কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

অঙ্গীকার

অঙ্গীকার ছোটগল্প – শম্পা শম্পি চক্রবর্তী

ছোট্ট গ্রাম হরিনারায়ণপুর। গ্রামের গা ঘেঁষে বয়ে চলা নদী নাম পারুল, আর তারই খুব কাছে রাধাগোবিন্দের মন্দির। বছর কুড়ি আগে দুই কিশোর কিশোরী সবার অলক্ষ্যে অঙ্গীকার করেছিল “–আমরা সারাজীবন একে অপরের হয়ে থাকবো কোনো দিন কেউ কারোকে ছেড়ে যাবো না সাক্ষী থাকলেন রাধা গোবিন্দ।” সত্যই সেদিন রাধাগোবিন্দ ছাড়া তাদের অঙ্গীকারের সাক্ষী আর কেউ থাকলো না। 

     সেই কিশোরের নাম সত্যেন কিশোরীর নাম প্রতিমা। ক্রমে সত্যেন আর প্রতিমা বড় হয়ে যৌবনে পা দিলো। সত্যেনের বিয়ে ঠিক হলো পাশের গ্রাম হরিদেবপুরে। পাত্রীর নাম জয়া। প্রতিমা কে পুরোপুরি মন থেকে মুছে দিয়ে সত্যেন সময়মতো বিয়ে করে নিলো। কিন্তু প্রতিমা থেকে গেল অনুঢ়া। জীবনে একজনকেই সে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসে অঙ্গীকার বদ্ধ হয়েছে। আর সেই স্থানে কারোকে সে বসাতে পারবে না। মনকে হাজারো বুঝিয়ে সে ঈশ্বরের পায়ে নিজেকে সঁপে দিলো আজীবনের জন্য। 

           এদিকে সত্যেনের সাথে তার স্ত্রী জয়া’র গাঁটছড়া বেশি দিন স্থায়ী হয়না। হঠাৎ করে সাপের কামড়ে জয়া’র মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে সে রেখে যায় তার ছয় বছরের  ছেলে মুকুল কে। জয়ার মৃত্যু হলে সত্যেন আর বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চাইলো না কারণ একমাত্র ছেলে মুকুল কে বড় করবে সে নিজ হাতে। বিমাতা এনে তার হাতে ছেলে কে তুলে দিলে ছেলের যারপরনাই ক্ষতি হবে। তাই বিয়ে থেকে শত হস্তে দূরে থাকাই শ্রেয় মনে করলো। কিন্তু তার ইচ্ছা কে গুরুত্ব দিলেন না সত্যেনের মা পদ্মা দেবী। এক প্রকার জোর করে তিনি তাঁর ছেলে সত্যেনকে  দ্বিতীয় বার বিয়ে দিয়ে দিলেন গ্রামের মোড়ল অক্ষয় চাটুজ্যের মেয়ে রমা’র সাথে। আর সেই সময় থেকেই মুকুলের জীবনে বিমাতা এসে জুটলো।      

      রমা বয়সে সত্যেনের  চাইতে অনেকটাই ছোট।  সত্যেন যদি পঁয়ত্রিশ হয় তো রমা কুড়ি কী বাইশ। রমা সুন্দরী, এবং বলতে অসুবিধা নেই সত্যেনের মৃতা স্ত্রী জয়া’র থেকে অনেকটাই বেশি আর সেই কারণেই হোক বা পাশাপাশি ঘি আগুন একসাথে থাকার কারণেই হোক খুব তাড়াতাড়ি সত্যেন মৃতা স্ত্রী জয়া কে ভুলে গিয়ে রমা কে গভীর ভাবে আঁকড়ে ধরলো। তার কথাতেই সে চলতে শুরু করলো। আর তার পুরোপুরি প্রভাব সত্যেনের অজান্তেই পড়ল ছোট্ট মুকুলের ওপর। মুকুল কে রমা মোটেও সহ্য করতে পারে না। দিনরাত্রি তাকে নানা কারণে বকাঝকা করার সাথে সাথে মারধরও করে।‌

