কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » রহস্যগল্প » দংশনে নীলকণ্ঠ

দংশনে নীলকণ্ঠ

দংশনে নীলকণ্ঠ রহস্য্ গল্প -শান্তনু দাশ

“দিদি একটা চিঠি আছে।”

  দরজা খুলতেই পিয়ন লোকটি গৃহকত্রীকে একগাল হেসে বলে ওঠে। কত্রী চিঠি নিয়ে পিয়নকে সই ক’রে দিয়ে খামটা দেখতেই দ্যাখে, যে পাঠিয়েছে তাঁর নাম নেই আছে শুধু ঠিকানা। ঠিকানাটা দেখেই কত্রীর মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে। শত রাগ যেত গোলাপি ঠোঁট দুটোয় এসে ধরা দেয়।

          “দিদি খুব জল তেষ্টা পেয়েছে।”পিয়ন কথাটা বলতেই কত্রী সামান্য মাথা নেড়ে রান্নাঘরে যায় জল আনতে।

    জল খেয়ে পিয়ন চলে যেতে কত্রী খামের মাথাটা একটানে ছিঁড়ে ভিতরের চিঠি বের করে অবাক হয়ে। কোনো চিঠি না; কেবল তিনটে সাদা এ-ফোর পৃষ্ঠা।

একঃ_________

             ব্রাঞ্চের অফিসরুমের বড়ো কাঠের টেবিলের এককোণায় ব’সে অম্বর বার বার টেলিফোনের রিসিভারটা কানে তুলে একটা নম্বর ডায়াল করছে আর কয়েক সেগেন্ড পরই রিসিভারটা নামিয়ে রাখছে। মুখে চিন্তামিশ্রিত বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠেছে। দেওয়ালে টাঙানো সাদারঙের ওয়ালক্লকের মিনিটের কাঁটাটা ছ’য়ের ঘরে আর ঘণ্টার কাঁটাটা দশ ও এগারোর ঠিক মাঝখানে। সেকেন্ডের কাঁটাটা আপনমনে ‘টিক-টিক’শব্দে নিজের গতিতে ঘুরে চলেছে।

   একটা হলুদরঙের কভারফাইল হাতে নিয়ে দেশাই, অফিসরুমে ঢুকে, অম্বরকে দেখেই বেশ অবাক হয়ে তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা ক’রে ওঠে, “কীরে ? ব্রাঞ্চে আসার পর থেকে দেখছি খুব টেনশন করছিস! কিছু হয়েছে?”

          “না।”অম্বর ছোট্ট ক’রে গম্ভীরস্বরে উত্তর দেয়।

   দেশাই আর কোনোরকম কথা না ব’লে, হাতের ফাইলটা অন্য টেবিলের উপর রেখে একজন মাঝবয়সী কনস্টেবলের সাথে ফাইল সংক্রান্ত কিছু ব’লে চলে। অম্বর প্রায় মিনিটতিনেক কপালে ভাঁজ কেটে বসে থেকে আবার ফোনের রিসিভারটা তুলে নিয়ে নম্বর ডায়াল করে এবং যথারীতি বিরক্তির সাথে রিসিভারটা নামিয়ে রাখে।

         বেলা সাড়ে-এগারোটায় নিনাদ, টীম নিয়ে রাউন্ড দিয়ে ব্রাঞ্চে উপস্থিত হয়। জিপের দরজা খুলে গ্রাউন্ডে নেমে ব্রাঞ্চের ভিতরে ঢুকতে যাবে এমন সময় ব্রাঞ্চের ছাদে তাঁর চোখ পড়ে। অম্বর ছাদের একধারে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে আর ভুড়ভুড়িয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। নিনাদ ব্রাঞ্চের ভিতরে প্রবেশ করে, সিঁড়ি পেরিয়ে ছাদে আসতেই অম্বর আড়চোখে নিনাদের দিকে তাকায়।

          “কী ব্যাপার বলতো?”নিনাদ বেশ গম্ভীরস্বরে জিজ্ঞাসা ক’রে ওঠে। “কারোর সাথে কথা বলছিস না, সকালে রাউন্ড দিতে গেলি না আর এখন সিগারেট টেনে চলেছিস। কী হয়েছে?”

          “তিনদিন থেকে কাকাকে টেলিফোন করছি কিন্তু পাচ্ছি না।”সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে নিয়ে অম্বর উত্তর দেয়।

          “পাচ্ছি না মানে ?”

          “দুইদিন ধরে বাড়ির ফোন থেকে, পি.সি.ও. থেকে, ব্রাঞ্চের ফোন থেকে ফোন করেই যাচ্ছি, রিংও হচ্ছে না, এঙ্গেজও বলছে না। শুধু ‘পিপ-পিপ’ করছে।”

       কথাটা শুনে নিনাদ বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা ক’রে ওঠে,“পরেরমাসে তোর কাকার বড়ছেলের বিয়ে না ?”

          “বিয়ের কথা চলছে। বিয়ের তারিখ ঠিক হয়নি।”

     বলা প্রয়োজন, অম্বরের পৈতৃকবাড়ি নিশ্চিন্তপুরে। অম্বরের বাবারা দুইভাই। বড়জনের নাম মানে, অম্বরের বাবা হলেন অজয়নারায়ণ সরকার এবং ছোটজন অমরকান্ত সরকার। অম্বরের বয়স যখন সাত বছর বয়েস তখন তাঁর বাবা হঠাৎই হার্ট-অ্যাটাকে মারা যান। অম্বরের মা, সুমিত্রা দেবী এই আঘাত সহ্য করতে না পেরে সেই শোকে বছরদুয়েকের মধ্যে তিনিও মারা যান। সেই থেকে পিতৃমাতৃহীন অম্বরকে মানুষ করেছেন তাঁর এই কাকা অমরকান্ত ও এনার স্ত্রী বসুধা দেবী। এনাদের দুইছেলে। বড়ছেলে অনীশ, পানাগড় কলেজে রসায়ন বিভাগে কর্মরত এবং ছোটছেলে অদৃশ; এগ্রিকালচার নিয়ে পড়াশুনা ক’রে গ্রামের কৃষিউন্নয়নের কাজ করছে। দুই ভাইই বিবাহিত কিন্তু বড়ভাইয়ের বৈবাহিক সম্পর্কটা বেশ গলদের। সেটাতে পরে আসবো। আপাতত ছোট-ভাইয়ের বউ রোহিণী, বর্তমানে ‘সরকার’-পরিবারের এক ও অদ্বিতীয়া পুত্রবধু। পুলিশবিভাগের সিনিয়ার-ইনস্পেক্টর পদে কাজ পাওয়ার পর অম্বর নৈহাটিতে এসে বসবাস শুরু করে এবং মাসে মাসে গ্রামে কাকাকে টাকা পাঠাতে থাকে। যদিও সেটার কোনো প্রয়োজন ছিল না কারণ অম্বরদের আর্থিক অবস্থা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের। এছাড়াও বাড়ির কাজকর্মের জন্য চাকর, কাজেরমহিলা, জমি দেখা শোনার জন্য লোকজন তো আছেই। বলাবাহুল্য গ্রামের মধ্যে ‘সরকার-বাড়ি’-র নাম সকলে একডাকে চেনে।

           অম্বরের কথাটা শুনে নিনাদ ছোট্ট একটা হাসি হেসে নিয়ে জানায়, গ্রামে টেলিফোনের লাইন গণ্ডগোল থাকায় হয়তো অম্বর লাইন পাচ্ছে না। কিন্তু অম্বর যেন কথাটা তেমনভাবে মেনে নিতে পারলো না। চিন্তার থেকে দুশ্চিন্তার ছাপ তাঁর মুখে বারংবার দেখা দিচ্ছে।

                           রাতে বাড়ি ফিরে প্রায় বারো থেকে পনেরোবার গ্রামেরবাড়িতে অম্বর টেলিফোন ক’রে কিন্তু উত্তর সেই আগেরমতই। একবার অম্বরের মনে হল, টেলিফোনের নম্বর হয়তো বদলানো হয়েছে কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হয়, নম্বর বদলানো হলে কি কাকা বা দুইভাইয়েরা তাঁকে জানাবে না? ঘরে পায়চারী করতে করতে, কটা সিগারেট অম্বর টানল তা বলা মুশকিল।

         পরেরদিন ব্রাঞ্চে গিয়ে আবারও একইরকম ঘটনা ঘটতে, নিনাদ, অম্বরকে সঙ্গে ক’রে নিয়ে, ব্রাঞ্চ-ইনচার্জ দামিনীর ঘরে এসে উপস্থিত হয়। দামিনী ডান হাতের দুই আঙুলের ফাঁকে একটা জ্বলন্ত সিগারেট ধরে রেখে টেবিলের উপর থাকা ফাইলটার পাতাটা, কলম ধরা বাঁ-হাতে উল্টে নিয়ে সই করে।

          “কী ব্যাপার? রাউন্ডে না বেরিয়ে শুম্ভ-নিশুম্ভ আমার কাছে কেন ?”দামিনী ফাইলের থেকে চোখ না সরিয়ে হেঁয়ালির সুরে আগত দুইবন্ধুকে জিজ্ঞাসা ক’রে ওঠে।

    নিনাদ, টেবিলের সামনে থাকা চেয়ারটা টেনে নিয়ে তাতে বসে, অম্বরের বাড়ির টেলিফোনের সমস্যার কথা ব’লে চলে। পুরো ঘটনা শুনে নিয়ে দামিনী, সিগারেটে টান দিয়ে নিয়ে সামান্য ধোঁয়া ছেড়ে বলে ওঠে, “চারদিন ফোনের লাইন খারাপ। অম্বর শেষ কথা কবে হয় তোর সাথে?”

    সামান্য চিন্তা ক’রে নিয়ে, “কাকার সাথে কথা হয়েছে দু’হপ্তা আগে। আর–”বলে অম্বর চুপ করে যেতেই দামিনী, জিজ্ঞাসা করে, “আর?”

          “গত শনিবার মানে আটদিন আগে, মাঝরাতে অনীশ টেলিফোন করেছিল।”

          “মাঝরাতে ?”নিনাদ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে।

    অম্বর মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ ’ক’রে নিয়ে বলে, “মাঝারাতে টেলিফোন করে আনতাবড়ি অনেককিছু বলছিল। আর আমি বেশ বকা দিই।”

          “কেন?”

          “একটা কলেজের স্টাফ হয়ে ড্রিংক করেছে। আর তারজন্যই উল্টোপাল্টা বকছিল; দিয়েছি ধমক।”

          “কী বলছিল?”দামিনী জিজ্ঞাসা করে।

    অম্বর কপাল কুঁচকে সামান্য চিন্তা করে নিয়ে বলে, “কথা বলার সময় খুব জড়তা ছিল জিভে। সবটা বুঝতেও পারিনি, তবে ওঁর বিয়ে নিয়ে কিছু একটা বলছিল। আমি ধমক দিয়ে বলি যে সকালে সুস্থ হয়ে আমাকে ফোন করিস কিন্তু তারপর আর করেনি। এদিকে আমারও মাথা থেকে ব্যাপারটা বেরিয়ে গিয়েছিল। গত তরশু ব্রাঞ্চে আসবো, বাইক বের করছি, হঠাৎ অনীশের কথাটা মনে পড়তেই আবার ঘরে ঢুকে টেলিফোন করি। ব্যাস, তারপর থেকে আর উত্তর নেই।”

     পুরোটা শুনে নিয়ে দামিনী চেয়ারে হেলান দিয়ে নিয়ে গম্ভীরস্বরে বলে ওঠে, “তুই আজই গ্রামেরবাড়ি থেকে ঘুরে আয়। দ্যাখ, তীর্থে গেল কিনা বাড়ির লোকজন আর সঙ্গে নিনাদকে নিস।”

   অম্বর মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ ক’রে নিনাদকে সঙ্গে নিয়ে দামিনীর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

       অন্যদিকে মিনিটপাঁচেক পর দেশাই একটা ফাইল নিয়ে ঘরে এসে দামিনীর সামনে খুলতেই দামিনী, সেটাতে একঝলক চোখ ফেলে দাঁত চিপে তেড়ে বলে ওঠে, “সালা স্ত্রৈণ প্রেমিক, যা প্রেমিকার আঁচলের তলায় বসে থাক। রাউন্ড রিপোর্টে এই জঘন্য হাতের লেখা?”

   দেশাই ফ্যালফ্যাল নজরে দামিনীর দিকে তাকিয়ে থাকে।

               প্রথমে ঠিক হয়েছিল, ট্রেনেই দুইবন্ধু নিশ্চিন্তপুর যাত্রা করবে কিন্তু পরে দামিনীর কথামতো তাঁরা পুলিশভ্যান নিয়েই রওনা হয় দুপুর তিন’টে নাগাদ। গাড়ি যখন নিশ্চিন্তপুরে পৌঁছল তখন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেছে। কাঁচা সড়কের উপর দিয়ে ধুলো উড়িয়ে হেডলাইট জ্বেলে গাড়ি এগিয়ে চলেছে ‘সরকার-বাড়ি’-র দিকে।

     সুবিশাল ও সুপ্রসস্থ দোতালা বাড়ির ফটকের কাছে এসে গাড়ি থামতেই, অম্বর আর নিনাদ চমকে যায়। বাড়ি পুরো অন্ধকার।

          “কীরে, দামিনীর কথাই মিলে গেল নাকি ?”নিনাদ জিজ্ঞাসা ক’রে ওঠে। “বাড়ি অন্ধকার, সত্যিই তীর্থে গেল?”

      অম্বর কোনো উত্তর না দিয়ে স্টেয়ারিং সীটের দরজা খুলে বাইরে আসতেই পিছন থেকে, “কে সরকার বাড়ির সামনে ?”একজন বলে ওঠে।

   অম্বর পিছন ফিরে তাকাতেই দেখে, গ্রামের পরিচিত এক প্রৌঢ় নিবাসী; নাম সুধাকর রায়।

          “আরে! অম্বু নাকি?” সুধাকরবাবু বলে ওঠেন।

          “হ্যাঁ জ্যেঠামশাই। আচ্ছা, কাকা, কাকীমা, অনীশ, অমৃশ এঁরা কি কোথাও গেছে?”

          “তা তো জানিনা রে। প্রায় পাঁচদিনের উপরে হয়ে গেল, অমরকে দেখিনি। আমরা তো ভাবছিলাম, সকলে তোর কাছে গেছে।”

    ইতিমধ্যে গাড়ির থেকে নিনাদও নেমে পড়েছে। সুধাকর বাবুর কথাটা শুনে অম্বর সামান্য অবাক হয়ে আবার বাড়ির দিকে তাকায়। সুধাকর বাবু আর কিছুক্ষণ অম্বরের সাথে কথাবার্তা বলে চলে যেতেই, অম্বর আর নিনাদ ফটকের দরজা খুলে নুড়ি বিছানো পথ দিয়ে বাড়ির সদর দরজার দিকে এগিয়ে যায়।

    সদর দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই নিনাদ বাড়ির হ্যাজবোলে হাত দিয়ে বলে ওঠে, “তালা।”

          “আমাকে একবারও কিছু না জানিয়ে গেল কোথায়?”অম্বর বেশ কৌতুহলের সাথে নিজেকে বলে ওঠে।

    হঠাৎ নিনাদ, গন্ধ শোঁকার মতো দুই-তিনবার টেনে নিয়ে জোর গলায় বলে,“অম্বর, ব্যাপার ভালো ঠেকছে না। একটা বিশ্রী গন্ধ বেরোচ্ছে। তালা ভাঙার ব্যবস্থা কর।”

      অম্বর সামান্য মাথা নেড়ে, দৌড়ে ফটকের বাইরের বেরিয়ে এসে গ্রামের দিকে এগিয়ে যায়।

    মিনিটপনেরো পর অম্বর, একটা বছর উনিশের ছেলে সঙ্গে করে নিয়ে সরকার-বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়ায়।

          “পল্টু, তালা কাট।”অম্বর আদেশের ভঙ্গীতে বলে ওঠে।

  কথামতো পল্টু তালা কাটতে শুরু করে। দশমিনিটের মধ্যে তালা কেটে, দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলতেই তিনজনে বিশ্রী দুর্গন্ধে নিজেদের নাক চেপে ধরে।

           “অম্বু-দা, ইঁদুর-টিদুর মরলো নাকি?”পল্টু নাকে দুইহাতে চেপে জিজ্ঞাসা করে ওঠে।

   সদর দরজা পেরিয়ে ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালতেই অম্বর আর নিনাদ চমকে ওঠে আর পল্টু ভয়ে চিৎকার দিতেই প্রতিবেশীরা ছুটে আসে সরকারবাড়ির দিকে। 

দুইঃ_________

      ব্রাঞ্চে নিজের ঘরে দামিনী একমনে একটা ম্যাগ্নিফাইংগ্লাস হাতে ধরে একটা ছবি অনেকক্ষণ সময় নিয়ে পরীক্ষা ক’রে চলেছে। টেবিলের উপরে থাকা চায়ের কাপের থেকে ধোঁয়া যাওয়ার মুখে। অর্থাৎ চা জুড়িয়ে জল। দেশাই হন্তদন্ত হয়ে দামিনীর ঘরের দরজা খুলে ঢুকতেই চোখ না তুলে দামিনী গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা ক’রে ওঠে, “কি ? আমার কথা মিলে গেছে তো?”

