কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » প্রবন্ধ » জামদানীর জন্মকথা

জামদানীর জন্মকথা

জামদানীর জন্মকথা প্রবন্ধ -পিয়াংকী

হাজার পান্না,তেরছা, ডুরিয়া,শামুকবুটি, কলসফুল শাপলাপাড়,ছিডা,বিলাইআড়াকুল,কলারফানা,
চন্দ্রহার, আঁশফুল চালতাপাড় ইঞ্চিপাড় আমকলকা কলারফানা সাবুদানা ইত্যাদি ইত্যাদি। কথা বলছি নকশা নিয়ে। আঁচলে নকশা, পাড়ে নকশা অথবা জমিতে নকশা। আদতে এক খন্ড বাংলা জুড়ে ঐতিহ্যের নকশা। জামদানী। এক ব্যাতিক্রমী ইতিহাস। বটবৃক্ষের শিকড় ডুবে আছে সমুদ্রের ভিতর, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ব-দ্বীপ জুড়ে।
জামদানীর কথা উঠলে সবার আগে উঠে আসে বয়নশিল্পের কথা। সুতিবস্ত্র অর্থাৎ মসলিনের নাম।কার্পাসতুলার সুতো দিয়ে তৈরি একধরণের সূক্ষ্মবস্ত্র হল মসলিন আর সেই মসলিনের ওপর বিভিন্ন আঙ্গিকের কারুকাজ নকশা দিয়ে ভরাট হবার পর তা হয়ে দাঁড়ায় জামদানী। প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত মসলিন আর জামদানী হল বাঙালির গর্ব। বর্তমানে জামদানী বললে আমরা শুধু শাড়িকেই বুঝে থাকি কিন্তু ইতিহাস বলে জামদানী আসলে একটি বিখ্যাত নকশাপদ্ধতি  ছাড়া কিচ্ছু নয়। সুপ্রাচীন কাল থেকে আজ অবধি ধারাবাহিক উপন্যাসের মতো  জীবন্ত সাংস্কৃতিক এই নিদর্শনকে মান্যতা দিয়ে ইউনেস্কো জামদানিকে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউম্যানিটি’ ঘোষণা করেছে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত কবিতা বাঁশিতে লিখেছেন;

এগান যেখানে সত্য
অনন্ত গোধূলি লগ্নে
সেইখানে
বহি চলে ধলেশ্বরী,
তীরে তমালের ঘনছায়া—
আঙ্গিনাতে
যে আছে অপেক্ষা করে, তার
পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।
…কবির এই কবিতায় ঢাকাই দিয়ে বাংলা মায়ের মুখ যেভাবে আঁকা হয়েছে সেটাই বুঝিয়ে দেয় কীইই অসাধারণ ব্যক্তিত্ব নিয়ে বিরাজ করত এই শাড়িশিল্প। ভাবতে অবাক লাগে জামদানীর এই বুনট পদ্ধতি পৃথিবীর অন্য কোনো শিল্পীর পক্ষে তো সম্ভব নয় ই এমনকি ঢাকার নির্দিষ্ট কিছু বিশেষ সম্প্রদায়ের তাঁতী ছাড়া অসম্ভব এই বয়ন।হয়ত এই কারণগুলোর জন্যই আন্তর্জাতিক মান পেয়েছে এই শাড়ি। ইংল্যান্ডের ভিক্টোরিয়া এন্ড অ্যালবার্ট মিউসিয়ামে সাদা মসলিনের ওপর সাদা সুতো দিয়ে তৈরি করা জামদানী সযত্নে রক্ষিত আছে। সম্রাট জাহাঙ্গীর ‘দারোগা ই মলমল’ নামের বিশেষ একপ্রকার পদাধিকারী নিযুক্ত করেছিলেন প্রাচীন বাংলায় যার কাজ ছিল শুধুমাত্র এই বয়নশিল্প সংক্রান্ত হিসেব নিকেশ রাখা এবং সমগ্র শিল্পের  দেখভাল করা

জামদানী শব্দটির উৎপত্তি ঘাঁটলে জানা যায় এটি একটি ফারসি শব্দ। জামা অর্থে কাপড় আর দানা অর্থে বুটি অর্থাৎ বুটিযুক্ত কাপড়। আবার কারোর মতে এটি মূলত ফরাসী শব্দ যাতে জাম অর্থে পারস্যের এক বিখ্যাত  সুরা রাখার পাত্র এবং দানী অর্থ বাটি বা পেয়ালা। মত যাই হোক না কেন খুব সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায় জামদানী হল মসলিনের ওপর তাঁতীর শিল্পজ্ঞান শিল্পীচোখ।


১৭০০ খ্রীস্টাব্দে জামদানীর কুর্তা শেরওয়ানি  এমনকি ওড়না পাগড়ি পর্দা রুমাল সেমিজ ঘাগড়ারও চিহ্ন পাওয়া যায়। মোঘল আমলের শেষদিকে নেপালের আঞ্চলিক পোশাক রাঙ্গা-র জন্য বিশেষ ধরণের জামদানী কাপড় তৈরি হত বলেও কিছু গবেষক মনে করেন

