কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » পূজা সংখ্যা ১৪৩০ » মায়ের চিঠি

মায়ের চিঠি

মায়ের চিঠি ছোটগল্প – প্রাপ্তি সাহা

খোকা,

কেমন আছিস ওখানে? ভালো আছিস নিশ্চয়। ঠিক সময়ে খাওয়া দাওয়া করিস তো? কাজের জায়গার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পেরেছিস, কোনো সমস্যা নেই তো? নিজের যত্ন নিস। আমরা এখানে সবাই ভালো আছি। বলছি যে, সামনেই তো পুজো, কবে আসবি? তোর বাবা বলছিলেন, আগে থেকে টিকিট কেটে নিতে নয়তো পাওয়া যাবে না। অনেক কেনাকাটা করা হয়েছে। জানিস, ঠাকুরদালান রং হয়েছে, মায়ের গায়ে মিত্তিকা পড়েছে, এবার চক্ষুদানের পর্ব। আয় না বাবা সময় করে, ক’টা দিন কাটিয়ে যা। গতবার অনেক আশা করেছিলাম আসবি বলে, কিন্তু শেষ অবদি পেরে উঠিসনি। ও বাড়ীর সব মেয়েরা এসেছিল। তোর রাঙা দিদিও এসেছিল। ওরা সবাই তোর কথা জিজ্ঞাসা করছিল জানিস। টুকু তো ছোটবেলার কথা মনে করে হেসে অস্থির। ওরা এলে বড় আনন্দ হয়। কেবলই মনে হয় আমার খোকা এলে কত আনন্দই না হত, নিজের মধ্যেই গুমড়ে মরি। তোর মনে পড়ে সেই ঘাটের কাছে শিউলি গাছটার কথা। জানিস, এক গাছ আলো করে ফুল ফুটেছে এইবার। পুজো চলে এলো ওই জানান দিচ্ছে জানিস। তুই আর টুকু মিলে কত ফুল কুড়িয়েছিস মনে পড়ে? তোর মনে পড়ে, তুই নিমকি, নাড়ু তৈরী করতে আমাকে অস্থির করে তুলতিস। মনে হয় এইতো ক’দিন আগের কথা যখন তুই পুজোয় থাকিস আমাদের সঙ্গে। এবারেও চলে আয় না খোকা তিলের নাড়ু বানিয়েছি, তোর পছন্দের। আমি তা একটু কষ্ট পাই বটে, তোর বাবাও অনেক কষ্ট পান জানিস। চিরকাল মানুষটা চাপা জানিসই তো, বুক ফাটলেও মুখ ফুটে কিচ্ছুটি বলবেন না। উনি বলেনও না, পাছে আমি কষ্ট পাই। আমি বুঝি তোকে ছাড়া পুজো ক’দিন উনি কষ্ট পান। নিজের পোশাক কেনার আগে মনে করে তোকে টাকা পাঠায় প্রতিবছর। আসবি তো খোকা এইবছর? তোর উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম। ভালো থাকিস। 

ছেলের চিঠি মা’কে –

মা,

যান্ত্রিক গোলযোগের কারণেই তোমার চিঠিখানা পেতে দেরী হয়। কাল অফিস থেকে ফিরেই তোমার চিঠিটি পেয়েছি। কাল ক্লান্ত ছিলাম তাই পড়তে পারিনি। আজ সকালে রেডিওতে যখন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে, “আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর; /ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা;” চণ্ডীপাঠ শেষ হল ঠিক তখনই চোখে পড়ল টেবিলে রাখা তোমার চিঠিটা। পড়ে আর ইচ্ছে করছে না এখানে থাকতে, মন করছে ছুটে চলে যাই। কিন্তু মা উপায় নেই। বস কিছুতেই ছুটি দিচ্ছেন না, উনি তো অবাঙালি তাই বোঝেন না আমাদের পুজোর দিনের আবেগগুলো। কর্মসূত্রে বাইরে থাকা সমস্ত ভাই-বোনদের সঙ্গে এই ছুটিতে দেখা হওয়া। বাড়ীর পুজোয় কোমর বেঁধে কাজ করা, নবপত্রিকার পুজো, দোলা নিয়ে আসা, বিসর্জনে বিষাদাছন্ন মনে আবারও এক বছরের অপেক্ষা করা সবমিলে জমজমাট চারটে দিন। পুজোর কেনাকাটা সঙ্গে দিদুনের দেওয়া টাকার কিছুটা বাঁচিয়ে শারদ সংখ্যা কেনা। পুজো চারটে দিন কাটত ওইসব নিয়ে। রাঙাদিদির পড়ার শেষে আমি ওরটা পড়তাম আর ও নিত আমারটা। কত সুন্দর ছিল দিনগুলো, সম্পর্কগুলো। মা তোমরা কেমন আছ? বাবাকে ওষুধ খাওয়ানোর জন্য তুমি আছ জানি, কিন্তু তুমি নিয়মিত প্রেশারের ওষুধ খাও? আগে তো রোজ ভুলে যেতে! মা আমি এবারও যেতে পারলাম না, তোমরা মন খারাপ করো না। আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি দেখা হবে। ততদিন ভালো থেকো মা, নিজের খেয়াল রেখ। দেখা হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি।