    দেশাইয়ের মুখ দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছে না। দামিনী ছবির থেকে মুখ উঠিয়ে তুলে দেশাইয়ের দিকে তাকায়।

          দেশাই মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ করে নিয়ে উত্তরে ব’লে চলে, “মিলে গেছে। এইমাত্র নিনাদ, অম্বরের গ্রামের বাড়ি থেকে টেলিফোন করে জানালো যে, অম্বরের কাকা, কাকীমা আর বড়ভাই অনীশ খুন হয়েছে। ঘরের ভিতরে সিলিং থেকে তাঁদের মৃতদেহ ঝুলছে আর বডি ডিকম্পোজ হতেও শুরু করে দিয়েছে। ফোনের রিসিভারটা ডেক্সের উপর ইচ্ছাকৃত নামানো ছিল। যাতে ভিকটিমদের ব্যাপারে কেউ সন্ধান না পায়।”

            “আর ছোটজন কোথায় ?”দামিনী ঠাণ্ডা চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞাসা করতে দেশাই উত্তরে বলে, “সেটা নিনাদকে আমি জিজ্ঞাসা করিনি। নিনাদ খুব তাড়াতাড়ি জানিয়ে ফোন রেখে দেয়, বোধয় সদর পুলিশস্টেশনে খবর দেবে।”

    দামিনী চেয়ারে হেলান দিয়ে নিয়ে দেশাইয়ের দিকে তাকিয়ে ধীরস্বরে বলে চলে, “উপর থেকে ভালো মনে হলেও ভিতরে পচতে শুরু করে দিয়েছিল সরকার বংশ।”

          “তুই আর নিনাদ একবার অম্বরের দেশের বাড়িতে গিয়েছিলি না? আমি তখন একটা কেসের ব্যাপারে বর্ধমানে। তোর কি তখনই মনে হয়েছিল?”

        দামিনী মুখে না ব’লে মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’করে নিয়ে বলে চলে, “মনে হয়েছিল তার আগেই। কনফার্ম হলাম নিশ্চিন্তপুরে গিয়ে। আমরা গিয়েছিলাম এই অনীশ আর তন্দ্রার ছেলে অঙ্গদের অন্নপ্রাশনে। তখন তো বড়জনের বউ তন্দ্রা, সংসারের প্রধানা। অনীশের সাথে ডিভোর্স হয়নি; ছোটজন বিয়ে করেছে সবে দেড়মাস। তন্দ্রা বরাবরই একটু মুখরা। স্বামী থেকে শুরু করে বাইরের লোক, সবার সাথেই চোপা। বড়লোকবাড়ির মেয়ে হলে যা হয়। আমার সাথেই বেঁধে গিয়েছিল।”

          “মানে?”দেশাই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে।

          “আমি আর নিনাদ দুইদিনের জন্য ছিলাম। অন্নপ্রাশনের আগেরদিন যাই, পরেরদিন রাতে অম্বরকে সাথে ক’রে নিয়েই ব্যাক করি। অনুষ্ঠানের দিন সকাল থেকে পরিবারের লোকজন আসতে শুরু করে দেয়। যেমনটা হয় ; আসল খাওয়াদাওয়ার অনুষ্ঠান ছিল রাতে। এবার রান্নার ঠাকুর যে ছিল, সে দুপুরের অল্প কজনের জন্য যে রান্না করেছিল, সেটা কম পড়ে গিয়েছিল। তখন আমি রান্না ধরি আর সেই রান্না খেয়ে সকলে প্রশংসা করে। ‘কেন রান্না ধরলাম’, এটা ছিল তন্দ্রার প্রশ্ন। ‘বাইরের মেয়ে হয়ে পরিবারের লোকেদের জন্য রান্না ক’রে মহান সাজার চেষ্টা করছি’, ‘সবাইকে এটা নাকি বোঝাতে চাইছি যে বাড়ির বড় বউ অক্ষম, ভালো রান্না পারে না’, ‘এরজন্যে তাঁর ছেলের যদি অশুভ কিছু হয়, তাঁর দায় আমার’ ইত্যাদি; মানে অযুক্তিক কথা।”

           “তারপর?”

          “তারপর আবার কী? এক-দু কথায় আমার সাথে কথা কাটাকাটি শুরু; অনুষ্ঠানবাড়িতে অশান্তি। অনীশ এসে তন্দ্রাকে সামলায় অন্যদিকে অম্বর আমাকে।”

     কথাটা শুনে দেশাই জিভ কেটে, “এ-বাব্বা ! ছিঃ ছিঃ, বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে,”বলতেই দামিনী নিরাশ হয়ে উত্তরে বলে, “বোঝো তাহলে! ওইদিনই আমি বুঝেছিলাম, যে সরকার পরিবারে ভাঙনের সময় হয়ে গেছে। বলতে না বলতেই এর একবছরের মাথায় অনীশের সাথে তন্দ্রার ডিভোর্স।”

          “সেই। আপাতত, এখন কী করা উচিত?”

          “আপাতত, এস.পি. স্যারের পারমিশন নিয়ে নিশ্চিন্তপুরের মার্ডার কেস হাতে নেওয়া তারপর ডাক্তার আর তোকে সঙ্গে ক’রে নিয়ে নিশ্চিন্তপুর যাত্রা। বুঝেছিস বুড়োভাম ? সালা—,স্ত্রৈণ প্রেমিক কোথাকার।” দামিনী শেষের কথাগুলো দাঁত চিপে বলে ওঠে।

     আসলে দেশাইয়ের বয়স, ঊনত্রিশ হলেও দেশাইয়ের ডাকনাম ‘বুড়ো।’ দামিনী সেটার পিছনে ‘ভাম’ শব্দটা বসিয়ে এই অপভ্রংশের জন্ম দিয়েছে। আর এটা তো সকলেরই জানা ফরেনসিক ইনচার্জ ডক্টর সৌরজাকে দামিনী ‘ডাক্তার’ বলে সম্বোধন করে এবং মাঝেমধ্যে দেশাইকে ঝাঁজি দিয়ে কথা বলার আসল কারণটা হল, ইদানিং দেশাই আর সৌরজার প্রেমটা বেশি গাঢ় হয়ে উঠেছে। কাজের থেকে ফাঁকিটা একটু বেশিই দিচ্ছে। 

              নিশ্চিন্তপুর সদর থানাতে খবর দিলে তাঁদের সরকার বাড়িতে পৌঁছতে সময় লাগলো টেলিফোন করার প্রায় একঘণ্টা পর। থানার পুলিশ ইনচার্জ বিপুল বণিক। দুইজন ফটোগ্রাফার খচখচ ক’রে ভিকটিমদের ছবি ও ঘরের পরিস্থিতির ছবি তুলে চলেছে। বাড়িতে যে মাঝবয়সী কাজেরলোক ও মহিলাটি কাজ করে, তাঁরা সরকারবাড়ির এহেন দুর্ঘটনা শোনামাত্রই নিজেদের বাড়ির থেকে ছুটে আসে। কাজেরলোকটির নাম বংশী আর মহিলাটির নাম কনক। অম্বর আর নিনাদ, বিপুলবাবুকে তাঁদের যাবতীয় ঘটনা জানালে তিনি আক্ষেপের সুরে জানায়, একজন ব্রাঞ্চ সিনিয়ার-ইনস্পেক্টরের বাড়িতেই যে এমন একটা খুনের ঘটনা ঘটতে পারে সেটা কল্পনাতীত। এতে অম্বরের কতটা ক্ষতি হয়েছে সেটা বলা মুশকিল কিন্তু পুলিশ ডিপার্মেন্টের উপর যে প্রশ্ন উঠবে তা ভালোরকমভাবেই বোঝা যাচ্ছে। আর তাছাড়া সংবাদ মাধ্যম তো সঙ্গে তাল দেওয়ার জন্য আছেই। যাদের বক্তব্য, ‘পুলিশ যদি নিজের বাড়িরই সুরক্ষায় অক্ষম হয়, তাহলে সাধারণ নাগরিকের জন্য কী পন্থা অবলম্বন করবে?’

      পোস্টমর্টেম গাড়ি পৌঁছলে হসপিটালের ওয়ার্ড-বয়রা ট্রেচরে ক’রে মৃতদেহ তিনটি অ্যাম্বুলেন্সে তুলতে থাকে।

          “অম্বরবাবু, আপনার ছোটভাই আর তাঁর স্ত্রী কোথায়?” বিপুলবাবু বেশ অবাকের সুরে জিজ্ঞাসা করেন।

     অম্বর মাথা নেড়ে ‘না’ করে নিয়ে উত্তরে জানায় সে কিছুই জানে না। অনীশের বিয়ের কথাবার্তা শুরু হয়েছিল, সেই নিয়ে বাড়ির লোকজন খুবই ব্যস্ত ছিল, আর এরমধ্যে এই ঘটনা ঘটে যাওয়াটা যেন বিশ্বাস করতে পারছে না অম্বর।

   বিপুলবাবু, লাশগুলোকে ভালোরকম দেখতে দেখতে জিজ্ঞাসা করেন, “অনীশ কেমিস্ট ল্যাবের ইনচার্জ ছিলেন তো?”

          “হ্যাঁ; বি.এম. কলেজ।”

          “আর আপনার ছোট ভাই যেন কী কাজ করেন?”

          “এগ্রিকালচার ডিপারমেন্টে।”

          “ওই ডিপার্মেন্টে তো একজনকে অ্যাসিস্ট করতে হয়, আপনার ভাই কি একাই সামলাতো?”

          “না, ওঁকে অ্যাসিস্ট করে জয়ন্ত নামের একটা ছেলে; জয়ন্ত রায়।”

           “ছেলেটিকে আপনি চেনেন?”

          “হ্যাঁ। প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল, ছোট্টুকে মানে অদৃশকে অ্যাসিস্ট করছে। ও হয়তো জানতে পারে যে অদৃশ কোথায় গেছে।”

          “আপনি কয়েকদিন নিশ্চিন্তপুর আছেন তো, নাকি নৈহাটি ফিরে যাবেন?” বিপুলবাবু জিজ্ঞাসা করেন।

     অম্বর উত্তরে বলে, “আপাতত আছি। পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা আসুক।”

          “আপনার পরিবারের সাথে শত্রুতা থাকতে পারে, এমন কেউ?”

          “নো আইডিয়া।”

       উত্তর শুনে বিপুলবাবু ছোট্ট একটা হাসি হেসে, মাথার পুলিশি-টুপিটা একটু ঠিক ক’রে নিয়ে, অম্বর ও নিনাদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক ক’রে বলে, “আমি সত্যিই দুঃখিত অম্বরবাবু। ভিতরে ভিতরে যে ভেঙে পড়েছেন, সেটা মুখে না বললেও চোখে প্রকাশ পাচ্ছে। নিজেকে সামলান আর প্রাথমিক ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এলেই আমি জানাচ্ছি।”

          “থ্যাংক ইউ।”অম্বর সামান্য মাথা নেড়ে বলে ওঠে।

                                                        নিশ্চিন্তপুরের রাত পুরো থমথমে। আকাশের চাঁদের উপর দিয়ে ভেসে চলেছে কালোমেঘের দল। চারিদিক থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁদের ডাক আর শেয়ালের কান্না। গ্রামের লোকেরা যে যার নিজের ঘরের খিড়কি-কপাট বন্ধ ক’রে ঘরেতে বসা। তাঁদের মধ্যে একটা চাপা ভয় যে কাজ করছে তা তাঁদের এই নিস্তব্ধতাই বুঝিয়ে দিচ্ছে। কোনো রক্ত নেই, ঘরের জিনিসপত্র ওলট-পালট নেই, চিৎকার নেই কিন্তু খুন হয়ে গেল। ফলে লোকেরা নিজেদের মধ্যে একটা প্রেত প্রভাবের বাতাবরণ তৈরী ক’রে নেয়।

       ঘড়িতে সময় বলছে রাত সাড়ে-আট’টা। অম্বরের বাড়ির কাজের লোক বংশী, রান্নাঘরের থেকে দুইকাপ চা করে নিয়ে এসে অম্বরের ঘরে এসে ঢোকে। অম্বর আর নিনাদের হাতে চায়ের কাপগুলো ধরিয়ে বংশী জানতে চায়, রাতে খাবার জন্য কী রান্না করবে সে। কনক সেই মতো ক’রে দেবে। অম্বরের মনমেজাজ খুবই খারাপ। মাথা নেড়ে ‘না’ করে বলে ওঠে, “আমি রাতে কিছু খাবো না বংশী কাকা। কনকদি-কে নিনাদের জন্য কিছু একটা ক’রে দিতে বলো।”

    অম্বরের কথার পর পরই নিনাদও জানিয়ে দেয় যে সেও আজ রাতে কিছু খাবে না। দরকার পড়লে নিজেরাই চা-কফি কিছু একটা বানিয়ে খেয়ে নেবে।

  বংশী বুঝতে পারে এইমুহূর্তে কথা বাড়িয়ে কোনো লাভ হবে না। এইরকম ঘটনাতে কারোরই খাবার গলা দিয়ে নামতে চায় না। অগত্যা বংশী, কনককে গিয়ে এইকথা জানালে দুইজনই সরকারবাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে নিজের নিজের বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।

               অম্বরের ঘর বাদে বাকি সব ঘরের লাইট নিভানো। ঘরের বড় খাটের উপর নিনাদ পা ছড়িয়ে বসা আর অম্বর ক্রমাগত ঘরময় পায়চারী করছে ও সিগারেটে টান দিয়ে চলেছে। ঘরের দেওয়ালে অম্বরের বাবা-মায়ের কাঠের ফ্রেম বাঁধানো বড় ছবি।

          “আমি যেটা ভাবছি, সেই একই ভাবনা কি তোর মাথাতেও ঘুরছে?”পায়চারী করতে করতে অম্বর, নিনাদকে জিজ্ঞাসা করে ওঠে।

      নিনাদ সামান্য মাথা নেড়ে উত্তরে জানায়, “তোর ছোটভাই কোথায়? সেটা গ্রামের কেউ বলতেই পারলো না? আর এঁদের খুন করে কী লাভ? মোটিভটা কী?”

          “ওই একই প্রশ্ন আমার মাথাতেও। আর বাড়ির ভিতরে এতো বড় একটা কান্ড ঘটে গেল, কিন্তু গ্রামেরলোক টের পর্যন্ত পেল না, এ হতে পারে?”

          “পারে।”নিনাদ ফট ক’রে বলে।“খুন করার সময় যদি ঘুমের ওষুধের অ্যাডিকশনে ভিকটিমরা সেন্সলেস থাকে তাহলেই সম্ভব।”

    নিনাদ আরও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল এমন সময় বাইরের থেকে একটা গাড়ির হর্ন শুনতে পেয়ে দুইবন্ধুতে চমকে ওঠে। “এইসময় কে আসবে? বিপুলবাবু?” অম্বর নিজের মনে প্রশ্নটা ক’রে নিয়ে নিনাদকে সঙ্গে ক’রে দোতালার থেকে নেমে সদর দরজার কাছে এগিয়ে আসে। সদর দরজা খুলে গাড়িবারান্দাতে নামতেই নিনাদ আর অম্বর চমকে যায়।

  একটা সাদারঙের অ্যাম্বাসেটর হেডলাইট জ্বালিয়ে ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে আর গাড়ির ভিতরে বসা তিনজন। স্টেয়ারিংসীটে দেশাই, তার পাশের সীটে সৌরজা আর ভাবী কত্তাগিন্নীর কাঁধের মাঝখান দিয়ে মুখ বেরিয়ে আছে ব্যাকসীটে বসে থাকা দামিনীর। নিনাদ আর অম্বর দৌড়ে ফটকের কাছে গিয়ে দরজা খুলতেই গাড়ি সোজা এগিয়ে যায়, বারান্দার সিঁড়ির দিকে।

          “তোমরা এইখানে?”গাড়ি থেকে তিনজনে নামতেই নিনাদ জিজ্ঞাসা করে ওঠে।

      দেশাই, অম্বরের কাছে এগিয়ে গিয়ে উত্তরে বলে, “এতো বড় একটা বিপদে আমরা আসবো নাতো কি বাইরের লোক আসবে?”

      কথাটা শুনে অম্বর আর নিনাদ দামিনীর দিকে তাকাতেই দ্যাখে দামিনী পুরো সরকারবাড়িটাকে ভালোরকমভাবে দেখে চলেছে। সৌরজা গাড়ির ডিঁকি খুলে একটা মাঝারি সাইজের ব্যাগ বের করে। তারমধ্যে ফরেনসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার কয়েকটি জিনিসপত্র থাকে।

          “সদর থানার ইনচার্জ কে?” হঠাৎ নিনাদের দিকে ফিরে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে দামিনী জিজ্ঞাসা করতে নিনাদ উত্তরে জানায়, “বিপুলবাবু।” পিছনে বাকী সবাই।

          “মালটার এখনো ট্রান্সফার হয়নি? সাতবছরের উপর হয়ে গেল এখানেই গেঁড়ে বসে আছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কবে আসবে কিছু বলেছে?”

          “বলছে তো তিন-চারদিন লাগবে।”

          “হুঁ! তাহলেই হয়েছে। হাতুড়ে থানার হাতুড়ে ডাক্তার।”

  ইতিমধ্যে সকলে বাড়ির বসবার ঘরে এসে দাঁড়ায়। পুলিশ ব্যারিকেটের ভিতরে ঢুকে বডির চকমার্কিং করা স্থানগুলো ভালোরকম দেখে নিয়ে অম্বরের দিকে ফিরে দামিনী আবার জিজ্ঞাসা করে ওঠে, “অদৃশ কোথায়?”

          “ওটাই তো প্রশ্ন।” নিনাদ পাশ থেকে বলে ওঠে। “কোথায় গেছে কেউ কিছু বলতে পারছে না।”

          “ওঁর শ্বশুরবাড়ি ফোন করেছিস?” দামিনী কথাটা বলতেই অম্বরের মাথায় চট ক’রে খেলে যায়, কিছুদিন ধরেই রোহিণীর বাবার খুব শরীর খারাপ শুনেছিল।

          “একদম মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।”অম্বর বলে ওঠে।

          “কাজের সময় তোমাদের দুইবন্ধুর মাথা কোনোদিনই কাজ করে না, এটা আমার অজানা নয়। ঠিক যেমন মনযন্ত্রণায় রাতে খাবার না খাওয়া।”

   অম্বর আর নিনাদ অবাক নজরে দামিনীর দিকে তাকাতেই কপাল কুঁচকে দামিনী বলে ওঠে, “অমন করে তাকানোর কিছু হয়নি। আসার পথে বংশী কাকার সাথে দ্যাখা হয়, সেই বলল। না খেয়ে থাকলে খুনির কোনোকিছু যায় আসবে না। আমি রান্নাঘরে গেলাম, আর অদৃশের শ্বশুরবাড়ি টেলিফোন ক’রে খবর নে যে ওঁরা ওখানে কিনা।”

    কথাগুলো বলে দামিনী রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়।

    রাত এগারো’টা নাগাদ খেতে ব’সে অম্বর জানায়, অদৃশ আর রোহিণী দিনসাতেক আগে মথুরাপুরে রোহিণীর বাবার সাথে দ্যাখা করতে যায়। সেখানে তিনদিন থেকে নিশ্চিন্তপুর রওনা হয়। কিন্তু বাড়ি ফিরে আসার খবর এঁরা দুইজনে না দেওয়ায় রোহিণীর বাবা ভরদ্বাজ রায় অনেকবার এইবাড়িতে টেলিফোন করেন এবং অম্বরের মতোই লাইন ডেড পায়। তিনি ভাবেন, টেলিফোনের লাইন গণ্ডগোল থাকায় অদৃশ আর রোহিণী খবর দিতে পারেনি।

    অম্বরের মুখ থেকে কথাগুলো শুনে নিয়ে দামিনী জিজ্ঞাসা করে ওঠে, “অনীশ যখন নেশা ক’রে তোকে টেলিফোন করেছিল, তুই বলছিলি ওঁ নাকি আনতাবড়ি কথা বলেছিল। মনে আছে কী কী বলেছিল?”

