নাকি সুর না খোনা সুর ভৌতিক গল্প – বিশ্বজিৎ রায় চৌধুরী
জায়গাটায় বিশ্রী গন্ধ । গন্ধটা পচা মাংসের গন্ধ । পচা পাঁকের গন্ধ । বোঁটকা গন্ধ । আঁশটে গন্ধ । গোবর পচা গন্ধ । মানুষের মল মূত্র ত্যাগজনিত গন্ধ । ঘাম পচা গন্ধ । ভাগাড়ের গলিত পশুর গন্ধ । চামড়া পচা গন্ধ । চামড়া ট্যান করার কারখানা থেকে বেরনো গন্ধ ।
মানে এই ভর সন্ধ্যেয় আর কি কি গন্ধের নাম দূর্গন্ধের লিস্টিতে থাকতে পারে , ভেবে বের করতে পারল না খুদু ।
তারপর হচ্ছে আওয়াজ । প্রথমেই খুদুর মনে এল বাজখাঁই । তারপর ছিচকাঁদুনে , তারপর বোম্বেটে গলার আওয়াজ , খাম্বাজ আওয়াজ , তারপর হিস হিস – ফিস ফিস , তারপর হাঁউ মাউ খাঁউ , আর হল দুম-দাম , হুটপাট , আর কিছু মনে আনতে পারল না খুদু ।
এবার হচ্ছে হাঁটাচলা । কারা এখন এই ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে চলাফেরা করছে । খুদু পায়ের নাকি রণ- পায়ের আওয়াজ টের করার চেষ্টা করল । হাঁটছে নাকি দৌড়চ্ছে ! পা ফেলে ফেলে হাঁটছে নাকি পা টিপে টিপে । পা ঘষটে ঘষটে হাঁটছে নাকি পা লেংচে , লেংচে । লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে নাকি খোঁড়াতে খোঁড়াতে ।
তারপর জায়গাটা । খুদু কিছুতেই আঁচ করতে পারল না জায়গাটা । এই জায়গাটা পরিত্যক্ত শ্মশান নাকি ভাগাড় । কবরখোলা নাকি ভূশূন্ডীর মাঠ । বাদাবন নাকি আদার – বাদার । বাঁশ বাগান নাকি আশশ্যাওড়ার জঙ্গল । মলমলি মসৃণ না এবড়ো খেবড়ো ।
সবশেষে খুদুর যেটা মনে এল তাহল সময় । প্রথমে তো মনে হয়েছিল ভর সন্ধ্যে । কিন্তু সব কিছু মনে করতে করতে ভর সন্ধ্যে আর আছে কি ? তাহলে এই সময় মানে অন্তিম সময় । কার ? কার আবার , এ তল্লাটে এখন আর খুদু ছাড়া কোন্ চাঁদুই বা পাত্তা দেবে ? তাহলে খুদুই বা পাত্তা দিচ্ছে কেন ? কারন মরণকাল ।
কে বলছে খুদুর মরণকাল উপস্থিত । বলবে কি আবার ঘটছে । কিন্তু যদি অলৌকিক বাগাতে পার পেয়ে যায় , তবে মরণকাল ঘটছে কি ঘটতে চলেছে সে কথায় কাজ কি ? কাজ হল সময় সম্পর্কে সচেতন হওয়া । প্রায় অচেতন অবস্থায় খুদু সময়ের পদধ্বনি শুনতে পেল ।
সময় আসছে পায়ে পায়ে । সুবর্ণ সময় না বড় দুঃসময় । অসময় না সুসময় । সুখের সময় না দুঃখের সময় । অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় না দিবালোকাচ্ছন্ন সময় । ভূতুড়ে সময় না সুপুত্তুর লাভের সময় , অবনতির সময় না উন্নতির সময় । সংকটজনক সময় না পরিত্রাণ লাভের সময় । ভেসে ওঠার সময় না ডুবে যাওয়ার সময় ।
