কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

অতলান্তে অন্তঃস্রোত  

অতলান্তে অন্তঃস্রোত প্রেমের গল্প – রানা জামান

মনটা অনেক অনেক খারাপ হয়েছে খালেদ চৌধুরীর আজ। এভাবে প্রত্যাখাত হবেন ভাবেন নি কখনো। পঞ্চাশ বছরে এমনটা কখনো ঘটে নি। তাকিয়ে আছেন ছাদের দিকে। কক্ষে শূন্য ক্ষমতার বাল্ব জ্বলায় কক্ষের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পাশে দ হয়ে শুয়ে আছেন নাফিসা তরফদার। বিয়ের পরে নাফিসা বাবার পদবি ছেড়ে স্বামীর পদবি নেন নি। ওদের দুটো সন্তান। নন্দিতা ও বিজয়। ওরা এখনো পড়ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। গেলো ক’ বছর যাবৎ বড়লোকদের সন্তানেরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হতে পারছে না। ওদের মেধা কম নাকি বাবা-মার টাকা বেশি থাকায় ঠাঁট দেখাবার জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়? গবষেকগণ ভাবুক তা নিয়ে, আমরা গল্পে যাই!
খালেদ চৌধুরী স্ত্রীকে একবার দেখে বেরিয়ে এলেন শয্যাকক্ষ থেকে। ড্রয়িংরুমে ঢুকে একটা একক সোফায় বসলেন। সোফাটা এল-প্যাটার্ণের; বামদিকে একটা ডিভান আছে। এটা ওঁর সোফা। ওঁ বরাবর এটায় বসে থাকেন। এই সোফার বাম বাহুর পাশে একটা দেরাজ আছে। ওখানে কিছু ব্যক্তিগত সরঞ্জাম থাকে ওঁর; যেমন সিগার বা সিগারেট, লাইটার, পানমশলা ইত্যাদি। খালেদ চৌধুরী বাম হাতে দেরাজ খুলে একটা সিগারেট ও লাইটার বের করে চলে গেলেন ব্যালকনিতে। সিগারেট জ্বালিয়ে টানতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরে পদশব্দে পেছনে তাকিয়ে বিজয়কে দেখতে পেয়ে সিগারেটে একটা লম্বা দিলেন।
বিজয় জিজ্ঞেস করলো, বাবা, এতো রাতে এখানে সিগারেট টানছো কেনো? মার সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে নাকি? না রে! ঘুম আসছিলো না, তাই এখানে এসে সিগারেট টানছি।
আমি ভেবেছিলাম তুমি সিগারেট টানা ছেড়ে দিয়েছো!
মনটা বেশি এলোমেলো হলে মাঝে মধ্যে টানি।
আগামীকাল বাড়িতে একটা বড় প্রোগ্রাম হতে যাচ্ছে। তুমি নির্ঘুম রাত কাটালে কাকে নিয়ে প্রোগ্রামটা করবো! খালেদ চৌধুরী বিজয়ের দিকে ফিরে বললেন, তুই জেগে আছিস কেনো? স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেছে? কেউ আছে নাকি স্বপ্নে এসে ডিস্টার্ব করার মতো?
লজ্জা পেয়ে বিজয় মাথা নিচু করে বললো, তেমন কিছু না বাবা! হাঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে কেনো জানি না মনে হলো এদিকে আসি। ড্রয়িংরুমে এসে সিগারেটের গন্ধ পেয়ে বুঝতে পারলাম তুমি ব্যালকনিতে আছো। খালেদ চৌধুরী বিজয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন, তুই শুতে যা! আমি সিগারেটটা শেষ করে যাচ্ছি। না বাবা! তুমি সিগারেটটা শেষ করো। তোমাকে রুমে পৌঁছে দিয়ে আমি আমার রুমে যাবো।
খালেদ চৌধুরী দ্রুত সিগারেট টানতে গিয়ে কেশে উঠলেন। বিজয় বাবার হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে ফেলে দিয়ে বললো, আর টানতে হবে না বাবা! যে কোনো কারণে তুমি অস্থির হয়ে আছো। এমনিতে ঘুম না আসলে একটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে নাও। ঘুমের ট্যাবলেট আছে তোমাদের কাছে?