    অম্বর সামান্য চিন্তা ক’রে নিয়ে, খাবার মুখে তুলে চিবোতে চিবোতে উত্তরে বলে, “বিয়ে নিয়ে কিছু একটা প্রবলেম চলছিল। সত্যি বলতে এই দ্বিতীয়বার বিয়ে করাটা ওঁকে জোর দিয়ে করানো হচ্ছিল।”

          “বিয়েটা কার সঙ্গে ঠিক হয়েছিল রে অম্বর?” অনেকক্ষণ পর সৌরজা জিজ্ঞাসা করে।

          “সম্মন্ধটা এনেছিল কাকীমার বাপেরবাড়ির দিকের কোন এক দাদা। মেয়ে নরেন্দ্রপুরের, নাম দীপান্বিতা।”

          “বাব্বা—! একেবারে মা কালীর নামে নাম। মেয়েও কী অনীশের মতো ডিভোর্সী?”

          “না, না! মেয়ের বয়স বাইশ-তেইশ হবে। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে এমপ্লয়েড; অল্প টাকার মাইনে।”

          “অনীশের ব্যাপারে সব জানতো?”

          “হ্যাঁ।”

     দামিনী জলের গ্লাসে চুমুক দিয়ে সামান্য জল খেয়ে ফট ক’রে জিজ্ঞাসা ক’রে ওঠে, “তন্দ্রার খবর কী রে ?”

          “জানি না।” অম্বর বেশ রেগেই উত্তরটা দেয়। “বাড়িতে ওঁকে নিয়ে আলোচনা হতো না।”

          “অনীশ আর তন্দ্রার ছেলে? মানে তোর ভাইপো, অঙ্গদ। কাস্টেডি তো তন্দ্রাই পায়? তাঁকে নিয়ে আলোচনা চলতো না? বলতে গেলে এখনো পর্যন্ত সরকার পরিবারের নেক্সট উত্তরসূরি ব’লে কথা।”

          “হ্যাঁ। মাসে একবার ক’রে অনীশ দ্যাখা করতে যেত, কিন্তু তন্দ্রা সেটাও মাসদুয়েক ধরে বন্ধ করে দিয়েছিল।”

          “বিয়েই বা করতে গেল কেন আর ডিভোর্সটাই বা হল কেন?” সৌরজা বেশ বিরক্তির সাথে আপনমনে ব’লে ওঠে।

     অম্বর কপালে ভাঁজ কেটে যা জানায় তা বিস্তারে না গিয়ে সংক্ষিপ্তসারে কথকের ভাষায় বললে যা দাঁড়ায়, টা হল, তন্দ্রার সাথে অনীশের প্রথম আলাপ পড়ার ব্যাচে আর সেখান থেকে তাঁদের মধ্যে ভালবাসা আরম্ভ হয়। কলেজের কেমিস্টল্যাবে চাকরি পাওয়ার আগেই হঠাৎ একদিন, অনীশ তন্দ্রাকে বিয়ে ক’রে এই বাড়িতে এই নিয়ে আসে। তখন দুইজনের বয়স মাত্র একুশবছর। দুই পরিবারেই শুরু হয় অশান্তি। অম্বরের কাকা, মানে অনীশের বাবা অমরকান্ত কিছুতেই ছেলেকে ঘরে উঠতে দেবে না, শেষে অনীশ, অম্বরকে জানালে সে এখানে এসে কাকাকে বুঝিয়ে রাজি করায়। অন্যদিকে তন্দ্রার বাড়ি লোকেরাও বাধ্য হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অনীশকে জামাই হিসাবে মেনে নেয়। কিন্তু তন্দ্রা কিছুতেই এইবাড়ির পরিবেশের সাথে মানিয়ে উঠতে পারে না। কথায় কথায় বাড়ি লোকদের সাথে তর্ক, অশান্তি, অপমান করা লেগেই থাকতো। তার থেকেও বড় একটা সমস্যা দাঁড়ালো, যখন তন্দ্রার মনে সন্দেহের বীজ বপন হয়। তন্দ্রার সন্দেহ, অনীশ তাঁর চোখকে ফাঁকি দিয়ে কোনো একটি মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। বিয়ের ঠিক দুই বছরের মাথায় এঁদের দুইজনের ছেলে অঙ্গদ জন্ম নিলে তন্দ্রার নতুন ক’রে একটা ধারণা জন্মায়, অনীশ তাঁকে খুন করতে পারে ওই মেয়েটির জন্য। এই নিয়ে অশান্তি সপ্তমে চড়লে, ছেলের জন্মের একবছরের দুইজনই ডিভোর্স ফাইল করে আর কোর্ট অঙ্গদের বয়স দেখে কাস্টেডি তন্দ্রার হাতে তুলে দেয়। অতএব বৈবাহিকযাত্রা তিনবছরে সমাপয়েৎ। শুদ্ধ ভাষায় যাকে বলে, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পূর্বেই সরকার-বাড়ির ‘সরকার’ উল্টে গেল।

          ঘটনা শুনে নিয়ে, “তা, তন্দ্রা কি বাপেরবাড়িতেই উঠেছে?” সৌরজা জিজ্ঞাসা করতে অম্বর মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’করে জানায়, “আপাতত সেটাই জানি। কারণ দুইবছর কোনো দ্যাখা-সাক্ষাৎ নেই। অনীশ দ্যাখা করতে যেত অঙ্গদের সাথে কিন্তু সেটাও ওখানকার কোনো রেস্টুরেন্ট বা পাবলিকপ্লেসে।”

          “অনীশের সাথে এই দীপান্বিতার বিয়ের কথা কতদিন আগে ওঠে?” দামিনী গম্ভীরস্বরে জিজ্ঞাসা করে।

          “দুই-তিনমাস আগে। কেন?”

          “তাহলে অনীশের মদ খাওয়ার কারণ বিয়ে নয়, বরং দেড় বছরের ছেলে।”

          “মানে?” নিনাদ বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে।

          “মানেটা হল, অনীশ এই দ্বিতীয়বার বিয়ে করলে ছেলের সাথে দেখা করতে পারবে কিনা, এটা ওঁর সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তন্দ্রা যা মেয়ে, ওঁ বলতে পারে, ‘নতুন যাকে বিয়ে করেছো, তাঁকে নিয়ে থাকো, ছেলের মুখ দেখার দরকার নেই।’ আমার তো মনে হচ্ছে তন্দ্রা, অনীশের দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা জানতো, আর সেটার জন্যই দুইমাস ধরে ছেলের মুখ দেখা বন্ধ করে দিয়েছিল।”

    দামিনী থামতেই সকলের মুখে একটা কিন্তু কিন্তু ভাব দেখা দেয়। খাওয়া সময় আর কোনো কথা হল না বললেই চলে। আরও মিনিটপনেরো পর খাওয়াপর্ব শেষ করে সকলে সরকারবাড়ির প্রতিটি ঘর ময়না করে চলে। কিন্তু লাভের লাভ লবডঙ্কা। সকলের সবকটি সাজানো গোছানো। এমনকি দামিনী যখন রান্নাঘরে যায়, সেখানেও কোনোরকম নোংরা বাসনপত্র তাঁর নজরে পড়েনি। সব ধোঁয়া এবং উপুড় করা। বাড়ির পরিবেশ দেখে কেউ ধারণাই করতে পারবে না, এখানে তিন-তিনটে মানুষকে নিঃশব্দে ঝুলিয়ে খুন করা হয়েছে।

তিনঃ_________

      সৌরজা বর্তমানে পুলিশী হসপিটালে, যেখানে তিনটি মৃতদেহের ময়নাতদন্ত চলছে। সৌরজা নিজের দায়িত্বে বডিগুলি পরীক্ষা ক’রে চলেছে। সদর থানার পি.আই. বিপুলবাবুর ঘরে দামিনী, অম্বর-নিনাদ আর দেশাইকে উপস্থিত হতেই বিপুলবাবু বেশ মনক্ষুণ্ণ হন। বিপুলবাবুর ঘরে তখন অদৃশের অ্যাসিস্ট্যান্ট জয়ন্ত রায় বসা। ছেলেটি অদৃশেরই সমবয়সী। মাঝারি গায়ের রঙ, হাইট পাঁচ দশ, মেদহীন সুগঠিত দেহগড়ন। অম্বরের সাথে জয়ন্তর চোখাচুখি হতেই জয়ন্ত তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অম্বরের কাছে এগিয়ে যায়। বিপুরবাবুর কপালে থাকা বিরক্তির ভ্রূকুটিটি আরও গভীরতর হয়ে ওঠে। এর আগেও কোনো একটি কেসের ব্যাপারে বিপুলবাবুর কাছে দামিনী আসে আর বিপুলবাবু ঠিক মতো তদন্ত না করায় দামিনীর কাছে বেশ কড়া ভাষায় কথা শোনেন। সেই থেকে দামিনীর উপর ভীষণ রাগ।

          “অদৃশ কোথায় অম্বর-দা?” জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করতেই অম্বর বেশ অবাক হয়ে উত্তরে বলে, “প্রশ্নটা তো আমি তোমায় করবো ভেবেছিলাম জয়ন্ত। কারণ, আমার বদলে তুমিই ওঁর সাথে বেশি সময় কাটাও। তাহলে ছোট্টু কোথায় সেটা তুমিই জানবে।”

          “আমার সাথে লাস্ট কথা হয় গত বুধবার; পাঁচদিন আগে। তারপর থেকে আর কোনো কথাই হয়নি।”

       চেয়ারে বসেই বিপুলবাবু বেশ গম্ভীরস্বরে জিজ্ঞাসা করেন, “মথুরাপুর থেকে কোথায় যাবে, এমন কিছু বলেছিল?”

    জয়ন্ত কিছুক্ষণ চিন্তা ক’রে নিয়ে উত্তরে মাথা নেড়ে ‘না’ ক’রে নিয়ে বলে, “না, তেমন কোনো কথাই হয়নি। তবে, অনীশদার সাথে যে মেয়েটির বিয়ের কথাবার্তা চলছিল, সেই মেয়েটির বাড়িতে যাওয়ার কথা হচ্ছিল ওই বিয়ের দিন ঠিক করার জন্য। সেখানে গেছে কিনা বলতে পারবো না।”

    এরপর আরও মিনিটদশেক বিপুলবাবু, জয়ন্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করে চলেন। কথাবার্তা ব’লে নিয়ে জয়ন্ত চলে যেতেই দামিনী, বিপুলবাবুর দিকে তাকিয়ে একটা সাদারঙের অফিসিয়াল খাম এগিয়ে দিয়ে শান্ত অথচ গম্ভীরস্বরে বলে, “বিপুলবাবু, এটা এস.পি. স্যারের নোটিস। কেসের তদন্ত এবার আমি করবো। যাবতীয় পোস্টমর্টেমের কাজ করবে ডক্টর সৌরজা।”

          “আপনি কি মনে করেন ম্যাডাম যে আমরা ঠিকমতো কাজ করবো না?” বিপুলবাবু দামিনীকে জিজ্ঞাসা করে ওঠেন।

    দামিনী, বিপুলবাবুর দিকে স্থির নজরে থাকিয়ে গম্ভীরস্বরে উত্তরে বলে, “সেটা তো বলিনি বিপুলবাবু। এই খুনের কেসটা ব্রাঞ্চ নিলো।”

          “কিন্তু কেন?”

          “কারণ, প্রেস অলরেডি কপচানো শুরু করে দিয়েছে। অম্বর আমার ব্রাঞ্চের একজন ইনস্পেক্টর, তাই। তারমানে এটা নয় বিপুলবাবু, যে আপনার কাজকে আমি ছোট করছি।”

          “আপনি কাকে সন্দেহ করছেন? কে করতে পারে এই কাজ?”

          “সেটা জানার জন্যই তো কেসটা স্বইচ্ছায় হাতে নিলাম। আপনি কাউকে করছেন?”

  দামিনী প্রশ্নটা করতেই বিপুলবাবু ঠোঁটের কোণে একটা বিদ্রুপসূচক হাসি হেসে নিয়ে বলে ওঠেন, “হোম-ওয়ার্ক করে আসেননি এখানে দেখছি। আমি যাকে সন্দেহ করছি, তাঁর নাম শুনলে হয়তো আপনি চমকে উঠতে পারেন।”

          “কাকে?”

          “আপনার কলিগ অম্বর সরকার।”

        নামটা নেওয়ামাত্রই অম্বর তীব্রস্বরে রেগে বলে ওঠে, “মাথা ঠিক আছে আপনার বিপুলবাবু? কাউকে না পেয়ে আপনি ডায়রেক্ট আমাকেই ক্লেম করলেন?”

     তর্ক বাড়ার আগেই দামিনী নিজের বাঁ-হাতটা তুলে অম্বরকে শান্ত ক’রে বিপুলবাবুকে সন্দেহের কারণটা জিজ্ঞাসা করে। বিপুলবাবু, টেবিলের উপর থাকা একটা চ্যানেলফাইল হাতে তুলে নিয়ে দামিনীর দিকে তাকিয়ে জানায়, “আপনার কলিগের হঠাৎ বাড়ির প্রতি দুশ্চিন্তা হওয়াটা অবাকের নয়? যাইহোক, আমি ক্লিয়ার করে দিচ্ছি। আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম, বর্তমানে এই সরকারবাড়ির যাবতীয় প্রপার্টি এখনো ভাগাভাগি হয়নি। অতএব, মালিক এখন অম্বর সরকার আর ওনার ছোটভাই অদৃশ সরকার। ছোটভাই আর ভাইয়ের বউ মিসিং, আদেও বেঁচে আছে কিনা কনফার্ম নয়। অম্বরবাবু আজ প্রায় পাঁচমাস নিশ্চিন্তপুর আসেন না আর হঠাৎ ওনার মনে হল, বাড়ির কেউ টেলিফোন ধরছে না ব’লে দুর্ঘটনা কিছু ঘটতে পারে আর সেটা সত্যিও হল।”

          “তাহলে আপনার যুক্তি হচ্ছে, প্রপার্টির জন্য আমি আমার পরিবারকে খুন করেছি।”অম্বর রেগে জিজ্ঞাসা করে ওঠে।

    বিপুলবাবু, দামিনীর হাতে ফাইলটা দিয়ে নিয়ে হেঁয়ালির সুরে উত্তরে বলেন, “সেদিকটাই তো যাচ্ছে অম্বরবাবু।”

     দামিনী ফাইলে ভালোরকমভাবে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বিপুলবাবুর উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, “আপনার ইনফরমেশনে অনেক জিনিস মিসিং আছে।”

          “মিসিং?” বিপুলবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন।

       দামিনী বলে, “এক, প্রপার্টির ভাগীদার আরও একজন আছে। অনীশের ছেলে অঙ্গদ। দুই, অম্বর যদি খুন করতো তাহলে বাড়িতে ঢোকার সময় তালা ভেঙে ঢুকতে হতো না, চাবি দিয়ে তালা খুলে ঢুকত। বাড়ির চাবি দুটো, একটা থাকতো অমরকান্তবাবুর আছে, আরেকটা থাকতো এইখানে থাকা দুইভাইয়ের কাছে। আপনি ভুলে যাচ্ছেন, খুন ক’রে খুনি সদর দরজাতে তালা দিয়ে গেছে।”

          “চাবি থেকে যে চাবি তৈরী করা যায় না এটা নিশ্চয়ই আপনি বলবেন না ম্যাডাম।”

          “বলছি নাতো বিপুলবাবু। তাহলে সেই একই জায়গায় আসতে হচ্ছে। অম্বর চাবির নকল তৈরী করালে তালা ভাঙতে হতো না।”

          “সেটা অ্যালিবাই রাখার জন্যও তো হতে পারে।”

          “নিশ্চয়ই পারে। আর দুটি চাবির মধ্যে একটি চাবিও পাওয়া যাচ্ছেনা। অন্তত অমরবাবুর কাছে যে চাবিটা ছিল সেটা তো পাওয়া যেত? সেটা কোথায় তাহলে? চাবির ডুপ্লিকেট করলে কি একসাথে দুটো চাবি নিয়ে গিয়ে করাবে? এবার কে কী পারে, সেটার জন্যই এই সরকারবাড়ির মার্ডার কেস, ব্রাঞ্চ সামলাবে। আশা করছি কোয়াপারেট করবেন।”

   দামিনীর কথাটা শুনে বিপুলবাবু মুখে কিছু না বললেও এই প্রস্তাব যে ওনার পছন্দ হল না, সেটা মুখের চাওনি দেখেই বোঝা যায়।

          দুপুর বারো’টা নাগাদ হসপিটালে গেলে, ডক্টর সৌরজা বেসিক পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা দামিনীর হাতে তুলে দেয় আর সেটা পড়তেই দামিনী বেশ অবাক হয়ে ওঠে। অ্যাটোপ্সি রিপোর্ট অনুযায়ী খুনের টাইম, বডি হসপিটালে পৌঁছনোর ছিয়ানব্বই থেকে একশো-পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে। অর্থাৎ চারদিন আগে। পেটের ভিতরে আনডাইজেস্টেড খাবার পাওয়া যায়। তারমানে রাতের খাবার খাওয়ার পর এই ঘটনাটা ঘটে। খুনের পর মৃতদেহগুলিকে সিলিংয়ের সাথে নাইলনের দড়ি দিয়ে ঝোলানো হয়েছে। কোনোপ্রকার ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়নি আর তিনজনের বেশ সর্দিতে বুকে কফ জমে গেছে।

          রিপোর্ট পড়ে নিয়ে দামিনী, সৌরজার দিকে তাকিয়ে বেশ রেগে বলে ওঠে, “আসল জিনিসটাই তো লেখোনি ডাক্তার। খুন করা হয়েছে কীভাবে? এখানে লিখেছ, মৃত্যুর পর বডি ঝোলানো হয়েছে, তাহলে মৃত্যু হল কী করে?”

