কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » রহস্যগল্প » গজমোতি

গজমোতি

গজমোতি রহস্য্ গল্প – মিত্রা হাজরা

ভোরের সমুদ্রের এ এক রূপ, অন্ধকার কাটিয়ে দিনমণির উদয় হচ্ছে। কোন অদৃশ্য শিল্পী কুসুম আবির ছড়িয়ে দিচ্ছে আকাশ জুড়ে, সেই রঙের ছটায় সমুদ্রের ঢেউ ও লাল হয়ে যাচ্ছে। দুই বন্ধু বিভোর হয়ে দেখতে থাকলো, এখন একজন কনুই এর খোঁচা দিল—কিরে! প্রাণ টা যে চা—চা করছে। অন্যজন ডাকলো—এই ভাই এদিকে দুটো চা দাও তো, বালিয়াড়ি তে সার সার চেয়ার পাতা, বসে গেল দুজনে—হিরন্ময় আর শিশির। গতকাল ই দুজনে পুরী এসেছে, একটা রহস্যের সমাধান করতে। উঠেছে হিরন্ময় এর বাবার বন্ধুর বাড়িতে। সমুদ্র থেকে অনেকটাই দূর, জায়গাটার নাম’ মুকুন্দ মিশ্র নগর’ ।

হিরন্ময় আর শিশির খুব ভালো বন্ধু, একসাথে খেলাধূলা, পড়াশোনা করে বড় হয়েছে, শিশির বেসরকারী সংস্থায় কাজ করে, হিরন্ময় এর বাবার ব্যবসা, তাই বাপের মত ব্যবসায় ছেলে সাথ দিক বাবার। কিন্তু ঐ বই পড়ে, সমাজ সেবা করে দিন কাটায়, ব্যবসার ধারে কাছে দেখা যায় না তাকে। আর শখের গোয়েন্দা গিরি—কয়েকটা রহস্যের সমাধান ও করেছে, তাতেই তার বেশ কেটে যায় সময়, সাথে অবশ্যই লেজ থাকা চাই—মানে শিশির।  এখন গরমকাল—কি করবে ভেবে ভেবে যখন কলকাতায় প্রাণ ওষ্ঠাগত—তখন ই কমলাক্ষ বাবু মানে হিরন্ময় এর বাবা বলেন– পুরী যেতে পারো তোমরা, ওখানে অত গরম নেই, আসলে আমার বন্ধু অনিল বসু তোমাদের কথা জিজ্ঞাসা করছিল। কিছু সমস্যা হয়েছে, সমাধান চাই।  তাঁকে ফোন করেই ভুবনেশ্বরে এসেছে — বিজু পট্টনায়ক আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে  দুজনে নামে ,গাড়ি নিয়ে হাজির ওনাদের ড্রাইভার রসরাজ মহাপাত্র। বাইরে বেশ গরম, শিশির বলল— কোথা বা- বা ঠান্ডা! তবে যত শহর ছাড়ালো সত্যি বেশ ভালো লাগছে দুজনের।  পুরী পৌঁছে গেল তাড়াতাড়ি ,ড্রাইভার বলল— জায়গাটার নাম মুকুন্দ মিশ্র নগর–যদিও বেশ দূর পুরীর জগন্নাথ মন্দির ও সমুদ্র থেকে। তাতে কোনো আপত্তি নেই, বেশ শান্ত জায়গা, গাছগাছালি ভরা। সত্যি ই  গরম অত লাগছে না। গাড়ি এসে পৌঁছালো একটা বড় সেকেলে বাড়ির সামনে,বাড়ির নাম মোতি ভবন। একটা সাত আট বছরের বাচ্চাকে দেখতে পেল –দৌড়ে এল, আপনারা কলকাতা থেকে আসছেন তাই না, দাদু বলেছে আপনাদের কথা। শিশির বাচ্চাটার মাথায় হাত দিয়ে তার চুলে আদর মাখালো, জিজ্ঞেস করলো —তোমার নাম কি?  ভুমলা —-ভালো নাম অভ্র বসু। তারপর একটু মিচকে হেসে বলল ,আরো একটা নাম আছে,মা ডাকে পুচকুন। সোজা সিঁড়ি বেয়ে সামনেই  বিশাল ড্রয়িং রুম আধুনিক আসবাবে সাজানো। পাশাপাশি পর পর ঘর—-টানা বারান্দা, বাড়িটা পুরানো দিনের মোটা মোটা থাম ওয়ালা ।বাগান ,বাড়ি মিলে বিশাল চৌহদ্দি। প্রথমে মনে হলো শিশিরের দোতলা,পরে দেখলো না ,তিন তলাতেও ঘর আছে খুব বড় একটা, আর ঠাকুর ঘর।রাধা কৃষ্ণ বিগ্রহ, মহাপ্রভুর ছবি —তিনি তো বিশ্বের প্রভু,এ স্থান জগন্নাথ ক্ষেত্র । পুরোহিত আসেন, নিত্য পূজা হয়।

