কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

হৈমন্তীর মন

হৈমন্তীর মন ছোটো গল্প – সৌমেন দেবনাথ

চোখে কাজল এঁকে, ঠোঁটে লাল প্রলেপ বসিয়ে, উন্মুক্ত কেশের উপর বকুলফুলের মালা গেঁথে, অলংকারে সর্বাঙ্গ আচ্ছন্ন করে হৈমন্তীর স্বাভাবিক শ্রীকে যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে বিনাশ করার জন্য। চির নীরব হৃদয়ের মধ্যে একটা অসীম অব্যক্ত ক্রন্দন, দুই চক্ষের পত্র পল্লবের বাঁধা ডিঙিয়ে অশ্রু বের হয়ে এলো। চক্ষু দুটি ক্রোধাগ্নি ব্যক্তির মতো লাল-রক্তিম হয়ে গেছে, নাক সর্দি লাগা লোকের মতো লালিমা হয়ে গেছে। এতে তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য ন্যূন না কমে বরং বিকশিতই হয়েছে। যেমন পরিপূর্ণ বয়স, তেমনি পরিপূর্ণ সৌন্দর্য। যেন শরৎকালের রোদের মতো কাঁচা সোনার প্রতিমা, সেই রোদের মতোই দ্বীপ্ত, উদ্বীপ্ত; তার দৃষ্টি দিনের আলোকের ন্যায় মুক্ত, উন্মুক্ত; নীরব শান্ত নদীর মতো শান্ত, নিস্তব্ধ। দীঘল কেশের উপর বকুলফুলের মালা হেলে দুলে খেলছে। ঘ্রাণে ঘরটা স্বর্গের রাজধানী অমরাবতীতে পরিণত হয়ে আছে। বিশ্বকর্মা অতিশয় সলজ্জ সজীব সৌন্দর্যের এই মেয়েটিকে মাত্র নির্মাণ করে যেন জগৎ মাঝে ছেড়ে দিয়েছেন। বয়স ঠিক করা মুশকিল। শরীরটি ডাগরের ন্যায় বিকশিত কিন্তু মুখটি এত কাঁচা লাগে যেন রোদের তাপ, কাজের চাপ, কষ্টের কালি বা চিন্তার চিহ্ন তাকে লেশমাত্রও স্পর্শ করতে পারেনি। সে যে যৌবনের বনে পা ফেলে মৌরানী হয়ে গেছে এখনো নিজের কাছে সে খবর যেন পৌঁছেনি। হৈমন্তীর রূপের উপর পিতামাতার একমাত্র ভরসা। বরপক্ষ যদি হৈমন্তীর সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে বিনাপণে গ্রহণ করেন তবেই পিতামাতার রক্ষা। জলের কাদায় বেড়ে উঠা জলপদ্মকে তাঁরা ডাঙায় রোপণ বা স্থানান্তর করতে যাচ্ছেন। রূপধন্যা ধরণীর মানুষের কাছে রূপের কদর খুব বেশি। তাই অপরূপ রূপবতী হৈমন্তীর বরপক্ষকে মন ভোলানোর জন্য এত সাজানোর প্রয়োজন মোটেও ছিলো না। একটা অতি নিগূঢ় মায়াবিনী চিত্র বা আভা তার মুখ জুড়ে বিরাজ করছে। মুখশ্রী সম্পর্কে অধিক কিছু কী বলবো! বনশ্রীর শুভশ্রী মেখে আছে মুখমণ্ডল জুড়ে, লাগে দেবশ্রী, অতুল্য মুখশ্রী, রূপশ্রীতে তার জয়জয়কার। কেবল মুখাবয়বে এই একটি অসামান্যতা বা ঘাটতি আছে যে, দেখলেই ঐ দ্বিধা জাগবে যেন বনের ত্রস্ত হরিণী। এই একটি মেয়েকে স্রষ্টা এত যত্নে, এত মহিমা ঢেলে, মনের মাধুরী মিশিয়ে, আপন খেয়ালে ফুলের মতো সুকুমার করে নির্মাণ করেছেন যে, দেখলেই বিস্ময় জাগে। তারপর জন্ম তার দরিদ্রতার সংগ্রাম প্রকোষ্টে। কিন্তু এই সংগ্রাম জীবনের আঁচই চেহারায় রূপের চেয়ে লাবণ্যকেই বাড়িয়েছে। সৌন্দর্যে বিবেক বশে, সৌন্দর্য বিবেক নাশে, সৌন্দর্য সীমিতই কী শ্রেয় নয়! হৈমন্তীর সৌন্দর্য কী বাড়াবাড়ি রকমের নয়? যাকে বলা যেতে পারে ঈশ্বরের বেশিবেশি। ওর সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ জনের অভাব নেই, বিমুখ জনের অভাবও নেই। অন্যায় রকমের এই সৌন্দর্য যে কারো মনে হিংসার জন্ম দেবে। আবার সৌন্দর্যে ভরা মানবীর কী অভাব ধরাতলে? পুরুষ চায় মেয়েদের রূপে ও মনে একত্রে মাধুর্যময়তা যেটা হৈমন্তীর মাঝে মোটেই কম নয়। রূপ-মাধুর্যে কত বেশি আগুয়ান হৈমন্তী, হয়ত হৈমন্তী জানেই না বা নিজে জানার চেষ্টাও করেনি। বিধাতাপ্রদত্ত রূপ আর রূপের বারতা নিয়ে অহমিকা প্রকাশের মাঝে আত্ম-আহম্মকী ছাড়া কিছুই নেই, হয়ত হৈমন্তী মনে-প্রাণে সেটাই ধারণ করে। বিধাতা নিজের আনন্দে গড়ে, নিজের খেয়ালে আবার ভাঙে, নিজের হেঁয়ালে আবার কাড়ে। হঠাৎ হৈমন্তীর ডাগর দুটি চোখ মোটা মোটা জলের ফোঁটায় আবার ভরে গেলো। চোখের জলের যেন কোনো দামই নেই, ও ঝরিয়েই চলেছে। মনের মানুষের নিষ্পাপ মুখের প্রতিচ্ছবি চোখে কেবলই ভাসছে। চিন্তায় হৈমন্তী অনাবৃষ্টির দিনে ফুলের কুঁড়িটির মতো একেবারে বিমর্ষ হয়ে পড়েছে, নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছে। নব জোয়ারের তেজে ঝকমক তনুলতাতে নিস্তেজতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নবরোপিত চারা জল না পেলে যেমন নেতিয়ে পড়ে, হৈমন্তীর অবস্থা এখন তেমন। মুখে গাঢ় একটা চিন্তার রেখা। পলকহীন ভাবে যেদিকে তাকাচ্ছে সেদিকেই একদৃষ্টে চেয়ে থাকছে। পাশে বেশ কজন সখী তাকে ঘিরে মজা করছে। কিন্তু তার মনের ভেতর দিয়ে যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে তা জানছে না বৃক্ষরাজি, জানছে না স্রোতস্বিনী নদী; সেখানে মানুষের বোঝার সাধ্য কই!