     সৌরজা কাপালে সামান্য ভাঁজ কেটে নিয়ে উত্তরে বলে, “দ্যাখ, বেসিক পোস্টমর্টেমে আমি ধরতে পারিনি যে খুন কী করে হল। শ্বাসরোধ করে যে মৃত্যু হয়েছে এটা বুঝতে পারছি। কিন্তু গলাতে নাইলনের দড়ি বাদে আর কোনো গলা টেপার চিহ্ন নেই।”

          “বালিশ চেপে ধরে?”

          “না! সেটা হয়ে নাক ইঞ্জিওর হতো, সেটাও হয়নি।”

      সৌরজার কথাটা শুনে দামিনী বড় কাঠের টেবিলের উপর শুইয়ে রাখা, অনীশের মৃতদেহের কাছে এগিয়ে গলার কাছে দেখে নিয়ে বলে, “নাইলনের ফাঁস এতোটাই কষে বাঁধা হয়েছিল যে গলার দাগ পুরো নীল হয়ে গেছে। আমি তো ভেবেছিলাম অজ্ঞান ক’রে নিয়ে হয়তো এঁদেরকে ঝোলানো হয়েছে।”

          “আমিও তেমনই ভেবে কাজ করি। কিন্তু কোনোপ্রকার ক্লোরোফর্ম বা ঘুমের ওষুধ আমি বডিতে বা পেটের খাবারে পাইনি।”

          “ওহঃ ডাক্তার! এটা কীকরম উত্তর? খুন হল কিন্তু হল কী করে হল সেটার উত্তর নেই?”

   সৌরজা সামান্য চিন্তা ক’রে নিয়ে শান্ত গলায় উত্তরে বলে, “আমি তো অ্যানালাইসিস করে যাচ্ছি, আমি দেখছি।”

          “শুধু দেখলে হবে না, রেজাল্ট চাই, রেজাল্ট! আর সাথে লিড।” কথাটা বলে দামিনী, নিনাদ আর দেশাইকে নিয়ে মর্গের থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে।

       বাইরে এসে পুলিশভ্যানে উঠতেই দেশাই জিজ্ঞাসা করে, এই মুহূর্তে কোথায় যাবে তাঁরা। উত্তরে দামিনী জানায়, দেশাই আর নিনাদ যেন গ্রামে গিয়ে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে খোঁজ খবর নেয় যে তাঁরা কিছু জানে কিনা আর দামিনী ও অম্বর যাবে তন্দ্রার সাথে তন্দ্রার বাপের বাড়িতে কথা বলতে।

      নিনাদ পুলিশভ্যান স্টার্ট দিয়ে হসপিটালের গ্রাউন্ডপ্লেস থেকে বেরিয়ে বাঁ-দিকের সড়কটা ধরে। সদর থানাটা সেইদিকে। কয়েকটা কাজের জন্য অম্বর থানাতে রয়ে যায়। সেখান থেকে নিনাদ, অম্বরকে গাড়িতে তুলে নেবে।

      গাড়িতে বসে, দামিনীর দৃষ্টি জানলার বাইরের দিকে। বেগময় প্রকৃতির সাথে দুরন্ত মনের প্রশ্ন, ‘খুন কী করে হল? খুন করার পর খুনি লাশ ঝুলিয়ে দিল কেন? এমন কী লুকিয়ে আছে সরকার-পরিবারে, যারজন্যে অম্বরের পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।’

      থানাতে পৌঁছতে সময় লাগলো মিনিটদশেক। দামিনী, নিনাদ আর দেশাই থানাতে ঢুকতেই থতমত খেয়ে চমকে ওঠে। অফিসরুমে, অম্বর আর বিপুলবাবুর সাথে অদৃশ ও রোহিণী বসা। অদৃশের চোখদুটো কেঁদে কেঁদে লাল হয়ে গেছে। রোহিণীরও একই অবস্থা।

          দামিনী কাছে এগিয়ে, “এতদিন কোথায় ছিল তাঁরা?” জানতে চাইলে অদৃশ জানায়, গত রবিবার রোহিণীর বাবাকে দেখতে তাঁরা দুইজনে মথুরাপুর যায়। কাজেরসুত্রে অদৃশ, শ্বশুরবাড়ির থেকে অফিসে ফোন ক’রে জানতে পারে আদহাটা গ্রামে কীটনাশক প্রয়োগের ফলে ফসলের গোঁড়া পচে যাচ্ছে। তাই মথুরাপুর থেকে ফেরার পথে অদৃশ ঠিক ক’রে যে আদহাটা হয়ে তারপর নিশ্চিন্তপুর ফিরবে। বুধবার, বাড়িতে এই কথা টেলিফোন করে অদৃশ জানিয়েও দেয় যে রোহিণীকে নিয়ে সে তিনদিন পর ফিরবে। পরে আধহাটা পৌঁছে কাজ মিটিয়ে রাতে ফোন করলে ফোনের লাইন পায়না। তখন অদৃশ ভাবে টেলিফোনের লাইন খারাপ হওয়ার জন্যই হয়তো লাইন পাচ্ছে না। আজ বাড়িতে ফিরে পাড়ার লোকেদের মুখে এই ঘটনা শুনেই তাঁরা সদর পুলিশ স্টেশনে ছুটে আসে অম্বরের সাথে কথা বলতে।

          “তুই যেদিন লাস্ট টেলিফোন করেছিলি, ফোন কে ধরেছিল?” অম্বর জিজ্ঞাসা করতে অদৃশ জানায়, ফোনটা রিসিভ করেছিল, ওঁর মা; মানে বসুধা দেবী।

          “কখন ফোন করেছিলি?”

          “রাত সাড়ে-ন’টা হবে।”

           “তা তুই শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলি সেটা কাউকে জানিয়ে যাসনি কেন?”

          “যাওয়ার কথা ছিল পরের মাসে বড়দা। কিন্তু রোহিণীর বাবার কন্ডিশন এতোটাই সেন্সেটিভ যে আর দেরী করলাম না। এমনকি জয়ন্তকে পর্যন্ত ব’লে যাইনি। আর ফিরে এসে দেখি সব শেষ।”

   হঠাৎ রোহিণী, অদৃশের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, “তুমি তন্দ্রার কথা কেন বলছ না বড়দাকে?”

       সকলে বেশ অবাক হয়। দামিনী গম্ভীরস্বরে জিজ্ঞাসা করে, “কী কথা রোহিণী ?”

     রোহিণী, দামিনীর দিকে তাকিয়ে চোখের জল মুছে নিয়ে বলে ওঠে, “দামিনী-দি, মেজদা, তন্দ্রাদি-কে নিয়ে খুব সমস্যায় পড়েছিল। এই দ্বিতীয়বারের বিয়েটা মেজদা কিছুতেই করতে চাইছিল না। তন্দ্রা, হুমকি দিয়েছিল মেজদাকে-!”

          “আহঃ রোহিণী! ওটার সাথে এই খুন মেলাচ্ছ?”অদৃশ বাধা দিয়ে বলে।

          “কেন মেলাবো না?”

          “তুমি তো তন্দ্রা বৌদিকে চেনো। রাগের মাথায় অনেককিছুই বলে দেয়।”

    যুবাবয়সী কত্তাগিন্নীর তর্ক বাড়তে যাবে এমন সময় অম্বর বেশ ধমকের ভঙ্গীতে তাঁদের থামিয়ে জানতে চায়, তন্দ্রা কী হুমকি দিয়েছিল বিয়ে নিয়ে।

         রোহিণী বলে চলে, “মেজদার সাথে তন্দ্রাদি-র প্রায়শই রাতে ফোনে কথা হতো। মাসদুয়েক আগে একদিন রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায় আর জলের বোতল আনতে রান্নাঘরে যাচ্ছি, তখন দেখছি সদর দরজা খোলা। আমি তোমার ছোট ভাইয়ের কাছে গিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে জানালে ওঁ বাইরে এসে দেখে মেজদা বাইরের সিঁড়িতে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর মদ খাচ্ছে। ওঁ গিয়ে মেজদাকে আটকায় আর আর কারণ জানতে চাইলে মেজদা বলে, তন্দ্রাদি, মেজদাকে বলেছে, দ্বিতীয়বার বিয়ে করলে ছেলের মুখ দেখা বন্ধ করে দেবে আর দরকার পড়লে সরকার-পরিবারের সবাইকে একসাথে সিলিংয়ের সাথে ঝুলিয়ে দেবে। আর, তন্দ্রাদি সেটা করতেও শুরু করে দিয়েছিল। অঙ্গদের সাথে মেজদাকে দেখা করতে দিত না। এমন কী জমিজমা ভাগাভাগির কথা পর্যন্ত ওঠে।”

          “রোহিণী, চুপ করো।”অদৃশ কাঁপাস্বরে বলে ওঠে।

          “কেন চুপ করবো? প্রপার্টি নিয়ে তন্দ্রাদি বাবাকে টেলিফোন করেনি? হুমকি দেয়নি?”

  কথাগুলো শুনে অম্বর বেশ গম্ভীরস্বরে জিজ্ঞাসা করে, “এতকিছু ঘটতে শুরু করে দিয়েছিল, আর একবারও আমাকে জানাতে প্রয়োজন মনে করেনি?”

          “মেজদা, ঠিক করেছিল, তোমার সাথে কথা বলবে কিন্তু–”

          “কিন্তু ?”

          “আপনার এই আদরের ছোটভাই বাধা দেয়। বলে, বড়দা এমনি নিজের কাজ নিয়ে দিনরাত পড়ে আছে, কেন পারিবারিক ঝামেলায় বড়দার মাথা খারাপ করাবে?”

    কথাটা শুনে অম্বর, অদৃশের দিকে কড়া নজরে তাকাতেই অদৃশ ভয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। দামিনী পুরো বিষয়টা অপলক ও স্থির দৃষ্টিতে শুনে চলে। মুখে কোনো শব্দ নেই।

              পুলিশস্টেশন থেকে দুটো গাড়ি দুইদিকে চলে বেরিয়ে যায়। একটা গাড়িতে দেশাই, নিনাদ, অদৃশ, রোহিণী যায় সরকার বাড়ির দিকে আর অন্যটিতে অম্বর-দামিনী যায় তন্দ্রার বাপেরবাড়ির দিকে। নিশ্চিন্তপুর সদরে তন্দ্রার বাপেরবাড়ি। পৌঁছতে সময় লাগলো মিনিটকুড়ি।

     সাজানো-গোছানো নতুন রঙ করা তিনতলা বাড়ি। নীচের ঘরগুলো ভাড়া দেওয়া আর উপরের দুটো ফ্লোরে বাড়ির মালিকের পরিবার নিয়ে বসবাস। তন্দ্রার বাড়িতে যাওয়ার আগে অম্বর, নিজের একমাত্র ভাইপোর জন্য বিভিন্নরকমের খেলনা, ও দুরকমের পরনের পোশাক কিনে নেয়। সিঁড়ি পেরিয়ে দোতালায় উঠে, দরজায় বারকয়েক টোকা দিতেই একজন মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা দরজা খুলে, অম্বর আর দামিনীকে দেখে বেশ অবাক হয়। ইনি তন্দ্রার মা, মধুবন্তী দেবী।

          “তন্দ্রা আছে?” দামিনী গম্ভীরস্বরে জিজ্ঞাসা করতেই মধুবন্তী দেবী শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করেন, “হঠাৎ?”

          “খুনের ব্যাপারে কথা আছে; ডাকুন।”

          “কী?” মধুবন্তী দেবী অবাক হতেই দামিনী সটান অম্বরকে নিয়ে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে।

     মিনিটদুয়েকের মধ্যেই অন্যঘর থেকে তন্দ্রা, দেড় বছরের অঙ্গদকে কোলে নিয়ে বসবার ঘরে এসে দাঁড়াতে অম্বর, অঙ্গদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে।

          “কী ব্যাপার, বড়দা, তুমি হঠাৎ?” তন্দ্রা, ছেলেকে নিয়ে সোফাতে বসতে বসতে জিজ্ঞাসা করে ওঠে।

      অম্বর, ভাইপোর জন্যে আনা জিনিসগুলো সামনের টেবিলের উপর রাখতেই তন্দ্রা বিদ্রূপসূচক হাসি হেসে নিয়ে আবার বলে ওঠে, “নতুন করে সম্পর্ক তৈরী বুঝি?”

          “ডিভোর্সটা তো, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হয়, বাবা মায়ের মধ্যে তো হয় না, তাই সম্পর্কটা পুরনোই আছে তন্দ্রা।” দামিনী হেসে শান্তস্বরে উত্তর দেয়।

          “বলো, হঠাৎ আমার কাছে কেন?”

          “অনীশের বিয়ের ব্যাপারে তুমি কিছু জানো?” দামিনী সোফাতে হেলান দিয়ে জেরার ভঙ্গীতে জিজ্ঞাসা করে।

          “কেন? আমি জানলাম কী না জানলাম, কার কী যায় আসে? অনীশকে তো আমি ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছিলাম।”

          “কিন্তু তোমাদের মধ্যে কথাবার্তা তো বন্ধ হয়নি।”

          “দ্যাখো দামিনী, অনীশ কথা আমার সাথে বলতে আসত না, আসত ছেলের সাথে দেখা করতে, কথা বলতে।”

          “তাও সেটা দুইমাস ধরে বন্ধ করে দিয়েছ।”

          “তুমি কী অনীশের হয়ে কথা বলতে এসেছ? আর আজ তো আমি সরকার বাড়ির বড়-বউ নই, তাহলে কেন?”

   দামিনী ছোট্ট একটা হাসি হেসে নিয়ে বলে, “তন্দ্রা, নিজেকে তুমি যতটা চালাক মনে করো, ততটা তুমি নও। আর সরকারবাড়ির বড়-বউ, তুমি কোনোদিনই হতে পারবে না কারণ, অম্বর বাড়ির বড়ছেলে। তাঁর বউ যে হবে, সেই এই বাড়ির বড়-বউ। যাইহোক কাজের কথায় আসি। গত বুধবার তুমি কোথায় ছিলে?”

      জেরার মতো প্রশ্নটা শুনে তন্দ্রা বেশ রেগে বলে ওঠে, “মানেটা কী?”

           “মানেটা হল, গত বুধবার রাতে অনীশ ও কাকা-কাকীমা খুন হয়েছে?” অম্বর রেগে উত্তরটা দিতেই তন্দ্রা আর মধুবন্তী দেবী চমকে ওঠে। “বলো এবার, কোথায় ছিলে বুধবার?”

           “কে খুন করলো আর কেন?”তন্দ্রার চোখ ছলছল করে ওঠে।

   দামিনী সোফা থেকে উঠে, ঘরটা দেখতে দেখতে বলে, “সেটা তো তুমি ভালো জানবে।”

          “মানে?”

          “মানেটা হল, তুমি অনীশকে হুমকে দাওনি যে, দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে গেলে বাড়ি শুদ্ধ লোককে ঝুলিয়ে দেবে?” অম্বর বলে ওঠে।

          “সেটা তো জাস্ট রাগের মাথায় বলা দামিনী। তারমানে সত্যি-সত্যিই ঝুলিয়ে দেবো নাকি? এ কিরকম কথা? অনীশ হাজবেন্ড আমার।”

          “হাজবেন্ড? তারজন্যই দুমাস ছেলের মুখ দেখতে দাওনি? মানসিক যন্ত্রনা দিয়ে গেছো? সম্পত্তিভাগের কথা বলেছ?”

         “আমি মানছি রাগের মাথায় ডিসিশন নিয়েছি, কিন্তু জমিজমা ভাগের কথা আমি বলিনি। আমি বলেছিলাম, দ্বিতীয়বার বিয়ে করছ, ভালোকথা কিন্তু ছেলের ভবিষ্যতের কথাটাও ভাববে। সরকার পরিবারের অংশ সে, ব্যাস।”

          “ব্যাস? এই কথাটাকে ভাগাভাগির আন্ডারে ফেলছ না?”

          “তারমানে এটা বলতে চাইছো যে সম্পত্তির জন্য আমি অনীশ আর তাঁর বাবা মাকে খুন করেছি? তাহলে লাভ কোথায়? বড়দা বেঁচে, অদৃশ বেঁচে আমার লাভটা কোথায় হল? আর বড়দা, কিছু মনে করো না, আমি তো চিরকালীনই খারাপ তাই নতুন ক’রে খারাপ হওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। তুমি আর তোমার ছোটভাইও ধোঁয়া তুলসীপাতা নও।”

          “মানে?” অম্বর গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করে। “কী বলতে চাইছো?”

          “অনীশের বাবা মা প্রথমে দীপান্বিতার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করেনি?”

    তন্দ্রা কথাটা বলামাত্রই দামিনীর নজর ঘুরে যায় অম্বরের দিকে। অন্যদিকে তন্দ্রা বলে চলে, “তুমি বিয়েতে আপত্তি করলে, তারপর বাড়ি সবাই অনীশকে বিয়ের ব্যাপারে চাপ দেয়। আর তোমার আদরের ছোটভাই, সে বিয়েটা নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছিল, যাতে সম্পত্তিটা ঠিকমতো ভাগাভাগি করতে পারে।”

        কথাটা শুনে দামিনী বেশ অবাক হয়ে তন্দ্রার দিকে তাকায়। অঙ্গদকে নিজের কোলে নিয়ে “তুমি জানলে কী করে এইসব কথা?” জিজ্ঞাসা করতে তন্দ্রা চোখের জল মুছে নিয়ে বলে, “আমাকে অনীশ বলেছিল।”

          “ঠিকমতো ভাগাভাগি হবে মানেটা কী?”