বলতে পারি না!
চলো, খুঁজে দিচ্ছি।
পিতার সাথে পুত্র শয্যাকক্ষে ঢুকতেই নাফিসা তরফদার চিৎ হয়ে ওদের দিকে তাকালে বিজয় বললো, বাবার ঘুম আসছে না। ঘুমের ঔষধ খুঁজতে এসেছি মা।
রহস্যময় হাসি ধরে নাফিসা তরফদার বললেন, তুই নিজ বেডরুমে যা। তোর বাবার ঘুমের ঔষধ আছে আমার কাছে!
বিজয় কিছু না বলে বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে। নাফিসা তরফদার বিছানা থেকে নেমে দরজার ছিটকিনি আটকে স্বামীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, আমার কাছে তোমার ঘুমের ঔষধ আছে না?
খালেদ চৌধুরী তোতলিয়ে বললেন, আ-আছে তো!
নাফিসা তরফদার খালেদ চৌধুরীর একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকলেন বিছানার দিকে।
আধাঘণ্টা পরে দিগম্বর নাফিসা তরফদার ঢুকলেন ওয়াশরুমে। দুই মিনিট পরে বারোটা বাজার সতর্ক সংকেত বাজলো। অর্থাৎ শুরু হলো আরেকটা দিনের, এই পরিবারের জন্য একটি বিশেষ দিনের। নাফিসা তরফদার ঝর্ণা অন করতে যাবেন তখন ম্যাসেজ টোন শুনতে পেয়ে মনে মনে বললেন: এসময় কে এসএমএস পাঠালো? নাফিসা তরফদার ঠোঁট উল্টে স্নান সমাপনে মনযোগ দিলেন। পাক গোসল করতে একটু সময় লাগে বৈকি! শরীরের সর্বত্র সাবান মাখাতে হয় যত্নের সাথে! তো নাফিসা তরফদার পনেরো মিনিট সময় নিয়ে গোসল সেরে গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে শয্যাকক্ষে ঢুকে দেখতে পেলেন স্বামী প্রবর গোসল না করেই নাক ঢেকে ঘুমাচ্ছেন! মুখ টিপে হেসে আলমারির দিকে যাবার সময় মনে পড়লো এসএমএস-এর কথা। নাফিসা ঘুরে এগিয়ে গেলেন খাটের দিকে। খাটের পাশে পার্শ্বটেবিলে মোবাইল ফোনটা রাখা আছে। একটি অচেনা নম্বর থেকে এসেছে এসএমএসটা: Congests for successful 50th anniversary! ভ্রু কুচকে নাফিসা তরফদার ভাবছেন: কে? আজ আমাদের এনিভারসারি জানলো কিভাবে? সবার আগে ঠিক বারোটায় উইস করে এসএমএস পাঠালো! ওদিকে আমার স্বামী প্রবর নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন! থ্যাঙ্ক ইউ জানাবো? না থাক!
নাফিসা তরফদার মোবাইল ফোনটা রেখে এগিয়ে গেলেন ওয়ারড্রবের দিকে। স্লিপিং স্যুট পরে হাই তুলতে তুলতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বিছানায়। আরেকবার হাই তুলেই মুদে নিলেন চোখ। সকালে ঘুম ভাংলো খালেদ চৌধুরীর ডাকে। দেয়ালে তাকিয়ে দেখতে পেলেন ঘড়ির কাঁটা আটটার ঘর ছাড়িয়ে গেছে। ফের হাই তুলে চোখ মুদতে গেলে খালেদ চৌধুরী বললেন, হ্যাপি এনিভার্সারি! আমি অফিসে গেলাম।
আরেকবার হাই তুলে নাফিসা বললেন, অফিসে যাচ্ছো মানে? তুমি না আজ ছুটি নিয়েছো?
