কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » ভৌতিক গল্প » অনিশ্চয়তা

অনিশ্চয়তা

অনিশ্চয়তা ভৌতিক গল্প – প্রত্যয় গাঙ্গুলী

অনিমিখ একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো। আসতে আসতে স্টেশনটায় ভালোই ভীড় বাড়ছে। অফিস ফেরত সময় এই ট্রেনটা ধরার জন্য প্রত্যেকদিনই বেশ ভীড় হয় এবং আজকের দিনটাতেও তার কোনোরকম ব্যতিক্রম হয়নি । অনিমিখের মাঝে মাঝে মনে হয় এই ডালহৌসি চত্বরের সব লোকই বোধহয় বজবজের দিকেই থাকে। নইলে প্রত্যেকদিন এই বিবাদী বাগ স্টেশনে এতো ভীড় কেন হবে !
দূর থেকে ট্রেনের হর্নটা ভেসে এলো। ট্রেনটা ঢুকছে। অনিমিখ চারিদিক আরেকবার চোখ বুলিয়ে দেখলো। এখন প্লাটফর্মে গিজগিজ করছে লোক ! মহিলা বাচ্চা বৃদ্ধ বৃদ্ধা কিছু লোক কয়েকটা কিসের যেন ভর্তি ড্রাম নিয়ে উন্মুখ ভাবে ট্রেনের দিকে তাকিয়ে। এরা সবাই যেন একি সাথে যেন বাড়ি ফিরবে ! মাঝে মাঝে অনিমিখের সত্যিই মনে হয় মানুষ প্রজাতি বোধহয় সত্যিই কোনো যন্ত্রে রূপান্তর হয়ে গেছে। নইলে একি সময় অফিস ঢোকা, একি সময় লাঞ্চ ব্রেকে সবার খিদে পাওয়া এমন কি এই দূ বছর সরকারি চাকরিতে ও এটাও লক্ষ্য করে দেখেছে যে অনেকে আবার একইসাথে একি জায়গায় একি সময়ে ঘুরতেও গিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে ওর এসব ভেবে হাসিই পেয়ে যায়, কিন্তু কি আর করবে। সরকারি চাকরি বলে কথা, মাইনেটাও খারাপ নয়। পছন্দ নয় বলে তো আর ছেড়ে দেওয়া যায়না। এই চাকরিটা পাওয়ার জন্য ওকে তো আর কম মাশুল গুনতে হয়নি!
ট্রেনটা এবার প্লাটফর্মের ভিতর ঢুকছে আসতে আসতে। ওর একবার মনে হলো ট্রেনটা ছেড়ে দেবে কিনা ! কিন্তু পরমুহূর্তেই ভাবলো যে না, আজকে ওকে আগেই যেতে হবে। ওর একটিই ছাত্রী, তার আবার পরের সপ্তাহ থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু ! তার মা অনিমিখকে বারবার করে অনুরোধ করেছেন যদি ও আজকে শেষবারের মতন একবার অংকটা দেখিয়ে দেয়। অনিমিখ ব্যাগটা সামনের দিক করে নিলো। ট্রেনটা প্রায় ঢুকেই গেছে, যাত্রীরা ছোটাছুটি শুরু করার জন্য তৈরি। ও নিজেও প্রস্তুত হলো। এক লাফে একদম ভিতর দিক ঢুকে যেতে পারলেই শান্তি !

ট্রেনটা থামার সাথে সাথেই ও লাফিয়ে উঠে ঠিক লেডিসের আগের কামড়াটার হাতলটা ধরে ভিতরে ঢুকতেই যাবে এই সময় পিছন থেকে একটা অসম্ভব ধাক্কা ওকে একদম কামড়াটার শেষে পৌঁছে দিলো। ও হুমড়ি খেয়ে একজন বয়স্ক ভদ্রলোকের গায়ে পরেই যেত, যদি না শেষমুহূর্তে ওর পা টা ওর সাথ দিতো। কোনোমতে দাঁড়িয়ে অনিমিখ পিছন ফিরে তাকিয়ে জোরে চিৎকার করার জন্য মুখ ফিরিয়েছে, ঠিক তখনই ব্যাপারটা হলো!
“ওঃ দাদা ! একটু আসতে!”
শব্দটা ও করেনি, করেছে ওর ঠিক পরের জন। তারও মাথা ঘুরে আছে তার পিছনের দিকে। এবং
অনিমিখ মুখ ফিরিয়ে যা দেখলো তাতে একপলক ও স্তম্ভিত হয়ে গিয়ে ওর শরীরের প্রত্যেকটা শিরার মধ্যে দিয়ে হঠাৎ এক নিমেষে কিরম যেন একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গিয়ে ওর ভিতর অব্দি কাঁপিয়ে দিলো ! ও ঠিক দেখছে তো !
ওর ঠিক পিছনের লোকের পড়ে একসাথে পাঁচটা ছেলে কামড়াটাতে উঠেছে। এবং তাঁদের পরেই, ওর থেকে বড়ো জোর দশ হাতের দূরত্বে, দরজাটা থেকে একটু খানি দূরেই দাঁড়িয়ে আছে ও!
সুতপা? হ্যা, সুতাপাই তো ! কিন্তু ওর এরম সাজগোজ কেন !
