কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » উপন্যাস » পিরীতি কাঁঠালের আঠা

পিরীতি কাঁঠালের আঠা

রীতি কাঁঠালের আঠা উপন্যাস – সুদীপ ঘোষাল

পর্ব- এক

সমীর তার প্রথম প্রেমের স্মৃতিবুকে এখন তৃতীয়ায় ব্যস্ত।প্রতিটি প্রেম তার বুকে আলো জ্বালিয়ে বলে,আমাদের অস্তিত্ব তো মিছে নয়।কোন এক চাঁদনী সন্ধ্যায় তুমি আমার ছিলে।কিছু করার নেই।বুকের গভীরতম কোঠায় তাদের স্থান।সে ভাবে,তাদের ভুলি এ সাধ্য কোথায়। প্রতিটি প্রেমের বিরহ এক একটা শোলা হয়ে ভাসে বুকের গভীরে।সমীর জানে সে এখন বিবাহের পর সন্তান,স্বামী নিয়ে সুখে আছে।তবুও যখন বাপের বাড়ি আসে একবার ডেকে পাঠায় তাকে।শুধু দেখে আর মুচকি হাসে।হাসির পিছনে লুকোনো প্রথম প্রেমের শিহরিত পরশ।সবার কাছে ভালোবাসা পেতে চায় মন।একটু স্নেহ,একটু বন্ধুত্ব আর কিছু না।

বাসস্ট্যান্ডের পাশে সন্তুর বাড়ি। সন্তু ছোটবেলায় ভাল ক্রিকেট খেলত। তবু কোনদিন উইকেট পাইনি। রান রেট কমে যেত তার বোলিং ওভারে।কোন বাহবা নেই। ব্যাট করতে নেমে দলকে জিতিয়েছে।
কিন্তু আটের ঘরে আউট। কোনদিন সেঞ্চুরি পায় নি। কোন পুরষ্কার তো দূর অস্ত জীবনে কোন প্রশংসা পায় নি। জীবনে প্রেম পায় নি। বন্ধুর প্রেমিকার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ।সে ছিল পত্রবাহক। সুন্দরী কোন মেয়ে ফিরেও তাকায় নি। সংসারে সকলের হাসির পাত্র ছিল সে। খুব মজা পেত সকলে তাকে পেলেই। হাসি ঠাট্টায় হেরে যেত তার মন। মনের কোণে ভালোবাসার জায়গা হয় নি। সে নাকি ভালবাসার যোগ্য নয়। ইন্টারভিউয়ে পাশ করেছি অনেক। কিন্তু চাকরি পাশ কাটিয়ে হয়েছে অধরা। সে শিক্ষকতা করে কিন্তু শিক্ষক নয়।তার নামের পাশে থাকে গৃহশিক্ষক । সংসারে সাহায্য করেও কোন মূল্য পায় না। তার সম্মান মেলেনি। ভালবাসার খাবার পায় নি। কেমন যেন সিঁটিয়ে গেছে সে। খোলা হাওয়ায় বুকটা হাল্কা হলেও ভারি হয়ে থাকে বাকি সময়। এক অপরাধির মত জীবন বয়ে যায় তার। জানে না কি সেই অপরাধ যা নিয়তির দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যায় আত্মীয় স্বজন। ভালবাসতে জানে। তার কথায় কেউ ব্যথা পেলে বুকে বাজে। ভালবাসা দিলেও অবজ্ঞা জোটে। লিখতে জানি না। পড়তে পড়তে বইয়ের পাতা ঝাপসা হয়। অন্ধকার নেমে আসে। পরাজিত হয়েও অন্তরে তার আলো জ্বলে ওঠে। মনে হয়, এই বুঝি ভালবেসে এল সত্যের শেষ আলো। এই আলোয় নিষিক্ত হবে দেহ মন। আর কেউ না হোক ভালবাসে অরূপরতন।

স্কুল থেকে ফেরে বিজু ঠিক পাঁচটার মধ্যে। কিন্তু তার স্ত্রী খুব চিন্তিত। সাতটা বেজে গেলো এখনও বিজু ফিরে এল না। বিজুর স্ত্রী পাড়ার সব প্রতিবেশীদের বলল,দেখুন আটটা বেজে গেল এখনও আমার স্বামী ঘরে ফেরে নি।
পাড়ার ছেলে পিরু বলল, চিন্তা নেই। আমি আছি। দেখছি ফোন করে। ফোন নাম্বার ছিল পিরুর কাছে। কিন্তু ফোনের রিং হয়ে যাচ্ছে। কোন উত্তর নেই। বার বার বারোবার ফোন করেও কোন উত্তর পাওয়া গেল না।

পর্ব- দুই

বিজু আর রাজু- মাষ্টার দুই বন্ধু। তারা দুজনে মোটর সাইকেলে স্কুলে যায়। তাই বিজুর স্ত্রী নিশ্চিত হল, রাত আটটা বেজে গেল। তার মানে কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে। রাজু- মাষ্টারমশাইয়ের মোটর সাইকেল আ্যক্সিডেন্ট হয়েছে মনে হয়। ফোন বেজে চলেছে। তারা হয়ত দুজনেই মরে পড়ে আছে।
বিজুর স্ত্রী বাপের বাড়ি থেকে বাবাকে, দাদাকে ডেকে আনল। বাবাকে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, বাবা চল একবার থানায় যাই।
বাবা বললেন, একটু সবুর করি। হয়ত ফিরে আসবে।
ঠিক সাড়ে আটটায় বিজু সমস্ত চিন্তার অবসান ঘটালো।
সবাই দেখল, বিজু দুইহাতে দুটো বড়মাছ ঝুলিয়ে দাঁত কেলিয়ে আসছে।
বিজুকে সবাই রেগে বলল, কি বেআক্কেলে লোক তুমি। কোথায় গেছিলে?
বিজু বলল, মাছ ধরতে গেছিলাম। ফাতনার দিকে তাকিয়ে ফোনের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছি। রিং হলেও পকেট থেকে বের করেনি রাজুমাষ্টার । আমি বললাম ফোনটা ধরতে।
রাজু মাষ্টার বলল, এখন ফোন নয়। শুধু জল আর ফাতনা। মেছেল আমি। এবার বুঝেঝি বড় রুই ঘাই মারছে। তু দাঁতকেলা, ডিস্টার্ব করিস না। কেলিয়ে দেব। বন্ধু হয়ে শত্রুতা করিস না। দিলি কথা বলে চারঘোলা করে।

বিজুর বৌ রেগে বলল,এই দাঁতকেলা।তোর মাছ, তুই খা। কোন বাপে রেঁধে দেয়,দেখি….।

পর্ব- তিন
অসীম ও মাসির কথা

আমরা চারজন বন্ধু ভবরঞ্জন,অসীম,তারকেশ্বর ও আমি দীঘা বেড়াতে গেলাম কলকাতার ধর্মতলা থেকে বাস ধরে।পৌঁছানোর পর বঙ্কিম আমাদের লজ খুঁজতে সাহায্য করল।তাকে তার পারিশ্রমিক দিয়ে আমরা লজের কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে থাকা খাওয়ার সমস্ত ব্যাবস্থা করে নিলাম। পিনু,মিলু,বিশু ও আমি চারজনে একটি ঘর নিলাম। তারপরের দিন দীঘার দর্শনীয় স্থানগুলি ঘুরে দেখলাম।
রোশনি বলল,অমরাবতী লেকের সাথে ছোট একটি পার্ক ও একটি সর্প-উদ্যান আছে। নৌকা ভ্রমণের সুবিধাও আছেে।
মিলু বলল,জুনপুটে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের পরিচালিত মৎস্য দপ্তরের মৎস্যচাষ ও মৎস্য গবেষণাকেন্দ্র আছে।আমি জানি , কাঁথি থেকে ১২ কিমি দূরে অবস্থিত বালুকাভূমিটির নাম স্থানীয় মন্দার ফুলের নামানুসারে রাখা হয়েছে। লাল কাঁকড়া অধ্যুষিত জায়গাটি এখন অন্যতম জনপ্রিয় অবকাশ যাপন কেন্দ্র।
বিশু বলল,,মন্দারমণি ও দীঘার নিকটে অপর একটি পর্যটন কেন্দ্র তৈরী হয়েছে। এখানে একটি সমুদ্রবন্দরের কাজ চলছে। উদয়পুর, নিউ দীঘার পাশে উড়িষ্যার বালেশ্বর জেলা ও বাংলার সীমানায় উদয়পুর সমুদ্রতট।শিবমন্দির, চন্দনেশ্বর, দীঘার ৬ কিমি পশ্চিমে এটি অবস্থিত। বিশুর পরামর্শমত আমরা ঘোরাঘুরি করলাম,দুপুুর অবধি।
দুদিন পরে আবার আমরা অজানা আকর্ষণে মন্দারমণি গেলাম। এখানে কমবয়সি ছেলেমেয়রা গাইডের কাজ করে আয় করে। পৌঁছানোমাত্রই একটি কমবয়সি মেয়ে এসে,আমাদের ঘর ভাড়া করার জন্য নিয়ে গেল একটা বাড়িতে।বাড়িটা ফাঁকা।মেয়েটি বলল,আমি মোবাইলে কথা বলে নেব ম্যানেজারের সঙ্গে।আপনার ঘরে মালপত্তর রেখে ঘুরতে চলুন। আমরা একটু ঘোরাঘুরি করলাম,এখানে ওখানে মেয়েটির সঙ্গে।বিশু বলল,তোমার নাম কি?

  • আমার নাম হল হল রোশনি এখান থেকে দু কিলোমিটার দূরে একটা গ্রামে আমার বাড়ি।পিনু বলল,রোশনি, একদিন তোমার বাড়ি যাব।
    রোশনিও আমাদের সঙ্গে ছিল। কিন্তু একটি মেয়ে যে আমাদের সঙ্গে আছে সেকথা জেনেও আমাদের মনে কোন প্রতিক্রিয়া হয় নি। রোশনি আমাদের অভিভাবিকার মত হয়ে গেল।
    পিনুর কথায়, রোশনি সম্মতিসূচকভাবে ঘাড় নাড়িয়ে চলে গেল আড়ালে। বিশু বলল,মেয়েটা খুব ভাল। ওর কথাবার্তাও খুব সুন্দর।
    আমি বললাম,কিরকম লাগছে তোকে বিশু? প্রেমে পড়ে গেলি নাকি? প্রেমে পড়লে এরকম কথা বলে ছেলেরা।তোর কি সেরকম কিছু হল?
    বিশু বলল,হতেও পারে। অসম্ভব কিছু নয়।আমাদের তো এটা প্রেম করার বয়স। তারপর সবাই আমরা হেসে উঠলাম ওর কথা শুনে।

তারপর ঘোরাঘুরি শেষে লাল কাঁকড়া দিয়ে ডিনার সেরে ভাড়া ঘরে এসে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। বিকেল হল।চা, বিস্কুট খেলাম।রাতের খাবারও পেলাম।সাদা আ্যপ্রনে ঢাকা একজন লোক এসে বলল,আপনারা শুয়ে পড়ুন।আমি বাইরের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছি। তারপর রাত এগারোটা নাগাদ আমরা সকলে ঘুমিয়ে পড়লাম।প্রায়
রাত দুটোর সময় পিনুর চিৎকারে আমাদের ঘুম ভাঙ্গে।পিনু বলল, একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এখানে।মিলু বলল,হ্যাঁ,ঠিক কথা, একটা মেয়ে দেখলাম পিনুর খাটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল।
বিশু বলল,মেয়েটা কেমন দেখতে?
পিনু বলল,আমরা যে মেয়েটাকে গতকাল দিনের আলোয় বালির চরে দেখেছিলাম,সারাদিন আমাদের সঙ্গে ছিল, এটা সেই মেয়ে রোশনিই ছিল।
আমরা বললাম ম্যানেজারকে,কি করে রোশনি ঢুকল ঘরে। দরজা তো বন্ধ ছিল।
ম্যানেজার বলল,বসুন আপনারা।দরজা বন্ধ থাকলেও ঢুকতে পারে রোশনি। মেয়েটি এখানে রোজ আসে। আপনাদের মত রোশনিও বেড়াতে এসেছিল বর্ধমান থেকে ওর বন্ধুদের সঙ্গে।তার বন্ধুরা মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ওকে রেপ করে এই ঘরে। তাই কোন
ছেলেরদল বেড়াতে এলে ও দেখে নেয়,দলে কোন মেয়ে আছে কি না? গতবার একটা দলে দুটি ছেলে ও একটা মেয়ে ছিল। পরের দিন বালুচরে দুটো লাশ পাওয়া যায়। বদউদ্দেশ্য নিয়ে কেউ বেড়াতে এলে ও তাদের হত্যাকরে প্রতিশোধ নেয়।
কাহিনী শুনে আমাদের আর ঘুম হলো না। নিজেরা ঘরে গিয়ে আলোচনা করলাম, আর এখানে না থাকাই ভালো।বিশু বলল,ভালোয় ভালোয় বাড়ি চলে যাওয়াই ভাল।
মন্দারমণিতে তখন মন্দার ফুলের গন্ধ বাতাসজুড়ে।রাতে বেশ লাগছিল।চাঁদের আলো আর ফুলের সৌরভ একাকার হয়ে গেছিল সে রাতে, রোশনির দীর্ঘশ্বাসে।

পরেরদিন আমরা ব্যাগগুছিয়ে ম্যানেজারের ঘরে গেলাম।গতরাতের ঘর তো নয় এটা , এঘরটা তো মাকড়সার জালে ভর্তি।রোশনিই আমাদের এই বাড়িতে এনেছে।রোশনি বাড়িতে ঢোকে নি কিন্তু ঘরের সব দরজা খোলা।পিনু বলল,অবাক কান্ড।
রাতে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা হয়েছিল টাকাপয়সার ব্যাপারে।আর কোন লোককে আমরা এ বাড়িতে দেখি নি।
আমরা বাইরে এসে কয়েকজনকে দেখতে পেলাম চায়ের দোকানে।আমি বললাম, কাকু এই বাড়িতে আমরা দুদিন ছিলাম।ভাড়ার টাকা বা খাওয়ার মূল্য নেওয়ার লোক এ বাড়িতে নেই।কি করি বলুন তো?
লোকটি বলল,ওটা ভূতের বাড়ি।প্রাণে বেঁচে গেছেন, ভূতের খাবার খেয়েছেন,ভূতের সঙ্গে গল্প করেছেন। এখন বাড়ি যান।ও বাড়িতে পাশের গ্রামের মৃত রোশনির আত্মা পাহারা দেয়। ম্যানেজার ছিল, ওর ছেলে বন্ধু। রোশনি মরে যাওয়ার পর ওর প্রেমিক ম্যানেজারও আত্মহত্যা করে, গলায় দড়ি দিয়ে। তারপর থেকে ও এই বাড়িতেই থাকে।ওরা বেড়াতে এসেছিল এ বাড়িতেই।কতযুগের পুরোনো এ বাড়ি তা কেউ জানে না। তবে যারা সভ্য, ভ্রমণপিপাসু বা ভদ্রলোকদের কোন অসুবিধা হয় নি আজ পর্যন্ত। কোন খারাপ কাজ এ বাড়িতে হলে তার আর রক্ষা নেই।এরকম কত ঘটনা যে আছে তা বলে শেষ হবে না। যান, তাড়াতাড়ি যান,এই তো বাস এসে গেছে, চেপে পড়ুন। আমরা চায়ের দাম দিয়ে বাসে উঠে পড়লাম কম্পিত হৃদয়ে।

পর্ব- চার

অসীমের মধু মাসি ফুটপাতের এক কোণে কোনোরকমে থাকে। তার কোনো ছেলেমেয়ে নেই।একদিন ফুটপাতে কুড়িয়ে পেলো একটা শিশুকে।তাকে ভগবানের দান মনে করে মানুষ করতে লাগলো।তারপর মাসি আরও চারজন অনাথ শিশুর খোঁজ পেলো। মাসি ভিখারী হতে পারে কিন্তু তার পড়াশোনার যোগ্যতা, বুদ্ধি ভালোই ছিলো। শিক্ষিতা রুচিশীল মাসি কি করে ভিখারী হলো, সে ঘটনা পুরো বলতে গেলে ইতিহাস হয়ে যাবে। যাইহোক স্বাধীনচেতা মাসি স্বামীর ঘর ছেড়ে ফুটপাতে আশ্রয় নিয়েছিলো বাধ্য হয়ে। মাসি এবার পাঁচ শিশুকে নিয়ে সরকারী অফিসে হানা দিতে শুরু করলো। একদিন এক সরকারী আধিকারিক বললেন,মাসি আপনার কোনো পরিচিতি নেই।আপনার অনাথ আশ্রমের কোনো জমি নেই। কি করে আপনি অনাথ আশ্রয় গড়ে তুলবেন।আপনার অর্থবল,জনবল কিছুই নেই।মাসি বললো,কিন্তু আমার একটা জিনিস আছে, তা হলো ইচ্ছাশক্তি। আমি আশ্রম গড়ে তুলবোই।আপনি দেখে নেবেন। আমার সে মনবল আছে।

