কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » প্রেমের গল্প » রৌদ্র ছায়া

রৌদ্র ছায়া

রৌদ্র ছায়া প্রেমের গল্প – মধুরিমা ব্যানার্জ্জী

সামন্তক একটা ফাঁকা ট্রেনে চেপে বসেছিল। হাওয়াটা ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিল বুক থেকে ভারী পাথরএকটা নেমে গেছে। নাকি আরও বোঝা চেপে বসছে? সে যা হোক, বহুদিন পর ট্রেনে চেপে বেশ ভালো লাগছিল। বীথির সাথে চিরকালের মতন সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে সে। হ্যাঁ, বীথি বেরিয়ে যাচ্ছিল, সে বাধা দেয়নি। তবুও বীথির চলে যাওয়ার সময় কান্নাধরা গলার কথাগুলো খুব মনে পড়ছিল সামন্তকের। বলছিল, সামন আমি চলে যাচ্ছি, তুই ভালো থাক। নিজের জীবনে এতটা ভালো ছিলিস, খুশি ছিলিস, আমাকে জোর করে কাছে ডেকেছিলিস কেন? যে বাবা ও মা বিয়ের আগে থেকে তোর এত আপন ছিলনা, সেই মা ও বাবা বিয়ের পর তোর সব জগতটা একটু একটু করে জুড়ে নিল। তুই তোর নিজের জগতটা একটু দেরি করে হলেও আমার চোখের সামনে ধরিয়ে দিলি। আজ আমি আর পারলাম না। সত্যিই সামন্তকও হাঁপিয়ে উঠেছিল। এই ৮ বছরে কম তো সহ্য করেনি সে? সেই দেবতনু দিয়ে শুরু। দেবতনু ছিল বয়ঃসন্ধিক্ষণে বীথির প্রথম প্রেম। তখন কত ঝামেলা পোয়াতে হয়েছে সামন্তককে। সামন্তক বুঝত দেবতনু কখনই বীথির জন্য ঠিক না, শুধু সময় কাটাচ্ছে। আর বীথিও ভুলেছে ওর মিষ্টি কথায়। তারপর তাদের প্রেম হল। বীথির বাড়ি বরাবর নাকউঁচু। সামন্তকের ও বাড়িতে ঢোকা অত সহজ ছিলনা। হিমালয়ের গায়ে যেমন পুরু বরফ থাকে, তেমন গুরুগম্ভীর শ্বশুরমশাই আর মুড স্যুইং এর ডালি শাশুড়িকেও মেনে নিয়েছিল সামন্তক। বদলে বীথি কিছুই দেয়নি তাকে। অবশ্য সামন্তক ভাবতে থাকে, রাগের বশে সে একটু বাড়াবাড়ি ভাবছে। বীথির মা যে যত্ন করে ওকে খাওয়াতেন, ভালবাসতেন, তাহ কখনো নিজের মায়ের কাছেও পায়নি সে। আবার শ্বশুরমশাই পড়ে এতোটাই কইয়ে-বলিয়ে হয়ে গেছিলেন যা সামন্তকের ভাবনার অতীত। তবে ইদানীং ওর মাথা গরমটাও বাড়ছিল, সেটা সে নিজেও বুঝত। বীথি কি আরও একটু মানিয়ে নিতে পারত না? সামন্তকের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় একটা মানিপার্স ছাড়া কিছুই সঙ্গে নেয়নি সে। সামন্তক একবারও তাকে থেকে যেতে বলল না। বীথির বাবা মায়ের কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিলনা। নিজে পছন্দ করে বিয়ে করলে মেয়েদের অনেক সমস্যা। সেই প্রথম দিন থেকেই শ্বশুর বা শাশুড়ির ভালোবাসা পায়নি বীথি। তাদের নিজেদের বাসা আলাদাও ছিল। কিন্তু ও বাড়িতে গেলে সামন্তকের আদর আহ্লাদ যতটা, তার ততটা ছিলনা। বুঝত সে যেন কেমন পরগাছা হয়ে আছে। সামন্তক বলত এটা বীথির অ্যাটিটিউড প্রবলেম। হ্যাঁ, বীথি মানে সে মনে মনে একটু অহংকারী। কিন্তু তাতে কি?