তারপর এই সময়ে কে আসছে ? পুরুষ না নারী । বাচ্চা না বুড়ো । ছেলে না মেয়ে । শরীরী না অশরীরী । ভূত না পেত্নী । দেব না দেবী । জ্যান্ত না মড়া ।
মড়া ! অ্যাঁ , অ্যাঁ, অ্যাঁ , অ্যাঁ, অ্যাঁ মড়াৎ । ব্যাস , মড়ার কথা মনে হতেই খুদু চিত্তির । মানে প্রপাতধরনীতল । কিন্তু শব্দটা মড়মড় মড়াৎ করেই বা হল কেন ? কেনই বা হবে না ! খুদু কি আর রক্ত মাংসের মানুষ আছে ? ও তো একটা নর কঙ্কাল । হ্যাঁ , নর কঙ্কাল । পটপট হাড় ভাঙছে , মড়মড় মড়াৎ করে আছড়ে পড়ছে । কড়কড় করে দাঁত বের করছে । করোটি থেকে ড্যাবড্যাবে চোখে চাইতেই হলুদ আলো বেরচ্ছে ।
তবুও সে আসছে । জলজ্যান্ত নরকঙ্কাল দেখেও আসছে । এ যে অবিশ্বাস্য ! কিন্তু কিভাবে আসছে ? সে আর বলতে ! যতরকম ভাবে আসা যায় ততরকম ভাবে আসছে । সে নাহয় বলা গেছে । কিন্তু আসছে কেন ?
” অ্যাই খুদু , দড়াম করে আছড়ে পড়লি কেন ? আমি যদি দাঁড়িয়ে থাকতে পারি , তুই কেন পারলি না ? “
খুদু শুয়ে শুয়েই বলল , ” তুমি কে ? কোত্থেকে আসছ । আর আমার কাছেই বা আসছ কেন ? আমার কিন্তু খুব ভয় করছে । “
” ভয় , সে তো পাবিই । তুই হলি কঙ্কাল । আর আমি ভূত । তোর হাড় কাঠি সার । আমার ভূতত্ব প্রাপ্ত । “
খুদু ভড়কে গিয়ে বলল , ” মা , মানে ? “
” সে তুই ভূতত্ব প্রাপ্ত হলেই বুঝবি । এখন তোর ওই হাড় জিড়জিড়ে নিয়ে হাড্ডিতে জোর এনে সটান দাঁড়িয়ে আমার মুখোমুখি হ । “
খুদু অবাক হয়ে বলল , ” সে কি করে হবে ? তোমার মুখের নাগাল পাওয়ার সাধ্য কি আমার আছে । ওই অত উঁচু ভূতত্ত্ব প্রাপ্ত মুখের নাগাল আমার কঙ্কাল চেহারায় পাচ্ছি কই যে তোমার মুখোমুখি হব । “
” নর কঙ্কাল রে বাছা । এখনও তোর মানুষের দশা মানে মরণদশা ঘোঁচেনি । মরণদশা ছেড়ে ভূতের দশা পাসনি । ”
খুদু জানতো সে মরে ভূত হয়ে গেছে । কিন্তু এ যে বলছে তার মরণদশা ছেড়ে ভূতের দশা চট করে আসেনি । তাহলে সাত তাড়াতাড়ি গলায় দড়ি দিয়ে মরার দরকার কি ছিল ! ভূত হবার বাসনা বুঝি মরলেই যুগপৎ পূরণ হবার নয় । তার মানে তার আত্মা মানে মানুষের আত্মা এখনও তাকে ছেড়ে যায়নি । আরে বাবা আত্মা কি সহজে দেহ ছেড়ে যেতে চায় ? যতক্ষণ না প্রেতাত্মায় পরিনত হচ্ছে ততক্ষণ খুদুর ভূতত্ব প্রাপ্ত হবার সম্ভাবনা নেই ।
