আদ্যাশক্তি জগজ্জননী দেবী দুর্গা প্রবন্ধ – রূপম চক্রবর্ত্তী
দুর্গাপূজা মূলত শক্তির আরাধনা। এর দর্শনটি হলো, দুর্বলের কোনো আত্মজ্ঞান হয় না, জীবনে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য চাই শক্তির সাধনা। আর ব্রহ্ম পরিপূর্ণতা লাভ করেন শক্তিতে। শক্তির পরিপূর্ণতার রূপায়ণ ঘটে জগৎসৃষ্টিতে।তিনি আদ্যাশক্তি, মহামায়া, শিবানী, ভবানী, দশভুজা, সিংহবাহনা ইত্যাদি নামে অভিহিত হন। দুর্গ বা দুর্গম নামক দৈত্যকে বধ করেন বলে তাঁর নাম হয় দুর্গা। জীবের দুর্গতি নাশ করেন বলেও তাঁকে দুর্গা বলা হয়। ব্রহ্মার বরে পুরুষের অবধ্য মহিষাসুর নামে এক দানব স্বর্গরাজ্য দখল করলে রাজ্যহারা দেবতারা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। বিষ্ণুর নির্দেশে সকল দেবতার তেজঃপুঞ্জ থেকে যে দেবীর জন্ম হয় তিনিই দুর্গা। দেবতাদের শক্তিতে শক্তিময়ী এবং বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিতা হয়ে এ দেবী যুদ্ধে মহিষাসুরকে বধ করেন।
মানবসভ্যতার আদিতে মানুষের বসবাসের সুরক্ষিত স্থান ছিল দুর্গ, আর এই দুর্গের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ছিলেন দুর্গা। আবার ‘স্কন্দ পুরাণ’-এ বলা হয়েছে, দুর্গ নামক এক অশুভ শক্তিকে বধ করার জন্য এক শক্তিময়ী নারীকে ‘দুর্গা’ নামে অভিহিত করা হয়। ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণ’-এ (দেবী মাহাত্ম্য ১১.৪৯-৫০) এই দৈত্যের নাম ‘দুর্গম’। ‘দুর্গা’ শব্দটি পাওয়া যায় ঋক্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, মনুস্মৃতি, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থে। ‘ঋক্বেদ’-এর দেবীসূক্তে (১০.১২৫) ও রাত্রিসূক্তে (১০.১২৭) এই দেবীর উল্লেখ আছে। ‘তৈত্তরীয় আরণ্যক উপনিষদ’-এ দুর্গা দেবী রূপে আবির্ভূতা হন। ‘কেনোপনিষদ’-এ উমা হৈমবতীকে সর্বশক্তিময়ী রূপে পাওয়া যায়। যিনি দুর্গার সঙ্গে অভিন্ন। ‘দেবীভাগবত’-এ (১২.৮) উমাকে বলা হয়েছে শিবা বা শিবানী।
দুর্গাপূজার প্রচলন সম্পর্কে পুরাণে লিখিত হয়েছে যে, পুরাকালে রাজ্যহারা রাজা সুরথ এবং স্বজনপ্রতারিত সমাধি বৈশ্য একদিন মেধস মুনির আশ্রমে যান। সেখানে মুনির পরামর্শে তাঁরা দেবী দুর্গার পূজা করেন। পূজায় তুষ্টা দেবীর বরে তাঁদের মনস্কামনা পূর্ণ হয়। এ পূজা বসন্তকালে হয়েছিল বলে এর এক নাম ‘বাসন্তী’ পূজা। , কালিকাপুরাণ, দেবীভাগবত, মহাভাগবত, বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণ, কালীবিলাসতন্ত্র দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী, দুর্গোৎসববিবেক, দুর্গোৎসবতত্ত্ব প্রভৃতি গ্রন্থে দেবী দুর্গা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা আছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকে জানা যায় যে, রামচন্দ্র রাবণবধের জন্য অকালে শরৎকালে দেবীর পূজা করেছিলেন। তখন থেকে এর নাম হয় অকালবোধন বা শারদীয়া দুর্গাপূজা।