এখানে দেখলো দুই বন্ধু অনিল বসুকে, পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে গেলে হাত ধরে ফেললেন, আসতে কোনো অসুবিধা হয় নি তো, বাবা মা ভালো আছেন? কথা বলতে বলতেই এল আম পোড়ার শরবত আর মিষ্টি। আম পোড়ার শরবত খেয়ে প্রাণ যেন ঠান্ডা হলো। দুপুরে খাওয়া টাও একটুবেশি হয়ে গেল।  তিন  চার রকমের মাছ, সামনে দাঁড়িয়ে খাওয়ালেন শর্মিলা বৌদি। ভারি মিষ্টি দেখতে বৌদি–মাজা রঙ,  ছিপছিপে গড়ন, নাক আর চিবুকে যেন দৃঢ়তার ছাপ। সামান্য গয়না ,অল্প প্রসাধন– পরনেএকটা হলুদ কালো তাঁতের শাড়ি—তাতেই অসাধারণ। পরে হিরু বলল— এগুলো সম্বলপুরী তাঁত , যে জায়গায় যায় দু বন্ধু ,সেখানকার শিল্প সাহিত্য, চিত্রকলা, গান বাজনা সম্বন্ধে জানতে বুঝতে চেষ্টা করে। উড়িষায় পটচিত্র বিখ্যাত, ইচ্ছে আছে  দেখতে যাওয়ার।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর ডাক পড়ল দুই বন্ধুর অনিল বাবুর শোবার ঘরে দোতলায়, একজন বুড়ো মানুষ ওদের নিয়ে গেল—নাম গোকুল। বড় খোলামেলা ঘর—বড় বড় জানলায় পর্দা লাগানো, তবে বাড়ির সামনে দিক এটা, ওদের থাকার ব্যবস্থা যে ঘরে হয়েছে সেটা  দোতলায় বাড়ির পিছন দিক , তবে জানলা দিয়ে গাছপালা আর দূরের খোলা মাঠ দেখা যায়। মনোরম লাগে, বিশেষত শহরে র ঘিঞ্জি এলাকা ছেড়ে এ বেশ ফাঁকা ফাঁকা ,মনে হয় প্রকৃতিকে ছুঁয়ে আছে। ঘরের মাঝে বড় পালঙ্ক ,তার  পাশেই নিচু বেডসাইড টেবিলে একটা বড় কাঠের পুতুল বসানো ইয়া গোঁফ ওয়ালা  । বিছানায় বসে আছেন কাকাবাবু,  ঘরের একদিকেএকটা কাঠের আলমারি ,এক সাইডে বড় বুক সেল্ফ- বই ঠাসা ,বেশির ভাগ ই রচনাবলী। বঙ্কিম, শরৎ,রবীন্দ্র রচনাবলীর পুরো সেট। সোফার উপর এসে বসলো দুই বন্ধু।  সামনের দেওয়ালে একটা ডেট ক্যালেন্ডার আর দেওয়াল ঘড়ি। মুখ খুললেন অনিল বাবু—আমাদের একটা বহু পুরানো-“গজমোতি মালা” গায়েব হয়ে গেছে দিন পনেরো আগে। সেজন্যই তোমাদের ডেকে পাঠিয়েছি। এই মালাটা তোমাদের খুঁজে দিতে হবে। বিশেষ মালা মনে হচ্ছে এটা হিরন্ময় বললো, হ্যাঁ আমাদের বংশের সৌভাগ্য জুড়ে আছে এর সাথে। আমার দাদু পেয়েছিলেন এক সন্নাসীর কাছ থেকে।,হাতির দাঁতের মালা তার উপর কয়েকটা মুক্তো গাঁথা আছে। শোনা যায় কোনো রাজা এ মালা দিয়েছিলেন সন্নাসীকে কে দান হিসাবে।  আমার দাদু  এ মালা পেয়েছিলেন হরিদ্বারে কুম্ভ মেলায় গিয়ে। প্রচন্ড ভিড় হয় জানো কুম্ভমেলার সময়। হুড়োহুড়ি তে এক সন্নাসী গুরুতর অসুস্থ হয়েছিলেন, আমার দাদু তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করেছিলেন।  খুব সেবা করেছিলেন। ভালো হয়ে সেই সন্নাসী চলে যাওয়ার আগে এই মালা দাদুকে দিয়ে যান। বলেছিলেন —এটা তোমার সৌভাগ্য  আনবে।  