সরি! ভুলেই গিয়েছিলাম!
নাক ডেকে ঘুমালে কি কিছু মনে থাকবে? ঠিক রাত বারোটায় অচেনা লোক আমাকে উইস করলো; কিন্তু তুমি পারলে না!
তখন মোবাইল ফোন থেকে এসএমএস আসার টোন শোনা গেলে হাত বাড়িয়ে মোবাইল ফোনটা তুলে নিলেন নাফিসা তরফদার। খালেদ চৌধুরী হলেন কক্ষান্তর। এসএমএসটা এরকম: ঘুম তো ভাংলো! এবার ফ্রেশ হয়ে পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা কবিতা লিখে ফেলুন না!
যেনো মুখোমুখি বসে কথা বলছেন এমনভাবে বললেন নাফিসা তরফদার, কবিতা লিখবো আমি! জীবনে পাঠ্য বইয়ের বাইরে কোনো কবিতা পড়ি নি!
যেনো এসএমএস প্রেরণকারি ওঁর কথা শুনে জবাব দিচ্ছে এমনভাবে এসএমএস পাঠালো: চেষ্টা করে দেখুন না! মানুষের অসাধ্য কিছু না! দুই লাইনের একটা কবিতা লিখবেন। গদ্য কবিতা। সময় এক ঘণ্টা। টাইম স্টার্ট নাও! তখন বিজয়ের ছোট বোন নন্দিতার ডাক শোনা গেলো, মাম্মি, আমরা তোমার জন্য ডাইনিং টেবিলে অপেক্ষা করছি। আসছি! বলে মোবাইল ফোনটা রেখে এগিয়ে গেলেন ডাইনিং স্পেসের দিকে নাফিসা তরফদার। দুই সন্তান ও স্বামী পাতে নাস্তা উঠিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছে। নাফিসা চেয়ারে বসতেই ওরা শুরু করলো খাওয়া। নাফিসা পাতে রুটি ও ভাজি নিয়ে ভুলে গেলেন মুখে তুলতে। ওঁর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কবিতার শব্দরাশি!
মাকে খেতে না দেখে নন্দিতা বললো, মাম্মি, খাওয়া বাদ দিয়া কী ভাবছো?
খালেদ চৌধুরী টিটকারি কেটে বললেন, তোদের মাম্মি কবি হয়ে গেছে মনে হচ্ছে!
নাফিসা তরফদার চমকে খালেদ চৌধুরীর দিকে তাকালেও কিছু বললেন না। ভাজি নিয়ে এক টুকরো রুটি মুখে ঢুকিয়ে না চিবিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, গাছের পাতা যতই সবুজ থাকুক, ধীরে ধীরে হলুদ হয়ে এক সময় ঝরে পড়ে।
এক টুকরো ডিমের ওমলেট মুখে পুড়ে নন্দিতা বললো, এটা কি তোমার কথা, নাকি কোনো কবির?
আমার হলে কেমন হয়?
খাবার চিবুতে চিবুতে বিজয় ও নন্দিতা হাততালি দিলো। আর খালেদ চৌধুরী মুচকি হেসে দ্রুত খাবার চিবুতে লাগলেন। এরপর চলতে থাকলো ভাইবোনের কথোপকথন মার কবিতা নিয়ে।
নাস্তা সেরে কফির কাপ নিয়ে নিজ কক্ষে চলে এলেন নাফিসা তরফদার। মূলত লাইন দুটো লিখে ফেলার জন্যই চলে এসেছেন। কফির কাপটা টেবিলে রেখে মোবাইল ফোনটা হাতে নিতেই ম্যাসেজ টোন এলো। ঐ অদেখা লোকের ম্যাসেজ!
নাস্তা খাওয়ার সময় নিশ্চয়ই চলে এসেছিলো ভাব? লিখেছেন লাইন দুটো?
