হলদে সংবাদ ভৌতিক গল্প – চিরঞ্জিৎ সাহা
বাংলা খবরের দুনিয়ায় রীতিমতো এক অবিসংবাদী নাম সমাচার বাংলা । প্রিন্ট মিডিয়া থেকে নিউজ চ্যানেল হয়ে ওয়েব পোর্টাল — তিন ক্ষেত্রেই টিআরপি তাদের টপ গিয়ারে । সৌজন্যে সম্পাদক সতীনাথ সেনের ক্ষুরধার মস্তিষ্ক । পাঁচ তরকারির মশলা দিয়ে বিরিয়ানি রাঁধতে সিদ্ধহস্ত তিনি । ফলস্বরূপ , বাকি মিডিয়া হাউসগুলোকে অনেকটাই পিছনে ফেলে তরতরিয়ে এগিয়ে চলছে সমাচারের গুণমুগ্ধের সংখ্যা । এই তো গত সপ্তাহেই বাঁকুড়ায় বিষাক্ত লিচু খেয়ে মারা যায় দুশো অসহায় গ্রামবাসী । নিতান্তই প্রকৃতির নিয়মে লিচুতে বাসা বেঁধেছিল মারণ ভাইরাস । কিন্তু সতীনাথবাবু লিখলেন — ” বেকারত্ব রূপান্তরিত প্রতিশোধস্পৃহায় । উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতক হয়েও চাকরি না মেলায় শেষমেষ নিজস্ব জমিতেই লিচু চাষ শুরু করে বাঁকুড়ার দরিদ্র যুবক রহিম শেখ । আদতে এটিকে সে বেছে নিয়েছিল সমাজের প্রতি নিজের আক্রোশ মেটানোর মাধ্যমরূপে । অধীত বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে লিচুতে মেশায় বিষাক্ত রাসায়নিক যা খেয়ে গত এক সপ্তাহে নিহত শতাধিক । অবশেষে পলাতক সেই শিক্ষিত লিচুচাষি । ”
তারপর ,
গতমাসে সংস্কারবিহীন , ভাঙাচোরা রাস্তার কারণে পথে উলটে যায় এক কন্যাযাত্রী বোঝাই বাস । সতীনাথবাবুর কলমে — “প্রেমের বদলা খুন । বাসমালিকের চাপে নিজের প্রাক্তন প্রেমিকার বিয়েতে ড্রাইভার হিসেবে বাস নিয়ে যেতে বাধ্য হয় যুবক । বোধ হয় , ঠিক এমন সুযোগই খুঁজছিল সে । ফেরার পথে নিজের ব্যর্থ প্রেমের ক্ষোভকে চরিতার্থ করতে অনিয়ন্ত্রিত ড্রাইভিং করে উলটে দেয় বাস । বাস উলটে প্রাক্তন-হবু শ্বশুরকে দায়িত্ব নিয়ে বাঁশ দিতে সফল সেই চালক ! নিহত ড্রাইভারসহ আরও পাঁচ । ” গতকাল রাতে হিন্দু হস্টেলের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে পদার্থবিদ্যার প্রথম বর্ষের এক ছাত্র । ছেলেটির হাতে ছিল ছোটোবেলার পক্সের দাগ । অত্যধিক পড়াশোনার চাপ ও পরপর দুটি সাপ্লি — শেষমেষ লোকলজ্জার ভয়ে সুইসাইড , এমনটাই অনুমান পুলিশের । কিন্তু সতীনাথবাবুর সম্পাদনায় — ” মাদক এবার থাবা বসাল মধ্য-কলকাতার বিখ্যাত হিন্দু হস্টেলেও । রোজ রাতের অভ্যাস মতো কোকেন না পেয়ে হস্টেলের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মঘাতী নেশাসক্ত এক ছাত্র । হাতে তার স্পষ্ট ড্রাগের ইনজেকশনের দাগ । কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষের চাপের মুখে গোটা ঘটনা আড়াল করতে তৎপর প্রশাসন । ”
এভাবেই বছরের পর বছর ধরে টলটলে মুরগির ঝোলকে চমৎকার চিলি চিকেনের রূপ দিয়ে আসছেন সম্পাদক সতীনাথ সেন । যে রাজ্যের মেগা সিরিয়ালে সরকারি উকিল অক্সিজেন মাস্ক পরে কোর্টে সওয়াল করেন , সে রাজ্যে এসব খবর বিক্রিও হয় হট কেকের মত । আর তাতে রঙিন মোড়ক পরাতে সতীনাথ সেনের জুড়ি মেলা ভার । খবর হবে পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে এক ঠোঙা ঝালমুড়ির মতো , অত সত্যিমিথ্যে বিচারের সময় কোথায় পাঠকের ! বিনোদন দিতে পারলেই বিন্দাস হয় পেপার আর বাড়তে থাকে বিজ্ঞাপন । তাই পশ্চিমবঙ্গেও বিক্রিতে শীর্ষে সমাচার ।
রাত দশটায় সমাচারের অফিসে ঢুকলেন সতীনাথবাবু । ইতিমধ্যেই তার রিপোর্টাররা সারাদিনের সমস্ত খবরাখবর জমা করেছে নিউজ ডেস্কে। সতীনাথবাবুর অপারেশন শুরু হবে এবার । মামুলি সংবাদগুলোই তিন ঘন্টায় হয়ে উঠবে মহাকাব্যের এক-একটা পৃষ্ঠা ।