তখন থেকেই  আমাদের বংশের ভাগ্য এর সাথে জুড়ে যায়, দাদুর সামান্য অবস্থা থেকে ব্যবসা করে বিশাল সম্পত্তি তৈরি করেন। এ রকম আমাদের আরো দুটো বাড়ি আছে কটকে, তবে সেগুলো ভাড়া দেওয়া আছে।  আমাদের দুর্বলতা বল ,বিশ্বাস বল ,আছে এই মালার উপর। শুধু মনে হচ্ছে কোনো বড় ক্ষতি হয়ে যাবে এবার। ব্যবসার হাল তো জানো, এই ভালো এই খারাপ–পর পর কতকগুলো ঘূর্ণিঝড় এ অনেক লোকসান হয়েছে পুরীতে।  এখন এই মালা গায়েব হয়ে গেল– খুব চিন্তায় আছি।  হিরন্ময় বলল— তা হলে আপনি পুলিশে খবর দেন নি কেন?  আমি ইচ্ছে করেই দিইনি, অকারণে সকল কে বিরক্ত করবে পুলিশ।

আপনি খুলে বলুন– যেদিন এই মালা গায়েব হয়েছে সে দিনের কথা। সেদিন বাড়িতে একটা ছোট অনুষ্ঠান ছিল সন্ধ্যায়, আমার নাতি ভুমলার জন্মদিনের । শিশির বলল— খুব প্রিয় নাতি আপনার জানি,-হাসলেন অনিল কাকাবাবু। ভুমলার মা বাবা কে দেখলে—আমার ভাইপো, ভাইপো বউ —অনিকেত আর শর্মিলা। আমার কোনো সন্তান নেই। আমার স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে বহুদিন। ভাইপো আর ভাগনাকে আমি নিজের কাছে রেখেই মানুষ করেছি ,ভাইপোর বিয়ে দিয়েছি, ভুমলা ওদের সন্তান। আমার প্রিয় নাতি। আর ভাগনা—কি নাম, তিনি কোথায়? ভাগনা বাসব— ও এখন কোনার্ক গেছে স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে, ও শিক্ষক।  কাল বা পরশু এসে যাবে। আর কে কে থাকে এ বাড়িতে? ঐ তো অনিকেত শর্মিলা, বাসব, গোকুল কে দেখলে, ও বহু পুরানো লোক। আর ড্রাইভার রসরাজ, দুটি মেয়ে ঘরের কাজে ,রান্নায় বৌমাকে সাহায্য করে—রাধা আর বিভা। তবে ওরা রাতে বাড়ি চলে যায়। রসরাজ আর গোকুল নিচের তলায় থাকে । আর একজন মাঝে মাঝে আসে খবর পাই, সে রসরাজের ছেলে, অকাল কুষ্মাণ্ড —রঘু তার নাম, হেন নেশা নেই যে করে না। বাপের উপর জুলুম করে টাকা কড়ি নেয়।  আমাকে ভয় পায়, তাই আমি থাকলে এখানে আসে না। অনেক রাতে আসে মাঝে মাঝে। হিরন্ময় আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো—আপনার কি রঘুকে সন্দেহ হয়? কি জানি! বুঝতে পারছি না, তবে রঘুকে কখনো দোতলায় উঠতে দেখিনি।
হিরন্ময় বলল— কাকাবাবু সেদিনের পার্টিতে কে কে ছিলেন একটু বলবেন ?ঐ তো বাড়ির কজন, আর বাইরের বলতে বিনয় চৌধুরী তাঁর স্ত্রী ,বাসবের স্কুলের একজন শিক্ষক লিঙ্গরাজ আচার্য আর তাঁর মেয়ে মধুজা। আর ভুমলার ছোট ছোট দুটি বন্ধু এই কয়জন। কেক কাটা হলো, বাচ্চারা হৈ হৈ করতে–খাওয়া দাওয়া সারতে রাত হয়ে গেল। আমি সকলকে জানিয়ে আমার ঘরে চলে এলাম, বয়স বাড়ছে, বেশি হৈ হৈ ভালো লাগে না। তারপর কখন দেখলেন  মালা গায়েব?  সেদিন রাতে ঘরে এসে প্রথম দেখলাম বিছানায় বালিশ টা এলোমেলো, কখনো তো এমন হয় না! বালিশের নিচে সেফের চাবি নেই, মনে আশঙ্কা হলো, অনেকগুলো টাকা আছে ঘরে, চাবিটা খুঁজে পেলাম পালঙ্কের নিচে। তাড়াতাড়ি সেফ খুললাম, দেখি টাকার বান্ডিল যেমন ছিল তেমন আছে। তখন মালার দিকে নজর দিলাম— বটুয়া পড়ে আছে, মালা গায়েব। সাথে সাথে সকল কে ডাকলাম, বাইরের নিমন্ত্রিত রা সকলে চলে গেছেন তখন। শুধু বাড়ির কজন, সকলে খোঁজাখুঁজি শুরু করলো, কিন্তু  মালা আর পাওয়া গেল না।

