কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » পূজা সংখ্যা ১৪৩০ » আম বাগানের ভূত

আম বাগানের ভূত

আম বাগানের ভূত ভৌতিক গল্প – কাজী সামসুল আলম

সুবিমল স্কুল থেকে ফিরেই চারটি নাকে মুখে গুঁজেই ছুটে ধাড়াদের আম বাগানের দিকে। সন্ধ্যা না হলে কোনোদিন বাড়ি ফিরবে না। হাজারবার মা, ঠাকুমা বারণ করলেও সে শুনবে না। শুধু যেদিন আকাশ কালো হয়ে মেঘ নেমে আসে কিংবা বৃষ্টি শুরু হয় সেদিনই ঘর থেকে বের হয় না। সেদিন ছাদের সিঁড়ি ঘরে গিয়ে বসে থাকে। একদিন ঠাকুমা কাপড় তুলতে এসে দেখে সুবিমল একা বক বক করছে। ঠাকুমা জিজ্ঞাসা করল, “কীরে একা একা কী বকবক করছিস?” সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সুবিমল বলেছিল, “ঠাকুমা, তুমি কখন এলে, ক্লাসের কবিতা মুখস্থ করছিলাম।” 

   ঠাকুমা ফিরে যেতে শ্বাস ছেড়ে মনে মনে ভাবল, “যাক বাবা, ধরা পড়িনি, বড্ড বাঁচান বেঁচে গেছি ।”    

  স্কুল থেকে ফিরে সবাই যখন নানান খেলা নিয়ে মেতে থাকে, ও তখন একা একা গিয়ে ধাড়াদের আম বাগানের কোনের গাছটার নীচে বসে থাকে। কেউ খেলতে ডাকলে সে যায় না। অন্য কাজ আছে বলে এড়িয়ে যায়। কেউ ওকে খুঁজেও পায় না। 

  পাড়ার ছেলেরা এসে সুবিমলকে ডাকতে এলে, সুবিমলের মা বেরিয়ে বলে, “সে তো খেলতে বেরিয়ে গেছে, দেখ গিয়ে, মাঠে পৌঁছে গেছে নিশ্চয়।”

  তন্ন তন্ন করেও পাড়ার বন্ধুরা কিন্তু ওর হদিস খুঁজে পায় না ।  অথচ মাস ছয়েক আগেও ফুটবল খেলায়, ক্রিকেট খেলায় সুবিমল, মনোতোষকে ছাড়া কোনো খেলায় হত না। দুই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু এক সঙ্গেই থাকবে সব জায়গায়। একই দলে তাঁদের রাখতে হবে, নাহলে খেলবেও না, খেলতেও দেবে না।

  মনোতোষ গাছ থেকে পড়ে মারা যাওয়ার পর সুবিমল আর কোনো খেলাতে অংশ গ্রহণ করে না। সকালে বই নিয়ে বসে থাকে। বিকালে গিয়ে সেই গাছটার তলায় বসে থাকে, যে গাছটা থেকে আম পাড়তে উঠে মনোতোষ পা পিছলে পড়ে যায়। হাসপাতালে নিয়ে গেলে, ডাক্তার মৃত ঘোষণা করে। শ্রাদ্ধ শ্রান্তির পরদিন রাত্রে ঘুমে স্বপ্ন দেখল সুবিমল, মনোতোষ এসে তাকে বলছে, “আমি নেই তো কী হয়েছে, আম বাগানে যাবি, আমি পেড়ে দেব।  কেউ ভয়ে যায় না সেদিকে, তুই বিকালে গিয়ে আম কুড়িয়ে আনবি, তোর সঙ্গে গল্প হবে, ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই।”  

  পরদিন বিকালে গিয়ে দেখে সত্যি সত্যি আম পড়ে আছে। কুড়িয়ে জমা করতেই, মনোতোষের গলা ভেসে এল, “তুই রোজ আসবি, আমি তোর সঙ্গে গল্প করবো।”

  মনোতোষের গলা পেয়ে একটুও ভয় পেল না সুবিমল, বন্ধুর ছেনা গলা, শুধু চোখে দেখা যায় না যা। এমনিতে ডাকাবুকা ও ডানপিটে ছেলে সুবিমল এবং মনোতোষও ছিল একই ধাঁচের। তাই ভয় না পেয়ে বলল, “তুই আমার সামনে আসতে পারবি না?”  

