কষনির টানে ঝুলন্ত শাড়ি লম্বালম্বি ভাবে পাতা। তারই ওপরে পেন্সিলে অস্পষ্ট জলচ্ছবি। রেখা বরাবর বসান হচ্ছে টিকি। টিকি হল জরির উপকরণ বিশেষ। নানান রঙের। নানান প্রজাতির প্রসাধনী- টুকরো। ফুল টিকি,নৌকো টিকি,রুইতন টিকি, পানপাতা টিকি আরও কত কি! সুচে পরান আইরন ডোর। তা টিকির মুখে মুখে ঢুকিয়ে গিঁট দেয়া হয়।হাতের গতিতে সূচ যেন ডলফিন৷ মুখ তোলে আর ডুবে যায়। নিরন্তর চলতে থাকে। নক্সা বুঝে টাকা। সাড়ি প্রতি  একশো -দেড়শো । কোনও কোনও মিলে রোজে পয়সা।  হাতের কেজো আঙুলে পরান থাকে আঙটা। অন্যথা চোখের পলকে সূচ ফুটে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে যাবে। তাহলেই বিপদ। কাজ বন্ধ। বন্ধ উপার্জন৷ 

 একই ভয়  টুসিরও । হাতে  সুচ। সাড়ির মেঝেতে গোছা গোছা টিকি,চিড়, পুঁথি। গেঁথে যায় সারাদিন। সকাল থেকে সন্ধ্যে।মিলের বিভিন্ন ঘরে কাজ চলে। এঘরে কেবল মারজান আর টুসি। ছোট্ট ঘর৷ একই সঙ্গে মাত্র দুটি সাড়িতে জরি বসানোর কাজ করা যায়।

    রংবেরঙের কাপড়। টিকি আর চিড় বসাতে বসাতে টুসি উদাস হয়ে যায়। ঘনঘন বৃষ্টির ঝাপটা জানালা- দরজায় আঘাত করে ।অস্পষ্ট হয়ে আসে কাচের পাল্লাগুলো। ক্লান্ত শরীর অবসন্ন হতে হতে শান্ত হয়ে যায়।কুচকে পড়ে বুকের পাজরে। ঘরও ক্রমশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে থাকে ৷ 

ঢাড্ডায় পাতা কাপড়। যেন সিনেমার পর্দা।তাতে ভেসে আসে কিছু রঙিন ছবি।  বীরভূমের    পাইকর । অসংখ্য মানুষের ভীড়। নতুন বউ। পাতলা গড়নে ফর্সা ত্বকের চোখধাঁধান ফিগার।টলমল কাঁচা দুধে যেন কাঁচা হলদির রস। সাদা গালের দুপাশে দুটি কানের লতিকা । অস্বাভাবিক সুন্দর। কোনও এক অদৃশ্য হাতে আঁকা নিঁখুত চিত্র।শরীরের ভাজে ভাজে চোখ টানে অবিরাম। বউ এর সাজে রূপবতী রাজকন্যা। আকাশের চাঁদ ভুল করে বুঝিবা গরিবের ঘরে ঝরে এসেছে, কথাটি বর পক্ষের একজন বলে হেসে ওঠে। পাশের চেয়ারে  একজন মানুষ। শেরওয়ানি পরা। মুখে রুমাল চেপে হাসে বারবার । ঘনিভূত আসন্ন মুহূর্তের তীব্র অপেক্ষা। হাতে হাত তুলে দেয় পাড়ার বয়স্কা ঠাকুমা। 

 — আজ বোধহয় বাড়ি যাওয়া যাবে না। কী বল টুসি?  মারজান মৌনতা ভেঙে কথা বলে ওঠে। কথার আঁচড়ে ভাবনায় ছেদ পড়ে টুসির ।

— হুঁ?  হুম! একটু সময় নিয়ে উত্তর করে টুসি। 

কী আর করার? কাজ করুন। দুটো পয়সা করুন।  এক আঁজলা হাসির ঢেউ উঠতে গিয়ে নেমে যায়। রাস্তার পাশে বড়ো ড্রেন।  জল নামে তাতে। রাস্তা ছাপিয়ে দু’কুল বেয়ে জল গড়িয়ে আসে। কলকল শব্দ কানে আসে। 

— এতো ঢল নামছে ! আজ কি খেতে যাবেন না ? মুহূর্ত ভেবে নিয়ে  জিজ্ঞেস করে টুসি ।  বৃষ্টি ভেজা ঝোড়ো বাতাসে শুনতে পায় না কথা৷  তবে মারজান বুঝতে পারে, টুসি তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু একটা বলছে৷ 

