কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

উন্নাসিকের উৎপীড়ন

উন্নাসিকের উৎপীড়ন প্রেমের গল্প – সৌমেন দেবনাথ

রক্তের সম্পর্ক যাদের মধ্যে তাদের মধ্যেই দ্বন্দ্ব বেশি। আপন মানুষই পর মানুষের চেয়ে খারাপ চায় বেশি। অপরিচিত মানুষের উন্নতি যতটা সহ্য করা যায়, আপন আত্মীয়ের উন্নতি তত সহজে সহ্য করা যায় না। আপন মানুষের সুখ আপন মানুষেরই সহ্য হয় না। আপন মানুষ খাদে পড়লে আপন মানুষই আনন্দ পায় বেশি। পর মানুষের চলন-বলন পছন্দ হলেও আপন মানুষের চলন-বলন মোটেও সহ্য হয় না। সব অঞ্চলেই, সব গোত্রেই একই দৃশ্য, যত ভালো সম্পর্ক হয় পরের সাথে৷ আপন মানুষের সাথে লাগালাগি লেগেই আছে। পর হয়ে যায় আপন, আপন হয়ে যায় পর স্বার্থপরতায়।
মল্লিকার সাথে ফল্লুরার সম্পর্ক তেমনি, একজন বুনো ওল তো অন্যজন বাঘা তেঁতুল। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। মল্লিকা যে রাস্তা দিয়ে হাঁটে, সে রাস্তা দিয়ে ফল্লুরা হাঁটে না। ফল্লুরা যার সাথে কথা বলে মল্লিকা তার ছায়াও মাড়ায় না। মল্লিকা পুকুরের উত্তর ঘাটে গোসল করে বলে ফল্লুরা পুকুরের দক্ষিণ ঘাটে গোসল করে। কেউ কারোর মুখ দেখে না, কথা বলে না কেউ কারও সাথে। তবে সহ্যাতীত হয়ে গেলে গলা ফাঁটিয়ে ঝগড়া করে। অথচ তারা পরস্পরের পর না সম্পর্কে। এক পরিবার থেকে আর এক পরিবারে এসে উঠেছে। ঝগড়া লাগলে মল্লিকা বলে ফেলে, আমার এই বাড়ি বিয়ে না হলে এই পরিবারে তোর আসা হতো? ফল্লুরাও কেঁকিয়ে বলে, আমি কি তোর মতো কালো? বেটে? আমার স্বামী আমায় বিয়ে করেছে আমার রূপ দেখে। মল্লিকাও খেই হারিয়ে বলে ফেলে, তোর চেয়েও বেশ্যাদের চেহারা ভালো।
এভাবে একজন আর একজনের নিন্দা করে আর ঝগড়া করে। ঝগড়ার সময় বিবেক লয় যায়। মনের মধ্যে জমা ক্ষোভ সব উগরে দেয়। কারোরই গলার শব্দ কম না। পাড়া প্রতিবেশীরাও ঝগড়া শুনতে যায় না ভয়ে। আদিল বাড়ি এলেও মল্লিকা থামে না। আশিক বাড়ি এলেও ফল্লুরা থামে না। ঝগড়া চলে বায়ুবেগে স্রোতের সাথে। ঝগড়ার মধ্যে একজন পটকা ফোটায় তো অন্যজন ফাঁটায় পারমাণবিক বোমা। স্ফূলিঙ্গে পুড়তে থাকে দুই ভাই। ভাগ্যে যদি এমন হিংসুটে আর ঝগড়াটে বৌ জোটে ভাগ্যলিপি তখন ভূত হয়ে যায়।
তবে ফল্লুরা তুলনামূলক শান্ত প্রকৃতির। তার গলার স্বর আর বাতাসে ভাসছে না। কিন্তু মল্লিকার কথাস্বর তখনও বাতাসে উড্ডীন। এবার সে তার স্বামীর নিন্দা করে ঝগড়া করছে। রগচটা নারীর রগরগে চোখে তাকাতেও আদিলের ভয় করে। ভয় সম্মান হারানোর, ভয় সমাজে হেয় হওয়ার তা কী আর বাদ আছে!