          “অনীশের বাবা, একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে জমির ভাগাভাগির সময় এগিয়ে এসেছে। তিনি ঠিক করেন, বাড়ি, পুকুর, জমিজমা মিলিয়ে ভাগ হবে মোট দুইভাগে। একভাগ হল বড়দার বাবা অজয়নারায়ণের, আরেকটা হবে অনীশের বাবার নামে। এবার যেহেতু অজয় জ্যেঠু আর বড়মা বেঁচে নেই তাই পুরো সম্পত্তির অর্ধেক অংশটা পাবে বড়দা আর বাকি অর্ধেক অংশ অনীশের বাবার। ওই অংশটাই দুই ছেলের মধ্যে ভাগ করবেন বলে ঠিক করেন। এখানেও আরেকটা সমস্যা তৈরী হয়। যেহেতু অঙ্গদের কাস্টেডি আমার কাছে তাই বাবা ঠিক করেন, তাঁর ভাগের ষাট ভাগ অনীশ ও অঙ্গদকে দেবে আর বাকি চল্লিশ ভাগ অদৃশকে। এবার দ্বিতীয়বার অনীশ যাকে বিয়ে করছে, সে পরিবারে আসলে অটোমেটিক তাঁর অধিকারও পরিবারে। তখন সম্পত্তি ভাগ হবে, ষাট-চল্লিশের বদলে পঞ্চাশ-পঞ্চাশে। অঙ্গদের কোনো ভাগ নেই। তাহলে এই মুহূর্তে অনীশের খুনে কার লাভ হচ্ছে দামিনী? আমার নাকি অদৃশের? দীপান্বিতার সাথে বিয়ের জোর অদৃশই দেয়। আর দামিনী, একবারও এটা চিন্তা করে দেখেছ যে এই খুনের পিছনে দীপান্বিতাও থাকতে পারে?”

     দামিনী, কপালে ভাঁজ কেটে গভীর মনোযোগের সাথে শুনে চলেছে।

          “একটা অবিবাহিতা মেয়ে, অবিবাহিত ছেলে ছেড়ে, দোজবরে বিয়ে করতে রাজি হওয়াটা অবাক করার বিষয় নয়? যদি বুঝতাম অঙ্গদ, অনীশের কাছে আর তাঁকে বড় করার জন্য একজন মায়ের প্রয়োজন।”

     ঘরের পরিবেশ থমথমে। ঘড়ির টিকটিক শব্দ, অঙ্গদের ‘অ্যাঁ-উঁ-বা-ব্বা’ করে ডাক আর সোফার এককোণায় বসে থাকা তন্দ্রার কান্না। মধুবন্তী দেবী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রান্নাঘরের দিকে চলে যায় দামিনী আর অম্বরের জন্য চা করতে।

          কোনোরকম জিজ্ঞাসা না ক’রে অম্বর, দামিনীর কোল থেকে অঙ্গদকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই দামিনী, তন্দ্রার পাশে বসে শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করে, “অনীশকে যদি এতোটাই ভালোবাসতে তাহলে ছাড়লে কেন?”

      তন্দ্রা দামিনীর দিকে তাকাতে দামিনী সামান্য হেসে নিয়ে বলে, “শোবার ঘরের ডেক্সের উপর অনীশের ছবি। মন থেকে সরালে, ছবিটাও সরে যেত।”

          পাড়াতে গিয়ে নিনাদ আর দেশাই বেশ কয়েজনের সাথে আলোচনা করে জানতে পারে, সরকার পরিবারের মতো পরিবার গ্রামে একটাও হয়না। বারংবার তন্দ্রার নামই তাঁদের মুখে উঠে আসে। তাঁদের বক্তব্য, তন্দ্রা এই পরিবারকে ভাঙার চেষ্টা করেছে। অনীশকে নিয়ে আলাদা হওয়ার জন্য তন্দ্রা ভীষণ জোর দেয়, কিন্তু অনীশ নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। কিন্তু খুন যে হতে পারে এমন ধারণা গ্রামের মানুষের মাথাতেও আসেনি।

      তন্দ্রার বাড়ি থেকে গাড়ি সোজা পৌঁছয় সদর থানাতে। আগের থেকে বংশী আর কনককে থানায় আসতে বলা হয়েছিল। দামিনী সোজা জেরা করাবার ঘরে বংশীকে বসিয়ে জানতে চায় যে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল আর বাড়ির কাজেরলোক হয়ে ধরতে পারলো না কেন?

    বংশী উত্তরে জানায়, সে শেষ কাজে গিয়েছিল বুধবার। রাতের কাজ শেষ ক’রে সে বাড়ি ফিরে আসে।

          “কখন ফিরে আসো?”দামিনী জিজ্ঞাসা করে।

          “সাড়ে-আট’টা থেকে ন’টার মধ্যে।”

          “তা পরেরদিন আর কাজে যাওনি?”

          “হ্যাঁ গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি সদর দরজায় তালা। আমি ভাবলাম হয়তো কোথাও বেরিয়েছে, কিছুক্ষণ পর আসবো। কিন্তু তার একঘণ্টা পর গিয়েও আমি দরজাতে তালা দেখি। সেইদিন অনেকবার সরকারবাড়ি যাই। পরে ভাবলাম, হয়তো অম্বুর কাছে ঘুরতে গেছে।”

         “অদৃশের যে শ্বশুর অসুস্থ এটা তুমি জানতে?”

          “হ্যাঁ।”

          “শ্বশুরবাড়ি যে ওঁরা দুইজন গেছে এটা অম্বরকে প্রথমে বলোনি কেন?”

          “ওঁরা যে শ্বশুরবাড়ি গেছে এটা জানতামই না। কোথায় একটা গেছে এটাই জানতাম আর সেটাই আমি অম্বুকে বলি।”

          “বাড়ির সদর দরজার চাবি কটা?”

          “দুটো।”

          “কোথায় থাকতো?”

          “একটা মালিকের কাছে আরেকটা দেরাজের ভিতরে।”

          “পরিবারে সম্পত্তি নিয়ে কোনো বিবাদ চলছিল?”

          “আমি বলতে পারবো না। আমার সামনে হয়নি।”

          “অনীশ কি রোজ নেশা করতো?”

          “অনীশ যে নেশা করতো, এটা আমরা পরে জেনেছি।”

          “অনীশ আর অদৃশের মধ্যে শেষের দিকের সম্পর্ক কেমন ছিল?”

          “ঠিকঠাকই তো মনে হয়েছে।”

           “বাড়িতে সমস্যা কাকে নিয়ে চলছিল?”

          “কাউকে নিয়ে না। তবে–”

          “তবে?”

          “গিন্নিমার সাথে কয়েকদিন ধরে অদৃশের খুব কথা কাটাকাটি চলছিল।”

          “কী নিয়ে?”

          “আমি সঠিক বলতে পারবো না। কিন্তু কিছু একটা জোর দিয়ে অদৃশ করতে বলছিল গিন্নীমাকে আর তাতে গিন্নীমা বার বার বলে, ‘তোর বাবা যেটা করছে, ঠিকই করছে।’ এর বেশী আমি আর কিছু বলতে পারবো না। আমি সত্যিই কিছু জানি না।”

          “খুন কে করতে পারে?”

          “আমি কী করে বলবো? ঝগড়াঝাঁটি সব পরিবারেই হয়। এরমধ্যে খুন হবে সেটা মাথাতেও আসেনি।”

     কাজেরলোক বংশী চলে গেলে কাজেরমহিলা কনক এসে দাঁড়ায় দামিনীর সামনে।

          “বসো।”দামিনী চেয়ারের ইশারা ক’রে কনককে বলে ওঠে।

   কনক চেয়ারে বসতেই দামিনী বংশীকে করা একই প্রশ্ন কনককে জিজ্ঞাসা করলে কনক উত্তরে জানায়, সেও গত বুধবার শেষ কাজে যায় আর বাড়িতে তালা দেখে পর পর দুইদিন ফিরে আসে। বাড়ির ভিতরে যে এইরকম কিছু একটা ঘটতে পারে সেটা সে চিন্তাই করতে পারেনি।

          “অদৃশ যে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল, এটা তুমি জানতে?”

          “রোহিণীর বাবার যে খুব শরীরটা খারাপ ছিল, সেটা শুনেছিলাম, কিন্তু ওঁরা যে ওইখানেই গিয়েছিল, এটা জানতাম না।”

          “সদর দরজার চাবি কটা, দুটো নাকি তিনটে?”

          “দুটো। একটা চাবি থাকতো কত্তাবাবা মানে অমরবাবুর কাছে আর একটা বাড়ির সকলের। বসবার ঘরে যে দেরাজটা আছে ওটার ভিতরে।”

          “কারোর সাথে কোনো ঝগড়াঝাঁটি চলছিল?”

          “তন্দ্রা বৌদি।”

          “সে তো আর বাড়ির মধ্যে না। ডিভোর্সের পর বাড়ির কারোর কোনো স্বভাবের পরিবর্তন? সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা?”

       দামিনীর প্রশ্নে কনক সামান্য চিন্তা ক’রে নিয়ে উত্তরে বলে, “সম্পত্তি কিনা জানি তবে, কত্তাবাবার সাথে গিন্নীমার বেশ কয়েকদিন ধরে কথা কাটাকাটি চলছিল।”

          “কী বিষয় হতে পারে তোমার মনে হয়?”

          “আমার মনে হয়, অনীশের এই দুইবারের বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে।”

          “কোনো দাবিদাবা করেছিল সরকার পরিবার?”

          “না, না।”

          “যার সাথে অনীশের বিয়ে ঠিক হয়েছিল তাঁকে দেখেছ? এই বাড়িতে এসেছিল?”

          “হ্যাঁ, একবার বাড়িতে কালীপুজো ছিল সেইসময়। শান্ত মেয়ে।”

          “তোমার কী মনে হয় খুন কে করতে পারে?”

          “সেটা আমি কী করে বলবো? আমি জানি না।”

    কনক চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই দামিনী পকেটের থেকে সিগারেটের বাক্স আর লাইটার বের করে, তারথেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চিন্তা ক’রে চলে। প্রায় মিনিটপাঁচেক পর নিনাদ আর দেশাই জেরা ঘরে উপস্থিত হতেই দামিনীর ঘোরটা কাটে।

    নিনাদ জানায়, রোহিণীর বাবার শরীর সত্যিই খুব খারাপ। দুটি মেজর অ্যাটাক এসে গেছে আর যারজন্য রোহিণীকে তিনি বারবার দেখতে চাইছিলেন। ওনার ট্রিটমেন্ট যিনি করছিলেন, ডক্টর পাঠক; তাঁর সাথেও নিনাদ কথা বলে জেনেছে অদৃশ আর রোহিণী রবিবার নরেন্দ্রপুর পৌঁছয় আর দুইদিন সেখানে থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ফিরে যায়।

     অন্যদিকে দেশাইয়ের খবর অনুযায়ী, আদহাটা গ্রামের পঞ্চায়েত দপ্তরে টেলিফোন ক’রে জানতে পারে, বিগত মাসদুয়েক ব্যবহৃত কীটনাশক প্রয়োগে ফসল নষ্ট হয় আর তাঁরাই অদৃশের সাথে কথা বলে ওখানে যেতে বলে। মঙ্গলবার রাতে অদৃশ আর রোহিণী আদহাটা পৌঁছয় আর আজকে সকালে তাঁরা ওখান থেকে ফিরে আসে।

     সব কথা শুনে দামিনী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে খুব ধিমিপদে পায়চারী করতে করতে বলে চলে, “তিনটে বিষয়ে খটকা লাগছে। এক, খুনি খুন ক’রে বডি ঝোলালো কেন? যখন মারাই গেছে তাহলে কষ্ট করে ঝোলানোর কারণ কী? দুই, খুন করে টেলিফোনের রিসিভারটা নামালো কেন ? মারা যখন গেছেই তখন রিসিভ করার কেউ নেই। তাহলে কেন রিসিভার নামানো? তিন, সদর দরজায় তালা দিলো কেন? আর দিলেও সেই চাবি দুটো কোথায়? হিসাব বলছে, একটা চাবি থাকতো অমরবাবুর কাছে আরেকটা বাড়ির বাকীদের জন্য। বাইরে যে যায় দেরাজ থেকে সে চাবি নিয়ে যায়। আর খুনের সময় বাড়ির বাইরে অম্বর আর অদৃশ। অম্বরের কাছে চাবি থাকলে তালা ভাঙতে হতো না। পড়ে রইলো অদৃশ।”

          “তাহলে কী অদৃশই খুন ক’রে আবার আধহাটা ফিরে যায়, অ্যালিবাই রাখার জন্য ? আর এই খুন করাটা প্রি-প্ল্যানিং ?” নিনাদ গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করে ওঠে।

     দামিনী পায়চারী না থামিয়েই বলে চলে, “কিন্তু কেন? সম্পত্তি?”

  কথাটা বলেই দামিনী পায়চারী বন্ধ ক’রে নিনাদ আর দেশাইয়ের দিকে ফিরে আদেশের ভঙ্গীতে বলে ওঠে, “তোরা কালই নরেন্দ্রপুর গিয়ে ওই দীপান্বিতাকে এখানে নিয়ে আসবি। অম্বরের কাছে অ্যাড্ড্রেস আছে। সরকার-বাড়ির বর্তমান পুত্রবধুর সাথে কথা বললাম, প্রাপ্তন পুত্রবধুর সাথেও কথা বললাম। ভাবী পুত্রবধু বাকী থাকবে কেন? অদৃশের উপর সিভিলড্রেসে নজর রাখতে বল কনস্টেবলকে। কিরে বুড়োভাম, বুঝেছিস কী করবি? সালা কামাক্ষ্যার ভেড়া কোথাকার !”

      শেষের কথাটা দামিনী, দেশাইয়ের দিকে ফিরে দাঁত চিপে বলতেই দেশাই মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ ক’রে ওঠে।

 চারঃ__________

          পুরো নিশ্চিন্তপুর ঘুটঘুটে অন্ধকার। সরকার বাড়ির সব ঘরের বড়ো আলো নিভে গেছে। প্রত্যেকের শোবার ঘরে জ্বলছে কেবলমাত্র লণ্ঠন। বৃষ্টিটা শুরু হয়েছে রাত্রি সাড়ে-আট’টার পর থেকে। থেকে থেকেই আকাশের বুক থেকে তীক্ষ্ণ আলোকরশ্মি নিয়ে বিদ্যুতের ঝলকানি আর তারসাথে স্বশব্দে বাজের খেলা হয়েই চলেছে। মুষলধারে বৃষ্টিটা না হলেও বর্ষণের গতি কম নয়।

মেঘের ডমরু ঘন বাআআজে

মেঘের ডমরু ঘন বাআআজে

বিজলি চমকায়,

    আমার বনছায়—-”,

       দামিনী নীচের বসবার ঘরের বড় সোফার এককোণে বাঁ পা-টা ডান পায়ের উপরে রেখে বসা। পরনে হালকা আকাশীরঙের সিল্ক-নেটের লং নাইট খোলা। কোমর ছাড়ানো মাথার ঘন ও লম্বা চুলগুলো পুরো খোলা পায়ে সাদারঙের রবারের চপ্পল। হাতে একটা বাহারি কাজের চিরুনি নিয়ে আপনমনে আলতো করে নিজের চুলগুলো আঁচড়ে চলেছে। নজরটা ঘরের জানলার দিকে; যার ওপারে শ্রাবণের বর্ষণমুখর রাত্রি। আর কণ্ঠে, ত্রিতাল তালের নজরুল গীতি।

 মনের ময়ূর যেন সাআআআজে।।

মেঘের ডমরু ঘন বাআআজে

        ‘সরকার বাড়ি’র ছোটবউ রান্নাঘরের থেকে হাতে একটা জলের জগ নিয়ে বসবার ঘরে এসে উপস্থিত হয়। সোফার সামনে একটা মাঝারি সাইজের টী-টেবিল আর তার ঠিক মাঝখানে রাখা একটা একটা পিতলের ক্যান্ডেলস্ট্যান্ড; যাতে একটা বড় ও মোটা সাদারঙের জ্বলন্ত মোমবাতি তার তরল মধুজ গলিয়ে মোমবাতির গোঁড়াতে জমা ক’রে চলেছে।  

          “রেওয়াজ করার সময় পাও?”রোহিণী বলে ওঠে। “যে প্রফেশনে তুমি আছো, তাতে তো মনে হয় না।”

     বাইরের দিক থেকে একঝকল রোহিণীকে দেখে নিয়ে সুরের লয়টা ঠিক রেখেই একটা ছোট্ট হাসিতে দামিনী উত্তর দেয়, সঘন শ্রাবণ গগনতলে—-, ওই রাতে ফিরে টুকটাক। তোমার রান্নাঘরের কাজ শেষ?”

          “হ্যাঁ। আর বীণা বাজানো?”

         “ওই, ব্রাঞ্চ থেকে রাতে ফিরে, রিমি ঝিমি ঝিম্নবধারা জলে—- ,কখনো ইমন বা মালকোষ। একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞাসা করার ছিল।”    

    রোহিণীও জলের জগটা সামনের টী-টেবিলের উপর রেখে দামিনীর পাশে বসে শান্ত গলায় বলে, “হ্যাঁ, বলো।”

         “চরণধ্বনি বাজায় কে সে—–! অনীশের আগে, অম্বরের সাথে, দীপান্বিতার বিয়ের কথা চলছিল?”

          “তুমি কিকরে জানলে? বড়দা বলেছে?”রোহিণী বেশ অবাক হয়ে প্রশ্নটা করে।

          “চরণধ্বনি বাজায় কে সে—–!  তন্দ্রা বলল।”

          “তুমি দেখা করেছো ওঁর সাথে?”

          “হুম।”দামিনী ছোট্ট ক’রে মাথা নাড়ে।

   বাইরে বাজ ও বিদ্যুতের সাথের বৃষ্টির প্রভাব বেশ বাড়তে শুরু করে দিয়েছে। বসবার ঘরের থাকা গ্র্যান্ডফাদার  ক্লকটি হঠাৎ একটা ‘ঢং’ শব্দে বেজে ওঠে। রাত সাড়ে-ন’টা। দোতলাতে অম্বরের ঘরো নিনাদ আর অম্বর নিজেদের মধ্যে খুন সংক্রান্ত আলোচনা করছে ঠিকই কিন্তু কানটা সজাগ দামিনীর গানের দিকে। অন্যদিকে দেশাই দামিনীর কথামতো সদর পুলিশ স্টেশনে বিশেষ কয়েকটা কাজে ব্যস্ত।

নয়ন লুটায় তারি লাআআজে

      রোহিণী, সোফাতে হেলান দিয়ে, বাঁ-পায়ের উপর ডান পা-টা তুলে নিয়ে বলে চলে, “এই দীপান্বিতা মেয়েটির বিয়ের সম্বন্ধ হুট ক’রে আসে। অদৃশের মায়ের বাপেরবাড়ি দিক থেকে এই সম্বন্ধটা আসে, বড়দার জন্য।”

          “নয়ন লুটায় তারি লাআআজে অম্বরের জন্য কি প্রথম থেকেই মেয়ে দেখা চলছিল?”

          “না। দীপান্বিতার বাবার সাথে মায়ের দাদার খুব ভালো সম্পর্ক আর একদিন তিনি, দীপান্বিতার বাবাকে নিয়ে এই বাড়িতে আসেন আর হুট ক’রে, বড়দার সাথে বিয়ের কথা তোলে। দীপান্বিতা দেখতে খুবই সুন্দরী কিন্তু বড়দা, জানালে বড়দা দীপান্বিতাকে না দেখেই জানিয়ে দেয়, এই মুহূর্তে সে বিয়ে করবে না আর করলেও নিজের পছন্দে করবে।”

     দামিনী কথাটা শুনে নিয়ে গানের ফাঁকে একটা সিগারেট জ্বেলে সেটার থেকে ধোঁয়া ছেড়ে প্রশ্ন ক’রে ওঠে, “তাহলে অম্বর মানা করার পর দীপান্বিতার সাথে অনীশের বিয়ের কথা চলে কীভাবে? মেঘের ডমরু ঘন বাআআজে

          “দীপান্বিতার বাবার এই পরিবারকে পছন্দ হয়, তাই তিনি মেজদার সাথে বিয়ের কথা চালায় আর সেটাও নাকি দীপান্বিতার কথাতেই।”

          “কিন্তু আমার কাছে খবর আছে, বিয়ের জোরটা নাকি অদৃশ দিয়েছিল?”

     কথাটা শুনে রোহিণী একটুও সময় না নিয়ে উত্তরে বলে, “জোর দিচ্ছিল মানে মেজদাকে। মেজদা রাজি ছিল না, তখন ওঁ বোঝায় যে কতদিন এইভাবে একা একা থাকবে, নতুন ক’রে আবার জীবন শুরু করতে বলে। অনেক বোঝানোর পর মেজদা রাজি হয়। কেন বলো তো দামিনী-দি? তুমি কি মনে করছো, এই খুনের পিছনে দীপান্বিতার হাত আছে?”

          “এখনো কিছুই ভাবিনি রোহিণী। গুনে গুনে গণনা করি, লাফিয়ে না। আআআআআ

       রোহিণী সামান্য মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ ক’রে নিয়ে বলে, “তোমার সাথে যে ডাক্তার দিদি এসেছেন, সে তো এখনো হসপিটাল মর্গে। আজ আসবে না?”

          “না। ওঁর কাজ চলছে। ওঁর টেলিফোনের অপেক্ষাতেই তো জেগে আছি।”

           “তাহলে ডাইনিং টেবিলে খাবার বাড়ি?”

           “মেঘের ডমরু ঘন বাআআজে হমম। চলো আমিও যাচ্ছি।”

    দামিনীর কথা শুনে, সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে, টী-টেবিলের উপর থেকে জলের জগটা হাতে তুলে রোহিণী একটা মুচকি হাসি হেসে নিয়ে বলে, “আমি জানি বড়দা বিয়েতে রাজি হয়নি কেন?”

          “কেন?”

          “আমার থেকেও কারণটা তুমি ভালোমতো জানো দামিনী-দি, বড়দার পছন্দ কে। অদৃশের বাবা-মাও বুঝে গেছিল যে বড়দার কার জন্য বিয়েতে অমত করে। কারণ মাঝে একবার বড়দার বিয়ের কথা উঠলে, সঙ্গে তোমার নামও ওঠে।”

         দামিনী, মুখে কোনো উত্তর না দিয়ে ঠোঁটের কোণে একটা হাসি হেসে আপনমনে গেয়ে চলে,

   বিজলি চমকায়,

    আমার বনছায়—-”,

মনের ময়ূর যেন সাআআআজে।।

মেঘের ডমরু ঘন বাআআজেমেঘের ডমরু ঘন বাআআজে

    দামিনী বাদে সকলে ঘুমে মত্ত। বৃষ্টির রেশটা কমেছে ঠিকই কিন্তু রাতের আকাশ থেকে ঘন মেঘ এখনো কাটেনি। নিশুতি রাতে ব্যাঙ ও অবিরাম ঝিঁঝিঁপোকার ডাকের জাথে শেয়ালের ডাকও ভেসে আসছে। দেশাই অনেকক্ষণ আগেই সদর পুলিসস্টেশন থেকে ফিরে এসেছে। অম্বর আর নিনাদ একঘরে, দেশাই অন্য ঘরে আর ছোট দম্পতি নিজের ঘরে। দামিনীর চোখে ঘুম নেই বললেই চলে। দামিনী বসবার ঘরে ঠায় সোফার উপর বসা হাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট। তাতে টান দিচ্ছে আর ধীরে ধীরে তার থেকে ধোঁয়া ছেড়ে চলেছে। হঠাৎ ডেক্সের উপর থাকা টেলিফোনটা বেজে উঠলো ঘড়িতে যখন বাজে ‘দু’টো-কুড়ি’। দামিনী তাড়াতাড়ি সোফা ছেড়ে উঠে গিয়ে টেলিফোনের রিসিভারটা তুলতেই বিপরীত দিক থেকে ভেসে আসে এক পরিচিতা কণ্ঠস্বর।

          “হ্যাঁ, ডাক্তার বলো। তোমার ফোনের অপেক্ষাই করছিলাম।”

          “………………।”

          “কী ! মানে এও হয় নাকি?”

          “…………………।”

          “ঠিকাছে আমি আসছি।”

    ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রেখে দামিনী বসবার ঘর থেকে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। প্রায় মিনিটদশেকের মধ্যে পরনের পোশাক বদলে, সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় উঠে, অম্বরের ঘরের দরজাতে বারদুয়েক টোকা দিতেই অম্বর দরজা খোলে। সৌরজার সাথে দেখা করতে মর্গে যাওয়ার কথা বলে নিয়ে দামিনী, অম্বরকে সাথে ক’রে  নীচে নেমে আসে। সদর দরজা খুলে দামিনী বাইরে বেরিয়ে যেতেই অম্বর বাড়ির সদর দরজা বন্ধ ক’রে। 

           সাদা অ্যাম্বাসেটরটা নিয়ে মর্গে পৌঁছতে সময় লাগলো প্রায় কুড়ি মিনিট। সৌরজা হসপিটালের বাইরের একটা দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল। রাতেও এই দোকান খোলা থাকে। সৌরজার সামনে গিয়ে দামিনী দাঁড়াতেই “চা খাবি?”জিজ্ঞাসা করতে দামিনী মাথা নেড়ে ‘না’ করে। চা শেষ করে, দাম মিটিয়ে দামিনীকে নিয়ে সৌরজা উপস্থিত হয় মর্গ রুমে।

          “বলো, এবার।”দামিনী তিনটে সাদা কাপড়ে ঢাকা মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে সৌরজাকে জিজ্ঞাসা ক’রে ওঠে।

   সৌরজা তিনটি মৃতদেহেরই মুখের সামনে থেকে কাপড়টা গলা পর্যন্ত নামিয়ে বলে ওঠে, “প্রত্যেকের গলাটা দেখ।”

          দামিনী ভালোরকম ভাবে দেখে নিয়ে বলে, “আগেরদিনও তো দেখলাম। নতুন ক’রে কী আর দেখার আছে ? কষকে নাইলনের দড়ি বেঁধে ঝোলানোর জন্য রক্ত জমে কালচে-নীল দাগ হয়ে গেছে।”

          “ভুলটা আমরা এইখানেই করি। কারণ এইখানেই দেখার বিষয়টা। খুন করা হয়েছে নীলকণ্ঠ বিষ দিয়ে।”

   দামিনী একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সৌরজার দিকে। অন্যদিকে সৌরজা বলে চলে, “অ্যাকোনাট নীলকণ্ঠ বিষ।”

          “অ্যাকোনাট?” দামিনী সামান্য অবাক ও কৌতুহল মেশানো স্বরে জিজ্ঞাসা করে।

          “ইয়েস। পোস্টমর্টেমে এই বিষকে শনাক্ত করা অসম্ভব। কারণ এই বিষের প্রধান লক্ষ্মণগুলি ফরেনসিক ডক্টররা না জানলে, এই নীলকণ্ঠ বিষ রিপোর্টে ধরাই দেবে না।”

     কথাটা বলেই সৌরজা মাথার কাছ থেকে সোজা চলে যায়, তিনটি মৃতদেহের পায়ের কাছে। তিনজনের পায়ের থেকে সাদা কাপড় তুলে নিয়ে বলে, “প্রত্যেকজনের নখ দ্যাখ, স্বাভাবিক। ঠোঁট, চোখ, জিভ কোথাও বিষের ট্রেস নেই। কারণ এই নীলকণ্ঠ বিষ একমাত্র ধরা দেয় গলার কণ্ঠীতে। পুরো বডিতে গলা বাদে আর কোথাও বিষের লক্ষ্মণ পাবি না। কারণ অ্যাকোনাট নীলকণ্ঠ বিষ মানুষের গলাতে এফেক্ট করে। এবার গলা পরীক্ষা করেও নীলকণ্ঠ বিষকে ট্রেস করা যায় না কারণ অ্যাকোনাট বিষ রক্তের সাথে নয় রক্তরসের সাথে মানে সিরামের মধ্যে বডিতে মিশে থাকে। যারজন্য, গলা যখন আমি পরীক্ষা করি, ফাঁস বাদে অন্য রিপোর্ট পাই না। হঠাৎ নজর পড়লো, প্রত্যেকের বডি ডিকম্পোজ হয়ে যাওয়ার পরেও ভেজা কেন! মনে হচ্ছে মৃতদেহ ঘেমেই চলেছে। যেটা হওয়ার কথা নয়। হঠাৎ এই অ্যাকোনাট বিষের কথা মাথায় আসে। সিরাম চেক করা মাত্রই নীলকণ্ঠ বিষকে ট্রেস করতে পারি। খুব ধীরে এই নীলকণ্ঠ বিষ কাজ করলেও, সঙ্গে সঙ্গে মানুষ মারে না। বডিতে ইঞ্জেক্ট করার এক থেকে দেড়ঘণ্টার ভিতর কাজ শুরু করে। অস্বাভাবিক মাথার যন্ত্রণা তারপর ঘাম। অ্যানালাইসিস ক’রে বুঝলাম, বিষ দেওয়া হয়েছে রাত্রি সাড়ে-ন’টা থেকে এগারোটার ভিতর। বিষ কাজ শুরু করে রাত বারো’টার পর থেকে। সকলে মারা যায় রাত দু’টো থেকে আড়াইটের ভিতর আর তারপর বডি ঝোলানো হয়।”

     দামিনী পুরোটা শুনে নিয়ে গম্ভীরস্বরে বলে, “গলাতে নীলকণ্ঠ বিষের ট্রেস থাকে বলেই খুনি খুন করে বডি ঝোলায়?”

          “ইটজ্যাক্টলি।”সৌরজা উৎসাহের সাথে উত্তর দেয়। “না ঝুলিয়ে যদি বডি এমনি ফেলে যেত খুনি, তাহলেও তো গলাতে এইরকম কালচে দাগ হতোই। সেটার থেকে অ্যাকোনাট বিষকে শনাক্ত করতে সহজ হতো। কারণ ডক্টরদের মনে হত বডিতে এইরকম দাগ কেন? যাতে বুঝতে না পারে তারজন্য বডিকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। গলাতে এই বিষ থাকে ব’লে, অনেক ডাক্তার এই নীলকণ্ঠ বিষকে ‘ব্লু-থ্রোট’ নামে ডাকে; বাংলায় দংশনে নীলকণ্ঠ।”

          “এই নীলকণ্ঠ বিষ কী কিনতে পাওয়া যায়।”

          “না। এটা কৃত্তিম উপায় তৈরী। তিনটি নীলকণ্ঠ বিষাক্তগাছের পাতা আর শিকড় একসাথে মিশ্রন ক’রে; পেস্টিসাইড ফর্মুলাতে তৈরী হয়। কিন্তু সেটাও বিশেষ কাজের জন্য। কিন্তু কেমিস্ট প্রোডাক্টস ছাড়া তৈরী সম্ভব নয়।”

    কথাগুলো শুনে দামিনীর মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে। সৌরজার দিকে স্থির নজরে তাকাতেই সৌরজা প্রশ্ন করে ওঠে, “আমি যা ভাবছি, সেটাই কি তোর মাথায় চলছে?”

      দামিনী ছোট্ট করে মাথা নেড়ে উত্তর দেয়, “আপাতত।”

          “একটা কথা মানিস তো যে খুন যেখানে হচ্ছে, সেখানে ‘মোটিভ’ ব’লেও একটা শব্দ আছে।”

          “একদম। খুন করাটা তো আর মুড়ি-মুড়কি নয়। প্রশ্ন এখানে মোটিভটা কী? খুনি খুন ক’রে আত্মহত্যার করার ইঙ্গিত তো দেয়নি। খুন যে হয়েছে এটা বোঝানোর জন্যই খুনি এতো কাঠখড় পুরিয়েছে?”

          “ইয়েস। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, কেন? মোটিভটা কি কেবলই প্রপার্টি? নাকি প্রপার্টিটা শিখণ্ডী হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আর উল্টোদিকে ভীষ্মের পতন।”

          “হ্যাঁ, ডাক্তার, হ্যাঁ। প্রপার্টিটা শিখণ্ডী। কৃষ্ণ আর অর্জুনটা কে?”

****************************************

                   পরেরদিন নাগাদ সদর থানাতে দামিনী হাতে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে থাকা নীলকণ্ঠ বিষের নাম আর তাঁর সাথে তৈরী পদ্ধতিগুলো ভালোমতো পড়ে নিচ্ছে। বিপরীত দিকের চেয়ারে সৌরজা বসা। নিনাদ আর দেশাই, অম্বরের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে নরেন্দ্রপুর গেছে, দীপান্বিতাকে আনতে। অন্যদিকে অম্বর দামিনীর কথামতো জয়ন্ত রায় আর বিএম কলেজের আরেকজন ল্যাব স্টাফ নাম রজত পালকে আনতে গেছে। এই রজতের সাথে অনীশের বেশ ভালো বন্ধুত্ব ছিল।

    প্রায় মিনিটকুড়ি সময় ধরে, নীলকণ্ঠ বিষের যাবতীয় তথ্য পড়ে, দামিনী, সৌরজার কাছে জানতে চায়, এই অ্যাকোনাট বা নীলকণ্ঠ বিষ মানুষের শরীরে প্রয়োগ হয় কি করে। উত্তরে সৌরজা জানায়, কৃত্তিম উপায়ে এই বিষ তৈরীর হলে সেটা তরল নয়, জেলির মতো থকথকে থাকে। দুটো উপায়ে শরীরে প্রয়োগ সম্ভব। প্রথম কোনো কিছু খাবারের সাথে মিশিয়ে আর দ্বিতীয়, শুকিয়ে। সৌরজা আরও জানায় যে, এই সরকার পরিবারকে খাইয়ে নয়, বরং অ্যাকোনাট শুঁকিয়ে খুন করা হয়েছে এবং খুনি এই বিষের সম্পর্কে অল্প নয়, বিস্তরে জানে।

   সৌরজা আরও কিছু বলতে যেতে এমন সময়, একজন কনস্টেবল অফিস ঘরে ঢুকে স্যালুট ক’রে নিয়ে দামিনীকে জানায়, গ্রামের একজন তাঁর সাথে কথা বলতে এসেছে। দামিনী জিজ্ঞাসা করাতে কনস্টেবলটি জানায়, ব্যক্তির নাম, প্রবীণ চন্দ। গ্রামে জিজ্ঞাসাবাদের সময়, এই ব্যক্তি এক অদ্ভুত কথা জানালে কনস্টেবলটি তাঁকে থানাতে নিয়ে আসে।

    কথাটা শুনে দামিনী আর সৌরজা একসাথে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে জেরা ঘরে এসে উপস্থিত হয়। লোকটির বয়স ত্রিশ কি বত্রিশ, মাঝারি উচ্চতা, গায়ের রঙ কালো।

          “কী বলবে বলো।” দামিনী বলতেই ব্যক্তিটি বলে ওঠে, “ম্যাডাম, খুন হবার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই রাতের দিকে, এক অল্পবয়সী মেয়েকে আমি সরকারবাড়ির আশেপাশে ঘুরতে দেখেছি। দেখে মনে হচ্ছিল, যেন সরকার বাড়ির উপর নজর রাখছে।”

          “মেয়েটিকে চেনো?”

          “না। তবে এই গ্রামের নয়। ওই মেয়েটিকে আমি পরে অনীশের সাথে কথা বলতেও দেখছি।”

          “কোথায়?”

          “আমাদের চণ্ডীতলার যে পোড়ো মন্দিরটা আছে ওখানে।”

          “দেখলে চিনতে পারবে?”

