অতীত কথা ভৌতিক গল্প – পায়েল মণ্ডল
জমজমাটি এক শীতের সন্ধ্যায় এক কাপ গরম চা হাতে নিয়ে, আপাদমস্তক কম্বল জড়িয়ে আরামকেদারায় বসে কৌস্তুভ কাঁচের জানালাটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। ঘড়িতে তখন পাঁচটা বেজে তিরিশ। কুশের এই আমেজটা বেশ লাগে। তাই খুব তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিল সে এই আমেজটা।কুশ নামটা তার মামাবাড়ি থেকে দেওয়া। ছোটোবেলায় মা-বাবা পথ দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর কুশ চলে আসে তার মামাবাড়ি ভূজন্ডী গ্ৰামে। এখানে দাদু- দিদা আর মামার সাথেই তার ছোটোবেলা কাটে। কৌস্তুভ খুব একটা মিশুকে প্রকৃতির ছিল না, তাই দাদু দিদাই ছিল তার একমাত্র খেলার সঙ্গী।আর মামা ভূতনাথ মল্লিক কে কুশ একটু এড়িয়ে চলত, এড়িয়ে চলত বলা ভুল বরং ভয় পেত। মামার গম্ভীর দুটি নিষ্পলক অথচ গাঢ় নীল চোখের দিকে তাকালে কৌস্তভের যেন হাত পা অসাড় হয়ে আসত। বড়ো হওয়ার পর সেই ভয়টা কাটলেও মামার সাথে হেসে কথা বলার সাহসটুকু জোগাতে পারেনি।
কৌস্তুভ যখন বিদেশে ডাক্তারি পড়তে যায় তখন দিদা মারা গেছেন। মামাবাড়িতে তখন শুধু দাদু মামা আর এক বিশ্বস্ত চাকর ভোলা। মামা ভূতনাথ বাবু বিয়ে করেননি। তিনি তখন একটি মিউজিয়ামে সংগ্ৰাহকের কাজ করেন। আর সারাদিন পুরোনো বইপত্র, চিঠি আর অ্যান্টিক জিনিসপত্র খুঁজে বেড়াতেন। কখনো কখনো প্রায় নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন।তার এই স্বভাবের জন্য কুশের দাদু ভূতনাথ বাবুর ওপর থেকে ভরসা হারিয়ে ফেলেন।
কৌস্তুভ ফিরে এসেছে আজ দুই বছর। দাদু আর নেই,মামাও নিরুদ্দেশ। কৌস্তুভ ফিরে আসার পর মামার সাথে তার দেখা হয় দাদুর শেষকৃত্যে। তারপর আর না। বিদেশে ডাক্তারি পড়লেও দাদুর আদর্শানুসারী কৌস্তুভ গ্ৰামেই ফিরে এসেছে।গ্ৰামে সেরকম কোনো ডাক্তার নেই তাই কারো অসুখ বিসুখ করলে এখন একমাত্র ভরসা ডাক্তার সেন মানে কৌস্তুভ সেন।
পুরোনো স্মৃতিচারণ করতে করতে কৌস্তুভ লক্ষ্যই করেনি কখন ঘরে এক আবছা শীর্ণকায় ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ চোখ পড়তেই চমকে ওঠে কৌস্তুভ।
_ “ও কে ও ?”
