কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » পুজো সংখ্যা ১৪৩১ » শালপাহাড়ির জঙ্গলে

শালপাহাড়ির জঙ্গলে

শালপাহাড়ির জঙ্গলে ভৌতিক গল্প – তরুণ প্রামাণিক

কোদাল বস্তি কোলিয়ারির সেফটি ইন্সপেক্টর আশীষ চ্যাটার্জী প্রতিদিনের মতই নিয়মমাফিক কয়লা খনির ইন্সপেকশন সেরে, আজ যখন তাঁর হুড খোলা জীপ গাড়িটি স্টার্ট দিলেন, ভাদ্রের লম্বা দুপুর গড়িয়ে বিকেল পড়েছে তখন।

দূরের ঐ গারো পাহাড়ের মাথা চকমকিয়ে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠছে মুহুর্মুহু। গারো পাহাড়ের গায়ে জমে থাকা দুধের সরের মত ঘন কালো মেঘ ভয় দেখাচ্ছিল সেই থেকে। 

স্টার্ট দিয়েই গাড়ির গতি বাড়ালেন তিনি। বেশ কয়েকটি ছোটো বড় শ্রীহীন আর লালচে রুক্ষ টিলাকে পিছে ফেলে প্রায় জনহীন একটা তেমাথা রাস্তার মোড়ে এসে থমকে দাঁড়ালেন। গাড়ি থামালেন বটে কিন্তু ইঞ্জিন চালু রেখে বাইরেটা দ্রুত জরিপ করে নিলেন একবার। বাদিকের পিচ কালো ঢালু রাস্তাটা সামনের ছোটো একটা বাদামী টিলাকে আড়ালে রেখে এক ছুট্টে হাইওয়েতে গিয়ে মিশেছে। প্রতিদিনের মত ঐ পথে ড্রাইভ করে সদরে তাঁর কোয়াটারে পৌঁছাতে ঘণ্টা খানিক সময় লাগে। কিন্তু মাথার উপর আজ বৃষ্টির ভ্রুকুটি ! তাই সাত পাঁচ আর না ভেবে, সুদীর্ঘ সে পথ বেশ খানিকটা শর্টকাট করতে ডান হাতে মৃত অজগরের মত শুয়ে থাকা বিশাল শালপাহাড়ির ঘন জঙ্গলের কাঁচা রাস্তাটাই ধরলেন তিনি। 

বেশ দ্রুত গতিতেই পেরিয়ে আসছিলেন বন পাহাড়ের সে পথ। কিন্তু শালপাহাড়ির গভীর জঙ্গলে ঢোকা মাত্রই সুবৃহৎ বনভূমির অপর প্রান্ত থেকে মাথার উপর দিয়ে ঝর ঝর শব্দের ক্রম চলমান একটা অস্পষ্ট আওয়াজ আশীষ বাবুর দিকে খুব দ্রুত এগিয়ে আসতে লাগলো। নৈঋত কোণ থেকে ভেসে আসা বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা ঝরে পড়লো তাঁর চোখ,মুখ,মাথার উপর। অ্যাক্সিলেটারে চাপ দিয়ে আরো স্পীড বাড়ালেন তিনি। বৃষ্টির ফোঁটা ঘন হয়ে পড়ে বেশ ভিজিয়ে দিলো তাঁকে। বনভূমির এই গভীরে এসে তিনি খেয়াল করলেন, মাথার উপরের খোলা আকাশ ঢেকে গেছে লতা পাতা আর গুলমাদির নিবিড় আচ্ছাদনে। মনে হলো, বাইরের আলোর জগতের সাথে দীর্ঘ জীবনের শত্রুতা এদের। ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে হঠাৎ একটা বড় পাখি ভেজা ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে গেলো ঠিক তাঁর মাথার উপর দিয়ে। নাকে ভেসে এলো জঙ্গুলে ঝাঁঝালো গন্ধ। বৃষ্টিতে ভিজে মাটি থেকে ভাপ উঠছে থেকে থেকে। সহসা সামনে আর পিছনে দুবার প্রবল একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গোঁৎ  গোঁৎ শব্দ করে থমকে গেলো জীপটা। বার বার চেষ্টা করা স্বত্বেও স্টার্ট নিল না কিছুতেই। গভীর জঙ্গলের মধ্যে এভাবে ফেঁসে গিয়ে আশীষ বাবু সত্যি সত্যিই প্রমাদ গুনলেন এবার। বন পাহাড়ের জঙ্গলে আঁধার নামে খুব দ্রুত, তাই সাত তাড়াতাড়ি বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করতে গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন তিনি। সর্বাঙ্গ তাঁর বৃষ্টিতে ভিজে জবজব করছে। মাথার উপর তখনো অবিশ্রান্ত ভাবে পড়ে চলেছে বৃষ্টি পিটির পিটির করে। মাথায় চুলের মধ্যে ডান হাতের পাঁচটি আঙ্গুল ঢুকিয়ে বৃষ্টির জল সমেত ভেজা চুল গুলোকে টেনে নিলেন পিছনের দিকে। চোখ নামিয়ে মাটির দিকে চেয়ে দেখলেন, ভেজা ঝরা পাতার ফাঁক দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে পিঁপড়ে মুখে ডিম নিয়ে সার বেঁধে চলেছে কোথায়। সামনেই শিরীষ গাছের একটি মোটা ডাল ভেজা অলোকলতার ভারে নুইয়ে পড়েছে একদম মাটির কাছে এসে। গাছের পাতায় পাতায় চাপ চাপ অন্ধকার। সাথী হারা ক্লান্ত ডাহুক সেই থেকে একা একা ডেকে চলেছে খুব তীক্ষ্ম স্বরে। আশীষ বাবু তাঁর জীপ টিকে পিছনে রেখে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন শাল পাহাড়ির আরো গভীরে।  

