কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

শেষ মানবী

শেষ মানবী ছোটো গল্প – তনিমা হাজরা

ঘুমের অতলে একটা প্রচন্ড আগ্নেয় বিস্ফোরণ হলো। চেতনার গভীর থেকে জেগে উঠে বসলো আহীরা। এখন কি ভীষণ কলকল করে ঘাম দিচ্ছে সারা গায়ে। স্বপ্নটা এতো সত্যির মতো সত্যি!  চোখ খুলে চারপাশে তাকালো সে। আজ আকাশটা খুব মেঘলা করে আছে। মনে হচ্ছে একটু বাদেই বৃষ্টি নামবে। মা বোধহয় এখনো পর্যন্ত ঘুম থেকে ওঠেনি। পাশের ঘর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না তো! কটা বাজে ঘড়ির দিকে তাকায় আহীরা। ঘড়িটা বন্ধ। বোধহয় ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে। চেঞ্জ করতে হবে। আকাশ দেখে বেশ বেলা হয়েছে মনে হচ্ছে। মা তো এতো বেলা অব্দি ঘুমোয় না। কি সাংঘাতিক ছিল যে স্বপ্নটা। ঘুমের মধ্যে আতঙ্কে কলকল করে ঘেমে গেছে। উঠে জানলাটা বন্ধ করে এসিটা চালালো। ইস! মোবাইলটাও চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। চার্জারটা খুঁজে লাগালো আহীরা। স্বপ্নটা প্রথম থেকে মনে করবার চেষ্টা করলো আর একবার…………… 