কনে দেখতে বরপক্ষ এসে উপস্থিত। বারান্দায় তাঁদের বসতে দেয়া হলো। হৈমন্তীর হৃদয়ে প্রকম্পন শুরু হলো। নিজের সৌন্দর্যকে সে গালি দিচ্ছে, কেননা তাঁরা তো তাকে অপছন্দ করে যাবার কারণ পাবেন না। প্রারম্ভিক কথা সেরে হৈমন্তীকে ডাকা হলো। সখীরা তাকে অতি যতনে রেখে গেলো। নতুন আত্মীয়দের সাথে রবীন্দ্র ছাড়াও আরো দুইজন যুবক ছিলো। ও দুইজন যুবকের নজর মাটিতেই আর পড়ে না। সলজ্জ তারা, তবুও নির্লজ্জের মতো চেয়ে চেয়ে দেখছে। চেয়ে দেখতে নেই মানা। মেয়ে দেখতে এসে লজ্জায় না দেখার লোক তারা নয়। স্বপ্নেও এমন নারী তারা দেখেনি যেন! টকটকে লাল শাড়িতে হৈমন্তীকে লাগছে লালপরী। বারান্দাটাও রক্তবর্ণ হয়ে গেছে। ছিপছিপে চেহারায় বিদ্যুতের চমক। চোখে ধাঁধাঁ লাগে। কপালে কালো টিপ, চোখে কাজলের রেখা মুখটিতে দিয়েছে চমৎকার মুগ্ধতা। এক যুবক শাড়ির উপরে যে জরির রশ্মি ঝলমল করছে এক মুহূর্তের মধ্যে দেখে চোখ নামিয়ে নিলো। দেখলেই মন আনমনা হয়। মন বলে দেখছো না কেনো, স্বর্গ থেকে দেবী সম্মুখে নেমে এসেছে। রক্তের ন্যায় রক্তিম পদপল্লব। খুব সুন্দর একটা ভঙ্গি নিয়ে চেয়ারে বসেছে। হাত দুটো হাঁটুর উপর। ঐ হাতের দিকে নজর নিক্ষিপ্ত করে হৈমন্তী বসে আছে। এক বৃদ্ধ মাথা তুলতে বললেন। চোখ দুটো খুলতে বললেন। হরিণীনয়না হৃদয় হরণা। দৃষ্টিশক্তির স্বচ্ছ আলো জ্বলজ্বল করছে, মুখের মধ্যের আকর্ষণীয় একটি। দেখে এক যুবক কী একটা বিস্ময়সূচক শব্দ উচ্চারণ করলো। তা শুনে হৈমন্তী তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। ঠেকলো শাণ দেয়া ছুরির মতো। ঘোমটা মেলতে বললেন অন্য আর এক বৃদ্ধ। ঐ চুলে চমক দিচ্ছে ভ্রমরকৃষ্ণ কালো বর্ণ। একটু দাঁড়াতে বললেন। উচ্চতায় অন্যতম। দশ জনের মধ্যে দাঁড়ালে বোঝা যাবে ঐ তো হৈমন্তী। সরল সোজা প্রশ্নের কিছু উত্তর দিলো। কী তার মায়াবী মুখের বচন! মধুমিশ্রিত উক্তি প্রাণ হরণ করে। এবার হেটে ঘরে চলে যেতে বললেন। হৈমন্তী পায়ের নূপুর বাজিয়ে নিক্বণে নিক্বণে ঘরে চলে গেলো। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্র সূক্ষ্মভাবে হৈমন্তীকে পর্যবেক্ষণ করেছে। যে দুইজন যুবক ছিলো তাদের অন্তরদ্বয় ছটফট শুরু করলো। আর একটু সময় থাকতো! রূপমুগ্ধ মন রূপ দেখে তৃপ্ত হয় না। শান্ত হয় না। দেখলে চোখের জ্যোতি বাড়ে, মনের আরাম বাড়ে, প্রাণের আরাম বাড়ে।হৈমন্তীকে তাঁরা পছন্দ করেছেন। অবশ্য পছন্দ না হবার কারণ তাঁরা খুঁজে পাননি। কারণ খোঁজার চেষ্টাও করেননি। এক টাকার কাঁচা পয়সা পড়ে থাকা দেখলে মানুষেরা ফেলে যান না, তাঁরা হৈমন্তীকে ফেলে যাবেন ভাবাও দুষ্কর। পণবিহীন তাঁরা রাজি। হৈমন্তীকে যে পাবে সাথে পণ চাইবে এমন অবিবেচক নয় সে। দিন তারিখ নির্ধারিত হলো। জলের থেকে মাছ উঠানো হলে যেমন মাছ ছটফট করে হৈমন্তীর অস্থির মনটাও তেমনি ছটফট করছে। পুঁটির প্রাণ হলে মরেই যেত। তাকে এই অবাধ বিচরণের ক্ষেত্রশালা থেকে কোনো এক অজানা বন্দীশালায় প্রেরণের বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। প্রকৃতিতে যে সয়, কংক্রিটে সে রয় না। হৈমন্তী প্রকৃতির দেবী, উন্মুক্ত এই আকাশ তলেই তার রূপের পূর্ণ পরিচয়, তাকে কোনো রাজপ্রাসাদের রানী হলে মানাবে না। এ্যাকুয়ারিয়ামে মাছকে যতই সুন্দর লাগুক, সেটা মাছের স্বাভাবিকতা নয়। স্বাভাবিকতাতেই প্রকৃত সৌন্দর্য ফোঁটে। সোনার ফুলদানির চেয়ে বাগিচাতেই ফুলকে বেশি আকর্ষণীয় লাগে। যে ফুল বাগিচায় বাড়ে, টবে সে ম্রিয়মাণ হবেই। হৈমন্তীর যার সাথে বিবাহ হতে যাচ্ছে সে হৈমন্তীর মন পাবে, না রক্তে মাংসে গড়া হৈমন্তীকে পাবে? তার হৃদয় সে তো এই খোলা পরিবেশে বিলিয়ে দিয়েছে। বনের পক্ষী কূজন বন্ধ করে হৈমন্তীর মিষ্টিমিশ্রিত কণ্ঠের গান শোনে, বনের গাছপালা কম্পন থামিয়ে অবাকদৃষ্টে ঐ চন্দ্রময় বদনের দিকে চেয়ে থাকে। সন্ধ্যায় তরুচ্ছায়াঘন নির্জন পথ তার পদধূলি পেয়ে, এত দেরী করার অপরাধ থেকে ক্ষমা করে দেয়। হৈমন্তীর সব অপরাধ আরও একজন ক্ষমার দৃষ্টে দেখে। অবশ্য ক্ষমা না করেও পারে না, কেননা মনের মানুষের অভিমান ভাঙানোর ক্ষমতা হৈমন্তীর প্রবল। আর হৈমন্তীর মুখপানে না তাকিয়ে অভিমান করে থাকা কী সম্ভব? অলোকসুন্দরী ফুলকুমারী হৈমন্তীর হৃদয় মন্দিরে যে আসন পেয়েছে সে অপু। হৈমন্তীকে দর্শনমাত্রই অপুর মেঘমুক্ত আকাশে শরতের সূর্য কিরণ ঘটে। অপু অবাক হয়, বিস্ময়ে অভিভূত হয়। মনের মলিনতা দূরীভূত হয়। চক্বিত চেয়ে থাকে। পুলকোচ্ছ্বাসে চিত্ত বিমোহিত হয়ে যায়। মনের মধ্যে যার ছবি আঁকা সেই ছবি যদি সম্মুখে আসে, ছবির মত অবিচল চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকে, ঐ মায়াবিনী চোখের ভাষা যদি তার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হয়, তবে অপুর কঠিন হৃদয়ে প্রস্রবণ বয়ে যেতে কেনোইবা দেরী করবে! অপু হৈমন্তীকে যতবার বুকে জড়িয়ে নিয়েছে ততবারই ভেবেছে, আমি সত্যই কী হৈমকে বক্ষ পিঞ্জরে ডানা দিয়ে বেঁধেছি, না স্বপ্ন দেখছি! এ যে দুর্লভ, আমি তাকে সুলভে পেয়েছি। দুর্লভ্যকে সুলভে পেলে পাওয়াতে খটকা লাগে। অপুর সৌন্দর্যময়, আলোকময়, সংগীতময় রাজ্যে কখনো কখনো এমন ভাবনাও উদিত হয়। আবার ভাবে, না, হৈম আমার ঐশ্বর্যের উজ্জ্বল মূর্তি। আমার প্রাণ প্রতিমা। একে অন্যের একে অপরের নয়নের মণি। পরম পাওয়ার মধ্যেও দ্বিধা থাকে, কারণ পরম পাওয়াতে বিশ্বাস স্থাপিত হতে চায় না।