গায়ে গাঢ় নীল রঙের দামি শাড়ি, ঠোঁটে উজ্জ্বল লিপস্টিক, হাতে নানান ধরণের চুরি ! এক মুহূর্তই অনিমিখ ওকে দেখলো, এবং তার পড়ে অনিমিখের চোখ গেলো ওর মাথার দিকে। সুতপা ওর দিকে ফিরেই ওর সামনের ছেলেটার সাথে একমনে কি যেন কথা বলছে আর তার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ করে হেসে উঠছে, এবং ওর চুলের ঠিক মাঝখানে গিয়ে অনিমিখের দুটো চোখ থমকে গেলো।
মাথার চুলগুলো ঠিক দুটো ভাগে নিপুনভাবে ভাগ করা। এবং তার ঠিক মাঝখান দিয়ে বই গেছে একটা গাঢ় লাল রঙের সিঁদুরের রেখা !
“হাহা! আরে ঠিক করে দাড়াও না !”
অনিমিখ ভীড় ভর্তি ট্রেনের মাঝেও চুপ করে দেখলো সুতপা ওর সামনের ছেলেটাকে কথাটা বলেই আবার হেসে উঠলো। ওর থেকে ঠিক কয়েক হাত দূরেই যে অনিমিখ চুপ করে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছে , তা যেন ওর খেয়ালই নেই। ও আপন মনে হাসছে, আর মাঝে মাঝে ওর বর (তাই হবে বোধহয় )এই ভিড়ের মাঝেও ওর কোমর ধরে ওকে নিজের দিকে টেনে নিচ্ছে। এক মুহূর্ত অনিমিখ চুপ করে দাঁড়িয়ে ওদেরকে দেখলো। ট্রেনটা আপন মনে ছুটে চলেছে, ভীড় ও বাড়ছে, কিন্তু এ সব কিছুই যেন ওদের দুজনকে, ওদের দুজনের পৃথিবীটাকে কোনোভাবেই বিচলিত করতে পারছেনা। ছেলেটা কেমন যেন একটু একগুঁয়ে, জেদি টাইপ মনে হলো অনিমিখের। অবশ্য সুতপা তো এমন একজনকেই চেয়েছিলো !
একটু বাদে, ট্রেনটায় আরো ভীড় বাড়তে ছেলেটি আর সুতপা নিজেদের জায়গা পরিবর্তন করলো। ছেলেটি এবার ওকে ট্রেনের সমগ্র যাত্রীদের থেকে এমন ভাবে আগলে দাঁড়ালো মনে হলো যেন ওরা কোনো যুদ্ধে আছে, এবং ছেলেটিই ওর একমাত্র রক্ষক! যত যাই হয়ে যাক, ও সুতপার কোনো ক্ষতি হতে দেবেনা! সত্যিই, ছেলেটাকে দেখে হিংসেই হলো অনিমিখের! হিংসাই তো? নাকি এ কোনো অজানা বিদ্বেষ? কিন্তু ওদের হাবভাব দেখে বোঝা যাচ্ছিলো যে ওরা সত্যিই দুজনে দুজনের সাথে খুশি ! হেঃ !
অনিমিখ আপন মনেই ওদের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কখন হেসে ফেলেছে বুঝতেই পারেনি। ওর খেয়ালটা হলো ঠিক কয়েক সেকেন্ড পড়ে !
কি একটা কথায় ছেলেটা এবার আবার অনিমিখের দিকে পিছন ঘুরে এক টানে সুতপাকে বুঁকের কাছে টেনে আনতে চাইলো, এবং সুতপা ওর বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়তে না পড়তেই হঠাৎ করেই কিভাবে যেন ওর দুচোখ ওর বরের (বা ওর পৃথিবীর! )উপর থেকে সরে গিয়ে অনিমিখের উপর পড়লো। একপলকের জন্য! ওই একপলকের জন্য অনিমিখ ভুলে গেলো এই ভীড় ট্রেন, এই রাস্তাঘাট, এই নিত্য দিনের অদ্ভুত রকমের নানান যুদ্ধের মাঝে নিজেকে বিজয়ীর স্থানে উত্তীর্ণ করার তীব্র আকাঙ্খার হাতছানিটা। একপলকের জন্য এক মহাসাগর অন্য আরেক অতুলনীয় গভীর মহাসাগরের দিকে চোখ মেলে চাইলো ! ওই চাহুনিতে কোনো প্রশ্ন ছিল কি? নাকি সব প্রশ্নের উত্তরে এক ফোটা “ভালো আছি ” এটা জানিয়ে দেওয়ার শান্ত একটা হাসি? এক পলকের জন্য এই পৃথিবীটাও যেন দিবারাত্রি ঘুরপাক খেতে খেতে তার পরিশ্রমের ক্লান্তি স্বীকার করে একটু খানি বিশ্রাম নিয়ে নিলো !
ওই এক পলকই।
তারপরের সেকেন্ডেই অনিমিখ মুখ ঘুরিয়ে নিলো।

ট্রেনটা ছুটছে আপন মনেই। যাওয়ার পথে সে কখনো হাত নিলিয়ে নিচ্ছে জং ধরে যাওয়া কিছু ফুলের সাথে, আবার কখনো তাকে দেখে বিদ্রোহ জানাচ্ছে আলগোছে খসে পড়ে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে থাকা অগুন্তি নিস্প্রান পাতার দোল। অনিমিখ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। ওর দুকানে হেডফোন তখনো লাগানো, কিন্তু কোনো গান বাজছেনা। একবার ওর মনে হলো ও পিছন ঘুরে একবার সুতপার দিকে দেখবে কি? ওর কেন জানিনা মনে হচ্ছিলো সুতপা বোধহয় ওর দিকেই তাকিয়ে আছে! যদি তাই না হবে, তাহলে ওর মাথার পিছন দিকটায় এরম একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে কেন? ও কি ওকে চিনতে পেরেছে! নাঃ, তা হয়না ! এই সাত বছরে অনেক কিছু পাল্টে গেছে। আর এতদিন পড়ে কোনো চেনা মানুষ কে দেখলে, শুধু তার মুখটাই চেনা চেনা লাগে। মানুষটাকে নয় ! ঠিক যেমন অনিমিখও সুতপাকে এখনো ঠিকঠাক চিনতেই পারছেনা! আর আজকের পর থেকে বোধহয় আর কোনোদিন চিনতে পারবেওনা !
