লাল রঙের খাম ভৌতিক গল্প – তুষার ভট্টাচাৰ্য
রাত্রিবেলা ডাইনিং টেবিলে একটা লাল রঙের খাম দেখতে পেলেন সম্প্রীতিপুর হাই -স্কুলের প্রধান শিক্ষক তনুশ্যাম শর্মা l চিঠিটায় সাদামাটা ভাষায় কাঁপা কাঁপা অক্ষরে লেখা রয়েছে -‘ মাননীয় হেড মাস্টার মশাই -আপনার ইস্কুলের পশ্চিম দিকের পলাশ, অশোক, কৃষ্ণচূড়া, বকুল, নারকেল গাছগুলি দয়া করে কাটবেন না l ওইখানে আমরা কতদিন ধরে বাস করি l ইতি, পেন্নাম সহকারে -হিজিবিজি ভুতু কেলাবের সদস্যব্রেন্দ l’ কোনও ছাত্র হয়তো দুস্টুমি করে চিঠিটা লিখেছে এই ভেবে তনুশ্যামবাবু ঘুমিয়ে পড়লেন l
ইস্কুলের এই বহুদিনের পুরোনো গাছগুলি কাটার একদমই ইচ্ছে নেই তনুশ্যাম বাবু’র l ওই বড় বড় গাছগুলিতে অনেক পাখির বাসা রয়েছে l বসন্তকালে ফুলে ফুলে গাছগুলি ঢেকে গেলে কোকিল পাখি, টিয়া পাখিরা দিনভর মিষ্টি সুরে ডাকে l আরও নাম না জানা কত পাখি উড়ে এসে বসে lপাখিদের কিচিরমিচির কলরবে ভরে যায় ইস্কুল প্রাঙ্গন l কিন্তু গাছগুলি না কেটে কোনও উপায় নেই l ইস্কুলের একাদশ -দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীদের জন্য আলাদা ক্লাসরুম খুব দরকার l তাই পশ্চিমদিকের গাছগুলি কেটে ফেলতেই হবে l
পরেরদিন ইস্কুলে গিয়ে তনুশ্যাম বাবু, লাল খামে লেখা চিঠির কথা সহকর্মী শিক্ষকদের বললেন l সংস্কৃত স্যার রাখহরি বাবু নাকে এক টিপ নস্যি দিয়ে বললেন – মশাই প্রেতাত্মার চিঠি l খুব সাবধানে থাকবেন l তার কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল l যদিও তনুশ্যাম বাবু ভূত প্রেতে একদম বিশ্বাস করেন না l বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন l ভূত প্রেত সব বুজরুকি মনে হয় তার কাছে l তবে এই ইস্কুলে যোগ দেবার আগে তিনি শুনেছিলেন – ইস্কুলে এবং স্টাফকোয়ার্টারে নাকি ভূতের বাসা আছে l অনেকের মুখে এই সব কথা শুনে তনুশ্যামবাবু হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন l দীর্ঘ দু’বছর হয়ে গেল তিনি একা একাই স্টাফ কোয়ার্টারে থাকেন l কোনও ভূততুট এখন পর্যন্ত দেখা দেয় নি l
ইস্কুল ছুটির পরে সন্ধ্যেবেলা তনুশ্যাম বাবু কোয়ার্টারে ফিরে এলেন l লোডশেডিং l তাই কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে পায়চারী করে, রাতের খাবার খেয়ে একটু আগেই শুয়ে পড়লেন l ভ্যাপসা গরম l ঘুম আসছিল না তার l হঠাৎ খোলা জানালায় অচেনা কয়েকজনের গলার আওয়াজ পেয়ে তিনি চমকে উঠলেন l ‘ছার আমাদের বিষয়টা একটু ভাববেন l’ এই সব কথা শুনে তিনি ধড়মরিয়ে বিছানা থেকে উঠে বসলেন l টর্চটা হাতড়িয়ে খুঁজলেন l কিন্তু পেলেন না l অন্ধকারে বিছানায় বসেই বললেন – কে তোমরা? ‘ছার – আমরা তো এই ইস্কুলেরই প্রাক্তন ছাত্তর ছেলাম l আজ্ঞে -আমার নাম ছেল রতন l সেবার খুব বন্যা হয়েছেল, এই ইস্কুলেই সবাই