যেদিন অপুর সাথে হৈমন্তীর প্রথম দর্শন হয় সেদিন হৈমন্তী তৃণশয্যায় শয়নে ছিলো। একটি তৃণ ছেদন দাঁতে পিষ্ট করতে ব্যস্ত ছিলো। ছাদসদৃশ আম গাছ তাকে ছায়া প্রশান্তি প্রদান করছিলো। ও যেন কাননের পোষা হরিণ। কানন মাঝের সৌন্দর্যে ডুবে থাকতে পছন্দ করে। আগন্তুক শিকারী অপু সেদিন হৈমন্তীর সম্মুখে পড়ে যায়। হৈমন্তীকে দেখামাত্রই তার ফাগুনের রোদের কথা মনে পড়েছিলো। একে সে যেভাবে হোক শিকার করবেই পণ করেছিলো। প্রথম দেখাতে অপুকেও হৈমন্তীর মনে ধরেছিলো। শ্যামলা রঙের অপুর ভ্রূ জোড়া খুব ঘন, চোখ দুটো পোষা প্রাণীর মতো। পাখি শিকার নেশা হলেও চোখে শিকারী ভাবটা ছিলো না। হৈমন্তীর দিকে বিনাসংকোচে তাকিয়ে ছিলো। দেখতে নেহাত ভালো মানুষের মত। হৈমন্তী অপুকে দর্শনমাত্র উঠে বসে। পিঠের বেণি করা চুল সম্মুখ বুকের উপর আছড়ে পড়ে। নিমেষ নয়নে অপুকে দেখে নজর নামিয়ে নেয়। অপু স্তম্ভিত হয়ে গিয়ে ভেবেছিলো, বিধাতা, আমাকে যেন ও শত্রু না ভাবে, কত মায়াবিনী ও, কত মায়ায় মোড়া তার ঐ চোখ, ঐ চোখে যদি শত্রু বলে বিবেচিত হই, তবে সত্য বলে পৃথিবীতে আর কিছুই থাকবে না। তোমাকে জয় করার প্রবল ইচ্ছা আমার পেয়ে বসেছে। তোমার ঐ অপরূপ রূপ-মাধুর্যের ভাগিদার হওয়ার আমি কী যোগ্য!অপু চমকে উঠে বাস্তবতায় ফেরেছিলো। সম্মুখে আর নেই সেই হঠাৎ দেখা মায়া-হরিণী। ঐ যে নেশা পেয়ে বসেছিলো অপুকে। শিকারের আশায় নিয়ত তাই এদিকেই তার যাত্রা থাকতো। দুইদিন পর পর না দেখতে পেয়ে অপু ভেবেছিলো, বিধাতা কী আমাকে আলেয়ার আলোয় ডুবালো?তৃতীয় দিন থেকে দেখা নিয়মিত হতে শুরু করে। কেউ কারো সাথে কথা বলে না। কিন্তু দুইজনের দেখা ঠিকই হয়। দুইজনের দেখা কেনোই হবে সেটাও প্রশ্ন! অন্যের হৃদয় জয়ের সুতীব্র ক্ষমতা ছিলো অপুর। ছলে বলে নয়, কুট কৌশলে নয়, হৃদয়ের ঐশ্বর্য দিয়ে অপু আকর্ষিত করে ফেলে হৈমন্তীর। কত এসেছে অপু, দাঁড়িয়ে দেখেছে দূর থেকে, কত কথা হয়েছে মনে মনে, হত না কথা মুখে। প্রত্যহ প্রথম দেখাতেই এক অমিয় হাসি দিত অপু। অপুর হাসিতে হেসে উঠতো হৈমন্তী। পালিয়ে ঘরে এসে ঐ হাসি মুখের ছবি নয়ন মাঝে জাগিয়ে সারারাত স্বপ্নের মালা গাঁথতো। এরপর থেকেই অপু তার হৃদয় মন্দিরের হৃদয় দেবতা। বনপাখি শিকারে এসে মনপাখি শিকার করে ফেলে অপু। মনপাখি বনদেবতাকে শপথ করিয়েছে আর যেন কখনো বনের উড়ন্ত বিহঙ্গকে শিকার না করে।
বরপক্ষ দিনক্ষণ পাকা করে যাওয়ার পর থেকেই হৈমন্তীর ঐ স্বতঃস্ফূর্ত মনে কেবলি অস্থিরতা বিরাজ করছে। মা বাবাকে বলতে চাচ্ছে, তোমরা আমাকে নির্বাসন দিও না। এই মুক্ত পরিবেশের প্রকৃতি দেবতার বক্ষ থেকে ছিন্ন করে আমাকে কোনো বদ্ধ পরিবেশে প্রেরণ করো না। হঠাৎ হৈমন্তীর অপুর সেই ঢলঢল দুখানি বড় বড় চোখ, চোখের কালো কালো তারা, ঘনকৃষ্ণ পল্লব, স্থির স্নিগ্ধ দৃষ্টির কথা মনে পড়ে গেলো। অপুর দর্শন না থাকায় এ কদিনে বিকশিত পুষ্পটি জীর্ণ হয়ে গেছে। আজ বকুলতলের তৃণবুকে সন্ধ্যাক্ষণে প্রতিমার মত দাঁড়িয়ে ছিলো। কিশোরী হৃদয়ের সবটুকু অংশীদার হয়েও কেনো অপু দূর বাস করছে? তখনকার হৈমন্তীর মনের ভাষাকে লেখায় প্রকাশ অসম্ভব ছিলো। 
রবীন্দ্রর আবদ্ধ প্রকোষ্টে হৈমন্তীর আজ থেকে যুগল বাসের যাত্রা শুরু। উন্মুক্ত আকাশের মুক্ত পক্ষীকে সে খাঁচায় বন্দী করলো। সে মন্ত্র বলে হৈমন্তীকে পেলো। এবার শুভদৃষ্টির প্রাক্কাল। রবীন্দ্র হৈমন্তীর লম্বা ঘোমটা খুলে ঝড়ের মতো কেঁপে উঠলো। একদিন দেখে সে অতৃপ্ত ছিলো। দেখার নেশায় তাই পেয়ে বসেছিলো।  এখন থেকে প্রত্যহ অহর্নিশ দেখে দেখে তৃপ্তি নেবে। দেখার মাঝেও দেখার বাকি থেকে যায়, হৈমন্তীকে দেখলে সেটাই বোধ হয়। চন্দ্রময় বদনের ঝলকে পুষ্পশয্যার ঘর আলোকিত হয়ে উঠলো। হৈমন্তীর রমণী হৃদয় থেকে কী এক অভূতপূর্ব শোভা, কী অভাবনীয় লাবণ্য বিচ্ছুরিত হচ্ছে! জগদাত্রীর মতো রূপ, একি সত্যি বাস্তবিক! রবীন্দ্র হৈমন্তীর এ রূপকে সংগায়িত করতে পারছে না। রূপের কী বর্ণনা হয়! রূপের কী বর্ণনা করা যায়! হৈমন্তীর হাত দুই ধরতেই রবীন্দ্র বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলো। চমকে উঠে রবীন্দ্র নিজেকে সামলে নিলো। ভাবলো, আগে মন জয়, পরে হাত। মগজ জয় করলে পুরো অবয়ব মেলে। নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে রবীন্দ্র মনে মনে হাসলো। মন্ত্রবলে হৈমন্তীর সব পাওয়া সম্ভব নয় রবীন্দ্র বুঝে ফেলেছে। তবে যতটুকু পেয়েছে তাতেই আপাতত সন্তুষ্ট। হৈমন্তীর ভালোবাসা থেকে যদি সে বঞ্চিত হয় তবে তার সান্ত্বনার কিছু আর থাকবে না। অভাগাদের একজন হয়ে যাবে।