— কিছু বলছ ?  জানতে চায় মারজান৷ টুসি  দ্বিতীয়বার খাওয়ার কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু  গিলে নেয় বাতাস। হাত দিয়ে খাওয়ার ভঙ্গি করে দেখায়। বুঝতে পেরে মারজানও আঙুল দিয়ে বাইরের বৃষ্টিকে ইঙ্গিত করে। নিঃশব্দে দুজনের ভাব বিনিময় হয়।  সশব্দে হেসে ওঠে দুজনেই । খ্যাক খ্যাক হাসির আড়ালে মিশে যায় খিলখিল হাসিটা। বৃষ্টি থামে না। খিদে পেটে কাজ কতক্ষণ! কাজের গতি শ্লথ হয়ে আসে ক্রমশ ৷ আইরন ডোর পরান সুচটা পাশের ক্যালেণ্ডারে বিঁধে দেয় মারজান৷ মোবাইলে গান দেয়–

  “ঝমঝম বৃষ্টির রাতে/তোমার ওই নরম হাতে 

এ হাতটি জড়িয়ে চলো/ওগো হাটি একসাথে “

    পাঁচ বছর আগের এমনই এক বৃষ্টির দিন৷ খুব মনে পড়ে টুসির৷ হাতে হাত রেখে  সারাপথ হেঁটেছিল দুজনে। মকসেদ বলেছিল, এভাবেই আরও হাঁটতে চাই। দু’জনে সংগোপনে। দীর্ঘ সময় ভেজা শরীর কামুক হাওয়ায় উন্মত্ত হয়ে আসে। খোলা আকাশ। সাদা বৃষ্টির  চাদরে মোড়ানো চারপাশ। তারই মাঝে  জাপটে ধরে একে অপরকে । শীতল হয়ে আসা প্রকৃতির বুকে গড়িয়ে নামতে থাকে উষ্ণ জল৷ নেমে যায় অনেক অনেক গভীরে। গরম হয়ে ওঠা কান আলতভাবে কামড়ে দেয় মকসেদ ৷ তারপর, সারারাত আদর করে টুসিকে। প্রাণ কেঁদে উঠে আনন্দে , আমদে, সুখে। 

— এত সুখ দিওনি  আমাকে! টলমল জলচোখে টুসি মকসেদকে বলে। 

— কেন?  অন্য কেউ আছে নাকি?

কথা বলতে দেয় না টুসি। হাতের তালুতে মকসেদের মুখ চেপে ধরে।  অমন কথা বল না গো! ভয় হয়!  যদি কখনও আমাকে ভুলে যাও। তখন এত সুখ আমি ভুলব কেমনে ? 

— কেন,  আমার থেকে বেশি সুখ কেউ দিতে পারবে না ! 

— না !  আমার চায় না অন্যের থেকে সুখ।নাকি সুরে বলতে বলতে দু’হাতে কিল মারতে থাকে মকসেদের বুকে। আলতো সুখের মার৷ আদরের মার। তারপর হারিয়ে যায় স্বর্গীয় সুখের সাগরে। যেখানে কোনও বাঁধা নেই। ভয় নেই। স্বাধীনতা আছে।  লাগাম ছেড়া মন।

— আহ্। আমার লাগছে তো!  ওভাবে মারলে সত্যি সত্যি পালিয়ে যাব। হা হা হা হাসির বুকে হিহি ডুব দেয় । শান্তির ডুব।

