একটা বৃষ্টির অপেক্ষায় ছোটগল্প – মৈত্রেয়ী ব্যানার্জি
বালিশের তলায় এখনও ছপাতা কড়া ঘুমের ওষুধ জমিয়ে রাখা। ঐন্দ্রিলা ভাবে এগুলো এবার অন্য কোন
জায়গায় তুলে রাখা দরকার। অনেকদিন ধরে এগুলো জমাচ্ছে সে। ডাক্তার তো এখন চট করে ঘুমের ওষুধ
দিতেই চাননা। অনেক সাধ্য সাধনা করে ‘ঘুম না হলে মরে যাবো’ এই বলে প্রেসক্রিপশন করানো। এবার ঘুরে ঘুরে
বিভিন্ন ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ জোগাড় করা। এই জোগাড় করতেই ঐন্দ্রিলার হাঁসফাঁস অবস্থা। একা থাকে
ফ্ল্যাটে। সৌরভকে ছেড়ে এসেছে তা প্রায় বছর আড়াই হতে চলল। সম্পর্কটা বহুদিন শেষ হয়ে গিয়েছিল, তবু
টাব্বুর মুখের দিকে তাকিয়ে সম্পর্ক বাঁচিয়ে রেখেছিল তারা দুজনেই। তারপরে আর…
টাব্বুর ভিতরে যে একটা বড় মানুষের জন্ম হচ্ছে সেটা ওরা খেয়াল করেনি। টাব্বু যেদিন ওদের নিয়মিত ঝগড়ার
মাঝে এসে দাঁড়িয়ে বলল “তোমরা এবার প্লিজ আলাদা থাকো, আমাকে একটু হেল্প করো। আমার কষ্ট হয়…”
তারপর দম নিল বড় বড় করে। তখনই ওরা সরে আসার সিদ্ধান্ত নিল। টাব্বু এখন আটে পড়েছে। ও সৌরভের
কাছেই থাকতে পছন্দ করে, কারণ সৌরভের বাবা মায়ের সঙ্গ। দুজন মিলে নাতনিকে আগলে রাখতে সুদূর
কলকাতা থেকে সিডনি চলে এসেছেন তাঁরা পাকাপাকিভাবে। আশ্চর্য এটা যে, ঐন্দ্রিলা আর সৌরভ যখন নতুন
সংসার পাততে সিডনি এসেছিল, তখন কিন্তু ওনারা কেউ ওদের সংসারে আসতে চাননি। না, ঐন্দ্রিলার বাবা মা,
না, সৌরভের মা বাবা! ওরা এসেছেন, থেকেছেন এক আধমাস। ঘুরে বেরিয়ে, রান্না করে, সংসার গুছিয়ে দিয়ে
আবার দেশের বাড়ির টান অনুভব করেছেন। যেন দেশটা ঐন্দ্রিলার বা সৌরভের নয়!
প্রেমে সায় না দেওয়ায় সামনের ফ্ল্যাটের মেয়েটা ফ্যানের সঙ্গে ওড়না জড়িয়ে সুইসাইড করতে গিয়েও পারেনি।
খুব ভিড় ওদের ব্লকের সামনে। ঐন্দ্রিলা দুধ আনতে বেরিয়ে খানিকটা দাঁড়িয়ে শুনল ব্যাপারটা। ও সাধারণত
কারোর সঙ্গে মেশেনা। মেয়েটা বেঁচে গেছে শুনে একবার কৌতুহল হচ্ছে ওকে দেখার। ভয় পেল শেষ মুহূর্তে না
কেউ দেখে ফেলে। কেউ বাঁচিয়ে দিল বলেই বেঁচে গেল মেয়েটা!