নাফিসা তরফদার আগের মতোই বলে ফেললেন, লিখি নাই!
টেক্সট করে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন এক্ষুণি!
তখনই এসএমএস করে লাইন দুটো পাঠিয়ে দিলেন নাফিসা তরফদার। তখন সিগারেট টানতে টানতে কক্ষে ঢুকলেন খালেদ চৌধুরী। বিছানায় উঠে স্ত্রীর পাশে আধশোয়া হয়ে সিগারেটে একটা লম্বা দম দিয়ে নাকেমুখে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, আমাদের ফিফটিন্থ এনিভার্সারি উপলক্ষে ছেলেমেয়েরা বিরাট আয়োজন করছে! নাফিসা তরফদার মোবাইল ফোনটা টেবিলে রেখে বললেন, জানি!
আমিও তোমাকে রাতে একটা সারপ্রাইজ দেবো।
কী সেটা?
এখন বললে সেটা সারপ্রাইজ থাকে কিভাবে?
ও! ছেলেমেয়েদের ঠেলায় সারাদিন ব্যস্ততায় কাটলেও নাফিসা তরফদারের মনটা পড়ে থাকলো এসএমএস পাবার প্রত্যাশায়। দুটো লাইন আসলেও কি কোন কবিতা হয়েছে কিনা, এর প্রত্যয়ন ঐ রহস্যময় এসএমএস-দাতার নিকট থেকে পাওয়া দরকার। আচ্ছা, লোকটা পুরুষ না মহিলা? পরক্ষণে ভাবলেন: মহিলা হয়ে এরকমভাবে উইস করে কবিতা লিখতে বলবে কেনো! সারাদিন কোন এসএমএস না আসায় বেশ হতাশ হয়ে সন্ধ্যার পরে বিউটি পার্লারে যাবার সিদ্ধান্তঃ নিলেন। পঞ্চাশতম বিয়ে বার্ষিকীতে একটু বিশেষ সাজগোজ করা দরকার! বুড়োত্বের ছাপ পড়তে থাকবে আরো। ছেলেমেয়ে দুটো তরতর করে বাড়ছে। বিশেষ করে মেয়েটা। আগের যমানা থাকলে এতোদিনে বিয়ে হয়ে কয়েক বাচ্চার মা হয়ে যেতো নন্দিতা। তখন মোবাইল ফোনে অচেনা নম্বর থেকে একটা কল এলো। নাফিসা অচেনা নম্বরের কল ধরে থাকেন। ওর তো কোন ক্ষতি হয় না! রং নম্বর হলে সরি! বলে কেটে দেন। কলটা গ্রহণ করে মোবাইল ফোনটা কানে ঠেকাতেই ওদিকের কবিতা আবৃত্তির সুর শোনে শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো নাফিসার। এতো মধুর কণ্ঠ! আর এতো চমৎকার কবিতা আবৃত্তি এর আগে কখনো শোনেন নি! দুটো লাইন বারবার আবৃত্তি করে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে: লাইন দুটো কোথায় যেনো শুনেছেন। তখন ওঁর মনে পড়লো: এ দুটো লাইন ওর-ই!
মন ভরে শোনার জন্য নিরিবিলি দরকার। একটু পরে মেয়েটা ওকে ডাকতে আসবে। স্বামী তো কক্ষে ঢুকেই আধশোয়া হয়ে শুয়ে থাকে বিছানায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা! ছেলেও আসতে পারে। সুনসান নিরবতা দরকার ওঁর। মোবাইল ফোন কানে জোরে চেপে ধরে উঠে এলেন ছাদে। ছাদে বেশ আলো-আঁধার অবস্থা এবং নিরিবিলিও। হঠাৎ আবৃত্তি থেমে মধুমাখা পুরুষ কণ্ঠটা বললো, আবৃত্তি কেমন হয়েছে বলবেন কী?
