কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » ভৌতিক গল্প » হারিয়ে যাওয়ার ফাঁদে

হারিয়ে যাওয়ার ফাঁদে

হারিয়ে যাওয়ার ফাঁদে ভৌতিক গল্প – তরুণ প্রামাণিক

সন্ধ্যা উতরে রাত্রি নেমেছে অনেক্ষন। একটানা ঝিঁঝির ডাক ছাড়া চারপাশটা বেশ নিঝুম। দূরের ঐ ঝুপসি বেঁটে বট গাছটা রাতের অন্ধকার গায়ে মেখে কালো ছায়ার মত নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই থেকে। ঐ গাছের উপর দিয়ে শকুন শাবকের একটানা ঘ্যানঘ্যানে কান্না হাওয়ার টানে ভেসে আসছে থেকে থেকে। সে আওয়াজ খুব তীক্ষ্ম নয় অথচ বিষাদ মাখা, নির্মম নয় তবে তাতে হতাশার সুর বেশ স্পষ্ট। হঠাৎ কানে এলে শ্মশান ফেরত মৃতের কোনো আত্মীয়ের সর্বহারা আর্তনাদ বলেই ভ্রম হয়।  

একটা দীর্ঘশ্বাস আপনা আপনি ভিতর থেকে বেড়িয়ে এলো বিজন সামন্তের। কান্নার ঐ আওয়াজের উৎসের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে, বিস্তীর্ণ নদীর ঘোলাটে জলের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন তিনি। 

আজ আবার একটা হারিয়ে যাওয়ার দিন। মাঝে মাঝেই খামখেয়ালি আর উদভ্রান্তের  

 মত মনটাকে নিয়ে, নিজের থেকে নিজেই হারিয়ে জান তিনি।

এতেই মেলে বাঁধন ছাড়া মুক্তির এক অনাস্বাদিত আঘ্রাণ। সংসারে যখন প্রবল একাকিত্ব এসে খামচা খামচি করে, তখন সব ছেড়ে উঠে দাঁড়ান বিজন সামন্ত। দীর্ঘ দিনের সঙ্গী লেদারের চৌক কালো ব্যাগটাকে বুকের কাছটায় জাপ্টে ধরে বেড়িয়ে পড়েন আবার নতুন করে হারিয়ে যেতে। যদিও তিনি জানেন সব সময় সব জায়গায় হারিয়ে যেতে নেই, তাতে ফেরা কঠিনই নয় দুঃসাধ্য হয়ে পরে।

দেশলাইয়ের কাঠি ঠুকে একটা বিড়ি ধরালেন বিজন বাবু। আঙুলের টোকায় নিভান্ত কাঠি টাকে দূরের জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে একরাশ তৃপ্তির ধোঁয়া ছাড়লেন। চিকন চোখে চেয়ে রইলেন সুদূর প্রসারী শান্ত নদীর ঢেউ হীন ঐ গভীর জলের দিকে। চারধার তখন খুব ফাঁকা। ছন, আর কাশের ঘন জঙ্গল ছড়িয়ে আছে এধারে ওধারে। এদিকটাতে দিন মানেই লোক বিশেষ ঘেঁষে না। শিয়াল ডাকে,সাপেরও বেশ উৎপাত। সন্ধ্যে নামতে না নামতেই তাই একরাশ নির্জনতা এসে চেপে বসে। ঘন অন্ধকারে ডুবে যায় জায়গাটা। গা কেমন কেমন করে। এখানেই একটা উঁচু মাটির ঢিপির উপর বসে আজকের এই হারিয়ে যাওয়ার দিনে সেই থেকে আকাশ কুসুম ভেবে চলেছেন বিজন বাবু। নদীর জল থেকে মাঝে মধ্যে জল পোকাদের বিচিত্র স্বর ভেসে আসছে। আর ভেসে আসছে কেমন একটা জলজ গন্ধ। বিজন বাবু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন,তিনি যেখানে বসে আছেন ঠিক তার পিছনে নদীর দিকে আসার ঢালু আর গড়ান পথের উপরে ঐ দূরের রাস্তায় ল্যাম্প পোস্টের হলদেটে আলোয় খেলা করছে হেমন্তের মৃদু কুয়াশা। এই আবছা অন্ধকার থেকে দেখতে বেশ ভালই লাগছে। যেন ধোঁয়ার আড়ালে লুকিয়ে থাকা হারিয়ে যাওয়ার গোপন দরজা!