                                        ইতি – তোমার খোকা

চিঠি লেখার পর্ব শেষ হলে স্রোত ভাবতে থাকে, অন্য আর একটি কথা। চিঠি আসা অবধি সে কথা তার মনে থাকলেও আর অনুশীলন করে না। তবু মায়ের চিঠি পেয়ে যেমন স্রোতের মন চাইছে গ্রামে ফিরতে, ঠাকুরদালানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। মনে চাইছে, শরতের শিশিরসিক্ত ঘাসে পা রাখতে, কাশফুলগুলোকে ছুঁয়ে দেখতে। যান্ত্রিক জীবন থেকে কিছুক্ষণের জন্য সে সরিয়ে আনতে চায় নিজেকে।মনে পড়ছে ছেলেবেলার তার সেই বন্ধুর কথা। তখন ওরা দুজনেই ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। জিওগ্রাফি ব্যাচে আলাপ এবং সেখান থেকে বন্ধুত্ব। কিছুটা সময় যেতেই তারা বন্ধুত্বের সীমা অতিক্রম করে। পরস্পর পরস্পরের ভালো-মন্দের সঙ্গী হয়ে ওঠে। বাড়িতে সবাই অবশ্য মনে করত স্রোতের আরও পাঁচটা বন্ধুর মতোই তটিনী। সে বারের পুজোয় স্রোত ঠিক করে, ও তটিনীকে তার মনের কথা জানাবে। অষ্টমীর দিন পুজো প্যান্ডেলে একসঙ্গে অঞ্জলি দিয়ে স্রোত তাকে বলেই দেয় –

– বলছি তোর সঙ্গে একটা কথা ছিল।

– হুঁ, বল না।

– শাড়ীতে তোকে বড্ড সুন্দর লাগছে। তবে একটা জিনিস একটু অন্যরকম হলে ভালো বই মন্দ হত না।

– কী সেটা?

– লিপস্টিক। একটু হালকা রঙের হলে ভালো মানতো।

– স্রোত!

– সরি, তোর খারাপ লাগলে।

– আর কিছু বলবি?

– হ্যাঁ। তুই যদি চাস তাহলে, আমরা সারাজীবন একসঙ্গে বসে ভূগোলের প্রাকটিক্যাল করতে পারি। ভালোবাসবি আমাকে?

– নে, কপালের ঘামটা মুছে নে। 

– উত্তরটা?

– পেয়ে যাবি সময়মতো।

– কাল কী বের হবি আমার সঙ্গে ঠাকুর দেখতে?

– যেতে পারি। তবে তোকে হলুদ পাঞ্জাবী পরতে হবে।

– বেশ। তাহলে দেখা হচ্ছে….

এইসব ভাবতে গিয়ে কখন যে, মহালয়ার চণ্ডীপাঠ শেষ হয়ে গেছে। দুবছর হল দেখা হয়নি তার সঙ্গে। বাড়িতেও জিজ্ঞাসা করতে পারে না স্রোত। ইউএসএ আসার পর তটিনীর নম্বরে অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে তবু সে চেষ্টা বারবার বৃথা হয়েছে। স্রোত ঠিক করে যে ভাবেই হোক এবছর ডিসেম্বরে সে আসবেই। পুরনো সম্পর্কগুলোকে আবারও প্রাণ দিতে।

মায়ের চিঠি ছোটগল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!