অপুর আসতে অনেক দেরীই হয়েছে। ঝড় থেমে গেছে আর চিহ্ন রয়ে গেছে। পুরো কাননের গাছপালা হৈমন্তীর অনুপস্থিতিতে আছাড়ি-পিছাড়ি খেয়েছে। সেই পূর্বের বনশ্রী আর নেই। বাগিচাই নতুন কোনো ফুলও ফোঁটেনি। ফুটন্ত ফুল গুলোও মাথা নুয়ে আছে। যেন ওরা অনশন করেছে। নেই ভ্রমরের গুঞ্জণ ধ্বনি। হিল্লোলে তরুপল্লব কাঁপছে না। প্রকৃতি যেন ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। অপুর বুঝতে আর বাকি থাকলো না। প্রকৃতি দেবী প্রকৃতিকে ছেড়ে চলে গেছে। ফুঁটো ফুটবলের মতো অপুর মনটা চুপসে গেলো। জীবনের প্রাণ প্রতিমা হৈমন্তী তার জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে। যে ছিলো সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে কাছের মানুষ, যাকে ঘিরে দীঘল স্বপ্নের জাল বোনা, সেই বনদেবী, কাননশ্রীর কানন দেবী হৈমন্তীকে অপু যে হাজার লক্ষ অপরিচিত মানুষের মধ্যে হারিয়ে ফেললো। অপুর আশা ভরা প্রেম আকাশে মুহূর্তের মধ্যে মেঘ এসে রাজত্ব শুরু করলো। অমাবস্যার ঘোর আঁধারে তার চন্দ্রালোকপ্লাবিত অসীম আকাশ নিমজ্জিত হয়ে গেলো। যাকে দেখলে নক্ষত্রলোকের মতো মনের মধ্যে আলোকপুঞ্জ জ্বলজ্বল করে উঠতো তাকে হীনা হৃদয় আকাশ ভাবনাহীন। ওদিন ও সন্ধ্যা পর্যন্ত ঐ বকুলতলের নিচে অপেক্ষায় ছিলো। অপেক্ষা তার নিরাশায় পর্যবেশিত হয়।
হৈমন্তী বদ্ধ ঘরে সারাক্ষণই অপুর বিশ্বাস ভরা সরল মুখের কথা ভাবে। আর অফিসে রবীন্দ্র অস্থিরভাবে ভাবে হৈমন্তীকে। এদিকে অপু বসে বসে হৈমন্তীর নানান বিপদের আশঙ্কা করে, সকল বিপদ থেকে সে যেন সুস্থ থাকে। হৈমন্তী রবীন্দ্রর থেকে পরিত্রাণ পেতে চায়। সামাজিক এই বন্ধন ছেদ করা ছেদন দাঁতের ক্রিয়ার মতো সহজ নয়। রবীন্দ্র হৈমন্তীর সকল মনোবাসনা পূরণ করতে পারে, তাই বলে এটা সে কোনক্রমেই করতে পারে না। খেয়ালি মনের খেয়ালি বাসনা পূরণ করা যায়, তাই বলে বন্ধন বিচ্ছিন্ন করা তো যাবে না। রবীন্দ্র অফিস থেকে বাড়ি এলো। ভেবেছিলো দু হাত প্রসারিত করে ডাকবে আর ওমনি হৈমন্তী দৌঁড়ে এসে বুকে মুখ লুকাবে। ভাবনা ভাবনায় থাকে। হৈমন্তী সাজেনি। কপালে সেই বাসী লাল রঙের টিপ। সিঁথিতে গতকালের সিঁদুর বিশ্রী রূপ নিয়েছে। গতকালের সেই লাল রক্তিমা শাড়িটা এখনো অঙ্গে। মুখে এমন একটি ভাব রয়েছে যে ভাবটি শুধু বলছে তার অন্তরটা অপুর শূন্যতায় ক্ষত-বিক্ষত হতে হতে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে। হৃদয়ের ভিতর তার যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, কে তা বোঝার চেষ্টা করবে! প্রভাতের শিশিরস্নাত স্নিগ্ধতা, পৃথিবীর সবুজ, আকাশের জ্যোৎস্না কিছুই যে অপুর শূন্যতায় তার ভালো লাগে না। শিশিরধৌত পূজার ফুলের মত পবিত্র ছিপছিপে তার দুটি চোখ কেবলি এই নির্দেশ করছে, অপু, তুমি আমাকে এই বদ্ধ প্রকোষ্টে প্রেরণের পূর্বে কেনো বাঁধা দিলে না! যাকে দেখামাত্রই গায়ের রক্ত টগবগ করে উঠে সেই স্বামী নামক বস্তুটি যে তোমার হৈমন্তীকে চোখের আড়াল হতে দেয় না! এ কেমন যন্ত্রণা! রবীন্দ্রর অবশ্য অধিকার আছে। রবীন্দ্র অধিকার ফলাতে যায়ও না। তবে রবীন্দ্রর বাড়ি একটাই কাজ প্রথম এবং পরম প্রিয়তমা প্রাণসখী স্ত্রীর ঐ অলৌকিক অনিন্দ্য রূপ দর্শন করা। রূপে আঁখি হরে, মন ভরে। রবীন্দ্রর আঁখি হরে, মন ভরে না। অন্তর অন্তর হৈমন্তীর চোখে জল চলে আসে। রবীন্দ্র হৈমন্তীর অশ্রুপূর্ণ কাতর চক্ষু দেখে বিহ্বল হয়ে যায়, বলে, কেনো কান্না করছো?রবীন্দ্রর কৌতূহলী মুখখানি হৈমন্তীর চন্দ্রসদৃশ মুখবদনের দিকে ফেলফেলিয়ে চেয়ে থাকে। ভাবে, মা বাবার জন্য মন পোড়ে, দুইদিন গেলে সব সয়ে যাবে। অন্তর যত না পিছে পড়ে পুড়তে চায়, তারচেয়ে আগামীর পথে হাটতে চায় বেশী। পথ পানে চেয়ে তাপিত হতে হতে নারী তো একদিন পিতৃগৃহে যেতে অনাগ্রহী হয়ে উঠে, স্বামীগৃহই স্বামীগৃহ থেকে আপনাগৃহ হয়ে উঠে। হয়ে উঠে আপনালয়, আপন বিচরণের স্বর্গক্ষেত্র।
ওদিন রাতে ছিলো ফুটফুটে জ্যোৎন্না। অশ্রুহীন অনিমেষ দৃষ্টিতে অপু চন্দ্রের দিকে চেয়েছিলো। হৈমন্তীকে উদ্দেশ্য করে বলছে, হৈম, তুমি আমাকে সহস্র হস্ত গভীর গহ্বরে কেনো ফেলে দিয়ে গেলে! তোমার বিচ্ছেদ স্মৃতি চতুর্দিক থেকে ঘেরাও করে আমাকে জ্বালাচ্ছে। আমার হৃদয় সাগরে যে তুমি গোপন শোকের মন্দির নির্মাণ করে দিয়ে গেলে! পূর্ণিমার উজ্জ্বলতা জীবন থেকে কেড়ে নিয়ে কেনো আমাকে অমাবস্যার কালিমা দিয়ে গেলে? আমার জীবনে তোমার ভালোবাসা কোনো দিনই অতীত হবে না। আমার অন্তরের আহাজারি কী তোমার অন্তঃপুরে পৌঁছে যায়নি? তোমার প্রতি আমার অনুরাগের আকর্ষণ তোমাকে কী আকর্ষিত করে আমার কাছে তোমাকে টেনে আনবে না? তুমি কী তোমার অন্তরকে পাথর বানিয়ে নিয়েছো?
