কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » পূজা সংখ্যা ১৪৩০ » প্রবন্ধ » ডোরাকাটার রহস্য সন্ধানে

ডোরাকাটার রহস্য সন্ধানে

ডোরাকাটার রহস্য সন্ধানে প্রবন্ধ – দিব্যেন্দু ঘোষ

মাসিকে পোষ মানানো যায় বলে কি বোনপোও সেই রাস্তায় হাঁটবে? আদুরে গলার মিউ মিউ শুনে গলার কাছে একটু চুলবুলি কিংবা গোঁফের পাশে তা দিয়ে বিছানার নরম আলস্যে সকাল-মৌতাত সে উপভোগ করে বলে কি বোনপোও ম্যাদা-মারা মানুষের আতিথেয়তায় দিব্যি কলিজা ডুবিয়ে হালুম বলেই কম্বলের ভিতর সেঁধিয়ে যাবে? সে গুড়ে বালি। এককালে বেজায় রাশভারী এক সাহেব ছিলেন বটে, তাঁর টিপ নাকি অব্যর্থ। এক গুড়ুমেই অক্কা। যতই তুমি মার্জার প্রজাতির কেউকেটা হও, তাঁর কাছে নো ত্যাণ্ডাই-ম্যাণ্ডাই। বেশি পাঁয়তারা কষেছো কি সাবাড়। জিম করবেট মশাই ইংরেজ হলেও জন্ম ভারতে। কুমায়ুন অঞ্চলের নৈনিতালে। আজও জিম করবেটের কিংবদন্তিগুলো শুধুমাত্র কুমায়ুন এবং গাড়োয়ালের মানুষদের হৃদয়েই নয়, সারা বিশ্বের মানুষদের মনেই অম্লান হয়ে রয়েছে। ১৯০৭ থেকে ১৯৩৮, ৩১ বছরে করবেট ৩৩টির মতো মানুষখেকো বাঘকে দুনিয়া থেকে টা টা বাই বাই করে দেন। বেশ কয়েকটি বিশ্বস্ত সূত্র বলে, হাজারখানেক মানুষ মেরেছিল এই মানুষখেকোর দল। তার মধ্যে চম্বাবতের মানুষখেকো সবথেকে কুখ্যাত। প্রায় ৪৩৬টি মানুষ মেরেছিল এই নরখাদক। ১৯১০ সালে করবেট সাহেব প্রথম যে লেপার্ডটিকে খতম করেন, সেটি প্রায় ৪০০ মানুষকে নির্বিচারে মেরেছিল। প্রায় আট বছর ধরে দৌরাত্ম্য দেখিয়েছিল কুমায়ুনের এক মানুষখেকো। এটিও ছিল লেপার্ড। প্রায় দেড়শোর কাছাকাছি মানুষ প্রাণ দিয়েছিল এই মানুষখেকোর থাবায়। এ ছাড়াও তাল্লা-দেসের মানুষখেকো, মোহনের মানুষখেকো, থাক-এর মানুষখেকো, মুক্তেশরের মানুষখেকো করবেটের নিশানা থেকে বাঁচতে পারেনি। তিনি অবশ্য কোনওদিন কোনও বাঘ কিংবা লেপার্ডকে গুলি করতেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের মানুষখেকো হিসেবে চিহ্নিত করতে পারতেন।

