কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

নিঃসঙ্গ

নিঃসঙ্গ ছোটগল্প – অদিপ রায়

একটা মিষ্টি শব্দ করে অভিরূপের আইফোনটা বেজে উঠলো। ফোনে দেখাচ্ছে অপরিচিত নম্বর ,অপর প্রান্তে বক্তার গলার শব্দও অপরিচিত। কাজেই অভিরূপ নিজের পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলো যে সে কার সঙ্গে কথা বলছে। গম্ভীর গলায় উত্তর এলো :

  • আমি হেনরি বেকার বলছি সিঙ্গাপুর ব্যাংকের কর্পোরেট অফিস থেকে।
  • সুপ্রভাত, আমি অভিরূপ দাশগুপ্ত। বলুন আপনার জন্য আমি কি করতে পারি?
  • আমি জানি যে আপনি এই পদে সদ্য যোগ দিয়েছেন। তবে আপনার জানা দরকার যে আপনাদের জঘন্য সার্ভিসের জন্য আমাদের ব্যাংকিং পরিষেবা বিপন্ন। আমার পক্ষে সেটা সহ্য করা আর সম্ভব হচ্ছে না। বিশদ আলোচনার জন্য আমি আপনাকে আমাদের অফিসে আসার অনুরোধ করছি। সম্ভব হলে আগামীকাল নয় তো বড়জোর পরশু। অভিরূপ পরদিন বিকেল চারটে নাগাদ যেতে রাজি হল। প্রস্তুতির জন্য একটু সময় দরকার । অভিরূপ দাশগুপ্ত দিন সাতেক আগে বেস্ট কম্পিউটারের ভাইস প্রেসিডেন্ট সার্ভিসের দায়িত্ব নিয়ে ব্যাঙ্গালোর থেকে দিল্লিতে এসেছে আগের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে । দুদিন হল একমাত্র মেয়ে বন্দিতা ওরফে বনি স্কুলে যেতে আরম্ভ করেছে নতুন স্কুলে । স্ত্রী সেবন্তী নতুন ফ্ল্যাট, নতুন পরিবেশ নিয়ে বিপর্যস্ত। কিন্তু পৃথিবী থেমে নেই।

ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর প্রায় আঠেরোটা গ্রীষ্ম পার করে অভিরূপ আজ এই পদে এসেছে। আর গ্রীষ্মের কথা বলার কারণ সার্ভিসের কাজে সব সময় ঘাম-ছোটানো সমস্যাই থাকে, বসন্তের সুখ বড় একটা থাকে না। কিন্তু এবার অভিরূপ নতুন কোম্পানি নতুন পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়াবার সময়টুকুও বোধহয় পেল না।

অভিরূপ ওর অফিসের টেকনিক্যাল ম্যানেজার মনোজিত কে নিজের ঘরে ডেকে পাঠালো। মনজিতের সঙ্গে বালাচন্দ্রনও ঘরে ঢুকলো। বালাচন্দ্রন স্পেশালিস্ট। ওদের সঙ্গে আলোচনা করে যা জানা গেল তাতে অভিরূপের চিন্তা আরও বেড়ে গেল। সিঙ্গাপুর ব্যাংক ওদের চার পাঁচটা বড় কাস্টমারের অন্যতম। আর ওদের ব্যাংকিং পরিষেবার প্রধান হলো হেনরি বেকার। উনি ভীষণ কড়া প্রকৃতির লোক। তাই ওনার অফিসের এবং বেস্ট কম্পিউটারের সবাই ওনাকে এড়িয়ে চলে। তবে ওনার দক্ষতার জন্য উনি ব্যাংকের বোর্ডের খুব প্রিয় পাত্র। সিঙ্গাপুর ব্যাংকের সঙ্গে বেস্টের এগ্রিমেন্ট খুবই একপেশে । সেই মতো বেস্ট কম্পিউটারকে যথেষ্ট জরিমানা দিতে হতে পারে ঠিকমতো সার্ভিস না দেওয়ার জন্য। অভিরূপ সব ফাইলপত্র বাড়ি নিয়ে যাবে ঠিক করল; পড়ে দেখার জন্য।

রাতে বাড়িতে ফাইল পড়তে গিয়ে অভিরূপের মাথা খারাপ হয়ে যাবার যোগার। এগ্রিমেন্ট এর শর্ত অনুযায়ী বেস্ট কম্পিউটারকে প্রায় বিনামূল্যে সার্ভিস দিয়ে যেতে হবে। চিন্তা মাথায় নিয়েই অভিরূপ খেতে বসল ।

খাবার টেবিলে সেবন্তী প্রথম কথা বলার সুযোগ পেল। কারণ তার আগে অভিরূপ কাগজপত্র নিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিল। – “তোমার নতুন কাজে মনে হচ্ছে বেশ সমস্যা দেখা দিয়েছে?”