    মুকুলের ওপর এমন দুর্ব্যবহার মোটেও পছন্দ করতো না প্রতিবেশী গোঁসাই খুড়োর মেয়ে প্রতিমা। এর পেছনে প্রধান কারণ দুটি, প্রতিমা সত্যেনের প্রেমিকা ছিল এক সময় তাই সত্যেনের সন্তানের প্রতি তার অপত্য স্নেহ জন্ম নিয়েছিল,এ বাদ দিয়ে আরো একটি কারণ সত্যেনের প্রথম স্ত্রী জয়া ও প্রতিমা একে অপরকে সখী বলে ডাকতো। ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল অটুট তাই হঠাৎ করে জয়া’র মৃত্যু খুব কষ্ট দেয় প্রতিমাকে আর ছোট্ট মুকুলের ওপর প্রতিমার ভালোবাসা জন্ম নেয় এবং তা প্রগাঢ় ।‌ তাই মুকুলের বিমাতা রমা’র মুকুলের ওপর অত্যাচার কিছুতেই সে মেনে নিতে পারে না । কিন্তু সে নিরুপায়। অপরের সন্তানের প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা দেখানো শোভনীয়ও নয়। তবু সে যতোটা পারতো মুকুলকে নিজের কাছে রাখার চেষ্টা করতো। আর তাতে মনে মনে সত্যেনের মা পদ্মা দেবীও খুশী হতেন কারণ যে মা মরা নাতিটিকে মানুষ করার জন্য তিনি ছেলেকে দ্বিতীয় বার বিয়ে দিয়েছিলেন তাতে দেখলেন নাতির কষ্টের সীমা নেই। তার ওপর অত্যাচার বৃদ্ধার সহ্যের বাইরে। এই অবস্থায় প্রতিমার তাঁর নাতীর প্রতি অগাধ স্নেহ তাঁকে মনে মনে আনন্দ দেয় যে আর যাইহোক মা মড়া নাতীটি তার মা কে হারিয়েও মায়ের ন্যায় একজন মাসি পেয়েছে যে তাকে জীবন দিয়ে আগলে রাখবে, সাথে সাথে অনুশোচনা ও হয় একদিন এই প্রতিমাকেই নিজের একমাত্র ছেলের বউ করতে রাজি না হওয়ায় জন্য।  হয়তো তারই পাপ তাকে বহন করতে গিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করছে ওই বালক মুকুল । চোখের জল ফ্যালেন পদ্মা দেবী নিজের অপরাধের জন্য, ভাবতে থাকেন জীবনে কতো বড় ভুল করেছেন রমা’র মতো একটি অহংকারী, বদমেজাজি মেয়েকে ছেলের দ্বিতীয় পক্ষের বউ করে এনে। এর চাইতে প্রতিমাকেই তো আনতে পারতেন ছেলের প্রথম বউ মারা যাওয়ার পর। আনার সুযোগও দিয়ে ছিলেন ঈশ্বর কিন্তু তিনি ঈশ্বরের ইজ্ঞিত কে উপেক্ষা করেছেন। ফল তো ভোগ করতেই হবে। কিন্তু এখন ভেবে লাভ নেই। মুকুলের কপাল মন্দ। রমার মতো এমন একজন বিমাতা তার জুটলো, আর তাঁর কপালে এমন ছেলের বউ। 

       বছর দু’য়েক সময় পার হয়ে গেছে। মুকুল আট বছরের। একটু বড় হওয়ার কারণে তাকে রমা বকাঝকা করলেও আগের মতো মারধর করতে পারে না কারণ তার আগেই সে ছুটে চলে যায় তার ছোট মা প্রতিমা’র কাছে। প্রতিমা ও কোমরে কাপড় গুঁজে সেই মুহূর্তে ছুটে আসে রমার কাছে এবং বেশ উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলে ওঠে “— রমা বৌদি তোমার কি মনে এতোটুকু মায়াদয়া নেই যে ছোট্ট ছেলেটাকে এমনভাবে বকাঝকা করো। শুনে রাখো ওর মা না থাকুক আমি ওর ছোট মা আমার জীবন থাকতে আমি মুকুলের কিছু হতে দেবো না। ওর চোখের জল যাতে কোনো দিন মাটি ছুঁতে না পারে তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাবো আমি। ” রমাও দমবার পাত্রী নয় সে যতোটা চিৎকার করলে সমগ্র হরিনারায়ণপুর গ্রামের প্রত্যেকটি মানুষ শুনতে পায় ততোটা উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলে ওঠে “— মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। যা যা নিয়ে যা। ওই আপদ কে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখ। আমার হাড় জুড়োয়।” 