এমনিতেই চারপাশটা ভীষণ নির্জন এদিকে। জন মানবের সামান্য অস্তিত্বটুকু পর্যন্ত নেই কোত্থাও। দিন ফুরিয়ে গিয়ে সন্ধ্যে নামার আগেই একরাশ নির্জনতা এসে যেন চপে বসতে চাইছে। দ্রুত নিঝুম হয়ে আসছে চারপাশ। আরো বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে জঙ্গলের মাঝ বরাবর এঁকে বেঁকে চলে যাওয়া কাঁচা রাস্তাটা ছেড়ে ঠিক তাঁর পায়ের কাছে অসার হয়ে পড়ে থাকা শুড়িপথটি ধরে বেশ খানিকক্ষণ হাঁটতে থাকলেন তিনি। একটা জঙ্গুলে বাঁক ঘুরতেই আচমকা তীব্র একটা ভালোলাগার ঝড়ো হাওয়া এক ঝাপটায় আছরে পড়লো তাঁর মুখের উপর।প্রবল উৎসাহে হাঁটার গতি বেড়ে গেল তাঁর। আশীষ বাবু দেখলেন তিনি যেদিকে হেঁটে চলেছেন সেদিকে ঘন বনভূমি বেশ ফাঁকা হয়ে এসেছে। সেদিক থেকেই বাঁধ ভাঙ্গা আলগা জলস্রোতের মতই চোখ ধাঁধানো আলোর বন্যা এসে ছিটকে পড়ছে বনভূমির অভ্যন্তরে স্লেটের মত জমাট বাঁধা কালো অতল অন্ধকারে। আশীষ বাবু ওই পথ ধরেই বাইরে বেরিয়ে এলেন দ্রুত। শরতের বৃষ্টি ধরে গেছে ততক্ষণ।

অন্ধকার গভীর অরণ্যের ভিতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে শরবন, কাশবন ও নানান সবুজ তৃণে আচ্ছাদিত বিস্তীর্ণ একটা লাল নুড়ি কাঁকর মেশানো চরভূমিতে এসে দাঁড়ালেন তিনি। জম জমাট বনভূমি এদিকটায় ফাঁকা হতে হতে শেষ পর্যন্ত একদম প্রায় হালকা হয়ে বিস্তীর্ণ এই ভূমি প্রান্তরে এসে মিশে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে  অরণ্য সঙ্কুল এই বনভূমির একেবারে প্রান্ত দেশ এটা। ইতস্ততঃ ভাবে এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে উট পাখির ডিমের মত অদ্ভুত আকৃতির সব বোল্ডার। ইচ্ছে করলেই যে কোনো একটির পিছনে লুকিয়ে থাকা যায় অনায়াসে। এখান থেকেই আশীষ বাবুর কানে ভেসে এলো খুব শান্ত ভাবে বয়ে চলা নদীর জল প্রবাহের ছলাৎ ছল শব্দ। যেন মিইয়ে পড়া মনে নতুন করে আশার আলো চলকে উঠলো তাঁর। নদীর প্রায় কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়ালেন তিনি। দূর থেকে দেখলেন, একটি সোমত্থ মেয়ে আনমনে তাকিয়ে আছে নদীর জলের দিকে। আশীষ বাবুর মনে হল ভীষণ উদ্বিগ্ন আর চিন্তিত মনে সে যেন কার আগমনের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে সেই অনন্তকাল ধরে। নির্মেদ আর উন্মুক্ত তামাটে পিঠে তার এলোচুল ভাসছে হাওয়ার টানে। পরনে বেড় দিয়ে পরা লাল ফুলছাপা ডুরে শাড়ি। সারা শরীরে মাখা হলুদ বাটার নির্যাস। প্রলেপের মত যেন মিশে আছে উজ্বল সেই শ্যামলা ত্বকে। তার পায়ের কাছে কোথা থেকে হুড়মুড়িয়ে এসে অভিমানীর মত বয়ে চলেছে তির তিরে ধারার দামোদর; অনেকটা শ্রীহীনের মত।

 শরতের আকাশে বৃষ্টি থেমে গিয়ে তখন ঝক ঝক করছে চারিধার। আবির গোলা টকটকে গোলাপী রং ছড়িয়ে রয়েছে আকাশের এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত। সেই রং ছুঁয়ে উড়ে চলেছে দুধ সদা বকের দল। আর নিচে সরু ফিতের মত বয়ে চলা দামোদরের হীরক কুচির ন্যায় স্বচ্ছ জলধারায় আকাশের সে রং গুলে গিয়ে সেখানে এক রং পরিবর্তনের মায়াবী দৃশ্যপট রচনা করছে থেকে থেকে।

চরভূমির উপর পড়ে থাকা বড় একটা গোলাকার পাথরের আড়াল থেকে বেড়িয়ে এলেন আশীষ বাবু। তাঁর সাড়া পেয়ে কিনা জানি না, তিনি স্পষ্ট দেখলেন তাঁকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটি এবার উঠে দাঁড়াল। শাখাহীন ঋজু শাল তামালির ন্যায় তন্বী চেহারা তার। শরীর থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে অপূর্ব এক রূপ লাবণ্যের ছটা। পূর্ণতার গাম্ভীর্যে তার চাপা সরল চাপল্য টুকু যেন ঈষৎ ভারাক্রান্ত। মেয়েটি যেখানে বসে ছিল, সেখান থেকে চঞ্চল পায়ে কিছুটা জলের মধ্যে নেমে স্রোতহীন নদীর ওপাড় থেকে সে যেন তারদিকেই কার আসার পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো। 