                এ লেখা অবশ্য জিম করবেটকে নিয়ে নয়, বরং বলা ভাল, সিংহ-বিক্রমী কয়েকটি চতুষ্পায়ীকে নিয়ে, যারা পোষ মেনেছিল। সেই সব বোনপো, যারা তাদের মাসিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিল। চার দেওয়ালের নীচে দিব্যি মানিয়ে-গুছিয়ে নিয়েছিল। মনিবের সঙ্গে ঘুরতে বেরোত, টেবিলে বসে চব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় সাঁটাত, আর পড়ে পড়ে মেজাজে ঘুম দিত। তবে মনিবকে বেজায় ভয় পেত। কারণ তারা জানত, মনিবের এক-একটা বজ্রমুষ্টি তীব্রবেগে মুখের ওপর নেমে এলে, চোয়ালের হাড় ভাঙতে কয়েক সেকেন্ড লাগবে, যতই তুমি বনের রাজা হও। কারণ, মনিবও যে রিংয়ের রাজা। ওই যে ভারতীয় সিনেমার এক অ্যাংরি ইয়ং ম্যান ঘুসি দেখিয়ে বলেছিল না, ঢাই কিলো কা হাত। মাইক টাইসনের এক একটা ঘুসির ওজন তার থেকেও বেশি ছিল। একটা দুটো নয়, সর্বকালের অন্যতম সেরা বক্সার মাইক টাইসন তিনটি বাঘ পুষেছিলেন। বাঘগুলোকে একেবারে বাচ্চা অবস্থায় নিয়ে আসেন তিনি। ১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে জেলে ছিলেন মাইক। সেই সময় বিড়ালের একজোড়া বোনপো অর্ডার দেন তিনি। তাঁর এক বন্ধু গাড়ি আমদানি বন্ধ করে পশু আমদানি শুরু করেছিল। ঘোড়া, বাঘ, সিংহ, এই সব। সেই বন্ধু টাইসনকে বুদ্ধি দিয়েছিলেন, একটা পোষা বাঘ বা সিংহ গাড়ির গ্যারাজে থাকা ফেরারি গাড়ির চাইতেও বেশি সম্মান দেবে। যখন জেল থেকে বেরোবেন, তখন বাড়িতে দুটো বাঘ অপেক্ষা করবে। এই আনন্দে মশগুল ছিলেন বক্সিং কিং। বনের রাজা বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে স্বাগত জানাবে বক্সিংয়ের রাজাকে। এই আনন্দেই গদগদ ছিলেন তিনি। তবে একটা সময় নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। পরবর্তীকালে তা স্বীকারও করে নেন। কেন ভুল করেছিলেন টাইসন?

        একবার তাঁর বাড়িতে ঢুকে পড়েছিলেন এক পড়শি। সেই মহিলাকে আক্রমণ করে টাইসনের একটি পোষা বাঘ। ইনস্টাগ্রাম লাইভে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে গল্পটি বলেছিলেন টাইসন। ওই মহিলা নাকি তাঁর বাড়িতে ঢুকে বাঘের সঙ্গে খুনসুটি করছিলেন। অচেনা নারীতে মোটেই মজেনি বাঘটি। কুটুস করে কামড়ে দিয়েছিল। এক আস্ত বাঘের কুটুস যে কী সাঙ্ঘাতিক, তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলেন টাইসনের সেই প্রতিবেশী। সেই মহিলা পরে মামলাও করার চেষ্টা করেন। তবে প্রশাসন জানতে পারে, ওই মহিলাই কলিং বেল না বাজিয়ে গেট টপকে ঢুকেছিলেন। তাই মামলা ধোপে টেকেনি। ওই মহিলার চিকিত্সার জন্য আড়াই লক্ষ ডলার দিয়েছিলেন টাইসন। টাইসন অবশ্য আফসোস করেছিলেন। বলেছিলেন, মাংসের জন্য যে বাঘগুলো কী করতে পারে, সে সম্পর্কে তাঁর কোনও ধারণাই ছিল না। কিংবদন্তি এই বক্সার এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে তিনি অনেক কিছু শেখেন। এই প্রাণীটিকে কখনই শতভাগ পোষ মানানো সম্ভব নয়। এটা হওয়ার কোনও উপায় নেই। তিনি বোকা ছিলেন, তাই আগে বোঝেননি। হঠাৎ একদিন দুর্ঘটনাবশত মানুষ মারবে ওরা। ওরা এতই শক্তিশালী যে, ইচ্ছে করে হয়ত মানুষ মারবে না, যা হবে তা দুর্ঘটনাক্রমেই হবে। আর এই দুর্ঘটনাগুলো ঘটবে খেলার সময়। খেলতে খেলতে কেউ হয়ত ওদের ঘুসি মারবে, তখন ওরাও খেলার ছলে আঘাত করবে, আর তারপরে দেখা যাবে যে বাঘের হাতে মানুষ প্রাণ দিয়েছে। টাইসনের কাছে আর তারা নেই। তবে স্মৃতির পাতা আজও ওল্টান তিনি, ‘আমি ওদের খুব ভালবাসতাম, আমি ওদের সঙ্গে ঘুমোতাম, খেলতাম। আমি জানি দেরি হয়ে গেছে, তবু বলব এ ঘটনা আমাকে বাস্তব সত্য শিখিয়েছে। আমি ভুল করেছি। বাড়িতে তাদের রাখা উচিত হয়নি আমার। আমি বোকা ছিলাম। আমি ভুল করেছিলাম।’

