কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » পুজো সংখ্যা ১৪২৯ » ছোটগল্প » ফর্সা বনাম কালো

ফর্সা বনাম কালো

ফর্সা বনাম কালো ছোট গল্প – উত্তম চক্রবর্তী

বাড়ির সবকটা বৌ হয়েছে ধবধবে ফর্সা। সেখানে অনুপমের বৌ কালো হবে সেটা কিছুতেই মানতে পারছিলেন না অনুপমের ঠাকুমা প্রভাবতী দেবী। চার ছেলের বৌ এনেছেন নিজে পছন্দ করে, তারপর পাঁচ নাতির বিয়ের সময় নিজে গিয়ে মেয়ের গায়ের রঙ দেখে নাত বৌদের ঘরে তুলেছেন। এখন একমাত্র মেয়ের ঘরের নাতি অনুপম বলে কিনা কালো সাদা যে কোন একটা মেয়ে হলেই চলবে, বিয়েতো একটা সামাজিক বন্ধন যেখানে স্বামী স্ত্রীর গায়ের রং না, মনের মিলটাই আসল কথা। কিন্তু অনুপমের এই যুক্তির কথায় চিঁড়ে ভেজেনি। দিদিমার স্পষ্ট কথা, গায়ের রঙ দুধে আলতা না হলে অনুপমের বৌকে তিনি কিছুতেই এই দত্ত বাড়ির বৌ মেনে নেবেন না। থাক অনুপম, তার বাবার বাড়িতেই বৌকে নিয়ে সুখে থাক।

অনুপম দেখেছে ওর মামাতো দাদাদের বৌ দিদিমা নিজে পছন্দ করে এনেছেন । কিন্তু তাদের মধ্যে দুজন ছাড়া আর তিনজন কোন কাজের না। বড় আর ছোট বৌদি ভীষণ ভালো। যেমন তাদের ব্যবহার, তেমন তাদের শিক্ষা দিক্ষা ও রুচি। অনুপম বড় বৌদি মালাকে মায়ের মত ভালোবাসে আর ছোট বৌদি রিমকিকে নিজের বড় বোনের মত। কিন্তু মেঝ বৌদি শ্যামলি, সেঝ বৌদি রঞ্জনা আর চতুর্থ বৌদি পিউকে অনুপম তেমন পছন্দ করে না। ওরা সবকটা বড়লোক বাপের বাড়ির মেয়ে। যদিও বড় বৌদির বাপের বাড়ির যা পয়সা এরা তিনজন কল্পনাও করতে পারবে না। শুধু ছোট বৌদি মানে রিমকি বৌদি সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। আর সেইজন্য তার বড় তিন জা রিমকিকে ভীষণ তাচ্ছিল্য করে, যেটা ওদের কথা বার্তায় স্পষ্ট ফুটে ওঠে। আর তার জন্য ওরা বড় জার কাছে বকাও খায়।

গিরিশ পার্কে ঠাকুরদাস চক্রবর্তী লেনে শিব মন্দিরের কাছেই দত্ত ম্যানসন প্রায় একশ বছরের পুরানো বিশাল বড় বাড়ি। শ্যামবাজারে পারিবারিক সিল্কের শাড়ী কাপড়ের ব্যবসা। বাবু নবারুণ দত্ত নাকি ছিলেন বর্ধমানের গলসির জমিদার এবং ইংরেজদের কাছ থেকে রায় বাহাদুর খেতাবও পেয়েছিলেন। তার একমাত্র ছেলে নবিন কৃষ্ণ দত্তর বিধবা স্ত্রী হলেন অনুপমের দিদিমা প্রভাবতী দেবী। শ্রীরামপুরের তখনকার জমিদার শ্রীযুক্ত মুকুন্দ লাল বসাকের মেয়ে প্রভাবতী দেবীর গায়ের রঙ যাকে বলে দুধে আলতা রঙ। এই একাশি বছর বয়সেও যেমন দেখতে সুন্দরী তেমনি প্রকাশ পাচ্ছে তার সোনার মত উজ্জ্বল গায়ের রঙ। বৌমারা শাশুড়ির গায়ের রঙের হিংসা করে তার সামনেই হাসাহাসি করে। আর বৃদ্ধা কেবল মুচকি মুচকি হাসেন। ছেলেদের বৌ আর নাত বৌরাও দিদিশাশুড়ির ধবধবে গায়ের রঙের সামনে যেন বাচ্চা।

