কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » পুজো সংখ্যা ১৪২৯ » ছোটগল্প » ভূত ও ইলিশ ককটেল

ভূত ও ইলিশ ককটেল

ভূত ও ইলিশ ককটেল ছোট গল্প – দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়

সম্পর্কে লালন না থাকলে সম্পর্ক ঝুরো বালি!সুবোধ বোঝে এটা।তবুও বেশ কিছু ‘যদি’,’ তবে’ মাঝে এসে দাঁড়িয়ে শ্বশুরবাড়ির সাথে দূরত্ব দিয়েছে বাড়িয়ে। নিজেকে অনেক ভেঙ্গেছে সুবোধ। ছেলে বউয়ের মুখ বুকের পাঁজরে মোচড় দেয় খুব। সবিতার সাথে প্রেম করে বিয়ে। দীর্ঘ আট বছর অনেক লড়াই লড়েছে তখন ওরা। সবিতা বড়োলোক বাবার বিরুদ্ধে একাই লড়ে গেছে। তখন সুবোধ শুধু টিউশন নির্ভর। বাড়িতে বিধবা মা আর ও। নিত্য দিন ক্ষিদের জ্বালা সঙ্গী। তবুও সবিতা তখন ভরসা জোগাত। আত্মবিশ্বাস তাই অপরিচিত হয়নি। অবশেষে একদিন জুটে গেল সরকারি চাকরি।আপার ডিভিসন ক্লার্ক।মাইনে ভালোই। আনন্দে আত্মহারা সুবোধ বুঝেছিল,এটা সবিতার ভালোবাসারই জয়।

অবশেষে চারহাত এক হলো ওদের এক মায়াবী সন্ধ্যায়।বেশ চলেছিল মাস ছয়েক।তারপরই শুরু হলো একটু একটু করে মনোমালিন্য। সুবোধের গরীবীর পরিধিতে মানিয়ে নিতে অসুবিধা হতে লাগলো সবিতার। ওর বাবা মা পূর্ণ সুযোগ নিলো পরিস্থিতির। এদিকে পেটে তখন অনুভব এসেছে। ওর মা মেয়ের দেখভালের জন্য নিয়ে চলে গেল ওকে ওদের কাছে। সুবোধ এতে খুব একটা বেসুরো কিছু দেখেনি। কিন্তু আস্তে আস্তে সবিতার বদল চোখে পড়তে লাগলো। কারণে অকারণে ওর গরীবীর খোঁটা দেওয়া শুরু হল। সুবোধের শ্বশুরবাড়ি যাওয়াও কমে গেল।পরে জানতে পারলো,এর কারণ সবিতার মা। বাচ্চাটাকে নষ্ট করতে চেয়েছিল ওরা। শেষ মুহূর্তে সবিতা রাজি হয় নি।এই জন্য সবিতার সব দোষ সুবোধ মাফ করে দেয় অক্লেশেই ।ওর জন্যই আজ সুবোধের প্রাণের অনুভব ওর বুক জুড়ে।অপত্যের নিবিড় বাঁধন শুধু টেনে নিয়ে যায় সুবোধকে অদৃশ্য সুতোয়।                                                                              ও শুধু সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।জানতো, এ দূরত্ব দীর্ঘস্থায়ী হবে না। একদিন না একদিন বরফ গলবেই। সুযোগও একটা পেয়েও গেল সুবোধ ওদের সাথে দেখা করার।ছেলের দশ বছরের জন্মদিন !সবিতা একটু ধুমধাম করে পালন করতে চায়।তাই আজ সুবোধের নিমন্ত্রণ।