রবীন্দ্র রাতে বাসায় ফিরে দেখে হৈমন্তী শয়নের জন্য প্রস্তুত। একটু আলাপ করতে পারে না রবীন্দ্র। প্রথমে হৈমন্তীকে ও একবার চোখ মেলে দেখে নিলো। তারপর বললো, তুমি আমার সাথে কথা না বলে কিভাবে থাকতে পারো?হৈমন্তী বললো, রাত এখন। আমি ঘুমে যাবো। আপনার সাথে কিচ্ছা করতে ভালো লাগে না।রবীন্দ্র নাছোড়বান্দার মতো করে বললো, এখনও কী অপরিচিত আমি তোমার কাছে? আমি তোমার সবচেয়ে চেনা, সবচেয়ে জানা। আমি তোমার সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে আপন। তোমার কাছে আমার কোনো অপ্রকাশ্য নেই। আমার সাথে কথা বলতে তোমার এত দ্বিধা কেনো? কেনো এত ইতস্তত তুমি?বলেই রবীন্দ্র হৈমন্তীর ডান হাত শক্ত করে ধরে বসলো। বললো, আজ ঘুমাবো না। তোমাকে ঘুমাতেও দেবো না।হৈমন্তী হাত ছুটিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো না। যেন অনুভূতিহীন। স্পন্দনহীন। রবীন্দ্র হাত ছেড়ে দিলো। নিরীক্ষণ করলো হৈমন্তীকে। অবুঝের মতো লাগছে। রবীন্দ্র উষ্ণ হয়ে উঠলো। ঠোঁট দুটো ফণা তুলে উদ্যত হলো হৈমন্তীর গালে ছোবল দিতে। যা ভাবনা সেই কাজ। হৈমন্তী এবারও অনুভূতিহীন, স্পন্দনহীন। রবীন্দ্র নিরাবেগের হৈমন্তীর পাশ থেকে উঠে গেলো।কাঁথাটা টেনে হৈমন্তী ঘুমের দেশে গেলো। সৌন্দর্য কত সুন্দর, সৌন্দর্য থেকে সুন্দরের দ্যুতি না অবজ্ঞার বিচ্ছুরণ বের হয় তা সে টের পাচ্ছে। রূপ দেখে বিমুগ্ধের কিছু নেই, এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে। রূপে বিমুগ্ধ হতে চাওয়া এখন বিদগ্ধ হচ্ছে।হৈমন্তীর মন জেগে ছিলো। চোখ খোলা ছিলো না। রবীন্দ্র এসে হৈমন্তীর ঘুমন্ত মুখে হাত বুলিয়ে দিলো। তারপর বাহু দ্বারা আঁকড়ে ঘুমালো। হৈমন্তী রবীন্দ্রর হাত সরিয়ে দিতে গেলে বাঁধা পেলো। হৈমন্তী বললো, কী মুশকিল, এ কেমন উপদ্রবের পাল্লাতে পড়লাম!রবীন্দ্র বললো, স্বামীর ছোঁয়া স্ত্রীর আকণ্ঠ তৃষ্ণার জল। স্বামীর পরশ স্ত্রীর জন্য স্বর্গের বাতাস। স্বামীর ঘ্রাণগন্ধে থাকা পবিত্র সুগন্ধী জলস্নানের চেয়ে শ্রেয়। স্বামীর দুই হাতের মাঝে স্ত্রীর সুরক্ষিত নিরাপত্তা ও সোহাগের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়। স্বামীর চোখের মায়াতে হারানোতেই স্ত্রীর শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। স্বামীর ডেরাতেই স্ত্রীর সুখের বলয়। আমাতে আশ্রয় নাও, প্রশান্তি পাবে। আমাতে হারাও, হারানো বৃথা যাবে না। আমাতে সুখ খোঁজো, সুখের মণিমুক্তা পাবে। শুধু একবার জেদের কাছে হেরে যাও, আমাতে বিলীন হও। আমি তোমার মন চাই, আর কিছু নয়।হৈমন্তী বললো, বিরক্তির সীমা থাকা দরকার। আপনার কর্মকাণ্ড রীতিমত উত্যক্তের পর্যায়ে চলে গেছে। সহ্য হচ্ছে না আর।রবীন্দ্র হৈমন্তীকে ছেড়ে দিলো। নানা কিছু ভাবলো। ভেবে হৈমন্তীর মন বোঝার চেষ্টা করলো। মনে মনে ভাবলো, নিশ্চয় ওর মনে কোনো অশান্তি বিরাজ করছে।মুখে বললো, তোমার মনে কী কোনো অশান্তি বিরাজ করছে? তোমার অশান্তি থাকতে পারে আমি বিশ্বাস করি না। একবার আমার বুকে লুকাও, যদি শান্তি না পাও পৃথিবীর আর কোথাও সুখ পাবে না। তোমার সুখ আমার কাছেই, পৃথিবীর তাবৎ সুখ।কথাগুলো শুনে হৈমন্তী তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। আর বললো, সুখ? পৃথিবীর তাবৎ সুখ? বাচ্চা বচন!হৈমন্তীর তাচ্ছিল্যে মাখা কথাতে রবীন্দ্র কান দিলো না, বললো, তুমি আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছো, আমার থেকে পালিয়ে তুমি আসলেই কী শান্তি পাবে? আমার থেকে তুমি যত সরবে, তত তোমার বিপর্যয়। আমার কাছে যত ধেয়ে আসবে, তত তোমার জয়, বিস্ময়। চারদিকে চেয়ে দেখো স্বামী-স্ত্রী শত প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে কেমন সুন্দর বেঁধে বেঁধে অটুট শৈলী মালার মতো বসবাস করছে। তুমি আমাকে নির্ভয়ে বিশ্বাস করো, তোমার হৃদয় মৃণালে নিঃসঙ্কোচে আমাকে আসন দাও, তোমার প্রতি আমার অনুরাগ ঠুনকো নয়।বলেই রবীন্দ্র আবার হৈমন্তীর হাত দুইখান ধরে বললো, তুমি চাও না আমার পেশাগত জীবনে উন্নতি হোক?হৈমন্তী বললো, শুধু আপনার না, পৃথিবীর সব মানুষ তাঁদের জীবনে উন্নতি করুক। কিন্তু আমি কী আপনার পেশাগত জীবনে উন্নতির অন্তরায়?রবীন্দ্র বিরক্তি প্রকাশ করে বললো, ওহ, তোমার উদাসীনতা, নিরাসক্ততা, মলিনতা আমার যাবতীয় কাজ-কর্মে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। তুমি বোঝো না আমার জীবনে তোমার কতো প্রভাব?হৈমন্তীকে টেনে বুকে নিলো রবীন্দ্র। রবীন্দ্রর বুকে লেপ্টে গেছে হৈমন্তী। ভাবলো, এ বিধির কোন নিয়ম, কেমন নিয়ম! কোথাকার অচেনার করালগ্রাসে আজীবন বন্ধী থাকতে হবে! আর কেনোইবা এনি আমার সাথে ছেলেমানুষি করবেন! আমার সুুন্দর সরল জীবনে এ বালাই কেনো এসে জুটলো!