” তা তোমার আগমনের হেতু কি ? সে কথাটা খোলসা করে বলো দিকিনি । ” খুদু আর ধৈর্য্য ধরতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেলল । তবে ভয় একটু লাগছে বৈকি । কারন এই অজ্ঞাত কুলশীল যে কোন কাজ করে বসবে তখন পস্তাতে হলে খুদুকেই পস্তাতে হবে । এমনিতেই যে দুর্গন্ধ চারদিকে তাতে এ তো বাড়তি দুর্গন্ধই বয়ে আনছে । তার ওপর তার যে আওয়াজ সেটাও ঠিক মালুম হচ্ছে না । ভুতুড়ে আওয়াজ কঙ্কালের বোঝার কথা নয় । সে তো পচেও নি , খসেও পড়ছে না । সে শুধু হাড়ওয়ালা কঙ্কাল । এই শুকনো হাড়ে গন্ধ কিছু থাকে না । সেই কারণেই গন্ধ তার টের পাওয়া । তার নিজের গন্ধ যদি টের পায় তো পাবে ওই ভূতত্ব প্রাপ্ত কি যেন বলে । দূর ছাই , আগুন্তুক তো পরিচয় কিছু এখনও খসায় নি ।
” বুঝবি কি করে নরাধম । তোর এসব কথা বোঝার বয়স হলে তো । আগে ভূতত্ত্ব প্রাপ্ত হ , তারপর নিজেই ভূত সমাজের সব কিছু বুঝবি । তাছাড়া তোর ওই নর কঙ্কালের দশা মোচন করে ভূতে রূপান্তরিত করতেই তো আমার আসা । না হলে আমার কত কাজ এখন । কিন্তু সব কাজ শিকেয় তুলে ছুটে আসতে হল তোর ভূতত্ত্ব প্রাপ্ত বয়সে এনে ধেড়ে বানাতে । “
এই বলা কওয়া হয়ে গেলে পর সে খুদুকে এক হেঁচকা টানে খাড়া করলে । খুদুর কঙ্কাল মড়মড় করে সোজা হল । ” বাবা গো , মা গো , আর পারি না গো ” খুদু প্রায় কেঁদে ফেলে আর কি ।
এরপর যা হল তা আর কহতব্য নয় । খুদু আর খুদু রইলো না । ঝড়ের বেগে তাকে তুলে নিয়ে গেল কে । পঞ্চভূতে শরীর বিলীন হয় , শুনেছে খুদু । সে বায়ুভুতে বিলীন হয়ে ভূতত্ত্ব প্রাপ্ত হয়ে গেল , বয়স তখন নিতান্তই কাঁচা ভূতের । কিন্তু যে বড় কাজটা হল সেটা বিস্ময়কর । তার আত্মা ভূত শরীর ছেড়ে সোজা আকাশমুখো উধাও । এ হে হে , এবার কি হবে । এতদিনের পোষা পুষ্ট আত্মা আর কি ফিরে পাবে খুদু ।
সে বললো , ” কি , উড়ে যেতে যেতে টের পাচ্ছিস তো কেমন হালকা হয়ে গেছিস । আর আত্মার গুরুভার বইতে হবে না । “
খুদু নাকে কোন দুর্গন্ধ টের পেল না । কোন আওয়াজ টাওয়াজ পেল না । জায়গাটা যে কোথায় তাও বুঝতে পারলো না । কিন্তু তার নিজের কথা । নিজের আওয়াজ !
খুদু বললো , ” এই তাহলে আমার মরণদশা ঘুচে ভূতত্ত্ব প্রাপ্ত দশা ? “
কিন্তু কেউ সাড়া দিল না । খুদু বুঝতেই পারছে না যে সে নাকি সুরে বলছে না খোনা সুরে বলছে । কে আর তা বলে দেবে । সে তো এখন স্বাবলম্বী ভূত ।
নাকি সুর না খোনা সুর ভৌতিক গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
রাজবাড়ী রহস্য
ব্রহ্ম দৈত্য
প্রত্যাবর্তন