ওদিন বিকালে আবারও তারা ঝগড়ালিপ্ত হলো। মানুষকে ক্রোধাগ্নি পেয়ে বসলে মানুষ তখন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। তখন কোনো কিছু গোপন রাখে না। মল্লিকা বলে ফেলে, আমার সাথে হিংসামি করিস? মোহনের সাথে তোর সম্পর্ক ছিলো আজ তা সবাইকে জানিয়ে দেবো। মেজাজ চড়ে গেলেও একথা শুনে ফল্লুরা থেমে গেলো, কিন্তু দমে গেলো না। সেও বললো, রাজনের সাথে তুই যে ঘর ছেড়েছিলি! তোর আব্বা যে তোকে তিনদিন পরে ঘরে ফিরিয়ে এনেছিলো আজ তা সবাইকে বলে দেবো! এই কথা প্রকাশ হওয়ার পরে দুইজনেই ঝগড়া রেখে ঘরে লুকালো। মল্লিকার সাথে যেসব প্রতিবেশীর সম্পর্ক ভালো তারা তার কাছে গিয়ে ফল্লুরার প্রেমের কাহিনি শোনে।৷ মল্লিকাও সব অকপটে বলে দেয়, ঘর ভাঙে ভাঙুক বোনের, বোন আর তো আপন না। ফল্লুরার সাথে যেসব প্রতিবেশীর সম্পর্ক ভালো তারা এসে মল্লিকার ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার গল্প শোনে আর ছি ছি করতে থাকে। এরপর থেকে দুই বোনের কথা গ্রামবাসীর মুখে মুখে রটে গেলো। মল্লিকা প্রচণ্ড চাপে পড়ে যায়। বাপের বাড়ি তাকে ফিরে যেতে হয়। মুরুব্বিদের মধ্যস্থতায় ঘর ফিরে পেলেও ঘরে আর মুখ উঁচু করে কথা বলতে পারে না। নিজেদের ক্ষতি নিজেরা না করা পর্যন্ত শান্ত হয়নি। ঝগড়াপনা কমলেও শত্রুপনা কমেনি। কোমর থাকলেই ঝাঁকাতে নেই, মুখ থাকলেই বাজাতে নেই। কথা বলার ছড়ি দুই বোনের হাত থেকে দুই ভাইয়ের হাতে চলে গেলো।
ছোটোবেলাতে মিশতে দিতো না, আর বড়ো হওয়ার পর কেউ কারও সাথে মেশে না। আবির মিশতে চাইলেও আমির মেশে না। আমির চলে ফিটফাট, ডাঁটে; কিন্তু আবির খুব সাধারণ জীবন যাপন করে। আমিরের পছন্দ উচ্চমার্গীয়, আবিরের পছন্দ সাধারণত্ব। খেটে খাওয়ার কৃষকের ছেলে আবিরের বন্ধু। আমির বলে, চেয়ারম্যানের ছেলে আমার বন্ধু, থানার বড়ো বাবুর ছেলে আমার বন্ধু; তোর বন্ধুরুচিও বড্ড খারাপ। আবির শান্তগলায় বলে, উড়ে বেশি উপরে উঠলে পড়ার পর বেশিই ব্যথা লাগে। জীবনে বন্ধু বাছাই ভুল হলে জীবন নষ্ট হয়ে যায়। আমার পছন্দ আমার থাক, তোর পছন্দে তুই চল্। আমির ক্ষুব্ধ হয়ে বললো, তোর যা রুচি, উপরে উঠতে হবে না! জীবনকে উপভোগ করতে হলে বন্ধুর মতো বন্ধু খুঁজতে হয়। আমির চলে গেলো। মন খারাপ করে বসে থাকলো আবির।
পরের দিন এক কালারের শার্ট পরে বের হয়েছে আবির। খুব পছন্দের শার্ট তার। আমির দেখেই বললো, গেঁয়ো ভূতেদের মতো পছন্দ তোর। বয়স্কদের মতো এক রঙের শার্ট পরেছিস। আমার মতো চেক শার্ট পরবি, স্মার্ট লাগবে। আবির আক্ষেপ করে বললো, আমার পছন্দের সাথে তোর পছন্দ কখনো মিলবে না। তুই হচ্ছিস শুল্কাপক্ষের চাঁদ, আমি হলাম কৃষ্ণপক্ষের কাক।
খুশি হয়ে চলে গেলো আমির। মন খারাপ করে আজও আবির বসে থাকলো। বাড়ি ফিরে শার্ট খুলে রেখে দিলো। ঐ শার্ট আর সে পরেনি। কারও ভালো-খারাপ মন্তব্য নিজ পছন্দে প্রচণ্ড প্রভাব ফেলে।