নিজের মনে মনে কিছু যেন ভাবতে ভাবতে ঠিক অনিমিখ দরজার দিকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো । দরজাটায় তখনো অনেক লোক ঝুলছে, আর ঠিক তাঁদের মাঝের এলোমেলো ফাঁক দিয়ে কেমন যেন বাইরের পৃথিবীটা তার জানান দিয়ে যাচ্ছে। একটা সময় জানলা দিয়ে চোখ বাড়িয়ে ও বাইরেটা দেখলো। দূরে পৃথিবীর কোনো এক অজানা প্রান্তে সূর্যোদয় হচ্ছে। se প্রান্ত চোখে দেখা যায়, কিন্তু কোনোদিন পৌঁছানো যায়না। এবং সূর্যোদয়ের সেই কোমল ছোয়ার মধ্যে দিয়ে ট্রেনটা তখন গঙ্গার পাশ দিয়ে আসতে আসতে ছুঁটে চলেছে। সে গতির কোনো বাঁধা নেই, কোনো সীমারেখাও নেই! থাকার মধ্যে আছে শুধু এক গভীর অনিশ্চয়তা ! সত্যিই ট্রেনটা আজ ঠিকঠাক ভাবে ওর গন্তব্যে পৌঁছবে তো? ও যেমনটা ভেবে রেখেছে, তেমনটা ঠিক ঠিক সময় ও করতে পারবে তো? ট্রেনরা তো কারুর বাধ্য বলে মনে হয়না। তাই কখনো যদি ওর মনে হয়, ওর ভিতরে অনিমিখ বলে একজন মানুষ চুপ করে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর অনেক রঙের মাঝে নিজের হারানো রঙটা খুঁজে বেড়াচ্ছে, তাহলে ওর জীবনটাকে প্রধান উদাহরণ ভেবে, এই ট্রেনটাও আবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যাবে না তো?

সেদিন রাত্রে অনিমিখ ভীষণ অদ্ভুত ধরণের কয়েকটা স্বপ্ন দেখলো। ঠিক সিনেমার মতো যেন একের পর এক দৃশ্য ওর চোখের সামনে এসে এক পলক থেকেই বারবার বেরিয়ে গেলো। প্রথমেই যেটা ভেসে এলো, তাতে ও দেখলো সাত বছর আগেকার একটা ঘটনা । ঠিক ওরই মতন দেখতে একটা ছেলে আর সুতপা একটা কোনো রেস্তোরায় বসে আছে। একমুহূর্ত দেখেই অনিমিখ চিনতে পারলো, রেস্তোরাটা বোধহয় কসবার কাছে কোথাও। এখানে ও আগে এসেছে ! উপরের দেয়াল থেকে হালকা খয়েরি রঙের কিছু নিয়ন বাল্বের আলো অনেকটা নিচ্ছে নেমে এসে নানান ধরণের মদের বোতলের মধ্যে ভরা হয়েছে। এবং তার কারণেই বোধহয়, রেস্তোরার ভিতরটা কেমন যেন একরকম অদ্ভুত ধরণের মায়াবী রকম অস্পষ্ট অন্ধকার আলোয় ঘিরে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটার পরনে একটা হালকা সবুজ রঙের পাঞ্জাবী, সুতপার পরনে হালকা লাল রঙের একটা সিল্কের শাড়ি। সেদিন বোধহয় স্বরস্বতী পুজো ছিল। একটা খয়েরি রঙের আলো নেমে এসেছে ওদের মাথার উপরেও, আর তাতে ছেলেটার উল্টো দিকের মানুষটার মুখের নানান রঙ বারবার ধাক্কা খেয়ে কোন এক অজানা শুন্যে হারিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটার মাথাটা সামান্য নিচের দিকে নামানো, এবং তার বা হাতে একটা সিগারেট একমনে জ্বলছে। কয়েকমুহূর্ত সব চুপ। পৃথিবীর কোথাও যেন কোনো আওয়াজ নেই। ঠিক তারপরের মুহূর্তে হঠাৎ করেই সুতপা ছেলেটার ডান হাতটা ছুঁয়ে দিতেই ছেলেটা মুখ তুলে ওর দিকে তাকালো।
“কি হয়েছে তোর?”