মুখের আধ পোড়া বিড়িটা মাটিতে ফেলে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন তিনি। চটির মাথা দিয়ে ডলে বিড়ির আগুনটা নেভাতেই খেয়াল করলেন একটা স্টিমার ভিড়েছে ঘাটে। মুখের ধোঁয়াটুকু খুব সরু করে শেষ পর্যন্ত ছেড়ে, পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন ও দিকে। রাতের নির্জনতা চিড়ে ঝাঁকড়া ঐ বট গাছের মাথা থেকে আবার ভেসে এলো শকুন শাবকের করুন আর্তনাদ। কোথা থেকে উড়়ে এলো একটা সাদা লক্ষ্মী পেঁচা, জল খাবে বলে।

মস্ত বড় স্টিমারের বুকে পা দিতে না দিতেই শরীরটা যেন সামান্য দুলে উঠলো তাঁর। ধেয়ে আসা কুয়াশার বুকে হৈ হৈ করে ছড়িয়ে পড়ছে আলো। লেদারের ব্যাগটা এক হাতে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে অন্য হাতে স্টিমারের হাতল ধরে উঠে পড়তেই, খুব নিঃশব্দে ছেড়ে দিল সেটা। যেন বিজন বাবুর জন্যই তার এখানে আসা। এদিকে ওদিকে ইতস্ততঃ ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খুব পুরনো কিছু কাঠের চেয়ার ব্যতীত প্রায় জনহীন এই চত্বর। এমন নির্জনতায় বিজন বাবু একটুও ভয় পেলেন না। এঘাট ও ঘাট করে ঝরঝরে আর ভগ্নপ্রায় হতে বসা স্টিমারটির বয়স ঠিক আন্দাজ করা যায় না। রং চটে গিয়ে প্রবল জরাজীর্ণ আর ভগ্নপ্রায় ও ভীষণ হতশ্রী দশা তার। এটুকুই বোঝা যায় যে এটা নিশ্চিত কোনো মালবাহী স্টিমার। ভেঙ্গে পড়ে হা হয়ে রয়েছে কাঠের পাটাতন, কালো ধোঁয়ার ছোবলে লম্বা চিমনিটিও তেলচিটে আর কালো কুটকুটে হয়ে রয়েছে। 

বিজন বাবু পায়ের নীচের কাঠের পাটাতন থেকে চোখ তুলে দেখলেন, চলমান নদীর তীর যেন অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। অনেক দূরে চলে যাচ্ছেন বিজন বাবুও। নদীর উজানে স্টিমার দুলে দুলে ভেসে চলেছে মৃদু একটা ঝংকার তুলে। উল্টো দিকে, জলের স্রোতের বুকে ভেসে চলেছে কচুরিপানা। দূরের ল্যাম্প পোস্টের ঘোলাটে আলো জাফর কাটা আলোর ফুলঝুরির মত জলে এসে লাফিয়ে পড়েছে লম্বাটে রেখায়। কাঁপতে থাকা সে আলো যেন ক্রমশ গুলে যাচ্ছে শান্ত নদীর ঘোলাটে জলে। এত টুকু ঢেউ নেই কোত্থাও। কেবল একটা তিরতিরে কাপন। সেখান থেকে ঠান্ডা একটা স্বস্তির বাতাস এসে বিজনবাবুর চুল গুলো ঘেঁটে দিচ্ছে। একটা কাঠের চেয়ারের উপর ধপ করে বসে পড়লেন তিনি। কোমরটাকে একটু টান করে, চিবুক ছুঁয়ে যাওয়া মৃদু হাওয়ার পরশে চোখ দুটো একটু বন্ধ করেছেন কি করেন নি, অমনি হঠাৎ অন্ধকারে নরম কিসের উপর পা পড়তেই আঁতকে উঠলেন তিনি। বিজনবাবুর গলা পেতেই এই এতক্ষন পায়ের কাছে কম্বলে মুড়ি দেওয়া শরীরটা একটু নড়েচড়ে উঠলো। বিজন বাবুর মুখে তো রা কাটে না। তাই দেখে ওই ঝাপসা অন্ধকার থেকে গায়ের কম্বলটা সরিয়ে কেউ একজন ধরফর করে উঠে বসলো। বড্ড রুগ্ন আর হাড় গিলগিলে চেহারা তার। সাধারণ মানুষ না ভিখারী তা ঠিক বোঝা যায় না। যেন ঠিক রক্ত মাংসের মানুষ নয়, কী কঙ্কালসার চেহারা তার! যেন সত্যিই কারেরই কঙ্কাল।