মুখে এ কথা বললেও সেবন্তি মনে মনে জানে যে অভিরূপ সমস্যার মধ্যে থাকতেই ভালোবাসে। সমস্যার সমাধানেই অভিষেক কাজ করার আনন্দ খুঁজে পায়।

“হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। কবিতার ভাষায় বলতে গেলে। আগুনের মধ্যে দিয়ে অভিষেক হচ্ছে আমার বেস্ট কম্পিউটারে।“

অভিরূপ খেতে খেতেই সংক্ষেপে সেবন্তীকে সব ঘটনা বলে গেল।। সব শোনার পরে সেবন্তীকে একটু চিন্তিত লাগলো। সে খাওয়া থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি তোমার বসকে সব জানিয়েছ?”

“একদমই নয়। আমার সমস্যা আমাকেই সামলাতে হবে। আর হেনরি যখন আমাকে ফোনটা করেছে তার মানে ও আমাকে টপকাতে চায় না।“

অভিরূপের প্রায় খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে গেছিল, সে উঠে দাঁড়ালো। “দেখাই যাক, আমি কি করতে পারি।“

কিছু পরে অভিরূপ বিছানায় শোয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু সেবন্তীর চোখে ঘুম আসছিল না। ব্যাঙ্গালোর থেকে দিল্লীতে আসার পর সেবন্তী খুব খুশি ছিল। ফ্ল্যাটটা মন্দ নয় আর মেয়েও মোটামুটি ভালো স্কুলে চান্স পেয়েছে। তবে অভিরূপের কাজের শুরুতেই এই সমস্যা, ওকে একটু ভাবিয়ে তুললো। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে টেরও পেল না।

পরদিন অফিসে পৌঁছেই অভিরূপ নিজের ঘরে না গিয়ে মনজিত আর বালাচন্দ্রনের ঘরে ঢুকলো। সকাল ন’টা বেজেছে বালা এসে গিয়েছে, কিন্তু মনজিত তখনো এসে হাজির হয়নি। বেস্ট কম্পিউটারের যোগ দেবার পর সার্ভিস বিভাগের বেশ কিছু লোকের সঙ্গে কথা বলে অভিরূপের ধারণা হয়েছে যে সবাই মোটামুটি ভাবে দায়িত্ববান। তবে কাজ ঠিক ভাবে ভাগ করা হয়নি। তাই বেশিরভাগই লক্ষ্যহীন ভাবে কাজ করে যায়। যে কাজটা একজন করতে পারে সেখানে দুই বা কি তিনজন থাকলে শুধু যে কাজের সময় বেশি লাগে তা নয় প্রত্যেকেই ভাবে দায়িত্বটা তার নয় অন্য লোকের। এরা জানে যে ক্রেতাকে খুশি রাখতে হবে। তবে জানেনা যে সেটা করতে হবে নিজের কোম্পানির স্বার্থের কথা মাথায় রেখে।

আজকাল প্রতিটা ব্যবসা সাংঘাতিক প্রতিযোগিতামূলক। সেই কোম্পানিই টিকে থাকবে যে ক্রেতাকে খুশি রাখার সঙ্গে নিজের লাভের অংক বজায় রাখবে । অভিরূপকে এদের চিন্তার আমূল পরিবর্তন করতেই হবে। তবে আপাততঃ শুধু সিঙ্গাপুর ব্যাংকের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করাই ভালো।

  • তুমি কি জানো কি কি কারণে সিঙ্গাপুর ব্যাংকের লোকজন আমাদের ওপর অসন্তুষ্ট?

প্রশ্নটা করে ও বালার মুখের দিকে তাকাল। এই অফিসে কোনদিনও ভাইস প্রেসিডেন্ট বালা বা মনজিতের ঘরে পদার্পণ করেনি। ওদের সব সময় নিজের ঘরেই ডেকে পাঠাতে। তাই আজ বালা কি করবে না বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়ালো।

  • আমি পুরোটা জানিনা। তবে গত মাসে ওদের কম্পিউটারের পাওয়ার সাপ্লাই খারাপ হওয়ায় কম্পিউটার সারাতে একটু সময় লেগেছিল।

ইতিমধ্যে মনজিত ঘরে ঢুকেছে। বালার মত সেও অভিরূপকে ওদের ঘরে দেখে অবাক। তবে খুব সহজেই কি নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে বুঝতে পারল।

  • আমিও যতদূর জানি হালে ওই কম্পিউটারের পাওয়ার সাপ্লাই ছাড়া আর কোন প্রবলেম হয়নি।

অভিরূপ খুব সহজেই বুঝতে পারল যে তার অফিসে বিশেষ কোন তথ্য নেই। তোমরা এখনি আমাদের প্রথম কুড়ি পঁচিশটা কাস্টমারের নামের তালিকা বানিয়ে ফেলো। সেই তালিকায় ওখানকার ম্যানেজারের নাম আর ফোন নাম্বারও চাই। এই তালিকা তৈরি করতে তোমাদের কতটা সময় লাগবে ?