এবারে মেয়েটার পাতলা লালচে দুটো ঠোঁট কেঁপে কেঁপে উঠলো।
“অনি, তিন বছর হয়ে গেলো আমরা একসাথে আছি। বাবা এবার আমার জন্য ছেলে দেখছে। তুমি এবারে একটা চাকরি দেখোনা লক্ষীটি। বাবাকে তো আর মানানো যাচ্ছেনা। যবে থেকে উনি তোমাকে আর আমাকে ঐ রাশবিহারীর মোড়ে দেখেছেন, তবে থেকে বাবা আমার পিছনে পড়ে গেছে বিয়ে দেবে বলে। আমি বাড়িতে বলে দিয়েছি, বিয়ে করলে শুধু তোমাকেই করবো। এবার তুমি একটা চাকরি দেখোনা প্লিজ। এই লেখালেখির কাজটা তো একটা চাকরি করতে করতেও করা যায় বলো? কতদিন আর এরম রাস্তায় রাস্তায় কবিতা নিয়ে ঘুরে বেড়াবে? ইংলিশে মাস্টার্স আছে তোমার, তোমাকে যে কোনো স্কুলে লুফে নেবে। তেমন হলে আমি আমার ডিপার্টমেন্টেও কোথা বলে দেখতে পারি। ওরা লোক নিচ্ছে, একটা সামান্য পরীক্ষা হবে শুধু। তোমাকে তো আমি চিনি, ঐ পরীক্ষা তোমার কাছে জল ভাত। প্লিজ পরীক্ষাটা দাও লক্ষীটি, প্লিজ? ” এর উত্তরে অনিমিখ দেখলো অনেক্ষন মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থেকে ছেলেটা হবহু ওরই কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো, “আমি তোমাকে প্রথম দিনই বলেছিলাম সুতপা, আমি এসব চাকরির পরীক্ষা দেবনা। আমি সারাজীবন শুধু লিখে বেঁচে থাকতে চাই, আর তাই করবো !”
“প্লিজ লক্ষীটি, প্লিজ? একটা সামান্য পরীক্ষা শুধু, প্লিজ? আমি জানি তুমি পারবে। প্লিজ! “
“না সুতপা, এখন আর তা হয়না। আমি অনেকদূর এগিয়ে এসেছি আমার এই লেখার হাত ধরে। আমার ভিতরে কেউ যেন একটা বলছে, আর একটা উপন্যাস, ব্যাস! আমাকে আর কোনোদিন কিছু ভাবতে হবেনা !”
কয়েকমুহূর্ত দৃশ্যটা থেমে রইলো। তারপর মেয়েটির মুখের রঙ আসতে আসতে পাল্টে গেলো। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ও আসতে আসতে নিজের হাত গুটিয়ে নিলো নিজের দুটো চোখের নিচে কি যেন মুছলো । অনিমিখ এবার দেখলো,সুতপার মুখে তখন সেই চেনা চেনা সূর্যোদয়ের মলিন হয়ে যাওয়া একটা হালকা ফিকে রঙ। ও আসতে আসতে চেয়ারটা থেকে উঠলো। তারপর ওর ব্যাগ থেকে একটা ১০০টাকার নোট বের করে টেবিলটার উপর রেখে বিন্দুমাত্র তাড়াহুড়ো না দেখিয়ে “আমি আসছি ” বলে সুতপা রেস্তোরাটার বাইরের গেটের দিকে পা বাড়ালো। অনিমিখ অবাক হয়ে দেখলো ছেলেটা সুতপাকে দেখলো, কিন্তু ওকে কোনো বাঁধা দিলোনা। সুতপা এবার নিজের লাল শাড়িটা কোনোমতে সামলে নিয়ে রেস্তোরাটা থেকে আসতে আসতে বেরিয়ে যাবে, এমন সময় একদম শেষ মুহূর্তে গিয়ে ও ঠিক দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে ছেলেটার দিকে ঘুরে তাকালো। ছেলেটি তখনো অন্যদিকে ফিরে চুপচাপ সিগারেটে টান দিয়েই যাচ্ছে। এবার অনিমিখ দেখলো সুতপা কাঁদছে। ওর দূ চোখ দিয়ে একের পর এক ফোটা এবার স্রোতের আঁকার নিচ্ছে। অনিমিখ এবারে অবস্থাটা বুঝে ছেলেটার উদ্দেশ্যে প্রচন্ড জোরে একটা চিৎকার করলো! ওর তীব্র চিৎকারে ভেঙে গেলো আকাশ, ভেঙে ফেটে গেলো পায়ের তোলার মাটি। ঘরের ভিতর সমস্ত টেবিল হুমড়ি খেয়ে পড়ে প্রচন্ড শব্দে ভেঙে গেলো, কেবল একটা বাদে। ঐ যে ঐ কোনার টেবিলটা! ঐ যে হালকা সবুজ পাঞ্জাবী পড়া ছেলেটা ওখানে বসে এখনো জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে আছে। ওর পৃথিবীতে এই চিৎকারের লেশমাত্র প্রভাব পড়লোনা!