পরদিন সাপ্তাহিক ছুটি। রবীন্দ্রর বুক সেলফ দেখতে দেখতে দুটো ডায়েরি পেলো হৈমন্তী। রবীন্দ্র দেখে ফেলতেই ডায়েরি বন্ধ করে ফেললো।  রবীন্দ্র দেখে বললো, বন্ধ করছো কেনো? পড়ো। আমার চিন্তা চেতনা ভাবনা দিয়ে কল্পনার অলিতে-গলিতে ঘুরে ঘুরে একটি প্রতিমা নির্মাণ করেছি। কবিতায় গল্পে যতটুকু তার রূপকে ফুঁটিয়ে তুলতে চেয়েছি, মনের মত করে তা পারিনি। যতটুকু ভেবেছি ততটুকু না হয় লিখতে পারিনি কিন্তু তার থেকেও যে আমি বেশী পেয়েছি এবং তা বাস্তবিক। আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আমার হৈমন্তী। হৈমন্তী নামের আগে আমি সব সময় ‘আমার’ যোগ করি। আমার হৈমন্তী। আমার কল্পনার সব উপমা তোমার রূপের কাছে মাথা নত করেছে। আমি তোমার অন্তরের অন্তঃস্থলের একমাত্র একজন হতে চাই।হৈমন্তী ডায়েরি দুইখান রেখে দিলো। বললো, ডায়েরি পড়ার ইচ্ছা আমার নেই। আপনার অনুরাগমিশ্রিত কথামালা পড়ার ন্যূনতম শখ আমার নেই। রবীন্দ্র হৈমন্তীর দেমাগী কথাতে কর্ণপাত না করে বললো, আমি যখন অফিসে যাই তোমার মুখটা ভাবতে ভাবতে যাই। যখন অফিস থেকে ফিরি তখনও তোমার মুখের ছবি মনের মাঝে আঁকতে আঁকতে ফিরি। আমি জানি, আমার হৈমন্তী আমার অপেক্ষাতে থাকে না। আমি জানি, আমার হৈমন্তীর সুন্দরতম হৃদয়ে আমার ঠাঁইটুকু হয়নি। আমি জানি, যার মাঝে হারিয়েছি, আমাতে সে হারায়নি।হৈমন্তী তীর্যক চোখে চেয়ে বললো, আমাকে না পাওয়া নিয়ে আপনার আক্ষেপের শেষ নেই। খেদোক্তির শেষ নেই। আমি কখন আপনার ছিলাম না?রবীন্দ্র বললো, একপ্রকার হয়ে আছো তুমি। তোমাকে তো পাওয়া হইনি আমার! যে পাওয়াতে তৃপ্তি নেই, সে পাওয়া পাওয়া নয়। যে পাওয়াতে দ্বিধার মিশ্রণ, সে পাওয়া পূর্ণাঙ্গ পাওয়া নয়।হৈমন্তী উচ্চস্বরে বললো, আমি তো আপনার দেয়া উপহার চার দেয়ালের মাঝেই। দূর আকাশের কোনো তারা নই, ইচ্ছাশীল দেখেন, ইচ্ছাশীল স্পর্শ করেন। আবার ইচ্ছামত ক্ষোভ প্রকাশ করেন। নিজে ভাবেন, নিজে বাজেন, নিজেই কাঁদেন। বেশী বেশী, একটু বেশী বেশীই।
দুপুরের দিকে হৈমন্তীর মা হৈমবতী আর বাবা শরৎ মেয়েকে দেখতে এসেছেন। অচেনার এই ভীড়ে হৈমন্তী কেবলি কান্না করতো, বাবা মাকে দেখে তার খুশি দেখে কে! তৎক্ষণাৎ তার মনের আকাশ সতেজ হয়ে উঠলো। রবীন্দ্রর মা বাসন্তী হৈমন্তীর মাকে হৈমন্তী সম্বন্ধে সব খুলে বললেন। বাড়ির কারো সাথে ঠিকমতে মেশে না, ঠিকমত কথা বলে না, ঘরের টুকটাক কাজেও মনোনিবেশ করে না। সংসারকে নিজের না ভাবলে সংসার কী গোছাতে পারে?রবীন্দ্রর মায়ের কাছে মেয়ে সম্বন্ধে এমন কথা শুনে হৈমন্তীর মা বাবা দুইজনের মন খারাপ হয়ে গেলো। হৈমন্তীর কাছে যেয়ে তার প্রমাণ হাতে নাতে পেলেন। হৈমন্তী অকপটে স্বীকার করে বলে, মা, বাবা, আমার এখানে ভালো লাগে না। মন টেকে না। আমার গ্রাম ভালো। আমি গ্রামে যাবো।হৈমবতী বললেন, মেয়ে বলে কী! এখন তো এ ঘরই তোর সব! এটাই তোর সংসার স্বর্গ।বাবা মা মিলে হৈমন্তীকে অনেক বুঝ দিতে লাগলেন। শ্বাশুড়ীকে সেবা-শুশ্রূষা করতে বললেন। স্বামীর কথা মতো চলতে বললেন। স্বামীকে দেবতাজ্ঞানে তাকে ভুল বুঝতে, কষ্ট দিতে বারণ করলেন। স্বামীকে আপন করে, তার কথার অবাধ্য যেন না হয় সে উপদেশও দিলেন।
পরদিন বাবা মা চলে গেলেন। হৈমন্তীর মন আবার খারাপ হয়ে গেলো। তার দুই চোখের উদাসীন দৃষ্টি কোনো এক অতিদূরবর্তী চিন্তারাজ্যে ভ্রমণ করছে। নানান ভাবনা তার মনকে বিচলিত করে তুললো। রবীন্দ্র অফিস থেকে ফিরে এসে দেখে হৈমন্তী মেঘলা আকাশের মত বিষণ্ন ভাব ধরে বসে আছে। রবীন্দ্র ঠোঁটের কোণে একটু হাসি ফুঁটিয়ে বললো, মা বাবা চলে গিয়েছেন। তাই বলে গোমড়া মুখে থাকবে? একলা থাকলে মন ভার হবেই।রবীন্দ্র হৈমন্তীর হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেলো। রবীন্দ্র হৈমন্তীর সম্মুখে বসে বললো, একা থাকি না, একা থাকা যায় না। তোমাকে এজন্য একা থাকতে মানা করি। একা থাকতেও দেবো না। একা থাকলে চিন্তার পরিসীমা বাড়ে। কিন্তু সেই চিন্তার বেশীর ভাগই নেগেটিভ। আমি সব সময় বিশ্বাস করি, তুমি আমি মিলে যে সিদ্ধান্ত নেবো তার মতো সুন্দর সিদ্ধান্ত তোমার আমার জীবনে আর নেই।হৈমন্তী বিমর্ষনেত্রে চেয়ে বললো, চুপ! এত বকেন কেনো? বাচাল? জ্ঞানীরা তো এত কথা বলেন না! রবীন্দ্র চুপ হয়ে গেলো। 
অফিসে এক কলিগকে রবীন্দ্র খুব বিশ্বাস করে। সংসার জীবনের অস্থিরতার কথা তার সাথে শেয়ার করলো। তার কলিগ বললো, এ নিয়ে ভাববেন না। অচেনা অজানা মানুষকে চিনতে জানতে সময় লাগে। বৌদিকে বেশী বেশী সময় দিতে হবে। আবার যদি বেশী সময় দিলে ঘটনা বিপরীত ঘটে তবে সময় দেয়া কমিয়ে দিতে হবে। বেশী সময় দিলে বন্ধনে যেমন কাঠিন্য বা মালিন্য আসে, সময় কমিয়ে দিলেও সান্নিধ্য আকাঙ্ক্ষা বা তৃষ্ণা জাগে। রবীন্দ্র বিমর্ষচিত্তে বললো, আমি সব দিক দিয়ে হেটেছি। ফলাফল শূন্য। একান্ত বিপদে পড়েই কথাগুলো আপনাকে বলেছি।কলিগ বিজ্ঞজনের মতো করে বললো, আচ্ছা, বৌদি কী পছন্দ করেন তাঁর অজ্ঞাতে জানার চেষ্টা করে তাঁকে এনে দেবেন, বিস্মিত হবেন। হীরা-মাণিক্যের চেয়ে হয়ত অনেকের কাছে রাস্তার দশ টাকার বাদামই দামী। বৌদির কাছ থেকে জানার দরকার নেই। তাঁর আকাঙ্ক্ষাটা বোঝার চেষ্টা করেন। আর ভালোবাসি ভালোবাসি বলার দরকার নেই, ভালোবাসেন সেটা কর্ম দিয়ে বুঝিয়ে দেন।রবীন্দ্র এক পলকে চেয়ে বললো, কঠিন কাজ!কলিগটি বললো, হ্যাঁ, কঠিন ও জটিল কাজ। আবার সহজ, আজ বাসায় ফেরার সময় একটা ফুলের স্টিক কিনে নিয়ে যান।রবীন্দ্র একটু হেসে বললো, হ্যাঁ, আপনার বৌদির ফুল পছন্দ। যেদিন তাকে প্রথম দেখতে যাই খোলা চুলে বেলিফুলের মালা ঢেউ খেলছিলো।