কাল সকালে আমরা আপনাকে তালিকাটা দিয়ে দেব। অভিরূপ একটু হেসে দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল।

  • তোমরা একেকজনে দশটা করে নামের তালিকা বানাও। আর আমার তালিকাটা আজই সকাল বারোটার মধ্যে চাই। যদি দু-একটা কম থাকে তাও চলবে। তবে সময় ওই বারোটা।

এদের একটু ঝাঁকুনি দেয়া প্রয়োজন । অভিরূপ ঘরে ফিরে এসে আবার সিঙ্গাপুর ব্যাংকের কাগজপত্র দেখতে আরম্ভ করল। পুরো প্রস্তুতি নিয়ে ও মিটিং করতে বিশ্বাসী ।

দিল্লির এক অভিজাত অফিস কমপ্লেক্সে সিঙ্গাপুর ব্যাংকের অফিস। অভিরূপ সেখানে সময় মতই পৌঁছালো। হেনরির সেক্রেটারি ওকে রিশেপসন থেকে হেনরির ঘরে নিয়ে গেল। হেনরি উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দন করে,ওর ঘরে রাখা সোফায় বসতে অনুরোধ করলো।

  • খুব দুঃখিত তোমার সঙ্গে প্রথম আলাপ শুরু হচ্ছে অভিযোগ দিয়ে।

অভিরূপ মৃদু হেসে বলল “কারণটা যাই হোক তোমার সঙ্গে আলাপ হওয়াটা সৌভাগ্যের । আমি ব্যক্তিগতভাবে যে কাস্টমার অভিযোগ করে তাদের শ্রদ্ধাই করি। কারণ তারা আমাকে শুধু শোধরাবার নয় ভালো করারও সুযোগ দিচ্ছে। তুমি ইচ্ছে করলেই অন্য কম্পিউটার কিনতে পার ।“

এরপর হেনরি যা বলে গেল তার মর্মার্থ হল যে সিঙ্গাপুর ব্যাংক অনেক আশা নিয়ে বেস্ট কম্পিউটারকে এতদিন সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু আর সেটা সম্ভব হচ্ছে না। আগামী এক মাসের মধ্যে অবস্থার পরিবর্তন না হলে,ওরা বাধ্য হবে অন্য কোম্পানির কম্পিউটার অর্ডার করতে। প্রায় প্রতি মাসেই বেস্ট কম্পিউটারের ব্যর্থতার জন্য ব্যাংকের কাজ ব্যহত হচ্ছে।

সামনের দামি কাপে রাখা দার্জিলিংয়ের চা আর মুখে দেবার প্রবৃত্তি হচ্ছিল না অভিরূপের। হেনরির গম্ভীর চোখমুখের চেহারা বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে আর কথা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই। অগত্যা ধন্যবাদ দিয়ে নিজের অফিসে ফিরে এলো অভিরূপ।

অফিস ফিরতে প্রায় ছ’টা বাজলো। আর পাঁচটায় অফিস ছুটি হওয়াতে বিশেষ কেউ ছিল না। অভিরূপ দেখল ওর টেবিলের উপরে একটা ছোট্ট চিরকুট। তাতে লেখা

“দেখা করতে এসেছিলাম। সময় পেলে একটা ফোন করো।“ সুষমা

সুষমা ধাওয়ান বেস্ট কম্পিউটারের ভাইস প্রেসিডেন্ট সেলস। একে সুন্দরী তার ওপর এগ্রেসিভ বলে কোম্পানিতে পরিচিত। অভিরূপ একবারেই ওকে ফোনে পেয়ে গেল।