ইতি মধ্যেই দিগন্ত প্রসারী এই নদীটি ডানদিকে বাঁক নিয়েছে। নদীর বুকেই জেগে উঠেছে গোটা একটি দ্বীপ। শর বন, ঘাস,আর কুলকাটার ঘন জঙ্গলে ভরা। তার পাশে দিয়েই মন্থর গতিতে চলেছে স্টিমারটা।বাইরেটা যেন ঘষা কাঁচের মত হয়ে আছে। খুব অস্বচ্ছ । কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

বিজন বাবুর দিকে ভীষণ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল লোকটা। বিজন বাবুর অস্বস্তিটা বেড়ে গেলো তাতে। সাময়িক সেই অস্বস্তি কাটাতে বাইরে তাকালেন তিনি।

‘ ভয় পাবেন নি বাবু। আমিও আপনার মতই একজন ভবঘুরে। আজ একেনে তো কাল সেকেনে।আজ টেরেনে তো কাল বাসে। এরাম করিই গোত্তা মেরি একেন ওকেনে পড়ি তাকি আর কি !’ কথা শেষ না করেই একটা ফ্যাস ফ্যাসে গলায় খ্যাক খ্যাক করে হাসতে লাগলো সে। তার পর অনেক ক্ষন মাথা টাতা চুলকে বিজন বাবুর দিকে খানিকটা সরে এসে, গলা আরো খানিকটা নামিয়ে এনে ফিসফিস করে বললো, ‘ এক খান বিড়ি হবে বাবু ?’

বুক পকেটে রাখা বিড়ির প্যাকেট থেকে একটা বিড়ি তার দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি।

ছো মেরে তাঁর হাত থেকে বিড়িটা যেন এক রকম কেরেই নিল ওই ভবঘুরে।কোমরের কাছে লুঙ্গির গিঠ খুলে একটা দেশলাই বারকরে খুব দ্রুত ফসস্ করে ধরিয়ে ফেললো সেটা। তার এই অদ্ভুত ভঙ্গিতে ভীষণ অবাক হলেন বিজন বাবু। হয়তো হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ার আনন্দ পূরণ করতে এমন আজগুবি রাত কখনো কখনো আসে জীবনে। ক্ষণজন্মা ওই আলোক শিখার উজ্বল আভায় তিনি দেখলেন, লোকটির একমাথা ঝাঁকড়া চুল। খুব রুক্ষ আর অবিন্যস্ত, এলোমেলো ভাবে উড়ছে। চোখ দুটো জন্ডিস রোগীর মতই ফ্যাকাসে আর হলুদ। মুখটা অনেকটা আমের আটির মত চ্যাপটা ও লম্বাটে। এক ঝলক দেখে মনে হয় যেন কোনো মৃতের শরীর। যেন কয়েকটি হাড়ের উপর আমসত্বের মত গাঢ় হলুদ রঙের চামড়া জরানো।

‘ এত রাত্তিরে কুথাই যাতিছেন বাবু ?’ বিড়ি ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়া বেশ খানিকটা আয়েশ করে ছাড়তে ছাড়তে বললো লোকটা।