শ্রাবণ থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত যখন সূর্যের দক্ষিণায়ন ঘটে তখন দেবতাদের রাত্রি এবং মাঘ থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত যখন সূর্যের উত্তরায়ন থাকে তখন দেবতাদের দিন সংঘটিত হয়। অর্থাৎ এই আশ্বিন মাস বা শরৎকালের দেবতাদের নিদ্রা সময়। আগেই বলেছে বোধন শব্দের অর্থ জাগানো। তাহলে এই সময় দেব দেবীদেরকে তাদের ঘুম থেকে জাগাতে হোলে অকালবোধন করতে হবে। রাম ব্রহ্মাকে যখন এই কথা জানান তখন ব্রহ্মা রামকে বলেন আমি তোমাকে বিধান দিচ্ছি তুমি দেবী দুর্গাকে পুজো করো সেই পারে একমাত্র তোমাকে রাবণকে বধ করার বর দিতে।
যথাবিহিত তাই হল। শুক্লাপক্ষের সন্ধ্যার সময় বেল তলাতে দেবীর বোধন হল। রাম নিজেই নবপত্রিকা বাধলেন। প্রভাতে স্নান শেষে সপ্তমীর দিন থেকে শ্রীরামচন্দ্র দেবীর পূজা শুরু করলেন। পূজা চলল অষ্টমী তিথি পর্যন্ত; পূজা হলো চণ্ডীপাঠের মাধ্যম দিয়ে তন্ত্র মন্ত্র সহ। সেখানে আছে বনফুল বনফলের সমাহার। অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে রামচন্দ্র সন্ধ্যাপুজা করলেন। কিন্তু এই তিথিতে ও দেবীর আবির্ভাব ঘটল না। নবমী তিথিতে বিভীষণ বললেন নীলকমল দিয়ে মাকে পুজো করলে নিশ্চয়ই মা সন্তুষ্ট হবেন এবং শ্রী রামচন্দ্রের সামনে অধিষ্ঠিত হবেন। কিন্তু এই নীলপদ্ম ধরাধামে একমাত্র দেবীদহ হ্রদে পাওয়া যায় যেখান থেকে আনা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার কারন দেবিদহ হ্রদ ছিল লঙ্কা থেকে বহুদুরে। কিন্তু সংকটমোচন শ্রীহনুমান এই অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেললেন।
হনুমান ১০৮টি নীলপদ্ম নিয়ে উপস্থিত হলেন। শুরু হলো নবমী তিথিতে মা দুর্গার আরাধনা। কিন্তু একই সেখানে এক ১০৮ টি পদ্মের জায়গায় ১০৭ টি পদ্ম মিলল; একটা অমিল কেন। রামচন্দ্র ও তার প্রতিজ্ঞায় অনড় দেবী মাকে তিনি সন্তুষ্ট করবেনই। রামচন্দ্র নির্ণয় করলেন যে তার অক্ষিদ্বয়ও তো নীল। সুতরাং তিনি একটি নীলপদ্ম যা অমিল ছিল তা তার অক্ষি দান করে মাকে সন্তুষ্ট করবেন। সেইমতো রামচন্দ্র নিজের চোখ উপড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং মা এসে সেই সময় তার হাত আটকে ধরেন এবং রামচন্দ্র মায়ের বর প্রাপ্ত হলেন। আর তারপর রাবণকে বধ করলেন নবমী তিথিতে। এই ভাবেই রামচন্দ্রের দ্বারা মা দুর্গার অকাল বোধন হয়েছিল। বিজয় দশমীতে রাবণের চিতা জ্বলল।
বাসন্তী পূজা হয় চৈত্রের শুক্লপক্ষে, আর শারদীয়া পূজা হয় সাধারণত আশ্বিনের কখনও বা কার্তিকের শুক্লপক্ষে। বর্তমানে শারদীয়া পূজাই সমধিক প্রচলিত। এসময় শুক্লা ষষ্ঠীতিথিতে দেবীর বোধন হয় এবং সপ্তমী, অষ্টমী ও নমবী (মহানবমী)-তে পূজা দিয়ে দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। এদিন দশোহরার মেলা হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন নতুন পোশাক পরে দশোহরার মেলায় যায়। মেলার দিন নৌকা বাইচ বিশেষ আকর্ষণের বিষয়। সকলে কোলাকুলি, প্রণাম, আশীর্বাদ ইত্যাদির মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময় করে। বৎসরের সুন্দরতম ঋতুতে বাংলার নিসর্গ-প্রকৃতি যখন সুস্নিগ্ধ লাবণ্যে অপরূপ হয়ে ওঠে, তখনই দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। শারদ এই শুভলগ্নে প্রকৃতিই প্রকৃতি হয়ে উঠে নির্মেঘ আকাশ হয়ে উঠে সুনীল এরইমধ্যে প্রকৃতি তাঁর স্বর্ণোজ্জ্বল রৌদ্রের প্রদীপালােকে জগন্মাতার বন্দনার আয়ােজন করে। শরৎ ঋতুর আগমনে মৃৎ-শিল্পীর দিবারাত্রির পরিশ্রমে দেবী দুর্গা মৃন্ময়ীরূপে দৃষ্টিগােচর হয়ে ওঠেন, বিপণিতে নয়নলােভন পণ্য আনন্দোচ্ছল ক্রেতার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। প্রবাসী কর্মীর দিন কাটে প্রিয়জনের সঙ্গে মিলনের প্রতীক্ষায়। অবশেষে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতিথির পুণ্যলগ্নে কল্যাণী জননী-রূপে দেবী দুর্গা তাঁর মর্তের সন্তানদের সম্মুখে আবির্ভূত হন। গ্রাম-বাঙলার শারদ আকাশে বাজতে থাকে আগমনীর সুর।
দুর্গাপূজা জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতায় বাংলার অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। দুর্গোৎসব নিয়ে আসে বাংলার জীবনে এক নতুন মাত্রা, বাংলার মানুষ মেতে উঠে খুশিতে আনন্দে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের খুব কম উৎসবের সঙ্গেই তার তুলনা চলে। যদিও এটি মূলত: ধর্মীয় অনুষ্ঠান তবুও বিভিন্ন শ্রেণীর জনসাধারণের আন্তরিক মিলনের ফলে এক দারুণ সামাজিক ব্যপ্তি লাভ করেছে। বিভিন্ন মানুষের মিলনই যদি জাতীয় উৎসবের বৈশিষ্ট্য হয়, তবে দুর্গোৎসবকে নিঃসন্দেহে বাংলা ও বাঙালী জাতির জাতীয় উৎসবরূপে স্বীকার করতে হবে। মাতৃ আরাধনা তখনই স্বার্থক হয়ে উঠবে, যখন ঘরে ঘরে দূর্গার মত মেয়েদের প্রকাশ ঘটবে। দূর্গা পূজা কেবল মাত্র পুস্পবিল্বপত্রের এবং ঢাক-ঢোলের পূজা নয়। এ পূজা মানবতার এক বিরাট মিলন উৎসব।
সনাতন ধর্ম মতে, বস্তুত যিনি ব্রহ্ম, তিনিই শক্তি। তিনিই দেবী দুর্গা। শাস্ত্রে বলা আছে, ব্রহ্মই আদ্যাশক্তি জগজ্জননী দেবী দুর্গা। নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অত্যাচারিত জীবের দুর্গতি হরণ করার জন্য দেবী দুর্গার আবির্ভাব হয়। দেবতাদের সম্মিলিত তপস্যা ও জ্যোতি থেকে সৃষ্ট আদ্যাশক্তি মহামায়া দুর্গা নাম ধারণ করে মর্ত্যলোকে আগমন করেন। তান্ত্রিক সাধকরা দেবী দুর্গাকে মাতৃজাতির প্রতীক করুণাময়ী বলে তাকে নারীমূর্তিতে কল্পনা করেছেন। ঈশ্বর এক, অদ্বিতীয় ও নিরাকার। বিভিন্ন দেব-দেবীও এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বরের বিচিত্র শক্তির প্রকাশ মাত্র। ভক্ত ঈশ্বরের প্রতীক। মূর্তিতে তার হৃদয়ের অর্ঘ্য দেবতার পাদপদ্মে নিবেদন করে করুণা লাভের চেষ্টাই পূজা বা উপাসনা। তাই পূজারী আরাধ্য দেবতার মৃন্ময়ী মূর্তিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে চিন্ময়ী জ্ঞানে অর্চনা করেন। ভক্তের হৃদয়ের অকৃত্রিম শ্রদ্ধাভক্তিতে মৃন্ময়ী মূর্তি তার মানসলোকে চিন্ময়ী হয়ে ওঠে।
আদ্যাশক্তি জগজ্জননী দেবী দুর্গা প্রবন্ধ – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
প্রচ্ছদ
কায়দায় জীয়ন কায়দায় মরণ
পিরীতি কাঁঠালের আঠা