“রাতের কলকাতায় আবারও মদ্যপ বাইক আরোহীর তান্ডব , পিষে দিল এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষককে।” — পড়ামাত্রই রে রে করে উঠলেন সম্পাদক মহাশয় । ” ছি ! এটা একটা খবর হয়েছে ! আজকালকার ছোকরা রিপোর্টারগুলো এক্কেবারে যাচ্ছেতাই ! বোগাস মাল শালা সব ! এমন লিখলে এরপর থেকে একটা বেকারি বিস্কুটের বিজ্ঞাপনও কপালে জুটবে না, কপি বিক্রি তো দূরে থাক। ছিঃ ! ” একরাশ বিরক্তি নিয়েই শিল্পকলার সূচনা করলেন তিনি — ” বছরের পর বছর ধরে প্রাইভেট টিউশনে প্রশ্নপত্র ফাঁসের জের । শেষমেষ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষককে বাইক চাপা দিয়ে খুন করল তাঁরই প্রাক্তন ছাত্র । অভিযোগ , কর্মজীবনে নিজের টিউশন ব্যাচের সমস্ত স্টুডেন্টকে পরীক্ষায় বেশি নম্বর দেওয়ার পাশাপাশি প্রশ্নপত্রও বলে দিতেন তিনি । গতরাতে সেই ঘটনারই মধুর প্রতিশোধ এক সদ্য পাস আউট ছাত্রের । অভিযুক্ত পলাতক । ” কলম রাখতেই অফিসঘরের দরজায় ছোট্ট টোকা । সতীনাথবাবু ভাবলেন — হয়তো বেয়ারা চা নিয়ে এসেছে । ভেতরে আসতে বললেন গম্ভীর স্বরে । কিন্তু প্রবেশ করলেন ধুতি পরিহিত টাক মাথার বছর পঁয়ষট্টির এক ভদ্রলোক ।
— ” কে আপনি ? “
— ” স্যার , আমি সমীরণ ঘোষ । “
— ” কে সমীরণ ? “
— ” স্যার , আমিই গতরাতে মারা গেছি স্যার । আমি প্রশ্ন ফাঁস করতাম না । জীবনে কোনোদিন টিউশনিও করিনি । বাইক আরোহী ছেলেটিও আমার স্কুলে পড়েনি কোনোকালে । ও মোটর মেকানিক স্যার । ফাইভ পাস । ড্রিংক করে বাইক চালাচ্ছিল । “
— ” মানে ? ছেবলামি হচ্ছে ? যে সে ইচ্ছেমতো ঢুকে পড়ছে অফিসে । হায়দার যে কি করে … শালা পাগলা বুড়ো ? এলি কি করে এখানে ? সিকিউরিটি ! সিকিউরিটি ! “
— “চোপ ! একদম চোপ শালা ! নিজে গিয়ে যখন মন্ত্রীর পা চাটিস, তখন তো একবারও বলিস না যে রাস্তা কেন ঠিক হয় না ! নিজেরা পাবলিকের টাকা মেরে ফাইভ স্টার হোটেলে মাগি নিয়ে স্ফূর্তি করবি আর বাস উল্টালেই আমাদের প্রেমের পিণ্ডি চটকাবি ? আমরা তোদের মতো নই যে নিজেদের স্বার্থে মানুষ মারব ! নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে জনগণকে খুন করব ! শালা চামার ! “— হঠাৎই ড্রাইভারের পোশাক পরিহিত এক মূর্তির আবির্ভাব সম্পাদকের ঘরে ।
— ” কে আপনারা ? কেন এসব করছেন ? আমার ঘরে এলেনই বা কি করে ? ”
—“হাতের সিগারেটটা ফেল । সামনে একজন শিক্ষক দাঁড়িয়ে আর তুই বাঞ্চোদ ফুঁকছিস ! বাপ-মা শিক্ষাদীক্ষা দেয়নি নাকি কিছু ? তোর জন্য তো আম্মি আমার মরতে বসেছে ! আমি ড্রাগ নিই ? হ্যাঁ ? জীবনে বিড়িই ছুলাম না আর ড্রাগ !
আম্মি পাড়ায় মুখ দেখাবে কি করে ? পুলিশ , মন্ত্রী , আমলা সবাইকে তো তেলে চুবিয়ে রেখেছিস । তোদের বিরুদ্ধে কেস করতে গেলেই দিবি শালা ভরে গারদে । আর সাথে আছে দালাল বুদ্ধিবিচিগুলো …ফেল শালা সিগারেট । শুয়োরের বাচ্চা ! ফিজিক্সের চাপ তুই কি বুঝবি ! “— বলেই চেয়ারে লাথি মারল গলায় প্রেসিডেন্সি- পদার্থবিদ্যার আইকার্ড ঝোলানো এক ছাত্রমূর্তি ।
সতীনাথবাবুর হাত থেকে জ্বলন্ত লার্জ সাইজ সিগারেট ছিটকে গিয়ে পড়ল ঘরের এসি মেশিনে । পরদিন সকালে চ্যানেলে চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ —” সমাচারের অফিসে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত সম্পাদক সতীনাথ সেন । শর্ট-সার্কিট থেকেই
অগ্নিকান্ড বলে অনুমান পুলিশের । ঘটনাস্থলে দমকলের চারটি ইঞ্জিন । “
দারোগা হায়দারকে বারবার ডেকেও গতরাতে সাড়া পাননি সতীনাথবাবু । অফিসের সামনেই এক অজ্ঞাতপরিচয় বিক্রেতার কাছে লিচুর জুস খেয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সে । প্রসঙ্গত , মিথ্যে অপবাদের জেরে বিক্রিবাট্টা কমে যাওয়ায় দিন দুয়েক আগেই বিষ খেয়ে আত্মঘাতী হয় বাঁকুড়ার সেই লিচুচাষি । সে খবর প্রকাশ পায়নি কোথাও!
হলদে সংবাদ ভৌতিক গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
অষ্টপদীর রক্তকাহন
ব্রহ্ম দৈত্য
প্রত্যাবর্তন