আজকাল সব শাশুড়ি মায়েরা তার বউমাকে মানিয়ে নেন। সেখানে বীথির শাশুড়ি কখনো চেষ্টাই করেননি শুধু তার জন্য কিছু করে দেওয়ার। সামন্তকের থেকে তাদের চাহিদা বা পাওনার শেষ না থাকলেও, সামন্তকের জন্য তাদের কিছুই ছিলনা। সামন্তক এই বিষয়টা বুঝেও চোখে যেন রঙিন চশমা পড়তে চাইতো। ঠিক যেন কাঁচের ঘরে বসবাস। এক মুখেই সামন্তক বলত বীথি ছাড়া তার জগত অন্ধকার। কিন্তু পরমুহূর্তেই বীথির মন ভাঙত, যখন সে দেখত তার মা বাবার চাহিদা মতই সে শুধু ছুটছে। যদি প্রথম থেকেই সামন্তক এটা শুরু করে দিত, তাহলে পরিস্থিতি এত গম্ভীর হত না। আজ সামন্তককে দেখে তার মনে হচ্ছিল কখনই সে সামন্তকের জন্য কিছুই করেনি। তার সমস্ত কালো দোষ ইদানীং সামন্তকের চোখে লাগত। বিথীকে সামন্তকের খিটখিটে ব্যাবহার ও বদমেজাজ ভীষণ একঘেয়ে করে তুলেছিল। একসময় বীথি অত মন দিয়ে চাকরির চেষ্টা না করে হেলায় কিছু সুযোগ হারিয়েছিল। তখন সামন্তক তার পাশে থেকে তাকে লড়াইয়ের সাহস যুগিয়েছিল। আর সেই সামন্তক ৮ বছরে এতোটাই পরিবর্তনশীল মানসিকতার হল যে কাল বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে বলেই ফেলল, বাপের টাকায় ফুর্তি কর, নিজের মুরোদ বলতে কিছুতো নেই। মাথাটা কেমন ঘুরছিল বীথির। এই চড়া রোদে স্টেশনে অনেকক্ষণ বসে আছে, কোথায় যাবে বুঝতেও পারছেনা, হঠাৎ ভীষণ অসহায় লাগছে।

            একবার মনে হয় বাড়ি ফিরে গেলেই বড় ভালো হত। সত্যি কোথায় যাবে সে? মানিব্যাগে তেমন পয়সাও নেই। দুটো কার্ড আছে, একটা বাবার, একটা সামন্তকের। দুটোর কোনটাই ব্যাবহারের ইচ্ছে নেই তার। সত্যিই একটা সময় মেয়েরা বড়ই খাদের কিনারে এসে দাঁড়ায়। তাদের নিজেদের বলতে কি কিছুই নেই? বড় কঠিন প্রশ্ন। আসলে কারোরই নিজের বলতে কিছু নেই। কেউ সঙ্গে কিছু নিয়ে আসেনি, যাবেও না। তাও এই দ্বন্দ্ব। সামন্তক থাকলে অবশ্য বলত, এসব ফিলোসফিকাল কথাবার্তা বলে আঁতলামো করিসনা। সত্যি ৮ বছর আগের সামন্তককে সে কিছুতেই মেলাতে পারেনি। এতটা আবেগশূন্য সে কখনই ছিলনা। বীথির সব কথাই তার ভালোলাগত, বীথির ঘোরার জায়গা, সঙ্গ। সবটাই কেমন একঘেয়ে হয়ে গেল। আসলে দুটো মানুষ একসাথে থাকলে বোধহয় এটাই হয়। কিন্তু বাবা মা এত বছর একসাথে থাকলেও তাদের সম্পর্কে এতটা তিক্ততা দেখেনি বীথি। সামন্তকের মা বাবাকেও এখন আর দোষ দেয়না বীথি। সামন্তক কখনো চেষ্টাই করেনি যাতে তার বাবা ও মা বীথিকে সঠিক সম্মান দেয়, যত্ন করে। সামন্তক মনে করত সে নিজে বীথি আকাশের চাঁদ চাইলেও যখন এনে দেয়, তখন এত ভাবনার, এত হিসেব নিকেশের কি দরকার? কিন্তু বীথির সত্ত্বাটা আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছিল সামন্তকের কাছ থেকে। হ্যাঁ, বলতে দ্বিধা নেই, প্রয়োজনের বাইরে পরিশ্রম করে সামন্তক বীথির সব চাহিদা পূরণ করেছে। আস্তে আস্তে সেই সামন্তক সময়ের নৌকায় বসে হারিয়ে গেছে। হয়ত বীথির চাহিদা পূর্ণতে বীথির অধিকারবোধ সামন্তকের উপর বোঝা হয়ে বসেছিল। নয়ত সামন্তক নিজের অস্তিত্ব বা অহংকারকে বেশী প্রশ্রয় দিচ্ছিল। পুরনো কচকচি আর ভাল লাগছিলনা তার।