একমুহূর্ত আবার সব চুপ। তারপর, সুতপা অল্প নিজের মনেই অল্প একটু হেসে চোখের তলা দুটো আরেকবার মুছে রেস্তোরার বাইরে বেরিয়ে গেলো।
এরপর এই দৃশ্যটা মুছে গিয়ে এলো আরেকটা দৃশ্য। ঐ একি রেস্তোরা, কিন্তু এবারে ভিতরের আলো গুলো যেন আরো একটু কম। অবশ্য এবারে আগেরবার থেকে আরো বেশ কিছু পার্থক্য আছে। এবারে সুতপা ছেলেটার হাত ধরে নেই, বরং ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে চুপ করে বসে আছে। ওর ডান চোখের কোনে কি অল্প জলের ফোটা দেখা যাচ্ছে কি? অনিমিখ ঠিক বুঝতে পারলোনা।
ছেলেটা অনেকক্ষন চুপ করে থেকে এবারে সুতপার দিকে তাকালো।
“কি হয়েছে তোর ?পুরো দুটো সপ্তাহ কোনো পাত্তা নেই। কোনো ফোন নেই , কোনো মেসেজও নেই। আমি ফোন করলেও তুলছিলি না। আমি ভাবছি কি হলো, হঠাৎ দেখি কাল রাতে একটা মেসেজ। “খুব জরুরি দরকার, কাল দেখা করো !” কি ব্যাপার তোর ? পাগল টাগল হয়ে গেলি নাকি রে !” কথাটা বলেই ছেলেটা ওর দিক একটু হেসে উঠলো। কিন্তু মেয়েটার উপর তার কোনো প্রভাব পড়লোনা।
একমুহূর্ত সুতপা এবারে ছেলেটার দিকে চুপ করে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর যখন ওর ঠোঁট নড়ে উঠলো অনিমিখ লক্ষ্য করলো এবারে ওর গলা, প্রচন্ড শীতের গভীর রাতের হওয়ার মতনই ঠান্ডা, আবেগহীন। এবং অচেনা।
“আমি খবরটা তোমাকে ফোনেও বলতে পারতাম, অনি, কিন্তু চাইনি। তাই আজ দেখা করতে এলাম। বাবা আমার পাত্র ঠিক করে ফেলেছে। ও কলকাতারই ছেলে, আর ও আমার মতনই একটা কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসে কাজ করে। আমি কথা বলেছি ওর সাথে। বেশ ভালো কথা বলে, ভালো গান করে আর তার সাথে সামান্য লাজুক ও। আমাদের বিয়ে পরের বছর ফেব্রুয়ারীতে ।” সুতপা এবারে এক মুহূর্ত থামলো। তারপর ওর ব্যাগটা হাতে তুলে নিলো।
” তাই তোমাকে জানাতে এলাম অনি, আজকের এটাই আমাদের শেষ দেখা। আমাকে যদি তুমি সত্যিই ভালোবেসে থাকো, তবে তোমার কাছে একটাই অনুরোধ করবো, কোনোদিনও আমার সাথে আর যোগাযোগ রাখার বা করার চেষ্টা করোনা। আশা করি তুমি আমার এই কয়েকটা কথা মনে রাখবে। ভালো থেকো। আসি। ” সুতপা ওর জায়গা থেকে উঠে ওর নীল পাড় শাড়িটা ঠিক করলো। তারপর বেরিয়ে যাবার ঠিক আগে ঠিক আগেরবারের মতনই আসতে আসতে ও পিছন ফিরে ছেলেটার দিক তাকালো। এবারে অনিমিখ পাশের টেবিলটা থেকে দেখলো ছেলেটা তীব্র দৃষ্টিতে সুতপার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে। এবং ওর দুটো চোখের জ্বালাময়ী দৃষ্টিতে এক তীব্র কষ্ট ও আতঙ্কের প্রতিফলন স্পষ্ট ! সুতপার মুখে কিন্তু কোনোরকম কোনো পরিবর্তন নেই। ও একি রকম শান্ত, একি রকমের শীতল।
“ভালো কথা, আমি তন্ময়কে বারবার জিজ্ঞেস করে যেচে খবর নিয়ে দেখে নিয়েছি। ও লেখালেখির দিকে নেই, ওসব একদম পছন্দও করেনা।” তারপর একটু থামলো । একটা ঢোক গিললো কি? “তন্ময়ের অনেককিছুই ভালো, তবে আমাকে যদি সত্যি কেউ কখনো জিজ্ঞেস করে কেন আমি ওকেই বাচলাম, তাহলে সেটার এক এবং একমাত্র কারণ হলো ওর লেখা এবং লেখকদের প্রতি এই ঘেন্নার জন্য!” শেষ কথাটা বলে সুতপা সোজা ছেলেটার চোখের দিকে তাকালো। এক মুহূর্তের জন্য।তারপরই সুতপা ছুটে গিয়ে রেস্তোরার দরজা বাইরে বেরিয়ে গেলো ! অনিমিখ ছেলেটার দিক তাকিয়ে দেখলো এবার ছেলেটার চোখের কোন হালকা হালকা ভিজে উঠেছে এবং তার ছেলেটার মুখে অনেক গুলো রঙ পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। ভয়, আতঙ্ক, রাগ, বিদ্বেষ সব যেন ঠিকরে পড়ছে ওই আগুনের মতন ওর দুটো চোখের জ্বলন্ত দৃষ্টি থেকে। অনিমিখ উঠে ওকে কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই ছেলেটা ওর সামনের টেবিলটার উপর প্রচন্ড জোরে একটা ঘুসি মারলো! এবং তার সাথে সাথেই গোটা টেবিলটার সাথে ওর গোটা শুন্যটাও কেঁপে গিয়ে সেই দৃশ্যটা কোনো একটা অজানা ধোঁয়ায় মুছে গেলো। এরপর এলো একটা নতুন দৃশ্য।
এটা, ওর জীবনের কোনোদিন ঘটনা নয় । এবং তাই, এই দৃশ্যটা দেখে অনিমিখ খুব চমকে গেলো।