ছোটো বড় পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে, বালির চড়ে দামোদরের হাঁটু জলধারা ফিন ফিন করে বয়ে চললেও নদীর দুধার ভাঙতে ভাঙতে কলেবরে বেশ ভালই শ্রী বৃদ্ধি ঘটেছে তার। হয়তো এর নদী খাত ও খুব গভীর ছিল এক সময়! এপাড় থেকে ও পাড় সব কিছু আবছা, ধোঁয়াশা আর অস্পষ্ট লাগে দেখতে। শুধু সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা ধূসর সারিপাহাড়ের উঁচু উঁচু মাথা গুলোই স্পষ্ট দেখা যায় এখান থেকে। আর তার পাশেই যে কোদাল বসতি কোলিয়ারি সেটা কিন্তু বিলক্ষণ চিনতে ভুল হলো না আশীষ বাবুর। তিনি মেয়েটির সেই দৃষ্টিপথের রেখা অনুসরণ করে, কপালের উপর ডান হাত আড়াল করে দুচোখ সামান্য টেনে নিয়ে দেখলেন, ওপার থেকে চলমান একটি বিন্দু ক্রমে শূন্য থেকে মানুষের অবয়ব নিয়ে কেঁপে কেঁপে দামোদরের হাঁটু জল ভেঙ্গে এদিকেই এগিয়ে আসছে খুব ধীরে।   

অতিক্রান্ত বেশ কিছুটা সময় পর ঐ ছায়া শরীরটা মেয়েটির খুব কাছে সরে এলে আশীষ বাবু চিকন চোখে চেয়ে দেখলেন বছর ত্রিশের একটি আদিবাসী কি বাউরি যুবক, ঠোঁটের কোণে মিষ্টি একটা হাসি ঝুলিয়ে মেয়েটির চোখে চোখ রেখেছে। আর মেয়েটিও তার ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের কাছে পেয়ে থেকে থেকে আনন্দে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। সে এক অবিচ্ছিন্ন মিলনের গাঢ় আনন্দ, যার শেষ নেই, সীমা নেই। মেয়েটি ছেলেটির চোখের থেকে একটু ও চোখ না সরিয়ে ছেলেটির হাত ধরে তাকে জল থেকে টেনে তুললো। সিংহের মত প্রশস্থ বুকে সরু কোমর তার। সবল বক্ষ স্থল, গোলেল বাহু। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল। তবে গায়ের রং গুড়ো কয়লার মত মিশমিশে কালো। মেয়েটি আঁচলের খুট দিয়ে তার কপালে ফুটে ওঠা বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখা মুছে দিল। ছেলেটি দেহাতি কায়দায় পরা মলিন ধুতির উপরে রাখা কোমরের কাছ থেকে বার করে আনলো সাদা ফুল ভর্তি ছোটো একটা হাসনুহানার ডাল। সেখান থেকে কয়েকটি ফুল ছিঁড়ে তা পরিয়ে দিলো মেয়েটির অবিন্যস্ত খোঁপাতে। তারপর তারা হাসাহাসি করতে করতে নদীর ধার বরাবর বেনাচিতির জঙ্গলের সরু রাস্তাটা ধরলো একসাথে। আশীষ বাবু পিছন থেকে বেশ খানিকটা দৌড়ে এসে মেঘের মত গম্ভীর স্বরে তাদের উদেশ্যে চিৎকার করে বলল, ‘ ও ভাই শুনছো ! আমি একটু বিপদে পড়েছি, তোমরা আমাকে একটু সাহায্য করবে? ‘

পথ চলতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো তারা। পিছন ফিরে তাঁর দিকে একবার তাকিয়ে, নিজেদের মধ্যে চাওয়াচায়ি করলো কয়েকবার। ছেলেটি পায়ে পায়ে তাঁর দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে আপাদমস্তক খুব ভালো করে দেখে নিল তাঁর। তারপর খানিকটা বিস্মিত হয়ে বলল, ‘ বল কিনে, তু কুন সাহায্যটা চাস আমাদিগের কাছ টো তে ? ‘ 

আশীষ বাবু ভরসা পেলেন তার কথাতে। তিনি তাদের গুছিয়ে বললেন সবটা। চিন্তার একটা স্পষ্ট ভাঁজ ফুটে উঠলো ছেলেটির কপালে কিন্তু সে মুখে কিছু বলল না। শুধু মাত্র লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেলো। 

‘ ইট্টা ত খুবই সমস্যা টোর কুত্থা আছে বাবু। তা বাদে এই ভরা সাঁঝের ব্যালটোয় ইত্ত গুলান লোক তুই পাবি কুথাকে ? ‘ ছেলেটির  একদম গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কথাটি বললো মেয়েটি। তারপর দুদণ্ড সে ভাবলো কি যেন, তারপর আমতা আমতা করে গলা খানিকটা নামিয়ে নিয়ে বললো, ‘ আমার ইকটা কুত্থা তু মান বাবু। চল না কিনে আমাদের ঘর টো তে ? কাল সোক্কাল বিলা লোক জুন ডিক্কে তোর গাড়িটো ঠিক করায়ে তুকে সদরে পৌঁছে দিবেক কিনে।’ আশীষ বাবু লক্ষ্য করলেন কপালে তার সন্ধ্যা গোধূলিরতে পাকা বটের ফলের মত ছোট্ট লাল টিপ। আর সেটাকে ঘিরে ফোঁটায় ফোঁটায় শ্বেত চন্দনের বৃত্ত। থুতনিতে খুব ছোট তিনটি কালো ফোঁটা। বন্য মেয়েটির এই মহানুভবতা মেনে নেওয়া ছাড়া আশীষ বাবুর কাছে আর অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না। এই বন পাহাড়ের খোলা আকাশের নীচে গোটা রাতটা কাটানোর চেয়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত এই মানুষের সঙ্গ নেওয়াটাই ঠিক বলে মনে করলেন তিনি। ডাইনে ঘন বনভূমির প্রান্তরেখা, ও বামে দামোদরের সরু স্রোত চরের পাশ দিয়েই এঁকে বেঁকে চলে গেছে। আর এই দুইয়ের মাঝে বেনাচিতি আর রাংচিতির আগাছার মধ্যে দিয়ে মানুষের পায়ের ছাপে তৈরী সরু রাস্তা ধরে তাদের সাথে অজানা এক গন্তব্যের দিকে হেঁটে চলেছেন আশীষ বাবু। ধূসর আর রুক্ষ দামোদরের চরে চিতার পোড়া কাঠ, মাটির মালসা,ভাঙ্গা কলসী, হাড়ের টুকরো এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