তখন তোমাদের কথা মনে পড়ল, কলকাতায় ফোন করলাম,  অনেক আশা করে আছি, তোমরাই পারবে, একটু চেষ্টা করো। আমরা চেষ্টার ত্রুটি রাখব না কাকাবাবু, বাকি ভগবান জানেন।  তারপর বলল— কাকাবাবু সেফটা একবার দেখবো । অনিল বাবু বালিশের নিচ থেকে চাবি নিয়ে সামনের দেওয়ালের ক্যালেন্ডার টা সরালেন। একটা চৌকো সেফের দরজা দেখা গেল। সেফটা দেওয়ালে গাঁথা ।প্রথমেই দেখা গেল পর পর টাকার বান্ডিল রাখা। আর একটা সবুজ থলি। হিরু বলল— ওটার মধ্যে ই কি মালাটা ছিল?  অনিলবাবু বটুয়াটা বের করে হিরন্ময়ের হাতে দিলেন। শিশির দেখলো হিরু বটুয়াটা হাতে নিয়ে চোখ কুঁচকে কি ভাবলো যেন। তারপর ওটা অনিল বাবুর হাতে ফেরত দিল। হিরন্ময় ঘরে আসতে আসতে বলল— শিশির আমাদের প্রথম কাজ বিনয় চৌধুরী র সাথে দেখা করা, আর বাসব বাবুর স্কুলে র শিক্ষক লিঙ্গরাজ আচার্য আর মধুজা দেবীর সাথে আলাপ করা। কাজ হবে বলছিস্? দেখা যাক, তবে যেহেতু এনারা বাইরের তাই দেখা তো করতেই হবে, যদি কিছু জানা যায়। বিকেলে দুজনে একটা টোটো নিয়ে সোজা স্বর্গদ্বার । অনিল বাবু বাড়ির গাড়ি ঘোরার জন্য  নিতে বলেছিলেন ,তবে এতে কোথা যাচ্ছো, কেন যাচ্ছে সব জানা হয়ে যাবে, তাই হিরন্ময় রাজি নয়। আবার রসরাজের ছেলের হদিশ ও তো করতে হবে— কে জানে, কেউ হয়তো ওকে কোনোভাবে কাজে লাগিয়েছে এই চুরি করতে! স্বর্গদ্বারের সামনে আসতেই ঢেউ এর গুম গুম আওয়াজ —আছড়ে পড়ছে বালিয়াড়িতে , কত মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। পা আপনি সে দিকে চলে যায়—শিশির এগোতেই হিরু টান দেয় হাতে—এখন নয়, আগে বিনয় চৌধুরী। ওরা চৌধুরী এম্পোরিয়াম খুঁজতে খুজতে অনেকটা চলে এলো, জায়গাটা ফাঁকা হয়ে এলো, মানে স্বর্গদ্বার থেকে অনেকটা চলে এসেছে। এটা পুরীর পুরানো এলাকা, সমুদ্রের ধারের হোটেল গুলো পুরানো, দোকানগুলোয় সব বিবর্ণ, দেওয়ালে কালের প্রলেপ পড়েছে। একটা পুরানো বিবর্ণ দোকানের সামনে লেখা দেখলো চৌধুরী এম্পোরিয়াম কাপড়ের দোকান। এক বয়স্ক মানুষ দোকানের মধ্যে পেপার পড়ছে, বিনয় চৌধুরী র কথা জিজ্ঞাসা করতে বললেন— বাবু এখনো আসেন নি, তবে এসে পড়বেন এবার, তখন ই বললেন— ঐ তো আসছেন! দুই বন্ধু দেখলো এক বিরলকেশ প্রৌঢ় ভদ্রলোক ঝুঁকে ঝুঁকে আসছেন। পরনে ধুতি আর শার্ট—সামনে আসতেই হিরু, শিশির হাতজোড় করে বলল— আমরা আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি। ভিতরে আসতে বললেন  ভদ্রলোক, গদিতেই বসা হলো। সব খুলে বলল হিরন্ময়, তারা মোতিভবনের অতিথি—সেটাও বলে দিল, ভদ্রলোক দপ করে জ্বলে উঠলেন, হ্যাঁ আমরা নিমন্ত্রিত ছিলাম সেদিন, অনিল বাবুর সাথে অনেক দিনের বন্ধুত্ব, তা বলে কি মালা চুরি করেছি? হিরন্ময় বলল— তা নয়, আমি জানতে চাই সেদিন এমন কিছু দেখেছিলেন, বা কেউ এমন কিছু বলেছিল যা আপনার খটকা লেগেছিল?  