     এজন্যই পথভোলা এক পথিক আজ সুবোধ ! অফিস থেকে আজ কাটোয়ার এই কুড়ুম্ব গ্রামের পথে ও।আজ মাইনের টাকাও পাওয়া গেল।তাই হাত খুলে খেলেছে সুবোধ ।বউ সবিতার জন্য শাড়ি, ছেলে অনুভবের জন্য নিউ মার্কেট থেকে কেনা মাউথঅর্গান, ক্যাডবেরি সেলিব্রেশন এর একটা প্যাকেট। মাছের বাজারের পাশ দিয়ে আসতে গিয়ে পেয়ে গেল ইলিশ। অনেক দিন ওর খাওয়া হয়নি। তাছাড়া ছেলে অনুভব খুব ভালোবাসে ইলিশ মাছ ভাজা। শ্বশুরবাড়ির বড় গুষ্টি।তাই জোড়া ইলিশই নিতে হল। সুবোধের মনে হল জামাইয়ের ইলিশ ঝুলিয়ে শ্বশুরবাড়ি ঢোকা বেশ জমে যাবে। শ্বশুরবাড়ির সাথে সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে এখন।তাই ইলিশ জোড়া ভবিষ্যতের জমাট সম্পর্কের বিনিয়োগ হতে পারে, ভাবল একবার।

      হঠাৎ এক বিজাতীয় আওয়াজ: ইলিশ কতো করে নিল?

আওয়াজটা যেন কানের একদম কাছে । সুবোধ স্পষ্ট শুনল, চন্দ্রবিন্দুর আধিক্য। একটু গা ছমছম করে উঠল ওর। নুপুরের আওয়াজ আরো জোরে কানে বাজছে। দ্রুত পা চালাল সুবোধ। আওয়াজটাও যেন দ্রুত হচ্ছে।তাকিয়ে দেখল, সামনে জনহীন প্রান্তর। সন্ধ্যে আস্তে আস্তে কালো রাতের গায়ে ঢলে পড়ছে। অনেক দূরে গ্রামের আলো টিমটিম করছে। মনে হল,এরাই এ মুহূর্তে ভরসার আলো। কিন্তু তাও তো প্রায় দু মাইল দূর!

       এই বাঁশ বাগান নিয়ে অনেক গা ছমছম গল্প আছে। একবার এক ব্রাহ্মণ কালীপূজোর পাওনা একটা পাঁঠার মুড়ি নিয়ে ফিরছিল।এই বাগানের কাছে আসতেই নাকি সুরে আওয়াজ : “মাংস খাবো।ও বামুন, মাংস খাবো।”ব্রাহ্মণ গায়ত্রী মন্ত্র জপ করতে করতে জোড়ে পা চালান। হঠাৎ একটা গাছের ডাল তার মাথায়। পাঁঠার মুড়ি ছিটকে কিছুটা দূরে। বিস্ফারিত চোখে তিনি দেখলেন মুড়ি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।ভয়ে অজ্ঞান ব্রাহ্মণকে সকালে পথচলতি মানুষ আবিস্কার করে।

         ভূত পেত্নীর প্রমাণ নাকি আরও আছে। অনেকে দল বেঁধে হারিয়ে যাওয়া গরু ছাগল খুঁজতে বনে গিয়ে হাড়গোড়, ছেঁড়া মাংস পড়ে থাকতে দেখেছে।দিনের বেলা জমিতে কাজ করতে করতে অথবা রাস্তা পার হবার সময় মহিলার তীক্ষ্ণ কান্নার আওয়াজ শুনেছে অনেকে।এই বাঁশ বাগানের লাগোয়া পুকুরে লাশ ভাসত একসময়।ডাকাতরা মা কালিকে নরবলি দিয়ে ডাকাতি করতে বের হত। বাঁশ বাগানের লাগোয়া এক গভীর জঙ্গল আছে। জঙ্গলের মাঝে এখনও ভাঙ্গাচোরা এক মন্দির আছে ।ঐটাই নাকি ছিল ডাকাতকালির মন্দির। জনশ্রুতি,ঐ গলাকাটা লাশগুলোই আজ ভূতের তান্ডব করে বেড়ায়।  প্রতিশোধ নেয় পথচলতি নিরীহ মানুষগুলোর ওপর।