ফল্লুরা ছেলেকে চোখে চোখে রেখে মানুষ করছে। নারী মা হলে মহীয়সী হয়ে যায়। ছেলেকে সুবেশ সুন্দর মানসিকতার পাশাপাশি সুন্দরের আচরণের অধিকারী হতেও দীক্ষা দেয়। পরিপাটি বেশধারী শরীরের বাহ্যিক অংশে হলেই হয় না, মন-মননেও হতে হয়। বসন্তের বিকশিত পুষ্পবনে দিগভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই এই লগনে চোখে চোখে রাখতে হয়। আবির মায়ের কথার অবাধ্য হয়ও না। মা বলে, কখনো শত্রু সৃষ্টি করবে না। প্রয়োজনে হেরে চলে আসবে। সবার সাথে মিলেমিশে চলবে। সামান্য ভুলে সমস্ত নষ্ট হয়। একবার মান গেলে গোটা জীবনেও তা উদ্ধার করা যায় না। মায়ের কথা আবিরের কাছে বাণী মনে হয়। মা আবার বলে, তর্ক করবে না কারও সাথে। তর্ক সুন্দর সম্পর্ক নষ্ট করে। মায়ের কথা কান খাড়া করে শোনে আবির। মা আবার বলে, তোমার বাবা পরিশ্রম করে, তোমাকেও পরিশ্রমী হতে হবে৷ জীবনে সফল হতে হলে কঠোর অধ্যবসায়, সাধনা আর ঝুঁকি নিতে হবে। উর্বর ক্ষেতে যেমন ফসল ফলে, উর্বর মস্তিষ্কেও তেমনি উন্নতি হয়। মস্তিষ্কের উর্বরতার জন্য অলস হলে হয় না, শিঙে শান দেওয়ার জন্য কলাগাছ খুঁজলে হয় না।
দূরে বসে মা-ছেলের কথা শুনছিলো আশিক। সে ফল্লুরার দায়িত্বসুলভ আচরণে খুব খুশি হলো।
সকালে হাঁটতে বের হয় আবির। আমির দেখে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বলে, দেখবো আমার চেয়ে কত বছর বেশি বাঁচিস! আবির বলে, সকালের আলোয় বুদ্ধি নির্মল হয়। বেঁচে থাকা আর সুস্থ থাকা এক কথা না। সুস্থ থাকতে হলে ভোরের আলোয় হাঁটতে হয়। আমির বলে, শরীর নেই তার আবার শরীরচর্চা! হাসিও লাগে, কান্নাও পায়।
আমির চলে গেলো। মন খারাপ করে বসে থাকলো আবির কিছুক্ষণ। আবিরের প্রতি কাজে আমির অনাকাঙ্ক্ষিত কথা বলে মন ভেঙে দেয়। আবিবের কোনো কাজই আমির পছন্দ করে না। হাঁটা বন্ধ করে সে বাড়ি চলে এলো।
টিউবওয়েলের পানি বালতিতে ভরে মগ দিয়ে পানি তুলে গোসল করে আবির। তা দেখতে পেয়ে উন্নাসিকের মতো নাক সিটকে আমির বললো, মগে তোলা পানিতে গোসল করে কি স্বাদ মেটে? পুরুষ মানুষ পুকুরের পানিতে দাপিয়ে গোসল করবে। সবাই-ই পুকুরে গোসল করে, দারুণ দারুণ মেয়েরাও আসে! আবির রাগ করে বলে, তোর উচ্ছ্বসিত আলাপ থেকে তোর মনের দীনতা প্রকাশ পায়। তোর মনের বৃন্তে সুকুমার বৃত্তির অংকুরিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ক্ষুব্ধ হয়ে আমির বললো, পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে স্নান করা গ্রামের ছেলেদের বৈশিষ্ট্য। লোকলজ্জার ভয়ে বালতিতে মগ ডুবিয়ে গোসল করা আমার কাজ না।
আমির চলে গেলে আবির নিষ্প্রাণ হয়ে বসে থাকলো। বাড়িতে গোসল করতে গেলেও আমির খারাপ খোঁজে, করবেটা কী সে!