অনুপম একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরী করে। ওর বাবা অঞ্জন নিজে একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, কাজ করেন টাটা মোটর কম্পানীতে, বসেন টাটা সেন্টারে। অনুপমের অফিস সল্ট লেকে সেক্টর ফাইভে। পদ্মপুকুরে সি আই টি রোডের উপর অঞ্জন সেনের পৈতৃক বিশাল বাড়ি। অনুপমরা এক ভাই এক বোন। অনুপমের ছোট বোন দিয়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে এম এ করছে। আর দিয়ার এক বান্ধবী পাপিয়া সরকার অনুপমের জন্য পাগল। প্রায়ই পড়ার ছলে দিয়ার সাথে সন্ধ্যা বেলা আসে পদ্মপুকুরে ওদের বাড়িতে। থাকে বেলেঘাটায়। বাবার সেখানে বড় হার্ডওয়ারের ব্যবসা। একটাই দাদা, বিয়ে হয়ে গেছে। এখন নাকি ওর সম্বন্ধ দেখা চলছে।

দিয়ারও মনে মনে ইচ্ছা ওর বান্ধবীকেই দাদা বৌ করে নিয়ে আসুক। পাপিয়ার চেহারা খুব সুন্দর। লম্বা, মাথা ভর্তি ঘন কালো কোঁকড়ানো চুল, মুখটা যেন খোঁদাই করা পাথরের প্রতীমা, এতো মিষ্টি দেখতে। কিন্তু একটাই সমস্যা হল, পাপিয়ার গায়ের রঙ কালো, বা ভালো ভাষায় বলা চলে তামাটে। পাপিয়া দিয়ার দাদাকে বেশ কয়েকবার দেখেছে ওদের বাড়িতে। এমনকি ওদের ইউনিভার্সিটির ফাংশনে দুবার দেখা হয়েছে ওদের। একদিন রাতে চূড়ান্ত বৃষ্টির সময় পাপিয়া ওদের বাড়ি আটকে গেছিল পর দিয়া দাদাকে নিয়ে ওর গাড়িতে পাপিয়াকে বেলেঘাটাতে ওদের বাড়িতে ড্রপ করে এসেছে।

অনুপম মেয়েটাকে দ্যাখে, ওর ভালো লাগে। কিন্তু কোনদিন ওকে কিছু বলবার সাহস করেনি। কী জানি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পড়া আজকালকার মেয়ে। যদি আবার কিছু মনে করে বসে বোনকে দুটো কথা শুনিয়ে দেয়। আর অনুপম জানে যে এই পরিবারে ছেলে মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার মালিক সেই একজন, ওর দিদিমা প্রভাবতী দেবী। দিদিমা নিজে ওর বাবার গায়ের রঙ দারুণ ফর্সা দেখে মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন। অনুপম মার কাছে শুনেছে শুধু মাত্র গায়ের রঙের জন্য দিদা নাকি অনেক বড় বড় ঘরের ছেলেদের সাথে আসা মার সম্বন্ধ ছেলে দেখেই পাত্র পক্ষকে না করে দিয়েছিলেন। 

কিন্তু অনুপমের বাবা অঞ্জন সেন ও ওর মা বিভাবতি দেবী সমস্যায় পড়ে গেলেন যখন এক রবিবার বিকেলে পাপিয়ার মা বাবা আর দাদা এসে হাজির হলেন অঞ্জন সেনের পদ্মপুকুরের বাড়িতে। দিয়া দুপুরে খাবার টেবিলে সবাইকে জানায় যে ওর বান্ধবী পাপিয়ার বাবা মা আসবেন মা বাবার সাথে দেখা করতে। পাপিয়াকে এই বাড়িতে বেশ কয়েকবার দেখেছেন ওঁরা। হটাত ওর বাবা মা কেন আসছেন সেটা আন্দাজ করতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলেন,’কেন, হটাত আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন মানে ?’