আর একটা কথা–এ মালা আপনি দেখেছিলেন কখনো? নাকি শুধু নাম ই শুনেছিলেন? ভদ্রলোক এবার শান্ত হলেন যেন। বললেন— না সেরকম কিছু দেখিনি, তবে ঐ মধুজা ম্যাডাম আর ঐ বাসব অনেকক্ষণ গায়েব ছিল  কেক কাটার পর লক্ষ্য করেছি। হ্যাঁ ঐ মালা আমি একবার দেখেছিলাম, অনিলবাবুই দেখিয়েছিলেন। ওরা  দুই বন্ধু  এবার চুপচাপ সেখান থেকে উঠে এলো। ভদ্রলোক কেন জানি গম্ভীর মুখে  চিন্তান্বিত হয়েবসে রইলেন। আসার পথে স্বর্গদ্বারে ওরা  অনিল বাবুদেরমোতি এম্পোরিয়াম দেখলো, বিশাল ঝাঁ চকচকে দোকান,অনেক কর্মচারী কাজ করছে, তবে বাইরে থেকে ওরা দেখেই চলে এলো সমুদ্রের ধারে, ফাঁকা জায়গা দেখে বালিতে বসে ঢেউ গুনতে লাগল।

পরদিন রাতে খাওয়ার টেবিলে ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত  একজন নূতন মানুষ দেখলো দুই বন্ধু, অনিকেত বাবু পরিচয় করিয়ে দিলেন আমার ভাই বাসব ঘোষ, যথারীতি খাওয়া দাওয়া চলছে, শর্মিলা বৌদি বকে চলেছেন ভুমলাকে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে খায় সে, এভাবে না— ঠিককরে খাও। এমন সময় বাসব বললেন— ভুমলা তোমার’ বিক্রম সিং’ এর কি খবর? ভুমলা হেসে বলল— দাদুকে পাহারা দেওয়া এখন ওর কাজ। সকলে হাসতে লাগল, বাসব শিশির কে বললেন– বুঝলেন না তো!  একটা কাঠের পুতুল আছে ভুমলার, আমাদের ফ্যাক্টরি তে তৈরি। ওর নাম বিক্রম সিং—শর্মিলা হেসে বললেন— বাবা! সে নিয়ে কী কান্না সে রাতে!স্বপ্ন দেখেছে দাদুকে কে নাকি মারতে এসেছে, সেই থেকে বিক্রম সিং—দাদুর বিছানার পাশে শোভা পায়। আবার তিনতলায় আমার ঘরে আছে পক্ষীরাজ—হিরন্ময় হেসে বলল নিশ্চয় ঘোড়া! হ্যাঁ —বাসব বাবু বললেন— এখন অর্ডার হয়েছে একটা বিশাল  ট্রয়ের ঘোড়া,যাতে কাকাই আর ভাইপো তার পেটের ভিতর লুকতে পারে। শর্মিলা বললেন— বড় হচ্ছে যত, সব আজগুবি কাণ্ডকারখানা।  হিরন্ময় বুঝলো ছেলেটা খুব ভাবুক। সেদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে শিশির দেখলো পাশে হিরন্ময় নেই, ভাবলো ওয়াশরুমে, অনেকক্ষণ কেটে গেলে দেখল না— ওয়াশরুমে তো আলো নেভানো,  উঠে  বারান্দায় এসে দাঁড়ালো, চারিদিক শান্ত— অন্ধকার রাত আকাশে অগণন নক্ষত্র রাজি পাহারায়। হঠাৎ কারো জড়ানো আওয়াজ কানে এলো–ছাড়ো আমাকে, কেন এ সব খেয়ে রোজ রাতে সিন ক্রিয়েট করো? ছেলে বড় হচ্ছে—জেগে যাবে। জানুক সব ছেলে, তাতে আমার কি?  একটা কাজ ও যদি ঠিকঠাক করতে পারো। দুর করে দেব একদিন, ঘরের দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ এলো। মানে অনিকেত বাবু আর শর্মিলা বৌদি। নাহ –হিরন্ময় তো এখনো ফিরল না! কোথা গেল! সকালে ঘুম ভেঙে দেখলো পাশে হিরু ঘুমাচ্ছে, কখন ফিরল কে জানে!