 “সামনেই তো আছি, কিন্তু তুই দেখতি পাবি না, এই যা । এই তোর গায়ে হাত দিলাম।”  

 একটা সিড়সিড়ানি ভাব অনুভব করল সুবিমল। বন্ধুর হাতের ছোঁয়া পেয়ে চোখে জল এসে গেলে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “কী যে হয়ে গেল, তুই চলে গেলি, আমি একা হয়ে গেলাম।” 

  “মৃত্যু কারো হাতে থাকে নারে সুবিমল, এই সার কথা আমি বুঝেছি, নাহলে শুধু শুধু পা ফসকে যায় আমার?”   

  সেই থেক সুবিমলকে কেউ কোনও খেলাতে খেলতেও দেখে না, আবার তাকে কেউ খুঁজেও পায় না। ধাড়াদের আমবাগানে গিয়েও কেউ তাকে খুঁজে পায়নি। একথা সুবিমলের মায়ের কানে যে আসেনি তা নয়, কিন্তু প্রতিদিন সন্ধ্যা নামলেই ছেলে বাড়ি চলে আসে বলে এসব নিয়ে সুবিমলের মা ঠাকুমা কেউ কিছু ভাবেনি। তবুও একদিন মা জানতে চেয়েছিল, “হ্যাঁরে, সবাই তোকে খেলার জন্য ডাকতে আসে, তুই তাদের সঙ্গে খেলতে যাস না, থাকিস কোথায়?” 

  “আমি এদের সঙ্গে খেলি না মা, মনা চলে যাওয়ার পর আমার আর এদের সঙ্গে খেলতে মন চায় না। আমি স্কুলের দিকে চলে যাই, রাধাচকের ছেলেদের সঙ্গে খেলি।“ তারপর থেকে সুবিমলের মা ছেলেকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করে না ।   

  প্রতিদিনের মতো আজও সেই আম গাছটার তলায় এসে বসল। কিন্তু তার কোনও সাড়া শব্দ নেই। বেশ কিছুক্ষণ বসার পর, নাম ধরে ডাকাডাকি করল খানিক। তবু সাড়া শব্দ নেই। যখন মন খারাপ করে উঠব উঠব করছে। ঠিক তখনই ঝাঁ ঝাঁ বাতাসের শব্দে আম বাগানে দোল উঠল, গাছের পাতারা নড়ে উঠল। তারপর শব্দ থেমে গেল।     

  “কীরে, চলে যাচ্ছিলি ? আমি স্কুলে গিয়েছিলাম। কদিন পরে তো তোর পরীক্ষা। প্রশ্ন জেনে আসতে হবে না?”

  “ও, আমি অনেকক্ষণ বসে আছি, তুই নেই, জোরে ডাকলে কেউ যদি শুনতে পায়, আজকে আবার মাঠে ট্রাক্টর নেমেছে। সবাই মাঠে ঘুরছে। তুই থাকলে আমাকে আড়াল করে রাখতিস, কেউ দেখতেও পেত না, আমার কথা কেউ শুনতেও পেত না।” মনোতোষের কথার উত্তরে বলল সুবিমল।     

  “সেটা অবশ্য ঠিক বলেছিস, তুই কালকে বলেছিলি না? সামনের সপ্তাহ থেকে তোর পরীক্ষা। কিছুই পড়া হয়নি। তাই তুই কালকে চলে যেতেই ভাবলাম, তোর জন্য প্রশ্ন চুরির কাজটা আমি করতে পারব।”   

  “প্রশ্ন পেয়েছিস? আর প্রশ্ন পেলেই বা কী হবে? আমি কি আর এই কদিনে মুখস্ত করতে পারব?” বলল সুবিমল।

  “সে দেখা যাবে । এ নিয়ে তুই ভাবিস না।” অদৃশ্য থেকে সাহস দিল মনোতোষ।   

  “কী আর ভাবব, তুই যখন ছিলি, দুজনে মিলে কত টুকলি করতাম, ধরা পড়ে স্যারেদের কান মলাও খেয়েছি দুজনে। তুই চলে যাওয়ার পর এখন আর এসব করতে ইচ্ছে হয় না। কিন্তু পাস যদি না করি, খুব লজ্জার হবে। সোরেন, বিটকেল, দিবাদেরকে চিনিস তো তুই, টিটকিরির জ্বালায় বাঁচতে দেবে না।”   