পাঁচ শিশুকে নিয়ে মাসির পথ চলা শুরু হলো। তিনি ভিক্ষা করে অই শিশুদের পরিচর্যার ব্যবস্থা করলেন।পাঁচ শিশুকে দেখে একদিন অমরবাবুর মায়া হলো। তিনি মাসিকে বললেন, আপনার শিশুদের থাকার জন্য আমি ঘর তৈরি করে দেবো। আমি জায়গা দেবো। আমার যতটা সাহায্য করা প্রয়োজন আমি করবো। আইনের ঝামেলা আমি দেখাশোনা করবো।
মাসি জোড় হাতে অমরবাবুকে নমস্কার জানালো। কেতুগ্রামের ফাঁকা জমিতে ঘর তৈরি হলো প্রথমে দুটি। তারপর শুরু হলো মাসির বিজয় যাত্রা। তারপর সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছ থেকে সাহায্য আসতে লাগলো। তৈরি হতে লাগলো আরও ঘর। বাউন্ডারি হলো। আর অনাথ শিশুর সংখ্যা বাড়তে থাকলো। প্রথমে শুকনো কাঠ কুড়িয়ে রান্না করা মাসি আজ গ্যাস ওভেনে রান্না করে নিজের শিশুদের জন্য।মাসিকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি। কিন্তু বাদ সাধলো আর এক বিপদ। একদিন আশ্রম থেকে তিনটি শিশু চুরি হয়ে গেলো। মাসি পাগলের মত খুঁজতে শুরু করলেন শিশুদের। এক রাখালের কাছে খবর পেলেন, এক পাষন্ড তিন শিশুকে হাত পা বেঁধে রেখেছে চিলেকোঠার ঘরে। রাখালকে নিয়ে মাসি থানায় গেলেন। পুলিশের সাহায্যে ধরা পড়লো বিরাট শিশু পাচারকারী দল।রাখাল অই মালিকের কাছেই কাজ করতো। তিনজন শিশুকে কাঁদতে দেখে রাখালের সন্দেহ হয়। তারপর মাসি জিজ্ঞেস করাতে সব ছবি পরিষ্কার হয়ে যায়।রাখালকে মাসি অনাথ আশ্রমের এক অনুষ্ঠানে পুরস্কৃত করলেন।

এইভাবে মাসি এলাকার মানুষের কাছে মা বলে পরিচিত হলেন। তিনি এবার আর একটি আশ্রম গড়ে তুললেন শালারে। এইভাবে মাসির পাঁচ পাঁচটা আশ্রম চলছে সুন্দর পরিবেশে মানুষের সহায়তায়।

ভবরঞ্জন ও চিনুর কথা

ভবরঞ্জনের বাড়ির সামনে একটা পুকুর আছে। ওরে যাস না ওদিকে, পুকুর আছে ডুবে যাবি
—– না মা, কিছু হবে না

ছোট থেকে চিনু দুরন্ত, একরোখা ছেলে। ভয় কাকে বলে সে জানে না। এই নিয়ে তার পরিবারের চিন্তা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

এইভাবে প্রকৃতির কোলে বড় হয়ে যায় মানুষ । কত কি শেখার আছে প্রকৃতির কাছে। কিন্তু কজনে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। কিন্তু চিনু সেই শিক্ষা নিয়েছিল। গ্রামের সকলে তাকে একটা আলাদা চোখে দেখত।বেশ সম্ভ্রমের চোখে। পরিবারের সকলে জানে না, কি করে চিনু শিক্ষা পেল। প্রথাগত শিক্ষা সে পায় নি। তবু বাড়িতে দাদুর কাছে লেখাপড়া শিখেছে। বই পড়া শিখেছে। চিনু বলত, দাদু কি করে তুমি বই পড়। আমি পারি না কেন? দাদু বলতেন, নিশ্চয় পারবি। মনে মনে বানান করে পড়বি। দেখবি খুব তাড়াতাড়ি বইপড়া শিখে যাবি।
হয়েছিল তাই। দুমাসের মধ্যে চিনু গড়গড় করে বই পড়ত।কোনো উচ্চারণ ভুল থাকত না।
দুপুরবেলা হলেই চিনু বন্ধুদের নিয়ে কদতলা, বেলতলা, আমতলা, জামতলা দৌড়ে বেড়াত। কাঁচা কদ কড়মড় করে চিবিয়ে খেত। লাঠিখেলা,কবাডি সব খেলাতেই তার অদম্য উৎসাহ। গ্রামের লোকের উপকারে তার দল আগে যায়।

এই দাপুটে ছেলে চিনু একদিন এক সাধুর সঙ্গে ঘরছাড়া হল। বাড়ির সকলে কান্নায় ভেঙ্গে পরলো। কিন্তু চিনুকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না।

একদিন গ্রামের একজন গিয়ে দেখল, সাধুর আশ্রমে সবুজ গাছ যত্নের, কাজ করছে চিনু….

আজ সুপার মার্কেটের পুরো গাছগাছালির আড়াল ঘিরে শুরু হয়েছে পৌষ পিঠের মেলা। এই মেলার সামনের পাড়ায় বস্তি এলাকায় কিছু গরীব সংসারের আবাস। তারা সুপার মার্কেটের সামনে থাকে এই নিয়ে তাদের গর্বের শেষ নেই। কারণ এই মার্কেট জুড়ে অনুষ্ঠিত হয় মেলা,সার্কাস আর বাজার। আর সেখানে কাজ করে তাদের ভালমন্দ খাবার জুটে যায়। শুধু বর্ষাকালে কোনো অনুষ্ঠান হয় না। তখন ঝড়ে ডালপালা ভাঙ্গে আর সেই ডালপালা নিয়ে এসে তারা বাড়িতে ফুটিয়ে নেয় দুমুঠো চাল। পুকুরের গেঁড়ি, গুগুলি তখন তাদের একমাত্র ভরসা।

আজ পৌষ পিঠের মেলা। দুটি বছর দশেকের শিশু চলে এসেছে মেলায়। তাদের টাকা পয়সা নেই। ঘুরে বেড়ায় উল্লাসে। তারপর বেলা বাড়ে আর তাদের খিদে বাড়ে সমানুপাতিক হারে। খিদে নেই ওদের যারা ঘুরে ঘুরে পিঠে খায়। ফেলে দেয় অর্ধভুক্ত পিঠের শালপাতার থালা। ডাষ্টবিন ভরে যায় খাবারসহ শালপাতায়।

শিশু দুটি অবাক চোখে ডাস্টবিনের দিকে এগোয়। দেখে গোটা গোটা পিঠে। তুলে নেয় হাতে। দোকানদার চিৎকার করে বলে, পালা পালা। যত সব ভিখারীর দল।
পাশে আলো মুখে একজন মহিলা এগিয়ে আসে। সে বলে, তোদের বাড়ি কোথায়। শিশু দুটি দেখিয়ে দেয় তাদের পাড়া। মহিলা বলে, আমাকে তোদের বাড়ি নিয়ে যাবি?
শিশু দুটি হাত ধরে নিয়ে আসে তাকে। পথে হাঁটতে হাঁটতে মহিলাটি বল, আমি তোদের দিদি। আমাকে দিদি বলে ডাকবি।
বাড়িতে নিয়ে গিয়ে শিশু দুটি বলে, মা মা দেখ দিদি এসেছে আমাদের বাড়ি। মা তো অবাক। তারপর জানতে পারে সব। পেতে দেয় তালপাতার চটাই। একগ্লাস জল খেয়ে দিদি ব্যাগ থেকে বের করে পিঠের প্যাকেট। সকলে একসাথে বসে খায়।

দিদি বলে শিশু দুটির মা কে, আমার ছেলেপুলে হয় নি। তোমার বাচ্চাদের দেখে চলে এলাম তোমাকে দেখতে। জানো ভগবান, সকলকে সবকিছু দেয় না। তোমাকে যেমন টাকা পয়সা দেয় নি আর আমাকে আবার সন্তান দেয় নি।
তারপর শিশু দুটির পিঠে খাওয়ার পরে কি নাচ। আনন্দে নাচতে নাচতে তারা দিদির সব দুঃখ ভুলিয়ে দেয়।

দিদি নতুন করে বাঁচার রসদ পেয়ে যায়। দিদির চোখে ভেসে ওঠে বস্তির সকল শিশুর পেট ভরে খাওয়ার পরে আনন্দের নাচ।

পর্ব- পাঁচ

অনুপের কথা

দুপুর হলেই অনুপ ছিপ হাতে চলে যায় কলাবাগানের পুকুর পাড়ে। সেখানে ঘাস জঙ্গল পরিষ্কার করে রাখাই আছে। স্নান করার সময় চারকাঠি পুঁতে রেখে যায়। দুপুরে একটা চট আর ছাতা হাতে চলে আসে পাড়ে। তারপর বাগিয়ে বসে অনুপ। ফাতনার দিকে তাকিয়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। ঠিক দুটো বাজলেই জগা রাঁধুনির বৌ চান করতে আসে পুকুরে। জগা পাড়ার যত ভোজকাজে সুন্দর রান্না করত। একদিন অতিরিক্ত মদ্যপান করে রান্না করছিল নেশায় চুর হয়ে। কখন যে উনুনের আগুন পিঠ বেয়ে ঘাড়ে উঠেছিল কেউ জানতে পারে নি। তার উপর শীতকাল। আগুনের তপ্ত আঁচ টের পেয়েছিল অনেক পরে। অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচানো যায় নি। তারপর থেকে বৌটা বিধবা। পাঁচ বছর হয়ে গেল। দুঃখের আঁচ এখন নিবু নিবু। ঘর করেছিল চারমাস।
অনুপ সব জানে। এতক্ষণ বৌটাকে দেখে তার সবকথা মনে পড়ছে। বৌটা চান করে বেশ খোলামেলা হয়ে। অনুপের আড়চোখে দেখাটা বৌটার গা সওয়া হয়ে গেছে। সে সোজাসুজি অনুপের দিকে তাকায়। কিন্তু অনুপের একটু লজ্জা পায়। যতই হোক পাড়ার বৌ। এতটা নির্লজ্জ সে হতে পারে না। আড়চোখে দেখেই তার সুখ। কেমন সুন্দর বুক দুখানা। অনুপ ভাবে, একবার যদি ওর চরণ দুখানি পাই নিজের করে, তাহলে আদরে ভরিয়ে দেব। ওর নামটা জানা হয় নি। একদিন ওর নাম জানব। অনুপ ভাবে, ও কি কখনও আমার হবে?

তারপর স্নান সেরে বৌটি চলে যায় মনটি ফেলে রেখে অনুপের কাছে। সারাদিনের ভাল থাকার রসদ পেয়ে যায় পাঁচ মিনিটের মানসিক অবগাহনে। শরীর মন প্রেমময় সুরে বাজতে থাকে পরবর্তী মিলনের অপেক্ষায়। বৌটি জানে অনুপ অবিবাহিত। সেও তাকে চায় একথা সে বুঝতে পেরেছে তার চোখের চাউনিতে।
তারপর রাত যায়। কোকিল ডাকে। মন উড়ু উড়ু দুপুরের অপেক্ষায়। রান্নাবান্না সেরে ঠিক দুটোর সময় চলে যায় পুকুরে। ফাঁকা দুপুরে, ফাঁকা পুকুরে শুধু ছিপ ফেলে তাকিয়ে থাকে মনের মাণিক।

অনুপ আজও কথা বলতে পারল না। শুধু তাকিয়ে রইল প্রাণের টানে। সে ভাবে, কাল দেখা যাবে।

এইভাবে কেটে যায় মাসের পর মাস। কোনো কথাই হয় না তাদের মধ্যে। শুধু মন দেওয়া নেওয়ার পালা।

তারপর এক গ্রীষ্মের দুপুরে অনুপ স্নান করতে যায়। আজ মাছ ধরা বাদ দিয়ে অন্য কাজে মেতে যায় সে। ঠিক সেই সময়ে আসে বিধবা বৌটি। ঘাটে নামতে ইতস্তত করে সে। অনুপ ডাকে এস। এস। তোমার নাম কি?
—– বীণা

—- আমি বাজাতে পারি।

—–; সবাই বলে। পরে ছন্দপতন হবে না ত?
-*- একবার শুনেই দেখ।

বীণা নেমে যায় গভীরে। অনুপ আজ সফল। তার মনজালে ধরা পরে বড় মাছ। কি ছটফটানি তার। বাগে আনতে কম বেগ পেতে হয় নি। দুজনের যুগ যুগ চেনা হৃদয়ে সোহাগ উথলে ওঠে ফুটন্ত ডালিয়ার মত। অনুপ ডালিয়ার আঘ্রানে ভরিয়ে তোলে জলকেলির খেলা। বীণা নবজন্ম পায় সোহাগের ছোঁয়ায়।

বীণা কেঁপে ওঠে কামনার শীতে, বল, তুমি মিশে থেক আমার শিহরিত শিরায়। রক্তের মত প্রবিষ্ট হও হৃদয় প্রকোষ্ঠে। আমি শত খরার শুকনো জমি।

—- কেন তুম তো মাঝে মাঝে আসো পুকুরে। সাধ মিটিয়ে নিও।

— আসি, কিন্তু ভিখারীর আবেদন নিয়ে। মনের মহারাজ আজ পেয়েছি।

বলেই বধু তাড়াতাড়ি বাড়ির পথে এগোয়। কারণ কেউ দেখে ফেললে বিপদ হবে। বদনাম হবে।

উপোসী ছারপোকার মত অনুপের অনুভূতি। একটু আগেই সুখে নিমজ্জিত মন এখন আরাম চায় নিদ্রার। সে বকুলের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়ে।

অনুপ দুপুর গড়িয়ে ঠিক যখন গৃহস্থরা একটু ভাতঘুমে ব্যস্ত থাকে ঠিক সেই সময়ে আবার ছিপ হাতে বেরোয়। আর বিধবা বৌটি সেই সময়, চিনে নেয় অনুভবে,অভ্যাসে। দেহের রসায়ন যেজন জানে সেজন প্রকৃত রসিক। সেই রসিক নাগরের পাল্লায় পড়ে বধু কাম মাতাল। অনুপ পুরোপুরি তার মর্যাদা ভরিয়ে রাখে কানায় কানায়।

তবু এক দুপুরে পরিবারের আবেদন মিটিয়ে সে আসে পুকুরে। ননদের সন্দেহ হয়, এখন সে কোথায় চলেছে। পিছু পিছু গিয়ে লুকিয়ে থাকে শরবনে। দেখে বৌদির মাতলামি। সে ভাবে,বৌদি এত অসভ্য? এ তো অসতী। লোকজন জড়ো করে বিচার করে মেছেল প্রেমিকের। বিচারে ঠিক হয়, দুজনকে বিয়ে করে সংসারী হতে হবে। পঞ্চায়েত থেকে বর্তমানে লিখিত করে তারা বিয়ে করে। আর তাদের মিলনে কোনো বাধা থাকল না।

তারপর তারা আকাশের উন্মুক্ত প্রান্তরে হারিয়ে গেল স্বাধীনভাবে।

পর্ব- ছয়

রমেনের পিরীতি

রমেনবাবু বললেন,একবার তোর ছেলে নরেনের কথা ভাবলি না। বউ মরার বছর না ঘুরতেই আবার বিয়ে করলি।

নরেনের বাবা বলল, কি করবো বল। নকল সাধু হয়ে লোক ঠকাতে পারবো না। তাই আবার বিয়ে করলাম।

  • কিন্তু তোর দ্বিতীয় স্ত্রী নরেনকে সহ্য করতে পারবে না। নরেনকে চিরদিন অত্যাচার সহ্য করতে হবে, সৎমায়ের ব্যাবহারে,ঘৃণায়। তার কথা আমি জানি। আমাদের পাড়ার বখাটে মেয়ে, তোর বর্তমান স্ত্রী । চিরকালের অসভ্য, কলহপরায়ণ।

এই কথা বলে রমেনবাবু চলে গেলেন।
ছেলে নরেন কলেজ থেকে এসে বললো,বাবা পাঁচ হাজার টাকা লাগবে। আমি কম্পিউটার কোর্সে ভর্তি হবো।

বাবা চুপ করে আছেন। সৎমা, রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, একটা টাকাও পাবি না। আমাদের ভবিষ্যৎ আছে।তোকে আর পড়তে হবে না। নিজেরটা নিজে দেখে নে। তোর খাবার জোগাড় করতে পারবো না। যা বেরো এখান থেকে। মরেও না আপদ।তারপর স্বামীর সামনেই অকথ্য গালাগালি শুরু করলো। স্বামী আসামির মতো চুপসে গেলো ভার্যার ভয়ে।
ছেলে বাবাকে আবার বললো তার স্বপ্নের কথা।
বাবা সমস্ত কথা শুনলো।তবু উত্তর নেই। দ্বিতীয় ভার্যার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে অযোগ্য বাবা। তার বাবা চুপ করে মাথা নিচু করে রইলো। নরেন বেরিয়ে গেলে সৎমা বললো, বুঝলে বাঁচলাম আমরা। পরের ছেলে থাকলেই ঝামেলা।