   মকসেদের কথাটা মজাই ছিল। কিন্তু রসের পায়েসে কালচে হয়ে আসা এলাচ কখনও সখনও মাথা তুলে থাকে। বিড়ম্বিত ভাগ্য ঠিক তাই৷ সুখের জীবনকে তেতো করে তোলে।  সত্যি তাই ঘটেছে টুসির জীবনে৷ বিয়ের এক বছর পর। ছন্নছাড়া হয় জীবন,যৌবন, সব সুখ।স্বামী হাওড়ায় জরির কাজ করতে আসে। ঘরে একা টুসি৷ যন্ত্রণার রাত কাটে বালিসে বুক চাপা দিয়ে । মকসেদ  আর ফেরেনি। কত দিন,কত মাস  কেটে যায়  পাথর বুকে। কত কুৎসা, কত অপবাদ,কলঙ্ক শুনতে হয়েছে। দু’চোখের কষ বেয়ে গড়িয়েছে অপেক্ষার অশ্রু। লোকে বলে মকসেদ আবার বিয়ে করেছে। সাদা শরীরে রক্তের স্রোত। যে কোন সুস্থ পুরুষের নেশা জাগাবেই। তাকে বউ করে পেয়ে কেউ ভুলতে পারে! এসব অশ্লীল কথায় পাড়ার  মেয়েরা মেতে ওঠে।  ঝিম ধরে থাকে টুসি।  সে অবশ্য  বিশ্বাস করে না । যাকে পেয়ে মকসেদ নিজেকে ধন্য মনে করত। টুসিকে বেহেস্তের হুর মনে করে জড়িয়ে নেয় বেলা- অবেলা। তাকে আর যা-ই হোক ভুলতে পারে না। সেই আশা বুকে গুঁজেই না হাওড়ায় আসা। প্রতিবেশী আর আত্মীয় স্বজনের টিপ্পনী সহ্য হচ্ছিল না আর। মকসেদ ফোনে ডেকেছে, মিথ্যা বলেই বাড়ির বাইরে পা রাখে ৷ তারপর কত খুঁজেছে। কত জরির মিল! কত কাজের ঘর! মকসেদকে পায়নি । কোনও সন্ধানও না। বাড়ি থেকে আনা টাকায় মাস দুয়েক গেলেও শেষ হয় এক সময়। শিখতে থাকে জরির কাজ। মকসেদ একদিন না একদিন ফিরে আসবেই। এই আশা নিয়েই থেকে যায় খয়জাপুর। তাছাড়া বাড়ি ফিরাটা আরও কলঙ্কের দাগ কেটে দিত। 

— কী হল টুসি বিবি?  মারজান জিজ্ঞেস করে। সে তাকে প্রথম দিন থেকে এই নামেই ডাকে। 

 কখন যে সে ঢাড্ডায় মাথা রেখে স্মৃতিঘুমে তলিয়ে যায় বুঝতেই পারেনি। চেতন পায়। মাথা তুলে তাকায়। বলে,কই কিছু না তো!

— শরীর খারাপ লাগছে  ?  সহানুভূতির সাথে জানতে চায় মারজান। এখানে কাজে এসে মারজানের সঙ্গেই  প্রথম পরিচয়।

 মকসেদের পরে একমাত্র  পুরুষ ।  টুসি বিশ্বাস করে।  মনের কথা বলতে পারে। মকসেদ অতীত; বুকের পাঁজর ঘেরা এক ভালোবাসা। মারজান বর্তমান;পাঁজরের বাইরের ছায়া।  একটা আস্থা। ছায়ার আড়ালে মিশে একাকার অতীত ও বর্তমান। 

গত দুই বছর ওরা এক সাথে কাজ করছে। ওর কাছে অনেক কাজ শিখেছে। একজন ভালো বন্ধু। অতীত ভুলে যাও টুসি। যত তাড়াতাড়ি ভুলবে তত তাড়াতাড়ি নতুন জীবন গড়তে পারবে। আবার সুখের খোঁজে চোখ তুলে তাকাও। কতদিন কতবার একথা বলেছে মারজান তার ইয়ত্তা নেই। 

— হাত ধুয়ে আসুন  মারজান ভাই। দেওয়ালের এক কোণে  একটি ব্যাগ। হাতে তুলতে তুলতে টুসি বলে। 

— কেন?  মারজান হাসতে হাসতে জানতে চায়।

–কেন আবার কী ?  বৃষ্টি হচ্ছে বাড়ি যেতে পারবেন নাকি!  খাওয়া লাগবে না ? আসুন খাবেন। 

— মানে?  তুমি  আমার জন্যও খাবার এনেছ নাকি টুসি বিবি ? হে হে হে করে হাসে। 

— না। আনিনি। এমন বৃষ্টি হবে জানলে হয়ত আনতাম । কোনও দ্বিধা না করে টুসি কথাগুলো বলে যায়। 

— তবে?  তোমার খাবার আমি খাব না  ?  তুমি কী খাবে’ক্ষণ?  

— দু’জনেই খাব । জলদি আসুন না। কাপড়ের ব্যাগ থেকে দুটি’ টিফিন বক্স বের করে। একটিতে রুটি অন্যটায় আলু ভাজা। সঙ্গে জলের বোতল। আর কথা বাড়ায় না মারজান। খিদে পেটে নাটক চলে না৷ হাত ধুয়ে আসে। টুসির সামনে বসে। দুজনে ভাগ করে খেতে শুরু করে। বৃষ্টির উন্মত্ততা আরও বাড়ে। মিলের গেটের তলা হয়ে জল ঢুকছে। 