কিভাবে এই জামদানী বাংলার হল,  কিভাবে কোন জোরে সারা পৃথিবীকে টেক্কা দিল সেই উৎস খুঁজতে খুঁজতে যত এগোলাম পেলাম মূলকান্ডপাতাফুলফল সম্বলিত পরিণত এক বৃক্ষ।  ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনার শাখানদীগুলোর সংযোগস্থল পৃথিবীর অন্যতম বদ্বীপ অববাহিকা।যা কার্পাসতুলো উৎপাদনের জন্য উর্বর এবং উপযুক্ত স্থান। ঐতিহাসিক জন টেলর ঊনবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে যেসব উচ্চমানের কার্পাস উৎপাদন স্থান উল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যে ফিরিঙ্গিবাজার বিক্রমপুর শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে রাজেন্দ্রপুর রয়েছে।এইসব অঞ্চলের দোঁয়াশ মাটি আবহাওয়ার আর্দ্রতা এবং মাটিতে লোহা ও চুনের আধিক্য বিশেষ ধরণের সুতো তৈরির সহায়ক। ঢাকার সোনারগাঁও, ধামরাই, বাজিতপুর ছিল জামদানি ও মসলিন কাপড়ের জন্য ঐতিহাসিক স্থান। শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে সোনারগাঁও অঞ্চলটিই ছিল ব্যাপক উৎপাদন কেন্দ্র। বর্তমানে বাংলাদেশে রূপগঞ্জ, সোনারগাঁও এবং সিদ্ধিরগঞ্জ-এ জামদানির কাজ হলেও সোনারগাঁওই জামদানিপল্লী হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিত রয়েছে।
জামদানীর ওপর এই যে কারুকার্য শোভিত থাকে তা কি বাংলার শিল্পীর আত্মমগ্নতা নাকি তাতে মিশে আছে পারস্য ইরান শিল্পকলা… এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে গিয়ে অনেক মতবাদ বেরিয়ে এল জাল ছিঁড়ে। যদি বলি জামদানী নকশায় মিশ্র শিল্পকলা  লক্ষ্য করা যায় , তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবে  বলতেই হয় মোঘল আমল মসলিন  (ব্যপক অর্থে  জামদানী) শিল্পের স্বর্ণযুগ। আর সেই  গাণিতিক সূত্রাবলী মেনে বলা যায় সম্রাটরা সে যুগে যেভাবে পার্সি বা ইরানি শিল্পীদের আমদানি করেছিলেন তাতে বয়নশিল্পে এদের স্বপ্রভাব থাকাই খুব প্রাসঙ্গিক। বিপরীতে জামদানীর পাড় আঁচল জুড়ে জ্যামিতিক সমতলক্ষেত্র ফুল ফল পাখি গাছ নদী ঢেউ এসব তাঁতীর চোখে দেখা একটুকরো রঙিন বাংলা। যুক্তি আর তার বিপক্ষ যুক্তি মেনে নিয়েই হয়ত
লোকগবেষক মোহম্মদ সাইদুর তার রচিত জামদানী গ্রন্থতে  জানাচ্ছেন, ‘দেশকালগত ভাবে একক কোনো প্রভাব থেকে জামদানী নকশার উদ্ভব হয় নি। বরং এতে কালে কালে এসে মিশেছে বিভিন্ন উপজাতীয় প্রভাব, হিন্দু বৌদ্ধ প্রভাব, মুসলিম প্রভাব, ব্রিটিশ প্রভাব, পাকিস্তানি ও বর্তমানের বাংলাদেশি প্রভাব। সুতরাং এটি বিভিন্ন প্রভাবের মিশ্রিত রূপ আর লৌকিক ধারানুযায়ী এসব প্রভাব মিলেমিশে একাকার হয়ে জন্ম নিয়েছে জামদানি নকশার।”

দিন যায়। সময় বাড়ে।নতুনের সংযোজন হয়,পুরানোরা বাদের খাতা করে নেয়। জামদানীর ইতিহাস ঘাঁটলে ঠিক এভাবেই কিছু আমদানি আর কিছু রপ্তানি নজর কাড়ে। সুলতানী এবং মোঘল প্রভাব বাদ দিলে নকশায় ফুটে ওঠা শিল্পীর চোখও কোনসময় সাদা সহজ ছেড়ে রকমারি জটিল রঙিন দুনিয়ায় প্রবেশ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় হাবিবুর রহমান তাঁর রচিত গ্রন্থে খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন, উচ্চমানের নকশাধরণ যেমন মাছিবুটি জালবুটি আশরাফিবুটি এসব সাদা মসলিনের ওপর সাদা সুতো দিয়েই বোনা হত যা কিনা ঊনিশ শতকের গোড়া থেকে ধীরে ধীরে রঙিন প্রজাপতির মতো জমকালো পোশাক পরতে শুরু করে  এবং তিনি আরও বলেছেন এই যুগান্তকারী পদক্ষেপের মূলে যিনি তিনি ঢাকার নবাব স্যার সালিমুল্লাহ। আজ থেকে দেড়শ বছর আগে রঙিন  জামদানী ছিলই না ঢাকার কোনো বয়নগ্রামে। নবাবই প্রথম এই কাজে হাত লাগান  জীবনের শেষ কিছু বছর একজন জামদানীলোকশিল্পী হিসেবেই চিহ্নিত করে গেছেন নিজের নাম