ট্রেনটা স্টেশনে ঢুকছিল। সামন্তকের ফ্ল্যাটটা দুটো স্টেশন পরেই। কোথায় গেছে বীথি? বাড়ি যেতে সামন্তকের ইচ্ছে করছিলনা। মায়ের হাজারখানা প্রস্নের মুখোমুখি হতে ক্লান্ত লাগছিল। বীথি ছাড়া ওই ফ্ল্যাটটা সামন্তক ভাবতে পারেনা। বেশ গুছিয়ে রাখত বীথি, সুন্দর করে। কে জানে বীথি কোথায় ঘুরছে? পুলিশে একটা খবর দেবে নাকি? বীথির বাবা মা কথাটা জানলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। বীথি বাড়ি থেকে দুটো স্টেশন টোটো চেপেই এসেছিল যাতে সামন্তকের মুখ দেখতে না হয়। বাড়ির ২ স্টেশন আগেই নামতে গিয়ে বীথির মুখোমুখি হল সে। বীথি ট্রেনে ওঠার আগেই হাতটা টেনে ধরে নিল সামন্তক। মনে পড়ে গেল প্রেমের সময় ট্রেনে চেপে অনেকবার বিধানপুরে গেছিল তারা। বীথির পড়া থাকত। সে যাওয়া আসা করত সাথে। বীথি যখন অনেকটা রেগে যায়, ওর মুখ লাল হয়ে যায়, আজও অন্যথা হয়নি। চিৎকার চেঁচামেচিতে স্টেশন চত্বরটা তোলপাড় হতে লাগল। অনেক লোক এগিয়ে এল নিজের দায়িত্বেই, সরিয়ে দিল বীথি। আবার দোষারোপের পালা শুরু হল দুপক্ষের। আর সেই সন্ধিক্ষণে বীথির মাথা ঘুরে গেল, হুঁশ ফিরল সামন্তকের।

নার্সিংহোমের বেডে শুয়ে ফুলদানির গোলাপগুলোতে হাত বুলিয়ে দেয় বীথি। অনেকদিন পর সুন্দর সকাল। সামন্তক আজ তাকে বাড়ি নিয়ে যাবে। বাবা, মাও বীথিকে দেখতে এসেছে। বীথিও সামন্তকের সঙ্গে চলে যাবে বলে তৈরি। মা নার্সিংহোমে এসে একটা চিঠি ধরালো। তার নামেই পোষ্ট করা চিঠি, একটা চাকরি জুটে গেছে বীথির। শহর থেকে অনেকদুরে। সামন্তকের চোখে একরাশ জল, মন খারাপ বীথিরও। তবে এই লোনা জলে একটা আনন্দও আছে। জীবনে একটাবার সামন্তকের কাছে জিতে গেছে বীথি। এক শীতল প্রতিশোধ। এটা সম্পর্কের রৌদ্র-ছায়ার আড়ালে মনখারাপের দিস্তার প্যাকেটগুলো কোথায় ঢুকিয়ে রাখবে, সেই নিয়ে চলে বিস্তর জল্পনা। কে জানে, এটা রেসের মাঠ? নাকি সংসার? সেই কথাই সম্পর্কের নিয়তি ভাবতে থাকে। এভাবেই বীথি ও সামন্তকেরা সম্পর্কের রৌদ্র-ছায়ায় তলিয়ে যাচ্ছে কি? উত্তরটা তোলা থাক?

রৌদ্র ছায়া প্রেমের গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!