— আচ্ছা আপনি বিয়ে করছেন না কেন  ?  টুসি কেন যে আজ এমন অপ্রাসঙ্গিক কথা জিজ্ঞাসা করে বসে। সে নিজেও জানে না। হয়ত লুক্কায়িত কামনা । হয়ত ঘুমিয়ে থাকা মনের বাসনা। সেটা জানা যায় না! স্মৃতি পুরনো হতে হতে এক সময় হারিয়ে যায়। নতুন গল্প জমে বুকে। নতুনকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখে মানুষ।  বিপন্ন-বিস্ময়ের ভেতরে হারিয়ে গেলে মানুষ আপনা থেকে উঠে আসার চেষ্টা করে। গভীর জলে ডুবতে থাকা মানুষ খড়কুটোকে বাঁচার অবলম্বন ভাবে। দুঃখের সাগরে তলিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ ই  উল্লাসের ছোঁয়া পেতে চায়। তা হয়তো সুখ  এনে দিতে পারে না। ক্ষনিকের হঠকারিতাকে উলোটপালোট করে দেয় । টুসির অশ্রুপ্লাবিত জীবনে মারজান এক ফালি ছায়া। তার আড়ালে  মুহূর্তের জন্য ক্লান্তি জোড়ান যায়।

 এমন কথায় মারজান আশার আলো দেখে। গত দু’বছরে অনেকভাবে সে চেষ্টা করেছে। টুসিকে বোঝাতে পারেনি৷ টুসি বিবাহিতা মেয়ে হলেও তার জীবনে সাতসমুদ্র রসের জোয়ার। তাকে দেখার আগে কখনও কোনও মেয়েকে ভালোবাসতে পারেনি মারজান ৷ টুসি একটিবার বলুক, সে নতুন জীবন গড়তে চায়। সে যা চায়বে তাই দিয়ে ওকে বিয়ের আসনে বসাবে। কথাটি ভেবেই হোঁচট খায় মারজান৷ তার কাছে তো বেশি  পয়সা নেই। এত বছর কাজ করেও একটা ইটের বাড়ি করতে পারেনি এখনও ৷ 

— কী হল ?  খুব যে অন্য সময় বকবক করতে থাকেন !  জবান কি  বন্ধ হয়ে  গেল ?  টুসি চাপা গলায় জানতে চায়৷ 

— হ্যা। ইয়ে, মানে। বিয়ে করব না কেন? 

— বুড়ো হয়ে গেলে কেউ বিয়ে করবে ? 

— আলত হাসি খেলে যায় ঠোঁটে। শৈশবের লাজুকতা মারজানকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। মুখে থাকা রুটি আর চিবোতে পারে না। ব্যক্তিগত জীবনে ভার্জিন। বিয়ের কথায় এতোটা মুষড়ে যাবে কে জানত! 

টুসিও অবাক বনে যায়। একজন দামড়া হাতিমার্কা পুরুষ। বিয়ের কথায় গলে গেল যে!  আহা মরি মরি! 

কেউ কোনও কথা বলতে পারে না আর৷ বাইরে শনশন করে বৃষ্টির খেলা চলে৷ দড়াম শব্দে একটা ডাল ভেঙে পড়ে মিলের শেডে৷ গুড়গুড় করে ওঠে মেঘ। মিলের আর সব শ্রমিকরা কখন কোন পথে ছুট দিয়েছে বাড়ির দিকে। বাকি একজোড়া মানুষ। ম্যাচিওর নারী-পুরুষ। নিজেদের সুখ-দুঃখের কথায় ডুবে যায়। 

   সন্ধ্যা নামে। রাত গড়ায়৷ খয়জাপুরের শেষ সীমানায় মারজানের বাড়ি। ঘোষালচক । টুসি থাকে বুড়িখালি । কাজ বন্ধ হয়েছে অনেক আগেই। মিল বন্ধ হয় এবার। দারোয়ান মিলের শাটার নামায়। দুজনে সন্তর্পণে বেরিয়ে আসে বাইরে। ওটা বাড়ি নয়, যে রাতে থেকে যাবে দু’জনে। তাছাড়া বাকি সকলে বাড়ি ফিরেছে কখন তার খোঁজ নেই৷ 

–আমার তো ঘর নেই। এতো বৃষ্টির রাতে তোমাকে একা ছাড়তে মন চায়ছে না ।  হঠাৎ কেন জানি আজ , মারজান অনেকটা বিচলিত বোধ করে। হাঁটতে হাঁটতে আগুনখালী শ্মশানের কাছাকাছি পৌঁছে যায়৷ শ্মশানের প্রান্ত বরাবর বাঁশবাঁধা ছোট ছোট  কুঁড়ে। সকালে সবজির হাট বসে। হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে আসে আবার । পাশের কুড়োয় মাথা লুকায় দু’জনে৷  ঘনকালো  রাত। কিছুই দেখা যায় না। শোঁশোঁ বৃষ্টির দাপটে চারপাশ একাকার।

 ভেজা শরীর। ঝোড়ো বাতাসে শিরশির করে। 

— তোমার কী ঠাণ্ডা করছে টুসি?  