একটা ট্রেন ছুটছে। ট্রেনটায় প্রচন্ড ভীড়, কোথাও একফোঁটা পা রাখার মতনও জায়গা নেই। তারই মধ্যে অনিমিখ একদিকের দরজার কাছে কোনোমতে নিজেকে ভিড়ের মধ্যে গুঁজে দিয়ে ঝুলছে। ট্রেনটা ক্রমাগত তার গতি বাড়িয়ে গঙ্গার পাশটা দিয়ে ছুটে চলেছে। ইডেন গার্ডেন্স স্টেশন চলে গেলো, প্রিন্সেপ ঘাট আসছে কিন্তু ট্রেনটা কিছুতেই থামছেনা। এদিকে ট্রেনটা এমন গতি বাড়িয়ে নিয়েছে, যে অনিমিখের মনে হলো ওর সাথে গোটা ট্রেন লাইন, নীচের মাটি, গোটা বিশ্ব ব্রহ্মান্ডটাও ভয়ানক গতিতে দুলছে। যখন খুশি যা খুশি একটা হয়ে যেতে পারে! হঠাৎ করেই ট্রেনটা কিভাবে যেন একটা ব্রিজের উপর এসে প্রচন্ড জোরে ব্রেক দিলো । অনিমিখ কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখলো অনেক অনেক নিচে গঙ্গার গভীর স্রোতে জল বয়ে চলেছে। এই জায়গায়টা আবার কোথায়! এটা ভাবতে ভাবতে এবারে ও মুখটা উপরে তুলতেই ট্রেনটা আবার ছুটতে শুরু করলো। আসতে আসতে আসতে আসতে প্রচন্ড জোরে! জোরে! জোরে! এবার ট্রেনটা যেন আলোর গতির থেকেও ভয়ঙ্কর জোরে ছুটছে !অনিমিখ দেখলো ওর আশপাশের পৃথিবীটা কেমন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে ! ঝাপসা হয়ে গেলো কালো ছাইমাখা একটা আকাশ, ঝাপসা হয়ে গেলো কত কত নক্ষত্র, ঝাঁপসা হয়ে ধুলোয় উড়তে গেলো কতগুলো ছিঁড়ে টুকরো হয়ে যাওয়া পলাশ ফুলের পাঁপড়ি ! কোথা থেকে যেন ভেসে এলো এক অদ্ভুত পোঁড়া পোঁড়া লাশের গন্ধ !অনিমিখ তাল সামলাতে পারছেনা তাও ট্রেনটা কিছুতেই তার গতিবেগ কমাচ্ছেনা। কি করবে ও ! কিভাবে বেঁচে বেরোবে এর থেকে !কোথায়? ওকে ছোটবেলা ওর দাদু যে একদিন গল্প করে বলেছিলো এই পৃথিবীর ভিতরে নাকি আরো অনেক অজস্র পৃথিবী আছে এবং তাঁদের নাকি আলাদা আলাদা করে কোটি কোটি অক্সিজেনের ভান্ডার আছে ! সে ভান্ডারগুলো কোথায় !ও যেতে চায় সেখানে। এখানে ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে ! ও আর স্বাস নিতে পারছেনা যে ! ওই তো ! ওই চলে গেলো “মুক্তি” স্টেশনটা !কিন্তু ট্রেনটা থামছেনা কেন ! থামো ! থামো ! বাঁচাও ! ও চিৎকার করলো কিন্তু ওর মুখ দিয়ে একটা শব্দও বেরোলোনা ! একি হচ্ছে ওর সাথে! পাগলের মতন ও ট্রেনটার হাতল খামচে ধরে ও আবার চিৎকার করতে যাবে, ঠিক তখনই ওটা হলো !
হঠাৎ ওর দুচোখ অনেক দূরের ওই জিনিষ্টার উপর পড়ে আটকে গেলো ! এবং পড়ার সাথে সাথেই ওর সমস্ত শরীরের রক্ত ভয়ে ও আতঙ্কে জমে গেলো !
একি, সামনে ওটা কি!
সোজা তাকালে অনেকখানি দূরে দেখা যাচ্ছে ব্রিজ টা সাপলুডোর মতন এদিক ওদিক বেয়ে কিছুটা চলার পরেই একটা গর্ত ! হ্যা ! গর্ত ! ওখানের পড়ে আর লাইন নেই !একি! তারমানে কি ব্রিজটা এখনো পুরোটা তৈরি হয়নি? কিন্তু তাহলে ট্রেনটা কেন যাচ্ছে এই লাইনে? অনিমিখ নিচে তাকিয়ে দেখলো! ওর বুঝতে অসুবিধে হলোনা যে ওরা অনেক উপরে দাঁড়িয়ে আছে ! এবং অনেক নিচে এখনো অঝোর ধারায় বয়ে চলেছে গঙ্গা নদী!এখানে স্রোত, ভয়ঙ্কর !এদিকে ট্রেনটা ক্রমশঃ স্পিড বাড়াতে বাড়াতে এবারে মোটামুটি বিদ্যুৎ বেগে ছুটছে। আর কয়েক সেকেন্ড পরেই সব শেষ! অনিমিখ পাগলের মতন এদিক ওদিক তাকালো। ট্রেনে ওর সাথে আরো কোটি কোটি লোক কিন্তু তারা সবাই সোজা তাকিয়ে আছে কেন? কারোর মুখে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই কেন? সবাই দেখতে পাচ্ছে তো যে ব্রিজটা ভাঙা? ড্রাইভার! সে দেখতে পেয়েছে তো ! অনিমিখ হন্তদন্ত হয়ে কি করবে বুঝতে পারছেনা, এমন সময় হঠাৎই ওটা হলো।
“কেমন আছো অনিমিখ? “
একটা চেনা চেনা কণ্ঠস্বর ওর কানে ভেসে এলো। পিছনে ফিরতেই ও দেখলো সুতপা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর পরনে ঠিক ওই প্রথমদিনের হালকা লাল রঙের শাড়িটা। ওর দুঠোঁটে হালকা স্মিত হাসি এবং কপালে, এক তীব্র গাঢ় লাল রঙের সিঁদুরের রেখা !
ও কিছু বলতেই যাবে অমনি ব্যাপারটা হলো। প্রচন্ড জোরে একটা শব্দ হতেই অনিমিখ দেখলো ট্রেনটা ঠিক ওই গর্তের সামনে এসে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়লো !
এবারে অনিমিখ একটা লম্বা স্বাস নিলো ! ওই স্বাসের আয়ু ছিল একমুহূর্ত ! ওই একমুহূর্তই ! কারণ ঠিক তারপরের মুহূর্তেই “একি তুমি এখানে কিকরে… ” বলে ও যেই সুতপার ডান হাতটা ছুঁয়ে দিলো , ঠিক তখনই ওটা হলো !