      হঠাৎ একটা ঠান্ডা দমকা বাতাস যেন ধাক্কা মারল সুবোধের গায়।ঠেলে ফেলে দিতে চাইছে রাস্তায়।পা টলোমলো। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। ডানহাতে ছাতা ধরা ।বাঁকাধে অফিস ব্যাগ।ব্যাগ ভিজে চুপচুপে। ভিতরে অফিসের কাগজগুলোরও এক অবস্থা নির্ঘাৎ। বাঁহাতে জোড়া ইলিশ ঝুলছে দড়ির আশ্রয়ে। ইলিশের গন্ধে ভূত আজ নটরাজন !

      জোরে পা চালাল ও। পায়ে লেগেছে ভয়ের তাড়ণ।দমকা হাওয়ায় ছাতা গেল উড়ে। মনে হল ,কে যেন কেড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল বিরক্তিতে। কাঁধের ব্যাগে পিছন থেকে টান। এগোতে পারছে না ও।পিছনের টান এগোতে দিচ্ছে না, স্পষ্ট বুঝতে পারল । ঈশ্বরের নাম অবরুদ্ধ কন্ঠে। মৃত্যুর এক বিচিত্র অনুভব ! এবার নাকি সুরে যেন  আরো জোরালো চ্যালেঞ্জ :”মাছজোড়া দে না রে খাই।ও মানুষের পো, মাছজোড়া দে না রে।” শেষে কান ফাটানো বিকট হাসি।এবার স্পষ্ট শুনতে পেল , হাসিতে সঙ্গত দিচ্ছে আরো হাসি। তাহলে দলবল চলে এসেছে ! 

        ভয়ে হাড় হিম হয়ে আসছে যেন ওর । জোরে জোরে চিৎকার করতে লাগল সুবোধ :”বাঁচাও, বাঁচাও।আমায় ভূতে খেলে গো।কে আছো বাঁচাও।”নিজেই বুঝতে পারল, ভয়ে -কাঠ গলা সরব নয়। ওর ম্রিয়মাণ চিৎকার যেন আরো উৎসাহিত করল দলবলকে। আবার পিছন থেকে ধাক্কা। শিকারী শিকার নিয়ে খেলছে। রাম নাম উচ্চারণ চলতে লাগল ওর। 

    হঠাৎ কয়েকটা সাদা কাপড় সামনে।তার পথ আগলে। নুপুরের আওয়াজে নাচের ছন্দ।কোমড় জড়িয়ে সাদা কাপড়ের সাঁওতাল নাচ।সুবোধ বুঝল ,এবার শেষ দৃশ্যের অভিনয় চলছে। রক্তগোলার মতো চোখগুলো যেন নাচের তালে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। ভয়ঙ্কর সব চেহারা সামনে।আজই তাহলে  জীবনে শেষের কবিতা !  নাচের তালে চন্দ্রবিন্দুরা বলছে : “মাছ মাংস দুটোই খাব।কি মজা ! কি মজা ! মাছ মাংস দুটোই খাব। জ্যান্ত মরা দুটোই খাব।হি হি হি হা হা হা !”

