রেলওয়ে ট্র্যাকে-ভ্রম না সত্যি ছোটগল্প – সৌরদীপ চৌধুরী
নিখিলবাবুর কয়লার বিজনেস ছিল স্বাভাবিক ভাবেই এখন আর নেই। সালটা ছিল ১৯৯৭এর ঘটনা নিখিল বাবু সার্ভিস বাড়ানোর জন্য অনেকজন ঘুরে বেড়াতেন যেখান থেকে ভালো কয়লা হোক যোগান দেয়ার জন্য।এরকম করতে করতে তিনি এক পরিচিত লোকের কাছে খবর পান ধানবাদের এরপর থেকে তিনি ধানবাদ থেকে কয়লা আনা শুরু করেন। ধানবাদ থেকে কয়লা আনার সময় তিনি নিজের লরিতে করে কয়লা আনতেন সেই লরির চালকের সঙ্গে বাড়ি ফিরে যেতেন।সময়টা ছিল সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ার দিকে সামনেই পুজো চতুর্দিকে শারদীয়ার আগমনীর উল্লাস ও আনন্দের মহিমা। পুজোপার্বনে অন্যান্য জিনিসের মত সেই সময়ে কয়লার চাহিদাও থাকতো তুঙ্গে মানুষের বাড়ির প্রয়োজনে তো বটেই তার সঙ্গে হোটেলে রেস্টুরেন্টগুলো থেকে ও অর্ডার আসত কয়লার জন্য, বলা নিষ্প্রয়োজন তখন ঘরে ঘরে গ্যাস ওভেনের রমরমা ছিলনা কেবল কতিপয় মানুষের বাড়িতে গ্যাস ওভেন থাকতো। নিখিল বাবু অন্যান্য বারের মতো এবারেও ফিরছেন কয়লা বোঝাই গাড়ির সাথে হাওড়া জেলার যে অঞ্চলে নিখিল বাবুর গোডাউন ছিল সেইখানে লরি নিয়ে আসতে গেলে একটা লেভেল ক্রসিং পেরাতে হতো।চতুর্দিকে ভালো হাওয়া বইছে ভোদায় সন্ধ্যের দিকে দারুন বৃষ্টি হয়েছে হাওড়ার সংলগ্ন অঞ্চলে নিখিল বাবুদের আসতে আসতে প্রায় রাত্রি দেড়টা বেজেগেছিল লেভেল ক্রসিংয়ে গাড়ি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে লরির ড্রাইভার চালক বিরক্ত হয়ে গেছে কারণ তাকে নিখিল বাবু পৌঁছে দিয়ে ওই মুহূর্তেই ধানবাদে ফিরে যেতে হবে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর নিখিল বাবু লরি থেকে নেমে পড়েন এবং পাশের গার্ডম্যানের ঘরে গিয়ে খবর নেন সে পরবর্তী ট্রেন কখন আসবে? গার্মেন্ট বললেন যে এখন কোন রকম সিগন্যাল আমরা পাচ্ছি না কাজেই এখন গেট খোলার প্রশ্ন নেই। নিখিল বাবু তখন গার্ডম্যানকে বললেন যে আমি গিয়ে তাহলে কেবিনে খবর নিয়ে আসি গার্ডম্যানও বললেন খবর নেয়ার জন্য তিনি অনেকক্ষণ ধরে কেবিন রুমে ফোন করছিলেন কিন্তু কেউ ফোন ধরছে না। নিখিল বাবুর অপেক্ষা করার মতো সময় ছিলনা কারন রাত অনেক হয়ে গেছিলো সেখানে নিখিল বাবু বেশি কথা না বাড়িয়ে কেবিনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।কেবিনটা ছিল ক্রসিং থেকে মাইলখানেক হবে।ক্রসিং থেকে নেমে তো সরু রাস্তা ধরে নিখিল বাবু হাঁটতে থাকলেন রাস্তার একদিকে ছিল বিশাল বড় ছিল আর একদিকে রেললাইন মাঝখানের সরু একফালি রাস্তা রেলওয়ে ট্র্যাক উঁচু হয়ে রাস্তাটা খানিক নিচু হয়ে গেছে বলতো অল্প বৃষ্টিতেই ঝিলের জলে রাস্তা ভরে গেছে রাস্তার ধার ঘেঁষে বাঁশের পাটাতন করে মাচা করা আছে দিনের বেলা স্থানীয় ছেলেরা সেখানে তাস খেলে রেলওয়ের আলোতে রাস্তা হাঁটতে টর্চ লাগছিল না,কিন্তু কিছুটা যাওয়ার পর ৩৭নম্বর পুল এর কাছে এসে লাইট গুলো জ্বলছিল না লাইট গুলো হয়তো কেটে গেছে।