নরেনের মনে পড়ল তার মৃত মায়ের কথা। মা বলতেন, কখনও লড়াই করা ছাড়বি না। লড়াই করে বেঁচে থাকাই তো জীবন। সৎমার এই অপমান সে ভুলে গেল। সে দেখল এক আকাশ আলো। শুধু আলো আর আলো। জীবনে অনেক পথ খোলা। সে ছুটতে ছুটতে চলে গেল আলোর দেশে,যেখানে ঘৃণা নেই। এই খবরটা ছড়াতে সময় বেশি লাগলো না।সবাই জানল নরেন বাড়ি ছেড়ে চলে গেল চিরদিনের মত।

সৎমার কানে খবরটা গেলো।সে বলল,আপদ বিদেয় হয়েচে। তার বদনে তখন গোপন গর্বে গোবরের হাসি…

পর্ব- সাত

প্রকৃতি প্রেমিক

সবাই তো দার্জিলিং,পুরী কিংবা দিঘা যায়। চল না নির্জন কোনো এক জায়গায়। যেখানে মানুষের ভিড় নেই। শান্ত সবুজের পরশ আছে। বললো দীপ।, অংশু বললো,চল যাওয়া যাক। কিন্তু সমমনস্ক আমরা দুজনে যাবো। কেনাকাটা করার লোকের সংখ্যা বেশি। তারপর আসল কাজ, ঘোরা, দেখা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। দীপ বললো,ঠিক বলেছিস। তাহলে ঝালং ওঝান্ডি ঘুরে আসি চল। অংশু রাজী হলো।

তারপর সামান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ওরা বোলপুর থেকে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস ধরে চলে এলো নির্দিষ্ট জায়গায়। একটা হোটেলে উঠে মালপত্তর রেখে দিলো ওরা। কিছু হাল্কা খাওয়া দাওয়া করে বেরিয়ে পরলো বাইরে।

সুন্দর সবুজ পাহাড় দেখে মন জুড়িয়ে গেলো বল দীপ, অংশু বললো। দীপ দেখলো,সমান্তরাল পাহাড়ের শ্রেণী দিগন্ত ঘিরে রেখেছে। পাহারা দিচ্ছে সুন্দর বাগান।

মানুষের ভিড় খুব কম। তার ফলে নোংরা আবর্জনা কম। দীপ বনের মধ্যে দিয়ে হাঁটছিলো। হঠাৎ একটা মেয়েকে দেখতে পেলো। পাহাড়ি, লোকাল মেয়ে। খুব সাহস। ভাঙ্গা বাংলায় বললো,এ বাবু। বেশি ভেতরে যাস লাই। লাফা জোঁক আছে। রক্ত চুষে লেবে। দীপ বললো,তাহলে তুমি এলে কেনো। তোমার ভয় করে না। মেয়েটি খিল খিল করে হেসে উঠলো। বললো,ভয় কি রে।আমাকেই সবাই ভয় করে। তারপর কোমর থেকে একটা ধারালো কুকরি বের করে দেখালো। বললো,এর ডগায় বিষ মেশানো আছে রে বাবু। একটু ছিঁড়ে দিলেই কাম ফতে।

দীপের মনে আছে একবার কোম্পানী ওকে ডমিনিকান রিওপাবলিক পাঠিয়েছিলো। কাজ সেরে ও গিয়েছিলো হিস্প্যানিওলা দ্বীপ। ওখানে নিয়ে যাবার জন্য লঞ্চ আছে। লঞ্চ তো নয়, ছোটোখাটো জাহাজ। ভূগোলে পড়েছিলো ও দ্বীপের দখলাতি নিয়ে স্পেন আর ফরাসীদের মধ্য লড়াই। কলহ হবে না কেন। গাইড ওদের বলেছিলো,এখানে মাটি খুব উর্বর
সাধারণত সামুদ্রিক মাটিতে দুর্লভ। তারপর যোগাযোগ ব্যাবস্থা সবই ভালো।

মানুষে মানুষে মিল দেখলেই ভারতবর্ষের কথা মনে পরে। কৃষিনির্ভর দেশ। পাশ্চাত্য দেশের রাস্তাঘাট, টেলি কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক,বিলাসবহুল রিসর্ট দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেছিলো দীপের। তবু ভারতবর্ষ, এক মন আনচান করার মোহময় দেশ। আনন্দময় দেশ।সেখানেও একটা সাহসী মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো।

আবার পাহাড়ি মেয়েটার কথায় চেতনা ফিরে এলো দীপের। বললো কি দেখছিস হাঁ করে বাবু। আমাকে না ওই পাহাড়কে। দীপ বললো,দুটোই।
মমে মনে ভাবলো,তোমার পাহাড় তো বাস্তবের পাহাড়কে হার মানিয়েছে। সাহস হলো না বলতে। কুকরি আছে। সাবধান। দীপ ভাবলো,মেয়েরা এখানকার সব চেনে। গাইড হিসাবে একেই নিতে হবে। অবশ্য মেয়েটি রাজী হলে তবেই।

দীপ বললো,আমাদের ঘুরিয়ে দেখাবি তোদের পাহাড়। আমার একটা বন্ধু আছে।
মেয়েটি বললো,আমার একদিনের মজুরি দিবি,তাহলে সব দেখাবো।

দেবো,দেবো নিশ্চয় দেবো।

আগে দে। গতবার এক হারামি পয়সা না দিয়ে পালিয়েছে।

দীপ একটা পাঁচশো টাকার নোট বার করে ওর হাতে দিলো। মেয়েটা হাসিমুখে একটা নমস্কার করলো। বললো,তু খুব ভালো। চ আমার সঙ্গে আয়।

দীপ আর অংশু ওর সঙ্গে গিয়ে দেখলো ওদের কাঠের বাড়ি। বুড়ো বাপ মেয়েটার রোজগারে খায়। খুব গরীব। এই গরীব মানুষগুলো ভারতের প্রাণ। বললো অংশু।বললো,এদের লাখ টাকা দিয়েও দেশ ছাড়াতে পারবি না। ওরা দেশকে হৃদয়ের এক অংশ মনে করে। দীপ বললো,এটা তোর পাকামির কথা। ভুগে মরবে তবু দেশ ছাড়বে না। তিন হাঁটুর এক মানুষকে দীপ বললো,আমার সঙ্গে যাবে। তোমার কোনো অভাব থাকবে না। লোকটি দুই হাঁটুর মাঝখান থেকে নেড়া মাথা তুলে বললো,তোর পয়সা তু রাখ,আমাকে আমার জাগায় থাকতে দে। মায়ের কোল ছেড়ে যাবো একবারে শ্যাষ দিনে। অংশু বললো,বেশি ঘাঁটাস না বোকাচোদা। ঝাড় খাবি।

মেয়েটা এবার সব জোগাড় করে ছাগলের দুধ দিয়ে চা বানিয়ে দিলো। দীপ আর অংশু খেলো
তারপর মেয়েটা ঝান্ডি পাহাড়ের আনাচে কানাচে ঘুরিয়ে আনলো। ঝালং এ ওরা বাস করে। খুব দূরে দূরে দুএকটি বাড়ি। ছবির মতো কোন শিল্পী এঁকেছেন কেউ জানে না। বললো অংশু।

সব ঘোরানোর পরে মেয়েটা বললো,রাতে কখন আসবি। বলে দে। আমার কাছে সোজা কতা। শরীল লিতে গেলে আরও টাকা লাগবে।

দীপ বললো,তার মানে। সে আবার কি। তু আমাদের সব দেখালি, পয়সা নিলি। তোর পরিশ্রমের হক্কের পাওনা। মনে রাখবি। তুই খুব ভালো। যা বাড়ি যা। শরীর চাই না। যা।

মেয়েটার চোখে জল। বলে সবাই আমার রূপ দেখে, মন দেখে না। তোর ভালো হবে।

এই বলে চলে গেলো। সেই রাতে দীপ ঘুমোতে পারলো না। শুধু পাহাড়ের ছবি জুড়ে সবুজ বরণ সাজ। মন পাগল করা সরলতা।

অংশু বললো,তুই প্রেমে পড়েছিস নাকি?কালকে রাতে ঘুমিয়েছিস তো?

চারদিন ওখানে থাকার পর ওরা আবার কলকাতা ফিরে এলো। দীপ বোলপুরে কাজ করে। কলকাতায় মেয়ে আর মেয়ের মা থাকে। মেয়ের মা বড়লোকের একমাত্র মেয়ে। ভালোবাসা কাকে বলে জানে না সে। দীপ ভাবে, হয়তো জিজ্ঞেস কর বে, ঘুরতে গেছিলে কেমন লাগলো। কিছু না। মেয়েটা এসে বললো,বাপি আমাদের এখানে একটা কাকু আসে মাঝে মাঝে। কে হয় আমাদের। দীপ সব জানে। ও বললো,আমাদের বাড়ি আসে মানেই আমাদের লোক। তোমার মায়ের বন্ধু। তুমি ভালো করে পড়বে। ওসব তোমাকে দেখতে হবে না মামণি।

দুদিন কলকাতা থেকে দীপ চলে গেলো বোলপুর কাজের জায়গায়। সারাদিন কাজ আর কাজ। বাড়ি ফিরে ও স্নান করে। মন আর শরীর দুটোই ফ্রেশ হয়। তারপর লেখা নিয়ে বসে। পড়াশুনা করে রাত বারোটা অবধি কোনো কোনো দিন। দীপ ভাবে, গ্রামে ও বড়ো হয়েছে। তুলি তখন দশম শ্রেণিতে পড়ে। দীপ তখন বারো ক্লাসে। একই স্কুলে পড়তো দুজনে। সাইকেলগুলো একটা ঘরে রাখতে হতো। দীপ সুযোগ বুঝে তুলিকে ডেকেছিলো। সেই ডাকে কি ভীষণ সারা তুলি যে দিয়েছিলে তা আজও মনে আছে দীপের। কেউ ছিলো না। টিফিনে মিড ডে মিল খেতে ব্যস্ত সবাই। তুলি তার তুলতুলে শরীরে শরীর ঘষে শিহরণ তুলেছিলো সারা শরীর জুড়ে
।দীপ ভাবে,যদি তুলির সঙ্গে নদীর ধারে কুটির বেঁধে বাস করতো তাকে বিয়ে করে তাহলে এক টুকরো আকাশের মালিক হতে পারতো। কিন্তু আর কোনো উপায় নেই। মেয়ে আছে। মেয়ের জন্য ত্যাগ স্বীকার তাকে করতেই হবে। মেয়ের মা তাকে ভালোবাসে না। তার কাছে কোনোদিন শোয় না। তাহলে মেয়েটা কার? কার সুখ আমি বয়ে নিয়ে বেড়াই নিশিদিন। দীপ ভাবে ছি ছি কি ভাবছে এসব। মেয়ের অকল্যাণ হবে না।

তারপর সুখেদুখে কেটে গেলো কুড়ি বছর। মেয়ের মা মারা গেছে। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। কোলকাতার বাড়িতে এখন জামাই আর মেয়ে থাকে। আর দীপ রিটায়ার্ড হওয়ার পরে বোলপুরেই থাকে।

একদিন দীপ শান্তিনিকাতনে ঘুরতে গেছে হেঁটে। এসময় হাঁটাহাঁটি শরীরের পক্ষে খুব ভালো। বয়স হয়েছে তো। দীপ হঠাৎ দেখলো একজন বিধবা মহিলা তার দিকেই এগিয়ে আসছেন। দীপ বিব্রত বোধ করছে। তিনি এসেই বললেন,এই যে আপনাকে বলছি,আপনি দীপ না? দীপ অবাক। আমার নাম জানেন কে আপনি?

——আমি তুলি, তোমার তুলি।

——তোমার তুলি! ও আমার হারিয়ে যাওয়া তুলি।
—- হ্যাঁ আমার এখানেই বিয়ে হয়েছিলো। ছেলেপিলে নেই। স্বামী মারা গেছেন। বাড়িতে আমি একা। তুমি কোথায় থাকো?

—–;আমি ভাড়া বাড়িতে থাকি।

—–ও কোলকাতায় থাকো না।

——না ওখানে মেয়ে থাকে। তার মা মরে গেছে অনেক আগেই।

——তা হলে এখন আমরা আবার আগের মতো হয়ে গেছি,সময়ের বিচারে।

—–কেন,আশীর্বাদ বলা যায় না?

——বলতে ভয় হয়। পোড়া কপাল আমার।

——সময় তো আশীর্বাদই করে,মানুষ তার যথাযথ সদব্যবহার করতে পারে না।

দীপ তুলিকে নিয়ে এখন কোথাও যেতে পারবে না। কারণ তুলি বিধবা । প্রথমে সঠিক একটা পরিচিতি বানাতেই হবে। তা না হলে মানুষ বিভিন্ন রকমের কথা বলবে। তাই একটা ভালো দিন দেখে ওরা বিদ্যাসাগরের ছবিতে প্রণাম জা নিয়ে কঙ্কালিতলায় বিয়েটা সেরে নিলো। তারপর নতুন একটা ঘর দেখে কীর্ণাহার শহরে ঘর ভাড়া করলো। সবাই নতুন বুড়োবুড়িকে বেশ হাসিমুখে বরণ করে নিলো।পূর্বকথা ওরা কেউ জানলো না। তুলির বাড়িটা বিক্রি করে অনেক টাকা পেয়েছে। ওরা ঠিক করলো,আর বাড়ি করবে না। কিছুদিনের মধ্যেই তো আপন বাড়িতে ফিরতে হবে। তাই তার আগে ভারতবর্ষের সমস্ত জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখবে। আর দীপ তার কলমে ফুটিয়ে তুলবে ভারতবর্ষের রূপ।

বাইরের ডাকে সাড়া দেবার আগে দীপ মেয়েকে মোবাইলে সব কথা জানালো। মেয়ে বাবার খুশিতে সুখী হলো। এবার দীপও তুলি বেরিয়ে পরলো আনন্দের সন্ধানে। ওরা চলে গেলো হিমালয়। কেদারনাথ,বদ্রিনারায়ণের পট খুলবে তৃতীয়ার দিন থেকে সাত দিনের মধ্যে।

পর্ব- আট

হিমালয়ের পথে পথে কেদার, বদ্রি, উখিমঠ,তিঙ্গনাথ,চোপতা সব ঘোরা হলো দুজনের। পরের দিন সকালে হরিদ্বার থেকে গাড়িতে রওনা হয়ে পথে পথে দেবপ্রয়াগ। ভাগীরথী এবং অলকানন্দ বেশ কিছুটা পথ আলাদা ভাবে গিয়ে গঙ্গা নামে বয়ে চলেছে। বাণীপ্রসাদ গাইড। সে সব বুঝিয়ে চিনিয়ে দিচ্ছে।দীপ আর তুলি দুজনেই খাতা, পেন বের করে সব টুকে রাখছে। লেখার সময় কাজে আসবে,বললো তুলি। বাণীপ্রসাদজী বলে চলেছেন,আমাদের বাস কর্ণপ্রয়াগে চলে এসেছে। গাড়োয়ালে অলকানন্দার সঙ্গে কুমায়ুন থেকে বয়ে আসা পিন্ডার নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। রাতে পিপলকোটি হোটেলে আশ্রয় নিলো সবাই। মোট তিরিশজন যাত্রী আছে । কেউ গুজরাটি।কেউ মারাঠি কেউবা বিদেশী টুরিষ্ট। সারা পৃথিবীর মিলনমেলা। বাইরে বেরোলে মন বড়ো হয় বলো,বললো তুলি। দীপ বললো,এদের মাঝে এসে আর কোনো দুঃখ আমাদের কাহিল করতে পারবে না। জীবন শুধু সংসারে আবদ্ধ রাখলে হবে না। তুলি মাথা নেড়ে সায় দিলো। তারপর রাত কেটে গেলো । প্রভাতের আলোতে তুলি আর দীপ বন্দনা করলো জগদীশ্বরের। তারপর প্রাতরাশ সেরে ওরা বেরিয়ে পরলো যোশীমঠ হয়ে বিষ্ঞুপ্রয়াগ। তুলি বললো,এখানেই নারদমুনি ভগবানের বরে তাঁর অভিশপ্ত মানবজীবন থেকে মুক্তি পান।
গাইড এবার বললেন,আমরা বদ্রি নাথে এসে পরেছি।