         শুধু টাইসন নয়, বাঘ পুষেছিলেন কয়েকজন বঙ্গবাসীও। ওড়িশার সিমলিপাল জাতীয় উদ্যানের প্রতিষ্ঠাতা সরোজ রাজ চৌধুরীর পোষা বাঘ ছিল খৈরী। কলকাতা শহরের বুকেও ঘটেছিল এমন কাণ্ড। তাও আবার এক বাঙালির হাতেই। কেবল সুন্দরবন কেন, খাস কলকাতা শহরের বুকেও বাঘের আনাগোনা ছিল এককালে। সে কলকাতা তখনও শহরের পোশাক গায়ে চাপায়নি। সাগরপারের দেশ থেকে ইংরেজরা এদেশে এসে জাঁকিয়ে বসছে সবে। আজ যে সব জায়গা সাহেবপাড়া বলেই পরিচিত, এই যেমন চৌরঙ্গী কিংবা পার্ক স্ট্রিট, সেসব এলাকায় বাঘের দেখা মেলা মোটেও অসম্ভব ছিল না সেকালে। কিন্তু সে বেশ আগের কথা। তারপর গ্রাম থেকে শহর হল, আর শহরকে জায়গা দিতে গিয়ে ক্রমশ পিছিয়ে গেল বনজঙ্গল। সেখানে ১৯৫০-এর দশকে ঝকঝকে দক্ষিণ কলকাতায় বাঘ? তাও কি সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব হয়েছিল। একটি নয়, দু-দুটি বাঘ বাস করত দক্ষিণ কলকাতার এক বাড়িতে। তাদের নাম স্যামসন আর ডিলাইলা। সে বাড়ির আদি নাম ছিল ‘নদীয়া হাউজ’। কিন্তু বাঘ বাবাজিদের হাঁকডাকের চোটে এলাকার লোক তাকে ডাকতে শুরু করে বাঘ-বাড়ি নামে। ‘নদীয়া হাউজ’ কৃষ্ণনগরের রাজাদের কলকাতার বাসভবন। এই বাড়িতে এককালে থাকতেন মহারাজা সৌরীশচন্দ্র। প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ভাল ছাত্রটি বন্দুক হাতে নিলেই হয়ে যেতেন অন্য মানুষ। ভারত জুড়ে ছিল তাঁর শিকারের খ্যাতি। আর সেই সূত্রেই একবার মধ্যপ্রদেশ সরকারের থেকে বাঘ শিকারের ডাক পান তিনি। সেটা ১৯৫৮ সাল। মধ্যপ্রদেশে উপদ্রব শুরু করেছে একটি নরখাদক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। পনেরো দিন ধরে সেই বাঘের পিছনে ঘুরে অবশেষে তাকে কব্জা করা গেল। তবে দুঃখে ভেঙে পড়লেন খোদ শিকারি। মা-পশুকে কোনও বড় শিকারিই সাধারণত মারেন না। সৌরীশচন্দ্রও এই নিয়ম মেনে চলতেন। কিন্তু এবার শিকার করার পর তিনি দেখলেন, তিনি মেরে ফেলেছেন একটি বাঘিনিকেই। খোঁজ পাওয়া যায় তার দুটি সন্তানের। অনুশোচনা থেকেই সেই দুটি বাঘের বাচ্চার দায়িত্ব নিতে চাইলেন তিনি নিজে। ব্যস, রাজা সৌরীশচন্দ্রের সঙ্গে বাঘের ছানারাও পাড়ি দিল কলকাতা। যত্নে, আদরে দিব্যি বেড়ে উঠল তারা, এই শহর কলকাতাতেই। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আইনি জটিলতায় পালক-পিতার কাছেও থাকা হয়নি তাদের। কিন্তু তাদের স্মৃতি রয়ে গেছে এই পুরনো বাড়ির আনাচে-কানাচে, আজও কলকাতা যাকে ‘বাঘ বাড়ি’ বলেই মনে রেখেছে।

