কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

বাটি

বাটি ভৌতিক গল্প – সৌরভ মুখার্জি

কিচেনে ঢুকতেই ডক্টর শর্মার চোখ গেল ওই তোবড়ানো এলুমিনিয়ামের বাটিটার দিকে। তাঁর এই বাংলোর মডিউলার কিচেনে যেখানে দামি দামি পোর্সেলিন আর কাচের থালাবাটিতে ক্যাবিনেট ভর্তি সেখানে এই তোবড়ানো রংচটা বাটিটা খুব বেমানান। ডক্টর শর্মার অন্তত খুব চোখে লাগল ব্যাপারটা।

ডক্টর শর্মা কলকাতার এক সরকারি হাসপাতালের হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্টে আছেন বছর কয়েক। এছাড়া কলকাতায় ও চেন্নাইয়ে প্রথম সারির বেশ কিছু নার্সিংহোমে তাঁকে নিয়মিত যেতে হয়। সেখানে বেশিরভাগই হাই প্রোফাইল পেশেন্ট, পলিটিশিয়ান, খেলোয়াড় কিংবা সিনেমাস্টার। তাঁর মনও পড়ে থাকে ওখানেই কিন্তু সরকারি হাসপাতালে একটু সার্ভিস না দিলে যে চারদিকে কথা উঠবে। তাই দিনে একবার করে এসে এখানকার পেশেন্টদের ভিজিট করে যান। বড়জোর আধঘন্টা সময় যায় তাতে। এই আধঘন্টা প্রাইভেট নার্সিংহোমে দিলে যদিও তিনি বেশ মোটা টাকা আয় করতে পারতেন, কিন্তু সামাজিক কর্তব্যের খাতিরে সেটা আর করা যায় না। এই শহরের সবচেয়ে ধনী তিনজন ডাক্তারের মধ্যে তিনি একজন। সকলে বলে ডক্টর শর্মা টাকার গদিতে ঘুমোন।

এই কদিন আগে এডিনবরা থেকে কনফারেন্স সেরে কলকাতায় একটা শিশু হাসপাতাল আয়োজিত সেমিনারে বক্তৃতা দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় তাঁর জুনিয়র ডাক্তার মজুমদারও এই কথাই বলছিল। সেদিন তিনি আর হাসপাতালে যান নি। কিন্তু মজুমদার বলেছিল একটা বুড়োর অবস্থা নাকি খুব ক্রিটিক্যাল। বাসের তলায় চাপা পড়েছিল। পিষে যায়নি এই ভাগ্য। একবার দেখে গেলে ভাল হত। কিন্তু এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ওই সেমিনারে যাওয়ার কারণে আর সময় হয়নি।

বাটিটাকে প্রথম দেখেন কিচেনে, আবার সেদিনই সন্ধ্যেয় ক্লাবে যাওয়ার সময় গাড়িতে ওঠার সময় বাগানে হোয়াইট লিলি গাছটার নিচে ওটাকে দেখতে পেলেন। সন্ধ্যের আলোতে ভালো খেয়াল না করলেও মনে হল ওই বাটিটাই। হয়ত কেউ রান্নাঘর থেকে ফেলে দিয়েছে। ভেবে একটু স্বস্তি লাগল।

দিন তিনেক পর আবার হাসপাতাল যেতে পারেননি কিছু কাজের চাপে। মজুমদার ফোন করে বলল, বুড়োটা মারা গেছে। এখন মর্গে রাখা হয়েছে। ডক্টর শর্মা কথাটা শুনে মনে মনে ভাবলেন বাসের তলায় চাপা পড়েও কি করে তিনদিন বেঁচে ছিল এটাই আশ্চর্যের।

