কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » ভৌতিক গল্প » অদৃশ্য প্রহরী

অদৃশ্য প্রহরী

অদৃশ্য প্রহরী ভৌতিক গল্প – প্রীতম সরকার

সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা হয়ে রয়েছে। যদিও বৃষ্টিটা নামলো প্রায় শেষ দুপুরে। সায়নদের বাড়িতে আজ দুপুরেই গোলাপী দাদু এসেছেন। তিনি আগে মিলিটারিতে চাকরি করেছেন। সেই চাকরির সূত্রে ঘুরেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তাঁর দারুন সব ঘটনার অভিজ্ঞতা রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে। আর সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে খুব সুন্দর সব গল্প বলতে পারেন। গোলাপী দাদুকে বাড়িতে আসতে দেখতেই মন ভালো হয়ে গিয়েছে সায়নের। সে জানে, আজ রাতে দাদুর কাছে ঘুমোনোর সুযোগ পেলেই বেশ ভালো সব গল্প শোনা যাবে। এর আগে যখনই গোলাপী দাদু সায়নদের বাড়িতে এসেছেন, নানা ধরনের গল্প শুনিয়ে মাত করে দিয়েছেন সায়নকে।

আজ শনিবার। আগামীকাল রবিবার হওয়ায় স্কুলেও ছুটি আছে। সুতরাং ভোরে উঠে স্কুল বাস ধরার তাড়া নেই। শুধু রাতে দাদুর সঙ্গে এক বিছানায় শুতে পারলেই অন্যবারের মতো গল্প শোনা যাবে, ভাবতে পেরেই সায়নের মন আনন্দে নেচে উঠলো। এদিকে সন্ধ্যা হতেই লোডশেডিং হয়ে গেলো। বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি আর ঘরেও বিদ্যুৎ নেই। বাড়ির ইনভারটাও গতকাল থেকে কাজ করছে না। সব মিলিয়ে ভুতের গল্প শোনার পক্ষে এক আদর্শ পরিবেশ। সায়নের বাবা স্থানীয় ইলেকট্রিক অফিসে ফোন করে জেনেছেন, লোকাল কি একটা ফল্ট হওয়ায় আজ সারারাতে আলো আসার সম্ভাবনা নেই।

প্রতিবারের মতো আজও রাতে সায়নের শোবার ব্যবস্থা হলো তাঁর ঘরেই গোলাপী দাদুর সঙ্গে। রাতে খেতে বসে গোলাপীদাদু বলেছিলেন, আগামীকাল তিনি আবার তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যাবেন। কিন্তু আজ রাতটা তো তিনি সায়নের কাছে থাকছেন!

রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে গোলাপী দাদু যখন বিছানায় এলেন, সায়ন সঙ্গে সঙ্গে জেদ ধরলো, “আমাকে কিন্তু আজ গল্প বলতে হবে দাদু। ভুতের গল্প! আজ বাইরে যা ওয়েদার, তাতে ভুতের গল্প দারুন জমবে কিন্ত!”

“গল্প শুনবি!” দাদু নাকে নস্যির কৌটা থেকে দু আঙ্গুলে নস্যি দিয়ে টেনে পাঞ্জাবির পকেটের ভিতর থেকে রুমালটা বের করে নাক মুছে বললেন, “ভুতের গল্প তো আমার একটাই মাত্র স্টকে আছে! সেটা তোকে বলিনি। কিছুটা নিজের লজ্জাতেই কখনও বলিনি। ঠিক আছে, আজ সেই ভুতের গল্পটাই বলছি তবে!”