 “— হ্যাঁ হ্যাঁ আমার কাছেই রাখবো তোমার মুখ ঝামটা খাওয়ার জন্য ওকে ফেলে রেখে যাবো না। “

  প্রায় দিনই এমন ঘটনা ঘটে আর প্রতিমাও হুমকি দিয়ে যায় রমা কে যে মুকুল কে সে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখবে। 

   সেদিন দুপুর বেলাও এমনি হলো। সত্যেন কয়েকদিনের ছুটিতে বাড়ি থাকার কারণে ভাত ঘুম দিচ্ছিল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল অশ্রাব্য ভাষায় কিছু গালাগালি কানে যেতে। কান খাঁড়া করে শোনার চেষ্টা করলে বুঝতে অসুবিধা হলো না মুকুলের ওপর তার বিমাতার রাগের প্রকাশ। রমা বদমেজাজি, মুকুল কে সহ্য করতে পারে না এ সব কিছু সত্যেন জানলেও রমা যে তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি দেয় তা জানতো না। বিছানা ছেড়ে উঠে সে ঘরের বাইরে যেতে গিয়ে থমকালো, ছোট্ট মুকুল চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে আর তার বিমাতা তাকে গালাগালি দিয়েই চলেছে। দোষ কি তার?সে না কি ফুটবল খেলতে গিয়ে একটি আচারের শিশি যা রোদে দিয়েছিল কিছু সময় আগে রমা তা ভেঙে ফেলেছে। দোষ‌ সে করেছে কিন্তু এতোটাও দোষ করেনি যে তাকে এভাবে গালাগালি দেওয়া যায়। সত্যেন মনে মনে বড় অসহায় বোধ করলো। এবং মুকুলের জন্য তার বুকের ভেতরটা কেঁদে উঠলো। দীর্ঘশ্বাস পড়ল সত্যেনের। নিরুপায় সে পুনরায় ঘরের ভেতর ঢুকে আসতে গিয়ে  থমকালো  চির পরিচিত একজনের  কন্ঠস্বরে, যে রমার গালাগালি ‘র প্রত্ত্যুত্তর দিচ্ছে সমতালে বড় মিষ্টি ভাষায়। দরজার আড়াল থেকে ভালো করে দেখলো এবং চিনতে অসুবিধা হলো না এক সময়ের প্রেমিকা প্রতিমাকে। আগে প্রথম স্ত্রী জয়ার সাথে বন্ধুত্ব থাকার কারণে  এ বাড়িতে খুব আসতো যেতো প্রতিমা। এমন ও হয়েছে জয়া ছেলের জন্য দুধ আনতে গিয়েছে রান্না ঘরে সত্যেন পিছন থেকে প্রতিমা কে জয়া ভেবে তুমি সম্বোধন করে ফেলে লজ্জিত হয়ে চলে গিয়েছে বাইরের ঘরে। কারণ এক সময়ের প্রেমিকা হলেও তার বিয়ের পর প্রতিমার সাথে দূরত্ব বেড়েছে অনেকখানি। আজ সেই প্রতিমার তার ছেলে মুকুলের জন্য রমার সাথে মৌখিক লড়াইয়ে নেমেছে দেখে সত্যেন সত্যিই অবাক। তার ছেলে কে রক্ষা করার জন্য প্রতিমা ছুটে এসেছে! যদিও সে জানতো প্রতিমা মুকুল কে ভালোবাসে কিন্তু এতোটা ভালোবাসে তা সে ভাবতে পারেনি। নিজেকে ধিক্কার দিল। নিজের আত্মজ কে তার বিমাতার গালাগালি থেকে রক্ষা করতে সে অপারগ অথচ একজন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ, যার সাথে মুকুলের রক্তের সম্পর্কও নেই কেবল তার মৃতা বান্ধবী’র ছেলে বা প্রাক্তন প্রেমিকের ছেলে যে কারণেই হোক্ ভালোবেসে তাকে রক্ষা করতে কোমর বেঁধে ঝগড়ায় নেমেছে! আশ্চর্য। মনে মনে  প্রতিমাকে ধন্যবাদ জানালো সত্যেন। সাথে নিজের প্রতি ঘৃণা আর রমা’র প্রতি তীব্র ক্রোধ জাগলো তার। 