হঠাৎ করে ওর গোটা পৃথিবীটা একটা প্রচন্ড দোল খেয়ে এক নিমেষের জন্য দিকভ্রান্ত হয়ে মাধ্যাকর্ষণের টানে নিচ্ছে পড়তে শুরু করলো। অনিমিখ মুখ বের করে দেখলো ট্রেনটা আবার চলতে সুরে করেছিল এবং তাই এখন ওর প্রত্যেকটা বগি নিমেষের মধ্যে ওই গর্তে পড়ে লাইন থেকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে সোজা গঙ্গার বুকের উপর পড়ছে! আর কিছু সেকেন্ড, তারপরেই সব শেষ ! অনিমিখ চারিদিক চেয়ে দেখলো। সবার মুখ চুপ চাপ, যেন তারা জানেই না তারা আর কোনোদিনও সূর্যের মুখ দেখবেনা! এক।
দুই।
তিন!
এবারে ও ওর পাশে তাকালো। সুতপা তখনও সেখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে এবং ওর চাল চলন দেখে মুচকি মুচকি হাসছে।
“সুতপা! দেখো আমাকে দেখো। এখন আমি তোমার মতনই একটা চাকরি পেয়েছি, দেখো! এবার আমার কাছে চলো এসো লক্ষীটি। সুতপা… সুতপা…! “
ট্রেনটা এবার প্রচন্ড গতিতে আছড়ে পড়বে গঙ্গার বুকে আর তার সাথে সাথে ওর গোটা শরীরটা জলের তলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে !আর মাত্র কয়েক সেকেন্ডর জীবন ওর ! ও এবারে চিৎকার করে সুতপার হাতটা ধরে প্রচন্ড জোরে নিজের দিকে টানতেই গোটা মহাকাশ শুনলো ওর ওই বুকফাটা আর্তনাদ !
“সুতপা….. “
প্রচন্ড জোরে কোটি কোটি লোহার ধাক্কার বিস্ফোরক গর্জনে আকাশ ফেটে পড়লো এবং তার সাথে সাথেই ওর গোটা শরীরটা কামড়াটার সাথে সাথে একটা অতুলনীয় গভীর জলের ভিতর ঢুকে গিয়ে ওর দম করে দিতে যাবে আর…

“নাঃ !!!!!!!!!!”

অনিমিখ ঘুম থেকে আতকে উঠলো ! ওর বুঁকের ভিতরটা তখনো প্রচন্ড ধরে ঢিপ ঢিপ করছে। একটুখানি বসে ও কয়েকটা লম্বা স্বাস নিলো। তারপরে ওর সারা শরীরে হাত বুলিয়ে দেখলো ওর পুরো জামাটা ঘামে ভিজে গেছে !
এদিকে অনেকক্ষন সকাল হয়ে গেছে। মা কখন এসে জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিয়ে গেছে ও বুঝতেই পারেনি ! সেই জানলাটা থেকে এখন সূর্যের নরম রোদ ঠিক ওর পায়ের কাছে এসে পড়ছে।
অনিমিখ বোধহয় একমুহূর্তের জন্য আনমনা হয়ে গেছিলো, সম্বিৎ ফিরলো ফোনটার শব্দে ! হঠাৎ করে বেজে উঠেছে ওটা! অনিমিখ মুখে হাত দিয়ে দেখলো, মুখটাও ঘেমে একাকার।
একহাত দিয়ে মুখটা মুছতে মুছতে ও আরেক হাতে ফোনটা কাছে তুলে নিলো।
“হ্যালো? “
“হ্যালো?” ওপাশ থেকে ওর খুব চেনা একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ” কি ব্যাপার কি তোমার অনি? কাল রাতে কখন বাড়ি ঢুকলে জানালেনা, আমি ফোন করলাম ধরলেনা, ঘুমোনোর আগেও জানালেনা। কি ভাবো কি তুমি নিজেকে? কাউকে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করোনা? “
অনিমিখ চুপ করে ফোনটা ধরে রইলো। এই বকুনিটা সত্যিই ওর প্রাপ্য ! সত্যি, ওতো ঠিকই বলছে।
“কাল কটায় ঢুকেছো বাড়ি? “
“১০.৩০টা। “
” কাল পড়াতে যাওনি? “
“না। “
“তাহলে কোথায় গেছিলে? “
“ঐ একটু পলাশের মেসে গেছিলাম। “
এবার ওইপাশের মানুষটার গলার শব্দ পাল্টে গিয়ে কেমন যেন নরম হয়ে গেলো।
“পলাশ ? মানে…মানে তুমি কালকে আবার ঐসব ছাইপাশ খেয়েছো? “
“ঐ আর কি। বেশি নয়…দুটো বিয়ার খেয়েছিলাম। তারপর বাড়ি ফিরে এসে শরীরটা ঠিক ভালো লাগছিলোনা, তাই শুয়ে পড়েছিলাম। “
“তা সেটা কি আমাকে জানানোর কোনো প্রয়োজন নেই নাকি মনে করোনা? আমি এদিকে সারারাত চিন্তায় চিন্তায় মরছি। কাল রাত থেকে তোমার ফোনে ফোন করে যাচ্ছি আর এই এখন ফোনে পেলাম! ভাল লাগেনা আমার! যাও তো। যা খুশি করো। “
অনিমিখ কিছুক্ষন চুপ করে ওদিকের মানুষটিকে শান্ত হওয়ার সময় দিলো। তারপর ভাঙা ভাঙা গলায় বললো।