ওদিন বিকালে গঞ্জের বাজার থেকে একটা গেঞ্জি কিনে এনেছে আবির। আমির দেখেই নাক সিটকে বললো, হাটখোলা বাজার থেকে কেউ গেঞ্জি কেনে? গেঞ্জি কিনতে হয় শহর থেকে। রুচির লেবেলটা আর উঁচুতে উঠলো না তোর। এসব গেঞ্জি রিক্সাওয়ালারা পরে। আবির আমিরকে খুশি করার জন্য বললো, তোর চোখের জ্যোতি ভালো। তাই চোখের জ্যোতিতে বৈচিত্র্য ধরা দেয়। তোর মতো রুচিশীল হলে তো রুচিকর জিনিসই চোখে পড়তো।
খুশি হয়ে চলে গেলো আমির। গেঞ্জিটা উল্টেপাল্টে দেখে ছুঁড়ে ফেলে দিলো আবির। মন ভেঙে গেলে সুন্দর জিনিসও অসুন্দর হয়ে যায়।
জেদ করে আবির শহরে গেলো। স্বনামধন্য দোকান থেকে একটি শার্ট কিনলো, আর মনে মনে বললো, দেখি আজ কী বলে! আবির বাড়ি এলে আমির শার্টটা নেড়েচেড়ে দেখে বললো, ‘আধুনিক ফ্যাশান হাউজ’ থেকে কিনেছিস? বাজারের সবচেয়ে বাজে দোকান। আমি গতকাল এই শার্টটাই ঘেটেঘুটে দেখে এসেছি। আমার একটুও পছন্দ হয়নি, আমার সাথে থাকা দুই বন্ধুও শার্টটি পছন্দ করেনি। এমন শার্ট পরে বাইরে বের হলে মানুষ ভালো বলবে? এসব কিনি আমরা ঘর মোছার জন্য। আবির শুনে বিব্রত হয়ে বললো, যে শার্ট পরলে আমি আরাম পাবো, আমার ভালো লাগা কাজ করবে আমি তো সেটিই কিনবো। আমার সামর্থ্য ভেবে আমি ক্রয় করি৷ কে কী ভাববে তা ভাবতে গেলে তো কিছুই কেনা যাবে না, পরা যাবে না। আমির বললো, নিজের ভালো লাগার জন্য যত দাম দিয়েই শার্ট কিনিস মানুষ ভালো না বললে তা কেনা বৃথা। তোর নিম্ন রুচির কারণে তোকে ভাই পরিচয়ও দিই না।
আমির চলে গেলো। আবির তার শখের শার্টটা এপিঠ-ওপিঠ উল্টে দেখে দূরে সরিয়ে রাখলো। বিষণ্ন মনে বসে থাকলো কিছুক্ষণ।
পরের দিন বড়ো একটা কাতলা মাছ কিনে আনলো আবির। ছোটো মা মাছ কুটছে দেখে আমির বললো, আমিও সকালে বাজারে গিয়েছিলাম। বিজয় কাকুর দোকানে বড়ো বড়ো এই কাতলা মাছ উঠেছে। চাষের মাছ বলে আমি কিনিনি। শুনে আবির বললো, চাষের মাছ বলে মাছ খাবো না? জীবন্ত মাছ, খেতে অবশ্যই ভালো লাগবে। আমির বললো, কোনটা স্বাদের মাছ চিনতে পারলে আমার সাথে তর্কে লিপ্ত হতিস না।
এভাবেই আবিরের পছন্দ করা জিনিসকে আমির হেয়, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। আবির গঞ্জের বাজারের স্যালুনে যায় বলে আমির শহরের স্যালনে যায়। আবির যে ব্র্যান্ডের ঘড়ি পরে আমির সেই ব্র্যান্ডের ঘড়ি পরে না। আবির যে কলেজে ভর্তি হয়েছে আমির সেই কলেজে ভর্তি হয়নি। পৃথিবীতে এত মানুষ শুধু ছোটো ভাইটাকে আমির প্রতিপক্ষ ভাবে। আবিরের ভালো আমির সহ্যই করতে পারে না।
আমিরের বাহাদুরি দেখানোর স্বাধ অসীম। বিনয়ী আবিরকে গাধা বানানোতে আনন্দ পায়। আবিরকে ভাবে অচল, ভাবে সময়ের অযোগ্য। বার্মিজ জুতা পরে আবির, আমির দেখেই বলে, চামড়ার জুতা পরবি, ওসব জুতা পরলে পায়ের ক্ষতি, চোখের ক্ষতি।