অফিস থেকে ফেরার পথে কয়েক রকমের ফুল কিনলো রবীন্দ্র। জীবনে কখনো ফুল ক্রয় করেনি। কোন বিপদে পড়লে সেই ফুল কিনতে হয়! তা হাতে করে বহন করতেও কেমন ইতস্তততা কাজ করছে। হৈমন্তীকে দিতে যেয়েও সেকি ইতস্তততা। কোথায় রাখবে এই খোঁজে হৈমন্তী চলে গেলো। হৈমন্তীকে পরোক্ষে যেতে দিলো না রবীন্দ্র। দেখলো পিছনের জানালা দিয়ে সে ফুল ফেলে দিচ্ছে। বিমর্ষ মনে দাঁতে ঠোঁট কাটলো রবীন্দ্র। রবীন্দ্রর সামনে দিয়েই হৈমন্তী হেটে চলে যাচ্ছিলো। ক্রুদ্ধ হয়ে রবীন্দ্র হৈমন্তীর হাত ধরতে যেয়ে ব্যর্থ হলেও কাপড়ের আঁচল ধরলো। হৈমন্তী এমন বাঁধা পেয়ে দাঁড়ালো ঠিকই, কিন্তু পিছনে ফিরে তাকালো না। পরে রবীন্দ্র আঁচল ছেড়ে দিলো। অফিসের অপ্রয়োজনীয় কাগজ বিনে ফেলতে যেয়ে রবীন্দ্র দেখলো তার আনা বাদাম বিনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। রবীন্দ্রর মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো।ছেলে বৌয়ের মধ্যে সম্পর্কের কোনো উন্নতি হয়নি মা বাসন্তী বুঝতে পারেন। বাসন্তী বললেন, সুখ ভালো লাগে না?হৈমন্তী চুপ থাকে। বাসন্তী আবার বলেন, রূপের গরব? মা দুর্গার ছেলে কার্তিকের মতো স্বামী হলে খুশী হতে? আমার ছেলের মতো ধৈর্যশীল আর সহ্যশীল স্বামী পেয়েছো, নতুবা আরো কয়েকটা স্বামীর ঘর এতদিন করা হয়ে যেত তোমার!মাকে মিষ্টি-মধুর গরম দিয়ে হৈমন্তীকে ডেকে ঘরে নিলো রবীন্দ্র। হৈমন্তীর প্রস্থান কালে মা শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, বেশী সুখে থাকলে শান্তি হয় না। সুখের জ্বর ভর করেছে!হৈমন্তী ঘরে আসতেই রবীন্দ্র বললো, মায়ের কথাতে রাগ করো না। তোমার যত রাগ আমার উপর প্রয়োগ করবে। আমি কিছু বলবো না। আর মা বকেছে? বকতেই পারে। মা বকেছে তার বিচার আমার কাছে চেও না যেন। মায়ের মাথায় তেল দিয়ে দেবে। মায়ের মাথায় চিরুনি করে দেবে। মায়ের কাছে বাবার গল্প শুনতে চাইবে। দেখবে মা তোমাকে আর বকবে না। ফলাফল হাতে-নাতেই পাবে, পরদিন মা তোমার মাথায় তেল দিয়ে দেবে, চিরুনি করে দেবে।হৈমন্তী রবীন্দ্রর দিকে একবার তাকিয়ে নিলো। আশ্চর্য হয় সে, একটু রাগ করে না, একটু সন্দেহ করে না। বললো, আমার এত অন্যায়, এত ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতেও আমার উপর আপনার রাগ উঠে না?রবীন্দ্র গুরুগম্ভীরভাবে বললো, কার উপর রাগ করবো! তোমার উপর! একটু তো ভালোবাসলেই না! আগে ভালোবাসো, রাগ করবো। অনুরাগের জন্য।হৈমন্তী আবারও মুখ তুলে রবীন্দ্রকে দর্শন করলো আর বললো, আমার ভেতর কী হয় আমি ঠিক বুঝি না। আমি নিজের সাথে পারি না। আমার স্বস্তি নেই।রবীন্দ্র নিষ্পলকে চেয়ে বললো, আমি জানি, তোমার অনেক অপ্রাপ্তি। কিন্তু তোমার প্রাপ্তিও কম নয়। অপ্রাপ্তির জন্য অধৈর্য হতে নেই। অপেক্ষা করতে হয়। সময় সব মানুষকে দিয়ে দেয়।হৈমন্তী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, আমার কোনো কিছুতে মন বসে না। না আপনাতে, না সংসারে।রবীন্দ্র বললো, মন যখন যা চায় তার জন্য আকুল হলে হয় না। মন বিচিত্র রূপের। সে চাইবে, যা দেখবে তাতেই নিবিষ্ট হবে। মনকে বলবে আমি তোর দাস নই, তুই আমার দাস। মনের বাড়ন্ত চাওয়া চুপ হয়ে যাবে। তুমি খুব অস্থির, তুমি চিত্তকে বশীভূত করার চেষ্টা করো। তোমার অস্থিরতা চলে যাবে।হৈমন্তী আজ নির্বাক। রবীন্দ্রর সব কথা তার ভালো লাগছে। বললো, আমার উপর অনেক স্বপ্ন ভর করে। অলীক স্বপ্ন। আমি অলীক স্বপ্নে মায়াচ্ছন্ন। কোনক্রমে অলীকতা থেকে বের হতে পারি না।রবীন্দ্র বললো, জানি, আমাকে তোমার মনে ধরে না। তোমার ক্ষোভ আছে। তোমার অতৃপ্তি আছে। কিন্তু দেখো, তোমার জন্য আমার চেষ্টার কমতি নেই। তোমাকে যা এনে দিতে পারি তা আমার সক্ষমতার পরিচয়। তোমাকে যা এনে দিতে পারি না তার জন্য আমার পরিশ্রম আছে। বাড়তি কিছু প্রাপ্তির জন্য বাড়তি শ্রম স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না। মনের স্বাস্থ্য নষ্ট হলে পঁচতে আর কিছু বাকি থাকে না। তুমি আমাকে সেদিকেই ক্রমে ক্রমে ঠেলে দিচ্ছো।হৈমন্তী কথাটি শুনতেই চমকে রবীন্দ্রর দিকে চাইলো। রবীন্দ্র আবার বললো, কিন্তু বিশ্বাস করো, আমার যেদিন নানা কারণে মন খারাপ হয় সেদিন মস্তিষ্ককে খুব ব্যস্ত করে তুলি। বই পড়ি, লিখি, কাছের বন্ধুকে ফোন করি। আমি নিজেকে সামলে নিই। তোমার সাথে পথ চলতে হলে এভাবে নিজেকে সামলে সামলেই চলতে হবে।হৈমন্তী মাথা নিচু করে বললো, আমার কংক্রিটের চার দেয়ালের মধ্যে ভালো লাগে না। আমি বনান্তে ঘুরবো, নদীর কাছে যাবো, হাঁসেদের খাদ্য অণ্বেষণ দেখবো। ফুলের কাছে যাবো। প্রকৃতির মায়ায় মিশবো। খালি পায়ে ঘাসের উপর দিয়ে হাটবো।রবীন্দ্র মৃদু হেসে বললো, তুমি এসব হতাশা থেকেই বলছো। আমার কারণে তোমার হতাশার শেষ নেই। তোমাকে পাওয়ার আশায় এই যে আমার লেগে থাকা তোমার ভালো লাগে না। আমি আজ কথা দিচ্ছি, আমি কখনো তোমার হাতে হাত দেবো না, যদি না তুমি হাত বাড়াও। আমি কখনো তোমাকে বুকে নেবো না, যদি না তুমি বুকে আসো। তোমায় ছুঁয়েও দেখবো না, যদি না ছোঁয়া দাও। কখনো উষ্ণ হবো না, যদি না উষ্ণতা বাড়িয়ে কাছে আসো। কখনো স্বপ্নেও দেখবো না, যদি না তুমি স্বপ্নের সারথি হও।