জামদানী বললেই এই যে ঢাকাই জামদানী শব্দজোড়া আপনাআপনিই চলে আসে এর মূল কারণ গঙ্গা বঙ্গোপসাগরের মধ্যে বিস্তৃত বাংলাদেশের ঢাকা অঞ্চল। সর্বোৎকৃষ্ট উৎপাদন এখানেই হয় আর তার থেকে বড় কথা হল যে নকশার জন্য এই লোকশিল্প পৃথিবী বিখ্যাত সেসমস্ত শিল্পীরা একদা এই অঞ্চলেই বাস করতেন।এমনকি আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে যে, শিল্পীদের বুড়ো আঙুল কেটে ফেলা হত যাতে তারা পরবর্তীতে আর এই কাজ করতে না পারেন। কথিত আছে মেয়েদের এই বুনটপদ্ধতি শেখানো হত না যাতে তারা বিবাহের পর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে অন্য কোনো বংশে ফাঁস না করে দিতে পারেন এই জটিল কঠিন কলাকৌশল। 
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র  আনুমানিক ৩০০ খ্রীস্টাব্দের, সেই  বইতে বঙ্গ এবং পুন্ড্র অঞ্চলের মিহিসুতিকাপড়ের বর্ণনা পাওয়া যায়। চর্যাগীতির বিভিন্ন পদে এমনকি ইবন বতুতা থেকে শুরু করে প্লিনি হয়ে মার্কোপোলো… কে নেই এই তালিকায় যিনি প্রাচীনতম এই সুতিবস্ত্র এবং তার সাথে জড়িত নকশার কথা তাদের ভ্রমণকাহিনি স্মৃতিকথা অথবা তথ্যসূত্র সমৃদ্ধ ইতিহাসে উল্লেখ করেননি।
১৭৪৭ সালের হিসেব অনুযায়ী পাঁচ লক্ষ টাকার মসলিন কেনা হয়েছিল দিল্লির বাদশা আর বাংলার নবাব ও জগৎ শেঠের জন্য,ইউরোপীয়ানরা কিনেছিলেন সেই সময়কার আর্থিক বাজারে নয় লক্ষ টাকার মসলিন। অথচ সেই গৌরবান্বিত ইতিহাসে ভাটা পড়ে যায় ১৭৬৫ সালে ইংরেজ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী বাংলার শাসনভার গ্রহণ করার পরই। শিল্প বিপ্লব  থেকে শুরু করে নীলচাষ…কমতে থাকে মসলিন আর জামদানীর চাহিদা। নান্দনিক এই শিল্পকলা জামদানী এতটাই দক্ষতা নির্ভর যে তাঁতশিল্পীদের অভাবে চড়া পড়ে যায় ব্যবসায়। তবু থেমে যাননি এরা। প্রাকৃতিক পরিবেশ মুখ্যত এই কারুকাজের উৎসস্থল। চালতাপাড় হোক বা ঝুমকোলতা অথবা বেলফুল, নাম থেকেই প্রমাণিত হয় সুতি বয়নে কিভাবে গ্রামবাংলা উঠে এসেছে চিরাচরিত এই কলায়।কোনরকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া শুধুমাত্র শ্রুতি স্মৃতি আর জন্মগত প্রতিভার মিশেলে কীইই আশ্চর্য সমস্ত সৃষ্টি হয়েই চলেছে এযাবৎ কাল অবধি। ডানদিকে বসা প্রধান শিল্পী এবং বাঁদিকের একজন সহযোগীর প্রচেষ্টার ফল জামদানী। সমকোণী ত্রিভুজ হয়ে সমান্তরাল চতুর্ভুজ, শিল্পীর আঙুলের ডগায় বাঁধা থাকে কিছু লোককথার ছড়া

হইরে বাড়ে / গ্যাডে বাড়ে / গ্যাডের খেও বাধে গ্যাডে / গ্যাডের খেও বোধে প্যাচে / প্যাডে বাড়ে…

… সহকারী শিক্ষানবিশ তার শিক্ষকের কাছ থেকে বংশপরম্পরায় গোপনীয় এইসমস্ত কৌশল শিখেই বুনে চলেছেন “জামদানী যেন তাঁতে লেখা কবিতা”  

জামদানীর জন্মকথা প্রবন্ধ – সমাপ্তি

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!