কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » রহস্যগল্প » ভ্রমর

ভ্রমর

ভ্রমর রহস্যগল্প – সৌভিক দাস

আমি সৌভিক, এখন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এর জাপানিজ বিভাগের প্রথম বর্ষে পাঠরত। বাবা পুলিশে থাকার সূত্রে থানায় আনাগোনা আমার লেগেই থাকত। এরকমই একদিন থানায় বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ নজর যায় কনস্টেবল অরিন্দম বাবুর দিকে, রবি দা কে নিয়ে আসছেন থানায়।রবি দা আমাদের গ্রামের ই দাদা, কিছুদিন আগেই বাবা কে হারিয়েছে। রবিদার বাবা ও তিন্নি দির বাবা একটা যৌথ ব্যাবসা করতেন, ব্যাবসায় ক্ষতি ও অনেক ধারদেনার কারণে রবিদার বাবা আত্মহত্যা করেন। এই ঘটনার এক সপ্তাহ পর জানা যায়, তিন্নি দির বাবার বিশ্বাসঘতকতাই ওদের ব্যাবসায় ক্ষতির মূল কারণ। এরপর সে তো দক্ষযজ্ঞ ব্যাপার দুই পরিবারের, এমনকি মা হারা তিন্নি দির বাবাকে খুন করার হুমকিও দেয় রবি দা। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সমাপ্ত হয় রবি দা আর তিন্নি দির ভালোবাসার সম্পর্ক। হ্যা, রবি দা আর তিন্নি দি ভালোবাসতো দুজন দুজনকে।
পাপী পেটের দায়ে এরপর রবিদা তার M.Sc ছেড়ে ট্যাক্সি ড্রাইভার হিসাবে কাজ শুরু করে,সে ঘটনা ২ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু আজ কেনো রবিদা কে থানায় নিয়ে এলো সেটার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতে লাগলাম, জানতে পারলাম তিন্নি দির বাবাকে কেও খুন করেছে আর পুলিশের সন্দেহের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে রবিদার নাম। কারণ টা তো বললাম, খুনের হুমকি দিয়েছিলো রবি দা। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করলো বাবারা সকলে মিলে, কিন্তু সন্দেহের কিছু না পাওয়ায় ছেড়ে দিলো রবিদা কে। পরে জানতে পারলাম যে তিন্নি দি নিজে বলেছে যে রবিদা তার বাবার খুন করেনি,এটাই আমার কৌতুহল অনেকগুণ বাড়িয়ে দিলো। যে কিনা ২ বছর আগে তার বাবাকে খুন করার হুমকি দেয়, দিদি তাকে একদম সন্দেহের বাইরে কি করে রাখছে? সামনে আমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা থাকায় এটার দিকে আর বেশি মন না দিয়ে পড়াশোনায় মন দিলাম।
আমাদের গ্রামে খুন হওয়ায় ইনভেস্টিগশনের লিড পেয়েছিল আমার বাবা, এটাই বাবার প্রথম কাজ ছিল লিডার হিসাবে। কোথায় ২ দিনে খুনি কে পাকড়াও করে বাবা প্রমোশনের ভাগীদার হবে, সেটা না হয়ে দিন দিন কেস এর জটিলতা বেড়েই চললো। ঋষি বাবুর অর্থাৎ তিন্নি দির বাবার বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছুই পাওয়া গেল না। কোনো প্রমাণের অভাবে ঋষিবাবুর খুনের ঘটনা টা ধামাচাপা পরে গেলো। কিছুদিন বাবা মনমরা হয়ে ছিল ঠিকই, তবে আস্তে আস্তে বাবাও ভুলে গেলো বিষয় টা।
উচচমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ, এমনকি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এ ভর্তির জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষা CUET ও দেওয়া হয়ে গেছে ; ফাঁকাই বসে আছি আর অপেক্ষা করছি ফল প্রকাশ এর। কোনো কাজ নেই তাই একদিন ভরদুপুরে বাবার অনুপস্থিতি তে বাবার কেস ফাইল গুলো ঘেঁটে ঘেঁটে দেখছিলাম। হঠাৎ চোখের সামনে ঋষি বাবুর কেস টা পেলাম। Unsolved Case লেখা টা চোখে পড়ার সাথে তিন্নি দির বয়ান টাও চোখে পড়লো। এটার জন্যই তো এই কেস টাই কৌতুহল জন্মে ছিল। নিজের বাবাকে যে খুনের হুমকি দেয় তাকে কিভাবে সন্দেহের তালিকার বাইরে রাখতে পারে কেউ? বয়ানে লেখা “বাবা একদিন রবির ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরেছিলেন; ওনার গাড়ি বিকল হওয়ার কারণে, আমার বিশ্বাস যে মারার হলে রবি সেইদিন ই মারতে পারতো।তাই আপাতত সন্দেহের বাইরে রবি।” বয়ান টা দেখে ফাইল টা রেখে দিলাম আর ভাবতে বসলাম যে খুন টা করলোই বা কে আর খুন হলোই বা কীকরে? বাবার মুখে শুনেছি ঋষিবাবুর খুনের রাতে তিনি গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফেরেন, তারপর খাওয়াদাওয়া করে বিছানায় ঘুমান। পরেরদিন আর চোখ খোলেন নি। অনেক কিছু ঘুরপাক খেতে লাগলো মাথায়। নিজের মতো বিভিন্ন ভাবে সাজিয়ে মেলাতে লাগলাম খুনের উদ্দেশ্য। সারাদিন বিভিন্ন চিন্তা করে যখন অসহ্য হয়ে উঠলো ভাবনা গুলো; তখনই সব ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটিয়ে হঠাৎ খুব জোড়ে কাশি হতে লাগলো, দেখলাম মা সন্ধ্যে দিচ্ছে। একটুপর হঠাৎ করেই মাথায় কয়েকটা চিন্তা খেলে গেলো।ফোন টা হতে নিয়ে একবার গুগল করলাম, আস্তে আস্তে সব জট খুলতে লাগল। রাতে বাবা বাড়ি ফেরার পর বাবাকে বললাম যে কাল তোমার সাথে একবার তিন্নি দির বাড়ি যাবো , মনে হয় তোমার খুনিদের আমি ধরতে পেরেছি। বাবা শুনে হকচকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী জানতে পেরেছিস ? আমি বললাম কাল ওখানেই সব বলব;আজকে ঘুমিয়ে পরো।
পরদিন সকালে আমি আর বাবা তৈরি হয়ে নিলাম, বাবা আরো ৩ জন কনস্টেবল কে সাথে নিয়েছিল তিন্নি দির বাড়ি যাওয়ার জন্য। যাওয়ার সময় বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম তিন্নি দিদি দের গাড়ি টার ভালোভাবে তল্লাশি নিয়েছিল নাকি? পাশে বসে থাকা কনস্টেবল কাকু বলল খুব ভালো ভাবে তল্লাশি করেও কিছু পায়নি। সেদিন তল্লাশি করার পর নাকি কাকুর খুব শরীর খারাপ করেছিল, কাশি সাথে আমাশয়। ব্যাপার টা আরো পরিষ্কার হয়ে গেলো আমার কাছে। পৌঁছালাম তিন্নি দিদির বাড়ি, সাথে বাবাকে বললাম রবি দা কেও ডাকতে। ১০ মিনিটে পৌঁছে গেলো রবিদাও। এবার আমি বলা শুরু করলাম,” আচ্ছা তিন্নি দি, তুমি বয়ানে বলেছিলে , তোমার বাবার গাড়ি খারাপ হয়ে গেছিলো। আচ্ছা গাড়ি টা সারাই কোথায় করিয়েছিলেন?”” উজ্জ্বলের গ্যারেজ এই করেছিল”, তিন্নি দি বলল। আমিও জানতাম এটা কারণ এই তল্লাটে ওই একটাই গ্যারেজ। সবাই ওখানেই গাড়ি সারাই করে। আর গ্যারেজ এ মাত্র 2 জন কর্মচারী, তার মধ্যে একজন রবি দা; আর একজন অশিক্ষিত , পেটের দায়ে এই লাইনে এসে