দিয়া বাবার প্রশ্নের উত্তরে বলে, ‘ আমি সেটা জানব কি করে ? আমাকে শুধু পাপিয়া ফোনে বলল যে ওর মা বাবা নাকি তোমাদের সাথে দেখা করতে চান। বিকালে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আসবেন। তোমরা থাকবে কিনা জিজ্ঞাসা করায় আমি শুধু বলেছি হ্যাঁ, বাবা মা আজ বাড়িতেই থাকবেন। কেন তোমাদের কি কোথাও বের হবার প্ল্যান আছে মা ?’ দিয়া চালাকি করে প্রসঙ্গ পাল্টায়। বিভাবতি বলে ওঠেন, ‘ না, আমাদের আবার কী প্ল্যান থাকবে। বাড়িতেই তো আছি। তা তুই তাহলে ঘর দোর একটু গুছিয়ে রাখিস দিয়া। ওনারা প্রথম বার আসছেন। কি জানি কি বলতে চান, দেখা যাক।’

দিয়া টেবিলের অন্যদিকে বসে একমনে খেতে থাকা দাদার দিকে তাকিয়ে একটা রহস্যময় হাসি হেসে উঠে পড়ে। মনে মনে ভাবে এবার দাদা কি করে পালায় দেখি। পাপিয়া নিশ্চয়ই ওর মাকে দাদার ব্যাপারে জানিয়েছে। আর উনি ওঁর স্বামীকে বুঝিয়ে রাজি করিয়েছেন সেটা তো বোঝাই যায়। পাপিয়া ওঁদের আসবার খবর দেবার সময় কেমন যেন লজ্জা লজ্জা ভাবে কথা বলছিল। দাঁড়াওনা একবার দেখা হোক, তোকে কেমন চিমটি কাটি দেখবি। অনুপম একবার মুখ তুলে বোনের দিকে তাকিয়ে সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নেয়। বোনের মুখে ঐরকম হাসি দেখেই বুঝে যায় ওরা একটা চক্রান্ত করছে। আজ ওকে ফাঁসিয়ে ছাড়বে মনে হচ্ছে। ভাবতে থাকে এখন বেরিয়ে যাওয়াটা ঠিক দেখাবে না।

পাপিয়ার বাবা মা নিজেদের হণ্ডা সিটি গাড়িতে অনুপমদের বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে এসে পৌঁছলেন ঠিক পাঁচটা পঁয়ত্রিশে। সাথে পাপিয়ার দাদা বৌদিও এসেছে দেখা গেল। পাপিয়ার বাবা আশুতোষ সরকার ভীষণ মজাদার মানুষ। প্রথম দেখাতেই অঞ্জন সেন ও তার স্ত্রীকে বেশ আপন করে নিলেন। এদিকে তার নিজের স্ত্রী নন্দিনী সরকার ও পুত্র বধু মুচকি মুচকি হাসছে। দিয়াকে ওঁরা বেশ ভালই চিনতেন। চা মিষ্টি খাবার পর আসল কথাটা পারলেন আশুতোষ বাবু। জানালেন তার মেয়ে পাপিয়ার বিয়ের সম্বন্ধ খুঁজছিলেন ওঁরা। হটাত জানতে পাড়েন যে অঞ্জন বাবুর ছেলেও বিবাহ যোগ্য একজন সুপাত্র। তাই ওঁদের মেয়ের সাথে অঞ্জনের বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছেন আজ।

বিভাবতি দেবী যে আগেই সন্দেহ করেননি তা নয়। এবার ওঁদের মুখ থেকে শুনে চুপ করে স্বামীর দিকে তাকালেন। পাপিয়াকে অঞ্জন সেন বেশ কয়েকবার দেখেছেন এই বাড়িতে মেয়ের সাথে আসতে যেতে। ওঁর বাবা মা দাদা বৌদি সবাই এসেছেন অনুপমের সাথে মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে শুনে উনি বলে উঠলেন, ‘তাই নাকি। বেশ তো, আগে আমার ছেলেকে আপনারা দেখুন। আমরা তো আপনার মেয়েকে অনেকবার দেখেছি। দাঁড়ান, এই দিয়া যা তো, ওপরে গিয়ে দাদাকে ডেকে আন গিয়ে।’ বলে দিয়ার দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন অঞ্জন সেন। বিভাবতি দেবী একটু হাসলেন শুধু। মনে মনে ভাবলেন পাপিয়া মেয়েটা দেখতে সুন্দর ঠিকই কিন্তু এই কালো মেয়েকে মা কি মানতে পারবেন ?    