সেরাতের নৈশ অভিযান সম্বন্ধে পরে বলেছিল হিরন্ময়, রাতে সে আওয়াজ শুনে নিচে নেমে  এসেছিল। আওয়াজ টা এসেছিল রসরাজের কামরা থেকে,বুঝলো সে কাউকে বকাবকি করছে, কেন এসেছিস্  ? তোকে মানা করেছি এ বাড়ি আসতে ।কেন আসবো না—কে খাবে ওই বুড়োর অত সম্পত্তি? তবুও বুড়োর টাকার খাঁই গেল না, আমি একলাখ টাকা চাইলাম  দিল না? তুই ওড়াবি বলে? আমিই তো মানা করেছি দিতে। তবে আর কি—আমাকে চোর ভাবে, এরপর তোমাকে ভাববে, তখন বেশ হবে। এরপরে রঘু বেরিয়ে যায়। আমিও ওর পিছন পিছন ওর ঠেকে যাই, মৌজ করে সব গাঁজা টানছে ।ভাব করে ওর পাশেই বসে কথা শুরু করে দিই। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম মালার কথা, বলল— বেশ হয়েছে !স্যান্ডরোজ ,স্যান্ডরোজ—দুবার বলল , –বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো। আর কিছু বের করতে পারলাম না ওর থেকে, নেশায় বুঁদ ।

একদিন রসরাজের সাথে ওরা রঘুরাজপুর আর পিপিলি  দেখে এলো, অপূর্ব শিল্পকর্মের গ্রাম, মন ভরে যায়, শুনলো বেশ বিদেশী মুদ্রা আসে এর থেকে, সরকার সাহায্য করে এই সব শিল্পীদের। গাড়িতে আসতে আসতে ওরা রঘু র কথা জিজ্ঞাসা করলো, রসরাজ বলল— ছেলেটা বখে গেছে দাদা, লজ্জায় আমি মুখ দেখাতে পারি না, আবার একলাখ টাকা চেয়েছিল  বাবুর কাছে টোটো কিনবে,আমি মানা করে দিয়েছি, ও টাকাও নেশায় ওড়াবে। আমার উপর খুব রাগ সেই থেকে। ফেরার পথে ওরা সমুদ্রের ধারে এসে গাড়ি ছেড়ে দিল, কত মানুষ দুপাশে ঘোরাঘুরি করছে, ওরা অনেকটা হেঁটে এসে ফাঁকা জায়গা দেখে বসে পড়ল, জেলেদের পাড়া মনে হলো, জাল ঝাড়ছে জেলেরা, তারা মাছ, জেলি মাছ ওরা সমুদ্রে ভাসিয়ে দিচ্ছে। এরপরে বোধহয় মাছ ধরতে যাবে। আর বিষন্ন বালিয়াড়ি যেন আড়মোড়া  ভাঙছে মনে হলো এখানে, হঠাৎ দেখলো চেনা মুখ, বাসব আর এক মহিলা হেঁটে ওদের দিকেই আসছেন, দেখতে পেয়ে হাত নাড়লেন বাসব। কাছে এসে ধুপকরে বালিতে বসে পড়লেন দুজনে,  এই মধুজা –বলে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন বাসব, বেশ মেয়ে মধুজা,  শান্ত সৌম্য, ভারি মিষ্টি, দেখে দু বন্ধুর বেশ লাগল ।শিশিরকে ইশারা করলো হিরু—শিশির বাসব কে বলল— চলুন দেখি চা পাওয়া যায় কিনা এখানে? দুজনে দূরে চলে যেতেই হিরন্ময় মধুজাকে জিজ্ঞেস করলো–ম্যাডাম আপনি তো ভুমলার জন্মদিনে মোতিভবনে উপস্থিত ছিলেন, সেদিন অস্বাভাবিক কিছু লেগেছিল কি? ও আপনি সেই মালা চুরির দিনের কথা বললেন তো! না আমরা খুব আনন্দ করছিলাম, তবে শর্মিলা বৌদি একসময় ছিলেন না অনেকক্ষণ, কেক কাটতে