ঘরের মোমবাতিটা এক ফুঁএ নিবিয়ে ঘর অন্ধকার করে সায়নের পাশে শুয়ে দাদু শুরু করলেন তাঁর গল্প।

“আমার মিলিটারি চাকরির প্রথম জীবনের কথা। তখন আমার সবে মাত্র পোস্টিং হয়েছে পূর্ব সিকিমের চিন বর্ডার নাথুলাতে। সেখানে আবার বিভৎস ঠান্ডা। বছরের প্রায় সব সময়ই সেখানে বরফ পড়ে। খুব কস্ট করেই আমাদের সৈনিকদের সীমান্ত পাহারা দিতে হতো। এমনিতেই ভারত চিন সীমান্ত খুব সেনসিটিভ। তাই আমাদের পাহারাও হতো খুবই সতর্কভাবে। কিন্তু একটু অসতর্ক হওয়ার জন্য আমি সেখানে ভুতের হাতে থাপ্পড় খেয়েছিলাম, বুঝলি তো!”

দাদু একটু থামলেন। বাইরে তখনও টানা এক নাগাড়ে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। সায়নের মনে হলো, ভুতের গল্প বলতে গিয়ে দাদু প্রথমেই কেন এধরনের কথা বলছেন! সে জিজ্ঞাসা করলো, “ভুতের হাতে থাপ্পড়! কেন? ভুত কি তোমাদের সেনা বাহিনীর কমান্ডার না কি!”

“আরে না! তার চেয়েও বেশি। খোদ সেনা বাহিনীর কমান্ডার থেকে বড় বড় অফিসাররা পর্যন্ত এখনও নাথুলা যাওয়ার আগে  এক প্রাক্তন সৈনিককে শ্রদ্ধা জানিয়ে যান! এমনই তাঁর প্রভাব! সেই সৈনিক আর কেউ নন, এক শিখ। তাঁর নাম বাবা হরভজন সিং। তাঁর কথা এখানে পোস্টিং নিয়ে এসেই শুনেছিলাম। কিন্তু খুব একটা গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু যেদিন ওই ঘটনা ঘটলো, তারপর থেকে আমিও বাবা হরভজন সিংকে মানতে লাগলাম। সেনা বাহিনীর সৈনিক হয়ে পাহারায় সামান্য গাফিলতির জন্য থাপ্পড় খেতে হবে, তাও ভুতের হাতে, সেটা আগে কখনও ধারনাই করতে পারিনি। আমি ভুতে অবিশ্বাস করতাম। ওই ঘটনার পরে ভুতে আমার বিশ্বাস হয়ে গেলো।”

বৃষ্টির রাতে ভুতের গল্পটা যেন ঠিক জমছে না বলেই সায়নের মনে হলো! সে গোলাপী দাদুকে ফের জিজ্ঞাসা করলো, “ঠিক কি ঘটেছিল সেখানে? কেনই বা তুমি ভুতের হাতে থাপ্পড় খেলে?”

দাদু এবার রহস্য মিশিয়ে গলাটা গম্ভীর করে বলতে শুরু করলেন, “আসলে হয়েছে কি জানিস, এমনিতে সেরাতে বেশ ভালো রকমের বরফ পড়ছিল। টানা দুরাত ডিউটি করতে করতে আমার দুচোখ কখন যেন একটু লেগে এসেছিল। হঠাৎ চমক ফিরলো, প্রচন্ড এক আঘাতে। আমার ডান গালে কে যেন এক জবরদস্ত থাপ্পড় কষিয়েছে! চোখ খুলে আশেপাশে কাউকে দেখতে পেলাম না! আমার মুখ দিয়ে বাংলাতেই বেরিয়ে এলো, ‘কে!’

যেন আকাশ থেকে আওয়াজ এলো, তবে ভাষাটা হিন্দিতে। গমগমিয়ে বলে উঠলো, ‘আমি হরভজন সিং। এখানে ডিউটি করতে এসে ঘুমোতে লজ্জা করছে না! ঠিক মতো পাহারার কাজ করো!’  আওয়াজটা এমন ছিল, ঠিক যেন কোন সেনা অফিসার তাঁর অধস্তন কর্মীকে হুকুমে করছেন, এরকমই!