কথায় আছে ‘জন্ম মৃত্যু বিয়ে, তিন বিধাতা নিয়ে।’ কার যে কোথায় বিয়ে হবার সেটা আমরা কেউই আগে থেকে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি না। অনুপম ওর দিদাকে বিয়ের কথা উঠলেই বলতো ‘ কালো ফর্সা একটা হলেই হোল।’  কিন্তু অনুপম এই কথাটা কখনই পাপিয়ার কথা ভেবে বলতো না। তখন হয়ত ওকে একবার দুবার দেখেছে অনুপম, কিন্তু দিদিমাকে মন থেকে বলতো কথাগুলি। আজ এই আধুনিক সভ্যতার যুগে যখন চারিদিকে বর্ণ বৈষম্যের ব্যপার নিয়ে এতো লেখালেখি এতো আন্দোলন হচ্ছে তখন দিদিমাদের সত্তর আশি বছর আগের চিন্তা ভাবনার অনেক পরিবর্তন দরকার, সেটা অনুপম বেশ বুঝতে পারতো। আর এ বাড়ির ফর্সা বৌদিদের তো কাছ থেকে দেখছে, কী এমন উদ্ধার হয়েছে বাড়িতে সব ফর্সা বৌদের এনে ?

প্রভাবতী দেবী মেয়ে আর জামাইয়ের কাছে তার আদরের নাতির জন্য একটা কালো মেয়ের সাথে সম্বন্ধর কথা চলছে শুনেই বেশ ক্ষুব্ধ হলেন। মেয়েকে জামাইয়ের সামনেই বললেন, ‘তুই তো জানিস বিভা, আমাদের বাড়ির বৌরা কত ফর্সা সবাই। সেখনে এই একটা কালো মেয়েকে জেনে শুনে দাদু ভাইয়ের সাথে কেন বিয়ে দিতে যাচ্ছিস ? এরপর দেখবি মেয়েটা এই বাড়িতে এসে কেমন নিজেকেই ছোট মনে করে দুঃখ পাবে। তোর বৌদিরাও বা কী ভাববে ? ওরা ভাববে না যে শাশুড়ি মা নিজের মেয়ের ঘরের নাতির বেলায় কই সব তো মুখ বুজে মেনে নিলেন। আর অনুপম কোথায় ? ও কী বলছে এই ব্যাপারে ? ও কি মেয়েটাকে দেখেছে ? ও কি জানে যে মেয়েটার গায়ের রঙ কেমন ?’

অনুপম পাশের ঘরেই ছিল ওর ছোট বৌদির সাথে গল্প করছিল। কথাটা কানে যেতেই উঠে এসে দাঁড়ালো দরজার পাশে। পিছনে রিমকি বৌদি এসে দাঁড়িয়ে ফিস ফিস করে বলল,’ঠাকুরপো, এবার তোমাকে তোমার দিদা কিভাবে চেপে ধরবে দেখো। তার তো আবার দুধে আলতা রঙ না হলে চলে না। তুমি কিন্তু মনে মনে প্রস্তুত হও, এবারই তোমাকে বাঘের মুখে ছেড়ে দেওয়া হবে।’ বলে রিমকি হাসতে থাকে। অনুপম পাপিয়ার সাথে সম্বন্ধ আসবার পর যখন ওকে জিজ্ঞাসা করা হয় তখন ওর মা বাবাকে নেগেটিভ কিছু বলেনি। বলেছিল, ‘তোমরা যদি ভালো মনে কর আমার কোন আপত্তি নেই।’  