সত্যযুগে শ্রীবিষ্ঞু এখানে পদার্পণ করেছিলেন। বিশাল কষ্টিপাথরের মূর্তি। দীপ বললো,চলো এবার দুপুরের খাবার খাওয়া যাক। তারপর বিকালের দিকে পায়ে হেঁটে ভারতবর্ষের শেষ গ্রাম মানাগ্রাম। মানাগ্রাম খুব ভালো লেগে গেলো তুলি ও দীপের। ওরা গাইডকে হোটেল ও খাওয়া খরচাবাবদ সমস্ত টাকা মিটিয়ে দিয়ে বললো,ভাই আমরা এখানেই থাকবো। আর কোথাও যাবো না। গাইড বললো,আপলোগকো বালবাচ্চা কিদার হ্যায়। দীপ বললো,হাম অর মেরে জানানা। অর কোই নেহি। গাইড বললো,হম আপকো লেড়কা মাফিক,আপ্লোগোকা খেয়াল রাখুঙ্গা। দীপ ওর কথা শুনে আরও পাঁচশো টাকা বখশিস দিলো। সে বললো,বাপকা দিয়া হুয়া আশীর্বাদ এহি রুপাইয়া। হম খরচা নহি করেঙ্গে। মেরা সাথ সাথ রহেগা। চোখের জলে বিদায়ের পালা শেষ হলো। তুলি আর দীপ মানাগ্রামে একটা ঘর নিলো। সামনেই বদ্রিনাথ। সকালে পুজো দেয়,প্রার্থনা করে। রান্না করার সবকিছু জোগাড় হয়েছে। কোনো অসুবিধা নাই। সামনে শ্মশান আছে। গাড়ি করে নিয়ে যায় এরা। কিছুটা দূরে সরস্বতি নদী পাহাড়ের ফাটল থেকে অলকানন্দা নাম নিয়ে বদ্রিনাথ মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে। মন খারাপ হলেই ওরা দুজনে সেখানে বসে। তুলি বলে, প্রকৃতির ভাষা পড়তে পারলে কোনো দুঃখ থাকে না। মানা গ্রামের কিছুটা দূরে চিনের বর্ডার।
এগ্রামের বৈশিষ্ট্য হলো প্রত্যেক পরিবারের কেউ না কেউ ভারতীয় সেনা বিভাগের কাজে যুক্ত।

ওখানে থাকাকালীন সকলের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেলো তুলি আর দীপের। ভাষা ওদের বাধা হয়নি। অল্প হিন্দী ভাষা এরা জানে। আবার ওদের কেউ কেউ বাংলা জানে।

হঠাৎ একদিন সেই গাইড এসে হাজির। সে বললো,মা কিছু বাংলা হামি জানি। হামি এখানে টুরিষ্ট আনলে একবার দেখা করে যাবে। তুলি বললো,নিশ্চয় আসবে বাবা।

দীপ ভালো মিষ্টি এনে পাতানো ছেলেকে খাওয়ালো।
তুলি এক নতুন বৌয়ের কাছে যায়। তার স্বামী বিয়ের পরে যুদ্ধে চলে গেছে। খুব চিন্তা। তুলি সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু একদিন খবর আসে তার স্বামী যুদ্ধে নিহত। কি মর্মান্তিক ভাষায় বর্ণনা কর যায় না, বললো দীপ। ওর শ্বাশুড়ি বললো,অপয়া মেয়েটা আমার ছেলেকে খেলো। ওকে ঘরে রাখবো না। শেষে তুলি তাকে তুলে আনলো মেয়ের পরিচয়ে। সে তাদের মেয়ে হয়ে আছে। খুব কম বয়স মেয়েটার। সতেরো বছরের রূপবতী মেয়ে। সবার লক্ষ্য তার দিকে। দীপ বললো,এর বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। মেয়েটার বাবা মা বললো,আপলোগ ব্যাবস্থা করে দিন। আমরা গরীব আদমী। তুলি বললো,ঠিক আছে, তাই হবে।

আবার একমাস পরে গাইড ছেলেটি এলে তুলি বললো, তোমার বিয়ে হয়নি? ছেলেটি বললো কে দেবে আমাকে লড়কী বলেন। দীপ বললো,তোমার মতো আমার একটা মেয়ে আছে। করবে বিয়ে। কিন্তু তার বিয়ে হয়েছিলো। স্বামী মারা গেছে।

গাইড বললো,করবো সাদী।

তারপর মেয়েটিকে দেখে গাইডের খুব পছন্দ। একদিন বাবা মা কে দেখিয়ে নিয়ে গেলো
গ্রামের সবাই উপস্থিত থেকে ওদের বিয়ে দিয়ে দিলো।

আটদিন পরে যখন ওরা এলো খুব ভালো লাগছিলো তুলির। কি সুন্দর মানিয়েছে। ঠিক যেনো হরগৌরী। গ্রামের লোক সবাই ধন্য ধন্য করলো তুলি ও দীপের নামে। গ্রামের প্রিয়জন হয়ে গেলো ওরা। কিন্তু ওরা বাঁধা জীবনে আর থাকবে না।

কাউকে কিছু না জানিয়ে সমস্ত মায়া ছেড়ে তার আবার চললো অজানার সন্ধানে, পথে পথে…

এবার ওরা গেলো পুরী। জগন্নাথ দেবের দর্শন সেরে সমুদ্রের কাছে একটা ঘর ভাড়া করলো।
পরিচয় হলো শিবরূপের অসংখ্য মানুষের সঙ্গে। সমীর বলে একটি ছেলে একদিন বললো,দীপ দা একদিন আমার বাড়ি চলুন। দীপ বললো যাবো। তুলিকে দীপ বলছে, বুঝলে আজ সমীর বলে একটি ছেলের সাথে পরিচয় হলো। সে অনেক কথা বললো।তার কাছে শোনা কথা তোমাকে বলি শোনো।
সমীর সমুদ্রের কাছাকাছি একটি গ্রামে বাস করে । তার এক ছেলে ও এক মেয়ে ।স্ত্রী রমা খুব কাজের মহিলা । কাজের ফাঁকে গাছ লাগায় ছেলে মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে । সমীর গ্রামে গিয়ে ছেলে মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে গাছ লাগায়।আবার সময় পেলেই বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে অনেক অজানা তথ্য গ্রামবাসীদের শোনায়।
——- পরিবেশ বলতে কি বোঝায় গো অমর দা?একজন গ্রামবাসী জিজ্ঞাসা করলেন ।

—–সবুজ গাছপালা,জীবজন্তু,মানুষ নিয়েই পরিবেশ। আমাদের পৃথিবীর নানা দিকে বরফের পাহাড় আছে ।অতিরিক্ত গরমে এই বরফ গলে সমুদ্রের জল স্তর বাড়িয়ে দেবে ।ফলে সুনামী , বন্যায় পৃথিবীর সবকিছু সলিল সমাধি হয়ে যাবে । সবুজ পরিবেশ আমাদের বাঁচাতে পারে একমাত্র।

——তাহলে এর থেকে বাঁচার উপায় কি?
—-মানুষকে প্রচুর গাছ লাগাতে হবে ।
——কি পদ্ধতি বলুন দাদা । কি করতে হবে আমাদের,সাধ্যমত করবো।
——এই যে পাখি ওপশুরা মল ত্যাগ করে বিভিন্ন স্থানে তার সঙ্গে গাছের বীজ থাকে ।এই বীজ গুলি থেকে বিভিন্ন গাছের চারা বেরোয় । বাবলা,গুয়ে বাবলা,নিম, বট,প্রভৃতি চারা প্রকৃতির বুকে অযাচিত ভাবেই বেড়ে ওঠে ।শিমূল গাছের বীজ উড়ে চলে আসে । একে আমরা বুড়ির সুতো বলি । তারপর বর্ষাকালে জল পেয়ে বেড়ে ওঠে ।
—–তাহলে আমাদের কাজ কি?
——-আমাদের কাজ হলও ওই চারা গুলি বড় করা ।তার জন্য আমাদের বাঁশের খাঁচা বানিয়ে ঢাকা দিতে হবে । পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ যদি এই নিয়মে মেনে গাছ লাগায় তবেই একমাত্র বিশ্ব উষ্ণায়নের কোপ থেকে রক্ষা পাবে ।

কিন্তু দুঃখের বিষয় মানুষের চেতনা এখনও হয়নি । গাছ কাটা এখনও অব্যাহত আছে ।তাইতো এত গরম ।বৃষ্টির দেখা নেই ।

অমর খুবই চিন্তার মধ্যে আছে । রাতে তার ঘুম হয়না । বর্ষাকাল চলছে ।সমুদ্র ফুলে উঠেছে আক্রোশে ।কি হয় ,কি হয় ।খুব ভয় ।
সমীর ভাবে,মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে বেইমানি করেছে । এর প্রতিশোধ প্রকৃতি নেবেই । তারপর অন্য কথা ।

পর্ব- নয়

একদিন বর্ষাকালে রাতে সবাই ঘুমিয়ে আছে কিন্তু জেগে আছে অমর আর সমুদ্রের বিষাক্ত ফণা । মাঝ রাতে সু না মীর একটা বড় ঢেউ এসে গ্রামের সবাই কে ভাসিয়ে নিয়ে গেল ধ্বংসের পথে । এখন সেই গ্রাম শ্মশানের মত ফাঁকা ।
প্রকৃতি এখনও সুযোগ দিয়ে চলেছে বারে বারে । সাবধান হলে বাঁচবে । তা না হলে ধ্বংস অনিবার্য ।
দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে তুলি বললো,
শত সহস্র অমরকে এগিয়ে আসতে হবে পৃথিবীর রক্ষাকর্তা হয়ে ।তবেইবাঁচবে আমাদের পৃথিবী।

দীপ বললো
বন্যার জলে সব কিছু সম্প্ত্তি ভেসে গেলেও অমর কিন্তু লড়াই করে বেঁচে আছে। সাঁতার কেটে শিশুপুত্রকে নিয়ে নিজেদের জীবন কোনোরকমে বাঁচিয়েছে।
তারপর দীপ ও তুলি গেলো অমরের বাড়ি। অমরের স্ত্রী তুলির সঙ্গে গল্প করছে। দীপ অমরকে কাছে পেয়ে বলতে শুরু করলো ছোটোবেলার কথা। দীপ বলছে,

আমরা ছোটোবেলায় মোবাইল পাই নি। কিন্তু আমরা যেসব আনন্দের অংশিদার ছিলাম সেসব আনন্দ এখনকার ছেলেরা আর পায় না। ইতিহাসের বাইরে চলে গেছে ভুলোলাগা বামুন।
ঠিক বলেছেন দাদা,আপনি বলুন। আমি শুনছি।

দীপ আবার বলতে শুরু করলো,জানো,
তিনি ঝোলা হাতে মাথায় গামছা জড়িয়ে আসতেন শিল্পকর্ম দেখিয়ে রোজগার করতে। তিনি আমাদের বাড়িতে এসে শুরু করতেন নিজের কথা বা শিল্পকর্ম। নাটকের অভিনয়ের ভঙ্গিমায় বলতেন, আর বলো না বাবা। তোমাদের গ্রামে আসতে গিয়ে চলে গেলাম ভুলকুড়ি ভুল করে। তারপর মেলে, কোপা, বিল্বেশ্বর, চুরপুনি, সুড্ডো ঘুরে কোমডাঙ্গা। তারপর কেতুগ্রাম, কেউগুঁড়ি হয়ে গুড়ি গুড়ি পায়ে হেঁটে পোশলা, নঁগা, খাটুন্দি, পাঁচুন্দি হয়ে তৈপুর, পাড়গাঁ, বাকলসা, পাঁচুন্দি, মুরুন্দি, সেরান্দি,খাটুন্দি পার করে কাঁদরের গাবায় গাবায় হেঁটে এই তোমাদের গ্রামে।

আমরা জিজ্ঞেস করতাম, এতটা পথ হাঁটলে কি করে দাদু। তিনি বলতেন, সব ভূতের কারসাজি। তেনারা ভুলো লাগিয়ে দেন। ভর করে দেহে। তাই এতটা পথ হাঁটতে পারি। তারপর চালটা, কলাটা, মুলোটা দিতেন তার ঝোলায় আমার মা বা পিসি।
অমর আবার কবি। তাই আমার বাতেলা শুনতে ভালেবাসে।
কবিকে বললাম, তুমি তো জানো আমি

রূপসী বাংলার রূপে ছুটে যাই। কিন্তু আমার চেনা পৃথিবীর সবটা হয়ে যায়
অচেনা বলয়,মাকড়সার জালের মতো জটিল । সবাই এত অচেনা অজানা রহস্য ময় ।বুকটা ধকধক করছে,হয়তো মরে যাবো, যাবো সুন্দরের কাছে,চিন্তার সুতো ছিঁড়ে কবির ফোন এলো । এক আকাশ স্বপ্ন নিয়ে, অভয়বাণী মিলেমিশে সৃষ্টি করলো আশা ।আর আমি একা নই,কবির ছায়া তাঁর মায়া আমাকে পথ দেখায়…

অমর বলে,দীপদা, আপনিও কবি। কি সুন্দর কথা বলেন।

দীপ বলে দেখো বিদেশের লোকরা
নেচে নেচে খোল করতাল বাজিয়ে আমাদের মহাপ্রভু চৈতন্য দেবের নামগান করে। এই হলো ভারতবর্ষ।
অমর বলে,ঠিক,আমরা তার সম্মান রাখতে পারছি কই? দীপ বললো,
শোন আমাদের পুজোবেলার কথা।

পুজো আসার আগে থেকেই বাড়িতে মা ও বাবা নানারকম মিষ্টান্ন তৈরি করতে শুরু করতেন। গুড়ের নারকোল খন্ড, চিনি মিশ্রিত নারকোল খন্ড, সিড়ির নাড়ু, গাঠিয়া প্রভৃতি। গুড়ের মিষ্টির ব্যতিক্রমি গন্ধে সারা বাড়ি ম ম করতো। আমরা স্বতঃস্ফুর্ত অনুভূতিতে বুঝে যেতাম পুজোর দেরি নেই। পুজোর কটা দিন শুধু খাওয়া আর খাওয়া। বাড়িতে যারা যাওয়া আসা করতেন তারাও পুঁটুলি বেঁধে নিয়ে যেতেন চিড়ি,মুড়কি, মিষ্টি মায়ের অনুরোধে ও ভালোবাসায়।

এখন গুড়ের মিষ্টি, ছানার মিষ্টির তুলনায় ব্রাত্য। কিনলে সবই পাওয়া যায়, ভালোবাসা মাখানো তৃপ্তি পাওয়া যায় কি?
আমি বহু জায়গায় ঘুরে ঘুরে বাস করি রেল স্টেশনের ধারেই আমার তখন বাসস্থান । অই পাড়ায় আমি পনেরো বছর ছিলাম । সকালের দৃশ্য বড়ো মনোহর । শহরের মহিলা পুরুষ সকলেই একসাথে প্রাতঃভ্রমণে ব্যস্ত । সবুজের নির্মল হাওয়ায় মন হারিয়ে যায় সুন্দর হাওয়ায় । তারপর সারাদিন স্টেশনের ব্যস্ততার সময় । ঠিক গোধূলির আলোয় আবার মানুষের মন হারানোর পালা । চুপিচুপি অন্ধকার রূপের আদরে আশাতীত ভালোলাগার পসরা সাজায় প্ল্যাটফর্ম ।হারিয়ে যাওয়ার আনন্দে আলোকের গোপন ঈশারা,তোমার অন্ধকার ভোগের শেষে । অন্ধকারের মূল্য অসাধারণ । আলোর স্পর্শে ভালোলাগার কারণ এই আঁধার ।
আঁধার কালো, কালো সুন্দর, অকৃত্রিম আনন্দের সাজি সাজায় কালো । এইসব চিন্তা করতে করতে রাত নামে । আলো জ্বালিয়ে বুড়োদের তাসখেলার আসর শেষ হয়। সমস্ত প্রবীণ অভিমান তারা ঝেরে ফেলে ঝরঝরে নবীন মনে বাড়ি ফেরেন তারা ।

গল্প করতে করতে কখন যে রাত হয়ে গেছে বুঝতে পারেনি দীপ।

বৌমা বললো,আজ রাতে আপনারা আমাদের বাড়িতে থাকুন। আজ যেতে দেবো না।

তুলি আর দীপ এদের নিয়ে বেশ সুখে আছে। ঈশ্বর দর্শন ওদের মানুষের মাঝেই হয়ে গেছে।
রাত জেগে ওরা ঠিক করেছে, আগামীকাল ওরা আবার অন্যস্থানে ঘুরতে যাবে। কিন্তু ওরা অন্য কাউকে তাদের গোপন কথা বলে না।

দশদিন অমর দীপদার দেখা পায় নি। তাই একবার ওদের বাসা বাড়িতে দেখা করতে গেলো। বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করলো,দীপ দাদা কোথায় গেছে।

বাড়িওয়ালা বললো,বড় ভালো মানুষ পেয়েছিলাম গো। আমাকে এক মাসের পয়সা বেশি দিয়ে চলে গেছে।

অমর বললো কোথায় গেছেন বলতে পারবেন।

—–না, বাবা। ওরা বললো আমাদের নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা নেই। সব সাধু লোক গো। সংসারে কে যে কোন রূপে থাকে চেনা যায় না বাবা। এই বলে হাতটা কপালে ঠেকালেন।