আকাশের গায়ে সূর্য ডোবার পর যে গোলাপী আভাটুকু ছিল এতক্ষন, তা মুছে গিয়ে গাছের পাতায় পাতায় কালচে ফ্যাকাসে রঙের সন্ধ্যা নামলো এইবার। সেই ফ্যাকাসে অন্ধকারের দিকে মাথা উঁচু করে একবার চাইলেন আশীষ বাবু। কালচে আকাশের একপ্রান্তে সন্ধ্যা তারা মিটমিট করে জ্বলছে। চলার পথে আশীষ বাবু জানতে পেরেছেন যে ছেলেটির নাম বুধুন আর মেয়েটি বুধিয়া। আরো খানিকটা উত্তর দিকে হেঁটে আবার জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে বুধুন আর বুধিয়া যখন তাদের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল, তখন গভীর আঁধারে গা চুবিয়ে নিঝুম হয়ে আছে পুরো বাড়িটা। তাদের সাড়া পেয়ে গোটা বাড়িটা এবার যেন গম গম করে উঠলো। 

বুধুনই সবার প্রথমে উঁচু মাটির দাওয়ার উপর উঠে ঘরের ভিতর থেকে খুব মৃদু একটা লণ্ঠনের আলো হতে নিয়ে বেড়িয়ে এলো। বাঁশের খুঁটির গায়ে সেটা ঝুলিয়ে দিয়ে খুব আলতো করে বলল, ‘ উট্ঠে আয় বাবু ‘। বুধিয়া বারান্দার এক পাশ থেকে নিয়ে এসে লম্বা করে পেতে দিলো হতে বোনা একটা খেজুরের পাটি। ওটার উপর আরাম করে বসলেন আশীষ বাবু। বুধুন তার গলাটা খানিকটা ঝেরে নিয়ে বলল, ‘ বাবু হামরা ছোট্ট লোক আছি। ছোট্ট জাত ! তাবাদে হেই ছোট্ট লকগুলানের হাত টো তে খেলে বা ছোঁয়া টো লাগলে তোর জাত যাবেক লা তো ! ‘

তার এই কথাগুলো যেন গালে সপাটে একটা চড় মারার মত অনুভূতি নিয়ে এলো আশীষ বাবুর কাছে। বুধুনের কথা শুনে শুধু হো হো করে হাসলেন তিনি কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। 

আশীষ বাবুর জন্য খাবার জোগাড় করতে, তাঁকে একলা বসিয়ে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো বুধুন আর বুধিয়া। একলা বসে থাকতে থাকতে কতটা সময় পেরিয়ে গেছে সে খেয়াল নেই তাঁর। প্রথম দিকে যে ভয়টা তাঁর মনের মধ্যে পাকিয়ে উঠে পা কাঁপিয়ে দিচ্ছিল, সেটা এখন প্রায় অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ঝিম ধরে থাকা গহীন এই অরন্যভূমির অপার নীরবতার মাঝে খুব একা আর অসহায় লাগছিল নিজেকে। বারে বারে শুধু কেবলই তাঁর মনে হচ্ছে কোন এক অনভিপ্রেত ঝঞ্ঝার আগমনে শান্ত বনভূমির সুর,তাল, লয় যেন কেটে গেছে। মনে হলো, এমন এক একটি রাত হয়তো জীবনে কখনো কখনো আসে এক আধবার। তাই এই রাত তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবার।

ভাদ্র মাসের অন্ধকার রাত্রি। হয়তো খুব কাছেই চলে এসেছে অমাবস্যা। আকাশে মেঘ জমেছে, সেই মেঘ সরিয়ে মাঝ আকাশে খয়াটে চাঁদের ম্লান আলো বড় বড় গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে বুধিয়ার নিকানো উঠানে এসে পড়েছে। পাতার ছায়া মাটিতে পড়ে ঘন হয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে থেকে থেকে। ঝি ঝি পোকা ডেকে চলেছে একটানা। অন্ধকারের মধ্যে বেশ কিছু জোনাকী  ঢেউয়ের মতো উঠছে আর নামছে। কতক্ষন স্থানুর মত এভাবে বসেছিলেন আশীষ বাবু, তা খেয়াল নেই তাঁর। সহসা একটা নিশাচর পাখি প্রহর ঘোষণা করে উঠলো, সঙ্গে আরো পাখি সাড়া দিল তাতে। নিঃশব্দ বনভূমির মধ্যে যেন একটা চাঞ্চল্য বয়ে গেলো অদৃশ্য এক তরঙ্গের মত। আশীষ বাবুর মনে হলো, পাতায় পাতায় ঘর্ষণ তুলে অস্বস্তিকর কিছু একটা দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে বনভূমির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত। তিনি কান খাড়া করে থাকলেন। মনে হল, কে যেন রিনরিনে কণ্ঠে আর খুব পাতলা সুরে, গান গেয়ে খুঁজে চলেছে তার সাথী কে। শীতের সকালে পাতলা খেজুরের রসের মতই সে সুর। বেশিক্ষণ ধরে কানে এলে যেন নেশা হয়ে যায়। তিনি পায়ে পায়ে বেড়িয়ে এলেন ঘর ছেড়ে উঠানের এক প্রান্তে। স্পষ্ট শুনতে পেলেন একটা খিল খিলে হাসির আওয়াজ ভেসে গেলো বৃহৎ বনস্পতির মাথার উপর দিয়ে। তীব্রতম এক উত্তেজনায় থর থর করে কেঁপে উঠলেন তিনি। সর্বশরীরে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে গেলো তাঁর। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেলো এভাবেই। বুধুন ও বুধিয়ার সমবেত গলার আওয়াজ পেতেই তিনি সামলে নিলেন নিজেকে। ঘর ছেড়ে এই অন্ধকারের মধ্যে তাঁর এত দুর চলে আসতে ওরাও অবাক হল একটু।