একটা খুব বড় ওয়েটিং লাউঞ্জ, ঠিক যেন একটা বিশাল এয়ারপোর্টের মতো। দেওয়ালগুলো কাঁচের। স্পেসক্রাফট ছাড়বার জন্য একটা ষ্টেশন এটা। বিরাট লাউঞ্জে চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছে অনেক মানুষ। আবার অনেকে কিউ-তে দাঁড়িয়ে আছে। একটা একটা করে স্পেসশীপ ছাড়ছে। মাইকে নাম বলা হচ্ছে কে কত নম্বর স্পেসশীপে যাবে। বছরের পর বছর ধরে ক্রমাগত জীবাণু যুদ্ধ হবার ফলে পৃথিবীর আবহাওয়া এতটাই দূষিত হয়ে গেছে যে আর এখানে বসবাস করা নিরাপদ নয়। তাছাড়া অতিমারীর পরে অতিমারী সহ্য করে পৃথিবীর মানুষের সংখ্যাও খুব কমে প্রায় বিপন্নপ্রজাতির খাতায় নাম উঠেছে মানুষের। কয়েক বছর আগে নিকটবর্তী গ্যালাক্সিতে একটা হ্যাবিটেবল প্ল্যানেট আবিস্কৃত হয়েছে। ইউনাইটেড নেশনের পক্ষ থেকে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে সেখানেই সবাইকে সরিয়ে নিয়ে যাবার কাজ চলছে। কাজ মোটামুটি প্রায় শেষ পর্যায়ে। অনেক মানুষকেই ইতিমধ্যে সেই নতুন গ্রহে পুনর্বাসন করা হয়েছে। আর দু একদিনের মধ্যেই পুরো কাজটা শেষ হয়ে যাবে।। প্রথমে একেবারে শিশু এবং পঞ্চাশ বছরের নীচে যাদের বয়স তাদের শিফট করা হয়েছিল। সেই অনুযায়ী আহীরা আর তার দাদার আগেই চলে যাবার কথা। কিন্তু তাদের ফ্যামিলি কিছুতেই মনস্থির করতে পারছিল না তাদের এ-ই পৃথিবী ছেড়ে অজানা কোনো গ্রহে যাওয়ার কথা। কিন্তু শেষ অব্দি প্রচন্ড অক্সিজেনের ঘাটতি আর পুনঃ পুনঃ সংক্রমণের তীব্র ভীতি ওদের যাবার কথা ভাবতে বাধ্য করলো। আহীরার বয়স পঁচিশ, ওর দাদার বয়স ত্রিশ। ওরা এই স্পেসশীপটায় যাবার টিকিট পেয়েছে। বাবা মায়ের বয়স পঞ্চাশের বেশি। ওরা আজ অপেক্ষা করবে। কাল বা পরশু যে লাষ্ট স্পেসশীপটা ছাড়বে তাতে তাদের নেওয়া হবে। পিঠে একটা ভারি রুকস্যাকে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আর অক্সিজেন সিলিন্ডার নাকে অক্সিজেন মাস্ক।এখন পৃথিবীর বাতাস এত দূষিত যে স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাস নেওয়া যায় না। অক্সিজেন সিলিন্ডার সবার পিঠে বাঁধা আর নাকে অক্সিজেন মাস্ক। কিউতে দাদার আর বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে আছে আহীরা। বারবার সে লাউঞ্জে চেয়ারে বসে থাকা মা বাবার দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। ওদের এখানে একা রেখে একদম যেতে ইচ্ছে করছে না ওর। যদি সবাইকার একই শীপে এ্যালটমেন্ট হয়ে যেতো তাহলে খুব ভালো হতো। যাক গে। কাল তো ওরা রওনা হবে। নতুন গ্রহে গিয়ে অপেক্ষা করবে ওদের জন্য। কে জানে কতদিন লাগবে পৌঁছাতে। কেমন সেই নতুন গ্রহ, কেমন সেখানকার চারিদিক, মাটি,আকাশ, গাছপালা আছে নাকি,পাহাড় বা নদী এখানকার মতো পাখি,পশু। কিচ্ছু জানা নেই।। প্রায় স্পেসশীপের দরজার কাছে পৌঁছে গেছে তারা। যে যতটা দাম দিয়ে টিকিট কেটেছে তাদের উইন্ডো ভিউ তত ভালো। দাদা আর আহীরা মাঝামাঝি জায়গায় সিট পেলো। সিটবেল্ট বাঁধা হলো। ভেতরের লাইট বন্ধ হলো। এবার সবার নাম আর সিট চেকিং হচ্ছে ফাইনালি। এখন উড়বার ঘোষণা হচ্ছে। এবারে ছাড়বে। শেষবার পৃথিবীর দিকে তাকালো আহীরা। বাবা মার জন্য, পৃথিবীর জন্য মনটা মুচড়ে উঠলো। অন্যগ্রহে পৌঁছে বাবা মার সাথে দেখা না হওয়া অব্দি শান্তি নেই। প্রচন্ড একটা আওয়াজ করে তীব্র গতিতে স্পেসশীপটা আকাশে উঠলো। কিন্তু ওকি!! পেছনে ওয়েটিং লাউঞ্জটায় প্রচন্ড একটা বিস্ফোরণ হয়ে আগুনের লেলিহান শিখা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো কেন এত তীব্রভাবে?? এদিকে স্পেসশীপের ভেতর সাংঘাতিক হট্টগোল আর কান্নাকাটি  শুরু হলো বিভিন্ন ভাষায়। যাদের আত্মীয়রা ওখানে ছিল সবাই পাগলের মতো চিৎকার করতে লাগলো। ওয়েটিং লাউঞ্জটা উড়ে গেল বিস্ফোরণে নাকি