অমর মাথা নীচু করে বাড়ি ফিরে চললো।

সে ভাবে, দিবারাতি নিজেকে ঠকিয়ে কোন ঠিকানায় ঠাঁই হবে আমি সর্বস্য মানুষের ।নিজেকে নিজের প্রশ্ন কুরে কুরে কবর দেয় আমার অন্তরের গোপন স্বপ্ন । জানি রাত শেষ হলেই ভোরের পাখিদের আনাগোনা আরম্ভ হয় খোলা আকাশে । আমার টোনা মাসিকে টোন কেটে অনেকে অভিশাপ দিতো । আমি দেখেছি ধৈর্য্য কাকে বলে । আজ কালের কাঠগোড়ায় তিনি রাজলক্ষ্মী প্রমাণিত হয়েছেন । কালের বিচারক কোনোদিন ঘুষ খান না । তাই তাঁর বিচারের আশায় দিন গোনে শিশুর শব, সব অবিচার ,অনাচার কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেবে আগামী পৃথিবীর ভাবি শিশু প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি। অপেক্ষায় প্রহর গোনে নিজের অন্তরের প্রদীপ শিখা জ্বালিয়ে । সাবধান খুনীর দল ,একবার হলেও অন্তত নিজের সন্তানের জন্য শান্ত পৃথিবী রেখে যা । ঋতু পরিবর্তন কিন্তু তোর হত্যালীলায় বন্ধ হবে না নির্বোধ ।শান্ত হোক হত্যার শাণিত তরবারি ।নেমে আসুক শান্তির অবিরল ধারা। রক্ত রঙের রাত শেষে আলো রঙের নতুন পৃথিবী আগামী অঙ্কুরের অপেক্ষায়।

পর্ব-১০

তারপর সংসারের টানা পোড়েন।রাগ,হিংসা,ক্রোধের সংমিশ্রণে সংসার স্রোতে ভাসতে ভাসতে জীবন প্রবাহ এগিয়ে চলে। হয়তো এর ফলেই দাদুর শেষজীবনে সেবার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা। আমি নিয়ম করে দাদুকে গীতাপাঠ করে শোনাতাম। দাদু কত গল্প বলতেন। কোনোদিন হা পিত্যেশ করতে দেখিনি। আমার সময় কাটতো দাদুর কাছেই বেশি। পড়াশোনার ফাঁকে চলতো গীতাপাঠ। আমি জিজ্ঞেস করতাম,দাদু মরণের পরে আমরা কোথায় যাই? দাদু বলতরন,জানি না ভাই। তবে।।মরণের পরে যদি যোগাযোগ করা যায়,তাহলে আমি তোকে নিশ্চয় জানাবো। দাদু বলতেন, আমি যখন শেষ বিছানায় শোবো,তখন আমি ঈশারা করবো হাত নেড়ে। তখন তুই গীতার কর্মযোগ অধ্যায় পড়ে শোনাবি। তোর মঙ্গল হবে। আমিও শান্তিতে যেতে পারবো। হয়েছিলো তাই। কর্মযোগ পাঠ করা শেষ হতেই দাদুর হাত মাটিতে ধপাস করে পরে গেলো। দাদু ওপাড়ে চলে গেলেন হেলতে দুলতে চারজনের কাঁধে চেপে। মাথাটা দুই বাঁশের ফাঁক গলে বেরিয়ে ঝুলছিলো। আমি বলে উঠলাম, ওগো দাঁড়াও দাদুর লাগবে। মাথাটা ঠিক কর বালিশে দি। কেঁধো বললেন,মরে গেয়েচে। ছেড়ে দে। আমি বললাম, না ঠিক করো। তারপর ঠিক করলো দাদাভাই,দাদুর মাথাটা বালিশে দিয়ে।
আমি ভাবতে শুরু করলাম,মৃত্যু কি জীবনের আনন্দ কেড়ে নিতে পারে? পারে না।
সব কিছুর মাঝেই ঋতুজুড়ে আনন্দের পসরা সাজাতে ভোলে না প্রকৃতি। সংসারের মাঝেও সাধু লোকের অভাব নেই। তারা মানুষকে ভালোবাসেন বলেই জগৎ সুন্দর আকাশ মোহময়ী, বলেন আমার মা। সব কিছুর মাঝেও সকলের আনন্দে সকলের মন মেতে ওঠে। সকলকে নিয়ে একসাথে জীবন কাটানোর মহান আদর্শে আমার দেশই আদর্শ।
সত্য শিব সুন্দরের আলো আমার দেশ থেকেই সমগ্র পৃথিবীকে আলোকিত করুক।
আমি বললাম, এক নাগাড়ে বকে গেলি অনেকক্ষণ। বন্ধু বললো, তুমি আরও কিছু বলো। সেই জন্যই তোমার কাছে আসা। আমি আবার বলতে শুরু করলাম,আমার কথা আমার গোপন কথা। আমার অনুভবের কথা। কবি বন্ধু আমার কথা শুনতে ভালোবাসে। সে সংসারী। তবু সব কিছু সামলে তার কবিতা ত লিখে চলে। আমি বন্ধুকে বলতে শুরু করলাম শরত জীবনের কথা।

শিউলি শরতের ঘ্রাণে শিহরিত শরীর। শিউলি নামের শিউলি কুড়োনো মেয়েটি আমার শৈশব ফিরিয়ে দেয়।
মনে পড়ে পিসির বাড়ির শিউলি গাছটার তলায় অপেক্ষা করতো ঝরা ফুলের দল। সে জানত ফুল ঝরে গেলেও
তার কদর হয় ভাবি প্রজন্মের হাতে । সে আমাদের ফুল জীবনের পাঠ শেখায়। মানুষও একদিন ফুলের মত ঝরে যায়। । শুধু সুন্দর হৃদয় ফুলের কদর হয়। শিমূল ফুলের মত রূপ সর্বস্ব মানুষের নয়। শরত আমাদের তাই শিউলি উপহার দেয় শিমূল নয়।
শিউলি ফুল তোলার পরে আমাকে দিত। শরতের মেঘ। হঠাৎ বৃষ্টি।।
আমার মনে পড়লো মাধবী আমাকে বৃষ্টির একটা বর্ণনা লিখে পাঠিয়েছিলো। সে বলেছিলো, তুমি তো লেখালেখি করো। আমার লেখাটা পড়ো। সে লিখেছিলো, বর্ষার কথা।

ঝরে চলেছে অবিশ্রান্ত। রাস্তায় বর্ষাতি ঢাকা প্রেমঋতুর আনন্দ বরিষণ বাড়িয়ে চলেছে উদ্দাম বৃষ্টির গতি । আনন্দে সে ভাসিয়ে চলেছে খাল বিল নদীর প্রসারিত কামদেশ। এখন ভাসাতে ব্যস্ত । তার সময় মাত্র দুই মাস । তারপর তাকে ময়দান ছাড়তে হবে । তাই সে নিজেকে উজার করে ঢেলে সাজাতে চায় ভিজাতে চায় শুকিয়ে যাওয়া ফুরিয়ে যাওয়া হৃদয় ।মাঝে মাঝে খেয়ালের বশে এত বেশি উচ্ছল হয় বর্ষাহৃদয় যে নদীর ধারা উপচে পড়ে ঘটায় অনর্থ । বন্যারাণী আবেগের ধারায় ভাসিয়ে দেয় গ্রাম শহরের সভ্যতা । মানুষের প্রতি রাগ যেনো ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে । মানুষ তবু শিক্ষা পায় কি ?কিছু অর্বাচিন গাছ কেটে সাহারাকে ডেকে আনতে চায় । কিছু মানুষ প্রকৃতির গতি হাতের মুঠোয় বন্দী করতে চায় । ফল হয় বিপরীত ।
অমর পৃথিবীর মানুষকে বলতে চায় তার অন্তরের কথা।
এসো বন্ধু আমরা সবাই বর্ষাহৃদয়ে ভিজি। যতদিন বাঁচি ভিজি,আনন্দ করি,বৃষ্টির সাথে খেলা করি। তারপর আমরা সকলে মিলিত হবো শেষ সম্মেলনে ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে। সেখানে কি খুঁজে পাবো এই বৃষ্টিহৃদয়?

এইসব ভাবতে ভাবতে সে পথের সন্ধান পেলো। পথ চলাই জীবন। এখনও তাকে চলতে হবে অনেক অজানা আকাশের পথ। তারপর শুরু হবে সোনার ধানের মরশুমে নতুন ভোর।

আর এক অন্য ভালোবাসার কথা

১১
সোমা লালবউ এলেই তার কাছে চুনোমাছ কেনার জন্য বায়না ধরত।অথচ সোমার বাবার পুকুর আছে।বড় বড় মাছ আছে।লালবউ অবাক হয়ে বলত,তুমি চুনোমাছ খাবে কেন দিদিভাই।তোমাদের পুকুর আছে।সোমা বলত,লাল শাড়ি পরে তোমাকে মাছ আনতে দেখলেই আমার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়।আমার মা চুনোমাছ খুব ভালবাসতেন।
সোমা চুনোমাছ দিয়ে ভাতটা খেয়ে নিত।অন্য কারও কাছে নিলে সোমা ভাত খেত না।
সোমাকে দেখলেই লাল বউ মাছ দিত কত গল্প বলত।রূপকথার দেশে সোমা হারিয়ে যেত।
তারপর সোমা বড় হল।স্কুলে পড়তে পড়তে কত ঘটনা ঘটল।
সোমা পড়ত ওকড়সা হাই স্কুলে।একবার বর্ষায় কাঁকড়ার দল উঠে এল রাস্তায় সারে সারে।কাঁকড়াগুলো টিফিনবাক্সে ভরে নিয়ে সকলে ব্যাগে রাখল।টিফিনের পর ক্লাস শুরু হল। বাংলা স্যার পড়াচ্ছেন আর ঢুলছেন।এদিকে কাঁকড়াগুলো টিফিনবাক্সের ভিতর খরখর আওয়াজ শুরু করেছে।সকলে হাসছে।স্যার বললেন,হাসছ কেন বেয়াদবরা।চুপ কর। আবার হাসির শব্দ। স্যার রেগে গিয়ে হেডমাস্টারকে ডাকলেন।হেডস্যার বললেন,তোমরা হাসছ কেন?
সোমা বলল,স্যার টিফিনবাক্সের ভিতর কাঁকড়ার আওয়াজে আমরা হাসছি।
হেডস্যার বললেন,আমরাও একবার বর্ষায় কাঁকড়া ধরে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম।বেশ আর হেসো না। এবার মন দিয়ে পড়া কর।
এইভাবে সময় বয়ে যায়।সোমার জীবন প্রবাহ চলতে থাকে নদীর স্রোতের মত।বিয়ে হল,ছেলে হল, কুড়িবছর পার হল।

একটা মেয়ে ইচ্ছে করলে পৃথিবীর সব কঠিন কাজ হাসিমুখে করতে পারে। দশভূজা দুর্গা। স্বামীর অফিসের রান্না,ছেলেকে স্কুল পাঠানোর পরে বাসনমাজা,কাপড়কাচা ও আরও কত কি? দুপুরবেলা বই নিয়ে বসে ঘুমে ঢুলে পরতো সোমা। আবার কোনো কোনো দিন ভাবনার সাগরে ডুব দিতো অনায়াসে। মনে পরতো কিশোরীবেলার স্কুলের পথে আলপথের ধারে ক্যানেলের জলে রং বেরংয়ের মাছের কথা। গামছা দিয়ে ছেঁকে তুলতো বায়েনবুড়ো কত মাছ। বায়েন বুড়োর কাছে চেয়ে একটা বোতলে ভরে রাখতো জল। আর তাতে সাঁতার কাটতো ছোটো ছোটো তেচোখা মাছ। পুকুরের ধারে বসতো বুড়ি গিন্নির ছাই দিয়ে বাসন মাজা দেখতে। কি ভালো যে লাগতো। মনে হতো দিই বুড়ির বাসন মেজে। কিন্তু সাহস করে বলতে পারে নি কোনোদিন। সন্ধেবেলা সিধুকাকা পড়াতে আসতো।সোমাব বলে, আমরা টিউশনির মেয়েরা সুর করে পড়তাম একসাথে। তারপর খাওয়ার পরে শোওয়ার পালা। ঠাকুমার পাশে শুয়ে শুনতাম পুরোনো দিনের কত গল্প। গল্প শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পরতাম ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে। জয়া এইসব ভাবতো আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামতো ঘাটে। স্বামী,ছেলে,মেয়েরা চলে আসতো তার স্বপ্ন নীড়ে। আবার শুরু হতো সংসারের ঘানিটানা কলুর বলদের মতো। দুঃখ,সুখের অপূর্ব মিশ্রণে বয়স কাঁটা এগিয়ে চলে টিক টিক শব্দে।

লাল শাড়ি পরে বৌটা তখনও চুনোমাছ বিক্রি করত পাড়ায় পাড়ায়। গ্রামের বান্ধবীর কাছে ফোন করে জানত তার কথা।সোমা ছোটবেলা থেকেই বৌটাকে দেখে তার বাবাকে বলতো, আমি লাল বউ এর কাছে মাছ নেব। তারপর থেকে লালবৌ এলেই সোমাদের বাড়ি আগে মাছ দিত। অতিরিক্ত মাছও দিত ভালবেসে।

সোমা দূর দূরান্তে না গিয়ে কাছাকাছি না দেখা গ্রাম দেখতে ভালোবাসত।একবার গেল বেলুন ইকো ভিলেজ পরিদর্শনে।সোমা জানে, হাওড়া আজিমগঞ্জ লোকাল ধরে শিবলুন হল্টে নামতে হয়। একবার সেখান থেকে অম্বলগ্রাম পাশে রেখে দু কিলোমিটার টোটো রিক্সায় বেলুন গ্রাম। একদম অজ পাড়াগাঁ। মাটির রাস্তা ধরে বাবলার বন পেরিয়ে তন্ময়বাবুর স্বপ্নের জগতে প্রবেশ করলাম।তন্ময়বাবু ঘুরিয়ে দেখালেন। তার জগৎ।প্রায় একশো প্রজাতির গাছ।পশু,প্রাণীদের উন্মুক্ত অঞ্চল।বিভিন্ন প্রজাতির সাপ ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে, সেখানে।তার নিজের হাতে বানানো মা কালীর মূর্তি দেখলাম। কাঁচের ঘরে ইকো সিষ্টেমের জগৎ।কেউটে সাপ, ব্যাঙ থেকে শুরু করে নানারকমের পতঙ্গ যা একটা গ্রামের জমিতে থাকে। বিরাট এক ক্যামেরায় ছবি তুলছেন তন্ময় হয়ে।আমি ঘুরে দেখলাম প্রায় দু কোটি টাকা খরচ করে বানানো রিসর্ট।ওপেন টয়লেট কাম বাথরুম।পাশেই ঈশানী নদী।এই নদীপথে একান্ন সতীপীঠের অন্যতম সতীপীঠ অট্টহাসে যাওয়া যায় নৌকায়। তন্ময়বাবু হাতে সাপ ধরে দেখালেন। শিয়াল,বেজি,সাপ,ভ্যাম আছে। তাছাড়া পাখির প্রজাতি শ খানেক।একটা পুকুর আছে। তার তলায় তৈরি হচ্ছে গ্রন্হাগার।সোমা বলে, শীতকালে বহু বিদেশী পর্যটক এখানে বেড়াতে আসেন। তন্ময়বাবু বললেন,স্নেক বাইটের কথা ভেবে সমস্ত ব্যবস্থা এখানে করা আছে। ঔষধপত্র সবসময় মজুত থাকে।
সোমা লালবউ আর বাড়ির লোকের সঙ্গে বেড়াতে যেত কাছাকাছি জায়গাশ।সোমা বলে, হ্যাঁ, বেলুন গ্রামটা ঘুরে দেখলাম। এখানকার চাষিরা সার,কীটনাশক ব্যবহার করেন না। তারপর বিকেলে নৌকাপথে চলে গেলাম অট্টহাস সতীপীঠ।এখানে মা মহামায়ার ওষ্ঠ পতিত হয়েছিলো। সোনা মহারাজ এই সতীপীঠের প্রধান। তারপর দেখলাম পঞ্চমুন্ডির আসন।ঘন বনের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। মন্দিরে মা কালীর মূর্তি। রাতে ওখানেই থাকলাম।

তার পরের দিন সকালে হাঁটাপথে চলে এলাম কেতুগ্রাম বাহুলক্ষীতলা। কথিত আছে এখানে মায়ের বাহু পতিত হয়েছিলো। এটিও একান্ন সতীপীঠের এক পীঠ।তীর্থস্থান। সুন্দর মানুষের সুন্দর ব্যবহারে মন ভালো হয়ে যায়।এর পাশেই আছে মরাঘাট। সেখান থেকে বাসে চেপে চলে এলাম উদ্ধারণপুর।এখানে লেখক অবধূতের স্মৃতি জড়িয়ে আছে।গঙ্গার ঘাটে তৈরি হয়েছে গেট,বাথরুম সমস্তকিছু।শ্মশানে পুড়ছে মৃতদেহ।উদ্ধারণপুর থেকে নৌকায় গঙ্গা পেরিয়ে চলে এলাম কাটোয়া। এখানে শ্রীচৈতন্যদেব সন্ন্যাস নেবার পরে মাথা মুন্ডন করেছিলেন। মাধাইতলা গেলাম। বহুবছর ব্যাপি এখানে দিনরাত হরিনাম সংকীর্তন হয় বিরামহীনভাবে। বহু মন্দির,মসজিদ বেষ্টিত কাটোয়া শহর ভালো লাগলো।তার পরের দিন রোদের ভালবাসার আদর গায়ে মেখে সস্ত্রিক উইকেন্ডসে আমরা এসেছি এখানে ভালোবাসার টানে। বহুবছরের ঋণ মনে হয় জমা হয়ে আছে এই খোলা মাঠের মায়ায়।স্ত্রী বলল, তুমি হানিমুনে এসে কবি হয়ে গেলে। সোমা, বলল,এটা আমার দূরে যাওয়া না হলেও আফটার অল হানিমুনে আসতে পেরে ভালো লাগছে খুব।