আশীষ বাবু দেখলেন বুধুন ও বুধিয়ার সাথে তাদেরই সম বয়সি বেশ কয়েকটি ছেলে মেয়ে হতে লণ্ঠনের আলো ঝুলিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর সামনে। এগিয়ে এসে বুধিয়া তাঁর হাতে তুলে দিলো বেশ কিছু টাটকা ফল। যেন এই মাত্র পেড়ে আনা হোয়েছে সব। বুধন উঠানের এক পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা খাটিয়াটা পেতে দিয়ে হাত ধরে বসলো তাঁকে। তারপর উঠানের অন্য পাশে রাখা শুকনো কাঠের স্তূপ থেকে বেশ কিছু কাঠ এনে চকমকি ঘষে আগুন দিলো তাতে। শুকনো কাঠ আগুনের ইন্ধন পেয়ে জ্বলে উঠলো দাউ দাউ করে। ঐ ছেলে মেয়েগুল হাত থেকে নামিয়ে রাখলো বেশ কয়েকটি পাকি মদের বোতল আর কচি শাল পাতায় জরানো সজারুর কাঁচা মাংস। মোরগ ফুলের মত ওঠা আগুনকে গোল করে ঘিরে ধরে হাতে হাত রেখে দাঁড়ালো তারা। বুধন মাদলে বোল তুললো গিজযাযা গিজাঙ, গিজযাযা গিজাঙ, গিজাঙ গিজাঙ, গিজযা গিজাঙঙ। পায়ের পাতায় পা মিলিয়ে অপূর্ব এক শারীরিক বিভঙ্গে দুলে উঠলো তারা। হাতের বেড় দিয়ে কোমর ধরে কখনো সামনের দিকে ঝুঁকে কখনো বা পিছনে সরে সরে অদ্ভুত এক লাস্যময় নাচের সাথে সাথে ছাড়া বলার মত সুর করে সবাই একসাথে গলা মিলিয়ে গেয়ে উঠলো গান। এই মধ্যরাতে গমগম করে উঠলো বুধুনের গোবরে নিকানো উঠোন। অনেক্ষন পর নাচ গান থেমে গেলে আগুনের কাছে ঘন হয়ে বসলো তারা। আগুন নিভে গিয়ে শক্ত জ্বলন্ত কাঠ টকটকে লাল হয়ে রয়েছে। বুধন একটা পোড়া কাঠ খুঁচিয়ে আগুন টাকে তুলতে চেষ্টা করলো। ফট ফট শব্দ করে সরু লাল সুতোর মত ঝিরঝিরে আগুন শিখা উঠেই তা মিশে গেলো বাতাসে। সজারু মাংস স্যাঁকার গন্ধ ম ম করছে চারিধার। তারা গলায় ঢালছে পাকি মদ। হেসে লটোপুটি খাচ্ছে আর ঢলে ঢলে পড়ছে এ ওর গায়ে। নিভন্ত আগুনের লালবর্ণ রং যেন বিধুনের খোলা আর প্রশস্থ বুকের উপর এসে ঘাম তেলের মত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। বুধিয়া ওখান থেকে উঠে এসে আশীষ বাবুর হতে তুলে দিল একটা পাকি মদের বোতল আর বেশ কিছু সজারুর পোড়া মাংস। ঢক ঢক করে গলায় ঢাললেন তিনি। মাথাটা এক নিমিষেই ঝিম ঝিম করে উঠল তাঁর। নিভন্ত আগুন ঘিরে বসা বুধন আর বুধিয়াদের গলার স্বর, তাদের হৈ হট্টগোলের আওয়াজ কোনো কিছুই যেন তাঁর কানে আসছে না। সন্ধ্যায় অস্তমিত সূর্যের রক্তিম আভার মত অস্বাভাবিক রকমের লাল হয়ে উঠেছে সবার চোখ গুলো। প্রচণ্ড নেশার ঝোঁকে কেউ বা হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে ধুলোয়, কেউবা তার সঙ্গীর কোমর ধরে সোহাগ করতে ব্যস্ত। আশীষ বাবুর দুই কান যেন স্তব্ধ আর ঝাপ ধরে আসছে। শরীর ও শিথিল হয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। দৃষ্টি শক্তি হয়ে উঠছে ক্ষীণ আর ঝাপসা। হঠাৎ বনাঞ্চলের স্তব্ধতা চিড়ে শেষে প্রহরের ঘোষণা করে কর্কশ স্বরে ডেকে উঠলো পাখির দল। রাতের ঘন আধাঁরে ডুবে থাকা বনভূমির মধ্যে গভীর আলোড়ন উঠলো চকিতে। নদীর চর থেকে ডেকে উঠলো শিবারা। আশীষ বাবু খুব ঘোলাটে আর জড়িয়ে আসা চোখে লক্ষ্য করলেন বুধন, বুধিয়া আর তার দলের অন্যান্যরা কিসের জন্য যেন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে হঠাৎ করে। মনে হলো নেশা তাদের কেটে গেছে অনেক আগেই, যেন সব সময় শেষ হয়ে এসেছে এবার তাই ফিরে যাওয়ার তাড়া। ক্রমপ্রবাহমান একটা চাঞ্চল্যের চোরা স্রোত বয়ে যাচ্ছে তাদের মধ্যে দিয়ে। আশীষ বাবু আর চেয়ে থাকতে পারছেন না। যেন কোনো মায়ার এক অনাবিল যাদু স্পর্শে তাঁর দুচোখ বুজে আসছে। তিনি শেষ বারের মত চোখ বন্ধ করে নেওয়ার আগে দেখলেন, বাতাসে ভেসে থাকা ধোঁয়া ধোঁয়া আবছা কুয়াশার আস্তরণ গাঢ় থেকে অতি গাঢ় হয়ে সব কিছুকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে গ্রাস করছে ক্রমে। বুধুন, বুধিয়া আর তার সঙ্গী সাথীরা সবাই যেন গুড়ো গুড়ো হয়ে মিশে যাচ্ছে কুণ্ডলী পাকানো সেই হিমেল কুয়াশার গভীর জটাজুটে।