কথা গুলো বলতে যেন কষ্ট হচ্ছিল তার। 

বিজন বাবু কোনো জবাব দিলেন না। সামনে বসা মানুষটাকে যেন খানিকটা মেপে নিতে চাইলেন। লোকটার গতিবিধি ঠিক সুবিধার ঠেকছে না! চোর ডাকাত নয় তো ! পাশেই চেয়ারের উপর রাখা ব্যাগটা কে আঁকরে ধরলেন বেশ শক্ত করে। অবশ্যি এত ভয়েরই বা কি আছে তার। সম্পদ বলতে তো ওই একটা ইনহেলার, এক ডিব্বা নস্যি, আর গুটি কয়েক পুরনো খবরের কাগজ। তবুও বিজন বাবুর এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর দিতে খুব বিরক্ত লাগে, আর দিতেও চান না তিনি।

ঘুরে বেড়ানোই তাঁর নেশা। সেই ছোটো বেলা থেকেই স্টেশনে এসে গন্তব্য ছাড়াই যে কোনো ট্রেন উঠে পড়তেন তিনি। তারপর অজানা কোনো জায়গায় নেমে পড়তেন। সেই অজানা মানুষ, অচেনা পরিবেশের মধ্যেই খুঁজে নিতেন হঠাৎ করে হারিয়ে যাওয়ার আনন্দ। আজ ও তাই হারিয়ে যাওয়ার উপযুক্ত রাত। এই রাতে কোথায় চলেছেন? কেনো চলেছেন ? এসব অবান্তর প্রশ্নের উত্তর দিতে একদম রাজি নন তিনি।

বিজনবাবু খানিকটা ব্যস্ততার ভান করে অন্য দিকে তাকিয়ে ডান পা টা ভাজ করে চেয়ারের উপর তুললেন। তারপর শোয়ার ভঙ্গিতে চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে, লোকটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বাইরের জমাট অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলেন খুব মিহি করে। 

‘বাবু ! আপনি মনে মনে যা ভাবতিছেন আমি কিন্তু তা নই। আপনি নিচ্চিন্তে থাকতি পারেন।আমার মনির ভিতর, কোনো খারাপ মতলব নেইকো বাবু।’ হেপো রোগীর মত হাঁপাতে হাঁপাতে কথাগুলো একটানা বললো ওই লোকটা। তার কাশির দমকে মুহূর্তের নীরবতা ভেঙ্গে গুড়ো গুড়ো হয়ে মিশে গেলো ঝিম ধরে থাকা রাত্রির নিকষ অন্ধকারে। কোথা থেকে একটা পাখি খুব তীক্ষ্ম স্বরে ডেকে উড়ে গেলো একদম নদীর জল ছুঁয়ে। বিজনবাবু একটু লজ্জিত হলেন বটে কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। শুধু মাত্র লেদারের ব্যাগের উপরে রাখা ডান হাতটা খানিকটা শিথিল হয়ে এলো তাঁর। মনের ভিতর শুধু একটি বিষয় ক্রমাগত খচ খচ করে চলছিল। লোকটি কি করে বুঝলো যে সে তাকে সন্দেহ করছে ! বিজন বাবু একটু রাগত স্বরেই প্রশ্ন করলেন, ‘ তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু তুমি কোথায় যাবে হে ? ‘  বিজন বাবুর কথা শেষ হতে না হতেই প্রবল অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল লোকটা। হাসতে হাসতে প্রচণ্ড কাশির দমক উঠলো তার। এমনই প্রাণান্তকর অবস্থা হল যে, এই যায় কি সেই সেই যায়। তারপর খানিকটা দম নিয়ে বললো, ‘ আমার কি আর কোত্থাও যাবার যো টি আচে নাকি ! সে পাট তো সেই কব্বেই চুকে গেচে  বাবু। তাই আগানে বাগানে, শ্মাশানে মশানে, ঘুরিঘুরি বেড়াই। ঘর নাই, বাড়ি নাই, এই সূক্ষ্ম দেহটা নে গে তাই যেখানে সেখানে ফেললিই হল।’ 

