কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

বরাত

বরাত ছোটগল্প – স্বর্ণশ্রী সাহা

চাবি খুলে ঘরে ঢুকতেই অনন্যার পা এগোতে গিয়েও থমকে গেল, গোটা ঘরে বিয়ারের বটলের কাঁচ ছড়িয়ে রয়েছে, খুব একটা চমকালো না অনন্যা,এরকম আগেও দু-একদিন হয়েছে I আলগা হাতে পাশের ঘরের পর্দাটা সরাবে ভেবেও না সরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লক করে সংলগ্ন বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালো অনন্যা,আর চোখে পড়ল পাশের ঘরে নিজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনুরোধ,থম মেরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বারান্দার গ্রিল গুলো ধরে, দৃষ্টি নিচে, চার তলা থেকে একদম নিচে, অনন্যার চোখে চোখ পড়তেই ঘরে চলে যায় সে I

 **** 

 আসলে অনন্যা আর অনুরোধ বিবাহিত, ওরা স্বামী-স্ত্রী,তবে শুধু সমাজের কাছেই I ওরা দুজনেই অন্য কাওকে ভালোবাসতো, কিন্তু দুজনের মনের মানুষেরই সংসার হয়ে গেছে অন্য জায়গায়, দুজনের বাড়ি থেকেই চাপ দেয় অন্তত এবার সংসারী হওয়ার জন্য, নইলে ওদের দুই বাড়ির লোকের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল ওদের উদাসীনতা, শেষমেশ ওদের এই সিদ্ধান্ত I সবাই খুশি হয়েছিল ওদের বিয়েতে আর নবোদম্পতি শুধু হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল, ওরা জানতো ওরা কেউই ওদের প্রাক্তনকে ভুলতে পারেনি, আর বর্তমানে সাত পাকে বাঁধা পরলেও ওদের আসলে কোনো বন্ধন নেই পরস্পরের প্রতি,ওরা শুধুই চুক্তিবদ্ধ ও স্বাধীন নিজেদের কর্মস্থলে,এভাবেই ওরা কাটাচ্ছিলো ওদের জীবন I অনুরোধ মাঝে-মাঝে পুরোনো কথা ভেবে বা নিজের প্রেয়সীর নতুন নতুন ছবি সোশাল মিডিয়ায় দেখতে পেয়ে ভীষণ কষ্ট পায় আর কষ্ট ভুলতে নেশা করতে থাকে I অনন্যাও একই কারণে এখনো মাঝে মাঝে টিন এজারদের মতো নিজেকে হার্ম করতে থাকে আর মাথার ওষুধ তো তার অনেকদিনের সঙ্গী হয়েই গেছে I ওরা দুজনেই একা, বড্ড একা, আর সত্যি বলতে যেন একা থাকতেই চায় ওরা I ওদের সঙ্গী বলতে কখনো ওদের কাজ, কখনো বই, কখনো মোবাইল ফোন, কখনো নেশা, কখনো আবার অন্ধকার ঘর আর কান্না, ওরা কথা বলে নিজেদের মধ্যে, তবে খুব কম বললেই চলে সেটা,,, যদিও একসাথে কিছু অনুষ্ঠানে ওদের যেতে হয়, ছবিও তুলতে হয় কচিৎ কখনো I একবার তো এক অনুষ্ঠানে এক প্রতিবেশী বলে ওঠে ওরা কোনো ইস্যু নেবে ভাবছে কিনা, অনুরোধ খুব বুদ্ধি করে সে কথা কাটিয়ে দেয় আর বাড়ি এসে শুধু এটুকুই অনন্যাকে বলে যে সে কোনো নতুন প্রাণ পৃথিবীতে এনে তাকে এই অবস্থার মধ্যে বড় করতে পারবেনা, অনন্যার সঙ্গে এমনিতেও তার কোনো শারীরিক সম্পর্ক নেই, শারীরিক সম্পর্ক তৈরির ইচ্ছাও নেই এবং একই কারণে সে কোনো দত্তক সন্তানও  চায়না,অনন্যা খুব মুক্তমনা মেয়ে আর এই বিষয়ে সে কোনো প্রত্তুত্তর দেয়নি অনুরোধকে I অনন্যা জানে একটি বাচ্চাকে বড় করতে গেলে তাকে একটা স্বাভাবিক পরিবেশ দেওয়া উচিত, আর তাদের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয়, অনুরোধ অনন্যার প্রতি কোনোদিনও শারীরিকভাবে কোনো জোর খাটায়নি, অনন্যাও ওরম কোনো আবেগ প্রকাশ করেনি, অনুরোধ বা অনন্যা বাইরে কোথাও নিজের খিদে মেটায় কিনা সেই নিয়ে কেও কাওকে কোনো প্রশ্ন আজ অবধি করেনি I

**** 

 একদিন……

 – হ্যালো, অনন্যা এক্ষুনি একবার বাড়িতে আসতে পারবে? 

