কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

জীবন ও আত্মা

জীবন ও আত্মা ছোটো গল্প- উত্তম চক্রবর্ত্তী

রাতের খাবার টা বেশ ভারী হয়ে গেছে। সৌমার্য উপরের ঘরে গিয়ে ফ্যানের স্পীড বাড়িয়ে শুয়ে পড়ল। স্ত্রী কুমুদিনী সব গোছগাছ করে তারপর আসবে বিছানায়। মনে হয় খুব গ্যাস হয়ে গেছে। একটু কার্মোজাইম খেয়ে নেব? না থাক। কিন্তু বুকের বাঁদিকটা একটু চিন চিন করছে। তা হোক, ঘুম ঠিক ঠাক হয়ে গেলে হজম হয়ে যাবে। তাই কুমুদিনীর অপেক্ষা না করে সে শুয়ে পড়ল। 

 ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই কুমুদিনীর নাঁকি কান্নায় সৌমার্যের ঘুম টা ভেঙে গেল। রাতের শেষ প্রহরের গভীর ঘুমটা এভাবে ভেঙে যেতে সৌমার্য বেশ বিরক্ত হল। বিয়ের দু এক বছর পর থেকেই কুমুদিনীর এ হেন আচরণের সূত্রপাত। মাঝে মধ্যেই কোন কারন অকারনে কান্না কুমুদিনী রপ্ত করে ফেলেছে। অহেতুক কান্না সে বরদাস্ত করতে না পারলেও অশান্তির ভয়ে চুপ করে থাকতে হয়। দুরতেরী ,বলে সৌমার্য সকল অলসতাকে ঝেড়ে ফেলে উঠে বসল। কুমু তার খাটের পাশে বসেই কাঁদতে বসেছে। একবার ভাবল কান্নার কারন জিজ্ঞেস করি। পর মূহুর্তে ভাবল, কি লাভ। 

সৌমার্য ব্রাশ কোলগেট নিয়ে ধীরে খাট থেকে নেমে এল। বারান্দায় এসে পায়ে জুতো গলাতে গিয়ে মনে পড়ল, আশ্বিন মাসে ভোরে শিশির পড়ে।খালি পায়ে ভোরে ঘাসের উপর হাটতে ভাল লাগে। এতে চোখের সমস্যা কমে, শরীর স্বাস্থ্যও ভালো থাকে ।না জুতোটা না গলিয়েই বেরিয়ে পড়ল। 

রাস্তায় নেমেই পায়ে পায়ে কাঁসাইয়ের দিকে এগিয়ে চলল। বাঃ, ব্রাহ্ম মুহূর্তের বাতাসের নির্মলতা, ভোরে ফোটা ফুলের গন্ধ তাকে মোহিত করে তুলল। গাঁয়ের বেশ কয়েকটা ছেলে কাঁসাইয়ের দিক থেকে ছুটে আসছে। ওটা ওদের মিলিটারি পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি। সৌমার্য হাসল। দেশে এখন চাকরী বাকরীর যা অবস্থা ,এই সব ছেলেদের দেখলে মায়া হয়। স্কুলে এরা কত ভালো রেজাল্ট করতো। সবারই স্বপ্ন ছিল, ভালো চাকরী পাবে। অথচ বর্তমানে বড়ো রকমের ঘুষ না দিলে চাকরী হয় না। তাই অগত্যা মিলিটারি পরীক্ষা ছাড়া গতি নেই। ছেলে গুলোকে দেখলে সৌমার্যের মায়া হয়। কি আর করা যাবে। এ যুগে চাকরীর গতি ভালো নয়। 

সামনে দিয়ে পেরিয়ে গেল মধু মাস্টারের ছোট ছেলে। বেশ সুঠাম শরীর। পড়াশোনায় খুব মেধাবী। তা হলে কি হবে। প্রাইমারী শিক্ষক মধুবাবুর না আছে টাকা, না আছে লোকবল। তাই ছেলে বেকার।ভোরে শরীর চর্চা করে। যদি মিলিটারি তে সুযোগ পাওয়া যায়, তার আশায়

এই আর কি। 

সৌমার্য তার নাম ধরে ডাকল। কোন উত্তর না দিয়ে ওকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। সৌমার্য মনে মনে হাসল। এই হয়েছে এখনকার ছেলে পুলে। কাউকে পাত্তা দেয় না, দোষ দেওয়াও যায় না। 