লোকটার কথায় ভীষণ অস্বস্তি হল বিজন বাবুর। শেষ ট্রেন ফেল করে স্টেশনে বসেই কাটিয়েছেন কত রাত। বাসের মাথায় চড়ে কত অপরিচিতের সাথে সারা রাত গল্পো করতে করতে নিজের থেকে হারিয়ে গেছেন বহু বার। কিন্তু কখনো তো এমনটা হয়নি তার। তবে কি রাতের বেলায় হঠাৎ করে হারিয়ে যাওয়ার পুরনো শখের টানে ভাসতে গিয়ে শেষে কি তেনাদের পাল্লায় পড়লেন তিনি ?

ভিতর ভিতর সহসা একটা তীব্র ভয়ের ছোঁয়া নাড়িয়ে দিলো তাঁকে। নদীর বুকে হেমন্তের হালকা হাওয়ায় একটা শীতের টান। সেই হাওয়া চিড়ে নির্ধারিত গন্তব্যের দিকেই স্টিমারটা চলেছে তির তির করে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বিজন বাবু ভয়ের মধ্যেই ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছিলেন একটু একটু করে। সহসা বুটের ভারী আওয়াজে দুজনেই সচকিত হয়ে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে একটা জোরালো টর্চের আলো লম্বা ফালিতে পাটাতনের উপরের আবছা অন্ধকার চিরে ফেললো। ঘটনার আকস্মিকতায় বসার জায়গা ছেড়ে ধরফর করে উঠে দাঁড়ালেন বিজন বাবু। দেখলেন সাদা জামার উপর কালো ব্লেজার চাপানো বেশ উঁচু লম্বা আর বেশ হৃষ্ট পুষ্ট দানবের মত চেহারার এক জন লোক বুক টান করে এসে দাঁড়িয়েছে তাদের সামনে। তাঁকে দেখে স্টিমারে সারেং বা নাবিক বলেই মনে হচ্ছে। বাম হাতের ইশারায় বিজন বাবুকে বসতে বলে, ডান হাতে ধরে থাকা টর্চের আলো ফেললেন পাটাতনের উপরে নির্বিকার ভাবে বসে থাকা অদ্ভুত দর্শন ওই লোকটার উপর। ওকে দেখে দু চোখে যেন আগুন জ্বলে উঠলো সারেঙের। ঝড়ের বেগে ছুঁটে গেলেন তার দিকে। চুলের মুঠি ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে গেলো পাশের কেবিনের ঘন অন্ধকারে।টর্চের আলো নিভে যেতেই খোলা নদীর বুক থেকে হু  হু করে ছুঁটে এলো মিশমিশে ঘন কালো আঁধার। উপচে পড়া দোয়াতের কলির মত ছড়িয়ে গেলো কোণায় কোণায়। বিজন বাবুর মনে হলো সর্বনাশী এই অন্ধকার যেন সব কিছুকেই নিরুদ্দেশ করে দেবে। সর্বগ্রাসী এই আঁধারের চোরা স্রোতে হারিয়ে গেলে ফেরার আর কোনো উপায় থাকবে না। মাঝে ক্ষণিকের নিস্তব্ধতা। শুধু জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শোনা যাচ্ছে। এবার কি করবেন ভাবতে ভাবতে দরদর করে ঘাম তে থাকলেন তিনি। হঠাৎ ভারী কিছু দিয়ে মাথায় আঘাত ও সেই সাথে যন্ত্রণার তীব্র আর্তনাদ ভেসে এলো তাঁর কানে। জপাং করে কেউ বুঝি জলে লাফিয়ে পড়ল। কাউকে যেন ঠেলে ফেলে দিল কূল হীন নদীর অথৈ জলে। ডুবতে ডুবতে বেঁচে থাকার শেষ আকুতি টুকু গোঙরানির মত নিশ্চিদ্র অন্ধকার ছিড়ে ভেসে আসছে। মাঝ আকাশ ফাটিয়ে চকিতে গর্জে ওঠা বাজের মত ঠিক সেই সময় বেজে উঠলো স্টিমারের তীব্র হর্ন। জমে ওঠা সেই আর্তনাদ ঢাকতেই কি হর্ন বাজলো রহস্যময় এই স্টিমার টা! বিজন বাবুর মাথা ঘুরতে লাগলো। ধপ করে বসে পড়লেন তিনি। ক্রমাগত ভয় আর অনভিপ্রেত এই রহস্যের জালে ফেঁসে বিজন বাবু যেন জমে যাচ্ছেন। অন্ধকারের মত ঠান্ডাও জমাট বাঁধছে তাঁর শরীরে। নিজের এত ঠান্ডা লাগছে কেন! শুধু কি ভয়ে ?