 – কেন অনুরোধ? সব ঠিক আছে তো? আমি আসলে মিটিং এ…

 – প্লিজ, কাম এজ সুন এজ পসিবল I

 অনন্যা কোনোরকমে বাড়ি ফেরে এবং হতভম্ব হয়ে দেখে বাড়িতে বসে অনুরোধের প্রাক্তন আর সাথে একটি বাচ্চা ছেলে, মেয়েটি অঝোরে কেঁদে চলেছে,কিছুই বলতে পারছেনা যেন I ক্রমশ বোঝা যায় যে দুদিন হলো অনুরোধের প্রাক্তন অনামিকার স্বামীবিয়োগ ঘটেছে এবং সমস্ত কাজ মেটার আগেই অনামিকার শাশুড়ি তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, নাতিকে না ছাড়তে চাইলেও অনামিকা কোনোক্রমে তাকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে,বাপের বাড়িতে একমাত্র রয়েছে অনামিকার অসুস্থ মা, বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন, এখন সে অসহায় হয়ে বসে রয়েছে অনুরোধের দ্বারে I অনুরোধ কি করবে যেন বুঝতে পারছে না তাই সে ডেকে পাঠিয়েছে অনামিকাকে….

 অনন্যা খুব শান্ত ভাবে একটা সিগারেট ধরায় নিজের ঘরের বারান্দায় গিয়ে, তারপর বেরিয়ে এসে অনুরোধকে 

বলে –

“ অনুরোধ, বিয়ের পর থেকে বৌ হিসেবে বা একজন সঙ্গী হিসেবে আমি কোনোদিন তোমার কাছে কিছুই চাইনি, চাওয়ার কথাও ছিলনা, কিন্তু এতদিনে তোমায় কিছুটা হলেও চিনতে পেরেছি, দুনিয়ার কাছে সহজ এবং সম্ভব অনেক জিনিসই অনেকসময় যারা সেই অবস্থাটা পার করছে, তারা বোঝে সম্ভব হয়না, তুমি আজও তোমার প্রাক্তনকেই ভালোবাসো, তাই তো কঠোর অতীত থাকলেও আজ তুমি না দেখাতে চাইলেও তোমার চোখের কোণে জল আমি দেখেছি, আর অনামিকা অনুতপ্ত কি নয় সেটা আমি না জানলেও বা অনামিকার তোমাকে কতটা দরকার সে বিষয়ে তর্কে না গেলেও আমি এটুকু জানি যে ওই বাচ্চাটার একজন বাবা দরকার, অন্য কোনো ছেলে তাকে তোমার মতো ভালোবাসা দিতে পারবে না যেটা তুমি পারবে, তাই প্লিজ কোনো কথা আর বেশি না ভেবে তুমি অনামিকার সাথে একটা নতুন সুন্দর সংসার গড়ে তোলো, যেটা হবে একটা আদৰ্শ সংসারের মতোই,এটাই আমি চাই…“ 

 — ” আর তুমি অনন্যা?“

 — “ আমি আবার কি? আমি এবার একটু পাহাড়ের দিকে যাব ভাবছি, স্যালারি টা অনেকটাই জমেছে আর ওবাড়ির সবাই তো আছেই, আগেও বেঁচে ছিলাম, এবার আবারও বাঁচবো, হয়ত একটু অন্যভাবে I ভালো থেকো তোমরা,আইনি কাজকর্ম মিটতে বেশি দেরি হবেনা, আর হ্যাঁ আমার সাথে তোমরা কেও কোনো বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগও রাখতে চেষ্টা করোনা, জটিলতা আসতে পারে..আসি,টাটা পুচকু I“

বরাত ছোটগল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!