           বাঙালি একসময়ে বাঘাড়ু ছিল বটে। বাঙালিদের মধ্যে প্রথম যিনি বাঘাড়ু হয়েছিলেন তাঁর নাম ছিল নরহরি দাস। তিনি সিংহের মামা ছিলেন। পঞ্চাশটি বাঘ ধরে তিনি রোজ যে ভয়ানক কাণ্ডটি করতেন, তার কথা বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই জানে। সুরেশ বিশ্বাস নামে একজন বাঘেদের নিয়ে ছেলেখেলা দেখাতেন। বাঘেদের সঙ্গে বাঙালির দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। টিপু সুলতান নামেও একজন ছিলেন। তিনি বাঘ হয়ে দুরন্ত ব্রিটিশ সিংহদের টিপে টিপে মারতেন। দাক্ষিণাত্যের মহান সুলতান ছিলেন টিপু। তাঁর মতো বাঘপ্রীতি ভারতের আর কোনও রাজার মধ্যে দেখা যায়নি। তাঁর শৌর্য ও বীর্যে মুগ্ধ হয়ে ইংরেজরাই তাঁর নাম দিয়েছিল ‘শের-ই-মহীশূর’। মহীশূরের কাছে শ্রীরঙ্গপত্তম ছিল তাঁর রাজধানী। তিনি তাঁর প্রাসাদেই কয়েকটি বাঘ পুষেছিলেন। তাঁর বাবা হায়দার আলির মৃত্যুর পর তিনি বাবার সিংহাসন বদলে বাঘের মাথার অনুকরণে এক রত্নখচিত সিংহাসন তৈরি করেন। এই টিপুই ভারতে প্রথম রকেট লঞ্চার যুদ্ধে ব্যবহার করেন। তখন ইংরেজদের কাছে সেই অস্ত্রের কোনও বিকল্প ছিল না। আরেক মহান সম্রাট ঘোর ইংরেজ-বিদ্বেষী নেপোলিয়ান বোনাপার্টে টিপুর বন্ধু ছিলেন। তিনি টিপুকে যে চিঠি লেখেন তাতে তিনি তাকে সম্বোধন করেছিলেন, ‘To the most magnificent Sultan, our greatest friend Tipoo saib’।
ইংরেজদের সঙ্গে টিপুর জন্মগত বৈরিতা ছিল। ইংরেজরা তাঁর বীরত্বকে শ্রদ্ধা করলেও তাঁর হিংস্রতার নানা কথা লিখে গেছে। ১৭৮০ থেকে ১৭৯০ সালের মধ্যে তিনশোর বেশি ব্রিটিশ সৈন্যকে টিপু কারাগারে বন্দি করে তাদের লিঙ্গের চামড়া কেটে দিয়েছিলেন। ক্যাথলিক ব্রিটিশদের মধ্যে যা ছিল এক সাঙ্ঘাতিক কলঙ্ক। ১৭৯৩ সালে হেক্টর মুনরোর ছেলে সুন্দরবনের সাগরদ্বীপে বাঘের হাতে মারা যান। এই খবর পেয়ে টিপু তাঁর ফরাসি মিত্রদের দিয়ে এক অসামান্য খেলনা তৈরি করেন যা কিনা ইতিহাসে ‘টিপুর বাঘ’ নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। এই কাঠের খেলনাটির ভেতরে একটি অর্গান ছিল। চাবিতে দম দিলে অর্গান থেকে বাঘের ভয়ঙ্কর গোঙানি বের হত। বাঘটি এক শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশকে মাটিতে ফেলে তার ওপর চড়ে বসেছে। চাবি দিলে তার গলা কামড়ে ধরত। টিপু অবসরে সেই খেলনাটিতে চাবি দিয়ে ব্রিটিশদের প্রতি তার গায়ের জ্বালা মেটাতেন। আবার কখনও তার প্রিয় গজলও নাকি এই খেলনায় চাবি দিয়ে শুনতেন। ১৭৯৮ সালে ব্রিটিশ জেনারেল নেলসন নীল নদের যুদ্ধে নেপোলিয়ানকে হারিয়ে দেন। পরের বছরই ১৭৯৯ সালে ইংরেজদের সঙ্গে শ্রীরঙ্গপত্তমের যুদ্ধে টিপু মারা যান। দুটি বুলেট টিপুর মাথা লক্ষ করে ছোড়া হয়। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। টিপুর মৃত্যুর পর তাঁর প্রাসাদ লুঠ করে ইংরেজরা অন্যান্য ধনরত্নের সঙ্গে তাঁর প্রিয় খেলনাটিও বিলেতে নিয়ে যায়। বর্তমানে সেটি লন্ডনের ভিক্টোরিয়া ও অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে রাখা আছে। রোমান্টিক যুগের এক অন্যতম কবি জন কীটস তাঁর এক কবিতায় সেই ‘টিপুর বাঘ’-এর কথা উল্লেখ করেছেন।