আমিরের পছন্দ এভাবে আবিরের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। আবিরের পছন্দকে হেয় করে আত্মতুষ্টি পায়। নিজেকে আমির সবজান্তা দাবি করে, আধুনিক দাবি করে, অহংকারও করে।
আমির যে আবিরকে এভাবে অবদমন করে রাখে তা বাড়ির সবাই জেনে গেলো। আদিল ছেলেকে বললো, ছোটো ভাইকে হেয় করতে নেই। তোমার বিপদে সেই আগে সাহায্যের হাত বাড়াবে। বিপদে পড়লে নিজের মানুষ ছাড়া আর কেউ আসে না। পরিবারের বাইরে কাউকে প্রিয়জন বানালে ঠকতে হয়। জীবনে ভাঁটার সময় কাউকে কাছে পাওয়া যায় না। আপন মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্বকে আমন্ত্রণ করতে নেই। আমির বলে, আব্বা, ওর পছন্দ বলতে কিছু নেই, রুচি নেই, বোধ কম, আমার বন্ধুদের সে বখাটে বলে, আমার ফেলে দেওয়া পোশাকের চেয়েও খারাপ তার পরিধেয়। আদিল বললো, বাবা, তুমি তোমার মতামতকে বেশি প্রাধান্য দাও, এজন্য এমন মনে হয়। ভাইয়ের সাথে লাগতে হয় না। তোমার কাকুর সাথে আমাদের দ্বন্দ্বের কারণে আমরাই পর হয়ে গিয়েছি। এই কারণে পর মানুষ সুযোগ পেয়ে ক্ষতিই করে। রক্তের সাথে দ্বন্দ্ব করতে হয় না, রক্তের বাঁধনে কেউ ঠকে না। জানোয়ারের উপর মমতা দেখানো আধুনিক কালচারের লক্ষণ। অথচ ভাইয়ের সাথে শত্রুতা। হায়েনারা দলবদ্ধ থাকে বলে হারে না, আমরা দ্বন্দ্বলিপ্ত বলে হেরে যাই, বিপর্যস্ত হই। বাবার কথাগুলো এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিয়ে আড্ডা দিতে চলে গেলো আমির।
ছেলের উড়নচণ্ডী চলাফেরা বাবা হয়ে আদিল সহ্য করতে পারে না। তাকে বিয়ে দেবে বলে মেয়ে দেখতে গেলো। মেয়েপক্ষের একজন আমিরকে দেখেই বললো, ছেলে তো বখাটে। আমার বোনকেই সে পথে বিরক্ত করেছে। আর একজন বললো, এই ছেলে তো কিশোর গ্যাং দলের সদস্য। আমার মোবাইলটা ছিনতাই করেছে।
মান-মর্যাদা জলাঞ্জলি দিয়ে আদিল মেয়ে বাড়ি থেকে ফিরে এলো। তার সুসন্তান মানুষের কাছে যে কুসন্তান সে এতদিনে বুঝলো। কষ্টে তার চোখে পানি চলে এলো। সন্তান মানুষ না হলে তা যে কী কষ্টের তা সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। মনে মনে নিজ স্ত্রীর প্রতি ক্ষুব্ধ হলো আর ভাবলো, মা ভালো না হলে কি সন্তান ভালো হয়? কলা গাছে কলা ছাড়া কি আপেল হবে? বৌকে বকে বললো, ছেলে কোথায় কী করে খোঁজ রাখো? মল্লিকা বললো, ছেলেকে কি ঘরে বন্দি করে রাখবো? ছেলেদের স্বভাবই উড়ে বেড়ানো। উড়বে উড়ুক, ঘুরবে ঘুরুক। আদিল বললো, ছেলে যে গোল্লায় গিয়েছে সমাজ জানে, জানো না তুমি। মেয়েপক্ষ তোমার ছেলেকে বখাটে উপাধি দিয়েছেন। মল্লিকা বললো, একটি মানুষ যখন একটি মানুষকে দেখে তখন ভালোটুকু না দেখে দোষটুকু দেখে। কোনো মানুষই সম্পূর্ণ সঠিক না। আমি গেলে মেয়েপক্ষকে সমুচিত জবাব দিয়ে আসতাম। আদিল আর কথা বাড়ালো না। যে ভালো-মন্দই বোঝে না, তার সাথে কথা বলতে থাকলে মস্তিষ্কে রক্ত উঠে যাবে।