আশেপাশে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেলাম না! দূরে দেখলাম, আমার অন্য এক সহকর্মী সজাগভাবে পাহারা দিচ্ছেন! আমি কি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম নাকি! তবে ডানদিকের গালে যে ধরনের জ্বলুনি হচ্ছে, ঘুমের মধ্যে তো এটা হতে পারে না! ব্যপারটা তখনকার মতো রহস্যই থেকে গেলো!

আমি ক্যাম্পে ফিরে আসার পরে অন্য সহকর্মীদের ব্যাপারটা জিজ্ঞাসা করলাম। তাঁরা আমাকে যা জানালেন, তাতে আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো! আমাকে একজন বললো, ‘এই সীমান্তে পাহারা দেওয়ার সময় নিখোঁজ হয়ে যান জওয়ান হরভাজন সিং। কিন্তু তাঁকে প্রায়ই এই এলাকায় পাহারা দিতে দেখেন জওয়ানরা। সবার পাহারা ঠিকমতো হচ্ছে কি না, সেটা ওই হরভজন সিং যেমন খেয়াল রাখেন, তেমনই আমাদের কোন জওয়ান কোন বিপদে পড়লে, তাঁকে সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দেন। নাথুলা বর্ডারে ইন্ডিয়ান জওয়ানরা তো বটেই, এমনকি চিনের বর্ডারের জওয়ানরাও এক দাড়ি চুল বিহীন পাগড়ি পড়া জওয়ানকে এখনও সাদা ঘোড়ায় চেপে বর্ডারে পাহারা দিতে দেখেন! তুমি নিশ্চই ঘুমোচ্ছিলে, তাই বাবা হরভজনের থাপ্পড় খেয়েছো! আর কখনও পাহারার সময় এমন কাজ কোরো না! সেনা বাহিনীর সবাই তাঁকে খুব মেনে চলেন!’

‘তিনি কি এখনও আছেন?’ আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম ওই জওয়ানকে। ওই জওয়ান আমাকে উত্তর দিয়েছিল, ‘কেন ছাংগু আর নাথুলার মাঝে বাবা মন্দির রয়েছে, সেটা দ্যাখোনি! ওখানেই তো ভারতীয় সেনা বাহিনী ওই বাব হরভজন সিং এর সমাধিক্ষেত্র বানিয়েছেন!”   

(সত্যি ঘটনা আবলম্বনে কাল্পনিক গল্প)

লেখকের জীবনপঞ্জী-

প্রীতম সরকারের জন্ম উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জ শহরে। বিজ্ঞানের স্নাতক। লেখালেখির শুরু ছোটবেলা থেকেই। স্কুলের শিক্ষা শেষ করে আঁকা শিখতে শান্তিনিকেতনের কলা ভবনে ভর্তি হন। কিন্তু পারিবারিক অসুবিধার কারনে সেই শিক্ষা অসমাপ্ত থেকে যায়। তার আগেই সঙ্গীতে বিশারদ ডিগ্রি লাভ। শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে ইংরাজি এবং বাংলা কাগজে কার্টুনিষ্ট হিসাবে কাজে যোগ দেন। পরে সাংবাদিকতা শুরু করেন। দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন আনন্দ বাজার পত্রিকা এবং হিন্দুস্থান টাইমস্‌ কাগজে। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সাংবাদিক। এখন নিয়মিত ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছোটগল্প, প্রবন্ধ, অনুগল্প, উপন্যাস লেখেন। মোট প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা পাঁচ। ‘মিলোহালে’, ‘জারোয়াদের জঙ্গলে’, ‘জালনোট পাচারকারীদের ক্ষপ্পড়ে’, ‘আগুন পাখির খোঁজে’ তাঁর লেখা বিখ্যাত উপন্যাস। এখন লেখালেখি ছাড়াও অবসর কাটান ছবি এঁকে, গান শুনে বা বই পড়ে।

অদৃশ্য প্রহরী ভৌতিক গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!