তিনি দেখলেন সারেঙের পিছু পিছু এসে পাটাতনের উপর চুপ করে বসলো লোকটা। চোখে মুখে তার সয়ে যাওয়া প্রশান্তি। ভাব খানা এমনতরো, কিছুই হয় নি যেন। আড় চোখে তাকে দেখলেন বিজন বাবু। লোকটি স্থির চোখে তাকিয়ে আছে তারই দিকে। সহসা সারেং সাপের মত লক লকে জিভ বার করে বিজন বাবুর কানের কাছে সরে এসে খুব ফিসফিস করে বললো, ‘ আপনি ঠিক আছেন তো ? মানেএএ কেমন লাগছেএএ এখন ? ‘ 

বিজন বাবুর খুব ভয় করছিল, সাংঘাতিক ভয়। তিনি কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। তবুও সেই থেকে মনের ভিতর উথাল পাথাল করা রহস্যের জট ছাড়াতে খুব কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্নটা করেই ফেললেন, ‘ ও কিসের কান্না ! কে কাঁদছিল অমন করে ? ‘

‘ ও তেমন কিছু নয়। মাঝে মধ্যেই এমন সব ঘটনা ঘটে। জীবন্ত মানুষ কিছু না বুঝেই কখনো কখনো উঠে পড়ে এই স্টিমারে, এসে পড়ে এই মৃতের নগরীতে। তখন আর কি! অগত্যা মারতেই হয় এই সব বোকাদের। ওই দেখুন না মরে গিয়ে বেচারা কেমন তুলোর মত হালকা হয়ে বসে আছে গুটিসুটি মেরে।’ মাটির খালি হাঁড়ির মধ্যে পাক খেতে থাকা গমগমে আওয়াজের মত প্রতি ধ্বনি তুলে সারেং বললো কথা গুলো। শরীরে জাঁকিয়ে বসা ঠান্ডা ফিকে করতে বিজন বাবু তাঁর দিকে শুধু চেয়ে রইলেন আবছা চোখে। সারেং তাঁর কাঁধে হাত রেখে আস্বস্ত করে বললেন, ‘ আপনি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন কেন ? আপনাকে শেষ গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েই তো আমাদের ছুটি।’ তারপর বিজন বাবুর থেকে খানিকটা সরে গিয়ে বাজ পড়ার মত ঠা ঠা করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে গিয়ে কি ভেবে যেন থমকে দাঁড়ালেন সারেং। তারপর ঠোঁট দিয়ে চুক চুক করে মৃদু একটা আওয়াজ তুলে বললেন, ‘ বুঝতে পেরেছি সবে সন্ধ্যা বেলায় মরেছেন তো, তাই জীবনের মায়া এখনো ছাড়েনি। অচেনা দুনিয়া মানিয়ে নিতে এখনো তাই কষ্ট হচ্ছে। শান্ত হয়ে বসুন গন্তব্য এসে গেলে আমি আপনাকে ডেকে দেবো।’

রাতের অন্ধকার ফালাফালা করে তারস্বরে আবার বেজে উঠলো হর্নটা।

হারিয়ে যাওয়ার ফাঁদ ভৌতিক গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!