  “তুই চিন্তা করিস না, আমি অনেক কিছু শিখে নিচ্ছি। আমি ছোট বলে আমাদের দলে আমাকে কেউ গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু ওরা কেমন করে সব কাজ করে আমি বুঝতে শিখছি ধীরে ধীরে। তোকে সন্ধ্যার আগেই চলে যেতে বলি সেই জন্য। সন্ধ্যার পরেই শ্যাওড়া গাছে গিয়ে জায়গা দখল করে নিতে হয়। ওখানেই সব মুরুব্বিরা এসে জমা হয়। অন্য গাছ ওদের পোশায় না।”  

  রোজ দুই বন্ধু এমন নানান গল্প করে। পাশ দিয়ে গ্রামের কেউ চলে গেলেও সুবিমলকে ওদের নজরে পড়ে না। সুবিমল ও মনোতোষের কথা ওদের কানেও আসে না। কিন্তু সুবিমল তাদের দেখতেও পায়, তাদের হাঁক ডাকও শুনতে পায়। এই যেমন সেদিন, রথীনকাকার গরু জঙ্গলে ঢুকে পড়েছিল, অনেকেই গরু খুঁজতে এল, ওর পাশ দিয়ে চলে গেল, কেউ ওর সঙ্গে একটি কথাও বলল না। মনোতোষ বলেছিল সেদিন, “আমি তোকে নজর বন্দী করে রেখেছি, তাই ওরা তোকে দেখতে পায়নি।”  

  সেদিন থেকেই সুবিমলের আরও সাহস বেড়েছে। ও ভেবেছে এই বন্ধু তাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করবে।  তাই পরীক্ষার কথা তুলেছিল। আজকে সেই কাজেই গিয়েছিল মনোতোষ।

  সুবিমল এবার জিজ্ঞাসা করল, “যে কাজে গিয়েছিলি, সেই কাজ হয়েছে, প্রশ্ন পেয়েছিস?”   

  “সব প্রশ্ন আসেনি, তবে ইতিহাস, বাংলা এসেছে। আমি নিয়ে এসেছি। তুই রাত্রে টেবিলে ইতিহাস আর বাংলা বই খুলে রাখবি, আমি সব পৃষ্ঠায় দাগ দিয়ে দেব। সকালে উঠে দেখে নিবি। তবে কাক পক্ষীও যেন না জানে।”  

  ঘুমাতে যাওয়ার আগে টেবিল থেকে সব বই সরিয়ে শুধু ইতিহাস ও বাংলা বই রেখে দিয়েছে সুবিমল। মনে করে হ্যারিকেন নিভিয়ে দিয়েছে। আলো জ্বললে মনোতোষ আসতে পারবে না, সে কথা অনেক আগে থেকেই জানে সুবিমল। মায়ের কাছ থেকে টর্চ নিয়ে রেখেছে। যদি রাত্রে প্রয়োজন হয়। রাত্রে টর্চ কী কাজে লাগবে মা জানতে চাইলে সে বলেছিল, “মাঝে মাঝে রাত্রে হ্যারিকেন নিজে নিজে নিভে যায়, ভোরে উঠে পড়তে হবে, পরীক্ষার আর কদিন বাকি ।”   

  মা বলেছিল, “বিকালে কোথায় যে চলে যাস, সেই সময়টুকু পড়লেও ভোরে উঠে আর পড়তে হয় না।” 

  “বিকালে পড়ায় মন বসে না, ভোরের পড়া মনে গেঁথে থাকে, আমাকে মধু স্যার বলেছেন।” 

  “প্রতি বছরই তো স্যারেদের কান মলা খাস বলে শুনেছি, পাসও করিস গড়পড়তা, এবারে ভোরে উঠে পড়ে কী রেজাল্ট করিস, দেখব এবার!” 