অঞ্জন সেন তার শিক্ষিত আজকালকার আধুনিক মনস্ক ছেলের কাছ থেকে এটাই আশা করেছিলেন। বাবা ছেলে এমনকি মেয়ে দিয়াও যখন পাপিয়াকে এই বাড়ির বৌ করে আনতে রাজি তখন বেচারি বিভাবতি আর কী করবেন ? সোজা পরের দিন সন্ধ্যায় সবাইকে এই বাড়িতে মার কাছে এনে ফেলেছেন। এখন মা যেটা বলবেন সেটা এরা খণ্ডায় কি করে দেখা যাক। দরজার কোণে দাঁড়ানো ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ ঐ তো তোমার নাতি। জিজ্ঞাসা কর ওকে। বলে কি তোমরা যা বলবে তাই হবে। আমি কী করি এখন বলতো মা ? ‘ বিভাবতি দেবীর গলায় হতাশার সুর।  

প্রভাবতী কটমট করে তাকালেন অনুপমের দিকে। অনুপম দরজার পাশে দাঁড়িয়ে দিদিমার দিকে বুড়ো আঙ্গুল তুলে দাখিয়ে ওঁকে ভ্যাঙ্গাতে থাকে। প্রভাবতী দেবী হেসে ফেললেন। বললেন,’ বদমাশ ছেলে। আয় এদিকে আয়। তোর কাণটা কেমন মলে দেই দেখিস। আমাকে ভ্যাঙ্গানো হচ্ছে না ? তুই তার মানে জেনেশুনে এই বিয়েতে মত দিচ্ছিস যাতে আমাকে জব্দ করা যায় তাই তো ?’ প্রভাবতী নাতির দিকে তাকিয়ে কথা গুলি বলেই সামনে বসা জামাইকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ তা মেয়েটা দেখতে কেমন অঞ্জন। তুমি দেখেছ ওকে ? এম এ করেছে তো শুনলাম। আর কিছু গুন টুন আছে মেয়েটার ?’

জবাব দিলেন মেয়ে বিভাবতি দেবী। স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ পাপিয়াকে আমি আর উনি দুজনেই দিয়ার সাথে আমাদের বাড়িতেই পড়াশুনা করতে দেখেছি। মেয়েটা খুব ভালো গান করে আর নাকি দারুণ সেলাইয়ের হাত। ক্রচেটের কাজ কি দারুণ করে গো মা ! দিয়াকে একটা টেবিল কভার করে দিয়েছে, দারুণ সুন্দর বুনেছে। আমারনা তোমার কথা মনে পড়ে গেছিল সেদিন। তুমিও তো আগে কত সুন্দর ক্রচেটের কাজ করতে, তাই নাগো, তুমিও তো দেখেছ।’  কথাটা বলে স্বামীর দিকে তাকান। অঞ্জন সেনের মেয়েটিকে বেশ ভালো লাগে। হেসে বলল, ‘ হ্যাঁ মা, হাতের কাজ তো দারুণ। বিভা ঠিকই বলেছে। আপনার হাতের কাজও তো আমি দেখেছি। মেয়েটার মুখটাও একদম যেন লক্ষ্মী প্রতিমা।’ 

প্রভাবতী পাত্রীর হাতের কাজ আর গানের কথা শুনেই অর্ধেক রাজি হিয়ে গেলেন। তবুও একবার নাতির সাথে বোঝা পড়া করবার জন্য ওকে ইশারায় কাছে ডেকে বললেন, ‘আয় দাদুভাই। এদিকে আয়। তোকে একটা কথা বলি।’  অনুপম হাসতে হাসতে এসে দিদিমাকে পেঁচিয়ে ধরে বলে, ‘ বল কী বলবে। তুমি ফর্সা বৌ চাও তাই তো দিম্মা ? আমি তো তোমাকে অনেকবার বলেছি আমার ওসব গায়ের রঙ নিয়ে কোন ছুঁৎমার্গ নেই। ওসব পুরানো দিনের চিন্তা ভাবনা। আর তুমি তো আমার মডার্ন দিম্মা। তুমি এখন অনেক বদলে গেছ না গো ?’