           টিপু অবশ্য বাঙালি ছিলেন না। বাঙালিরা সিংহদের ঠিক পছন্দ করে না। বলা ভাল, সিংহরাই বাঙালিদের ঠিক পছন্দ করে না। সেইজন্যেই বাংলাদেশে কোনও সিংহ পাওয়া যায় না। তবে বাংলার বাঘকে চিনতে বাঙালি ভুল করে না। আগে বাংলার বাঘ ছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, এখন কেউ কেউ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কেও বাংলার বাঘ বলে থাকেন। বাঙালিদের মধ্যে প্রথম বন্দুক দিয়ে বাঘ মারেন অবশ্য ফেলুদা। মহীতোষ সিংহ রায় মারবে না শুনে তিনি ওই বাঘটিকে মারেন। এর পরে বাঙালি বাঘ মারতে না পারলেও গান গেয়ে বাঘেদের চুপ করিয়ে রাখত গুপী-বাঘা। তার পরের বাঙালিরা আর সেটাও পারত না। একবার শিবা বলে একটা বাঘ এক বাঙালিকে খেয়ে ফেলে। এর পরেই বাঙালিদের মধ্যে বাঘের গলায় মালা পরানো বন্ধ হয়ে যায়। চিড়িয়াখানায় গেলে দেখা যায় বাঘেদের নাম নীলাদ্রি, হিমাদ্রী। আগে দু-টাকার নোটে বাঘের ছবি থাকত। এখন দু-টাকা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে, মুখে বাঘ মেরে পকেটে নিয়ে ঘোরাও বাঙালির এখন বন্ধ। তবে বাঘ বলে কথা। জাতীয় পশু। তাকে অত সহজে মুছে ফেলা যাবে না। যতই তার অস্তিত্ব বিপন্ন হোক।

               এখনকার পৃথিবীতে যত প্রাণী জীবিত আছে, রাজকীয় ঐতিহ্যে বাঘের ধারে-কাছে কেউ আসতে পারে না। সারা জীবন একা থাকা একটা প্রাণী শুধু আজকেই আমাদের জাতীয় পশু হয়নি। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ সালে সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকেই সে আমাদের জাতীয় পশু। হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োয় যে বিখ্যাত পশুপতির মূর্তি পাওয়া গেছে, তাতে আমরা প্রধান পশু হিসেবে বাঘের উপস্থিতি লক্ষ্য করেছি। তাই বলা যায়, সিন্ধু সভ্যতার লোকেরাও বাঘকে তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী হিসেবে দেখত। পরবর্তীকালে হিন্দু পুরাণেও বাঘের উল্লেখ দেখা যায়। আগে মহাদেব নগ্ন অবস্থায় ঘুরে বেড়াতেন। নগ্ন মহাদেবকে দেখে মর্ত্যের ঋষিপত্নীরা পুলকিত হয়ে ওঠেন। তাই দেখে ক্রুদ্ধ ঋষিরা তাঁদের তপস্যার বলে এক বিরাট বাঘের সৃষ্টি করলেন মহাদেবকে হত্যা করার জন্য। কিন্তু মহাদেব সেই বাঘকে মেরে তার ছাল পরিধান করলেন। সেই থেকেই তিনি ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিত। মহিষাসুরকে হত্যা করার জন্য দেবতাদের তেজোপুঞ্জে যে দেবী দুর্গা বা অম্বিকার সৃষ্টি হয়, তাঁর বাহনও বাঘ। অম্বিকা গিরিকন্যা। পাহাড়ি উপকথায় এবং উপচারে নানাভাবে অম্বিকার সঙ্গে বাঘের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। দাক্ষিণাত্যে সবচেয়ে দীর্ঘকাল রাজত্ব করেছিল চোলেরা। তারা প্রায় ৩০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ১২৭৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করে। তাদের রাজকীয় প্রাণী ও প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল বাঘ।