_ “আমি ভোলা গো কুশ বাবা ।” ভোলার বয়স পঞ্চাশের অধিক না। সে এসেছিল কৌস্তুভ কে ডাকতে কারণ গ্ৰামের পশ্চিম প্রান্তে এক ব্যক্তিকে সাপে কেটেছে। কৌস্তুভ প্রথমে কিছুটা ইতস্তত করলেও পরে নিজের দায়িত্ববোধের কথা ভেবে গরম জামাকাপড় পরে আর ডাক্তারির জিনিসপত্র নিয়ে তৈরী হয়ে নিল। বেরোনোর সময় দাদু দিদার ফটোটার দিকে চোখ গেল। দুজনেই যেন মুচকি হেসে বললো – “আয় বাবা।”
রোগী দেখতে বেশ রাত হয়ে গেল প্রায় নটা বাজে।একে শীতের রাত তায় আবার গ্ৰাম।খালি জনবসতির কারণে অন্ধকার রাস্তায় কোনটা ফাঁকা মাঠ আর কোনটা বসতি বোঝা দায় হয়ে পড়েছে। এরকম দূরে রোগী দেখার ডাক আসলে অন্যদিন হলে কৌস্তুভ নিজের সাইকেল কিংবা ভোলাকে সঙ্গে নিয়ে বেরোত। কিন্তু আজ তাড়াহুড়োয় সব ভুলেছে। ভোলা অবশ্য আসতে চেয়েছিল কিন্তু কৌস্তুভ নিজেই বারন করেছে। আসলে এতটা যে দেরী হবে ফিরতে সে হয়তো নিজেও বুঝতে পারে নি। কৌস্তুভের হাতে একটা টর্চ লাইট, কিন্তু গ্ৰামে শীতের কুয়াশা ভেদ করার মত সাধ্য সেই টর্চ লাইটের আলোয় নেই।একটু ভীতু প্রকৃতির কৌস্তুভ তাই দ্রুত পা চালিয়ে যেতে চেষ্টা করল। কিন্তু কথাতেই আছে – “যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়।”
হঠাৎ করেই একটা দমকা হাওয়া দিল আর কৌস্তভের মনে হল কেউ যেন তার পিছু নিয়েছে। কৌস্তুভ মনকে প্রবোধ দিল সে যে সায়েন্সের ছাত্র। আর ভূত বলে কিছু নেই। ভূত মানে তো অতীত আর অতীত কি কখনও বর্তমানে আসতে পারে….। কিন্তু ভূতের না হোক চোর ডাকাতের ভয় তো আছে। তাই আরো জোরে হাঁটতে থাকে সে। কিন্তু আশ্চর্য কিছুতেই সে পেছনের লোকটির থেকে এক হাতের বেশি এগোতে পারে না।
কিছুক্ষণ পর কৌস্তুভ তার পিঠে একটা ঠান্ডা নিরেট হাত অনুভব করে। মুহূর্তে তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। কৌস্তুভ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ফুটে উঠেছে।ভয় আর উত্তেজনার মাঝে কৌস্তুভ শুনল একটা ভারী অথচ অতি পরিচিত একটি কন্ঠস্বর – “ডঃ কুশ নাকি ?” আরে এতো ভুতো মামার গলা। পেছন ফিরে দেখার পর ধোঁয়াশা কাটল। পূর্নিমার আলো আর শীতজমাটি অন্ধকারে মামাকে চিনতে পারে।
কুশের মামার প্রতি একটা ভয় থাকলেও এখন এই অন্ধকারে একজন চেনা সঙ্গী পেয়ে কুশ যেন সেকথা ভুলেই গেল। কথা বলতে বলতে তারা এগিয়ে চলল। মামার এই অকস্মাৎ আগমনের কথা আলাদা করে সে ভেবেও দেখেনি।কুশ বলল – “এবার কিছুদিন থেকে তবে ফিরবে তো মামা ?” ভূতনাথ বললেন – “না রে কুশ সময় নেই তোকে একবারটি দেখতে এলাম।” কুশ বললো আমি ছাড়লে তবে তো ফিরবে।” ভূতনাথ হেসে বললেন – “অতীত কে কি কখনো ধরে রাখা যায়, আমি তো’ভূতনাথ’মানে অতীতের নাথ।”
কুশ শুধু থতমত খেয়ে বলল – ” মামা আজ তোমাকে বড়ো প্রাচীন লাগছে,এত রহস্য করে তো তোমাকে কখনো বলতে শুনিনি।”
ভূতনাথ এবার অদ্ভুতভাবে হাসতে হাসতে বললেন – “হা হা হা হা প্রাচীন তো বটেই, কারণ সেখানেই তো আমি মানে ভূতনাথ! অতীতের নাথ…….”
কথাগুলো বলতে বলতে ভূতনাথ যেন কুয়াশায় মিশে চাঁদের আলো হয়ে খেলতে লাগল। কৌস্তুভ অপ্রতিভের মত দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অজ্ঞান হয়ে যায়।
জ্ঞান ফেরার পর কুশ দেখল ভোলা তার মাথার কাছে বসে আছে। ভোলা কুশকে জিজ্ঞেস করল – ” কুশ বাবা তুমি উত্তুরের শ্মশানে কি করতি গিছলে ?” কুশ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। ভোলা পাশের ঘর থেকে একটা চিঠি এনে কুশের হাতে দিল। সেখানে লেখা আছে, “ভূতনাথ মল্লিক একমাস আগে পরলোকগমন করেছেন। সংবাদ দিতে দেরি হওয়ায় জন্য দুঃখিত।” _ মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ।
কুশের হাত থেকে চিঠিটা খসে পড়ল,সে বিড়বিড় করল – ” মামা আর নেই….”
তারপর আবার বলে উঠলো – ” মামা আছে, ভূতনাথ আছে অতীতের নাথ হয়ে অতীত কথায়…….।”
অতীত কথা ভৌতিক গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
ব্রহ্ম দৈত্য
প্রত্যাবর্তন
অদৃশ্য প্রহরী