— হুম। খানিকটা । 

— তোমার কাছে কোনও কাপড় নেই?  মানে শরীরটা মোছার জন্য? 

— নাঃ!  বলেই নিজের ওড়নার দিকে চোখ পড়ে। বিদ্যুতের আভায় সাদা ওড়না চকচক করে। লজ্জায় লাল হয়ে যায় টুসি। তারপর ঝুলতে থাকা ওড়নার এক প্রান্ত দিয়ে নিজের মাথা, দুই হাত, কনুই, মুখ, গলা, নিচের সমতলভূমি মুছে নেয়। 

— ভেজা কাপড়ে তোমাকে দারুন লাগছে টুসি! 

— এতো অন্ধকারে কীভাবে বুঝলেন?  চাপা গলায় বলে টুসি। গলায় বিশ্বাসের সুর। 

— শত আঁধারেও তোমাকে দেখতে পাই যে। 

— কীভাবে?  

— পাই টুসি, পাই। ইচ্ছে থাকলে মানুষ সব পারে। এই প্রথম শুধু টুসি নামটি ধরে ডাকে মারজান৷ একক সত্তা। সেখানে মকসেদের অস্তিত্ব ‘বিবি’ নেই। টুসি চুপ করে থাকে। 

 –এতো বৃষ্টি, এতো ঝড়, এতো অন্ধকার পৃথিবীতে আর কেউ আশেপাশে আছে বলে তোমার মনে হয়  টুসি? প্রয়োজনের চেয়েও বেশি করে টুসি নামটি উচ্চারণ করে মারজান ৷ আজ হঠাৎ রোমান্টিক হয়ে ওঠে সে। ওই একটিমাত্র জিনিস, যেটা পৃথিবীর পাগলকেও বোঝাতে হয় না। আঁচলের  গন্ধে রক্তরা খেলা করে শরীরের অন্ধকারে। শিরায় শিরায়  চলতে থাকে আগুনের হলকা। অবস হয়ে আসে মনও৷ আগ্নেয়গিরিতে পড়তে থাকা জলের বিন্দু যেন ধোঁয়া হয়ে উড়ে যায়।  মুহূর্তে সব শীত সময়ের কাছে গলে পড়ে মাটিতে। মারজান হঠাৎ ঝুলতে থাকা ওড়নার অন্য প্রান্ত তুলে নেয় হাতে ৷ কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে আসা জল মুছে নেয়।  মুখ মোছে। একটা মায়াবী সুগন্ধি নাকে লাগে। মেয়েলি শরীর । ওড়নায় চুমু খায়৷ পৃথিবীর সমস্ত মেয়ের শরীরের গন্ধ একই নাকি! সেসব  মারজান জানে না। মাথার মধ্যে কেমন করে!  এ শরীর তার অচেনা জগত৷ আর একটু জড়িয়ে নেয় হাতের তালুতে। আর একটু । আরও একটু। টান পড়ে বুকের কাপড়ে। কোথাও যেন মারজানের ছায়াতে মকসেদকে দেখতে পায় টুসি। কিন্তু পুরুষের গন্ধ তার চেনা। অবসন্ন দেহে হারাতে থাকে নিজেকে। আরও আনন্দ, আরও সুখ…

 এটা কী করছেন আপনি ? আমাকে এভাবে একা পেয়ে সুযোগ নিচ্ছেন? ঝাঁঝালো কণ্ঠ। অবিশ্বাসের সুর।  হ্যাচকা টানে ওড়নার প্রান্ত মুক্ত করে টুসি।  মুক্ত করে নিজেকেও৷ কেমন বিরক্ত লাগে মারজানকে। এক দৌড়ে বেরিয়ে যায় হাট বাঁধা দোকানের চালার তলা থেকে। উন্মত্ত  বৃষ্টির স্রোত, সাদা ফেনায়িত বৃষ্টিবতী পাগলা হাওয়ার ভীতর দিয়ে  ছুটতে থাকে টুসি। দূর, দূরে, অনেক দূরে মিশে যায় টুসি।

ছায়ার আড়ালে ছোট গল্প – সমাপ্তি

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!