নাফিসা তরফদার ভুলে গেলেন কয়েক ঘণ্টার এসএমএস-এর মাধ্যমে পরিচয় লোকটার সাথে, যার নাম এখনো অজানা। অভিমানাহত কণ্ঠে নাফিসা বললেন, সারাদিন আপনার খবর নেই! কবিতাটা আমার হলো কী হলো না জানাবেন তো!
সরি! আপনার কবিতাটা এত্তো ভালো হয়েছে যে আবৃত্তি চর্চায় লেগে গেলো এই সময়টুকু। এবার বলেন কেমন হয়েছে আবৃত্তি।
অপূর্ব! আমি বিমোহিত আবৃত্তি শোনে। তাছাড়া আপনার কণ্ঠের মধুরতা কোকিলকেও হার মানায়।
লোকটি প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললো, আপনি কি ব্যস্ত?
পার্লারে যেতে চেয়েছিলাম।
আপনি পার্লারে যাবেন কেনো! আপনি এমনিতেই অনেক অনেক সুন্দর! মুখে রং মাখালে আপনাকে সঙ-এর লাগবে! তখন আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে যাবে।
আপনি কি আমাকে দেখেছেন কখনো?
না দেখে না জেনে আপনাকে বিয়ের পঞ্চাশ বছরের প্রথম সেকেন্ডে উইশ করলাম কিভাবে!
তাইতো! কয়েক সেকেন্ড নিরবতা।
লোকটি জিজ্ঞেস করলো, কী করছেন?
ছাদে দাঁড়িয়ে আপনার আবৃত্তি শুনছিলাম। এখন প্রশ্বাস নিচ্ছি, নিঃশ্বাস ফেলছি!
খুব ভালো কাজ! আমি মাঝে মাঝে ভুলে যাচ্ছি প্রশ্বাস নেয়া!
কেনো? আপনার সাথে এতক্ষণ ধরে কথা বলছি এই আনন্দে!
ও। কী ঠিক করলেন?
কোন বিষয়ে?
পার্লারে যাবার বিষয়ে!
যাচ্ছি না!
থ্যাঙ্ক ইউ! পার্টি করছেন একটা রেস্টুরেণ্টে। ঠিক?
ঠিক। সময়টা আনন্দে কাঠুক আপনার। পার্টি থেকে ফিরে এলে ফের আমি কল দেবো।
আমি আপনার কলের অপেক্ষায় থাকবো।
লাইন কেটে যেতেই ছেলেমেয়ে দু’জনেই এলো ছাদে।
নন্দিতা বললো, কী মাম্মি! তুমি ছাদে কী করছো? পার্লারে যাবে না?
নাফিসা তরফদার বললেন, না রে! বাসায় সেজে নিলেই হবে!
বেশ! চলো নিচে। আটটার মধ্যে বের হতে হবে।
আটটার মধ্যে বের হতে পারে নি ওরা। সোয়া আটটায় বের হয়ে চলে গেলো এক রুফটপ রেস্টুরেণ্টে। বেশ আনন্দ হলো; মূলতঃ কেক কেটে বার্ষিকী উদযাপনের পরে বাফেট ডিনার হলো। বাসায় ফিরতে ফিরতে বেজে গেলো রাত এগারোটা। গাড়ি থেকে নামতেই প্রহরি একটি বড় ফুলের তোড়া ও একটা বাঁধানো শো-পিস দিয়ে বললো যে একটা লোক দিয়ে গেছে। শোপিসটা নাফিসা তরফদারের কবিতার দুই লাইন ছাপিয়ে বাঁধানো হয়েছে।
নন্দিতা শো-পিসটা হাতে নিয়ে বললো, তুমি কখন বাঁধাই করতে দিলে মাম্মি?