১২
সোমা বলছে সকলকে ,সিঙ্গি হল বাংলার প্রাচীন গ্রাম। এই গ্রামেরই নদী পুকুর খাল বিল জলাশয় সব আছে। ফসল বিলাসী হওয়ার গন্ধ আছে সিঙ্গীর মাটির উর্বরতায় ফুলে ফলে ফসলের সুন্দর গ্রাম।
বাংলার সব পাখিরা কমবেশি সিঙ্গীর আকাশে বাতাসে ঘুরপাক খায়। তিনি বিখ্যাত করেছেন ইতিহাসে স্থান করে দিয়েছেন।কবি কাশীরাম দাস সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন মহাভারতের কাহিনী। এই মহাপুরুষের জন্মভিটার সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। আমরা দিনে তাঁর ভিটাতে দাঁড়িয়ে তাঁকে শ্রদ্ধাসংগীত শোনাতে পারি। তারপর অনেকটা হেঁটে গিয়ে দাসপাড়া পেরিয়ে গিয়ে বটবৃক্ষের তলায় দাঁড়ালাম উদাস হয়ে। এই স্থানের মাটি কপালে বুলিয়ে নিলাম একবার। সবাইকে ক্ষেত্রপালের মন্দির নিয়ে গেল। ক্ষেত্রপাল বটবৃক্ষের নিচে অবস্থিত। তারপরে রাস্তা দিয়ে গিয়ে সোজা শিব মন্দির।
এখন পাকা রাস্তা হয়ে গেছে বুড়ো শিবের মন্দির যেতে। সোমা বলল, ছোটবেলায় আমাদের কোপা গ্রামে মাটির রাস্তা ধরে ধুলোমেখে ঘরে ঢুকতাম। বর্ষাকালে এক হাঁটু কাদা হয়ে যেত। গোরুর গাড়ি ছাড়া কিছুই যান ছিল না। আর ছিল পাল্কি। গ্রামের ছেলেমেয়ের বিয়ে হলেই শুনতাম পাল্কির গান।
সোমা এই গাঁয়ে মায়ের গন্ধ পায়।সোমা বড় হলে, তার বিয়ে হল। সংসারে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আগের ছোট্ট মেয়েটি বড় হয়েগেল। তারপর সোমার ছেলে হল। কালস্রোতে সংসারে মিশে গেল ।অনেকদিন পরে সোমা ছেলেকে নিয়ে বাবার বাড়ি এল। জেলে পাড়ার মোড় পেরোতেই দেখা হল লাল বউ এর সঙ্গে। সোমা বল্ল,লালবৌ কেমন আছ? চুনোমাছ এখনও বিক্রি কর ? লালবৌ সোমাকে চিনতে পারল না। সোমা বলল, আমি মন্ডলপাড়ার সাদা বাড়িটার পাশে থাকি গো।ছোটবেলায় তোমার কাছে মাছ নিতাম। বয়সের চাপে লালবৌ বুড়ি হয়েছে। সোমাও বড় হয়েছে। তাকে সে প্রায় কুড়ি বছর পরে দেখল।লালবৌ করুণ সুরে বলল,আমি আর মাছ বেচি না গো। ছেলের বউ এর অনাদরের ভাত খাই।নিলুদা ছোট থেকেই এই লালবৌকে বুড়ি অবস্থায় দেখাশোনা করত।

ছোটবেলায় নিলুদার সঙ্গে খেলতে যেতাম নানা জায়গায়।নিলুদা উইকেট কিপিং করতেন।আমরা ছিলাম নিলুদার ফ্যান।তাঁর সাথে সময় কাটাতে ভাল লাগত।
গ্রীষ্ম অবকাশে বট গাছের ডালে পা ভাঁজ করে বাদুড়ঝোলা খেলতাম নিলুদার নেতৃত্বে।তারপর ঝোল ঝাপটি। উঁচু ডাল থেকে লাফিয়ে পড়তাম খড়ের গাদায়। এসব খেলা নিলুদার আবিষ্কার। তারপর সন্ধ্যা হলেই গ্রামের বদমাশ লোকটিকে ভয় দেখাত নিলুদা। বদমাশ লোকটি বটগাছের ডাল থেকে শুনলো, কি রে বেটা খুব তো চলেছিস হনহনিয়ে। আয় তোকে গাছে ঝোলাই। সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। তারপর থেকে ও পথে যেত না বদমাশ লোকটি। সাদা চুলো বুড়োকে রোজ সন্ধ্যাবেলা নিজের মুড়ি খাইয়ে আসতো অতি আদরে। নিলুদা বলতো, আমরা তো রাতে খাবো। বুড়োর কেউ নেই, আমি আছি তো। শ্রদ্ধায় মাথা নত হত নেতার হাসিতে। নিলুদা বলতেন,ভাল বন্ধু পেতে দশ ক্রোশ হাঁটতে হলেও হাঁটবি তবু ক্রুর ব্যাক্তির সঙ্গে মিশবি না।

একবার বন্যার সময় স্কুল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের নেতা। কোথাও সাঁতার জল কোথাও বুক অবধি জল। একটা সাপ নিলুর হাতে জড়িয়ে ধরেছে। এক ঝটকায় ঝেরে ফেলে দিলো সাপটা। স্কুল আমাদের যেতেই হবে। সাঁতার কাটতে কাটতে আমাদের সে কি উল্লাস। যে কোনো কঠিন কাজের সামনাসামনি বুক চিতিয়ে সমাধান করার মতো মানসিকতা নিলুর ছিলো। সে সামনে আর আমরা চলেছি তার পিছুপিছু। শেষ অবধি পৌঁছে গেলাম স্কুল। হেড মাষ্টারমশাই খুব বাহবা দিলেন স্কুলে আসার জন্য। তিনি বললেন, ইচ্ছা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।

টিফিনের সময় ছুটি হয়ে গেলো। আসার সময় একটা নৌকো পাওয়া গেলো। মাঝি বললেন, আমার বয়স হয়েছে আমি একা অতদূর নৌকা বাইতে পারবো নি বাবু। তাছাড়া আমার এখনও খাওয়া হয় নি।

নিলু সঙ্গে সঙ্গে নিজের টিফিন বের করে দিলো। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিফিন বের করে দিলাম। মাঝি ভাই বললেন, এসো সবাই এক হয়ে খেয়ে লি। তারপর নৌকার কান্ডারি হলো বিশু। আর আমরা সবাই মুড়ি মাখিয়ে খেতে শুরু করলাম। মাঝি ভাই ও নিলু খেলো। ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম গ্রামে। মাঝি ভাইকে পারিশ্রমিক দিয়ে বিদায় জানালাম।

পরের দিন রবিবার। রঙিন সকাল। আকাশে মেঘের আনাগোনা। কাশের কারসাজি নদীর তীর জুড়ে। বন্যার জল নেমে গিয়েছে। পুজো পুজো ভাব। নিলু কাশফুলের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। কয়েকদিন হলো তাকে দেখা যাচ্ছে না।

আমি ঘুরতে ঘুরতে পুজো বাড়ির ঠাকুর দেখতে গেলাম। সেখানে দেখি নিলু হাতে কাদা মেখে শিল্পীকে সাহায্য করছে। তিন দিন ধরে এখানেই তার ডেরা। এখন তার মনে বাজছে ঢাকের ঢ্যামকুড়াকুড়। মন মন্দিরে তার দুর্গা গ্রামদেশ ছাড়িয়ে অভাবি বাতাসে বাতাসে। পুজো বাড়িতে আমাকে দেখেও কোনো কথা না বলে হাঁটতে হাঁটতে বাইরে চলে গেলো।
আমি জানি সে এখন চাল, ডাল নিয়ে সর্দার বুড়িকে রেঁধে খাওয়াবে। সে বলে, ওর যে কেউ নেই। ও খাবে কি?

১৩

আজ নিলুদা টরেন্টোয় অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত আছেন। তিনি গ্রামের বাড়িতে এসেছেন।কিছুটা সময় তাঁর সাথে কাটল গ্রামের স্কুলে। বড় ভালোবাসার ব্যক্তি এই মিলুদাকে সঙ্গে পেয়ে ভালো লাগল।মনে পড়ে গেল নিলুদার মোহমুক্তির কথা।
নিলুদার অবিবাহিত কাকা বড়বাজারের একটা মেসে ভাড়া থাকতেন।তিনি ছিলেন সরকারী কর্মচারী।তার বড়দার তিনছেলের মধ্যে তিনি নিলুদাকে বেছে নিয়েছিলেন ভবিষ্যত প্রজন্মের উন্নতির আশায়।
নিলুদার পড়াশোনার যাবতীয় দায়ীত্ব তিনি তুলে নেন নিজের কাঁধে।বর্ধমানে হোষ্টেলে থেকে নিলুদা উচ্চতর শিক্ষালাভ শুরু করেন।ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি থাকার ফলে প্রফেসরদের সুনজরে পরতে দেরী হয় নি।প্রফেসর সুবোধবাবু একদিন বললেন,ফিজিক্স সাবজেক্টে কোন অসুবিধা হলে আমার বাসায় এসো।তোমাকে বাসাটা চিনিয়ে দিই এস।নিলুদা বাসা দেখে বললেন,আমি রোজ আসব স্যার আপনার কাছে।
নিলুদা আড়চোখে দেখেছে স্যারের মেয়ে একই ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। বি এস সি সেকেন্ড ইয়ার আর মিলুদা এম এস সি ফার্স্ট ইয়ার।
তারপর নিলুদা প্রায় দুবছর স্যারের কাছে পড়লেন।আর তাঁর মেয়ের প্রেমের পড়লেন।শুরু হল আরও বৃহত্তর শিক্ষালাভের প্রস্তুতি। ইতিমধ্যে তিনবছর কেটে গেছে।সুবোধবাবু তাঁর মেয়ের এবং নিলুদার বিদেশে টাকার সমস্ত ব্যাবস্থা পাকা করে ফেললেন।এদিকে নিলুদার কাকা চিঠি লিখলেন নিলুদাকে,স্নেহের নিলু,তোমার পত্র পেলাম ও জানতে পারলাম তুমি বিদেশে পড়াশোনা করার জন্য যাবে।আমি এ বিষয়ে রাজী নই।জানি আজ তুমি বড় হয়েছ,তোমার সিদ্ধান্ত তুমি নিজেই নিতে পারবে তবে শিকড়াটা ছিঁড়ে ফেলো না।আর যদি তুমি এদেশে না থাকো তাহলে তোমার সঙ্গে আমার আর কোন সম্পর্ক থাকবে না।আমার মরামুখও তুমি তাহলে দেখবে না, এটা আমার আদেশ।ইতি – সেজকাকা।
নিলুদা পত্র পাঠ করে নীরব হয়ে রইলেন বারোঘন্টা।নির্জনে, একান্তে মোহমুক্তির বর চাইলেন নিজের কাছে।নিলুদা নিজের মনে বললেন,আমাকে এই মোহের আকর্ষণ ছিন্ন করে এগিয়ে যেতে হবে।আমি পারব, আমি পারব।জীবন্ত মুখ যদি দেখতে না পাই তবে মরামুখ দেখার মোহ আমি ছিন্ন করবই।আমি তোমার আদেশ মাথায় করে তুলে নিলাম সেজকাকা।

গ্রামের হাই স্কুল।ছেলেমেয়ে একসাথেই পড়াশোনা করে এই স্কুলে। ষষ্ঠ শ্রেণীর ফার্স্ট গার্ল জপমালা বেশ বুদ্ধিমতি।ছাত্রছাত্রীদের কাছে সে বেশ প্রিয়। সকলের উপকারে সে সবসময় এগিয়ে যায়।
এদিকে ক্লাস নাইনের কুশ, খুব চঞ্চল আর ডেঁপো প্রকৃতির। খেলা,গান,নাটক সবকিছু একসঙ্গে করতে গিয়ে কোনটাই ঠিকমত হয় না তার।পড়াশোনাতেও ভাল নয়।যত কুবুদ্ধির পোকাগুলো তার মাথায় নড়াচড়া করে।
কুশের বন্ধু ঝুলু,সৈকত,ধীরু,মনা,চনা,বুড়ো জলা ও আরও অনেকে।তারা বলে,কুশ, লেখাপড়াটা ভাল করে কর তা না হলে চাকরি পাবি না।কুশ বলত,আমি ব্যবসা করব।
ঝুলু বলল,সৈকত, আপনাকে খুব শ্রদ্ধা করে
স্যার বললেন,সেকথা আমিও জানি।
সৈকতের অন্য বন্ধুরা বলত পাগল স্যার। সৈকত বলত, এইরকম বিজ্ঞানপাগল স্যার হাজার হাজার প্রয়োজন আমাদের শিক্ষার জন্য।
ঝুলু বলল,মার্চ মাসে বিজ্ঞানী আইন স্টাইনের জন্ম। এই বিজ্ঞানীর জন্মদিনে খুব মজা করে আপনি বিজ্ঞান বোঝাতেন । আপনি বলতেন বিজ্ঞানী আইনস্টাইনও খুব রসিক মানুষ ছিলেন।
স্যার বললেন,হ্যাঁ ঠিক।একবার তাঁর জন্মদিনে, লাফিং গ্যাসের বোতলের ঢাকনা খুলে গিয়ে হাসাহাসির কান্ডটা মনে পড়ে তোর ।সকলে হাসছি আমরা। হেডস্যার রেগে ঘরে ঢুকেই হাসতে শুরু করলেন।লাফিং গ্যাস নাকে ঢুকলে হাসি পায় সকলের।

ঝু্লু বিজ্ঞানের স্যারকে বলল বলল,হ্যাঁ, মনে পড়ে আজও।আপনিও হাসছিলেন।
স্যার বললেন, আমি দেখলাম বোতলের মুখ খোলা। বোতলের গায়ে লেখা ছিল , নাইট্রাস অক্সাইড,মানে লাফিং গ্যাসের বোতল।আমি বন্ধ করলুম বোতলের ঢাকনা।

তারপর দশমিনিট পরে হেডস্যারকে বললাম, স্যার লাফিং গ্যাসের বোতল খুলে ফেলেছে কেউ। তার ফলে এই হাসি।

ঝুলু বলল,স্যার হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছে।

স্যার বললেন, কে যে বোতলটা খুলেছিলো তা আজ পর্যন্ত জানতে পারি নি.। ঝুলু তুই জানিস নাকি?