প্রভাবতী হেসে অনুপমের কাণ টেনে ধরে বললেন, ‘ওরে আমার শয়তান ছেলে। তারমানে তুই বলতে চাস আমি রাজি হয়ে গেছি তাই না ? ঠিক আছে যা তুই যখন রাজি তখন আমার আর কি ? তবে একটা কথা শোন, তোর বৌদিরা সবাই ভীষণ ফর্সা , সেখানে যদি ঐ মেয়েটা মন খারাপ করে তখন তোকেই কিন্তু ওর পাশে শক্ত খুটির মত দাঁড়াতে হবে। মেয়েরা স্বামী পাশে থাকলে সমস্ত আলোচনা সমালোচনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারে। আমিও তো মাত্র এইট ক্লাস পাস। আর তোর দাদু ছিল সেই দিনের আই এস সি পাশ। কিন্তু সবসময় আমাকে মনোবল জুগিয়ে এসেছেন।’  বলতে গিয়ে একহাতে আঁচল দিয়ে চোখের জল লুকোলেন আরেক হাতে অনুপমকে আশীর্বাদ করলেন। 

অনুপম আর পাপিয়ার বিয়েতে আর কোন বাঁধা এলো না। দিয়াদের ফাইনালের রেসাল্ট বের হবার পর অগ্রহায়ণের এক সন্ধ্যায় ধুম ধাম করে ওদের বিয়ে হয়ে গেল। অনুপম পাপিয়াকে বৌভাতের রাতে একটা হীরের আংটি উপহার দিল। পাপিয়া ভীষণ খুশী। এই বাড়িতে এসেই বন্ধু কাম ননদ দিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলেছে, ‘দাড়া, এবার আমি তোর জন্য একটা রাজপুত্র যোগাড় করে দেব। তুই শুধু দেখে যা আমি কী করি। আমার আত্মীয়দের মধ্যে অনেক ভাল ভাল পাত্র আছে তোর জন্য।’

প্রভাবতী দেবী পাপিয়ার মুখশ্রী দেখে অবাক হয়ে গেলেন। এতো সুন্দরী মেয়েটাকে উনি না করে দিতে যাচ্ছিলেন ! বুঝতে পারলেন, গায়ের রঙ্ই সব নয়। মানুষের শিক্ষা দিক্ষা, তার গুণ, তার রুচি, তার আচার ব্যবহার এগুলই হচ্ছে আসল কথা। যেই মেয়ের মধ্যে এসব আছে সেই মেয়ে লক্ষ্মীমন্ত হবে সেটা আর বলবার নয়। প্রভাবতীর নিজের তিন ছেলের ঘরের তিন নাত বৌকে তো উনি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন। সবকটা বৌ শুধু সাজ গোজ, সীনেমা দেখতে যাওয়া, মার্কেটিং করতে যাওয়া আর বেড়াতে যাওয়া ছাড়া আর কিছু জানে না। না জানে হাতের কাজ, না জানে ঘরের কাজ, না জানে গান , না জানে আঁকতে বা না জানে নাচতে। অথচ অন্য দুটো বৌয়ের তুলনা হয়না। এই মেয়েটিও মনে হচ্ছে অনুপমকে আর বিভাবতিকে বেশ সুখেই রাখবে।

সত্যিই তাই হল। কিছুদিনের মধ্যেই পাপিয়া এই বাড়ির সবার মন জয় করে নিল। এমনকি ওর ফর্সা বড় ননদরাও নতুন বৌয়ের কথা বার্তা আর ব্যবহারে বেশ খুশী। লাভের লাভ হল একটাই যে তাদের স্বামীরা এখন প্রায়ই ছোট বৌয়ের প্রশংসা করে নিজেদের বৌদের তার মত হবার জন্য চাপ দিতে শুরু করে দেয়। প্রভাবতী দেখেন একেক দিন একেক বৌ এসে রান্না ঘরে রাঁধুনিদের সাথে হাত লাগায়। বাড়ি ঘরের চেহারা পাল্টে দিল এই বাড়ির বৌরা। প্রভাবতী এই সবের জন্য মনে মনে পাপিয়াকে ধন্যবাদ জানান। অনুপম এলে পর তাকে কাছে টেনে বলেন, ‘রূপে ফর্সা হলেই হয়না রে দাদুভাই, আমি তোকে দেখে শিখলাম যে কালো মেয়েদের গুণের কাছে সবারই মনটা ফর্সা হয়ে যায়।’   

ফর্সা বনাম কালো ছোট গল্প – সমাপ্তি

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!