পরদিন অফিসে যেয়ে সেই কলিগকে বর্তমান অবস্থা সব বললো রবীন্দ্র। কলিগ একগাল হেসে নিয়ে বললেন, বৌদি আপনাকে অনেক ভালোবাসেন। আপনাকে ঝালিয়ে নিচ্ছেন। রবীন্দ্র বললো, আর বলেন না। এত শক্ত মনের মেয়ে হতে পারে জানা ছিলো না। চেয়েও দেখে না। চিনেও চেনে না। চোখে তাকিয়ে দুটো কথাও বলে না। ভরদিন বাইরে কাজ করি, আমার প্রতি তার কোনো মায়াও জন্মালো না।কলিগ বললো, কখনো তাঁর সামনে অহংকারী হয়েছিলেন? নিজেকে কী বড় করে জাহির করেছিলেন? বা রাগ করেছিলেন?রবীন্দ্র বললো, আপনি কী আমাকে চেনেন না? আপনার কী মনে হয় আমি বড়াই করতে পারি? আমি তার সব সয়ে নিই, প্রচণ্ড রাগ উঠলেও হেসে বুক হালকা করি।কলিগ বললো, কদিনের জন্য কোথাও থেকে ঘুরে আসেন। যত অচেনা জায়গায় ঘুরতে যাবেন ততই দেখবেন নিজেদের মধ্যে চেনা জানা বাড়বে। অচেনার ভীড়ে আপনারা দুইজনই তো দুইজনের পরিচিত!রবীন্দ্র বললো, যাবে না। বাইরে তাকে নিয়ে যেতে পারবো বলে মনে হয় না!কলিগ আরো একটা বুদ্ধি দিলো, হাতে ব্যান্ডেজ করে বাসায় যান, দেখেন আপনার অসুস্থতা দেখে তাঁর ভেতর ছটফটানি বাড়ে কিনা!বুদ্ধিটা রবীন্দ্রর ভালো লাগলো, কিন্তু দ্বিধান্বিত হয়ে বললো, অসুস্থ সেজে থাকা, তারপর ধরা পড়া; ছেলেমি হয়ে যাচ্ছে না?কলিগ বললো, তবে একদিন প্রহার করেন, ভূত ছুটে যাবে। রবীন্দ্র বুঝতে পারলো তার কলিগ কিছুটা বিরক্ত হয়ে উঠেছে এ বিষয়ে। তাই আর কথা বাড়ালো না। কিন্তু কলিগ নিজ থেকেই বললো, সময় করে একদিন শ্বশুরবাড়ি যান। আপনার স্ত্রীর কোনো এক বান্ধবীকে ডেকে জানার চেষ্টা করেন আপনার স্ত্রীর কোনো সম্পর্ক আছে কিনা!কথাটি শুনতেই রবীন্দ্র স্থির হয়ে গেলো। হৈমন্তীর কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে ও মানতেই পারছে না। ভাবনাতেও কখনো নেইনি। উদ্বিগ্ন হয়ে বাড়ি এলো। তবে সহসা জানার চেষ্টা করলো না। হৈমন্তী রবীন্দ্রর ধারে কাছে এসে বসলো। আর বললো, আপনাকে বিচলিত লাগছে! রবীন্দ্র কোনো কথা বললো না। হৈমন্তী বললো, আমার নিজের প্রতি আমার নিজের রাগ, আমার নিজের প্রতি আমার নিজের ঘৃণা। আমার মন ভাসে, মন বসে না। আমি আর স্বপ্ন দেখতে চাই না, কিন্তু স্বপ্ন ভর করে, বিভোর করে। অতীত শুধু চারদিকে ঘোরে। অতীতের প্রতি কেনো এত মায়া আমার! অতীত কেনো আমাকে মোহমগ্ন করে রাখে? বর্তমান কেনো আমাকে মোহগ্রস্ত করতে পারে না?রবীন্দ্র হৈমন্তীর কথাগুলো শুনে থমকে থাকে। বিষণ্ণতা গ্রাস করলো ওকে। রাজ্যের মেঘ ভর করলো মুখের উপর। ও কত বড় বড় সমস্যা সমাধান করেছে কখনো এত বিমর্ষ হয়ে পড়েনি। মনমরা হয়ে ও ঘরে চলে গেলো। হৈমন্তী রবীন্দ্রর বর্তমান অবস্থাটা উপলব্ধি করলো। ও দিন ও সারারাত ভেবেছে, নানা বিষয় ভেবেছে। অপু তাকে কতটুকু মায়া দিয়ে মন ভরিয়েছিলো তারচেয়ে কম ছায়া কী রবীন্দ্র দিচ্ছে? আশার উল্কায় চড়িয়ে অপু হৈমন্তীকে দেশ পরিভ্রমণ করিয়েছিলো, রবীন্দ্র তো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডও ঘুরাতে সক্ষম। যে অপু তার বিবাহের পর আর খোঁজ নেইনি, সেই অপুকে সে রোজ ভেবে ভেবে কাঁদবে কেনো? যে রোজ খোশ মেজাজে দোষ না দেখে জাগিয়ে তুলতে চায় তাকে কেনো বঞ্চিত করবে সে? এসব ভাবতে ভাবতে নিজের মনকে সে বশে আনতে ব্যপ্ত হলো। যার সান্নিধ্যে তৃপ্তি ছিলো, আনন্দ ছিলো, প্রাণস্ফূর্তি ছিলো, সাথে কলুষ হওয়ার ভয়ও ছিলো তার কথা এতকাল কেনো সে মনে গেঁথে রাখবে? যার সান্নিধ্য পেয়ে কালিন্য, মালিন্য, মনোদারিদ্র্য দূর হবে তাকে কেনো হতাশায় নিমজ্জিত রাখবে সে? সারারাত সে ঘুমালো না। ভোরেই উঠে পড়লো। সংসারের কাজে হাত দিলো। মা আর রবীন্দ্র দেখলো, আশ্চর্য হলো। কিন্তু না দেখার ভান করে বিনাশ্চর্যেই থাকলো, কারণ যে নদীর বহমান ধারায় বাঁক ফিরেছে তাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া আর তাচ্ছিল্য সমান। রবীন্দ্র অফিসে যাবে। সামনে হৈমন্তী মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে গেলো। রবীন্দ্র অপ্রস্তুত হয়ে অজানা ভাবনায় পড়লো। হঠাৎ হৈমন্তী রবীন্দ্রর বুকে গিয়ে পড়লো আর শক্ত করে তাকে ধরলো। খুব শক্ত করে ধরলো। কোনো কথা বলছে না। রবীন্দ্র হৈমন্তীকে বুক থেকে তুলে চোখের মণি বরাবর চেয়ে ভ্রূ নাচিয়ে বললো, কী! কিছু বলবে!হৈমন্তী লাজুক হেসে বললো, কিছু না! যাও, অফিসে যাও! মন দিয়ে কাজ করবে!প্রফুল্ল মনে রবীন্দ্র অফিসের উদ্দেশ্যে বের হতেই হৈমন্তী ডাক দিলো, শোনো, ফেরার পথে একটি বকুলফুলের মালা আনবে!মৃদু হেসে রবীন্দ্র গেট পার হয়ে গেলো। হৈমন্তী দৌঁড়ে গেটে এসে আবার রবীন্দ্রকে ডাকলো, আর শোনো, দশ টাকার বাদামও আনবে!মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে রবীন্দ্র চলে গেলো। লজ্জায় আঁচল চিবাতে চিবাতে হৈমন্তী ঘরে গেলো।
দুপুরে একটু কাজে বের হয়েছিলো হৈমন্তী। বাইরে বের হতেই সামনে দেখে অপু। অপুকে দেখেই হৈমন্তী আঁচলে মুখ ঢেকে বিপরীত পথ ধরে হাটতে লাগলো। পিছন থেকে অপু হৈম হৈম তারপর হৈমন্তী হৈমন্তী শব্দ উচ্চারণ করে বারবার ডাকলো। হৈমন্তী পিছন ফিরে একবারও তাকায়নি। দুচোখ বেয়ে তার জলের ধারা বইতে লাগলো। অনেক জল, এত জল তার চোখ থেকে কখনো ঝরেনি। কী শপথ করে রবীন্দ্রকে সে এত শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলো যে অপুকে দেখতেই আবার তার চোখে এত জল এলো?

হৈমন্তীর মন ছোটো গল্প – সমাপ্তি

যে কেউ তাদের লেখা জমা দিতে চান। অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা জমা দিন পৃষ্ঠায় জমা দিন এবং যারা লেখা জমা দিচ্ছেন। পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!