তিতির কান্না ছোট গল্প – ভাস্কর সিন্হা
“তুই তো অনেক দিন হলো ফোনই করিস নি। যাবার আগে ক্য়াট মেসো বারকয়েক জিজ্ঞেস করেছিলো তোদের কথা।”
“হ্যাঁ ক্য়াট মাসি, সত্যি সত্যি, এই কয়েক মাস ভীষণ ধুন্ধুমার গেলো। নতুন জায়গা, তায় বিদেশ। বুঝে উঠতেই খানিক সময় কেটে গেল। মনে ছিল তোমাদের কথা। হচ্ছে- হচ্ছে, দেখতে- দেখতে, এতো সময় যে চলে গেল দামোদরের খাল বেয়ে। তা ক্য়াট মেসোর কি-“
“গতবার হয়েছিল সে যমে-মানুষে টানাটানি। হঠাৎ অ্যাটাকে প্রায় সবই অসাড়। তারপর কোনক্রমে ডান দিকে কিছুটা সাড় এলো ফিরে।”
“হ্যাঁ, শুনেছিলাম কিছুটা। তারপর তো তোমাদের দেখ ভালে কিছুটা ঠিক-“
“ওই আর কি। তবে সেবারই ডাক্তার বলেছিলেন যে আবার কিছু হলেই খুব মুস্কিল,” বলতে বলতে ক্য়াট মাসি প্রায় বাক রুদ্ধ।
অনি হড়বড়িয়ে ওঠে, “ঠিক আছে ক্য়াট মাসি তুমি এখন বিশ্রাম নাও। নিশ্চয় ভীষণই পরিশ্রান্ত। অনেক ধকল গেছে।”
“হ্যাঁ, তিতি তোর ক্য়াট মেসোকে এখন ফুলে আর চন্দনে সাজাচ্ছে। যাই ওকে একবার দেখি। জানিস অনি, ওই হাসপাতালে ওরা বললে যে যান বডি নিয়ে চলে যান। বডি কি রে? ও যে তোর ক্য়াট মেসো।”
“হ্যাঁ ক্য়াট মাসি, তুমি এখন মেসোর পাশে খানিক বসো। খোকা মামা কি এসেছে?”
“খোকামামাকে তো খবর দেওয়া হয়েছে। জানি না কি করবে? বিয়ের পর তো পরই করে দিল আমাদের।”
“হ্যাঁ ক্য়াট মাসি, খুবই দুর্ভাগ্যজনক! তবে আশাকরি নিশ্চয় যোগাযোগ করবে।”
“হাঁরে অনি, তোর মনে আছে গড়চুমুকের দিনগুলো? কত সুন্দর ছিলো বল?”
“নিশ্চয়! কখনো ভোলা যায় সে সব দিন? স্নিগ্ধ ঝিরিঝিরি নদী আর সবুজ বনের সুবাতাস। আমার সবসময় মনে আসে। আর দামোদর ভাগীরথীর মিলিমিশিতে, যেখানে আমরা পিকনিক করতে যেতাম-“
“তুই একবার দস্যি ফুটকির সাথে ডিঙ্গি নিয়ে ওপারে।”
“হ্যাঁ ক্য়াট মাসি, খুবই ঘাব্ড়ে গিয়েছিলাম। দাঁড়ই সঙ্গে নেই তো কি দিয়ে টানব? ওপারে খোকা মামা আর মাঝি চিলাচ্ছে। তারপর কি যে হলো, দুই জনার জোর ধাক্কায় আর আমাদের ঝম্পে ডিঙ্গি এসে এপারে।”
“খোকা মামা তো তোকে খুবই ভালবাসত। অবশ্য তিতিকেও আদর- ভালবাসা দিয়েছে অনেক।”
“সত্যি ক্য়াট মাসি, তোমরা ছাড়া ছোটোবেলাটার কোন মানেই হয় না। যা ভালবাসা পেয়েছি- মন কানায়- কানায় পূর্ণ। তোমরা তো অতলহীন ঘড়া থেকে ঢেলেই যেতে।”
“তোর খোকামামাও তো আমাদের কত খেয়াল রাখত। বেশ ছিলো রে দিনগুলো। তারপর কি যে হলো সব? এখন যাই রে অনি। সবাই এসে গেছে। তোর ক্য়াট মেসোকে এখন ঘাটে নিয়ে যাবে।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, যাও। পরে আবার কথা বলছি।”