  রাত গভীর । রমা রোজ তার স্বামীটিকে বোঝায় অন্যত্র কোথাও বাড়ি ভাড়া করে তাকে এ বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য , কারণ সে আর মুকুলকে নিয়ে চলতে পারছে না। মুকুলের মতো দুষ্টু ছেলেকে মানুষ করা তার পক্ষে অসম্ভব। রাগ এতোটাই রমার মুকুলের প্রতি যে সে মুখ ফসকে এ কথাও সে রাতে বলে ফ্যালে “— তোমার আগের বৌটি তো সাপের কামড়ে মড়েছে সাথে সাথে তোমার ছেলেটিও মড়লো না কেন কে জানে তাহলে তো আমাকে এ অশান্তি সহ্য করতে হতো না। ” মাথায় রক্ত চড়ে গেল সত্যেনের। রমার সাথে বিয়ের পর থেকে এই দু’ বছর ধরে প্রতি রাতে সে তার মুকুলের দুষ্টুমি সম্পর্কে অনেক কিছু শুনে আসছে সাথে  রমা তার‌ জন্য মুকুলকে কি শাস্তি দিয়েছে তা রমার মুখে না শুনলেও মা পদ্মা দেবীর মুখে আড়ালে গিয়ে শুনেছে। কিন্তু তার জন্য রমাকে সে কোনো দিন কিছু বলেনি কারণ মনে করেছে বিমাতা হলেও রমা মুকুলকে একটু আধটু হয়তো ভালোবাসলেও বাসতে পারে। একজন নারী হয়ে কখনো একটি মাতৃহারা বালককে না ভালোবেসে থাকতে পারে না। মুকুলকে সে যা বকাঝকা করে তা তার স্নেহের’ই প্রকাশ। একজন মাও তার সন্তান কে বকাঝকা করে তা তো তার ভালোর জন্যই। সেইরূপ।

কিন্তু আজ এ কথা কি বললো রমা? সে নিজের সুখের জন্য মুকুলের মৃত্যু কামনা করছে ? এতো নারী নয় একজন ডাইনি। যার মনের মধ্যে সতীনের ছেলের প্রতি তীব্র ঘৃণা। এই ঘৃণা বাড়তে দেওয়া যায় না। সেই প্রথম চিৎকার করে ওঠে সত্যেন রমার ওপর, বলে ওঠে”– চুপ করো। তোমার স্পর্ধা তো কম নয় আমার সামনে আমার সন্তানের মৃত্যু কামনা করছো । তুমি কি মা ! তুমি একটা ডাইনি। যে নারী একটা নিষ্পাপ বালকের মৃত্যু কামনা করে নিজের সুখের জন্য সে কখনো নারী হতে পারে না। একজন নারী সে হলো মা, প্রত্যেক নারীর মধ্যে সুপ্ত মাতৃত্ব লুকিয়ে থাকে। নিজের হোক্ বা অন্যের সন্তান হোক্  সে সকলকেই নিজের সন্তানের মতো দ্যাখে অথচ তুমি অবলীলায় একটা বালকের মৃত্যু চাইছো এ জানা সত্ত্বেও যে সে তোমার স্বামী ‘র সন্তান। ছিঃ ছিঃ রমা।” 