  “আচ্ছা মা, পাস করেও কী করব বলতে পারো, সেই তো চাষের কাজে লাগতে হবে।”   

  “ভাল পড়লে, বেশি পড়লে চাষের কাজে লাগতে হবে তোকে কে বলেছে? দেখিস না গোঁসাইদের রাজীব কেমন অফিসার হয়েছে। কেউ জানত, বাবার মতো যজমানি না করে ছেলেটা অফিসার হবে। তোর বাবাও বলছিল, তুই যদি এমন হাঁদারাম মার্কা রেজাল্ট না করে ভাল রেজাল্ট করে মস্ত পাস দিস, তবে জমিটুকু বিক্রি করে হলেও অনেক পড়াবে তোকে, তোকে চাষা হতে দেবে না।”   

  “ঠিক আছে, এবারে আমি খুব চেষ্টা করব। তবে ঐ জমিটুকু বিক্রি করে দিলে আমরা খাব কী?”  

  “সে ভাবনা তোর নয়, বাবা জন মনুষি করে যেমন সংসার চালায়, তেমনি করেই চালাবে।”  

  মাকে মিথ্যা বললেও, আজ কিন্তু একটু সকাল সকালই উঠেছে সুবিমল। রাত্রে ভাল করে ঘুমও হয়নি তার। মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙ্গে চোখ খুলে তাকিয়ে রয়েছে কখন মনোতোষ আসে দেখার জন্য। কিন্তু না, সেরকম কোনও সাড়া পায়নি সে। সকাল সকাল উঠে জানালা দরজা খুলে ঘরে আলো আসার রাস্তা করে দিল আগে। জানলা দিয়ে উষার আলো এসে পড়ল বিছানায়, রাজেন কাকা কাঁধে হাল এবং বলদ জোড়া নিয়ে মাঠের দিকে রওনা দিয়েছে। বোরো চাষের মরশুম যে শুরু হয়ে গেল, সে কথা মনেই ছিল না তার। বাবাও এবার চাষের তোড়জোড় শুরু করবে। পরীক্ষা শেষে তাকেও মাঝে মধ্যে মাঠে যেতে হবে ধানের চারা পৌঁছে দিতে, বাবা ও জন মুনিষদের জন্য খাওয়ার পৌঁছে দিতে। জানালার কাছ থেকে সরে এসে টেবিলের বই নিয়ে বাইরে বারান্দায় বেরিয়ে এল। তন্ন তন্ন করে দুটো বইয়ের পাতা খুঁজে বেড়ালো, কিন্তু কোথাও কোনও দাগ খুঁজে পেল না সে। 

  মনোতোষের উপর খুব রাগ হল সুবিমলের। এমন রাগ আগে কখনও হয়নি তার। শুধু শুধু ধোঁকা দিল তাকে। রাগে বইগুলো টেবিলের উপর ছুঁড়ে ফেলে গজর গজর করতে লাগল, “না পারবি, বললি কেন?”

  কথাটা একটু জোরেই বলে ফেলেছিল, মা উঠানে উনুন নিকোতে নিকোতে জানতে চাইল, “কী বকছিস, কে কী পারেনি?” 

  “ভোরে পড়তে বসে একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাইনি, রমেন দেবে বলেছিল, দেয়নি। তাই বলছিলাম।“ বলেই ভাবল, জোরে কথা বলা যাবে না, মায়ের সবদিকে খেয়াল থাকে। বাড়ির বড় ছেলে সুবিমল, ওর পরে আরও দুই বোন। মা তাকে একটু বেশিই ভালবাসে। তাই সব দিকেই মায়ের একটু বাড়তি সতর্কতা ।      

  স্কুলে সব ক্লাসেই আগের থেকে বেশি আনমনা থাকে সুবিমল। আগের মতো হৈ হুল্লোড় করে না। আগে দুজনে মিলে অন্যের গায়ে কালি ছেটানো, কার বইয়ের পাতায় কালি ফেলে দেওয়া, কাউকে পা বাড়িয়ে ফেলে দেওয়া, এসব দুষ্টুমিতে ব্যস্ত থাকত। এসব বন্ধ হয়েছে মনোতোষ মারা যাওয়ার পর থেকেই। স্যারেদের সঙ্গে অকারণ তর্কও করে না আর। আজকে একটু বেশিই আনমনা ছিল। তারমধ্যে ইতিহাসের স্যার এসে সংবিধানের প্রস্তাবনা মুখস্ত বলতে বলায় গড় গড় করে মুখস্ত বলে ফেলল। স্যার যত না অবাক, তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছে সুবিমল নিজে। স্যার যখন বললেন, “বাহ, ফাস্ট ক্লাস বলেছিস, হুবুহু বইয়ের মতো, কোথাও ভুল হয়নি। তোর অনেক উন্নতি হচ্ছে সুবিমল।”