ঝুলু বললো, না স্যার, জানি না। তবে যেই খুলুক সে ভালো করেছিলো। তা না হলে এই সুন্দর স্মৃতি রোমন্থন করার সুযোগটা আর পেতাম না।

১৪

মাষ্টারমশাই দীনেশবাবু সাদাসিধা মনের মানুষ। একটা সাধারণ প্যান্ট জামা পরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ট্রেনে তার নিত্য যাওয়া আসা। ট্রেনে যাওয়ার সময় অনেক বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ হয়। তারা হাসি মস্করায় ব্যস্ত থাকে। দীনেশবাবু নিজে জানালার এক কোণে বই নিয়ে বসে পড়েন। তিনি নিজেও অনেক বই লিখেছেন। কলকাতার নামীদামী প্রকাশনা থেকে তাঁর লেখা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তাতে তার কোনো অহংকার নেই। ছাত্র ছাত্রীদের কি করে ভালভাবে প্রকৃত মানুষের মত মানুষ করা যায়, এই নিয়ে তাঁর চিন্তা। শিক্ষকতা শুধু পেশা নয় তার সঙ্গে মিশে থাকে বাড়তি দায়ীত্ববোধ। তিনি এইকথা ভাবেন মনে মনে। কি করে সর্বোত্তম সেবা প্রদান করা যায়, এই নিয়েই দিনরাত চিন্তাভাবনা করেন। স্কুলে পৌঁছান। ঘন্টা পড়ে প্রার্থনা সভার। জাতীয় সংগীত শেষ হওয়ার পরে শুরু হয় ক্লাস। ক্লাসে গিয়ে তিনি কোনোদিন চেয়ারে বসেন না। ছাত্রদের কাছে গিয়ে সমস্যার সমাধান করেন। পড়াশোনার কাজে সাহায্য করেন। স্টাফরুমে বসেন। তারপর কুশল বিনিময়ের পরে তিনি চলে যান ক্লাসে। কোন ক্লাস ফাঁকা আছে রুটিন দেখলেই জানতে পারেন। কোনো শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলেই তাঁর ক্লাসে চলে যান নিয়মিত। টিফিনে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সময় কাটান। সদাহাস্যময় দীনেশবাবু নিজের কাজে ব্যস্ত থাকেন সারাদিন। স্কুল থেকে ফেরার পরে নিজের লেখা নিয়ে বসেন। কোনোদিন ভাষাসদনে যান। সেখানে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটান। তারপর বাজার সেরে বাড়িতে ঢোকেন।আমার মা বলেন, ভাল লোকের কোন পারফিউম লাগে না। তাদের গা থেকে আপনা আপনি চন্দনের সুগন্ধ পাওয়া যায়। মা আরও বলেন, ভরা কলসি টগবগ করে না।জ্ঞানী লোক কথা কম বলেন। তাঁরা প্রচারবিমুখ হন। দীনেশবাবু এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কথা কম বলেন কিন্তু কর্মি লোক

লোকের ভাল ছাড়া মন্দ ভাবেন না কোনোদিন। তাঁর স্বভাব দেখলেই সকলের ভাল লেগে যায়। দীনুবাবুও এই ধরণের লোক। দীনেশবাবুকে মা আদর করে দীনুবাবু বলেন। তিনি সকালে নিমকাঠির দাঁতন ব্যবহার করেন। জনশ্রুতি আছে, বারোবছর নিমকাঠির ব্যবহারে মুখে চন্দনকাঠের সুবাস হয়। কথা বললেই নাকি চন্দনের সুবাস বেরোয়। শুনে অনেকে নিমকাঠির ব্যবহার করেন। কিন্তু মা বলতেন, শুধু নিমকাঠির ব্যবহার নয়, তার সঙ্গে মানুষকে ভালবাসতে হয়। কারও অমঙ্গল কামনা করতে নেই। মিথ্যা কথা বলতে নেই। তাহলেই মানুষের মুখে সুগন্ধ হয়। এমনকি দেহের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। মানুষ তো দেবতার আর এক রূপ। দীনেশবাবু ছুটির দিনগুলোতে ফুটপাতের অসহায় লোকগুলোর জন্য হোটেল থেক ভাত তরকারি কিনে, প্যাকেটে ভরে তাদের হাতে দেন। তাঁর ইচ্ছে আছে গরীব লোকগুলোকে প্রত্যেকদিন একমুঠো করে মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার।
তিনি সংসারী লোক। তাই এগোতে হবে ধীরে ধীরে।তিনি জানেন, এসব কাজে সবদিক চিন্তাভাবনা করে এগোতে হয়। তিনি ভাবেন, সামাজিক, আর্থিক, আইনগত সমস্ত দিক দেখে তবেই কাজে নামা প্রয়োজন।
আজ সকাল সকাল দীনেশবাবু ছেলেকে ডেকে তুললেন ঘুম থেকে। ছেলেকে বললেন, পড়তে বোসো বাবু। সকালে পড়া মুখস্থ হয় ভাল। ছেলে বলে, বাবা তোমার মুখ থেকে চন্দনের সুন্দর গন্ধ পাচ্ছি ।
দীনেশবাবু বলেন, ও তাই নাকি? তোমার মুখেও তে সুন্দর গন্ধ।রাস্তায়, স্কুলে যেখানেই দীনেশবাবু যাচ্ছেন সকলের মুখেই এক কথা,দীনুবাবু আর একটু কথা বলুন। আপনার মুখে চন্দনের সুবাস। বসুন বসুন। সকলের আদরে তিনি নিজেও যেন চন্দনের সুবাস অনুভব করছেন। আদরের আতিশয্যে তিনি খুশি।
আমি মাকে বললাম,দীনেশবাবুর মুখে চন্দনের গন্ধ, তিনি কথা বললেই টের পাওয়া যায়।
মা বললেন,মানুষের কত উপকার করেন উনি।পশুপাখি, জীবজন্তু সকলকে ভালোবাসেন। জীবকুলকে ভালোবাসলে চন্দনসুবাসে ভরে যায় হৃদয়।
কুশ স্কুলের পাকা চুলের মাষ্টারকে ভালোবেসে ফেলেছিলো!সাইকেল চালিয়ে কেতুগ্রাম থেকে মাষ্টারমশাই যখন আসতেন,মাঝ রাস্তা থেকে সাইকেলে চাপিয়ে রতনকে নিয়ে আসতেন স্কুলে! রতনকে না পেলে রাস্তায় কোনো ছাত্রকে দেখলেও তুলে নিতেন নিজের সাইকেলে! নিজের টিফিন থেকেও খাওয়াতেন ছাত্রদের.!পড়া সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন ! তিনি বলতেন,এই চল্লিশ বছরে বহু ছাত্রদের আমি পড়িয়েছি,তারা মানুষ হয়েছে! তোরাও মানুষ হ!

তারপর কুশ বড় হয়েচে!হেড মাষ্টারের পরেই সেকেণ্ড মাষ্টারের নাম!তাই পাঁচ গাঁয়ের লোকজন তাকে সেকেন মাষ্টার বলে!রিটায়ার হওয়ার পরেও সকলের ভালোবাসায় স্কুলে পড়াতে আসতেন!সব সময় তার হাসিমুখে কাজ মানুষের বিপদে আপদে কাজে দিত!পৃথিবীতে কিছু মানুষ মানুষের কাজ করতেই জন্মগ্রহণ করেন!তার ভালবাসার পরশ পাথরের ছোঁয়া পেয়ে মন্দ মনের মানুষও ভাল হয়ে যেত!

কুশ আর তার বন্ধু রতন দেখেছে বৃষ্টিতে ভিজে রোদে পুড়ে মানুষটা সকলের সেবার জন্যই জন্মগ্রহণ করেছেন!
একবার মাঝি পাড়ার দুখিকে সাপে কামড়েছিলো ,সেকেন মাষ্টার গিয়ে দেখেন,ওঝা এসেই ঝাড়ফুঁক শুরু করেছেন!ওঝাকে বললেন মাষ্টার,ওকে ছেড়ে দাও ,আমি হাসপাতালে নিয়ে যাব!সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে চলে গেলেন মহুকুমা হাসপাতালে !দুখি ফিরে এলে ওর বাবা, মা মাষ্টারকে প্রণাম করে দুটি কুমড়ো দিয়েছিলেন !তারা বললেন ,এটা আমাদের ভালবাসার উপহার !লিতেই হবে !তিনি নিয়ে পরে ডোম পাড়ার খেনি বুড়িকে দান করে দিলেন !
সুখ দুখে তাকে ছাড়া কারও চলত না! গাঁয়ের সেকেণ্ড মাষ্টার সকলের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন অজান্তে! একবার বন্যার সময় চার রাত স্কুলের ছাদে সকল দুর্গতদের সঙ্গে থেকে তাদের সাহায্য করেছিলেন! নিজের জীবন বিপন্ন করে মানুষের সেবা করাই ছিলো তার ধর্ম!

তিনি নামতা পড়াতেন,দুই একে দুই,বাড়ির পাশে ভুঁই !দুই দুকুনে চার,দেশ তোমার আমার,দুই তিনে ছয়,জাতি দাঙ্গা নয়!এই রকম বিভিন্ন রকমের শিক্ষামূলক ছড়া শূনিয়ে শিশুদের জীবনের ভিত শক্ত করে দিতেন!তাঁর প্রত্যেক কাজেই ছিলো জীবনের ছোঁয়া !

পর্ব- ১৫

সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পড়ে সাইকেল চালিয়ে তিনি স্কুলে আসতেন সাধকের মনে ! স্কুল ছিলো তার সাধনার স্থান !ছাত্র ছাত্রীরা ছিলো তার ভগবান,আল্লা বা যিশু !! তিনি যখন স্কুলে নিয়মিত শিক্ষক ছিলেন তখন সকল ছাত্রদের নিজের খরচায় টিফিন খাওয়াতৈন !সিদু কাকা বলতেন ,তখন তো আর মিড দে মিল ছিলো না !এই সেকেন মাষ্টার নিজের খরচে সকলকে খাওয়াতেন ,বুঝলে বাবাসকল !তারপর তার স্ত্রী গত হলেন ! তবুও স্কুল নিয়মিত আসতেন তিনি !আমাদের অনুরোধে রিটায়ার হওয়ার পরেও তিনি স্কুলে আসেন ! ইনি হচ্ছেন আদর্শ শিক্ষক গো !আর কোথাও এমনটি দেখলুম না !গ্রামের ছেলেমেয়েরা অবাক হয়ে শোনে সিদু কাকার কথা !

প্রসন্ন মনে তাদের সেবা করতেন অবিরাম!গ্রামের মানুষজন তাকে মান্য করতেন গুরুদেবের মত!

কুকুর,বিড়াল,ছাগল কোনো প্রাণী তার করুণা থেকে বঞ্চিত হত না! এক ভালোবাসার মন্ত্রে সকলকে গেঁথে দিত তার হৃদয়!

সিদু কাকা একদিন বললেন,আমার একটা আশ্রম আছে!সেখানে অনেক অনাথ শিশু থাকে !মাষ্টার তুমি কিছু টাকা চাঁদা তুলে দিও !
সেকেন মাষ্টারের কথা কেউ ফেলতে পারে না !তার কথায় অনেক চাঁদা উঠলো আর নিজেও রিটায়ার্ডের টাকা থেকে এক লক্ষ টাকা দান করলেন !

আশ্রমের শিশুরা এখন ভালভাবে খায় ,পড়ে!
সেকেন মাষ্টারের ছেলেপিলে নেই !নিঃসন্তান!

তিনি বলেন,ছাত্র ছাত্রীরাই আমার সন্তান !এইভাবেই হেসে খেলে জীবন কেটে গেলেই হলো !

একদিন সেকেন মাষ্টার স্কুলে এলেন !শুনলেন রাষ্ট্রপতি আসবেন নিজের গ্রামে! কেতুগ্রামের পাশেই বাড়ি।

নিলুদার মনে পড়ে, গণিতের শিক্ষকমশাই বলতেন, যোগ,বিয়োগ,গুণ,ভাগ জীবনের ক্ষেত্রেও মেনে চলবি। যত দুঃখ,ব্যথা বিয়োগ করবি। আনন্দ যোগ করে খুশি গুণ করবি। আর খাবার ভাগ করে খাবি। একা খেলে,বেশি খেলে রোগ বেড়ে যাবে। মজার মধ্যেও কতবড় শিক্ষা তিনি আমাদের দিয়েছিলেন আজ বুঝতে পারি। আদর্শ শিক্ষক বোধহয় এই রকম হন। ফোচন বললো।ফোচনের বোন ফোড়োনকে মাস্টারমশাই মশলা বলে ডাকতেন। ফোড়োন খুব রেগে যেতো। কারণ বন্ধুরাও তাকে মশলা বলেই ডাকতো। একদিন স্যারের কাছে ফোড়ন বললো,আপনি মশলা নামে ডাকেন বলে সবাই ডাকে। মাস্টারমশাই বলেছিলেন,আদর করে দেওয়া নাম কোনোদিন ফেলবি না। রাগ করবি না। দেখবি একদিন যখন তোর বন্ধু, বান্ধবীরা দূরে চলে যাবে তখন এই নাম তোর মুখে হাসি ফোটাবে। সংসারের সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দেবে আদরের পরশে। ফোড়োনের জীবনে সত্য হয়েছিলো এই কথা। একদিন বিয়ের পরে রমেশের সঙ্গে দেখা হলো তার। রমেশ বললো,কেমন আছিস ফোড়োন। ফোড়োন বললো,একবার মশলা বলে ডাক। তা না হলে আমি তোর প্রশ্নের উত্তর দেবো না। রমেশ তারপর ওকে মশলা বলে ডেকেছিলো। মশলা সেবার খুশি হয়ে রমেশকে ফুচকা খাইয়েছিলো। গ্রামে থাকতেই প্রাইমারী স্কুলে যেতাম।

মাষ্টারমশাই আমাদের পড়াতেন। পরের দিন আমরা দুই ভাই স্কুলে ভরতি হতে গেলাম। বড়দা গ্রামে কাকার কাছে আর ছোটো ভাই বাবু একদম ছোটো। স্কুলে মীরা দিদিমণি সহজ পাঠের প্রথম পাতা খুলে বললেন,এটা কি? আমি বললাম অ য়ে, অজগর আসছে ধেয়ে।
আবার বই বন্ধ করলেন। তারপর আবার ওই পাতাটা খুলে বললেন,এটা কি?
আমি ভাবলাম,আমি তো বললাম এখনি। চুপ করে আছি। ঘাবড়ে গেছি। দিদি বাবাকে বললেন,এবছর ওকে ভরতি করা যাবে না।
ছোড়দা ভরতি হয়ে গেলো। তারপর বাসা বাড়িতে জীবন যাপন। সুবিধা অসুবিধার মাঝে বড়ো হতে লাগলাম। আমাদের খেলার সঙ্গি ছিলো অনেক। ধীরে ধীরে আমরা বড়ো হয়ে টি,আর,জি,আর,খেমকা হাই স্কুলে ভরতি হলাম। তখন লাইনের পাশ দিয়ে যাওয়া আসা করার রাস্তা ছিলো না। লাইনের কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে হেঁটে যেতাম। কতজন ট্রেনে কাটা পরে যেতো তার হিসাব নেই। তারপর ওয়াগন ব্রেকাররা মালগাড়ি এলেই চুরি করতো রেলের সম্পত্তি। কঠিন পরিস্থিতি সামলে চলতো আমাদের লেখাপড়া।এখন পরিস্থিতি অনেক ভালো। পাশে রাস্তা আছে। ওয়াগান ব্রেকারদের অত্যাচার নেই।মনে আছে ক্লাস সেভেন অবধি লিলুয়ায় পড়েছি। তারপর গ্রামে কাকাবাবু মরে গেলেন অল্প বয়সে। বাবা অবসর নিলেন চাকরী থেকে। বড়দা ও ছোড়দা রয়ে গেলো লিলুয়ায়। বাবা, মা ও আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে এলেন বড় পুরুলিয়া গ্রামে।গ্রামে কাকীমা ও দুই বোন। রত্না ও স্বপ্না। আমরা চারজন। মোট সাতজন সদস্য। শুরু হলো গ্রামের জীবন।আবার বিল্বেশ্বর হাই স্কুলে ভরতি হতে গেলাম বাবার সঙ্গে। ভরতি র পরীক্ষা হলো। হেড মাষ্টারমশাই বললেন,বাঃ, ভালো পত্রলিখন করেছে। বিজয়া প্রণামের আগে চন্দ্রবিন্দু দিয়েছে। কজনে জানে।আমি প্রণাম করলাম স্যারকে। ভরতি হয়ে গেলাম।
স্কুলে আজ বাংলার স্যার দুটো ক্লাস একসঙ্গে নিলেন। কবি বিহারীলাল ও অক্ষয়কুমার বড়াল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলেন।স্যার সুদীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন তিনি বললেন,কবি বিহারীলাল বাংলা ভাষার কবি। বাংলা সাহিত্যের প্রথম গীতি-কবি হিসেবে তিনি সুপরিচিত। কবিগুরু তাকে বাঙলা গীতি কাব্য-ধারার ‘ভোরের পাখি’ বলে আখ্যায়িত করেন। তার সব কাব্যই বিশুদ্ধ গীতিকাব্য। মনোবীণার নিভৃত ঝংকারে তার কাব্যের সৃষ্টি। বাঙালি কবি মানসের বহির্মুখী দৃষ্টিকে অন্তর্মুখী করার ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য।

পর্ব-১৬

নিলুদার মনে পড়ে,মাষ্টারমশাই আমাদের পড়াতেন। পরের দিন আমরা দুই ভাই স্কুলে ভরতি হতে গেলাম। বড়দা গ্রামে কাকার কাছে আর ছোটো ভাই বাবু একদম ছোটো। স্কুলে মীরা দিদিমণি সহজ পাঠের প্রথম পাতা খুলে বললেন,এটা কি? আমি বললাম অ য়ে, অজগর আসছে ধেয়ে।
আবার বই বন্ধ করলেন। তারপর আবার ওই পাতাটা খুলে বললেন,এটা কি?
আমি ভাবলাম,আমি তো বললাম এখনি। চুপ করে আছি। ঘাবড়ে গেছি। দিদি বাবাকে বললেন,এবছর ওকে ভরতি করা যাবে না।
ছোড়দা ভরতি হয়ে গেলো। তারপর বাসা বাড়িতে জীবন যাপন। সুবিধা অসুবিধার মাঝে বড়ো হতে লাগলাম। আমাদের খেলার সঙ্গি ছিলো অনেক। ধীরে ধীরে আমরা বড়ো হয়ে টি,আর,জি,আর,খেমকা হাই স্কুলে ভরতি হলাম। তখন লাইনের পাশ দিয়ে যাওয়া আসা করার রাস্তা ছিলো না। লাইনের কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে হেঁটে যেতাম। কতজন ট্রেনে কাটা পরে যেতো তার হিসাব নেই। তারপর ওয়াগন ব্রেকাররা মালগাড়ি এলেই চুরি করতো রেলের সম্পত্তি। কঠিন পরিস্থিতি সামলে চলতো আমাদের লেখাপড়া।এখন পরিস্থিতি অনেক ভালো। পাশে রাস্তা আছে। ওয়াগান ব্রেকারদের অত্যাচার নেই।মনে আছে ক্লাস সেভেন অবধি লিলুয়ায় পড়েছি। তারপর গ্রামে কাকাবাবু মরে গেলেন অল্প বয়সে। বাবা অবসর নিলেন চাকরী থেকে। বড়দা ও ছোড়দা রয়ে গেলো লিলুয়ায়। বাবা, মা ও আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে এলেন বড় পুরুলিয়া গ্রামে।গ্রামে কাকীমা ও দুই বোন। রত্না ও স্বপ্না। আমরা চারজন। মোট সাতজন সদস্য। শুরু হলো গ্রামের জীবন।আবার বিল্বেশ্বর হাই স্কুলে ভরতি হতে গেলাম বাবার সঙ্গে। ভরতি র পরীক্ষা হলো। হেড মাষ্টারমশাই বললেন,বাঃ, ভালো পত্রলিখন করেছে। বিজয়া প্রণামের আগে চন্দ্রবিন্দু দিয়েছে। কজনে জানে।আমি প্রণাম করলাম স্যারকে। ভরতি হয়ে গেলাম।
স্কুলে আজ বাংলার স্যার দুটো ক্লাস একসঙ্গে নিলেন। কবি বিহারীলাল ও অক্ষয়কুমার বড়াল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলেন।স্যার সুদীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন তিনি বললেন,কবি বিহারীলাল বাংলা ভাষার কবি। বাংলা সাহিত্যের প্রথম গীতি-কবি হিসেবে তিনি সুপরিচিত। কবিগুরু তাকে বাঙলা গীতি কাব্য-ধারার ‘ভোরের পাখি’ বলে আখ্যায়িত করেন। তার সব কাব্যই বিশুদ্ধ গীতিকাব্য। মনোবীণার নিভৃত ঝংকারে তার কাব্যের সৃষ্টি। বাঙালি কবি মানসের বহির্মুখী দৃষ্টিকে অন্তর্মুখী করার ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য।