  “— বেশ করেছি। আরো চাইবো। ওই আপদ নিজে না মড়লে আমি ওকে বিষ খাইয়ে মারবো। ও যতোদিন বাঁচবে আমি শান্তি পাবো না। তাই ওই অশান্তি কে আমি নিজে হাতে শেষ করে শান্তি আনবো আমার সংসারে। ” সত্যেন স্তম্ভিত। এ কী ঘৃণা রমার মনের মধ্যে জমা হয়ে আছে মুকুলের প্রতি! এতো রাগ! কিন্তু কেন? মুকুলের মতো শান্ত ছেলে কে ,যাকে আত্মীয় স্বজন তো বটে সাথে প্রতিবেশীরা ও সকলেই ভালোবাসে তার প্রতি এতো ঘৃণা কেন ? কী রহস্য আছে এর পেছনে ? মাথাটা ঠাণ্ডা করে সত্যেন জিজ্ঞাসা করে ‘– তোমার এতো ঘৃণা কেন মুকুলের প্রতি? ওর মতো শান্ত, বাধ্য ছেলেকে তোমার ভালো লাগেনা কেন? ও তোমার সতীনের ছেলে বলে ? কিন্তু তোমার সতীন তো বেঁচে নেই। তুমি অনায়াসে ওই বালকের মা হয়ে উঠতে পারতে। ও তোমাকেই মা ভাবতে শিখতো যদি তুমি ওকে ভালোবাসা দিতে। কিন্তু তা নয়। তুমি ওর সাথে অন্যায় করো। অত্যাচার করো যা ওর মধ্যে তোমার প্রতি ভালোবাসা নয় ভয় আর ঘৃণা ‘র সৃষ্টি করবে যা তোমার আর ওর দু’জনের পক্ষেই ভালো নয়।  তুমি ওকে একটু ভালোবাসা দাও ও তোমাকে খুব ভালোবাসবে।”

  “— ভালোবাসা! ওই আপদ টা কে? জীবনে কোনদিন ভালোবাসা তো দূর ওর মুখ দেখলে আমার শরীর জ্বলে যায়। আমার সন্তান হলেই ওকে দূর করে দেবো যাতে তোমার সম্পত্তি’র একখণ্ডও ও না পায়। ” 

    বুঝতে পারলো সত্যেন আসলে রমা মুকুলকে তার অনাগত সন্তানের প্রতিদ্বন্দ্বি মনে করে। 

“—না রমা তুমি সত্যিই বিমাতা । তুমি কোনো দিন মুকুলের মা হয়ে উঠতে পারবেনা। মুকুল তোমার থেকে দূরে থাকাই ভালো। আমি ওর ব্যবস্থা কাল সকাল হতেই করে আসবো। আর সম্পত্তি তা থেকে কোনো দিন কেউ মুকুল কে বঞ্চিত করতে পারবেনা এমনি ব্যবস্থা ও করা যাবো”। মনে মনে কথাগুলি বললেও মুখে কিছু বললোনা সত্যেন।

     পরের‌ দিন সকাল হতেই সত্যেন গিয়ে হাজির হলো রাধাগোবিন্দের মন্দিরে। সে জানে এই মন্দিরেই পাওয়া যাবে প্রতিমাকে ‌। কারণ সেই কিশোর বয়স থেকেই সে প্রতিমা কে অনেক খানি চেনে। প্রতিমা যে তাকে ভালোবাসতো বা এখনো হয়তো বাসে তাও সে অনুমান করে। গোঁসাই খুড়ো বৈষ্ণব ধর্মের মানুষ। মেয়েকে তিনি বিয়ে না দিয়ে তাঁর রাধাগোবিন্দ মন্দিরের সেবাদাসী করে রেখে দেন। কেউ মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ দিতে চাইলে তিনি সোজা বলেদেন “– আমার প্রতিমা গোবিন্দের সেবাদাসী। ওর বিয়ে তাঁর সাথেই হয়ে গেছে। ”  কিন্তু কেন গোঁসাই খুড়ো একথা প্রতিমা সম্পর্কে বলেন তাও মোটামুটি অনুমান করতে পারে সত্যেন।

    রাধাগোবিন্দের মন্দিরের কাছে আসা মাত্রই দেখা মিললো প্রতিমা’র সাথে সত্যেনের। সত্যেন কে দেখে বেশ অবাক হলো প্রতিমা কারণ সত্যেন রাধাগোবিন্দ মন্দিরে আসে না বললেই চলে প্রশ্ন টা তাই করে ফ্যালে “— তুমি এখানে সত্য দা ? তুমি তো কোনো দিন মন্দিরে আসোনা। তাহলে?” 

“— আমি মন্দিরে আসিনি প্রতিমা ,এসেছি তোমার কাছে । আর কেন এসেছি তা জানলে আশাকরি তুমি আমার কথা রাখবে, কারণ তুমি মুকুলকে ভালোবাসো এবং তা আমি দেখেছি তোমার দু’চোখে যখন তুমি রমার সাথে মুকুলের হয়ে ঝগড়া করছিলে গতকাল দুপুরে আমার ধারণা সে ভালোবাসা নিতান্তই সাদামাটা ভালোবাসা নয় একজন মা তার সন্তানকে যতোটা ভালোবাসে ততোটাই তুমি ভালোবাসো মুকুল কে। কিন্তু কেন এতো ভালোবাসো তা জানি না। আজ তাই  জানতে এসেছি এতো ভালোবাসা কিসের? আমার অনুমান যদি ঠিক হয় তাহলে আমি চলে যাবো আর যদি ভুল হয় তাহলে আমি তোমাকে একজনের দায়িত্ব দেবো সারাজীবনের জন্য।” 

  “— তোমার অনুমান টা কি জানতে পারি সত্য দা?”

      প্রতিমা ‘র প্রশ্নে স্মিত হাসি হাসলো সত্যেন। তারপর ভনিতা না করে বলে উঠলো”— সেটা মুখে বলতে হবে প্রতিমা? আসল সত্য তুমি এখনো আমাকে ভালোবাসো। তাই আমার সন্তানকেও তুমি পাগলের মতো ভালোবাসো। প্রথম বার আমার মায়ের অনিচ্ছা থাকার কারণে তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়নি তাই  জয়া’র মৃত্যুর পর তুমি আসা করেছিলে তোমাকেই হয়তো আমার মা আমার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী করে নিয়ে যাবেন কিন্তু তা ও যখন হলো না তুমি ঈশ্বর সাধনায় নিজেকে উৎসর্গ করলে। আর গোঁসাই খুড়ো তোমার হঠাৎ করে এই আধ্যাত্মিক মনোভাবের কারণ জেনেও গোবিন্দের তুমি সেবাদাসী বলে জনসমাজে পরিচয় দিতে লাগলেন। এটাই সত্য তো প্রতিমা?” 

  “— প্রতিমা নীরব থেকে গেল। তার দুটো চোখ ভরে উঠলো জলে। এতোদিনে ‘র ভালোবাসার পরিনাম কি ভেবে সে আজ যেন প্রথম অনুতপ্ত বোধ করলো।” 

 “– বলো প্রতিমা এটাই সত্যি কি না? নইলে আমার মুকুলের প্রতি তোমার এই মমতার কারণ কী?” 

সত্যেনের কথাগুলি’র প্রত্ত্যুত্তরে ম্লান হাসি হাসলো প্রতিমা তারপর ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠে”– তুমি এতোদিনে সবটা তাহলে এই বুঝলে? কিন্তু তোমার বোঝার ভুল কোথায় জানো আমি আমার অঙ্গিকার রক্ষা করতে জানি। তাই তোমার স্ত্রী হওয়ার কোনো ইচ্ছা বা বাসনা পরবর্তীতে আমার না থাকলেও জয়ার  কাছে অঙ্গীকার বদ্ধ আমি ওর সন্তান যাতে কোনো কষ্ট না পায়। মৃত্যু পথযাত্রী’র কাছে করা অঙ্গীকার অস্বীকার করি কেমন করে ? আর তুমি তো জানো আমি যা অঙ্গীকার করি তাতে অটল থাকি।

এবার বলো কী কারণে এসেছ । ” 

“– আমি তাহলে ভুল বুঝেছিলাম তোমাকে। তবে আজ একটা অনুরোধ করবো মুকুলকে তুমি নাও প্রতিমা ?” 