তখন ও বাকি, তারপর এলেন কিন্তু আচরণ যেন ঠিক ছিল না, বার বার  রুমাল দিয়ে ঘাম মুছছিলেন। আমি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম–বৌদি শরীর ঠিক আছে তো? রুক্ষস্বরে বললেন— আমার আবার কি হবে! আমার খারাপ লাগল, তবে আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। এমনিতে মানুষ টা খুব হাসিখুশি। তবে সেদিন ডিস্টার্ব্ড লাগছিল।

পরের সন্ধ্যায় হিরু আবার গায়েব, অনেক রাতে ফিরেছে, জিজ্ঞেস করতে বলল— স্যান্ড রোজ ক্লাবে গিয়েছিল,অভিজাতদের ক্লাব, টেবিলে টেবিলে তাস চলছে, অবশ্যই জুয়া, হাতে হাতে ঘুরছে ড্রিঙ্কস । পরের দিন জিজ্ঞেস করলো শিশির কিছু পেলি ওখানে?  ধীরে বন্ধু! তোর ব্যাপার তো কিছুই বুঝতে পারছি না। পারবি,  সম্ভবত কাল ই যবনিকা উঠবে। ঝেড়ে কাশ না একটু! তবে শোন মালা এখনো এই মোতিভবনেই আছে বলে আমার বিশ্বাস  ।এক কাজ কর, অনিলবাবুর ব্যবসা পত্তরের খোঁজ নে তো, তুই আবার কোথা যাস্? ভুমলা গল্প শোনাবে বলেছে—আজকের দিন, ভুমলার নামে। হাসতে হাসতে চলে গেল। শিশির চলল অনিল বাবুর সাথে গল্প করতে—শাড়ির ব্যবসা, আর কাঠের খেলনার ব্যবসার হাল হকিকত জানতে, বোধহয় চাকরি ছেড়ে এই ব্যবসা শুরু করা যায় কিনা ভাবতে থাকল।
পরের দিন বিকেলে হিরন্ময় বাড়ির সকলকে হলঘরে উপস্থিত হতে বলল—। কাজের মেয়েদুটোকে বিকেলেই ছুটি দিয়ে দেওয়া হলো। আর রসরাজ আর গোকুল বাদ, গোকুল কে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছে হিরু ভুমলার কাছে থাকার। হিরন্ময় আর শিশির আগেই এসে গেছে, অনিল বাবু এলেন, তারপর বাসব ঢুকলো, অনিকেত বাবু এলেন, সবার শেষে শর্মিলা বৌদি। শিশির দেখলো শর্মিলা বৌদির চোখ লাল, কাঁদছিলেন নাকি! প্রথমে অনিকেতবাবুকে হিরন্ময় জিজ্ঞাসা করলো—আপনি গোবিন্দ লাল পন্ডাকে চেনেন অনিকেতবাবুকে? তিনি বললেন— না তো! কে গোবিন্দলাল? আচ্ছা তবে—জি এল কে চেনেন স্যান্ডরোজ ক্লাবের? মুখ চুণ হয়ে গেল অনিকেতবাবুর। এই জি এল স্যান্ডরোজ ক্লাবের মালিকের শ্যালক। পঞ্চাশ লাখ টাকা ধার আছে আপনার তার কাছে, ভুলে গেলেন? ফয়সলা হয়েছিল– এই গজমোতি মালা দিয়ে সে ধার শোধ হবে, তাই না? মাথা তুলতে পারছেন না অনিকেত বাবু, কারণ সকলে অবাক হয়ে তাঁকে দেখছেন। অনিলবাবু বললেন— অনু কি বলছে হিরন্ময়! এ কথা সত্যি? এবার শর্মিলা দেবী পার্টির দিন একফাঁকে সেজন্য আপনি সেফ খুলেছিলেন? শর্মিলার চোখে জল- বললেন— বিশ্বাস করুন কাকাবাবু, আমাকে ও বাধ্য করেছিল এই কাজ করতে, না হলে আমাকে ডিভোর্স দেবে ভয় দেখিয়েছিল। তবে আমি সেফ খুলে সে মালা পাইনি, শুধু সবুজ বটুয়াটা পড়ে ছিল। হিরন্ময় বলল— তা আমি জানি, মালা তার আগেই গায়েব হয়েছিল। অনিল বাবু বললেন— হিরন্ময় তুমি কি করে জানলে বৌমা সেফ খুলেছিল? হিরন্ময় বলল— ওনার নখের লাল নেলপালিশ বটুয়ার গায়ে লেগেছিল, তখন ই বুঝি উনিও এ সেফে হাত দিয়েছিলেন। তারপরে বাসব বললেন— আপনি আমার দিকে তাকাচ্ছেন কেন?  আমি এ সবের বিন্দুবিসর্গ জানি না। হিরন্ময় বলল— জানি, আপনি তো আমার চোখ খুলে দিয়েছিলেন, যখন বলেছিলেন বুমলা ট্রয়ের ঘোড়া চেয়েছে যাতে কাকাই আর বুমলা লুকোতে পারে। তখন ই মাথা খুলে গেল আমার। ডাকলেন গোকুল ভুমলা কে নিয়ে এসো, আস্তে আস্তে বুমলা গোকুলের সাথে হল ঘরে এসে উপস্থিত হলো, হাতে সেই কাঠের পুতুল—বিক্রম সিং। সে এসে সেই পুতুল টা হিরন্ময় এর হাতে দিল, বাকিরা ব্যাপার টা কিছু বুঝতে পারছেন না।

হিরন্ময় পুতুল টা হাতে নিয়ে মাথাটা ঘুরিয়ে খুলে ফেলল, তারপর ঝাঁকিয়ে ওর ভিতর থেকে বের করলো সেই গজমোতি মালা—যা উজ্জ্বল আলোয় ঝকমক করছে। আনন্দে অনিলবাবুর চোখে জল এসে গেল– ভুমলা বলল— রাতে মা বাপির কথা শুনে নিয়েছিলাম, বাপি মাকে জোর করছিল, যদি মালাটা না বের করে আনে সেফ থেকে, মাকে বাড়িছাড়া করবে। আমি কি করে থাকব মা ছাড়া, আর দাদুর খুব প্রিয় জিনিস এটা— যদিও কাকাই বলেছে সৌভাগ্য টৌভাগ্য নয়, মালাটা আ্যন্টিক তাই অমূল্য। আগের দিন ই দাদু যখন ঘরে ছিল না, আমি মালা বের করে বিক্রম সিং এর মধ্যে লুকিয়ে দাদুর চোখের সামনেই রেখেছিলাম। বেঁচে গেল– আমি ঠিক করেছি না দাদু? দাদু নাতিকে জড়িয়ে ধরে বললেন— একদম ঠিক কাজ করেছো দাদু। শুধু এই বড় গুলোই যত বেঠিক কাজ করে। পরের দিন হিরন্ময় আর শিশির পুরী ছাড়ার জন্য তৈরি হলো। বেশ কিছু তসর সিল্কের জামাকাপড়, ঘর সাজানোর জিনিস আর মোটা টাকার একটা চেক দিলেন অনিলবাবু। আর নিমন্ত্রণ করে রাখলেন– আগামী শীতেই বাসব আর মধুজার বিয়ে দেবেন, ফোন করবেন, কার্ড পাঠাবেন, আসা চাই দুই বন্ধুর।  ওরা শুনলো সেই রাতেই অনিকেত বাবু আর শর্মিলা দেবী পায়ে ধরে মাফ চেয়েছেন, এবং অনিল বাবু দুজনকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, শুধু তাই নয় ঐ ধারের টাকাও শোধ করার ব্যবস্থা করে দেবেন বলেছেন। হিরন্ময় শুধু একটা অনুরোধ করেছেন অনিল বাবুর কাছে ,রঘুকে যেন টোটো কেনার জন্য এক লাখ টাকা দেন, ছেলেটা শুধরে যাবে। শুনে রসরাজ হিরন্ময় এর হাত ধরে চোখের জল ফেলেছে।

গজমোতি রহস্য্ গল্প – সমাপ্তি

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!