নাফিসা তরফদার রহস্যময় হাসলেও কোনো জবাব না দিয়ে ঢুকলেন ভেতরে। দুই ছেলেমেয়ে মা-বাবার বেডরুমকে বাসরশয্যায় রূপ দিয়েছে। সবকিছু গোছগাছ করতে করতে রাত বারোটা বেজে গেলো নাফিসা তরফদারের। বাসরঘর তথা শয্যাকক্ষে ঢুকতে যাবেন তখন এসএমএস এলো রহস্যময় লোকটার: জানি বাসরের মুডে আছো! আজ রাত বিরত থাকার অনুরোধ জানাচ্ছি!
চমকে উঠলেও এসএমএস পাঠালেন নাফিসা তরফদার: কিভাবে সম্ভব?
ঘুমের ঔষধ হতে পারে!
তখন নাফিসা তরফদারের মনে পড়লো পুরনো ছায়াছবিতে নববধূ দুধের গ্লাস নিয়ে বাসরঘরে ঢুকতো! উত্তেজনাকে সংযত করতে সক্ষম হলেও হাতের কাঁপুনি থামাতে পারলেন না নাফিসা।
স্ত্রীর দুধের গ্লাসধরা হাতটা মৃদু কাঁপতে দেখে খালেদ চৌধুরী বললেন, বাহ! নববধূর মতোই লাগছে তোমাকে দুধের গ্লাস নিয়ে আসায়। কিন্তু তোমার হাত কাঁপছে কেনো ?
উত্তেজনায়! খালেদ চৌধুরী স্ত্রীকে একবার চোখ টিপে গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে পান করছেন। নাফিসা তাকিয়ে আছেন স্বামীর দিকে এক দৃষ্টে। মনে দ্বিধা: কাজ হবে? কতটুকু কাজ হবে?
খালেদ চৌধুরী একবারেই পুরোটা দুধ পান করে গ্লাসটা টেবিলে রেখে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে ফেলে দিলেন বিছানায়। অন্যসময় হয়তোবা বাঁধা দিতেন, কিংবা সক্রীয় হতেন। এখন তিনি হতভম্ব হয়ে আছেন। খালেদ চৌধুরীর হা-পা থেমে নেই নাফিসা তরফদারের শরীরে! কিন্তু ঠোঁটটা নাফিসার ঠোঁটে লাগার সাথে সাথে গা এলিয়ে পড়ে গেলেন একদিকে।
নাফিসা তরফদার স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে বসে মোবাইল ফোনটা নিয়ে এসএমএস পাঠালেন: কাজ হয়েছে! এখন কী করতে হবে?
উত্তর এলো: নিশ্চিন্তে ঘুম দাও! তুমি সকালে হাঁটো। তাই আগামীকাল ভোর পাঁচটায় চলে আসবে চন্দ্রিমা উদ্যানে। তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা হবে। ঘুমুতে যাবার আগে তোমার সাথে আমার কথোপকথনের এসএমএসগুলো ডিলিট করে দিয়ো! শুভরাত্রি!

ভোর পাঁচটায় বের হবার সময় খালেদ চৌধুরীকে ঘুমে রেখে এলেন নাফিসা তরফদার। চন্দ্রিমা উদ্যানে লোকটাকে দেখে বিস্মিত হলেও খুশি হলেন খুউব! স্পষ্টতই বুঝা যায় বয়স ওর চেয়ে অনেক কম! কথা বলতে বলতে কখন আটটা বেজে গেলো বুঝতেই পারলো না ওরা। নন্দিতার ফোন এলে চমকে উঠলেন নাফিসা। রহস্যময় লোকের হাত ছেড়ে দিয়ে ছুটে এলেন বাড়িতে। ডাক্তার চলে এসেছে। অতিরিক্ত ঘুমের ঔষধ খাওয়ায় খালেদ চৌধুরী মারা গেছেন শুনে পরিবারের সবাই হয়ে গেলেন স্তম্ভিত। খালেদ চৌধুরীর বালিশের নিচ থেকে বিমানের দুটো টিকিট পাওয়া গেলো ঢাকা টু চায়নার।

অতলান্তে অন্তঃস্রোত প্রেমের গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!