তখন পূর্ব দিক থেকে জঙ্গলের মাথা টপকে সূর্যের আলো বনভূমির ভিতরে এসে পড়েছে। খুব ধীরে ধীরে স্নায়ু সচল হয়ে উঠছে আশীষ বাবুর। আলতো করে চোখের পাতা খুলতেই বল্লমের মত লম্বা সূর্য রশ্মি ছিটকে এসে প্রবল ভাবে বিধলো তার চোখে। ভারী হয়ে থাকা চোখের পাতা খোলার চেষ্টা করলেন আবার কিন্তু পারলেন না। খুব ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে নিজেকে যেন ফিরে পাচ্ছেন তিনি। ডান হাতের আঙ্গুল কেঁপে উঠল, পা টাও নড়ে উঠলো সামান্য। কানে খুব হালকা করে ভেসে এলো শাখায় শাখায় উরে যাওয়া পাখপাখালির প্রভাতী সুর মূর্ছনা। কে যেন কুড়ুল দিয়ে কাঠ কাটছে ঠক ঠক করে। দূর থেকে ভেসে আসা সে আওয়াজ খুব তীক্ষ্ম হয়ে এবার কানে বিধলো তাঁর। দুচোখ খুললেন তিনি। মাথা ভারী হয়ে আছে, সর্ব শরীরে যন্ত্রণা। চোখ খুলতেই দেখলেন উপর থেকে তিন জোড়া চোখ সাটান তাকিয়ে আছে তার দিকে। আর তিনি লতাপাতা গুলমাদি জড়িয়ে মোটা ঘাসের চাদরের উপর পড়ে আছেন অবিন্যস্ত ভাবে। চমকে উঠলেন তিনি। কোথায় বুধন কোথায় বুধিয়া ? কোথায় বা তাদের সঙ্গী সাথীরা? কোথায় তাদের ঘর, মাটির দাওয়া, নিকানো উঠান! দেখে তো এটাকে একটা কবর স্থান বলেই মনে হচ্ছে! চারিদিকে ঘন জঙ্গলের এহেন পটপরিবর্তনে খুব অবাক হয়ে গেলেন তিনি। আশীষ বাবু যতটানা ভয় পেলেন তার থেকে অবাক হলেন বহুগুণ বেশি। কানুইয়ের উপর ভর দিয়ে উঠে বসতে চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না। শেষ মেস ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা ঐ লোক গুলোই হাত ধরে টেনে তুললো তাঁকে। তাদেরকে দেখে কাঠুরিয়া বলেই মনে হল। তাদের কাঁধেই ভর দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এলেন গভীর অরণ্যের সেই ভূমি প্রান্তর থেকে। কাল তিনি যে পথে এসেছিলেন , ঠিক তার উল্টো পথে নদীর ধার ঘেষে আরো খানিকটা পথ দক্ষিণে গিয়ে কচ্ছপের পিঠের মত একটা উঁচু টিলার উপর পৌঁছল তারা। তাঁর অনিতি দূরেই হেলে পড়া মস্ত একটা পাকুড় গাছের নিচে শ্মশান কালীর একটা জীর্ণ মন্দির। মন্দিরের সিমেন্ট করা লাল চাতালের ঠিক মাঝখানে সিঁদুর মাখানো হাড়ি কাঠের পাশে এক গোছা ধূপকাঠি জ্বলছে। তার পাশ দিয়ে এসে জুতো খুলে মন্দিরে দাঁড়াতেই দেখলেন, প্রয়ান্ধকার মন্দিরে কাঠের খোলা দরজা দিয়ে সকালে সূর্যের নরম আলো লম্বা ভাবে এসে একদম লুটিয়ে পড়েছে। ভিতরে প্রদীপের আলোয় আরতির ঘণ্টা ধ্বনি। রক্তবর্ণ কাপড় পরিহিত এক বৃদ্ধ পূজারী তখন পুজোতে ব্যস্ত। তিনি মন্ত্রচ্চারন করতে করতে এক ঝলক দেখে নিলেন আশীষ বাবুকে। ইশারায় তাঁকে বসতে বলে অন্যদের সেখান থেকে চলে যেতে নির্দেশ দিলেন। মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করে একদম দেবী মূর্তির সামনেই থেবরে বসলেন তিনি। পূজারী পুজো শেষ করে মায়ের পায়ের কাছে রাখা পিতলের ঘটিটি নড়িয়ে দিলেন সামান্য। তারপর ঘটির উপরে রাখা আম্রপল্লবটিকে ঐ ঘটি জলে চুবিয়ে দুর্বোধ্য এক মন্ত্রচ্চারন করতে করতে ফোঁটায় ফোঁটায় ছিটিয়ে দিলেন আশীষ বাবুর শরীরে। বিদ্যুৎ প্রবাহের মত এক পাকানো শক্তি শেল যেন জড়িয়ে ধরলো তাঁকে। শ্মশান কালী মায়ের পা থেকে ডান হাতের বুড়ো আঙুলের মাথায় সিঁদুর লাগিয়ে এনে লম্বা ভাবে পরিয়ে দিলেন কপালে। আশীষ বাবু কিছু বলতে চাইলেন, কিন্তু থামিয়ে দিলেন পূজারী। ওই সিঁদুরের টিপের উপর করে আঙ্গুল ঠেকিয়ে অর্ধেক চোখ বন্ধ করে অদ্ভুত এক সুরেলা কণ্ঠে মন্ত্রচ্চারন শুরু করলেন তিনি। আশীষ বাবু দেখলেন পূজারীর চোখের মণি দুটি কেঁপে কেঁপে উঠছে। মনে হল তাঁর শরীর তুলোর মত হালকা হয়ে আসছে। শরীরের যত ব্যাথা,বেদনা, কুর্পরের  মত উবে যাচ্ছে এক লহমায়। 