দুপুরবেলা সল্টলেকের এক নামকরা নার্সিংহোম থেকে ফেরার পথে সেন্ট্রালের কাছে সিগন্যালে গাড়িটা দাঁড়াতেই একটা কাঠির মত হাত পা ওয়ালা বুড়ো ভিখিরি গাড়ির কাচের গায়ে ঠকঠক করে আওয়াজ করে পয়সা চাইল। কি দিয়ে ঠুকল কে জানে, কিন্তু এত জোরে ঠুকল যে ডক্টর শর্মার মনে হল কাচে বুঝি দাগ হয়ে যাবে। তিনি ওই গরমেও কাচ নামিয়ে চিৎকার করে বললেন, “মেরে চামড়া গুটিয়ে নেব। কাচটা ভাঙবে নাকি?” বলেই কাঁচটা উঠিয়ে দিলেন, বাইরে লু বইছে। কয়েক সেকেন্ডে যেন তিনি পুড়ে গেলেন। লোকজন এরই মধ্যে হাঁটছে, বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে অফিস যাচ্ছে। সিগন্যালটা সবুজ হওয়া মাত্র তিনি দেখলেন কিছুটা দূরে ওই বুড়োটা অন্য একটা গাড়ির কাচে ঠোক্কর দিচ্ছে। হাতে সেই সেদিনের দেখা এলুমিনিয়ামের তোবড়ানো বাটি।

সেই বাটিটাই? কি করে হবে? তাঁর বাড়ি গড়িয়াহাট আর এটা মধ্য কলকাতা। এই তিনদিনের মধ্যে বাটিটা কি করে এতদূর আসবে? ভিখিরিটা কি তাঁর বাড়িতেও গিয়েছিল?

আপাতত সেসব ভাবনা মন থেকে সরিয়ে তিনি গাড়িতে রাখা একটা মেডিক্যাল জার্নাল খুললেন। খুব বড় করে একটা টপিক বেরিয়েছে, হ্যালুজিনেশন এন্ড ইলিউশন। ইলিউশন অর্থাৎ যেটা বাস্তব নয় সেটাকেই বাস্তব মনে করার মত মানসিক অবস্থা। তিনি মনে মনে ভাবলেন, ওই গরম হাওয়ায় এক ঝটকায় হয়ত তাঁর ইলিউশনই হয়েছিল।

পরদিন তিনি যাবেন বর্ধমান। সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে পড়তে হয়েছে। নইলে নটার মধ্যে গাড়িতে বর্ধমান পৌঁছনো যাবে না। ওখানে একটা প্রাইভেট নার্সিংহোম উদ্বোধন হবে। তারপর যাবেন বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট ভিজিট করতে। হেলথ মিনিস্টারেরও আসার কথা সেখানে।

গাড়ি কোনা এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার আগেই তাঁর চোখদুটো বুজে এসেছিল। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনিতে ঘুমটা ভেঙে যেতেই ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হল? এত জোরে ব্রেক মারলে কেন?”

ড্রাইভার ছেলেটা নতুন কাজে লেগেছে। সে একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “স্যার, রাস্তার মাঝে কি একটা পড়ে ছিল। ওটাকে পাশ কাটাতে গিয়ে বেরেক দিয়েছি। সরি স্যার।”

ডক্টর শর্মা পেছনের কাঁচ দিয়ে দেখলেন মাঝরাস্তায় কোথা থেকে একটা এলুমিনিয়ামের তোবড়ানো বাটি পড়ে রয়েছে। যদিও অনেকটা দূরে, কিন্তু তাঁর ডাক্তারি চোখ তো এত ভুল করবে না। সেই একইরকম বাটি।

সেদিন অনুষ্ঠানে মন বসল না। তবে দুপুর দুপুর করে অনুষ্ঠান শেষ হলেও ডক্টর মিত্রের কোয়ার্টারে গিয়ে বেশ জমিয়ে খাওয়া দাওয়া হল। ডক্টর মিত্র বর্ধমানের খুব নামকরা একজন সাইকোলজিস্ট। তাঁর কলেজের সহপাঠীও। এদিকে ড্রাইভার কিন্তু তাঁকে নামিয়ে দিয়েই উসখুস করছে। তাঁর এই নতুন ড্রাইভারের বাড়ি যে বর্ধমানে তা তিনি জানতেন না। তাছাড়া মন চাইছিল একটু লং ড্রাইভে বেরোতে। ড্রাইভারকে তাই আজকের জন্য ছুটি দিয়ে বর্ধমান থেকে তিনি নিজেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। তবে ছেলেটাকে বেশ কড়কে বলে দিলেন, কাল সকাল সকাল যেন চলে আসে। অনেকগুলো জায়গা যাওয়ার আছে।

বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। কোনা এক্সপ্রেসওয়ে আসার আগেই মনে পড়ল ঠিক এই জায়গাতেই ওই বাটিটা রাস্তায় পড়েছিল। এখন নিশ্চয়ই আর নেই। এর মধ্যে অন্তত হাজারখানেক গাড়ি ওখান দিয়ে গেছে এসেছে। কোথায় উড়ে গেছে এতক্ষনে।

কোনা এক্সপ্রেসওয়ের এদিকটা একটু অন্ধকার। হুসহুস করে গাড়ি আর বড় বড় ট্রাক বেরিয়ে যাচ্ছে। তিনি যদিও বেশি জোরে চালাচ্ছিলেন না, তবু খোলা জানলা দিয়ে বেশ হাওয়া আসছিল। কখনো কখনো এসির হাওয়ার থেকেও বাইরের হাওয়া সুন্দর মনে হয়, আরাম লাগে।

ড্রাইভারের পাশের সিটে বেশ কয়েকটা মিষ্টির বাক্স রাখা ছিল। ডক্টর মিত্র জোর করে কয়েকটা বড় বড় প্যাকেটে সীতাভোগ আর মিহিদানা দিয়েছেন। কিন্তু যেটা তিনি দেননি সেটা হল, ওই বাক্সগুলোর ওপরে রাখা রংচটা তোবড়ানো একটা বাটি। এলুমিনিয়ামের বাটি।

ডক্টর শর্মা ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গেলেন। ভাগ্যিস স্পিড বেশি ছিল না। নইলে হয়ত ধাক্কাই মারতেন সামনের গাড়িতে। গাড়ির মধ্যে বাটি এলো কোথা থেকে? সেই একই বাটি। রান্নাঘরে দেখেছেন, বাগানে দেখেছেন, সিগন্যালে দাঁড়ানো ভিখিরির হাতে দেখেছেন, আজ রাস্তায় পড়ে থাকতেও দেখেছেন একই জিনিস। এই প্রথম খুব কাছ থেকে দেখলেন, সাধারণ এলুমিনিয়ামের বাটি, একটা দিক তুবড়ে গেছে যেন ভারী কিছু চলে গেছে ওর ওপর দিয়ে। বাকি বাটিটাও নোংরা। ধুলো লেগে আছে চারদিকে।

ডক্টর শর্মা কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে ধরলেন বাটিটাকে। মৃতদেহের মত ঠান্ডা। যেন এক্ষুনি ফ্রিজ থেকে বের করা হয়েছে। ফ্রিজ নাকি মর্গ থেকে। বাটিটা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন জানলা দিয়ে। গায়ের জোরে যতদূরে ছোঁড়া যায়, ফেলে দিলেন।

এখন মনে হচ্ছে ভুল হয়েছে। সারাদিনের জার্নির পর এতখানি ড্রাইভ করে আসার ধকল সহ্য হচ্ছে না। এটাও একধরণের হ্যালুজিনেশন। নাকি ইলিউশন। কিন্তু তিনি তো বাটিটাকে ধরলেন, অনুভব করলেন। ইলিউশন কি এতখানিও হয়?

সেদিন খুব কষ্ট করে বাড়ি পৌঁছলেন। ডিনার পর্যন্ত করতে পারলেন না, শুয়ে পড়লেন। কাল সারাদিনের সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করতে হবে। এসিস্ট্যান্টকে একটা মেসেজ করে বললেন, শরীর খারাপ। সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করে দিতে।

রাতে ঘরের মৃদু আলোটা জ্বালিয়েই রাখলেন। আধঘন্টা অন্তর অন্তর ঘুম ভেঙে যেতে লাগল। শেষবার দেখলেন রাত আড়াইটে। বালিশে মাথা রেখে ওপাশ ফিরে শুলেন। আর ঠিক তখনই বালিশের তিন ইঞ্চি দূরে দেখলেন সেই অ্যালুমিনিয়ামের বাটিটা যেন তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসছে।

ওটা কি নিঃশ্বাস নিচ্ছে? নইলে এই গরমের দিনেও এত ঠান্ডা হাওয়া কোথা থেকে আসছে? তিনি মাথাটাকে বালিশ থেকে ওঠাতে চেয়েও পারলেন না। আবছা অন্ধকারেও দেখলেন বাটিটার গায়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্তের দাগ।