 পাশ থেকে রমেন বলে উঠল, “স্যার, ও এখন ভোরে উঠে পড়ে, বিকালে আমাদের সঙ্গে খেলে না। লুকিয়ে লুকিয়ে পড়া মুখস্ত করে স্যার।”    

 কেমন করে এমন উত্তর দেওয়া সম্ভব হল, ভাবতে ভাবতে সারাটা দিন কেটে গেল।

 বিকালে আম বাগানের দিকে যেতে গিয়ে রমেনের সঙ্গে দেখা। ওকে দেখেই জিজ্ঞেস করল, “কীরে কোথায় যাচ্ছিস?”     

  “মাঠে যাচ্ছি, বাবা গেছে, মা বলেছে, বাবা সব আনতে পারবে না, তাই যেন যাই।” রমেনকে মিথ্যা কথা বলে ছুট লাগালো সুবিমল। রমেন খুব বাজে ছেলে, সব কথা সবাইকে লাগিয়ে ভাঙ্গিয়ে বড় করে শোনায়। একবার আম বাগানে যাওয়ার কথা জানতে পারলে গল্প বানিয়ে ছাড়বে। 

  আজকে আর দেরি করেনি মনোতোষ, সুবিমল আসতেই বলল, “কী রে খুব রেগে গেছিস আমার উপর?”

  “রাগব না তো কী করব? আমি মরছি জ্বালায়, আর তুই আমার সঙ্গে মশকরা করছিস?”  

  “মশকরা করিনি-রে, কালকে রাত্রে আর একটা উপায় শিখেছি, তাই তো আর তোর কাছে যাইনি বইয়ে দাগ দিতে। তোর চিন্তা নেই আমি সব ব্যবস্থা করে দেব তোর। তুই বরং এই কদিন আর আমার কাছে আসিসনি। বই নিয়ে সারাক্ষণ বারান্দায় বসে পড়। মাঝরাত পর্যন্ত জোরে জোরে পড়, যাতে পাড়ার লোকেও শুনতে পায়। ভোরেও পড়বি, সকালে মাঠে যাওয়া লোকেরা যাতে বুঝতে পারে নিধুরাম কাকার ছেলে পড়ায় মন বসিয়েছে।”

  “তাতে কী উপকার হবে? এতো খাটতে পারব না।”

 “ উপকার কী হবে রেজাল্টের দিন বুঝতে পারবি।”  

  “আমি তবে কাল থেকে আর তোর সঙ্গে গল্প করতে পাব না? ”  উপর দিকে মুখ করে জিজ্ঞাসা করল।

  “না, আমিও এই কদিন এখানে থাকব না, তোর পরীক্ষার পর আবার কথা হবে দুজনের।”   

  পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে, স্কুলে হৈ চৈ পড়ে গেছে এইটের মাথামোটা হাঁদারাম সুবিমল থার্ড হয়েছে। অঙ্ক, ইংরেজিতে আবার হায়েষ্ট নম্বর পেয়েছে। টিউশনির স্যার গৌতমবাবু এসে বললেন, “তোর যে এতটা উন্নতি হবে আমরা বুঝতেই পারিনি। ইতিহাস ভূগোলে নম্বর বেশি পেলে তো ফার্স্ট হয়ে যেতিস! একটা বড় অঘটন ঘটে যেত স্কুলে।”   

  পরীক্ষার পর থেকেই মাঠের কাজে মনোতোষের সঙ্গে দেখাই করা যায়নি। গতকাল রাত্রে স্বপ্নে দেখেছিল, “মনোতোষ তাকে বলছে, কীরে পাস করলি, দেখা করলি না যে?”