              তবে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বাঘ ভারতে বেশিদিন আসেনি। তাঁদের মতে, আজ থেকে মাত্র ১২,০০০ বছর আগে ভারতে বাঘের প্রবেশ ঘটেছে। তার আগে ভারতে বাঘ ছিল না। এর বহু বছর আগে থেকেই রাশিয়া ও চীনের উত্তরে সাইবেরিয়ায় সাইবেরিয়ান টাইগার বা ‘প্যান্থেরা টাইগ্রিস আলতাইকা’ বসবাস করত। সাইবেরিয়ায় প্রায় ২০ লক্ষ বছর আগেকার বাঘের ফসিল পাওয়া গেছে। প্লেস্টোসিন যুগের শেষদিকে যখন পৃথিবীতে দীর্ঘকালীন বরফ যুগ চলছে, তখন সাইবেরিয়ার অঞ্চল বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে যাওয়ায় বেশ কিছু বাঘ দক্ষিণের উষ্ণতর অঞ্চলে সরে আসে। দক্ষিণ চীন হয়ে ভারতের পূর্ব দিক বরাবর তারা ভারতে প্রবেশ করে। ভারতে যে বাঘের ফসিল পাওয়া গেছে তার কোনওটারই বয়স ১১,০০০ বছরের বেশি নয়। হলোসিন যুগে অর্থাৎ আজ থেকে ১১,৫০০ বছর আগে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করলে বহু হিমবাহ গলে যায় ও সমুদ্রস্তর বাড়তে থাকে। তাই আগে ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে যে স্থলভাগের যোগসূত্র ছিল তা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তাই সবে ভারতে ঢোকা সাইবেরিয়ান টাইগার সেই সমুদ্র ডিঙিয়ে শ্রীলঙ্কায় ঢুকতে পারেনি।
ভারতে যে বাঘ পাওয়া যায় বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছেন বেঙ্গল টাইগার বা ইন্ডিয়ান টাইগার। মাইটোকন্ড্রিয়াল নিউক্লিওটাইড ও মাইক্রোস্যাটেলাইট পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, ভারতীয় বাঘ বা ‘প্যান্থেরা টাইগ্রিস টাইগ্রিস’ সেই সাইবেরিয়ান বাঘেরই উপপ্রজাতি। যদিও তারা আকারে কিছুটা ছোট। ক্রমেই সেই বাঘ গোটা উত্তর ভারত হয়ে দক্ষিণের দিকেও ছড়িয়ে পড়ে। আগে বাংলার গ্রামেও বাঘ দেখা যেত। এখন শুধু সুন্দরবন ও উত্তরের কিছু পাহাড়ি এলাকা ছাড়া এদের দেখা মেলে না। ব্যাপক হারে শিকার করা ও নগরায়নের ফলে বাঘেদের বসতি ক্রমেই কমেছে।