সকালে বাড়ির কাজের মেয়েটাই চোখে মুখে জল ছিটিয়ে তাঁর জ্ঞান ফেরায়। চোখ খুলেই তিনি দেখেন, বাটিটা পাশে নেই।

সেদিন দুপুর অবধি অনেকে ফোন করে তাঁর খবর নিলো। কিন্তু তিনি কাউকেই মন খুলে বলতে পারেন না তাঁর এই অভিজ্ঞতার কথা। ডক্টর মিত্রকে জিজ্ঞেস করবেন করবেন করেও আর বললেন না। তিনি হয়ত এসব শুনে হাসবেন। সেই তিনি প্রথমবারের জন্য অনুভব করলেন টাকা অনেক থাকলেও তাঁর কোনো বন্ধু নেই।

বেলার দিকে কাজের মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলেন রান্নাঘরে ঐরকম কোনো তোবড়ানো বাটি দেখেছে কিনা। প্রত্যাশিতভাবেই উত্তর এল, না। সে দেখেনি। কথায় কথায় বাগানের মালীকেও জিজ্ঞেস করে একই উত্তর পেলেন। বিকেল নাগাদ ড্রাইভার ছেলেটা এলে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, সেদিন কি দেখে গাড়িতে জোরে ব্রেক মেরেছিল। সে বলল, “ভাল বুঝতে পারিনি স্যার। তবে একঝটকায় দেখে মনে হল একটা রক্তমাখা কাপড়। হয়ত কোনো অ্যাক্সিডেন্ট…”

ডক্টর শর্মা তাকে মাঝপথে থামিয়ে বললেন, “বেশ তুমি এখন এসো।”

সেদিন বিকেলের পর আর কোনো অসুবিধে হয়নি। জুনিয়র ডাক্তার মজুমদারের সঙ্গে সন্ধ্যের দিকে একবার হাসপাতাল ভিজিট করতে গেলেন। রুটিং প্রশ্ন করতে করতে ছাব্বিশ নম্বর বেডের কাছে এসে দেখলেন, লোহার খাটের নিচে একটা এলুমিনিয়ামের বাটি। সেই বাটি।

ডক্টর শর্মা একটু থমকে গেলেন। কিন্তু এখন চারদিকে লোকজন আছে, সাথে মজুমদারও আছে। তিনি সাহস করে গলা তুলে বললেন, “ওই বাটিটা এখানে কি করছে? পেশেন্টের জায়গাটা একটু পরিষ্কার করে রাখা যায় না?”

পাশেই নার্স দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, “আসলে স্যার সেদিন একটা বাস অ্যাকসিডেন্টের কেস এসেছিল। এটা সেই পেশেন্টের।”

“হ্যাঁ, তো?”

“পেশেন্ট কিছুতেই বাটিটা ছাড়তে চাইছিল না। যতক্ষণ সেন্স ছিল বুকে আঁকড়ে ধরে ছিল। সেন্ট্রালের মোড়ে ভিক্ষা করতে গিয়ে বাস চাপা পড়েছিল।”

“হ্যাঁ তাতে কি হয়েছে? পেশেন্ট রিলিজ হবার সময় বাটিটা নিয়ে যায়নি?”

মজুমদার বলল, “রিলিজ হয়নি স্যার। তিনদিনের মাথায় এক্সপায়ার করে গেছে। ক্রিটিক্যালি ইনজিওর্ড হয়েছিল। আপনাকে বলেছিলাম, আপনার হয়ত মনে নেই। বডি এখন মর্গে আছে।”

ডক্টর শর্মা দ্বিতীয়বারের জন্য সেন্সলেস হয়ে হাসপাতালের মেঝেতেই লুটিয়ে পড়েন। ভারী শরীরটা ধপ করে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাত লেগে সেই বাটিটা ছিটকে জানলার বাইরে চলে যায়। মজুমদার দেখেই চিৎকার করে ওঠে, “ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। এক্ষুনি অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে বলো”।

অ্যাম্বুলেন্স আসার আগেই ডক্টর শর্মা মারা যান।

বাটি সৌরভ ভৌতিক গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!