  খুব লজ্জায় পড়ে গেল সে, তাই তো, রেজাল্টের দিন দেখা করতে বলেছিল মনোতোষ। কিন্তু রেজাল্টের আনন্দে সে ভুলে গিয়েছিল একেবারে। তাই আজ আর বাবার সঙ্গে মাঠে যাবে না, বিকালে যেতেই হবে আম বাগানে, মনোতোষের সঙ্গে অনেক গল্প বাকি আছে।

  অনেকক্ষন বসেও মনোতোষ এল না, এদিকে সন্ধ্যা হয়ে এল, ভয় ভয় করতে লাগল, হতাশ মনে বাড়ি ফিরে এল।

  রাত্রে হঠাৎ কী একটা শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল, তাকিয়ে দেখে ঘর অন্ধকার, হ্যারিকেন কখন নিভে গেছে, জানালার পাল্লাটা নড়ে উঠল, ভাবল বাতাসে নড়ছে মনে হয়।  তারপর মনে হল, জানালা তো বন্ধ ছিল, শীতকালে সে তো কখনও জানালা খুলে ঘুমায়নি। কিছু বুঝার আগেই, মনোতোষের গলা ভেসে উঠল, “আমি আর ঐ গাছে থাকি না, তাই তোর সঙ্গে আজ দেখা হয়নি। আমার প্রমোশন হয়েছে, আমি বড় সাফল্য পেয়েছি, তাই মহারাজ বলেছেন, আমি যেন শ্যাওড়া গাছেই থাকি, কোথাও যেন না যাই। রাত বাড়লে মহারাজ এলে আমার ছুটি তখন, যেখান খুশি সেখান যেতে পারি। তোর রেজাল্ট ভাল হয়েছে তাই অভিনন্দন জানাতে এলাম বন্ধু।”   

  “সবই তোর কেরামতি, আমার বুঝতে বাকি নেই। তোকে অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু তুই কী সাফল্য পেয়েছিস, সেটা শুনতে আগে ইচ্ছা করছে।”    

  “কেন, তুই কি বুঝতে পারিসনি? তোর পাসের সাফল্য। বলেছিলাম না, উপায় জেনে গেছি, চিন্তা করিস না।”

  “সে আমি জানি, আমি ভেবেছিলাম, আর কিছু কি না?” 

  “অনেক কিছু জেনেছি, আর একটা কথা, আমার মাকে বলিস, ঘরে দলিল পত্রের যে বাক্স আছে সেটি মাঝে মধ্যে দেখতে, পোকা মাকড় যেন না লাগে। আমিই বলেছি বলবি।”

  আসলে সুবিমল বন্ধু হলেও মাকে টাকা পাঠানোর কথা না বলে পোকা মাকড় লাগার কথা বলল মনোতোষ। মাকে টাকা পাঠানোর কথা পাঁচ কান না হওয়ায় ভাল। মনোতোষের মায়ের আর কষ্ট থাকবে না। ছোটবেলা বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে জমি ভাগ চাষ দেওয়া আর লোকের বাড়ি কাজ করে মনোতোষের মা সংসার চালিয়েছে, কিন্তু অর্থাভাবে একমাত্র দিদির বিয়ে দিতে পারেনি। সেইজন্যই তো মনোতোষ এতটা বখাটে ছেলে হয়ে গিয়েছিল। এবারে দিদিরও বিয়েটা হয়ে যাবে, টাকার অভাব আর হবে না।    

  “বলব, তোর দুঃখে তোর মা কাতর হয়ে আছে। তুই তো তোর মায়ের সঙ্গেও দেখা করতে পারিস?”  

  “নারে একজনের বেশি দেখা করা যায় না। মায়ের সঙ্গে দেখা করলে তোর সঙ্গে আর দেখা হবে না।”   

  কিছুক্ষণ চুপ থেকে সুবিমল প্রশ্ন করল, “আমার সঙ্গে তোর কীভাবে দেখা হবে তবে?” 

  “রোজ নিশুতি রাতে আসবো, আলো বন্ধ রাখবি। যেদিন কথা বলার ইচ্ছা হবে না, সেদিন আলো জ্বালিয়ে রাখবি, আমি ফিরে চলে যাব।”    

 আর মনোতোষের কোনও শব্দ নেই, কেবল জানালার পাল্লা আবার নড়ে উঠল। বাইরে প্যাঁচার ডানা ঝাপটানোর শব্দ আর দূরে খেকশেয়ালির হুক্কা হুয়া শব্দে মাঝ রাতের নীরবতাকে আরও ভয়ার্ত করে তুলল।

আম বাগানের ভূত ভৌতিক গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!