পূজারী শান্ত হলেন এবার। খুব ধীরে ধীরে পূজার আসনে বসা পা দুটোকে খানিকটা টান টান করে এবার একটু আরাম করে বসলেন তিনি। পানের ডিবে থেকে একটা পান বার করে মুখে ঠুসে দিয়ে বললেন, ‘ আমি কর্ণ পিশাচ সিদ্ধ। তাই কোনো কিছুই আমার অজানা নয়। আপনারা শিক্ষিত লোকেরা এসব তো আর বিশ্বাস করবেন না, তবুও বলছি, এই বিশ্ব সংসারে জীবন ও মরণ, একই শক্তির দুটি বিরোধী রূপ। এ বিরোধের মধ্যে সন্ধির কোনো মধ্য পথ নেই। তাই মরণের পর আত্মার পূর্ণ বিলুপ্তি কখনো ঘটে কখনো নয়। তাই পরপারের ওপার থেকে অবিলুপ্ত আত্মা মহাকালের দেখানো রেখাপথ ধরে ফিরে ফিরে আসে বার বার। কখনো বা আদিম মহাপ্রকৃতিতে প্রচ্ছন্ন ভাবে বাস ও করে। একটু একটু করে সব কিছুকে গ্রাস করে পরিশেষে নিজেই ধ্বংস হয়ে যায় এই মাটির পৃথিবীতে।

একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস গোপন করে নিলেন আশীষ বাবু। ‘ কিন্তু আমি তো কোনো অর্থই খুঁজে পাচ্ছি না আপনার কথায়।’ বেশ খানিকটা বিস্মিত হয়ে বললেন তিনি। পূজারী এবার যেন খানিকটা ভাবনার সাগরে ডুব দিলেন। পিছনে রাখা পিকদানিতে খানিকটা পিক ফেলে বললেন, ‘ সেটাই তো স্বাভাবিক। তবে আগাগোড়া শুনুন গোটা ঘটনাটা। আশা করি সমস্তটাই বুঝবেন এবার।’ বলতে শুরু করলেন পূজারী।

 ‘ আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে কার কথা। কোদাল বস্তি কোলিয়ারির মাতব্বরই বলেন আর মুরুব্বিই বলেন, বনয়ারি লাল ছিল ঐ বস্তির শেষ কথা। তার নির্দেশে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেতে। গোটা সমাজটা তার কথাতে উঠতো তার কথাতেই বসত। তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার মত সাহস বা স্পর্ধা কারোরই প্রায় ছিল না। তিনি শত বিপদ, ঝড় ঝঞ্ঝার হাত থেকে বুক দিয়ে আগলে রাখত কোদাল বস্তি আর গোটা সমজটিকে।