  • সুষমা তোমার সঙ্গে দেখা না হওয়ার জন্য দুঃখিত। বলো আমি কি করতে পারি তোমার জন্য?
  • “তোমার হেনরির সঙ্গে কেমন কথাবার্তা হল ?” অভিরূপ বুঝলো তার সঙ্গে হেনরির কথাবার্তার খবর অফিসে চাউর হয়ে গেছে। তবে ও নিজের থেকে কাঁদুনে গাইতে রাজি নয়। ও জানে কর্পোরেট জগতে তুমি একদম বন্ধুহীন একা। তোমার যুদ্ধ তোমাকে একলাই লড়তে হবে। তবে এক্ষেত্রে মিথ্যাও বলা যাবে না।
  • হেনরি আরো ভালো সার্ভিসের প্রত্যাশাটা জানিয়ে দিয়েছে আমাকে।

সুষমা খবর পেয়েছে যে ওদের এক প্রতিযোগী কোম্পানি কম দামে আরও বেশি শক্তিশালী কম্পিউটার সিঙ্গাপুর ব্যাংককে দিতে চাইছে। আর স্বাভাবিক কারণেই সুষমা সেটা হতে দিতে চায় না। বিশেষতঃ সেটা যদি খারাপ সার্ভিসের জন্য হয়।

এই সাঁড়াশি আক্রমণ বোধহয় অভিরূপের একেবারে অপ্রত্যাশিত নয়। কর্পোরেট জগতে সাধারণতঃ এইরকমই হয়। পুরানোরা নতুনদের সহজে মেনে নিতে চায় না । নতুনদের নিজের জায়গা যুদ্ধ করে তৈরি করে নিতে হবে । মহাভারতের ভাষায় – বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী ।

মনের চিন্তা মুখে আসতে না দিয়ে বাড়ি ফিরেই অভিরূপ সেবন্তীর মুখোমুখি হল।

  • কেমন হলো তোমার মিটিং?
  • মোটামুটি হয়েছে এখন এক কাপ গরম চা খাওয়াও । তোমাদের কি খবর ?

দুজনে একসঙ্গে বসে চা খেতে খেতে সেবন্তী জানালো যে অংকের ক্লাস টেস্টে মেয়ে বনি সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে। অভিরূপের মনে হলো অফিসের আপাত অশান্তি বাদ দিলে বাকি জীবনটা মন্দ নয়। বিশেষ করে ওর পারিবারিক জীবন। আর সেটা পাথেয় করেই তাকে বহির্জগতের লড়াই জেতার শক্তি পেতে হবে। কিছু পরে নৈশ ভোজে যোগ দিল তিন জনের ছোট পরিবার।

এর পরের তিন চার দিনের ঘটনা খুব দ্রুত কেটে গেল। সিঙ্গাপুর ব্যাংকের গত দু-তিন মাসের সবকিছু খতিয়ে দেখতে গিয় অভিরূপের একটা ব্যাপারে একটু খটকা লাগলো। গত তিন মাসের মধ্যে। তিন চারবার কম্পিউটারের পাওয়ার সাপ্লাই ইউনিট বিকল হয়েছে। এটা খুবই অস্বাভাবিক ঘটনা। ও মনোজিতকে ডেকে ঐখানকার পাওয়ার এনালাইজার টেস্ট করার পরামর্শ দিল। পুরো ২৪ ঘণ্টা ধরে টেস্ট করার পরে রিপোর্ট দেখে অভিরূপের মুখে স্বস্তির ছাপ ফিরে এলো। যা ভাবা যাচ্ছিল ঠিক তাই। ব্যাংকের ইউপিএস এর গলদ স্পষ্ট। আর সেই কারণেই তাদের কম্পিউটার বারবার বিকল হয়েছে। এটা সিংগাপুর ব্যাংকের দায়িত্ব ।

এর মধ্যেই একদিন প্রেসিডেন্ট চন্দ্রশেখরের ফোন।

  • অভিরূপ আশা করছি সব ঠিকমতো চলছে ?

অভিরূপ সংক্ষেপে হেনরির ফোন কল আর তারপরের ঘটনা জানালো।

  • ঠিক আছে, যদি দরকার হয় আমাকে ফোন কোরো। তোমার ওপর আমার ভরসা আছে। শেষের পাঁচটি শব্দে যেন কোন জাদু ছিল। অভিরূপ আর সাঁড়াশী আক্রমণের ভীত নয়। ওর নিজের উপর আস্থা সহস্র গুন বেড়ে গেল।

পরের ঘটনা যে কোন নাট্যকারেরও কল্পনার বাইরে। অভিরূপ আবার হেনরির সঙ্গে দেখা করলো। আর এনালাইজার রিপোর্টের কথা সবিস্তরে জানালো। রিপোর্ট দেখে হেনরির মতো রাশভারী লোকও কেমন সংকুচিত হয়ে গেল । মিটিং করতে করতে বেলা প্রায় শেষ হয়ে গেছিল।