“ভেরি সরি সোহিনী । আমার ভুল হয়ে গেছে। “
এর উত্তরে ওপাশ থেকে ভেসে এলো শুধু একপাল নিস্তব্ধতা। এবারে অনিমিখ নিজের গলার স্বরটা আরো একটু করুন করে বললো,
“সোহিনী, সত্যি বলছি। আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো এরম হবেনা।”
কিছুক্ষন সব চুপচাপ। তারপর ওদিক থেকে একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে এলো।
“বুঝেছি। সব বুঝেছি আমি। এখন শরীর কেমন শুনি? “
“এখন অনেকটা ভালো। “
“সেই। অফিস যাওনি নিশ্চয়? “
“না না। এই তো ঘুম থেকে উঠলাম। “
“সেটা আগেই বুঝেছি। ” তারপর সোহিনী একমুহূর্ত চুপ করে থেকে কি যেন একটা vebw বললো “বেশ, তবে আজ দেখা করতে পারবে? ৬.৩০টা নাগাদ, বাটার মোড়ে? আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়িই বেরোবো তাই বলছিলাম আর কি।”
অনিমিখ এর উত্তর ভাবতে এক মুহূর্ত সময় নিলোনা।
“একদম। তোমার কোনো অসুবিধে হবেনা তো? তাহলে চলে এসো। “
এবারে ওর কানে একটা হালকা হাসির শব্দ এলো।
“বাবু আবার আমার অসুবিধের কথা ভাবেন নাকি! বাঃবাঃ! এসব কথা শুনেও ভালো লাগে। “
এরপরের মোটামুটি পাঁচ সেকেন্ড দুজনেই চুপ। যান্ত্রিক পৃথিবীতে এবারে শুধু একরাশ স্তব্ধতার মাঝে পরস্পরের স্বাস প্রশাসের শব্দ শোনা গেলো। এই ফাঁকে কিছুটা কথা বলে নিলো সময়। তারপরে যখন অনিমিখের গলা ভেসে এলো, তখম ওর গলার স্বর পুরোপুরি পাল্টে গেছে।
“একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো তোমাকে, সোহিনী ? এখনই উত্তর দিতে হবে কিন্তু !”
“কি প্রশ্ন শুনি? “
আবার সব চুপ।
“অনি?”
পরের মুহূর্তেই সোহিনীর কানে এসে ধাক্কা খেলো অনেক দিনের বন্দ থাকা একটা জং ধরা ভারী গলার নিস্তব্ধ আর্তনাদ।
“আমাকে বিয়ে করবে, সোহিনী? “
এরপরের কয়েক সেকেন্ড সব চুপচাপ থাকার পর ওইপ্রান্ত থেকে শব্দগুলো অনিমিখের কানে ভেসে এল।
“৬.৩০টা। বাটার মোর। দেরি করোনা। টাটা। “
কুট করে একটা শব্দ হয়ে ফোনটা কেঁটে গেলো। অনিমিখ ফোনটার দিকে কিছুক্ষণ চুপ চাপ তাকিয়ে থেকে চোখটা বন্ধ করলো। কয়েক সেকেন্ডই হবে, এবং তার সাথে এবার ও পুরো ব্যাপারটা একটা ছবির মতন দেখতে পেলো।

ও দাঁড়িয়ে আছে বিবাদী বাগ স্টেশনে। ওর গায়ে একটা নীল শার্ট আর একটা হালকা খয়েরি রঙের ফর্মাল প্যান্ট। পায়ে ঝকঝকে পালিশ করা ফর্মাল শু। কাঁধে একটা ছোট বাগ ঝুলছে ! এবং তার সাথে ও র আসে পাশে স্টেশনটা পুরো খালি।
নিজের মনে ফোন নিয়ে ও কি যেন খুট খুট করছিলো, বোধহয় একটা কবিতাই লিখছিলো হবে । এবার দূরে একটা শব্দ হতেই, ও মুখ তুলে যা দেখলো তাতে তার পরমুহূর্তেই ওর দুটো ঠোঁট একটা উজ্জ্বল হাসিতে ভরে গেলো।

অনেকদূরে বসন্তকালের একটা ক্লান্ত সূর্য আপন মনে গঙ্গার অন্য কোনো একটা প্রান্তে অস্ত যাচ্ছে, এবং তার থেকে অভিমানে ছিটকে বেরিয়ে আশা রাশি রাশি আলোর বিন্দু ট্রেনটার উপর তেরচা হয়ে এসে পড়ে ওটাকে যেন একটা আয়নার মতন রূপ দিয়েছে।
ট্রেনটা আবার একবার জোরে হর্ন দিলো।
অনিমিখ এবারে একবার চারিদিকটায় তাকিয়ে দেখে নিশ্চিন্ত হলো।
যাক, কেউ নেই! এবারে এই ট্রেনটা ও নিশ্চিন্ত ধরতে পারে।
এই ট্রেনটা যে ওকে ধরতেই হবে!

এবারে সময় মিটমিট করে চোখ মেলে দেখলো খাটের উপর বসে থাকা অনিমিখের চোখ বন্ধ করা মুখটার তামাকে পুড়ে যাও দুটো ঠোঁটে হঠাৎই কেমন যেন একটা অদ্ভুত হাসি খেলে গেলো।

এই ট্রেনটা নিশ্চয় ওকে ওর গন্তব্যে ঠিক পৌঁছে দেবে।
কি তাই তো?
সত্যিই দেবে তো?

ট্রেনটা, তখনো ঢুকছে।

অনিশ্চয়তা ভৌতিক গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!