পড়েছে। রবিদার দিকে ঘুরে বললাম,” আচ্ছা রবি দা, রিসিন কি জানো?” এই কথা শোনা মাত্রই রবি দৌড় দিলো, যদিও তেমন সুবিধা করতে পারলো না, কনেস্টবল কাকুরা পাকড়াও করে নিয়ে এলো। আমি আবার বলতে লাগলাম,”ricin এমন এক বিষ যা মানুষের নিশ্বাস প্রশ্বাস এর মাধ্যমে গেলে মানুষকে অসুস্থ করে দেয়;আর বেশি পরিমাণে দিলে আর দেখে কে, মানুষের মৃত্যু অবধারিত। আর এই ricin এর সবথেকে ভালো গুন হলো এটা ট্রেস করা যায় না। অর্থাৎ পোস্টমর্টেম এ এর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। ঋষিবাবুর গাড়ি সারানোর সময় রবিদা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে গাড়ির ফ্রেগনান্স লিকুইডে এই ricin মিশিয়ে দেয়। ricin এর আরো এক ধর্ম হচ্ছে এটা স্লো পয়জন। মানুষের ভিতরে যাওয়ার ২-৩ দিন পর মানুষের মৃত্যু হয়। তার আগে অবধি মানুষটি কিছু বুঝতে পারে না।” আর এতসব কিছু একজন অশিক্ষিত লোক নিশ্চয় জানবে না। তারপর রবিদা M.Sc Botany। তার পক্ষে ricin এর সমন্ধে জানা অসম্ভব কিছু না আর খুন করার যথেষ্ট কারণ ও আছে। নিজের গাড়িতে খুন করলে রবিদা সেদিনই ধরা পড়ে যেত; তাই সেদিন ছেড়ে দিয়েছিলো ঋষি বাবুকে। কিন্তু সবথেকে বড় বিষয় যেটা আমিও জানি না তিন্নি দি,” তুমি কেনো নিজের বাবার হত্যায় সাহায্য করলে? সবাইকে বলো একটু।” তিন্নি দি কাদতেঁ শুরু করলো, সাথে বলতে আরম্ভ করলো,” ছোটবেলায় আমার মা মারা যাওয়ার পর বাবা ই আমাকে মানুষ করে। আমি বাবাকে খুব ভালো ভাবতাম। কিছুদিন আগে জানতে পারি, মা এর মৃত্যুর কারণ আমার বাবা। বাবা এক মহিলার ফাঁদে পরে মা কে হত্যা করে। এই রাগেই আমি বাবা কে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করি আর সাথে নি রবি কে। রবির কাছে আমার বাবাকে মারার যথেষ্ট কারণ ছিল। তাই ২জন মিলে বাবা কে হত্যা করি।” এইটুকু বলেই তিন্নি দি কাঁদতে লাগল। কনস্টেবল কাকুরা ওদের ২জন কে নিয়ে গেলো থানায়।
বাবা এরপর আমাকে জিজ্ঞেস করলো,” তুই কীকরে জানলি যে ricin গাড়িতেই আছে?” আমি বললাম,”ricin বাড়িতে রাখা থাকলে তোমাদের সকলের শরীর খারাপ করতো। ricin নাকে গেলেই তার কাশি,আমাশয় এগুলো হয়। তোমার যেহেতু কিছুই হয়নি এরকম আর গাড়ি চেক করেছিল ওই কাকুটার এই লক্ষণ দেখা গেছে ;তাই বুঝে গেলাম ricin গাড়িতেই ছিল।” আর তিন্নিও যে এই খুনের সাথে যুক্ত সেটা কিভাবে জানলি? “ricin সব জায়গায় পাওয়া যায় না বাবা। বেশিরভাগ কেমিক্যাল স্টোরেই পাওয়া যায়, তাও যে নেয় তার নাম ঠিকানা সব নোট করে রাখা হয়। আর এই তল্লাটে এইরকম দোকান কেবল সৌরিশ-এর বাবার আছে। তাই কাল সৌরিশ কে ফোন করে জানতে পারি যে ricin টা তিন্নি দি কিনেছিল। সেখান থেকেই বুঝতে পারি যে তিন্নি দি ও যুক্ত।” আর এই কেসে মায়ের ও অবদান রয়েছে। মায়ের ওইদিন ধূপের গন্ধে যদি কাশি না পেত তাহলে আজও এই রহস্য সমাধান হতো না।
“ভ্রমর হুল ও ফোঁটালো আবার নিজেও মরলো।”

ভ্রমর রহস্যগল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!