  • আগের দিন তোমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার জন্য আমি খুব লজ্জিত। কাজের চাপে আমি মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। আমি কি এখন তোমাকে একটা ড্রিঙ্ক এর জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারি ?
  • তোমার সঙ্গ পেলে আমার ভালই লাগবে।

দিল্লির এক অভিজাত রেস্তোরায়,ওরা সামান্য কিছু খাবার আর দুজনে দুটো হুইস্কি নিয়ে বসলো।

হেনরি যেন এক শ্রোতার অপেক্ষাতেই ছিল? এক নিঃশ্বাসে অনেক কথা বলে গেল । ভারতে আসার আগে ও সিঙ্গাপুরের বেশ কিছুদিন ছিল। সেখানকার পরিবেশ পছন্দ না হওয়ায় ওর ইংরেজ স্ত্রী লিজা। বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে লন্ডনে ফেরৎ চলে যায়। আর হেনরির দুর্ভাগ্যবশত, ওদের একমাত্র ছেলে অ্যালেক্সের কাস্টোডি লিজাই পেয়ে যায়। পাঁচ বছরের অ্যালেক্স হেনরির খুব প্রিয় ছিল। তাই হেনরি এখন অ্যালেক্সকে খুবই মিস করছে।

  • ব্যাংক আমাকে একটা খুব সুন্দর ফ্লাট দিয়েছে দিল্লিতে।। কিন্তু আমার সেটায় একদম ফিরতে ইচ্ছে করে না। সেখানে আমি নিঃসঙ্গ, একা।

অভিরূপের পক্ষে হেনরির অবস্থাটা বোঝা খুবই সহজ ছিল। কথায় বলে মানুষ সামাজিক জীব। আর এই আত্মীয়-স্বজন হীন, বন্ধু-বান্ধব-হীন বিদেশে ও একদম একা । অভিরূপ বিশ্বাস করে যে পারিবারিক শান্তি না থাকলে তার ছাপ কর্মজীবনে পড়তে বাধ্য । কাজে নিষ্ঠাবান হেনরির কষ্টটা খুব সহজেই অনুভব করতে পারছিল।

  • তুমি আমাকে তোমার বন্ধু ভাবতে পারো। আমি বুঝতেই পারছি যেই বিদেশে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব-হীন অবস্থায় তুমি কতটা কষ্টে আছো।

দিল্লির এই পাঁচতারা হোটেলের রেস্টুরেন্টে বেশি লোক ছিল না। ওয়েটার এসে জানতে চাইলো। ওদের আরো কিছু লাগবে কিনা। হেনরি আরও একটা বড় হুইস্কি চাইল। যে দু-চারজন রেস্টুরেন্টে ছিল, তারা খুবই নিম্নস্বরে কথা বলছিল। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে ছিল হেনরি। অনেকটা সময় চুপ করে থাকার পর অভিরূপ প্রথম মুখ খুলল।

– বন্ধু হিসেবে আমি কি তোমাকে দু-একটা পরামর্শ দিতে পারি।

হেনরি মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিল।

  • প্রথমত তুমি কুকুর বা ওই ধরনের কিছু পুষতে পারো। যে তোমাকে নিঃশর্তে সঙ্গ দেবে। দ্বিতীয়তঃ তুমি রাজি থাকলে আমরা মাঝে মাঝে দু একটা সন্ধ্যে একসঙ্গে কাটাতে পারি। তৃতীয়ত তুমি তোমার কাজের চাপটা কমাও। তোমরা তোমাদের কম্পিউটারকে ভীষণ বেশি রকম লোড করে ফেলেছ। তাই একটু এদিক-ওদিক হলেই তোমার জন্য সেটা ভীষণ। চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ওটার ক্ষমতা বাড়ালে তোমার কাজ অনেক হালকা হবে।
  • “তোমার তিনটি প্রস্তাবই আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি একটা কুকুর পুষবো। পরের শনিবার। তোমার স্ত্রী সমেত নেমন্তন্ন রইল। আর সুষমাকে বলো আমাদের একটা নতুন শক্তিশালী কম্পিউটারের অফার পাঠাতে।“

দুজনেই ড্রিঙ্ক শেষ করে, পাঁচতারা হোটেলের বাইরে চলে এলো। দিল্লির আকাশে তখন একটি একটি করে অনেক তারা ফুটে উঠেছে। কিন্তু এক ফালি চাঁদের পাশে তার সব সময়ের প্রিয় সঙ্গী রোহিনী নক্ষত্র নেই ।

তাই এক ফালি চাঁদও এখন নিঃসঙ্গ, একা।

নিঃসঙ্গ ছোটগল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!