 সৌমার্য কংসাবতীর পাড়ে এসে দাঁড়াল। এখন শরৎকাল। মুকুটমণিপুরের ড্যাম জলে ভরতি ,তাই কাঁসাই আবরা জলে পরিপূর্ণ। ওপারে গলাকাটা ডুংরির বন থেকে ভোরে ফোটা বুনো ফুলের গন্ধ, পাখি গুলো দল বেঁধে আকাশে উড়ে চলেছে। তাদের কিচিরমিচির আওয়াজ, গলাকাটা ডুংরির জঙ্গলে রাত্রির অন্ধকারের সখ্যতা এখনো কাটে নি, সব মিলিয়ে বেশ পরিবেশ। 

সৌমার্য অনেক ক্ষণ বসে রইলো নদীর পাড়ে। কুমুদিনীর কান্না তার মনটাকে ভোরেই খিঁচড়ে দিলেও  নদীর তীরবর্তী পরিবেশে মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে। 

কাঁসাইয়ের জলে হাত মুখ ধুয়ে সৌমার্য উঠে এল। পূবের আকাশটা লাল হয়ে উঠেছে। সকালের আলো চারদিকে ফুটে উঠেছে। একবার নদীর তীরবর্তী ধানী জমি গুলো দেখে বাড়ী ফিরবো বলে সে জমি গুলোর দিকে এগিয়ে গেল। আহা! প্রকৃতির কি রূপ! কোমর সমান উঁচু ধান গাছের উপর দোলা দিয়ে বাতাস বয়ে চলেছে। সব ক্ষেত গুলো একবার দেখা শেষ হলে সে বাড়ীর পথে পা বাড়াল। গ্রাম থেকে কাঁসাইয়ের দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। পথ চলতে চলতে সে দেখল তার গ্রাম থেকে কারা যেন খাটিয়ায় করে শব নিয়ে কাঁসাইয়ের শ্মশানের দিকে আসছে। সাথে তার জ্ঞাতি ভাই -ভায়াদরাও রয়েছে। 

সৌমার্য এগিয়ে গিয়ে তাদের জিজ্ঞেস করলো, কে মারা গেলো রে ?

শ্মশান যাত্রীরা তার কথার উত্তর দিল না ।তারা নিজের খেয়ালে বলতে বলতে চলল, — “বল হরি, হরিবোল। “

গ্রামের সব ছেলেরা ও মাঝবয়সীরা রয়েছে তাদের দলে। সৌমার্য ভাবল নিশ্চয় তারও শ্মশান যাত্রীদের সাথে যাওয়া দরকার।বাড়ী গিয়েই করবে কি? সেই তো কুমুদিনীর কান্না। তার চেয়ে  সময় পেরিয়ে গেলে  হয়তো কুমুদিনী একটু শান্ত হবে। কতক্ষণ আর কাঁদবে? সৌমার্য শ্মশান যাত্রীদের সাথে কাঁসাইয়ের শ্মশানের দিকে এগিয়ে চলল। 

মৃত দেহ নামিয়ে চুলা তৈরী হলে মৃত দেহ শ ‘য়ে যেই না চাপাল,সৌমার্য থমকে গেল। এতো আমি! আমি তো এখনো জীবিত, ওরা আমাকে পুড়িয়ে মারবে কেন? জনে জনে বলতে লাগল, তোমরা আমাকে পুড়িয়ে ফেলছো কেন? আমি তো দিব্যি বেঁচে আছি। সৌমার্যের কথা কেউ কানে না তুললে, সে বাড়ীর দিকে তার কুমুদিনীর কাছে ছুটতে লাগল। বাড়ীতে এসে দেখল, বাড়ীতে পাড়ার সব মেয়েরা কুমুদিনী কে ঘিরে রেখেছে আর কুমুদিনী তখনো কেঁদে চলেছে, —

“ওগো তুমি কোথায় গেলে গো, তোমাকে ছাড়া বাঁচবো কি করে ?”

সৌমার্য মেয়েদের কাটিয়ে কুমুদিনীর পাশে বসল। আহা! আলুথালু কুমুদিনী কে দেখে তার মন টা মুচড়ে উঠল। ক্রন্দনরত কুমুদিনীর মুখটা তুলে সৌমার্য বলল, কুমুদিনী কাঁদছো কেন, দেখো, এই তো আমি, তোমার পাশেই আছি।

জীবন ও আত্মা ছোটো গল্প- সমাপ্তি

যে কেউ তাদের লেখা জমা দিতে চান। অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা জমা দিন পৃষ্ঠায় জমা দিন| এবং যারা লেখা জমা দিচ্ছেন। পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!