রাস্তাটা অনেক লম্বা অন্ধকার ছিল বেশ ঘন ৩৭নম্বর পুলের কাছে জায়গাটি বিভিন্ন কারণে প্রসিদ্ধ সবথেকে বড় কারন হলো রে লেখাটা পড়ার জন্য কত লোক যে এখানে সুইসাইড করেছে আর তাছাড়াও অসাবধানতাবশত রেললাইন পার হতে গিয়ে কাটা পড়েছে তার কোনো হিসাব নাই। পরপর পাঁচটা লাইন অন্ধকারে ট্রেন চলে এলে তাই মানুষে সামলাতে পারেনা তাই এই বিপত্তি।অন্ধকার রাস্তায় নিখিল বাবু টর্চ জ্বেলে এগোতে থাকলেন সন্ধ্যাবেলায় হয়তো এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে ঘন অন্ধকারে নিখিল বাবু কোনরকমে হাঁটছিলেন। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে নিখিল বাবু চোখ গেল রেললাইনের ট্রাকের উপর তিনি দেখলেন দুজন লোক তিন নম্বর লাইনের মাঝখান দিয়ে আপন-মনে গল্প করতে করতে হেঁটে চলেছেন তিনি অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন তারা অনেকক্ষণ ধরে লাইন এর মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলেছেন তিনি দেখলেন লোকগুলোর কোন বিকার নেই তারা অনেকক্ষণ ধরে লাইনে আর মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলেছে নিখিল বাবু এবার কিছুটা উপযাচক হয়ে লোকগুলো বললেন কি ব্যাপার দাদা আপনারাও এরকম লাইনের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন কেন? এক্ষুনি যদি একটা ট্রেন পাস করে করে তখন আপনারা সামলাতে পারবেন তো? নেমে আসুন এইতো আমি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি অসুবিধা হচ্ছে কিন্তু বিপদ তো নাই। লোকগুলোর সে কথা এখনো গুরুত্ব না দিয়ে নিজেদের মতই হেঁটে চলতে লাগলো।কিছুক্ষন দেখার পর আর সহ্য না হয়ে আপত্তি করে নিখিল বাবু আবার তাদের বললেন নেমে আসার জন্য কিন্তু এ দ্বিতীয়বারেও সেই লোকগুলি নিখিলবাবুর কথায় কোন আলোকপাত না করে নিজেদের মতই এগোতে থাকলো নিখিলবাবু বুঝলেন যে এইখানে প্রতি রাত্রেই নেশা করে মাতাল লোকেরা এসে পড়ে থাকে এরা তাদের মতই কেউ যাদের নিজেদের জীবনের কোনো পরোয়া থাকে না কাজেই এদেরকে বুঝিয়ে লাভ নেই। এই ভেবে নিখিলবাবু আগের মতই সেই সরু রাস্তা ধরে এগোতে থাকলেন কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পরেই কেবিন এসে পড়ল এবং কেবিনের আলোয় যেমনি টর্চ জ্বালাবার আর প্রয়োজন হলো না ঠিক সেরকমই কেবিনের আলো গিয়ে পড়ল রেললাইনের উপর যেখান দিয়ে সেই দু’জন লোক হেঁটে যাচ্ছিল নিখিল বাবু দেখলেন যে দুজন লক্ষ্যে তিনি এক্ষুনি বুঝিয়ে দেন রেল লাইনের ট্রেন থেকে নেমে হাঁটার জন্য তাদের দুজনেরই কারো মাথা নেই ধর থেকে মস্তক সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ নিখিল বাবু স্পষ্টতই শুনেছিলেন তারা দুজনে গল্প করতে করতে হেটে যাচ্ছিলেন এবং এখনও তারা হেঁটেই যাচ্ছে এরকম দৃশ্য দেখার পর নিখিলবাবু থর থর করে কাঁপতে লাগলেন নিজেকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন বোধ হয় আমি কোন ভুল লেখছি অন্ধকারে চোখের কোন আমার সমস্যা হচ্ছে এ দৃশ্য কি করে সম্ভব কিন্তু কিছুতেই খাবার পরে নিখিল বাবু স্পষ্টতই দেখতে পেলেন তিনি যা দেখেছেন কিছুই ভুল দেখেননি ওদের দুজনের মাথা নেই যেন কোন লাশ কাটা দেহ মর্গ থেকে উঠে এসেছে পাড়ি জমিয়েছে রেলওয়ে ট্রাক এ তাদের দিকে আরো ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলেন নিখিল বাবু এবং নিখিল বাবরি কাটা যেন হয়ে মানুষ দুজন অনুভব করতে পারছে। এতক্ষণ নিখিলবাবু যখন তাদের রেললাইনের ট্রাক থেকে নেমে হাঁটার জন্য বলেছিলেন তারা কোনো ভ্রুক্ষেপ করেনি অথচ এখন তারা মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়েছে এবং তাদের মধ্যে একটি লোক আস্তে আস্তে পেছন ফিরছে ভয়নিখের বাবুর বুকের ধুকপুকানি আরো দ্বিগুন বেড়ে যেতে লাগল ভয়ে তিনি আর এক পা চলতে পারছেন না, যেন পৌষ মাসের ঠান্ডা এর মতো তিনি ঠকঠক করে কাঁপছেন উনার জিভ পুরা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে উনার গলা দিয়ে যেন কোন আওয়াজ বেরোচ্ছে না, ওনার রক্ত যেন জমে বরফ হয়ে গেছে চোখগুলো যেন এখনই অক্ষিগোলক থেকে বেরিয়ে মাটিতে মিশে যেতে চাইছে। লোকটি নিখিল বাবুর কাছে আসতে আসতে পায়ে কাছে এগিয়ে এলেন নিখিলবাবু লক্ষ্য করলেন যে তার মুণ্ডটি তার পেটের কাছে ঝুলছে সেটি যেন তাহার সুষুম্নাকান্ডের সঙ্গে সুতো দিয়ে বাঁধা রয়েছে এরকম দৃশ্য তিনি কোনোভাবেই সহ্য করতে পারলেন না, ছুটতে লাগলেন রেলওয়ে ট্র্যাক ধরে পাগলের মত। যখন ছুট ছিলেন তিনি অনুভব করলেন পাশে থেকে যে দুজন লোক ছিল তারা তো ছিলই এছাড়াও তিনি তার পেছনে আরও চার জোড়া পা যেন তার পেছন পেছন আসছে জলের গর্তে সেই পায়ের ছপছপানি আওয়াজ নিখিলবাবু স্পষ্ট বুঝতে পারছেন।আওয়াজ তার নিজের পায়ের আওয়াজ নয় এ যেন তার পিছু করা অন্য কারোর পায়ের আওয়াজ কিন্তু পেছন ফিরে তাকাবার মত মনের অবস্থাও এ সময় তার ছিল না কিছু জায়গাতেই কেবিনের কাছে গিয়ে পা পিছলে পড়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে যায় যখন জ্ঞান হয় তখন তিনি নিজেকে এক রুমের মধ্যে পান, তার চারপাশে কিছু লোক ছিল তারা সকলে কেবিনেটে লোক ছিল তারা নিখিল বাবু কে আশ্বস্ত করেন যে তিনি এখন সুরক্ষিত আছেন। নিখিল বাবু ওনাদের পুরো ঘটনাটি খুঁটিনাটি খুলে বলেন ওখানে থাকা কিছু ছোকরা এই শুনে হাসতে থাকে একজন বলে ওঠেন এইটা নিয়ে আসার কিছু হয়নি এরকম আমরা অনেকবার দেখেছি কিন্তু এখানে কেউ এটা নিয়ে বিশেষ আলোচনা করে না সেই রাত্রে তারাই নিখিল বাবুকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে আসেন। ঘরে ঢোকার পরে নিখিল বাবু দেখেন তাদের মধ্যে কারোর একজনের একটি ব্যাগ তার বাড়িতেই রয়েগেছে তিনি সেটাকে ফিরত দেওয়ার জন্য দরজা খুলে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়েন কেবিনের সকলেই তখন গাড়ির মধ্যে উঠে পড়েছিল সেই ব্যাগটি ফেরত দেয়ার জন্য নিখিলবাবু যখন গাড়ির দরজা খুলেন দেখেন যে গাড়ির ড্রাইভার থেকে শুরু করে তার পাশে বসে থাকা আরোহী এবং পিছনের তিনজন প্রত্যেকেরই মস্তক ধর থেকে বিচ্ছেদ ছিল!
রেলওয়ে ট্র্যাকে-ভ্রম না সত্যি ছোটগল্প – সমাপ্তি
যে কেউ তাদের লেখা জমা দিতে চান। অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা জমা দিন পৃষ্ঠায় জমা দিন এবং যারা লেখা জমা দিচ্ছেন। পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
বাংলার রূপের সাত সতেরো
সাগর দেখার স্বপ্ন
নবমীর শেষরাত