অতি অল্পকালের ভিতরে তিনি বাংলা কবিতার প্রচলিত ধারার পরিবর্তন ঘটিয়ে নিবিড় অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে গীতিকবিতার ধারা চালু করেন। এ বিষয়ে তিনি সংস্কৃত ও ইংরেজি সাহিত্যের মাধ্যমে গভীরভাবে প্রভাবিত হন। বিহারীলাল তার কবিতায় ভাবের আধিক্যকে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রকৃতি ও প্রেম, সংগীতের উপস্থিতি, সহজ-সরল ভাষা বিহারীলালের কবিতাকে দিয়েছে আলাদাধারার বৈশিষ্ট্য।বিহারীলাল চক্রবর্তী ২১ মে, ১৮৩৫ তারিখে কলকাতার নিমতলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম দীননাথ চক্রবর্তী। মাত্র চার বছর বয়সে মাতা মারা যান।বিহারীলাল চক্রবর্তী শৈশবে নিজ গৃহে সংস্কৃত ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি কলকাতার সংস্কৃত কলেজে তিন বছর অধ্যয়ন করেন।বিহারীলাল চক্রবর্তী উনিশ বছর বয়সে অভয়া দেবীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। অল্পকাল পরে অভয়া দেবী মারা গেলে কাদম্বরী দেবীকে বিবাহ করেন।তার রচনাবলীর মধ্যে স্বপ্নদর্শন, সঙ্গীত শতক (১৮৬২), বঙ্গসুন্দরী (১৮৭০), নিসর্গসন্দর্শন (১৮৭০), বন্ধুবিয়োগ (১৮৭০), প্রেম প্রবাহিনী (১৮৭০), সারদামঙ্গল (১৮৭৯), মায়াদেবী, ধুমকেতু, দেবরাণী, বাউলবিংশতি, সাধের আসন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। পূর্ণিমা, সাহিত্য সংক্রান্তি, অবোধবন্ধু ইত্যাদি তার সম্পাদিত পত্রিকা। সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও তিনি যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন।সারদামঙ্গল কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর শ্রেষ্ঠ কাব্য। আখ্যানকাব্য হলেও এর আখ্যানবস্তু সামান্যই। মূলত গীতিকবিতাধর্মী কাব্য এটি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কাব্য সম্পর্কে লিখেছেন, “সূর্যাস্ত কালের সুবর্ণমণ্ডিত মেঘমালার মত সারদামঙ্গলের সোনার শ্লোকগুলি বিবিধরূপের আভাস দেয়। কিন্তু কোন রূপকে স্থায়ীভাবে ধারণ করিয়া রাখে না। অথচ সুদূর সৌন্দর্য স্বর্গ হইতে একটি অপূর্ণ পূরবী রাগিণী প্রবাহিত হইয়া অন্তরাত্মাকে ব্যাকুল করিয়া তুলিতে থাকে।”[৫] সমালোচক শিশিরকুমার দাশের মতে, “মহাকাব্যের পরাক্রমধারার পাশে সারদামঙ্গল গীতিকাব্যের আবির্ভাব এবং শেষপর্যন্ত গীতিকাব্যের কাছে মহাকাব্যের পরাজয়ের ইতিহাসে সারদামঙ্গল ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ কাব্য। বিহারীলালের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি নয়, কিন্তু নিজ উদ্যোগে তিনি সংস্কৃত, ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্য অধ্যয়ন করেন এবং অল্প বয়সেই কবিতা লেখা শুরু করেন। তাঁর পূর্বে বাংলা গীতিকবিতার ধারা প্রচলিত থাকলেও এর যথার্থ রূপায়ণ ঘটে তাঁর হাতেই। তিনি বাংলা কাব্যের প্রচলিত ধারার রদবদল ঘটিয়ে নিবিড় অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে গীতিকবিতার প্রবর্তন করেন। এ বিষয়ে তিনি সংস্কৃত ও ইংরেজি সাহিত্য দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। তাঁর রচনায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য কবিদের প্রভাব থাকলেও নিজস্ব রীতিই ফুটে উঠেছে। বিহারীলাল বস্ত্ততন্ময়তার পরিবর্তে বাংলা কাব্যে আত্মতন্ময়তা প্রবর্তন করেন। বাংলা কবিতায় তিনিই প্রথম কবির অন্তর্জগতের সুর ধ্বনিত করে তোলেন। তাঁর কবিতায় রূপ অপেক্ষা ভাবের প্রাধান্য বেশি। প্রকৃতি ও রোম্যান্টিকতা, সঙ্গীতের উপস্থিতি, সহজ-সরল ভাষা এবং তৎসম ও তদ্ভব শব্দের যুগপৎ ব্যবহার বিহারীলালের কাব্যকে করেছে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। তাঁর কবিতার বিষয়-ভাবনা, প্রকাশভঙ্গির অভিনবত্ব, অনুভূতির সূক্ষ্মতা, সৌন্দর্য প্রকাশের চমৎকারিত্ব, ছন্দ-অলঙ্কারের অভূতপূর্ব ব্যবহার অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পঁয়ত্রিশ বছরের কবিজীবনে বিহারীলাল অনেক গীতিকাব্য ও রূপককাব্য রচনা করেছেন।বিহারীলালের রচনাবলির মধ্যে স্বপ্নদর্শন (১৮৫৮), সঙ্গীতশতক (১৮৬২) বন্ধুবিয়োগ (১৮৭০), প্রেমপ্রবাহিণী (১৮৭০), নিসর্গসন্দর্শন (১৮৭০), বঙ্গসুন্দরী (১৮৭০), সারদামঙ্গল (১৮৭৯), নিসর্গসঙ্গীত (১৮৮১), মায়াদেবী (১৮৮২), দেবরাণী (১৮৮২), বাউলবিংশতি (১৮৮৭), সাধের আসন (১৮৮৮-৮৯) এবং ধূমকেতু (১৮৯৯) উল্লেখযোগ্য। নিসর্গসন্দর্শন কাব্যে বিহারীলাল বঙ্গপ্রকৃতির শোভা অপূর্ব ভাব-ভাষা ও ছন্দ-অলঙ্কার প্রয়োগের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। বঙ্গসুন্দরী কাব্যে কয়েকটি নারী চরিত্রের মাধ্যমে তিনি গৃহচারিণী বঙ্গনারীকে সুন্দরের প্রতীকরূপে বর্ণনা করেছেন। সারদামঙ্গল কাব্য বিহারীলালের শ্রেষ্ঠ রচনা। এটি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একটি স্তম্ভস্বরূপ। এর মাধ্যমেই তিনি উনিশ শতকের গীতিকবিদের গুরুস্থানীয় হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ এ কাব্যটি পড়ে নানাভাবে প্রভাবিত হয়েছেন এবং বিহারীলালকে আখ্যায়িত করেছেন ‘ভোরের পাখি’ বলে।বিহারীলাল কাব্যচর্চার পাশাপাশি পত্রিকা সম্পাদনার কাজও করেছেন। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা: পূর্ণিমা, সাহিত্য-সংক্রান্তি, অবোধবন্ধু প্রভৃতি। এসব পত্রিকায় অন্যদের রচনার পাশাপাশি তাঁর নিজের রচনাও প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ভারতী, সোমপ্রকাশ, কল্পনা প্রভৃতি পত্রিকায়ও তাঁর রচনা প্রকাশিত হয়েছে। বিহারীলাল ১৮৯৪ সালের ২৪ মে মৃত্যুবরণ করেন।

পর্ব-১৭

সংসারে সং সেজে দিবারাতি নিজেকে ঠকিয়ে কোন ঠিকানায় ঠাঁই হবে আমার ।নিজেকে নিজের প্রশ্ন কুরে কুরে কবর দেয় আমার অন্তরের গোপন স্বপ্ন । জানি রাত শেষ হলেই ভোরের পাখিদের আনাগোনা আরম্ভ হয় খোলা আকাশে । আমার টোনা মাসিকে টোন কেটে অনেকে অভিশাপ দিতো । আমি দেখেছি ধৈর্য্য কাকে বলে । আজ কালের কাঠগোড়ায় তিনি রাজলক্ষ্মী প্রমাণিত হয়েছেন । কালের বিচারক কোনোদিন ঘুষ খান না । তাই তাঁর বিচারের আশায় দিন গোনে শিশুর শব, সব অবিচার ,অনাচার কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেবে আগামী পৃথিবীর ভাবি শিশু প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি। অপেক্ষায় প্রহর গোনে নিজের অন্তরের প্রদীপ শিখা জ্বালিয়ে । সাবধান খুনীর দল ,একবার হলেও অন্তত নিজের সন্তানের জন্য শান্ত পৃথিবী রেখে যা । ঋতু পরিবর্তন কিন্তু তোর হত্যালীলায় বন্ধ হবে না নির্বোধ ।শান্ত হোক হত্যার শাণিত তরবারি ।নেমে আসুক শান্তির অবিরল ধারা। রক্ত রঙের রাত শেষে আলো রঙের নতুন পৃথিবী আগামী অঙ্কুরের অপেক্ষায়। শিউলি শরতের ঘ্রাণে শিহরিত শরীর। শিউলি নামের শিউলি কুড়োনো মেয়েটি আমার শৈশব ফিরিয়ে দেয়।মনে পড়ে পিসির বাড়ির শিউলি গাছটার তলায় অপেক্ষা করতো ঝরা ফুলের দল।

শিউলি শরতের ঘ্রাণে শিহরিত শরীর। শিউলি নামের শিউলি কুড়োনো মেয়েটি আমার শৈশব ফিরিয়ে দেয়।মনে পড়ে পিসির বাড়ির শিউলি গাছটার তলায় অপেক্ষা করতো ঝরা ফুলের দল। সে জানত ফুল ঝরে গেলেও
তার কদর হয় ভাবি প্রজন্মের হাতে । সে আমাদের ফুল জীবনের পাঠ শেখায়। মানুষও একদিন ফুলের মত ঝরে যায়। । শুধু সুন্দর হৃদয় ফুলের কদর হয়। বিদেশে ষাট বছরেও মানুষ স্বপ্ন দেখে। নিজেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরখ করার সুযোগ মেলে। কিন্তু আমাদের কয়েকজন বন্ধু লোক ব্যাঙ্গের সুরে বলে, বুড়ো ঢ্যামনার ভিমরতি হয়েচে। সখ দেখো এখনও রঙীন জামা পড়ে। ব্যায়াম করে। মেয়েদের সঙ্গে কতা বলে।একটু হাসি ঠাট্টা করলে বলবে, মিনসে, ঘাটের মরা এখনও দুধ তোলা রোগ গেলো না।সব স্বপ্ন দেখা বন্ধ রেখে বুড়ো সেজে থাকলেই সম্মান পাওয়া যায় বেশি। নিজের মনে গুমরেওঠে যত স্মৃতি। শেয়ার করার কেউ নেই। তারপর মরে যাওয়ার পড়ে অন্তিম কাজ, নির্লজ্জ ভুরিভোজ। তবু সব কিছুর মাঝেই ঋতুজুড়ে আনন্দের পসরা সাজাতে ভোলে না প্রকৃতি। সংসারের মাঝেও সাধু লোকের অভাব নেই। তারা মানুষকে ভালোবাসেন বলেই জগৎ সুন্দর আকাশ মোহময়ী, বলেন আমার মা। সব কিছুর মাঝেও সকলের আনন্দে সকলের মন মেতে ওঠে। সকলকে নিয়ে একসাথে জীবন কাটানোর মহান আদর্শে আমার দেশই আদর্শ।
সত্য শিব সুন্দরের আলো আমার দেশ থেকেই সমগ্র পৃথিবীকে আলোকিত করুক। আমার দুই বোন। তিন ভাইঝি। বোনেদের নাম রত্না স্বপ্না। রত্না হলো কন্যারত্ন। সব অভাব অভিযোগ তার কাছে এসে থমকে পড়ে অনায়াসে। আর অপরের উপকার করতে স্বপ্নার তুলনা মেলা ভার। ভাইঝিরা তানুশ্রী, দেবশ্রী,জয়শ্রী। এরা বড়দার মেয়ে আর মেজদার মেয়ে পৃথা,ছেলে ইন্দ্র। এরা সকলেই আমার খুব প্রিয়। বাবুর মেয়ে তিন্নি আমার ছেলে সৈকত। রূপসী বাংলার রূপে ছুটে যাই। কিন্তু আমার চেনা পৃথিবীর সবটা হয়ে যায়
অচেনা বলয়,মাকড়সার জালের মতো জটিল । সবাই এত অচেনা অজানা রহস্য ময় ।বুকটা ধকধক করছে,হয়তো মরে যাবো, যাবো সুন্দরের কাছে,চিন্তার সুতো ছিঁড়ে কবির ফোন এলো । এক আকাশ স্বপ্ন নিয়ে, অভয়বাণী মিলেমিশে সৃষ্টি করলো আশা ।আর আমি একা নই,কবির ছায়া তাঁর মায়া আমাকে পথ দেখায়…আমার মায়ের বাবার নাম ছিলো মন্মথ রায়। মনমতো পছন্দের দাদু আমাদের খুব প্রিয় ছিলেন। যখন মামার বাড়ি যেতাম মায়ের সঙ্গে তখন দাদু আমাদের দেখেই মামিমাকে মাছ,ডিম,মাংস রান্না করতে বলতেন। কখনও সখনও দেখেছি মামিমা নিজে ডেঙা পাড়া,সাঁওতাল পাড়া থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে নিয়ে আসতেন। তখন এখনকার মতো ব্রয়লার মুরগি ছিলো না। দেশি মুরগির বদলে চাল,ডাল,মুড়ি নিয়ে যেতো মুরগির মালিক। নগদ টাকর টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল,ডাল,গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন মামিমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে দাদু নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা,মৃগেল। তারপর বিরাট গোয়ালে কুড়িটি গাইগরু। গল্প মনে হচ্ছে। মোটেও না। এখনও আমার সঙ্গে গেলে প্রমাণ হিসাবে পুকুর,গোয়াল সব দেখাতে পারি। আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রাম। লাল মাটি। উঁচু উঁচু ঢিবি। আমি পূর্ব বর্ধমানের ছেলে। সমতলের বাসিন্দা। আর বীরভূমে লাল উঁচু নিচু ঢিবি দেখে ভালো লাগতো।আমাদের মাটি লাল নয়। কি বৈচিত্র্য। ভূগোল জানতাম না। জানতাম শুধু মামার বাড়ি। মজার সারি। দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিসটার্ব হতো।একদিন ভয় দেখানোর জন্যে বাড়ির মুনিষকে মজার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ছেলেধরার গুজব উঠেছিলো। আমরা দুপুরে খেলছি। দাদু বার বার বারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,আজ কিন্তু ছেলেধরা আসতে পারে। আমি খুব ভিতু ছিলাম। আমার মামার ছেলে বাঁটুলদা,হোবলো,ক্যাবলা,লেবু। সবাইকে বললাম। তখন বারো থেকে পনেরো বছরের পালোয়ান আমরা। সকলের ভয় হলো। দাদু কোনোদিন মিথ্যা বলেন না। কথার মধ্যে কনফিডেন্স না থাকলে তিনি রাগ করতেন। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,এই অঙ্কটা পারবি। পড়ে দেখ। আমি বললাম,বোধহয় পারবো। তিনি রেগে বললেন, বোধহয় কি? হয় বল না, কিংবা হ্যাঁ। নো অর ইয়েস। ধমকে

পিরীতি কাঁঠালের আঠা উপন্যাস- সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!