মন ছুঁয়ে রাখা তিরিতিরি প্রজাপ্রতিটা যে একটা বর্ণচ্ছ্বটায় রঙীন কাঁচের জানলা যে কখন, কিভাবে ডানার প্রসারণে খুলে অনির মনের কোনের দুটো ভারহীন হালকা সবজে হলুদের বুদ্বুদ ভাসিয়ে দিল অজান্তেই। ক্য়াট মাসির এহেন দুঃসহ পরিস্থিতিতে অনি এসকল ভাবনায় যুগপৎ বিব্রত ও সংকুচিত হলো। তবুও পুরানো সেই দিনের কথার চিত্রকল্পসমূহ মনের মায়ামুকুরে ক্রমশঃ উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে লাগল।
দুষ্টু ফুটুসের সাথে বনভোজনের পরিকল্পনা। কাঠ আর শুখা পাতার আগুনে জমিয়ে আলু তো পোড়ানো হলো। তারপর শেষে ক্য়াট মাসির শরণাগত হয়ে ভাত আর ডিমের ঝোলের ব্যবস্থা। দাদাই-এর কাঁধে চড়ে প্রভাতফেরি। তারপর মাঝ রাতে অমৃতি খাবার বায়নাক্কা। অগত্যা দাদাই ফতুয়া গলিয়ে চললেন ভোলা ময়রাকে জাগাতে। আবার আঁচ উঠবে। কড়াই-এ তেল চড়বে। অমৃতি এসে পৌঁছয় অবশেষে। অনিবাবু- লোচন মণি তখন ঘুমের দেশে।
গ্রীষ্মের ছুটি গুলো নির্বিঘ্নে কেটে যেত আরাম কেদারায় শরীর ডুবিয়ে অগুন্তি সাহিত্যসম্ভারের রসাস্বাদনে। সব পাঠ্য যে বয়সোপযোগী ছিলো তা বলা চলে না। অভিভাবকেরা জানতেন বোধহয়। তবে পাঠে সেন্সরের হস্তক্ষেপ কদাপি ঘটে নি।
মন খারাপের শুরু ক্য়াট মাসির বিবাহের পরিকল্পনা শুরু হতেই। আগে কতো পারিবারিক বৈবাহিক উৎসবে কতো উৎসাহ-উদ্দীপনার সঞ্চার ঘটিয়েছে। নাতবরের এলাহি আপ্যায়নে মন যেন জাপানী রঙীন ফানুস। তবে এবারে মনে হয়েছে যে বাম দিক খুঁড়ে কেউ রক্তাক্ত ধুক্পুকানি বার করে নিয়েছে। ভীষণ রাগ হয়েছিলো ক্য়াটমেসোর উপর আমার মনপরিকে কেড়ে নিয়ে শাল-মেহগনির পথ ছাড়িয়ে ঝর্ণাকোষায় চলে যাওয়ায়।
তারপর দিদাই চলে যেতেই গড়চুমুকের ফ্রেমে ধুলোর পলস্তারা পরার শুরু। দুঃসংবাদটি আকস্মিক এবং অবিশ্বাস ছিলো শুধু তাই নয়, ঐ সকরুণ পরিস্থিতি নবরসের রাগ, ক্রোধ, অভিমান, জিঘাংসা ইত্যাদির উদ্বেলতার জোয়ার-প্লাবন জুগিয়েছিলো। এই ক্য়াটমাসি-ই তখন হাল ধরে ভাঁটায় নৌকো ভিড়ায়।
যাক এতো বড়ো ঘটনার পর একটু সামলাতে দিতে হবে ক্য়াটমাসিকে। অনি জানে সময়ের সাথে নতুন স্মৃতির জন্ম হয়। পুরাতন স্মৃতি বিবর্ণ হতে হতে ক্যানভাসের ফ্য়াকাশে চুনকামে মিশে যায়।
শ্রাদ্ধের ফুলে ঢাকা ক্য়াট্মেসোর ছবি পোস্ট করে তিতি। পরলোকগত আত্মার শান্তি কামনা করে ক্য়াটমাসিকে দূরভাষে আবার ধরে অনি। আজ ক্য়াটমাসি একটু বেশী শান্ত। বলে প্রচুর লোকসমাগমের কথা। শান্তি- শ্রাদ্ধাচার ও গীতা পাঠের কথা।