পরের দিন মাথা নিচু করে হেঁটে যাচ্ছে আবির। দেখে আমির বললো, কিসের পুরুষ তুই, বুক উঁচিয়ে হাঁটবি। প্রতিউত্তর না করে আবির চলে গেলো। ডাল কিনে ফেরার পথে আমির আবার ধরলো, বললো, যেদিন মা ডাল রান্না করে সেদিন আমি বাড়ি ভাত-ই খাই না। আবির ঠোঁটের কোণে একটু হাসি জাগিয়ে বললো, যারা রোজগার করে না তারা মাছ-মাংস খাই খাই করে, রোজগার করতে শেখ্ সব খেতে ভালো লাগবে।
একেকদিন একেকজনের কাছ থেকে নালিশ আসে আমিরকে নিয়ে। আদিল ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, ছেলের জন্য মান-সম্মান গেলো। মল্লিকা বলে, ছোটোবেলাতে ছেলে সন্তান একটু দুষ্টুমি করেই। ফল্লুরার ছেলের মতো আমার ছেলে নির্বোধ নাকি! সবার ভালো একটা ছোটোবেলা থাকতে হয়, বড়ো হলে গল্প করতে পারবে, গর্ব করতে পারবে। আদিল আরও রেগে গেলো, বললো, তোমারও তো খুব সুন্দর ছোটোবেলা আছে। রাজনের স্মৃতিচারণ করো, শুনি। রাজনের কথা শুনতেই ফল্লুরা চুপ হয়ে গেলো। এমন কোনো কাজ করতে নেই যা জীবনে কালিমা হয়ে থেকে যায়।
বখে যাওয়া ছেলেকে বাঁচাতে হলে কঠিন সিদ্ধান্তটাই নেওয়া দরকার। আদিল ছেলেকে শহরে পাঠিয়ে দিলো তার মামার কাছে। তার মামা কাজে যায়, কিন্তু আমিরকে কাজে নিয়ে যেতে পারে না। যে বেঁকে বিপথে গিয়েছে, সে কি সহজে পথে ফেরে?
এদিকে আবিরের জন্য মেয়েপক্ষ থেকে জোরালো প্রস্তাব এলো। আবির লেখাপড়া শেষ না করে বিয়ে করবে না, কিন্তু সে অনড় অবস্থায় বেশি দিন থাকতে পারলো না। আবিরের বিয়েতে গ্রামবাসী পেট পুরে খেলো, দাওয়াত পেলেও বিয়েতে আসেনি আদিল-মল্লিকা-আমির।
মামাকে ফাঁকি দিয়ে আমির বাড়ি চলে এলো। বাড়ি এসে সবার আগে ছোটো ভাইয়ের বৌকে দেখতে গেলো। ছোটো ভাইয়ের বৌকে দেখেই সে চমকে গেলো। প্রবল হিংসা যার মনে অন্যের ভালো দেখলেই কষ্ট পায়। আবিরকে বাইরে ডেকে বললো, গতবার এই মেয়েকেই দেখতে গিয়ে আমি অপছন্দ করে চলে এসেছিলাম। সত্যই তোর রুচি আর উঁচু স্তরে পৌঁছালো না। আমিরের কথা শুনে আবির হাসে। আমিরের অপছন্দ প্রকাশ করার কারণে আবির সব সময় মন খারাপ করলেও আজ মন খারাপ করলো না। সে জানে সে কী পেয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ, বাংলাদেশ থেকে

উন্নাসিকের উৎপীড়ন প্রেমের গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!