“— আমি মুকুল কে নেবো ! কিন্তু কেন কোন্ অধিকারে সত্য দা?” 

“— তুমি ওর ছোট মা । আর সেই ছোট মায়ের অধিকারে। আমি জানি তুমি না করতে পারবে না। কারণ তোমার মুকুলের প্রতি ভালোবাসা তোমাকে না বলতে দেবে না। তবু বলছি যদি ওই হতভাগা’র দায়িত্ব নাও তাহলে ও বাঁচে নইলে তিলে তিলে ও শেষ হয়ে যাবে। আমি নিরুপায় বাবা ছেলের এই যন্ত্রণা আর চোখে দেখতে পারছি না। তাই তোমাকে জোর করছি না অনুরোধ করছি তুমি ওকে তোমার করে নাও। তোমার শিক্ষায় বড় করে তোলো। মানুষের মতো মানুষ করো।  যা টাকা লাগে আমি দেবো । তুমি শুধু ওর ছোট মা নয় আজ থেকে মা হয়ে ওঠো প্রতিমা। “

      প্রতিমা ভেবে পেলো না এ কী অনুরোধ তার কাছে করছে তার সত্য দা? সে কি পারবে এতোবড় দায়িত্ব ভার নিতে? হয়তো পারবে কিন্তু তা টাকার বিনিময়ে ? না কখনো না। সে পুনরায় ম্লান হাসি হেসে বলে ওঠে “–আবার অর্থের বিনিময়?”

 চমকালো সত্যেন। মনে পড়ে গেল পনেরো বছর আগের একটি রাতের কথা। যে রাতে পদ্মা দেবী সত্যেনের জীবন থেকে চিরকালের জন্য প্রতিমা কে সরে যাওয়ার জন্য এই মন্দির প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়িয়ে  বলেছিলেন “— কতো টাকা দিলে তুই আমার সত্য কে মুক্তি দিবি? বল্ কতো টাকা?” প্রতিমা হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে চলে গিয়েছিল কোনো উত্তর না দিয়ে। গোঁসাই খুড়ো তা দূর থেকে দেখে  চোখের জল মুছতে মুছতে চলে গিয়েছিলেন। এই সবটাই সত্যেন সে রাতে দেখেছিল মন্দিরের পাঁচিলের আড়াল থেকে। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারেনি কারণ মা পদ্মা দেবী ‘র শপথ করিয়েছিলেন তাকে “— যদি সে তার মায়ের পছন্দ করা মেয়ে জয়া কে যদি বিয়ে না করে তাহলে তিনি আত্মহত্যা করবেন। আর তাঁর এই আত্মহত্যার জন্য দায়ী থাকবে সত্যেন। ” 

   “– বেশ তোমাকে অর্থ দিয়ে ছোট করবো না। শুধু বলবো তুমি তোমার মনের মতো করে মুকুলকে মানুষ করো। একদিন আমি তোমাকে বিয়ে করে স্ত্রী’র মর্যাদা দিয়ে নিজের পরিবারে নিয়ে যেতে পারিনি ভেঙেছি আমার অঙ্গীকার শুধু মায়ের শপথের ভয়ে আজ তাই ঈশ্বরের কাছে নতুন  করে অঙ্গীকার করছি আমি তোমাকে মুকুলের মায়ের স্থান দিলাম প্রতিমা তুমি গ্রহণ করো। ” প্রতিমা ‘র দু’চোখের কোণ থেকে নেমে আসা নোনা জলের ধারা, ঠোঁটের প্রান্তে ফুটে ওঠা প্রশান্তির হাসি সত্যেন কে বুঝিয়ে দেয় মুকুলের দায়িত্ব নিতে প্রতিমা সম্পূর্ণ রূপে রাজি। সত্যেনের বুক যেন এতোদিনে ভারমুক্ত হয়। 

অঙ্গীকার ছোটগল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!