         যুগে যুগে বাঘ শিকার করাকে এক রাজকীয় ঐতিহ্য হিসেবে দেখা হয়েছে। আবার মানুষখেকো বাঘের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষা করাকেও এক রাজ-কর্তব্য বলে ভাবা হত। জাহাঙ্গীরের সময় মথুরার কাছে এক মানুষখেকো বাঘ সেখানকার মানুষদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। সম্রাট ও তাঁর বেগম নূরজাহান বিরাট কনভয় নিয়ে সেখানে যান। বেগম হাতির ওপর হাওদায় বসে দুটি মাত্র গুলি ছুড়ে সেই মানুষখেকোকে হত্যা করেন। ‘রুদ্রপ্রয়াগের চিতা’ যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা সকলেই সেই হাড় হিম করা চিতার সম্পর্কে জানেন। যে আমগাছের ওপর বসে জিম করবেট সেই চিতাকে হত্যা করেন, সেই আমগাছের নীচে তার স্মৃতিতে নির্মিত এক পাথরের ফলক আজও অবহেলায় অক্ষত।

            বাঘ মূলত জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে আত্মগোপন করে শিকার করে। তাই তার বেঁচে থাকার জন্য জঙ্গলের প্রয়োজন। একই সঙ্গে এভাবে শিকার করার জন্য যুগে যুগে সে আমাদের মধ্যে সম্ভ্রম-মিশ্রিত ভয়ের সৃষ্টি করে এসেছে। সাহস ও শৌর্যের উদাহরণ বলতে আমরা এখনও বাঘকেই বুঝি। কিন্তু পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপে যে শ্বাপদের বাস, তারা নাকি দুহাজার সত্তর সালের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। আর মাত্র ৫০ বছর। ২০৭০ এর মধ্যে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হতে পারে সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। রাষ্ট্রসঙ্ঘের এক প্রতিবেদনে এমনই আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। স্থলভাগের ৫ লাখ প্রজাতির বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা। যার মধ্যে সুন্দরবনের বাঘও রয়েছে। কারণ, জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন। গোটা বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে বঙ্গোপসাগরে। এমনকী সুন্দরবনেও। বাংলাদেশ ও ভারতের চার হাজার বর্গমাইল এলাকা নিয়ে সুন্দরবন। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ অরণ্য। এই অঞ্চলের ৭০ শতাংশ ভূমি সমুদ্রের উপরিভাগের মাত্র কয়েক ফুট ওপরে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধি হচ্ছে। যার জেরে কমে আসছে রয়্যাল বেঙ্গলের প্রজননক্ষেত্র। একইসঙ্গে আবহাওয়ায় ব্যাপক পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না বাংলার বাঘ। তার ফলে কমছে প্রজনন ক্ষমতাও। ২০১০ সালে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার একটি গবেষণা চালায়। তাতে দেখা যায়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১১ ইঞ্চির মতো বৃদ্ধি পেলেই কয়েক দশকের মধ্যে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমে আসতে পারে ৯৬ শতাংশ। আরও দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের বিপন্নপ্রায় স্তন্যপায়ী প্রাণীকুলের প্রায় অর্ধেক ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার মধ্যে বাঘের উল্লেখও রয়েছে। এমনিতেই, চোরাশিকার, বনভূমি ধংসের কারণে বাঘের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছে গত কয়েক বছরে। তার উপর নতুন সমস্যা। মোকাবিলা করবে কে! আমাদের দেশ ছাড়া আর মাত্র পাঁচটি দেশে এই প্রাণীটি কোনওক্রমে টিকে আছে। আমাদের সকলেরই দায়িত্ব যাতে তারা তাদের অস্তিত্ব হারিয়ে স্যাবার টুথড টাইগার বা আমেরিকান কেভ টাইগারের মতো সম্পূর্ণ মিথ বা ঐতিহাসিক প্রাণী না হয়ে যায়।

তথ্যসূত্র : Tim Werling, Jim Corbett : Master of the Jungle

Undisputed Truth : My Autobiography by Mike Tyson

Wild Tiger Conservation : Save The Tiger Fund

বনেদি কলকাতার ঘরবাড়ি, দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, রামতনু লাহিড়ি ও তত্কালীন বঙ্গসমাজ, শিবনাথ শাস্ত্রী, নদীয়া হাউজ, কলকাতা

ডোরাকাটার রহস্য সন্ধানে প্রবন্ধ – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!