তাই সকলের কাছেই সে ছিল ভীষণ প্রিয় ও শ্রদ্ধেয়। কিন্তু এর মধ্যেই ঘটে গেলো ঘটনাটি। লাজ লজ্জা ভয় সব কিছুকে উপেক্ষা করে তার মা মরা একমাত্র মেয়ে বুধিয়া ভালোবেসে ফেললো কোদাল বস্তি কোলিয়ারির এক সামান্য কুলি বুধুনকে। তাদের জাতের হলেও বুধিয়া ছিল দলপতির মেয়ে, আর বুধুন কোলিয়ারির সামান্য এক দিন মজুর। বৃদ্ধ বনোয়ারি লাল সহজে মেনে নেবেন কেন ! তিনি শর্ত রাখলেন এক চান্দ্রমাসের মধ্যে যদি বুধুন দশ টাকা আর দুটি বড়ো পাঠা এনে তার পায়ের কাছে রেখে দিতে পারে তবে বুধিয়া তার। সে খুব ভালো করে জানত যে তার দেওয়া এই শর্ত বুধুন কিছুতেই পূরণ করতে পারবে না। আর সত্যিই সত্যিই বাস্তবে ঘটলো ও তাই। বুধুন দুটো পাঠা তো জোগাড় করে ফেলেছিল কিন্তু ওই নির্দিষ্ট দিনের দুদিন আগে পর্যন্ত সে দুটো টাকার বেশি ব্যাবস্থা করতে পারলো না। বনয়ারিলাল আর দেরি না করে তাদের সমাজের ভবি বা হবু দলপতি বছর ত্রিশের লাখাইয়ের সাথে বুধিয়ার সাঙার দিন ঠিক করে ফেললো। দেখতে দেখতে সেই দিনটিও এসে গেলো। নাছোড় আর আপাত শান্ত বুধিয়া বাপের অবাধ্য হয়ে উঠলো এবার। সেদিন সন্ধ্যায় উঠানে লাগানো দড়িতে লাল, নীল কাগজের রংবেরঙের পতাকা পত পত করে উড়ছে। মশালের আলোয় সেজে উঠেছে বনোয়ারির উঠান। জোয়ান ছেলে ছোকরা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, বৃদ্ধ,মহিলারা পর্যন্ত শুয়োরের চর্বি সহযোগে পাকি মদ খেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছে। ঠিক তখনই একটা চাপা সোরগোল উঠলো বনয়ারির বাড়ির ঐ বিবাহ বাসরে। শোনা গেলো ভরা এই সাঁঝের বেলায় দামোদরের গভীর জলে ঝাঁপ দিয়ে বুধুন আত্মহত্যা করেছে। খোলা আকাশের নিচে পড়া বাজের তীব্রতার মত সে খবর ছড়িয়ে পড়লো কোলিয়ারির এক প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত। বুধিয়ার কপালে তখন বট ফলের মত লাল টিপ টক টক করছে। ওটাকে কেন্দ্র করে সাদা ফোঁটায় ফোঁটায় চন্দনের ছাপ। গায়ে কাঁচা হলুদ বাটার গন্ধ মাখা অপূর্ব এক মায়াবী রুপোলাবন্যে সে কেঁপে উঠল খবরটা শুনে। ডান হাত দিয়ে ঘেঁটে দিলো কপালে মাখানো চন্দনের ফোঁটা। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে বুধুন কিছুতেই হেরে যাবে না। শেষ পর্যন্ত সে তার বাপের মুখের উপর ভেটের টাকা ছুঁড়ে দিয়ে তাকে ঠিক নিয়ে যাবে। তাই বিয়ের সাজে সেজে গুজে বসে ছিল সে। বুধুনের মৃত্যুর খবর শুনে পাথরের মত নিশ্চুপ আর নির্বাক হয়ে গেল। তারপর সবার অলক্ষ্যে ঘরের পিছনের দরজা দিয়ে এক ছুটে দৌড় দিলো শাল পাহাড়ির ঘন জঙ্গলের দিকে। সে রাতে তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেলো না। পরের দিন অবশ্যি দুজনকেই খুঁজে পাওয়া যায় মৃত অবস্থায়। বুধুন দামোদরের ওধারের একটি চরের গায়ে আটকে ছিল। আর ঝুলন্ত বুধিয়াকে নামিয়ে আনা হয়েছিল বড় একটি বুনো জাম গাছের ডাল থেকে।’ 

এই পর্যন্ত বলে একটু থামলেন পূজারী। আশীষ বাবুর চোখে মুখে বিস্ময়ের ঘোর। তিনি ছোট্ট একটা ঢোক গিলে নিয়ে কাঁপা গলায় বললেন, ‘ তারপর ? ‘

খানিক ক্ষণ চুপ করে রইলেন পূজারী। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ তারপর আর কি। বেঁচে থেকে যারা উঁচু নিচু,জাতপাতের দোহাই দেখিয়ে একে অন্যকে কাছে পেল না। মৃত্যুর পর দামোদরের সরু ঐ চরের ওধারে ঘন জঙ্গলের মধ্যে পাশাপাশি শুইয়ে দেওয়া হল চিরতরে। মানে আজ যেখান থেকে আপনাকে পাওয়া গেছিলো সেখানেই আর কি। দুদিন বাদেই কৌশিকী অমাবস্যা। প্রতি ভাদ্র মাসে কালকের এই নির্দিষ্ট দিনে ওরা প্রতি বছরই ফিরে ফিরে আসে এভাবে। নাচে গায়, আমোদ প্রমোদ আর স্ফূর্তি করে। আপনার মতই বিশেষ বিশেষ কাউকে স্বেচ্ছায় দেখা দেয় ওরা। তবে হ্যাঁ আজ পর্যন্ত ক্ষতি কারোর করে নি। আপনি তো নতুন মানুষ এদিক কার। তাই এদের অমর প্রেম গাঁথার কথা জানেন না।’

শব্দহীন হয়ে এলো মন্দির চত্বর। 

যেন নিজের শ্বাসের শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছেন আশীষ বাবু। উঠে দাঁড়ালেন তিনি। মন্দির থেকে নেমে এসে পায়ে জুতো গলিয়ে ঢাল বেয়ে নেমে এলেন দামোদরের শুকনো চরের উপর। চলার পথে তুলে নিলেন এক গোছা হাসনুহানা। পায়ে পায়ে জঙ্গলে ঢুকে সোজা এসে দাঁড়ালেন সেই কবর স্থানের সামনে। যেখানে পরম নিশ্চিন্তে সেই অনন্ত কাল ধরে হাত ধরা ধরি করে শুয়ে আছে বুধুন ও বুধিয়া। দুই হাঁটু ভাজ করে বসে স্নেহের পরশ রাখলেন তাদের শিয়রে। সমাধি সাজিয়ে দিলেন সাদা হাসনুহানার ফুলে ফুলে। মনে মনে বললেন, হে মহামানব! এই তুচ্ছ জাত পাত আর উঁচু নিচুর দোহাই দিয়ে যারা তোমাদের ভালোবাসার অধিকারকে কেড়েছে, জন্ম আর জন্মান্তরেও মহাকাল তাদের ক্ষমা করবে না। কুচক্রী মানুষের অর্থ লিপ্সায় তোমাদের ভালোবাসা ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু পরপারে তোমরা সুখী হয়ো। আশীষ বাবু দুচোখের কোণে গড়িয়ে পড়া দুফোঁটা জল তাঁর শার্টের আস্তিনে মুছে, পিছনের দিকে একটি বার ও না তাকিয়ে, বেরিয়ে এলেন গভীর জঙ্গল থেকে। তাঁর কানে তখনো বেজে চলেছে কালকের ওই মাদলের আওয়াজ গিজযা গিজাঙ, গিজযা গিজাঙ, গিজাঙ গিজাঙ।

শালপাহাড়ির জঙ্গলে ভৌতিক গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!