পরিকল্পিতভাবে উড়িয়ে দেওয়া হলো। দাদা স্থানুবৎ বসে আছে। আহীরা উন্মাদের মতো কেঁদে উঠলো। চিৎকার করছে কিন্তু গলা দিয়ে কিছুতেই আওয়াজ বেরোচ্ছে না। এইরকম দমবন্ধ কষ্টের মধ্যে ঘেমে নেয়ে ঘুমটা ভেঙে গেছিলো আহীরার।। ঘুম ভেঙে স্বাভাবিক ঘরে শুয়ে আছে দেখে খানিকটা ধাতস্থ হয়েছিল সে। কিন্তু চারিদিক শুনশান। হাতটা নিজের নাকের উপরে রাখলো সে। না অক্সিজেন মাস্ক ছাড়াই সে নিঃশ্বাস নিচ্ছে । মা, মা, করে ডাকলো একবার সে। দেওয়ালে বাবার ছবিটার দিকে চোখ পড়লো। বাবা তো তার ছোটবেলাতেই মারা গেছেন। দাদাও চাকরিসূত্রে অন্য শহরে থাকে। সে তার মার সাথে থাকে। আবার সে ডাকলো মা, মা। কোনো উত্তর এলো না। পাশের ঘর খালি। মা কি তাহলে কোথাও বেরিয়েছে? কিন্তু না বলে কোথায় যাবে। ফোন তুলে মায়ের নম্বরটায় রিং করলো সে। মেশিন ভয়েস বলছে, দিস নাম্বার ডাজ নট একজিষ্ট। আবার, বারবার চারবার রিং করলো, একই উত্তর এলো।। আচ্ছা ফ্যাসাদ তো!!  দরজা খুলে ব্যালকনিতে এলো সে। সাততলার উপর থেকে নীচের রাস্তায় তাকিয়ে দেখলো, নাঃ, চারিদিক কোনো লোকজন নেই। অদ্ভুত ব্যাপার!  দাদার নম্বরে ফোন করল সে। ওই একই মেশিন ভয়েস বল্ল, দিস নাম্বার ডাজ নট একজিষ্ট। কেমন যেন ঘুলিয়ে যাচ্ছিল মাথাটা আহীরার। এই একটু আগে ওইরকম একটা ভয়ানক স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে আবার এইসব অদ্ভুত ঘটনাগুলো ঘটছে তার সাথে। এটাও কি স্বপ্ন নাকি?  নাঃ নিজের হাতে নিজে চিমটি কেটে সে দেখলো যে সে জেগেই আছে। হঠাৎ মোবাইলটার দিকে চোখ পড়তেই টাইমের নীচে ডেটটা দেখে সে ভারি অবাক হয়ে গেলো। সালটা দেখাচ্ছে   3021.মানে?   2021 হওয়ার কথা তো। এক হাজার বছর আগে ঘুমিয়েছিল সে তাহলে আর জেগে উঠলো আজ এক হাজার বছর বাদে। তাড়াতাড়ি আয়নায় দেখলো নিজেকে। হ্যাঁ চুলগুলো সব প্রায় সাদা আর মুখে চামড়াও কিছুটা ঝুলে পড়েছে। কিন্তু একহাজার বছর ধরে সে বেঁচে আছে কি করে?? পাশের বাড়ির ফ্ল্যাটে, তার পাশে, তার নীচের তলায়, তার নীচে সবার বাড়িতে পাগলের মতো বেল বাজাতে থাকলো সে। কেউ যদি বেরিয়ে আসে কোনো বাড়ি থেকে। নাঃ কেউ বেরিয়ে এলো না। 
দরজা খুলে রাস্তায় বেরিয়ে এলো সে।আকাশের রঙ কী ভীষণ গাঢ় সবুজ।। 
 

সামনের রাস্তা ধরে হনহন করে হাঁটতে শুরু করলো। কোনো মানুষ তো দূরের কথা, একটাও কুকুর বেড়াল বা পাখিও দেখা যাচ্ছে না কোথাও। এতবড় অতিমারী পেরিয়ে তাহলে সে একাই বেঁচে রইলো নাকি তাহলে, নাকি তাকে ছেড়ে দিয়ে সবাই স্পেসশীপে করে অন্য গ্রহে চলে গেছে?  

মাত্র একজন জীবিত কোনো জীবনের দেখা পাবার জন্য উন্মাদের মতো সে ছুটতে থাকলো পৃথিবীর শুনশান রাস্তা ধরে।

শেষ মানবী ছোটো গল্প – সমাপ্তি

যে কেউ তাদের লেখা জমা দিতে চান। অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা জমা দিন পৃষ্ঠায় জমা দিন| এবং যারা লেখা জমা দিচ্ছেন। পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!