“তোর ক্য়াট মেসো খুবই অনুভূতিশীল ছিল রে। আমার অপারেশনের পর সঙ্গে- সঙ্গে আয়া রেখে দিল। আর রান্না- রান্নার কারবারটা হোটেলের উপর বর্তে দিল।”
“হ্যাঁ, জানি- জানি, সবই শুনেছি। তোমরা তো ছিলে এক হরিহর আত্মা। বলি কি একটু শক্ত হও ক্য়াট মাসি। তিতিও তো দেখছি ভেঙ্গে পড়েছে। ওর সামনে তো পুরো জীবনটাই-“
“জানি রে অনি, সেই তো চিন্তা- হঠাৎ আমার কিছু হলে ও তো অকুল- পাথারে পড়বে।”
“বালাই ষাট। শুভ- শুভ বলো। তাই তো বলি শক্ত হও। যা হয়েছে- তা অপূরণীয়। কিন্তু যা রয়েছে তাও তো ফেলনা নয়। জীবন যতক্ষণ আছে, ততক্ষণই মূল্যবান। তিতি তো দেখছি কথা বার্তা বেশী বলছে না।”
“হ্যাঁ রে আমিও চলে গেলে, ওকে তোরা দেখবি না?”
“কি যে বলো, আমরা তো সবাই আছি। ক্য়াট মাসি তুমিও ঠিক থাকবে। খুব বেশী আর ভেবো না।”
এর পর কয়েকদিন দূরভাষালাপ ক্ষীণ হয়ে গেছিল, হয়ত স্ফীত দূরভাষের বিলের বিবেচনায়। যদিও সেদিন কিছুক্ষণের আলাপে দুজনকেই দুজনার উপর খেয়াল রাখতে বলায় কার্পণ্য করেনি সে।
হঠাৎই, “হ্যাঁ অনিদা, মা তো আর কিছু বলতেই পারছে না। মুখ হাঁ করে শ্বাসের চেষ্টা করছে, কিন্তু মনে হয় কিছুই যাচ্ছে না-“
“তুই এখনই এম্বুলেন্স ডাক। তাড়াতাড়ি ক্য়াট্মাসিকে কাছের হাসপাতালে নিয়ে চল।”
স্নিগ্ধা অনিকে তারপর দূরভাষালাপেই বসে থাকতে দেখে সব কাজ শিকের তুলে। তারপর দুদিন বাদে অনি একদম শান্ত হয়ে যায়। স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে, অনি রূদ্ধকন্ঠে জানায় যে ক্য়াট মাসি আর একাকী নেই। পরমপিরীতিজনার সঙ্গে আবার ঘর বেঁধেছে।
“তিতি আর কাঁদিস না। আমি তো আছি। শক্ত হ। আর খোকামামাকেও জানা।”
একথার উচ্চবাচ্য না পেয়ে অনি ধারণা হলো যে সে খুব একটা কথার মতো কথা বলে ওঠেনি। এরপর দিনকয়েক অনি ফোনটা হাতছাড়া করেনি। আবার অধুনাতন গণমাধ্য়মগুলির উপর বিশেষ আস্থা না থাকলেও বা নিজে তাদের ব্য়বহারপটু না হলেও, অনি সেগুলি চোখ ছাড়া করেনি।স্নিগ্ধা দেখে অনি ব্যাগ গোছায়। আবার কার্যালয়ের ট্য়ুর নাকি? অনি শুকনোমুখে সকালের গণমাধ্য়মগুলির সংবাদ স্নিগ্ধার দিকে এগিয়ে দেয়। স্নিগ্ধার চোখ চারটি কালো অক্ষরে থমকে যায়- ঝর্ণাকোষায় মাতৃপিতৃহীন যুবতির অপহরণ!
তিতির কান্না ছোট গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
শ্রাবণ সন্ধ্যা
শাস্তি
রাজবাড়ী রহস্য