একটা প্রেমের জন্যে সত্যিই মরে যাওয়া যায়! ঐন্দ্রিলা আর সৌরভ যখন ভালবাসায় উথাল পাথাল, তখন
একবারও কি ওরা ভেবেছিল ওদের বিয়ের পর বিদেশে সংসার করতে গিয়ে ওরা অফিস, বাড়ি সব সামলাতে
গিয়ে হাঁসফাঁস করবে! এতটাই দমবন্ধ হয়ে আসবে যে সম্পর্কটাকে টুকরো টুকরো করে বেরিয়ে আসতে হবে
ওদের! অথচ তখন যদি সৌরভ বা ঐন্দ্রিলার বাবা মা গিয়ে একটু থাকতেন, হয়ত…
দমবন্ধ করা গরম পড়েছে কদিন। এসি ঠিকমতো কাজ করতে মাঝেমাঝেই বিদ্রোহ করছে। যন্ত্রের আর দোষ
কি, টানা কাজ করতে কারই বা ভাল লাগে? ঐন্দ্রিলার দেশে ফেরার আজ বেশ কিছু বছর হয়ে গেল। ভেবেছিল,
দেশে ফিরে ও ভাল থাকতে পারবে। কিন্তু ফিরে অবধি মনে হয় না ফিরলেই ভাল ছিল। অন্তত কারোর সঙ্গে দেখা
হলেই কেন সে সংসার করতে পারল না, এ কৈফিয়ত দিতে হতনা জনে জনে। ইদানিং ঐজন্য সে কারোর বাড়ি
যায়না, মেশেনা। এমনকি নিজের বাপের বাড়িও নয়। আত্মীয় কেউ আসতে চাইলে ও কিছু একটা বাহানা করে
কাটিয়ে দেয়।
ওষুধের ফয়েল থেকে একটা একটা করে অনেকগুলো বের করে একটা ছোট ট্রেতে রাখছে। রান্না করে সুহাস
যাবার আগে বারবার মনে করে খেতে বলে গেছে। ঐন্দ্রিলা আজকাল প্রায়ই খেতে ভুলে যায়। আসলে ভোলেনা।
ভাল লাগেনা একা একা খেতে, তাই খায়না। সুহাস ভাবে, তার দিদিমণি সব ভুলে যায়। ভুলে যেতে তো ঐন্দ্রিলাও
চায়। পারে না বলেই তো এতো ওষুধ জমিয়ে তোলা। টাব্বু আজকাল তার মাকে রোজ ফোন করে না। বলে ভুলে
গেছি! ওই টুকু মেয়ে নিজের মাকে ভুলে যায় কি করে!
সব ওষুধ একটা কাচের গ্লাসে ঢেলে জলের দিকে তাকিয়ে থাকে ঐন্দ্রিলা। এই বেশ ভাল। কাল ওকে ঘুম থেকে
উঠতে না দেখে সবাই জানতে পারবে ও চলে গেছে। নিজের সমস্ত যন্ত্রনা একা গিলে সে চলে গেছে। ভাবতে
ভাবতে দেখে জলের রঙ চেঞ্জ হচ্ছে! গ্লাস হাতে মুখে তুলতে যাবে ঠিক সেই সময় ফোনটা বেজে উঠল। টাব্বু
গুড়িয়া কলিং। আর ঠিক সেই সময় আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে একটা বেদম ঝড়ের ঝাপটা গোটা কলকাতা
এলোমেলো করে দিল। উল্টে গেল গ্লাস। অন্ধকার চারিদিক। শুধু সোঁ সোঁ আওয়াজ। কোন জানলা বন্ধ করার
কোন তাগিদ আজ ঐন্দ্রিলার নেই। সে চুপ করে ফোন গালে চেপে ধরে বসে থাকে। ওদিক থেকে রিনরিন
আওয়াজ “মাম্মা শুনতে পাচ্ছো? হ্যাপি বার্থডে মাম্মা। এই নাও, পাপা তোমার সঙ্গে কথা বলবে…. মাম্মা শুনতে
পাচ্ছো! আই মিস উ মা!….
ভরা জষ্টিতেই শ্রাবণ নামে ঐন্দ্রিলার চোখে, বুকে, মনে…
একটা বৃষ্টির অপেক্ষায় ছোটগল্প – মৈত্রেয়ী ব্যানার্জি
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
প্রচ্ছদ
কায়দায় জীয়ন কায়দায় মরণ
পিরীতি কাঁঠালের আঠা