আশ্রয় নেছিলাম l তো জলে ডুবে মরে গেলামl তারপর থেকে মোরা এখানেই আছি l হি….. হি l ছার -আমার নাম কাঞ্চন l এই ইস্কুলের বাথরুমে সাপে কামড়েছেল l মরার পর এখানেই আছি l হি.. হি….. ছার – আমার নাম ছেল ফটিক l ইস্কুলের মাঠে ফুটবল খেলার সময় বাজ পড়ে মারা যাই l ছার আমরা ইস্কুলের এই বাড়ি, আর গাছগুলিতেই থাকি l রাত্তিরে ঘোরাফেরা করি খেলাধুলা করি, কারুর কোনও ক্ষতি করি না l তা গাছগুলি কেটে ফেললে আমরা যাবোনি কোথায়? আর ইস্কুলের পাঁচিলেই তো লেখা আছে – একটি গাছ একটি প্রাণ, গাছ কাটা সামাজিক অপরাধ l ন্যাকা সুরে কাঁপা কাঁপা গলায় এই সব বলে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ওরা l তনুশ্যাম বাবু ওঁদের কথা শুনে খানিকটা ধন্দে পড়ে গেলেন l তিনি ভূত প্রেতে একদম বিশ্বাস করেন না l কিন্তু নিজের কানে ওঁদের সব কথা শুনেছেন l এইসব সাতপাঁচ ভেবে রাত্তিরে আর ঘুম এল না তার l কিন্তু গাছগুলি না কেটেও কোনও উপায় নেই l পরের দিন ইস্কুলে গিয়ে ঘরে বসতে না বসতেই একজন ভদ্রলোক এসে বললেন – নমস্কার স্যারl আসতে পারি l হ্যাঁ, আসুন l আমার নাম -প্রভাত দাশ l কলকাতায় থাকি l আপনাদের ইস্কুলের দক্ষিণ দিকের বাড়িটা আমাদের l ফাঁকা পড়েই আছে l আমি আপনাদের ইস্কুলকে দশ কাঠা জমি সহ বাড়িটা দান করে দিতে চাই l তবে আমার অকাল প্রয়াত একমাত্র ছেলে ফটিক দাশের স্মৃতির উদ্দেশ্যে যদি একটি শ্রেণী কক্ষ তৈরি করেন তাহলে ছেলের আত্মা শান্তি পাবে l আমি সমস্ত খরচ দেব l ও আপনাদের স্কুলেরই ছাত্র ছিল l ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছে l বুঝলেন ফুটবল পাগল ছিল ছেলেটা l তো এক বৃষ্টির বিকেলে এই ইস্কুলের মাঠে ফুটবল খেলার সময়ে বাজ পড়ে মারা যায় lএইসব বলে প্রভাত বাবু রুমাল দিয়ে দু’চোখ মুছে বিদায় নিলেন l ইস্কুল থেকে ফিরে হেডমাস্টার তনুশ্যাম শর্মা মনে মনে ভাবলেন – ইস্কুলে পড়তে পড়তেই যে সব ছাত্র অকালে মারা গিয়েছে তাঁদের সবার নামে একটি করে শ্রেণী কক্ষের নামকরণ করবেন l এই সব ভেবে রাত্তিরে ঘুমিয়ে পড়লেন l মধ্য রাত্তিরে আবার খোলা জানালায় ঠক ঠক খট মট আওয়াজ পেলেন l ‘ছার -পেন্নাম l গাছগুলি কাটছেন না তো’ l আধো ঘুমের ঘোরেই তনুশ্যাম বাবু বললেন – না – না গাছ কাটবো না l তোমরা নিশ্চিন্তে থাকো l হে হে হি হি আওয়াজ করে চলে যাবার আওয়াজ শুনতে পেলেন তিনি l ভোরবেলা চা খেতে খেতে তনুশ্যাম বাবু ভাবতে লাগলেন – গতকাল কী স্বপ্ন দেখছিলেন! আশ্চর্য, নিজের কানে স্পষ্ট শুনেছেন ওঁদের সব কথা l তাহলে? ইস্কুলে যেতে যেতে ভূত নিয়ে হাবিজাবি ভাবতে লাগলেন l এই সব ঘটনার কথা যদিও কেউ বিশ্বাসই করবে না l আর বলাও যাবে না কাউকে l
লাল রঙের খাম ভৌতিক গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
রাজবাড়ী রহস্য
ব্রহ্ম দৈত্য
প্রত্যাবর্তন