      আর লড়াই করতে পারছে না সুবোধ।জোর ধাক্কায় ব্যাগ ছিটকে পড়েছে রাস্তায়।কাদা মাখামাখি। অফিসের মাইনের টাকাটা ভেতরে। নিচু হয়ে তুলতে গেল।ব্যাগ শূণ্যে লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে।হাতের নাগালের বাইরে। দুহাতে শেষ সম্বল মাছদুটোকে চেপে ধরল বেঁচে থাকা শক্তিটুকু দিয়ে। এবার মাছের দড়িতে টান শুরু হল। সুবোধ বুঝল, খেলাটা এবার শেষ করতে চাইছে বিপক্ষ। ও যত টানে, বিপক্ষের টানও তত প্রবল হয়।টাগ অব ওয়ার। হঠাৎ মগজাস্ত্র সক্রিয় হল।জামার ভেতর থেকে পৌতেটাকে বার করে জড়িয়ে দিল ও মাছের সঙ্গে। উল্টোদিকের টান আর নেই। “রাম, রাম ” জপ চলছে। বিরক্ত ভূতের উদ্ধত আওয়াজ ” ও! আমাদের ভয় দেখানো ! তবে এবার সামলা ।” সামনের গাছের একটা ডাল উড়ে এসে পড়ল মাথায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত। ভেসে যাচ্ছে শরীর।অবশ হয়ে পড়ছে সারা দেহ।ইলিশজোড়া বুকের জামার ভেতর ঢুকিয়ে দিল সুবোধ শেষ শক্তি দিয়ে। শেষ চেষ্টা !

          প্রায় বুজে যাওয়া চোখ মেলে দেখল ,রক্তমাখা মুখগুলো মাটিতে পড়ে থাকা ওর গায়ের রক্ত চেটে চেটে খাচ্ছে।বীভৎস দৃশ্য ! আঁতকে চোখ বুজে ফেলল ও। ভূতগুলো জামাটা ছিঁড়তে চাইছে।আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না সুবোধ।ছেলের মুখটা চোখের তারায়।আর দেখা হলো না ।অলবিদা অনুভব !অলবিদা সবিতা ! ভালো থেকো সকলে। মায়ের বুকফাটা কান্নার আওয়াজ যেন কানের ভেতর।

          সুবোধ বুঝতে পারছে তার শরীরটাকে  রক্তখেকোগুলো শূণ্যে তুলে ধরেছে মাছের দখল নেবে বলে।তার শরীর দিয়ে যে ইলিশ ঢাকা! ঘাড়ের কাছে জোড়ালো কামড়।ঘাড় মটকে রক্ত খাবে।হাত ছুঁড়ে ছাড়ানোর শেষ চেষ্টা করল।পারল না। দাঁতগুলো গভীরে ঢুকেছে।জিভ চকচক রক্ত চোষার আওয়াজ কানে। পেটের কাছ থেকে মাছ উধাও।পৌতে উধাও আগেই ! পৌতেহীন সুবোধের শরীর নিয়ে তাই ওরা যেন সার্কাসের বলের মতো লোফালুফি খেলছে।মাছ খাওয়ার উত্তেজনায় সব পৈশাচিক আওয়াজ তখন ভূতেদের !

       হঠাৎ সুবোধের শরীর উড়ে গিয়ে পড়ল পাশের পুকুরের মাঝে। ছয় ফুটের পেশী বহুল শরীরের সলিল সমাধি হচ্ছে। চিৎকার করে বাঁচার চেষ্টায় হাত পা ছুড়তে লাগল ও। যদি ভেসে ওঠা যায়! হঠাৎ হাতের কাছে নরম কি একটা পেল। গাছের ডাল ? শক্ত করে চেপে ধরল বাঁচার অন্তিম চেষ্টায়। খুব শক্ত করে শরীরের অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে জাপটে ধরছে ও………

         হঠাৎ কানের কাছে ” বাঁচাও, বাঁচাও” চিৎকার!চোখ খুলে দেখল সবিতার গলা দুহাতে জড়িয়ে ধরে ও। জিভ যেন বেড়িয়ে আসছে সবিতার। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ।ছেলে অনুভব ঘুমভাঙা চোখে ভ্যাবচ্যাক ।সুবোধের হৃদয়ে তখন মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার আনন্দ। বুঝল, রাতে ইলিশ পাতে শোনা গল্পের ভূতেরা জ্যান্ত হয়েছে ঘুমে। বাঁচার আনন্দে দুজনকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল ও ভালোবাসার অমৃত স্নানে।

ভূত ও ইলিশ ককটেল ছোট গল্প – সমাপ্তি

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!