          “হ্যাঁ।”

   প্রবীণ কথাটা বলতেই দামিনী, কনস্টেবলটিকে সরকারবাড়ির ফাইলটা আনতে বলে। ঘর থেকে বেরিয়ে একমিনিটের মধ্যে হলুদরঙের একটা কভারফাইল নিয়ে এসে দামিনীর হাতে দিতেই দামিনী তাঁর থেকে তন্দ্রার ছবিটা বের করে, প্রবীণের সামনে ধরতেই প্রবীণ মাথা নেড়ে ‘না’ ক’রে নিয়ে জানায় এই মেয়ে সেই মেয়ে নয়। তন্দ্রাকে সে ভালমতোই চেনে। হঠাৎ দামিনীর হাতে থাকা তিনটে ছবির মধ্যে একটা ছবিতে প্রবীণের চোখ পড়তেই, “ম্যাডাম, এই মেয়েটা।” বলে ওঠে।

          “তুমি ঠিক বলছ, এই মেয়েটাই?”

          “হ্যাঁ।”

    প্রবীণ চলে ঘর থেকে বেরোতেই থানার আরেকজন কনস্টেবল জেরা ঘরে ঢুকে দামিনীকে জানায়, নিনাদ ও দেশাই, দীপান্বিতাকে নিয়ে এসে অফিসরুমে বসিয়েছে।

     দামিনে, সৌরজাকে নিয়ে অফিসরুমে এসে ঢুকতেই দীপান্বিতা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। গায়ের রঙ ফর্সা, ছিপছিপে গড়ন, মাথার চুল হস্টেল খোঁপায় বাঁধা, পরনে কালো ও ধূসর রঙ মেশানো সিল্কের শাড়ি। দীপান্বিতার মুখটা দেখে দামিনী সামান্য কপালটা কুঁচকে নিয়ে, আবার স্বাভাবিক মুখের চাওনি করে, “বোসো”বলে তাঁর কাছে এগিয়ে যায়।

          “অনীশ আর তাঁর বাবা মা যে খুন হয়েছে তা তুমি জানো?”

          “হ্যাঁ। খবরের কাগজে দেখেছি।”

          “তোমার সাথে প্রথমে অম্বরের বিয়ে ঠিক হয়েছিল?”

          “হ্যাঁ। কিন্তু অম্বর বিয়েতে রাজি ছিল না।”

          “তারপর, অনীশকে বিয়ে করতে রাজি হলে কেন? তুমি একজন অবিবাহিতা মেয়ে হয়ে একজন ডিভোর্সী ছেলে বিয়ে করতে রাজি হলে?”

          “হ্যাঁ, হলাম। অনীশ বেশ ভালো মনের ছেলে আর পরিবারটাও ভালো।”

          “কথাটা এমনভাবে বললে, যেন অনীশকে অনেকদিন ধরে চেনো।”

          “তেমন কোনো ব্যাপার নেই। যে ভালো সে সব সময়ই ভালো।”

          “অনীশের স্ত্রীয়ের সাথে কথা হয়েছে কোনদিন?”

          “না। কেবল নাম জানি, তন্দ্রা।”

          “আচ্ছা, এই খুন কে করতে পারে?”

    দামিনীর প্রশ্নটা শুনে দীপান্বিতা সামান্য কপাল কুঁচকে নিয়ে উত্তরে বলে, “যে সত্যি লুকাতে চায়, সেই খুন করেছে।”

          “কে?”

          “সেটা খোঁজার দায়িত্ব আপনার। যাইহোক, আপনাদের আর কোনো প্রশ্ন আছে, তাহলে আমি উঠবো।”

          “এসো।”

    দামিনী কথাটা বলতেই সৌরজা বেশ চমকে ওঠে। নিনাদ আর দেশাই দীপান্বিতাকে নিয়ে ঘর থেকে চলে যেতেই সৌরজা জিজ্ঞাসা করে ওঠে, “কী রে, ছেড়ে দিলি কেন? দীপান্বিতাই-তো পোড়ো মন্দিরের সামনে অনীশের সাথে দেখা করতো।”

      দামিনী, একটা সিগারেট জ্বেলে নিয়ে সামান্য ধোঁয়া ছেড়ে বলে, “কয়েদিনের পরিচয়ে হবু বরের সাথে দেখা করতে যাওয়া আর রাতেরবেলা সরকারবাড়ি তাক করা হিসাব মিলছে না।”

          “আর, তুই দীপান্বিতাকে দেখে হুট করে কপাল কুঁচকালি কেন?”

          “ছবিতে অতটা বুঝতে পারিনি কিন্তু সামানা-সামনি দেখে দীপান্বিতাকে খুন চেনা চেনা লাগল। কোথাও কি দেখেছি আগে?”

     ইতিমধ্যে অম্বর, জয়ন্ত রায় আর রজত চন্দকে সাথে ক’রে নিয়ে ঘরে আসতেই দামিনী চোখের ইশারা ক’রে দুইজনকে দুইঘরে বসাতে বলে আর দেশাইকে, পুলিশ নিয়ে তন্দ্রার বাড়ি সার্চ করার আদেশ দেয়। প্রথমে দামিনী কথা বলে যায় জয়ন্তর সঙ্গে।

    জয়ন্ত একটা চেয়ারে বসে, দুটো হাত টেবিলের উপর রেখে দামিনীর দিকে তাকিয়ে।

          “অদৃশ ছেলে কেমন?”দামিনী শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করে।

   উত্তরে জয়ন্ত বলে, “খুবই ভালো ছেলে।”

          “অদৃশ যে আধহাটা যাবে এটা তুমি জানতে না?”

          “একদমই না। জানলে কী আমি বলতাম না?”

          “কিন্তু অদৃশ বলছে ওঁ নাকি জানিয়েছিল।”

          “না ম্যাম, সত্যিই বলছি, আমি জানতাম না। মথুরাপুর থেকে যে আদহাটায় যাবে এমন কিছুই ওঁ বলেনি।”

          “অদৃশের বাবা-মা বলেছিল? কারণ খুনের রাতে তুমিও তো ওই বাড়িতে যাও। গ্রামের লোকেরা-তো সেটাই বলছে।”

          “হ্যাঁ গিয়েছলাম, কিন্তু রাতে সাড়ে-আট’টাতে আমি বেরিয়ে আসি। ওনারা কিছুই বলেননি।”

  ‘নাওয়াইতু আন্উসাল্লিয়া লিল্লাহি তাআলা থমথমে অফিসঘরে গ্রামের মসজিদের থেকে দুপুরের আজান ডাকের সুর ভেসে আসে। সেইসময়েই কয়েকজন মুসলিম কনস্টেবল অফিসরুমে ঢুকে নামাচ পড়ার বিরতি চাইলে দামিনী মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ করে।

    দামিনী, জয়ন্তকে আর কোনোকিছু জিজ্ঞাসা না ক’রে যেতে বলে। জয়ন্ত চলে যেতেই অম্বর, রজতকে নিয়ে আসে অফিসরুমে।

   রজত দামিনীর সামনে থাকা চেয়ারতে বসতেই দামিনী জিজ্ঞাসা করে, “সম্প্রতি অনীশের মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলেন? আপনি আর ওঁ তো অনেকক্ষণ একসাথে সময় কাটাতেন।”

   অম্বর, দামিনীর ডানপাশে দাঁড়িয়ে।

      রজতবাবু সামান্য মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ ক’রে নিয়ে বলে, “পরিবর্তন তো হয়েছিল।”

          “জিজ্ঞাসা করেছিলেন?”

          “করেছিলাম। কিন্তু লাভ হয়নি। কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে খুব চিন্তিত ছিল। আমি অনেকবার জিজ্ঞাসা করি, কিন্তু উত্তরে কিছুই জানায়নি। হেঁয়ালি ক’রে বলতো, সম্পর্ক খুবই জটিল। লাভ কেন, অ্যারেঞ্জও চিঁর ধরে।”

          “তন্দ্রার ব্যাপারে কিছু?”

          “সঠিক বলতে পারবো না। হতেও পারে আবার অঙ্গদের জন্যও হতে পারে। দু’মাস যাবৎ ছেলের সাথে দ্যাখা-সাক্ষাৎ নেই।”

          “ওদের দুইজনের মধ্যে ডিভোর্স হবার পর তো তদ্রা বি.এম. কলেজের চাকরিটা ছেড়ে দেয়?”

          “না। ডিভোর্সের আগেই। কিন্তু–”

          “কিন্তু?”

          “অনীশের বিয়ে করার ইচ্ছা কিন্তু ছিল না আর আমার মনে হয় এটা দীপান্বিতাও জানতো। যারজন্যে দীপান্বিতাও এই বিয়ের তারিখ বার বার চেঞ্জ করছিল।”

          “আর অনীশের ড্রিংক করা?”

          “শেষের দিকে সেটার ঘোরে পড়েছিল। বারণ করি। ওটা খেত ছেলের শোকে।”

  দামিনী কিছুক্ষণ চিন্তা ক’রে নিয়ে রজত চন্দকে যেতে বলে। তিনি ঘর থেকে চলে যেতেই অম্বরের দিকে ফিরে দামিনী বলে ওঠে, “সার্চের সময় এসে গেছে অম্বর।” 

          পুলিশ কনস্টেবলদের নিয়ে দেশাই গেল তন্দ্রার বাড়িতে আর নিনাদ গেল সরকার বাড়িতে, বাড়ি সার্চ করতে। সরকারবাড়িতে দামিনী স্বয়ং উপস্থিত। প্রত্যেকের ঘর খানাতল্লাশি শুরু হলে অম্বর কপালে হাত দিয়ে সোফাতে বসে পড়ে। সে যেন ভাবতে পারছে না, এতদিন সে অন্যের বাড়ি খানাতল্লাশি করে এসেছে আজ সেই জিনিস তাঁর বাড়িতেও। রোহিণী, দামিনীর কাছে এগিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ক্রমাগত বলে চলেছে, “দামিনী-দি, তুমি অদৃশকে কেন সন্দেহ করছো? খুনের বিষে পেস্টিসাইড ফর্মুলায় তৈরী হয়েছে বলেই? অদৃশ নিজের দাদাদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, আমার থেকেও বেশি। দামিনী-দি—!”

           “রোহিণী এই মুহূর্তে আমি অন ডিউটি। তাকিয়ে দ্যাখো, তোমাদের বড়দাও চুপচাপ বসে পড়েছে, আমার কাজে বাধা দিচ্ছে না।”

          “কিন্তু খুনের সময় ওঁ বাইরে দামিনী-দি।”

          “সেটা তুমি বলছ, কোনো প্রমাণ নেই। আদাহাটা থেকে মাঝরাতে যে অদৃশ আসবে না, এমন কোনো গ্যারান্টি আছে?”

          “কিন্তু কেন খুন করবে, সেটা ভেবে দ্যাখো।”

          “কোটি টাকার সম্পত্তি, সেটা যথেষ্ট কারণ নয় রোহিণী।”

    দামিনী বলামাত্রই রোহিণী ছুটে অম্বরের পায়ের কাছে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ে।

   শোবার ঘর থেকে রান্নাঘর, ক্ষুব্ধ নেকড়ের মতো কনস্টেবল আর নিনাদ খুনের প্রমাণ সন্ধান ক’রে চলেছে।

          রোহিণী বলে,“বড়দা, আমার থেকে তো তুমি, তোমার ছোটভাইকে চেনো। তোমারও তাই মনে হয়, প্রপার্টির জন্য তোমার ভাই খুন করবে বাবা মা আর মেজদাকে?”

    অম্বর মুখের থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে শান্ত গলায় উত্তর দেয়, “আমি কিছুই ভাবতে পারছি না রোহিণী।”

   হঠাৎ নিনাদ সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসতেই দামিনী জিজ্ঞাসা করে, কিছু পাওয়া গেল কিনা। নিনাদ, দামিনীর মুখের সামনে ডান হাত তুলে ধরতেই অম্বরের চোখ বড়বড় হয়ে ওঠে। একটা পাঁচ সিসি.এম.এল-য়ের কাঁচের শিশি। ভিতরে হালকা পিত্তিরঙের থকথকে জেলি। অদৃশের ঘরের দেরাজের একদম ভিতরের কোণাতে লুকানো ছিল। দামিনী শিশিটাকে হাতে নিয়ে সেটাকে ফরেনসিক টেস্ট করতে সৌরজার কাছে পাঠাতে বলে।

 অন্যদিকে অম্বরের আদেশে নিনাদ, অদৃশকে পুলিশভ্যানে তোলে।

পাঁচঃ_________

       টেস্ট করতে বেশি সময় লাগলো না। সৌরজা জানায়, সেটা নীলকণ্ঠ বিষই। খবর পেয়ে দামিনীর জোরকদমে জেরা শুরু করতেই অদৃশ কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে, সে খুন করেনি। সার তৈরী করতে সে ওটা স্যাম্পেল হিসাবে রেখেছিল। খুনের ব্যাপারে সে কিচ্ছু জানে না।

          “সদর দরজার চাবি কোথায় অদৃশ?”অম্বর প্রশ্ন করে।

          “আমায় বিশ্বাস করো, আমি জানি না। আমি চাবি নিয়ে মথুরাপুর যাইনি। আর মা, বাবা, মেজদাকে যদি অ্যাকোনাট নীলকণ্ঠ বিষ দিয়ে খুন করা হয় তাহলে সেই নীলকণ্ঠ বিষ শুধু আমার কাছে না, তন্দ্রা বৌদির কাছেও আছে।”

           “মানে?”

           “তুমি কি ভুলে গেছো, দাদা আর তন্দ্রা বৌদি দুইজনই কেমিস্ট ল্যাবের ক্লার্ক ছিল। আর তন্দ্রা বৌদি দাদার কাছে মাসদুয়েক আগে অ্যাকোনাট নীলকণ্ঠ বিষ চেয়েছিল আর তখন দাদা আমার কাছে এসে বলে যে, আমি যে অ্যাকোনাট নীলকণ্ঠ বিষ তৈরী করেছি সেটা আছে কিনা। আমি তখন ওটার অর্ধেক দাদাকে দিই আর সেটা দাদা তন্দ্রা বৌদিকে দেয়।”

       ইতিমধ্যে দেশাই জেরা ঘরে ঢুকে দামিনীকে একটা খবর দিতেই দামিনী চমকে ওঠে। তন্দ্রার বাড়ি থেকেও, অ্যাকোনাট নীলকণ্ঠ বিষ আর সাথে সরকার-বাড়ির সদর দরজার চাবি পাওয়া গেছে। কেমিস্ট ল্যাবে কাজ করার জন্য, তন্দ্রা নাকি অনীশকে নীলকণ্ঠ বিষটা দিতে বলে আর দুইমাস আগে অনীশ এটা দেয়। কিন্তু চাবির ব্যাপারে কিছুই জানে না। অনেকবার তন্দ্রাকে জেরা করেও চাবির ব্যাপারে সে কিছুতেই স্বীকার করছে না।

     সবকিছু শুনে দামিনী মুখে কিছু না বলে, ঘর থেকে বেরিয়ে পুলিশ স্টেশনের বাইরে আসতেই হঠাৎ দ্যাখে দীপান্বিতা, পুলিশস্টেশনের গেট দিয়ে ভিতরে আসছে। হাতে একটা চ্যানেলফাইল। দামিনীর কাছে এগিয়ে এসে, “আপনার সাথে কিছু কথা আছে,” বলতেই দামিনী দীপান্বিতাকে নিয়ে অফিসরুমে ঢোকে।

       দামিনী চেয়ারে বসা, বিপরীত দিকের দুটো চেয়ারের একটাতে দীপান্বিতা বসা। অম্বর-নিনাদ আর দেশাই দামিনীর ডায়ে ও বাঁয়ে দাঁড়ানো।

         দীপান্বিতা হাতের চ্যানেল ফাইলটা খুলে নিয়ে বলে, “বিগত দুইমাস আগে, জাফর শেখ নামের এক ছেলে, কেমিস্টল্যাবে খুব ঘোরাঘুরি করছিল। এই জাফরের বসদবাড়ি মথুরাপুরে। মথুরাপুরে একটা সারের দোকান আছে ছিল, আয় ভালোই হচ্ছিল। কিন্তু বিগত দেড়বছর জাফরের আর পাত্তা নেই। এই জাফরের সাথে, অদৃশের খুব ভাব। এমন কি সরকার-বাড়িতে যাতায়াতও করে। বাড়িতে বাবা মা আছে। তাঁরা কেউই জানে না, জাফর কোথায়।”

     দামিনীর স্থির দৃষ্টি দীপান্বিতার দিকে। দীপান্বিতা একটা ছবি বের করে নিয়ে দামিনীর সামনে এগিয়ে দিয়ে বলে, “এটা হল, জাফরের ছবি। বিদ্যার্থী কলেজ থেকে রসায়নে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে। রাজাবাজারে এঁর মামার বাড়ি আর আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, রাজাবাজারে নেই। পড়ে রইলো, কাশিমবাজার। ওখানে খোঁজ করলে জাফরকে পেতে পারেন। আর এই জাফরকে তুললেই খুনের রহস্য সমাধান।”

        মুহূর্তের মধ্যে দামিনীর ঠোঁটের কোণায় হাসি ধরা দেয়। এই হাসি, খুনি ধরার নয়, এই হাসি দীপান্বিতাকে চিনতে পারার।

       শান্ত গলায় দামিনী জিজ্ঞাসা করে ওঠে, “জাফরকে ধরতে হলে, ধরো, আমার এবার নৈহাটি ফেরার সময় হয়ে গেছে।”

::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::

             দুপুরের দিকে বিপুলবাবু সমেত সরকার-বাড়ির হত্যাকান্ডে জড়িত সবাই সদর থানার বড় অফিসরুমে দাঁড়িয়ে। সবাই বলতে, বিপুলবাবু, সাথে দুইজন কনস্টেবল, তন্দ্রা, তাঁর বাবা-মা, অদৃশ, রোহিণী, রোহিণীর বাবা-মা, বংশী, কনক, দীপান্বিতা, জয়ন্ত, নিনাদ, অম্বর, দেশাই, সৌরজা আর দামিনী।

          দামিনী বলে, “খুন এখানে তিনটে নয়, হয়েছে চারটে।”

     কথাটা বলামাত্রই সৌরজা আর দীপান্বিতা বাদে সকলে বেশ অবাক হয়।

          “উপর থেকে সরকার পরিবারকে ভালো মনে হলেও ভিতরে পচন ধরে গিয়েছিল। খুন হুট ক’রে করা হয়নি, বরং খুন করা হয়েছে, ঠাণ্ডা মাথায়, প্ল্যান ক’রে। এই কেসে প্রথম সন্দেহ হয় আমার অনীশের উপরেই। কারণ অনীশ বিয়ে আর সম্পত্তির হাত থেকে বাঁচার জন্য কি, কিছু ভুল পদক্ষেপ নিতে চলেছিল? নিজেকে কি শেষ করতে চাইছিল? কিন্তু পরে বুঝলাম, না। অনীশ নিজের পরিবারের পচন বুঝে গিয়েছিল আর সেটার থেকে বাঁচার জন্য সে একটা ব্যবস্থাও নিয়েছিল। খুনি বুঝতে পারে, তাঁর মিথ্যা আর বেশি দিন লুকিয়ে রাখতে পারবে না, তাই সে ঠিক ক’রে সময় এসেছে সত্যকে গোপন করার। এখানে তিনটি নীলকণ্ঠ বিষয় আমার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। বডি ঝোলানো, ফোনের রিসিভার নামানো আর দরজায় তালা। কিন্তু ডক্টর সৌরজা একটা ফিঙ্গার প্রিন্টের রিপোর্ট হাতে দিতেই কেস পুরো ঘুরে যায়। টেলিফোনের রিসিভারে কনকের ফিঙ্গারপ্রিন্ট।”

    কথাটা বলামাত্রই সকলের নজর ঘুরে যায় কনকের দিকে। কনক ভয়ে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে, “আমি খুন করিনি।”

          “খুন করেছো, এমন তো কিছু বলিনি। আর সেটা করোনি তা আমি জানি।”দামিনী গম্ভীরস্বরে উত্তর দেয়। “খুন যে হয়েছে এটা তুমি জানতে। কারণ জেরা করার সময়, তুমি বলেছিলে রোহিণীর বাবার শরীর খারাপের কথা তুমি জানতে। কিন্তু ভরদ্বাজবাবুর কথা শুনলে জানা যায়, এই কথা বাড়ির লোক ছাড়া কেউ জানতো না এমন কি রোহিণী আর অদৃশ যে ভরদ্বাজবাবুর সাথে দেখা করতে যাবে, এটা তিনিও জানতেন না। তুমি জানলে কী করে? জানবে তখনই যখন ওখান থেকে তোমাক কেউ ফোন করে জানাবে। আর ফোনটা করেছিল, রোহিণী।”

       অদৃশ চমকে উঠে রোহিণীর দিকে তাকাতেই রোহিণী মাথা নামায়।

          “রোহিণী, লুকিয়ে আর লাভ নেই।” দামিনী বলে ওঠে। “চার-নম্বর খুনটা হল সম্পর্কের। কিন্তু এরপরের অংশটা বলতে গেলে যার নাম বলতেই হয় সে হল, দীপান্বিতা। সে না থাকলে এই কেসের সমাধান করতে আমার আরও সময় লাগতো। দীপান্বিতাকে ছবিতে দেখে আমি অতটা চিনতে পারিনি। চিনলাম, সামনা-সামনি দেখে। এর আসল নাম শর্বরী মুখার্জি। একবার ব্রাঞ্চ সেমিনারে সেরা স্ট্রিং-অপারেশন ইনভেস্টিগেটরা মেডেল পায়, তারমধ্যে একজন হল, ব্রাঞ্চ সাব-ইনস্পেক্টর শর্বরী।”

     দামিনী থামতেই দীপান্বিতা ওরফে শর্বরী বলে ওঠে, “আমি আর অনীশ নরেন্দ্রপুর কলেজে পড়তাম। সাবজেক্ট আলাদা হলেও আমাদের মধ্যে একটা ভালো বন্ধুত্ব তৈরী হয়। তারপর আমি মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিয়ে ব্রাঞ্চ লাইনে গেলে অনীশের সাথে দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ পাঁচমাস আগে নরেদ্রপুরে আবার অনীশের সাথে আমার দেখা হয় একটা মার্কেটে। আর তখনই অনীশ নিজের জীবনের যাবতীয় কথা আমাকে বলে আর সাথে এটাও বলে, সরকার-বাড়িতে কোনো একটা ষড়যন্ত্র চলছে খুন করার। আমার কাছে সাহায্য চাইলে আমি দীপান্বিতা হয়ে স্ট্রিং-অপারেশনের কাজ আরম্ভ করি। এবার আমার প্রয়োজন ছিল ওই বাড়িতে যেনতেন প্রকারে ঢোকার। আমি বলি, বাড়ির বড়ছেলে মানে অম্বর স্যারের সাথে আমার কথা পাড়তে। অনীশ আর তাঁর মা ছাড়া আমার পরিচয় আর কেউ জানতো না। কিন্তু অম্বর স্যার আমাকে বিয়ে করতে আপত্তি জানাতেই আমি মুশকিলে পড়ি। কী উপায়ে সরকার-পরিবারে ঢুকবো? অবশেষে আমি, অনীশের সাথে দেখা ক’রে বলি, যে তাঁর মা যেন, আমার বাবার সাথে কথা ব’লে ওঁর আর আমার বিয়ের কথা চালায় আর বিয়ের আগেই আমি এই কেসের ক্লু সামনে আনব। বিয়ে করার কোনো ব্যাপারই আসবে না। আমাদের মধ্যে যাবতীয় কথা চলতো টেলিফোনে অথবা সামনা-সামনি হলেও সেটা পোড়ো মন্দিরের ধারে। এইসময় হঠাৎ লক্ষ্য করি, জাফর প্রায়শই সরকার-বাড়িতে আসতে শুরু করেছে। সন্দেহ দাঁড়ায় অদৃশের উপর। কিন্তু খোঁজ নিলে জানতে পারি এই ছেলে মথুরাপুরের আর রোহিণীর বাপেরবাড়ির এলাকার।”

          “আর ছাত্র হল বিদ্যার্থী কলেজের।” শর্বরী থামতেই দামিনী ব’লে ওঠে। “সেই কলেজ, যে কলেজে রোহিণী পড়াশুনা করেছে। সেখান থেকেই এঁদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরী হয়। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায়, হিন্দু-মুসলিম। অবশেষে রোহিণী বাধ্য হয় অদৃশকে বিয়ে করতে। কিন্তু বিয়ের পর রোহিণী বুঝল, সরকার-পরিবারে ভাইয়ে ভাইয়ে ভীষণ মিল আর টাকার অঙ্কটাও কম নয়। ডিভোর্স হলে এতো বড় সম্পত্তি, জাফরের কাছে সে পাবে না। তাই টাকাটাও থাকলো সঙ্গে পুরাতন প্রেমিকও থাকবে এমন একটা উপায় তাঁকে করতে হবে। উপায় ? ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ লাগানো। প্রথম টার্গেট, তন্দ্রা। অনীশ কোনো একটি মেয়ের সাথে প্রেম করছে, এই সন্দেহ তন্দ্রার মনে ঢোকায় রোহিণী আর তন্দ্রা সেই কথা ডিভোর্সের পর অনীশকে বললে, অনীশ বুঝতে পারে, সরকার-পরিবারে নীলকণ্ঠ বিষ ঢালতে দংশন-কন্যাকে তাঁরা সাধ করে নিয়ে এসেছে। তারজন্যই শর্বরীকে সন্ধান করতে বলে। তন্দ্রা যে অ্যাকোনাট নীলকণ্ঠ বিষ চেয়েছে সেটা যখন অনীশ, অদৃশকে গিয়ে জানায় তখনই রোহিণী প্ল্যান কষে নেয় এই সেই সুযোগ। হুট করে বাপেরবাড়ি যাওয়ার প্ল্যান। আমার প্রথম সন্দেহ হল, বাপেরবাড়ি থেকে কাজেরসুত্রে অদৃশকে যেতে হল আদহাটা, কিন্তু সাথে রোহিণী গেল কেন? সে তো ফিরে আসতে পারতো। কারণ রোহিণীর গোপনে ফোন করার প্রয়োজন ছিল। আদহাটা পৌঁছে সেখানকার কোয়াটার থেকে শ্বশুরবাড়ি ফোন ক’রে, কনককে দায়িত্ব দেয় সদর দরজা চাবি যেন জাফরের হাতে দিয়ে দেয়। কারণ খুনের দিন সকলে কনককে সরকার-বাড়ি থেকে বেরোতে দেখেছে রাত সাড়ে-দশটায়। বলো কনকদি ঠিক বললাম তো?”

          দামিনী হুঙ্কার দিতেই কনক কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে, “রোহিণী আমাকে ফোন করে বলে যে, দেরাজ থেকে সদর দরজার চাবি যেন আমি বাইরে টবে রেখে দিই। আর একজন ছেলে একটা ওষুধ নিয়ে আসবে সকলের জন্য। সেটা যেন আমি সবাইকে জল গরম করে শুঁকতে বলি, তাতে সর্দি চলে যাবে। রোহিণী যখন টেলিফোন করেছিল ঠিক সেই মুহূর্তে ওই জাফর নামের ছেলেটি আসে আর আমি ফোন নামিয়ে দরজা খুলতে যাই। জাফর ঘরে এসে আমার হাতে একটা শিশি ধরিয়ে গরমজল করে তিনটে জামবাটিতে দিতে বলে। আমার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, রোহিণী ফোনে আছে। গরমজল করে এনে দেখি জাফর কত্তাবাবা, গিন্নীমা আর অনীশের সাথে বলছে, অনেকদিন ধরেই ওদের ঠাণ্ডা লেগেছে দেখছে তাই গরমজলে ওষুধ ফেলে নাক দিয়ে টানলে সর্দি বেরিয়ে আসবে। আমি গরমজল করে রাখতেই জাফর আমাকে বাড়ি চলে যেতে বলে, আর–”

          “আর তুমি চলে যাও। তারপর বাকী কাজ, জাফর করে। মারা যাওয়ার পর বডিগুলোকে সিলিং থেকে ঝোলাতে শুরু করে দেয়। রোহিণী বাড়ি ফিরে আসলে তারপর কাজে আসা বন্ধ করো। কারণ রোহিণী বাড়ি গিয়ে তোমায় টাকাটা দিয়ে আসে আর বলতে বারণ করে যে খুনের রাতে সে যে ফোন করেছিল আর জাফর এসেছিল সেটা না জানাতে। তাই তো?”

      দামিনী জিজ্ঞাসা করতেই কনক মাথা নাড়ে।

    মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ সকলের সামনে, রোহিণীর ডান গালে উল্টো চড় মারতেই টেবিলের উপর ছিটকে পড়ে রোহিণী। তাড়াতাড়ি অম্বর, অদৃশকে আটকালে অদৃশ কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে, “শেষ করে দিল আমার পরিবারটাকে। আরে তোমার প্রপার্টির দরকার ছিল, সেটা একবার আমায় বলতে, দিয়ে দিতাম, কেন শেষ করলে পরিবারকে? এইবার বুঝতে পারছি রাতে টেলিফোনে কার সাথে কথা বলতে। মেজদা বুঝে গিয়েছিল আর সেটা মাকে জানিয়ে দেয় আর মা বাবাকে জানায়। যারজন্যে বাবা তোমাকে বার বার বাপেরবাড়ি রেখে আসতে বলে আর আমি ভেবেছিলাম, সংসার ঠিকমতো দেখছ না বলে হয়তো বাবা এই ডিসিশন নিয়েছে।”

    দেশাই, দামিনীর দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করে, “জাফর কোথায় তাহলে?”

    দেশাই জিজ্ঞাসা করতেই দামিনী মুহূর্তের মধ্যে জয়ন্তের বাঁ-গালে উল্টো হাতে থাবড় কষাতেই জয়ন্ত ছিটকে মাটিতে পড়ে।

          “কিন্তু দামিনী, চাবি?”নিনাদ জিজ্ঞাসা করে। “নীলকণ্ঠ বিষটা রোহিণী মথুরাপুরে বাবাকে দেখতে যাওয়ার আগেই জাফর ওরফে জয়ন্তর হাতে দেয়। চাবি তন্দ্রার বাড়ি গেল কী করে?”

        দামিনী বলে, “তন্দ্রাকে জিজ্ঞাসা করি যে খুনের দিন থেকে এরমধ্যে কোনো অচেনা বা পরিচিত লোক এসেছিল কিনা। তখন তন্দ্রা জানায়, খুনের পরেরদিন মানে বৃহস্পতিবার এক পিয়ন চিঠি দিতে তাঁর কাছে যায়। অবাক করার বিষয় হল, কে পাঠিয়েছে সেটা লেখা নেই কিন্তু ঠিকানা সরকার-বাড়ির। খাম খুলে দ্যাখে কেবল সাদা কাগজ ভর্তি। এরই মাঝে সেই পিয়ন তন্দ্রার কাছে জল খেতে চাইলে তন্দ্রা জল আনতে রান্নাঘরে যায় আর সেই সুযোগে ড্রয়িংরুমের সোফার গদির তলাতে চাবি রেখে আসে। পড়ে রইলো আরেকটা চাবি। সেটা আছে রোহিণীর কাছে। চাবি নকল করার জন্য দেরাজ থেকে দ্বিতীয় চাবিটা নেয় আর সেখানে রাখে অমরবাবুর কাছে থাকা চাবিটা। কিন্তু যখন চাবি নকল করতে গেলে ধরা পড়ার চান্স থাকে, তাই সে প্ল্যান চেঞ্জ করে। আমার মনে হয় রোহিণী সেই চাবি রাখার সুযোগ আর পায়নি।”

   কথাগুলো বলেই দামিনী, “ডাক্তার–”ব’লে ডাকতেই সৌরজা, জয়ন্তকে নকল গোঁফ আর গালে কালোরঙের চাপদাড়ি ও চোখে পুরু চশমা পড়িয়ে দেয়।

          “দামিনী, এই সেই পিয়ন।”তন্দ্রা আতঙ্কের স্বরে চিৎকার ক’রে বলে ওঠে।

   দামিনী বলে চলে,“রোহিণী সর্বপ্রথম তন্দ্রার উপর তির মারে যাতে চাবির সন্ধানে ওঁকে আমরা ধরি। আর অন্যদিকে অদৃশ খুনের দায়ে জেলে গেলে প্রেমিকের সাথে পথ মসৃণ। কারণ অদৃশের ঘরে নীলকণ্ঠ বিষ পাবার আগেও ওই দেরাজ আমি নিজে ঘেঁটেছিলাম। নীলকণ্ঠ বিষ ছিল না। এমনকি অদৃশ ফিরে আসার পরও আমি আবার সার্চ করি। তখন ছিল না। যে খুন করবে সে কখনোই হাতের কাছে বিষ সাজিয়ে রেখে দেবে না, যেখানে পুলিশ অলরেডি তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখছে। অতএব নীলকণ্ঠ বিষ রাখা হয়েছে অদৃশকে খুনি হিসাবে প্রমাণ করার জন্যই।”

   এটুকু বলে দামিনী, জয়ন্ত ওরফে জাফরের কাছে এগিয়ে গিয়ে তির্যকদৃষ্টিতে বলে,“এসব বস্তা পচা হিন্দি সিনেমার ছদ্মবেশ দামিনী আঁতুড়ঘর থেকে শিখে এসেছে। আমি মরা মানুষের থেকে সত্যি কথা বের করে আনতে পারি, সেখানে তো তুই বেঁচে। তুই যে আসল সেটা প্রথমদিন তোর কথাতে ধরি। বিপুলবাবু যখন জিজ্ঞাসা করে যে অদৃশ কোথায় যেতে পারে এমন কিছু তোকে ব’লে গেছে কিনা, তখন তুই উত্তরে মথুরাপুরের কথা তুলিস। তুই কী করে জানলি, ওঁরা মথুরাপুর গেছে? অতএব, তুই হচ্ছিস সে অর্জুন আর রোহিণী পুরো বুদ্ধিটা দিয়েছে। প্রথমে স্বাভাবিক অবস্থায় সরকার-বাড়ি যাওয়া, তারপর জাফরের ছদ্মবেশে। যাতে কথা উঠলে জাফরের নাম উঠবে, জয়ন্তর নয়। তুই যে জাফর সেটা আমি বুঝতে পারি, কাল যখন আমার সাথে জেরায় বসেছিলি। মনে পড়ে আজানের সুর? শুরু হতেই টেবিলের উপর রাখা তোর হাত দুটো মুঠো হয়ে যায় আর এক ছটফটানি শুরু। নামাচের ছটফটানি। তারউপর কপালের উপরিভাগে গোল হয়ে থাকা কালচে দাগ। যেটা নামাচ পড়ার সময় মাটিতে মাথা ঠুকে তৈরী হয়। তাকিয়ে দ্যাখ, যে আল্লার এতদিন ধরে দোয়া করে গেলি সেই আল্লাই তাঁর সুরে তোকে ধরিয়ে দিয়ে গেল। বুঝিয়ে দিল, ইমান বেঁচে; বিশ্বাস ভেঙে; নমকহারামি করে; আল্লার বান্দা হওয়া যায় না। এবার আমাকে একটা কথা বলতো, জাফর হয়ে ওই বাড়িতে গেলে বাড়ির সকলে তোকে বিশ্বাস করলো কী করে?”

    জয়ন্ত গালে হাত রেখে কাঁপা গলায় উত্তরে বলে, “অদৃশের ব্যাপারে আমি সবই জানতাম। তাই রোহিণী আমাকে বলেছিল যে, ওই বাড়িতে গিয়ে অদৃশের বন্ধু ব’লে রোহিণীর নামে মিথ্যে কয়েকটা কথা বলতে। যাতে বাড়ির সকলে আমাকে বিশ্বাস করে। আর সেটাই হয়েছিল। বিশ্বাস যাতে আরও সাচ্চা হয় তারজন্যে এটাও বলি যে ওঁরা যেহেতু মথুরাপুর গেছে তাই অদৃশ, রোহিণীর অ্যাবসেন্সে আমাকে পাঠিয়েছে।”

    দামিনী কথাটা শেষ করতেই শর্বরী, রোহিণীর ডানবাহুটা চেপে ধরে গম্ভীর গলায় বলে ওঠে, “চলুন, ছোটগিন্নী, প্রেমিককে তোলা হয়ে গেছে, নতুন ক’রে সরকার গঠন করবেন জেলের ভিতরে।”

দংশনে নীলকণ্ঠ রহস্য্ গল্প – সমাপ্তি

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!